
দীর্ঘ প্রস্তুতির কঠোর আত্মনিয়ন্ত্রণের পথ বেয়ে আজ সে নিজেকে দাঁড় করিয়েছে যে হিমশীতল চূড়ান্ত গন্তব্যের কাছাকাছি, আকবর আলী টের পায় মোমেনার করতলের উষ্ণতা সংক্রামক হয়ে সেই হিমশীতলতা গ্রাস করে ছড়িয়ে পড়তে চাইছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে.....বিশেষ অঙ্গেও! কী লজ্জা!!
হিমশীতলতার বরফ গলে গলে পরাজিত হতে চায় জীবনের উষ্ণতার কাছে, নৈতিক কিংবা অনৈতিক, পাপ কিংবা পূণ্য কোনো হিসাবের ধার না ধেরে বেহিসাবী দুর্নিবার হতে চায়। কিন্তু, কিন্তু প্রাণপণ লড়াই করে নেয়া প্রস্তুতিকে এতো তাড়াতাড়ি পরাজিত হতে দেবে সে? হতেই পারে না।
ঠিক তখন স্বর্গ মর্ত্য পাতাল কাঁপিয়ে একটা ঠাডা পরে বাইরে, ইলেকট্রিসিটিহীন জমাট জমাট অন্ধকার ছিঁড়ে ফুড়ে যায় বিজলীচমকের ডালপালায়। বিছানা লাগোয়া জানালার শার্সির কাঁপন থামে না, সমতলে ছুঁড়ে দেয়া পানির মতো ছড়িয়ে যায় জানালা লাগোয়া নিষ্প্রাণ খাট-বিছানা আর সপ্রাণ মানুষ পর্যন্ত। আকবর আলী পাশ ফিরে শোয়, আজ তার শেষ সিঁড়ির ধাপগুলো পার হওয়ার কথা। প্রস্তুতিকাল অনতিদীর্ঘ হলেও প্রস্তুতির লড়াইটা কঠিন। প্রতিনিয়ত নিজের সাথে। লড়াইটা তার জন্য কঠোর হয়েছে অনঅভ্যস্ততার কারণে। এমন নয় যে সে আগে জীবনের জন্য কোন সিঁড়ি বানায়নি সিঁড়ি বানানোর জন্য কোনো পাপ করেনি। মূলত জীবনের অতি অনিবার্য প্রয়োজনগুলো পাড়ি দেয়ার জন্যই আরো দুটি পাপ করতে হয়েছে তাকে, পাপের বিনিময়ে সিঁড়ি বানাতে হয়েছে। কিন্তু তখন পাশে সান্ত্বনা নিয়ে আশ্রয় দিয়ে পরামর্শ দিয়ে পাশে ছিলো জহুরা, জহুরা খাতুন। জহুরা খাতুন ছাড়া সে ছিল অচল, অসহায়, কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
জননী যেমন খুন করে আসা পুত্রকেও ক্ষমা করে আশ্রয় দেয়. জহুরা ঠিক তেমন আশ্রয় ছিল তার। কিন্তু এই অন্তিম সিঁড়ি বানানোর লড়াইটি সম্পূর্ণ তার একার। কেবলই একার। আর এই লড়াই সিঁড়ি বানিয়ে প্রয়োজন পাড়ি দেবার নয়। বরং সব প্রয়োজন শেষ করে পাপ থেকে মুক্তি পাবার। যে পাপের কথা যে লড়াইয়ের কথা জহুরাকে জানানো যায় না। জানায় নি সে।
মোমেনার গায়ের গন্ধ তাকে বিচ্যূত করছে লক্ষ্য থেকে, শেষ সিঁড়িতে পা রাখার সকল প্রস্তুতি তার নস্যাৎ করে দিচ্ছে সুচতুর রাজনীতিবিদের মতো। মেয়েটা নিষ্পাপ। আকবর আলী জানে। তাই যতোই সে অন্তর থেকে চাইছে মোমেনা চলে যাক, চলে যাক এখান থেকে, মুখে বলতে পারছে না। থাকুক বসে মোমেনা। তীরে এস তরী ডুবালে চলবে না তার। অগ্রাহ্য করতে হবে মোমেনার উপস্থিতি, অবিচল থাকতে হবে নিজের লক্ষ্যে। তৃতীয় এবং শেষ ধাপের সিঁড়ি বানানো শেষ তার, এবার শুধু পাড়ি দেবার পালা...বানানো যখন শেষ তখন পাড়ি দিতে আটকে গেলে চলবে? ব্যার্থ হতে দেয়া যাবে না শেষ জীবনের শেষ লড়াই।
আকবার আলী পা রাখে সিঁড়ির প্রথম ধাপে। ঠিক তখন দেখতে পায় একদম শেষ প্রান্তে, চূড়ান্ত গন্তব্যে হাত বাড়িয়ে বসে আছে জহুরা খাতুন। আশ্চর্য! জহুরা খাতুন কী টের পেয়ে গেল? সেতো এই বলেনি জহুরা খাতুনকে। তবে কেন সে হাত বাড়িয়ে বসে আছে বাউন্ডুলে ছেলের ঘরে ফেরার অপেক্ষায় থাকা মায়ের মতো?
সেই প্রথমবার প্রথম পাপটি করে বাড়ি ফেরার পরও জহুরা চেহারা দেখেই বুঝে ফেলেছিল কিছু একটা ঘটেছে। কিন্তু তারপরও সারা বিকাল-সন্ধ্যা তাঁকে ঘাটায়নি কিন্তু রাত গভীর হলে, নিঃশব্দ হলে, আদিম প্রবৃত্তি যখন উত্তাল হয় বিপরীত লিঙ্গের সান্নিধ্যের নেশায়, তখন জহুরা একে একে শরীরের ভাঁজ খুলে খুলে জানতে চায়- কি হইছে কন দেহি তোবারকের বাপ। আকবর আলী জানে জহুরার কাছে লুকাবার কোন উপায় নেই। প্রয়োজনও নেই। স্বীকারোক্তি নয়। বরং বলাটা প্রয়োজন। কারণ জহুরাই একমাত্র আশ্রয় তার। নিজেকে নির্দোষ কিংবা মহান প্রমাণপূর্বক সামান্য সহানুভূতি প্রত্যাশার ভান না করেই সে বলে, সদ্য অবসরপ্রাপ্ত হেড কেরানি কেরামত খানের পেনশনের ফাইল আটকে পঞ্চাশ হাজার টাকা উৎকোচ নেবার ঘটনাটা। জহুরা দুা হাতে আকবর আলীকে শরীরের অলিন্দে অলিন্দে টেনে নিতে নিতে ফিসফিস করে- খুব ভালা করছ। খুব ভালা কাম করছ। ব্যাটার কামটাও হইল, আম্রারটাও। জহুরা খাতুনের উৎসাহে সেদিন আকবর আরীর শিরায় শিরায় যেন নতুন যৌবনের টগবগে ঘোড়ার জোয়ার নামে। উদ্দাম হয়ে পড়ে সে......জহুরাও ফোঁস ফোঁস শব্দে আত্মসাৎ করে স্বামীর মধ্যযৌবনের উপচে উঠা জোয়ার। দুজনেই পরমতৃপ্ত। এই পঞ্চাশ হাজার টাকা এই মূহুর্তে না হলে বড় মেয়ের বিয়ের খরচের শুরুটা করা যাচ্ছিলো না।
এই ছেলে যে দুনিয়াত কেমনে করে খাবে- এই চিন্তায় চিন্তায় শেষ শয্যায় গেছে আকবার আলীর বাপ-মা। তিন ছেলের মধ্যে আকবর আলী সবচেয়ে সরল-সহজ। পাড়ার ছেলেরা তারে মুল দলে না নিয়ে সাইড লাইনে বসিয়ে তারই ফুটবল দিয়ে দিব্যি খেলে যায়। বন্ধুত্বের খাতিরে সময় সময় তার মাথায় হাত বুলিয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকে কড়া বৈশাখের রোদে গাছের সব কাঁচা আম, শেষ মাঘের শীতে কোঁচড় ভরে কুল পেড়ে নিয়ে যায়। পরীক্ষার আগের রাতে পড়া বই সে সহপাঠীর বাসায় দিয়ে আসে সহপাঠীর কান্নায় গলে। এই ছেলে দুনিয়াত খাবে কেমনে- বাপ-মায়ের পুনপুন এই আক্ষেপ প্রোথিত হয়েছিল তার বিশ্বাসেও। দুনিয়াতে চলে-ফিরে খাবার যোগ্যতা তার নাই।
কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ্ সে ঠেকে নাই। টেনেটুনে মাধ্যমিক এবং বার কয়েকের মাথায় ভাগ্যক্রমে বাহাত্তার সনে সদ্য স্বাধীন দেশে বই খুলে পাশের হিড়িকের সুযোগে উচ্চমাধ্যমিকের ঘরও। আর দিব্যি একখানা চাকরি আর চাকরির খাতিরে জহুরার মতো বুদ্ধিমতী-কৌশলী স্ত্রীও জুটে গেছে। যার অপরিসীম বুদ্ধি আর সুনিপুণ দক্ষতায় চাকরির গুনা টাকায় দিব্যি সংসার চলে গেছে। তার গায়ে কোন আঁচই লাগেনি কোনো সংকট-উত্তাপের। বাসা ভাড়া থেকে ছেলেমেয়ের পড়াশোনা, ঈদে গরু কেনা থেকে শশুরের চেহলামে চাঁদা দেয়া কিছুই সংসারের প্রচলিত নিয়মানুসারে পুরুষ হয়েও ভাবতে হয়নি তার।
বড় নির্ভার-নিরিবিলি-নিশ্চিত দিনযাপন করেছে সে। বাপ-মায়ের আক্ষেপ-দুশ্চিন্তা মিথ্যে করে তার দুনিয়ায় চলে খাওয়া বরং ঈর্ষাই জাগাতো আশে পাশের পুরুষদের। অন্য পুরুষরা যখন সংসারের দৈর্ঘ্য- প্রস্থে অপর্যাপ্ত কম্বলের মতো খরচ টানতে হিমসিম খেতো, পা ঢাকলে মাথা ঢাকতে পারতো না, মাথা ঢাকলে পা উদোম হয়ে পড়তো, তখন আকবর আলীর নিশ্চিত দিনযাপনের অলক্ষ্যে স্ত্রী ভাগ্য আবিষ্কার করে তারাই আক্ষেপে ডুবে মরতো।
প্রথমবার জহুরার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ দেখেছিলো সে সেবারই। নইলে বাপ-মায়ের আক্ষেপ মিথ্যে করার স্বস্তিতেই দিন কাটছিল তার। বড় মেয়েটার বয়স আঠারোর ঘর পার হতে না হতেই আমেরিকা প্রবাসী পাত্রপক্ষ বাড়ি পর্যন্ত এলে জহুরার জহুরী বিবেচনা সুযোগটি হাতছাড়া করতে চায়নি। পাত্রের ফিরে যাবার তাড়া। সাতদিনের মধ্যে বিয়ে দেয়ার তাগাদায় একবারই সে ভাঁজ দেখেছিলো জহুরার কপালে- এই মূহুর্তে বিয়া ধরলে কম কইরা লাখখানেক টাকা লাগবো, পাই কই!
সবসময় সংসারের সব আপদ-টানাপোড়েন থেকে তাঁকে আগলে রাখা জহুরার এই অস্থির ভাঁজ- তারে অসহ্য করে। কী করে সে! কেমনে মুক্তি দেয় সে জহুরাকে এই দুশ্চিন্তা থেকে। ভিতরে ভিতরে ভেবেছে সে, জহুরাকে বুঝতে দেয়নি। শেষ পর্যন্ত সামনে খোলা থাকা একমাত্র উপায়টিই কাজে লাগিয়েছে সে। পাপ জেনেই। অন্যায় জেনেই। ঘাম ধুয়ে ভিজে জবজবে শরীরে ওয়াশরুম থেকে ফিরে শরীরে খুলে রাখা কাপড়খানা জড়িয়ে জহুরা ফ্যানের স্পিড বাড়াতে বাড়াতে পাশে বসে কাঁধে হাত রেখে বলেছিলো- শোন, কতোজন জীবনে উপ্রে উডার সিঁড়ি বানাইতে কত আকাম করে, মাইয়াডারে বিয়া দেয়ার জইন্য সামান্য হাজার পঞ্চাশেক টাকা নিয়া মুখডা অমন পাতিলের তলার মতো কালো বানাইয়া রাখছ কেন? যা করছ, ঠিক করছ। এরকম একটু-আধটু সিঁড়ি আগে থেকে বানাইলে এতোদিনে কই থাকতা একবার ভাবো!
জহুরার কথায় কী স্বর্গীয় সুধা ছিলো কে জানে, সঙ্গমক্লান্ত শ্রান্ত শরীরে যেনো শীতাতপযন্ত্রের হাওয়া লাগে। অপার শান্তি আর স্বস্তিতে জীবনের এক কঠিন সিঁড়ি পাড়ি দেয়ার সুখে ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসতে থাকে তার.....।
ঘুম ঘুম চোখে জহুরার হাত বাড়িয়ে আকুল বসে থাকার দিকে দ্রুত আবার সিঁড়িতে পা রাখে আকবর আলী। এই শেষ সিঁড়ি, দীর্ঘ লড়াই শেষে প্রস্তুতি তার। দ্রুত পাড়ি দিতেই হবে। পৌঁছাতে হবেই শেষ মাথায়.....মোমেনার ব্লাউজভেজা ঘামের মাতাল গন্ধ সিঁড়িতে রাখা পা টলিয়ে দেয়, ভরপেট মাতালের পায়ের মতো। আকবর আলী বিপর্যন্ত বোধ করে। বাইরে বিজলি ঝড়ের তুমুল দাপাদাপি, সুপারি গাছের পাতায় পাতায় বিপন্নতার শো শো.....। বাইরের ঠাডার গর্জন যেন মোমেনার উষ্ণতার মতো ভীষণ। সংযমের সব দেয়াল ভেঙ্গে চুরে ঢুকে পরতে চায় অন্দরে। এই ঠাডা ঝড় ঝঞ্ছা না থামলে মোমেনা তাকে একা ফেলে যাবেনা। ভালোই জানে আকবর আলী। বাঁধভেঙে পানির তোড়ের মতো বাড়তে থাকে বৃষ্টির তোড়......কাছাকাছি থামার কোনোই লক্ষণ নেই আকাশে-বাতাসে। বৃষ্টির তোড় আর বিজলি চমকানোর প্রতিযোগিতা যতোই বাড়তে থাকে, ততোই বাড়তে থাকে আকবর আলীর বিপন্নতাও। কপালে রাখা মোমেনার উষ্ণ হাত চঞ্চল হয়। আঙুলগুলো সমদূরত্বে সুবিন্যস্ত ফাঁক হয়ে হাঁটতে থাকে চুলের গহীনে গহীনে। আকবর আলীর সংহত লক্ষ্য শিথিল হয়ে যেতে চায়। নিজের সাথে নিজের তীব্র লড়াই চলতে থাকে অবিরাম। এই উষ্ণতার লোভে পড়ার পাপে জড়িয়ে পড়লে চলবে না কোনমতেই। ঐ তো সিঁড়ির শেষ ধাপে জহুরা খাতুন দাঁড়িয়ে আছে হাত বাড়িয়ে......। তাকে যেতে হবে।
এমনি দাঁড়িয়েছিলো জহুরা খাতুন সেদিনও, যেদিন দ্বিতীয় পাপটি করে তার আশ্রয়েই ফিরেছিলো সে। ঢাকা থেকে নতুন প্রজেক্টের পিডি ট্রেনিং প্রোগ্রাম উদ্বোধন করে কেন যেন আকবর আলীকেই সবচেয়ে বিশ্বস্ত ভেবে কানে কানে জানিয়েছিলো, হোটেলে রাতটা একটু এনজয় করতে চায়। আকবর আলী একটু থতমত খেলেও, জ্বী স্যার জ্বী স্যার বলে তাৎক্ষনিক ব্যবস্থার যোগাড়ে নামে। সবার আগে ফোন করে জহুরাকে। জহুরা এক কথায় তাঁকে অধিক উৎসাহে প্ররোচিত করে। বস বইলা কথা, খুশি অইলে কপালে কী ঘটে আল্লায় জানে। খুশি করেন খুশি করেন...। এসব ব্যাপারে আকবর আলীর অভিজ্ঞতা একবারেই নাই, জীবনে জহুরা ছাড়া দ্বিতীয় নারী শরীর দেখে নাই সে। তবে এমএলএসএস তকদিরের অভ্যাসের কথা অফিসে খোলা গোপনীয়। তকদিরের দ্বারস্থ হলে ঘন্টাখানেকের মধ্যে ম্যানেজ করে ফেলে সে। সারাটা সময় বুক ধুকধুক করে.... মেয়েটাকে হোটেলে পৌঁছে দিয়েই জহুরার আশ্রয়ে ফিরে ঘামতে থাকে সে। ঠান্ডার ফ্রিজের পানিতে লেুবু-লবন-চিনির শরবত গুলে আকবর আলীর হাতে দিয়ে হাসতে হাসতে ভেঙ্গে পড়ে জহুরা- আহারে, দেখ কাণ্ড! পাঁচ বাইচ্চার বাপ একটা মাইয়া মানুষ লইয়া এমুন কাঁইপা কুঁইপা শেষ। আর কেউ অইলে ঠিক....জহুরা শেষ করে না, নাউজুবিল্লাহ নাউজুবিল্লাহ পড়ে আকবর আলী, জীবনেও যেন এমন বিপথে চালিত না হয় সে। সে যাত্রা অবশ্য একটা বাজারী মেয়ের বিনিময়ে দারুন নিশ্চিত নির্ভাবনার সিঁড়ি বানানো হয়ে গিয়েছিলো তার। তিন ধাপ প্রমোশন পেয়েছিল আকবর আলী, বেতনের কাঠামোটা এমন জায়গায় পৌঁছেছিল যে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। অফিসের সবাই ঘটনাটা জানলেও প্রকাশ্যে কারো কিছু বলার সাহস ছিল না, কারণ বলাটা যে বসের বিপক্ষেই যায়। তবে অনেকেই ঠেস দিয়ে কথা বলতে ছাড়তো না, গায়ে মাখতো না আকবর আলী। তবে কেউ কেউ এমন সন্দেহও করতো যে এমন নারীসঙ্গ বোধ করি তারও অভ্যাস, নইলে বস আর কাউকে না বলে তাকেই কেন বলতে গেলো! সবার ঠেস দেয়া কথা যদিও বা সহ্য করা যেতো নীরবে, সন্দেহটুকু সইতো না। জহুরার কাছে এস গুজগুজ করতো রাগে। জহুরা মুখ টিপে হাসতো- ভালাই তো! সবাই যদি জানে আমার জামাইর এমন মুরোদ তো মন্দ কী? আমিতো জানি আফনে খালি আমার কাছেই পুরুষ মানুষ!
জহুরার এই তীব্র বিশ্বাস কী না ভেঙ্গে পড়তে চাইছে! মোমেনার স্পর্শ তাকে জড়িয়ে জড়িয়ে বাঁধছে! মোমেনা এবার তার ঠোঁট দুটি নামিয়ে আনে প্রায় নিঃসাড় আকবর আলীর কানের কাছে, নিঃশ্বাসের উষ্ণতা টের পায় আকবর আলী। মোমেনা জানতে চায়- ডরাইতাছেন? ডরাইয়েন না। আমি পাশে বসা আছি। বাইরে আরো তুমুল বেগে নামে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি। ইলেকট্রিসিটি আসার নামগন্ধ নাই। ঘরের ভিতর জ্বালানো মোমবাতির শিখাটা ফাঁক-ফোঁকড় গলে আসা বাতাসের সাথে লড়াই করেও জ্বলে যাচ্ছে অক্লান্ত। মোমেনার কন্ঠ আর উদ্বিগ্নতা তাকে অস্থির করে। তাকে ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিতে চায় সে। কিন্তু নির্দেশ দেয়ার সে বাসনা কন্ঠনালীতেই ফ্যাসফ্যাস করে ঘুরে মরে। কেমনে বলে সে মোমেনাকে, কেমনে বলে। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ করে হার্ট এটাকে জহুরার মৃত্যুর পর যে অথৈ সমুদ্রে পড়েছিল আকবর আলী সেখান থেকে তো তাকে টেনে তুলেছে এই মোমেনা। ঠিক জহুরার মতো ওষুধখানা হাতের কাছে এনে দিয়ে, পাশে বসে পান বানিয়ে দিয়ে, মোজা জোড়া খুঁজে দিয়ে দিনের পর দিন নিজেকে অনিবার্য করে তুলেছে আকবর আলীর কাছে।
নইলে জহুরার মৃত্যুর পর সবাই যখন জহুরার বেহেশত নসিবের জন্য হাত তুলছিল তখন আকবার আলী হাবুডুবু খাচ্ছিল মধ্য সমুদ্রে। কেমনে পাড়ি দেবে সে বাকি জীবন। যদিও বড় আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর চিন্তা, তবুও সে অস্বীকার করতে পারে না জহুরার বেহেশত প্রাপ্তির চিন্তার চেয়ে নিজের বাকি জীবন কাটানোর চিন্তাই বেশি পীড়িত করেছিল তাকে সে মূহুর্তে। তৎক্ষনাৎ ছেলেমেয়েরা ‘আব্বা ভাইঙ্গা পইড়েন না, আমরা আছি ত’ ইত্যাদি সান্ত্বনা বাণী ক্রমাগত করে গেলেও দুই ছেলে আর তাদের বউরা ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা-প্রাইভেট-স্কুল ইত্যাদি বাহানায় কেটে পড়েছে মাস না ফুরাতেই। আর দেশে থাকা একমাত্র মেয়ের স্বামীরও হোটেল রেঁস্তোরায় খেয়ে পেটের পীড়ার বাড়াবাড়িও আটকে রাখা গেলো না মাসাধিক কাল।
ভাগ্যিস মাসখানেকের মধ্যেই ঘরে এলো মোমেনা আর লাগাম টেনে ধরলো আউলা-ঝাউলা হয়ে পড়া আকবর আলীর জীবন। সবই ঠিকঠাক ছিলো। বাকী ছেলেমেয়েরাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছিল মোমেনার যতœআত্তি দেখে। কিন্তু সমস্যাটা তৈরি হলো নিজের ভেতরেই। এমন সমস্যা!! এমন সমস্যা কাউকে বলা যায় না, সহ্যও করা যায় না। এক দুঃসহ পাপবোধের ক্ষরণ তাকে রক্তাক্ত করতে থাকে প্রতিদিন। মোমেনা পাশে বসলে তার গায়ে গা লাগলে টের পায় আকবর আলী সে এখনো পুরুষ রয়ে গেছে। মনে মনে বয়স হিসাব করে সাত দশকের ঘর পার হয়নি যদিও, তবু এটা তো সব প্রবৃত্তি থেকে অবসর নেয়ারই বয়স। সামাজিকভাবেও প্রাকৃতিকভাবেও। কিন্তু কী আশ্চর্য! রাতে মশারির চারমাথা লাগিয়ে তোষকের নীচে টানটান গুঁজে দেয়ার সময় ব্লাউজের গলা ভেদ করে দেখা যায় যে মোমেনার সুডৌল যৌবন, তা কিনা তার সারারাতের ঘুম কেড়ে নেয়। নানাভাবে চেষ্টা করে সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণের। ধর্মে-কর্মে অধিক মনোযোগী হয়। কিন্তু দিনকয় পরেই টের পায় লাভ হচ্ছেনা। বরং মোমেনার প্রতি আকর্ষণ দ্বিগুন মাত্রায় বাড়তে থাকে তার।
তারপরই এই সিঁড়ি বানানোর সিদ্ধান্ত নেয় সে। ধীরে-ধীরে, দিনে-দিনে। তৃতীয় পাপের আগেই জীবনের শেষ সিঁড়িটি বানাতে থাকে নিজের সাথে লড়াই করে করে...। কাউকে জানতেও দেয়নি, বুঝতেও ...। আজই সেই সিঁড়ি বানানো শেষ করেছে সে। আজই তার শেষ বোঝাপড়ার রাত। এর আগে দু দুটো পাপ তার জীবনের সিঁড়ি পাড়ি দেয়ায় অনিবার্য অনুষঙ্গঁ হয়েছে। আর এবারের সিঁড়িটা তাকে তৃতীয় পাপ থেকে মুক্তি দিয়ে পৌঁছে দেবে চূড়ান্ত গন্তব্যে।
ওষুধগুলো সে খেয়েছে মিনিট বিশেক আগেই। জমিয়ে রাখা ঘুমের ওষুধ। আকবর আলী ধীরে ধীরে তীব্র ঘুম টের পায়...টের পায় নিজ দেহের ক্রমশীতলতার দিকে যাত্রা।। কিছু কথা অস্পষ্ট কানে ঢুকে তার, কিছু ঢুকে না। মোমেনার উষ্ণ হাতও শীতল লাগে ততোক্ষনে, শুনতে পায় মোমেনা উদ্বিগ্ন গলায় ডাকছে তার স্বামীকে, ডাকছে তার স্বামী আকবর আলীকে তৃতীয় ছেলে সোবহানকে- শোনছেন, তাড়াতাড়ি আইয়েন আব্বাজানের শরীলডা ক্যামন সাপের মতো ঠান্ডা লাগতাছে!! আকবর আলী শোনে কী শোনে না..... অনেক দূর থেকে ছেলে সোবহানের কন্ঠ- ও আব্বা! আব্বা!! চোখদুটো একবার খুলতে চায় সে.....পারেনা। ততোক্ষনে সে পৌঁছে গেছে সিঁড়ির শেষ ধাপে, জহুরা বাড়িয়ে থাকা হাত ছুঁয়ে।
0 মন্তব্যসমূহ