সুমী সিকানদারের গল্প : সময় অসময়

লোহার গেইটা খুলতে গেলেই বিকট চিৎকারে ঘটাং শব্দ হয়। তারপরেও নমু কিভাবে যেন টেকনিক করে খুব সন্তর্পণে গেইটটা খোলে। একবার খুলে ফেলতে পারলে ফের লাগানোর ঝামেলায় যায় না। মুহূর্তে দে দৌড় খেলার মাঠগুলো পেরিয়ে পাশের রোডের একতলা বাড়িটার কাছে।
মানে একতলা ছিল। এখন হঠাৎ তাকালে বুকের ভেতর ধক করে ওঠে। বাড়ি শুদ্ধমানুষগুলোও উধাও।


দিনভর মিস্ত্রিরা থান ইটগুলোকে টুকরো টুকরো করে করে পাঁচগুটি বানিয়ে ফেলছে। কাজের কারণে গুচ্ছের বালু ঢিবি করে রাখা। অন্য বন্ধুরা আসার আগেই নমু বালুর মধ্যে পা ডাবিয়ে ডাবিয়ে উপরে ওঠে এবং উপর থেকে ধপ করে লাফিয়ে ফের বালুতেই পড়ে। এইভাবে বার দশেক চলতে থাকে, আস্তে আস্তে দেখা গেল হেনা চলে এসেছে নাইলনের লাফদড়ি সাথে নিয়ে। মিতু, কেয়া, সিলভিও চলে এসেছে নাচতে নাচতে। এখন শুরু হবে দড়িলাফ।

লাফানোর সময় প্রাণপণে অনেক উঁচুতে লম্বা হয়ে নমু খেলতে থাকে। প্রতিবার তার মনে হয় আকাশ বুঝি ছুঁয়ে দিতে তার দেরি নেই। এই বুঝি দোনোমোনো মেঘকে খামচে দেয়া যাবে। সারা বিকেল তাদের এই খেলা।

কিন্তু আজ নমুর কেন যেন অতো উঁচুতে উঠতে ইচ্ছে করছে না। খানিকটা দান ছেড়ে দিয়ে বালুর ঢিবিতে গিয়ে কতক্ষণবসে থাকল। কিন্তু তাতেও ভাল লাগছে না। শেষে কাউকে কিছু না বলেই বাসার পথে হাঁটা ধরল। হাঁটতে হাঁটতে পায়ের গোড়ালিতে গড়িয়ে কী রকম যেন ভেজ ভেজা। নমু এবার হাঁটা বাড়িয়ে দিয়েছে, দ্রুত হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে ফের পড়ে যাচ্ছিল। এমনিতেই সে বেজায় শুকনা সামান্য বাতাসেইহেলেদোলে। বাড়ির সামনে এসে দেখে গেইট সেভাবেই খোলা। কার্নিশে শেফালিদের বাড়ির পোষা বাঁদরটা পা দোলাচ্ছে, হাতে বিস্কুট। এক ছুটে পড়িমরি করে ঘরে ঢুকে গেল সে। এরপর পরপর তিন দিন আর বালুর ঢিবিতে নমুকে দেখতে পেলো না কেয়ারা।

বাসায় ঢুকেই সোজা বাথরুমে ঢুকেছে। ভয়ে আধমরা নমু। পায়ের গোড়ালিতে টপ টপ করে পানিপানি রক্ত পড়ছে। এখন কি করতে হয়? ভয়ে শাওয়ার ছেড়ে তাতে দাঁড়িয়ে গেল। কাপড় চোপড় না নিয়েই ঢুকে গেছে কাজেই গা ধুয়ে দরজাটা একটু ফাঁক করে বুয়াখালাকে ডাকতে লাগল। ‘বুয়াখালা বুয়াখালা। আমার শুকনো কাপড় দেবে,আমি পুরো ভেজা।‘

রান্না ঘর থেকে মাছ কাটার বটি মেঝেতে নামিয়ে রেখে গজগজ করতে করতে একটা ফ্রক আর পাজামা এনে দিলো বুয়াখালা।কাপড় পালটে শান্ত হয়ে বসে পুরো ঘটনা মনে করার চেষ্টা করল নমু।

কি হয়েছিল আজ? টাইম মতোই তো খেলতে গেছিল। বন্ধুদের রেখে চলে আসতে হলো। পায়ের গোড়ালির কাছে এরকম পাতলা পাতলা রক্ত কেন পড়ছিল? দুপুরবেলা এক গাদা চালতার আচার খাওয়াতেই এরকম হয়েছে আসলে। মা শুনলেই ঝাড় দেবে। কাকে জিজ্ঞেস করে! মা তো বাসায় নেই। নমু বুঝল সন্ধ্যা পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতে হবে মা ফিরুক।

কলিং বেল বাজতেই দৌড়ে দরজা খুলেছে নমু, নাহ মা আসেনি। এসেছে রুপু'দা, সাথে দোলন ভাই। এনারা পাড়ার ছেলে। নানান সাংগঠনিক কাজে মায়ের কাছে আসে। কিন্তু মা তো বাড়িতে নেই। নমু তাদের বসতে দিতে চাইল না। এগুলো বুদ্ধি তার নতুন হয়েছে। সে বলল মা তো বাসায় নেই সন্ধ্যায় ফিরবে। দাদা পরে আসেন।

কিন্তু রুপুদা তো যায় না। কতক্ষণ ডিভানে কাত হয়ে বসে, একবার ফ্যানের স্পিড বাড়ায়। বেতের বইয়ের আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে কতক্ষণ বই ঘাটল। হঠাৎ কি হলো রুপু'দা এক লাফে নমুর কানের কাছে এসে বলছে। ''তোর মা'কে সবাই কি বলে জানিস?’’ দোলন ভাই ইশারায় রুপুরকে মানা করছিল।কিন্তু তিনি তা শুনবেন কেন। দোলন ভাই এবার উঠে দাঁড়িয়ে ধমকের সুরে বললেন ‘নম্রতা তুমি ঘরে যাও আমরা পরে আসবো।‘ এই বলে রুপুদাকে হিড়হিড় করে টেনে একেবারে বাসার বাইরে নিয়ে গেল।

কদিন বাদে পরীক্ষা। সব বাচ্চা কাচ্চারা খেলা কমিয়ে পড়ায় মন দিয়েছে। শুধুই পড়া মাঝে মাঝে একটু গল্প। নমু যে কিপড়ে নিজেই বুঝে উঠতে পারে না। ইম্পর্টেন্টগুলো বন্ধুরা বলতে চায় না। ফলে সে একা একা যেমন ইচ্ছে পড়ে। একটা দুইটা সাবজেক্টে ফেলও করে। কি করবে। বাসায় যে কেউ নেই নমুকে পড়ায়।

একবার টাক মাথা আউয়াল স্যারকে ঠিক করা হয়েছিল পড়ানোর জন্য। তো স্যার সাইকেলে চেপে আসতেন এবং শুরুতেই গুনে গুনে ১০টা অংক করতে দিতেন। নম্রতা পারে কি পারে না সে সব নিয়ে চিন্তা ছিলোও না। যাবার সময় তাঁর জন্য বাটিতে রেখে দেয়া সাদা মিষ্টি কিম্বা সুজি তৃপ্তি করে খেয়ে ঢক ঢক করে পানি খেয়ে ঢোল পেটে হাত বুলাতে বুলাতে চলে যেতেন। নমুর অংক গাছে উঠে বসে থাকত। কিন্তু তা নিয়েভাবার সময় কোথায়। নমুর মাথায় কেবল কখন বিকেল চারটা বাজবে, সে লোহার গেইট ঘটাং করে খুলবে এবংখালি পায়ে দুনিয়া ভেঙ্গে দৌড় লাগাবে।

মাঝে মাঝে নম্রতা খেয়াল করেছে রুপুদা তাকে লাফ দেবার সময়টা একটু দেখার জন্য কয়েক মিনিট ঘোরাঘুরি করে এবং পরে চলে যায়। উঁচু ঢিবি থেকে লাফ দেবার সময় কুচি দেয়া পলিয়েস্টার কাপড়ের ফ্রকটা অনেক সময় ফুলে মাথার উপর উঠে যায়। হলুদ রঙের হাফ প্যান্টটা এক ঝলক দেখা যায়। আগে বোঝেনি নমু। বুঝতে পেরেই সব মিলিয়ে তার অস্বস্তি লাগা শুরু হলো।

নমু বুঝে গেছে কটা দিন লাফ দড়ি খেলা যাবে না। রেখা জিজ্ঞেস করে সেদিন কি হয়েছিল রে তোর। নমু বলে তুই ক’দিন পরেই বুঝবি। ক'দিন পরে রেখা না মিনু এসে বলে,জানিস নমু, সেদিন স্কুল থেকে বাসায় ঢুকে বাথরুমে গিয়ে দেখি পায়জামায় রক্ত। নমু মুচকি হেসে ওঠে। মিনু বলে 'প্লিজ কাউকে বলিস না'। 'আচ্ছা।'' নমু হাসে।

সন্ধ্যা বেলায় পড়তে বসে হাত মুখ ধুয়ে। বাটিতে সুজি দিয়ে যায় বুয়াখালা। তাই খেয়ে পড়তে থাকে। মা বড় ব্যস্ত প্রায়ই অনেক রাতে ফেরে। নমুর ঘটনা তাকে বলাই হয়নি। সেদিনকি মনে করে মা ফিরেছে আগে আগে। নমু একটু উঁকি দিয়ে দেখে মায়ের সাথে গেস্ট এসেছেন। তাই লক্ষ্মী মেয়ের মতো টেবিলে বসে গলার শব্দ আর খানিক বাড়িয়ে চেয়ার দুলিয়ে দুলিয়ে পড়তে থাকে। মা একবার এসে গাল টিপে আদর করে দিলেন। বললেন পড়ো, আমি কিছু জরুরী কাজ সেরে আসছি।

খুশীমনে পড়ছিলো নমু। পড়তে পড়তে টেবিলে মাথা রেখে জিওগ্রাফি বইয়ের ম্যাপের উপরেই ঘুম। হঠাৎ ঘুম ভেংগেগেছে। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে সে ঠাহর করতে পারেনি। উঠেইবুয়াখালাকে খুঁজল। নাহ খালা তো রান্নাঘরে নেই, মনে পড়ল ওহ মা'তো ফিরেছেন। ড্রইংরুমেই আছেন।

সেখানে ঢুকতে গিয়েই ধাক্কা খেলো। আলো নেভানো। এখানে তো আলো নেভানো হয় না। নমু ভয় পেয়ে ডেকে উঠলো মা... তুমি কোথায়। কোত্থেকে মা ছিটকে এসে আলো জ্বেলে দিলো।ঘরের ভেতরে যে অচেনা গেস্টটা ছিলো সে কোনও মতে শার্ট ইন করতে করতে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো নমু অবাক হয়ে বলল মা উনি কে? মা বললো ‘চলো তোমার জন্য মিটিং এর খাবার এনেছি।‘

হাতে দুইটা গ্র্যান্ড সুইটসের ছোট প্যকেট। তাতে লাল টুকটুকে আপেল, সাদা মোড়কে ছানা, জিলাপী, সিঙ্গারা। দারুণ খুশী হয়ে গেছে নমু। সন্ধ্যায় এত ভাল জলখাবার হয় না। খুশীর চোটে কে যেন মায়ের সাথে এসেছিল, কেন দৌড়ে লোহার গেটটাকে বিকট শব্দ করে চলে গেল ভুলে গেছে নমু।

একসাথে এত খাবার পেয়ে প্রথমেই জিলাপি মুখে দিয়েছে সে। হঠাৎ মনে পড়লো রুপু'দা এসেছিল। গড়গড় করে মা'কে বলে দিচ্ছে। রুপু'দা খেলার সময় হা করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। তুমি তাকে ডেকে বকা দিয়ে দিও। আজ বাসায় এসেছিল তোমকে খুঁজতে।

মা কিছুটা বিরক্ত। চুপ করে আছে।

''নম্রতা খাও। খাবার সময় এত কথা বলো তুমি।''

নমুর থামাথামি নেই। সে বলেই চলেছে, পাড়ার সবাই নাকি তোমাকে কি একটা নামে ডাকে। মন দিয়ে খাচ্ছে আর বকবককরছে। মা অধৈর্য্য হয়ে বললো’ কি ডাকে ?’’নমু বলছে ‘ কি যেন বাজারে পাওয়া যায় বলল রুপুদা। আমি তো বুঝিনি। তুমি যে খাবারগুলো এনে দিলে এগুলোও তো বাজার থেকেআনা তাই না?’

মা চুপচাপ বসে নেই। এক হাতে কমলা ছিলছেন। কমলার ঝাঁজে কিনা জানি না তাঁর চোখের কোণাটায় জলের ফোঁটা। নম্রতা বুঝে নিল বোকার মতো মাকে সব বলে দেয়া ঠিক হয়নি। মার গলা ধরে বলল ‘মা তোমাকে রুপুদা কি বলেছে আমি বুঝিনি। ঝুমুরকে জিজ্ঞেস করলাম ঝুমুর বলেছে মাকোনও বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না গাধা। রুপুদা কেমনযেন’।

মা স্থবির বসে আছেন। অন্ধকার ঘর থেকে তার গেস্ট কায়েসসাহেব আচমকা দৌড়ে যাবার সময় তাকে তুমুল গালি।

অই মাতারি তোর মেয়েকে টাইম মতো অন্যখানে রাখতে পারিস না? বুয়ার সাথে টাকা দিয়ে বাইরে পাঠাতে পারিস নাই? অর্ধেক টাকাও পাবিনা। সামনের দিন হয় মেয়ে সরাবি নইলে তুই তোর মেয়ে জমা দিয়েআমার সামনে থেকে সরে যাবি শালি মাতারি।

খোসা ছেলা কমলাবরণ কমলাগুলো চুপচাপ সাদা রেকাবিতে চেয়ে আছে, আর মায়ের চোখ চুপচাপ মেঝের দিকে। নমু অবাক হয়ে দেখছে তার স্কার্টের তলা দিয়ে ফের রক্ত গড়িয়ে পায়ে পড়ছে। তিন দিন হয়ে গেল মা’কে ঘটনাটা বলাই হয়নি। বুয়াখালাই দোকান থেকে প্যাড এনে দিয়েছিল।

সে খাওয়া বন্ধ করে চিৎকার করে মাকে ডাকতে গিয়ে থেমেগেল।

মা’কে আর যখন তখন ডাকবে না নম্রতা।


লেখক পরিচিতি
সুমী সিকান্দার
গল্পকার। কবি।
ঢাকায় থাকেন।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ