মােহাম্মদ বজলু যখন জানতে পারে, কোনাে এক টেলিভিশন চ্যানেলের লােকজন ক্যামেরা নিয়ে তার বাড়ির দিকেই আসছে, তখন সে নিশানদিয়া গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তের তার বাড়ির বিছানায় শুয়ে পড়ে । শােবার আগে তার স্ত্রী মােমেনাকে ডেকে কানে কানে কিছু একটা বলে। খাটের নিচে ঠিক তখন তার বাড়ির মুরগিটা ডিম প্রসব করে ধীর পায়ে খড়ের ঝাঁকা থেকে বেরিয়ে এসে চিৎকার করে তার সদ্য প্রসবযন্ত্রণা লাঘবের ঘােষণা দেয় ‘কক কক কক'। মােহাম্মদ বজলু কি এই দিনটার জন্যই অপেক্ষা করছিল এত দিন ? সে কি মনে মনে চাইছিল যে তারা আসুক এবং তাকে এই নাটকের মঞ্চ থেকে নামিয়ে দিক?
নারকেল পাড়া, ডাব পাড়া, নারকেলগাছের চূড়ার মরা পাতা পরিষ্কার করা, খেজুরগাছে রসের হাঁড়ি বসানাে—এ-ই হচ্ছে কাজ বজলুর। নিশানদিয়া গ্রামের গুটিকয় গাছির ভেতর সে একজন। সরু, উল্লম্ব গাছ বেয়ে তরতরিয়ে উঠে যাওয়ার এই নেশা বজলুর আশৈশব। গাছের যে প্রান্তে কেউ যেতে পারে না, বজলুর সেখানে পৌঁছে যাবার নেশা চাপে। ডান থেকে বাম পা, বাম পা থেকে ডান পা এঁকেবেঁকে একটু একটু করে বালক বজলু উঠে যায় কৃষ্ণচূড়াগাছটার একেবারে শেষ চূড়ায়, যেখানে একচ্ছত্র অধিকার নিয়ে বসে ছিল ভুবন চিল। পাতার ফাঁক দিয়ে বজলুর মাথা দেখা দিতেই ত্রস্ত চিল ডেকে ডেকে উড়ে যায় আকাশে। বজলু সেই উঁচু ডালে বসে নিশানদিয়া গ্রামের দূর দূর প্রান্ত দেখতে পায় । দেখতে পায় দূরে কাশেমদের বাড়ির রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসছে ধোঁয়া, দেখতে পায় গ্রামের সবচেয়ে রূপসী মেয়ে পারুলের বেড়ায় শুকাতে দেওয়া হলুদ শাড়ি। এই উঁচু থেকে পৃথিবীকে দেখার নেশায় পেয়ে বসে তাকে। ছােট গাছ থেকে বড় গাছ। গ্রামের সবচেয়ে উঁচু গাছের মগডালে চড়ার ঘাের লাগে তার। একেকটা উঁচু গাছ তার জন্য একেকটা চ্যালেঞ্জ। নারকেল আর তালগাছ তার প্রিয়তম চ্যালেঞ্জ। এই এক পায়ে সব গাছ ছাড়িয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানাে গাছগুলােতে দিনের পর দিন উঠতে গিয়ে অনন্য দক্ষতা অর্জন করে সে । তখন অবশ্য সে জানে না যে এই গাছে চড়াই হয়ে উঠবে তার জীবিকা। বজলু হবে নিশানদিয়া গ্রামের গাছি। কিন্তু গাছির কাজ নিয়মিত মেলে না বজলুর। স্ত্রী মােমেনা আর দশ বছরের কন্যা শিল্পীকে নিয়ে তার যে সংসার, শুধু ডাব নারকেল পেড়ে সে সংসার চলে না । কিন্তু বৃক্ষ পরিচর্যা ছাড়া আর কোনাে ব্যবসা শেখেনি বজলু।
সেদিন সকালে গ্রামের মেম্বার আলতাফ আলীর নারকেলগাছ পরিষ্কারের কাজ করছিল বজলু। তরতরিয়ে গাছের চূড়ায় উঠে সেখানকার শুকনাে পাতা পরিষ্কার করছিল সে। গােটা দশেক নারকেলগাছ আছে আলতাফ আলীর। প্রথম এবং দ্বিতীয় গাছের শুকনা মরা পাতাগুলাে বজলু পরিষ্কার করে ফেলে নিপুণভাবে। তৃতীয় গাছটা যখন পরিষ্কার করছে, তখনই বিপত্তি ঘটে। পা ফসকে উঁচু নারকেলগাছ থেকে পড়ে যায় বজলু। ভেঙে যায় তার ডান পা। মাটিতে পড়ে কিছুক্ষণ বিমূঢ় থাকে সে, তারপর ধীরে তার তীব্র ব্যথা শুরু হয়। আলতাফ আলী সােবহানকে তার ভ্যান নিয়ে আসতে বলে খবর দেয় মােমেনাকেও। সােবহানের ভ্যানে বজলুকে নিয়ে মােমেনা যায় গ্রাম থেকে দশ মাইল দূরে উপজেলা হাসপাতালে। ডাক্তাররা পরীক্ষা করে বলেন, বজলুর ডান উরুর হাড় পুরােটা ভেঙে গেছে। তাঁরা তার পায়ে প্লাস্টার বেঁধে দেন এবং জানান তাকে দ্রুত ঢাকার হাসপাতালে নেওয়া প্রয়ােজন। তাঁরা ঢাকার হাড়ভাঙা সারানাের এক বড় হাসপাতালের ঠিকানা দেন। আলতাফ আলী কিছু টাকা ধার দেন বজলুকে। মােমেনা তার কানপাশা বিক্রি করে কিছু টাকা জোগাড় করে। মেয়ে শিল্পীকে মায়ের কাছে রেখে মােমেনা বজুলকে সঙ্গে করে উঠে পড়ে ঢাকার বাসে।
ঢাকার নির্ধারিত হাসপাতালে পৌঁছাতে রাত হয় বজলু আর মােমেনার। মােমেনার ঘাড়ে হাত রেখে কোনােরকম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বজলু হাসপাতালের মূল দরজা দিয়ে ঢোকে। ভেতরে ঢুকে যে পরিস্থিতিতে গিয়ে পড়ে তার জন্য প্রস্তুত ছিল না তারা । দেখতে পায় ভেতরে এক ব্যাপক হই-হুলস্থুল অবস্থা। হাসপাতালের বারান্দায়, করিডরে অগণিত হাত-পা ভাঙা রক্তাক্ত রােগী, তাদের কারও হাত-পা প্লাস্টার করা, কেউ কেউ তখনাে প্লাস্টারবিহীন ভাঙা হাত-পা নিয়ে গােঙাচ্ছে। সেই সব রােগীকে ঘিরে আরও অগণিত মানুষ। সেই সঙ্গে আরও কিছু মানুষ ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন নিয়ে হাসপাতালের এদিক-ওদিক দৌড়ে বেড়াচ্ছে। রােগীদের নিয়ে ছােটাছুটি করছে ডাক্তার, নার্স। ঢাকার হাসপাতালে ব্যাপক ভিড় থাকবে, সে ভাবনা তাদের ছিল কিন্তু চারিদিকের এমন নাটকীয়, উদ্বিগ্ন পরিস্থিতি দেখে তারা ভড়কে যায়। মােমেনা আর বজলু হাসপাতালের বারান্দার এক কোনায় বসে পড়ে। বজলু প্লাস্টার করা পা ছড়িয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে চারিদিকে তাকিয়ে ব্যাপার বােঝার চেষ্টা করে। মােমেনা সাথে করে আনা কলা আর বনরুটি খেতে দেয় বজলুকে। নিজে খায়। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কাগজটা হাতের মুঠোয় রাখে। সেখান থেকে দেওয়া একটা ট্যাবলেট পানি দিয়ে খাওয়ায় বজলুকে। হাসপাতালের রােগীদের অপেক্ষার জায়গায় দেয়ালে লাগানাে একটা টেলিভিশনের দিকে চোখ যায় বজলুর। বজলু তার ময়লা হয়ে যাওয়া পায়ের প্লাস্টারে হাত রেখে একবার মানুষের ভিড় ছােটাছুটি দেখে, একবার টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখে।
কিছুক্ষণের ভেতর ব্যাপার খােলাসা হয় বজলুর কাছে। জানতে পারে, সেদিন সকালে ঢাকার এক বড় পােশাক কারখানার দালান ধসে শত শত মানুষ মারা গেছে, আহত হয়েছে হাজার হাজার। সেই আহত লােকেরাই ঢাকার নানা হাসপাতালে ছুটে আসছে। বজলু টেলিভিশনের পর্দায় সেই পােশাক কারখানার ভেঙে পড়া ছাদ, তার ভেতরে আটকে পড়া শ্রমিকদের আহত, নিহত শরীর বের করে আনার প্রক্রিয়া, শ্রমিকদের আত্মীয়স্বজনের আহাজারি, সেনাবাহিনীর তৎপরতা ইত্যাদি দেখে। টেলিভিশনে প্রচারিত ধ্বংসস্তুপ থেকে উদ্ধার পেয়ে আসা শ্রমিকদের জবানবন্দি মন্ত্রমুগ্ধের মতাে শােনে বজলু। টেলিভিশনে সে তেমন লােকের বক্তব্য শােনে, যারা সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে শ্রমিকদের উদ্ধার করতে গিয়ে আহত হয়েছে। এই আহাজারি, ধ্বংসযজ্ঞ, মৃতদেহ টেলিভিশনের পর্দায় দেখতে দেখতে কেমন ঘাের লাগে বজলর। নিজের পায়ের ব্যথার কথা ভুলে যায় সে। অনেক রাত অবধি সেই হাসপাতালে আহত রক্তাক্ত রােগীরা আসে। বজলু দেখতে পায় সেসব রােগীর অনেকে কারখানার শ্রমিক, যাদের ওপর আছড়ে পড়েছে ইট, পাথর, বিম আবার কেউ কেউ আছেন যাঁরা সেই শ্রমিকদের উদ্ধার করতে গিয়ে হয়েছেন আহত। সাংবাদিকেরা ক্যামেরা, মাইক্রোফোন নিয়ে তাদের নানা প্রশ্ন করছেন, তাঁরা তার উত্তর দিচ্ছেন। আহত, নিহতদের জন্য ঘােষিত হচ্ছে নানা আর্থিক সাহায্য। বারান্দার দেয়ালে হেলান দিয়ে এসব শােনে বজলু । শুনতে শুনতে কখন যেন তার তন্দ্রা আসে।
ব্যাপারটা কি তার এই তন্দ্রার ভেতরই ঘটে? এই তন্দ্রার ভেতরেই কি তার ওপর ভর করে কল্পনাপ্রসূত গভীর সৃজনশীলতা? কল্পনাপ্রবণ হয়ে উঠবার নানা সূত্র তাে বজলুর জীবনে রয়েছে। গাছের মগডালে, আকাশের খুব কাছাকাছি একা একা বৃক্ষ পরিচর্যা করতে করতে একজনের ভেতর গভীর কল্পনা প্রবণতা তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক না।
তবে আমরা ধারণা করি, বজলুর কাল্পনিক জগতের সূত্র সম্ভবত অন্যত্র। সে সূত্রটাই বরং বেশি শক্তিশালী। আমরা জানি, এই বৃক্ষ নেশা ছাড়া আরেক গােপন নেশা আছে বজলুর। সেই নেশার সূত্র ধরেই তার মনে চলে কল্পনার চাষ । বজলুর আছে পুঁথি পড়ার নেশা । হাটে গিয়ে নিয়মিত পুঁথির বই কিনে আনে সে। স্কুলের নিচু ক্লাস পর্যন্ত পড়ে যেটুকু বিদ্যার্জন হয়েছে বজলুর, তার একমাত্র ব্যবহার এই পুঁথি পড়ায়। পুঁথি পড়া বলতে জনসমক্ষে পুঁথিপাঠ নয়। পুঁথিপাঠ আর তার গ্রামে এখন হয় না। তবে হাটের দিন দূরের বুড়িরভিটা গ্রামের কবি আবদুল করিম প্রায়ই তাঁর লেখা আধা ফর্মার পুঁথির চটি বই বিক্রি করেন। বজলু আবদুল করিমের অবধারিত ক্রেতা। কবি আবদুল করিমের সঙ্গে একটা সখ্যও গড়ে ওঠে তার। সপ্তাহের জমানাে পয়সা দিয়ে সেই পুঁথি কেনে বজলু এবং বাড়িতে এনে হারিকেনের আলােতে পড়ে, মােমেনাকে পড়ে শােনায় । গ্রামে পল্লী বিদ্যুৎ থাকলেও বজলুর তা ভােগ করবার সাধ্য নাই। রাতের খাবার খেয়ে ঘুমাবার আগে হারিকেনের আলােয় একটু একটু করে তারিয়ে তারিয়ে আবদুল করিমের পুঁথি পড়ে শােনায় মােমেনাকে। সুন্দর কণ্ঠ বজলুর আর জানে পুঁথি পড়ার কৌশল।
কিন্তু মােমেনা বজলুকে বাস্তব পৃথিবীতে টানবার চেষ্টা করে, ‘পুঁথি পইড়া কেরােসিন শেষ করলে হইব? কেরােসিন কেনার পয়সা কই? গাছির কাম ফালাইয়া অন্য কাম করলেও তাে পারাে, দুইটা পয়সা বেশি কামাইতে পারবা । মাইনষে কি আর কোনাে কাম করে না? সােবহানে ভ্যান চালাইতে শুরু করছে। ভ্যান তাে চালাইতে পারাে?’
বজলুর ওই সব টায়ার, স্পোক, হ্যান্ডেল ইত্যাদি ধাতব জিনিস নাড়াচাড়া করতে ভালাে লাগে না । সে ওই গাছ, পাতা, বাকল এই পৃথিবীতেই থাকতে চায় । আর থাকতে চায় পুঁথির গল্পের পৃথিবীতে। বজলু মােমেনাকে বলে, ‘চিন্তা কইরাে না। পয়সার ব্যবস্থা একটা হইব। আগে করিমের নতুন পুঁথিটা শুন।’
আলতাফ আলীর নারকেলগাছ থেকে পড়ে যাবার ঠিক আগের রাতেই বজলু একটা আশ্চর্য সমাপতনের ঘটনার পুঁথি পড়েছে। তার স্ত্রী মােমেনাকে পড়ে শুনিয়েছে। সেই পুঁথি পড়বার পর থেকে ঘটনার সমাপতনের ব্যাপারটা বজলুকে বিহ্বল করে রেখেছে। কবি আবদুল করিম বিচিত্র বিষয়ে পুঁথি লেখেন। ইউসুফ জুলেখা বা সয়ফুল মুলক বদিউজ্জামান-জাতীয় বিষয়ে তিনি লেখেন না। লেখেন অদ্ভুত সব বিষয়ে। সে রাতে বজলু যে পুঁথিটা পড়েছিল তার নাম ‘মামলার সাক্ষী ময়না পাখি’। নিউজপ্রিন্টে ছাপানাে পুঁথির প্রচ্ছদে একটা ময়না পাখির ছবি। বজলু হারিকেনের হলুদ আলােয় সেই পুঁথি পড়ে শুনিয়েছে মােমেনাকে :
শােনেন বন্ধুগণ দিয়া মন আশ্চর্য ঘটনা। মামলার সাক্ষী ময়না পাখি কবিতার বর্ণনা। আছে এক মেম্বার, নামটি তার জেকের আলী মিয়া। ছােট ভাই তার কাশেম আলী আই এ পাস করিয়া, বেড়ায় ঘুরে ঘুরে। বেড়ায় ঘুরে ঘুরে খাঁচায় পুরে ময়না পাখি পােষে। জীবনের চেয়ে অধিক ভালাে পাখিটারে বাসে। শিখায় বাংলা ভাষা। শিখায় বাংলা ভাষা, ইংলিশ ভাষা আরও হিন্দি ভাষা। মিষ্টি মিষ্টি কথা পাখি বলছে কেমন খাসা। একদিন জেকের মিয়া। একদিন জেকের মিয়া রাগ করিয়া কাশেমকে বলিলে, পাখি পুষলে চলবে না ভাই রুজি না করিলে । নাহি জমিদারি । নাহি জমিদারি চিন্তায় মরি সংসার চলবে কিসে। লক্ষ্মীছাড়ার মতাে ঘুরলে চলবে না আর শেষে। ভাইয়ের রাগ দেখিয়া। ভাইয়ের রাগ দেখিয়া কাশেম মিয়ার রাগ হইল মনেতে । বাড়ি হইতে যায় চলিয়া পাখি নিয়া সাথে। গেল ফরিদপুরে। গেল ফরিদপুরে, বেড়ায় ঘুরে চাকরি নাহি মেলে । তিন দিন ধরে অনাহারে বসে গাছের তলে তখন ক্ষুধার জ্বালায়। তখন ক্ষুধার জ্বালায় পাখিটি হায় ঢলে ঢলে পড়ে। কাশেম মিয়া উঠায় হাত আল্লাহর দরবারে । বলে মালেক সাই। বলে মালেক সাই কেহ নাই তুমি বিনে আর। বিপদ ভঞ্জন প্রভু তুমি, করাে কৃপা দান। করাে কৃপা দান, বাঁচাও জান ক্ষুধায় যাচ্ছি মরে । তখন স্কুল হইতে একটি মেয়ে এল ধীরে ধীরে । বয়স পনেরাে ষােলাে, বয়স পনেরাে ষােলাে, যেন হলাে পূর্ণিমারও চান...
স্কুল থেকে আসা পনেরাে ষােলাে বছর বয়সী পূর্ণিমার চাঁনের মতে এই মেয়েটির নাম মতিজান। পুঁথির গল্পে এরপর দেখা যায় এই রূপসী মেয়ের সামনে কাশেম আলী কুণ্ঠিত, দ্বিধান্বিত, নতশির।লজ্জিত কাশেম কোনাে কথা বলতে পারে না । এমন পরিস্থিতিতে দেখা যায় কথা বলে উঠেছে সেই ময়না পাখি। ময়না পাখি আকুল কণ্ঠে মতিজানকে জানায়, তার মালিক কাশেম মিয়া । তিন দিন অনাহারে আছে । না খেয়ে আছে সে-ও। খেতে না পেলে তারা মারা যাবে। এই কথা শুনে মতিজানের মনে দয়া জাগে। মতিজান কাশেম আলী এবং তার ময়না পাখিকে নিয়ে যায় তার বাড়িতে । কাশেম আলীকে বসায় বাড়ির বৈঠকখানায়।
তখন বৈঠকখানায় দেখিতে পায় মতিজানের মায়। ঘরখানা হয়েছে আলাে ছেলের চেহারায়। ভাবে মনে মনে । ভাবে মনে মনে ইহার সনে মেয়ের বিয়া দিব। বিয়া দিয়ে জামাই মেয়ে বাড়িতে রাখিব। তখন কাশেমেরে, তখন কাশেমেরে ধীরে ধীরে করে জিজ্ঞাসন। বিদেশেতে তুমি বাবা এলে কী কারণ। কথা বলে যখন, কথা বলে যখন এল তখন মতিজানের পিতা। নামটি তাহার ওসমান গনি শোনেন সকল শ্রোতা। তিনি অতি ধনী, তিনি অতি ধনী মানে মানী করেন যে কারবার। বড় মহাজন নামটি আছিল তাহার। গিন্নি বলিতেছে, গিন্নি বলিতেছে স্বামীর কাছে, শুনেন প্রাণনাথ। তিন দিন হইল এই ছেলেটির পেটে নাইকো ভাত। করছে আইএ পাস। করছে আইএ পাস ছেড়ে দ্যাশ চাকরি পাওয়ার আশে। পোষা ময়না সঙ্গে নিয়ে ঘুরে দ্যাশে দ্যাশে। বলে ওসমান গনি। বলে ওসমান গনি ওগো গিন্নি, ভাগ্য মোদের ভাল। মতিজানের জোড়া বুঝি খোদায় এনে দিল। তখন বলে বাবা। তখন বলে বাবা কোথায় যাবা চাকরি খুঁজিবারে। আছে কত কর্মচারী আমারি আন্ডারে। তাদের খাটাইবা। তাদের খাটাইবা হিসাব নিবা যখন যেমন চাও, আমার বাড়ি ছেড়ে তুমি পাও না বাড়াও...
ঘরজামাই হয়ে ওসমান গনির ব্যবসাপাতি দেখার দায়িত্বের বিনিময়ে মতিজানের সাথে বিয়ে হয় কাশেম আলীর। কিন্তু এর সাথে মামলা আর মায়না পাখিরই-বা কী সম্পর্ক কী—বুঝে উঠতে পারে না বজলু। বজলুর সাথে সাথে কৌতুহল চাঙা হয় মোমেনারও। তবু মোমেনা স্মরণ করিয়ে দেয় বজলুকে, ‘হারিকেনের ত্যাল কিন্তুক শেষ হইয়া আসতাছে।’
বজলু বলে, 'এই তো আর বেশি বাকি নাই। ঘটনা তো শুরু হইব এখনই।’
ঘটনা এই যে কাশেম মতিজানকে নিয়ে তার শ্বশুর ওসমান গনির ব্যবসা-বাণিজ্য দেখতে থাকে। দিনের পর দিন যায়। অনেক দিন পর কাশেম আলী স্বপ্নে দেখে তার বড় ভাই জেকের আলী তার কোনো খোঁজ না পেয়ে আকুল হয়ে কাঁদছে। তখন কাশেম আলী খবর ওসমান গনির অনুমতি নিয়ে মতিজান এবং তার পোষা ময়নাকে নিয়ে রওনা দেয় তার নিজের বাড়িতে বড় ভাই জেকের আলীর সাথে দেখা করতে। বাড়ির কাছে পৌঁছাতে রাত হয় তাদের। রাতে নদী পার হবার জন্য নৌকা নেয় তারা। মাঝনদীতে নৌকার দুই মাঝি কাশেমের কাছ ঠেকে টাকা পয়সা সব কেড়ে নিয়ে তাকে নদীতে ফেলে দেয়। এরপর মতিজানকে তারা তাদের বাড়ি নিয়ে গিয়ে ভোগ করবে এই ফন্দি আঁটে। মতিজান আকুল কান্নায় তাদের কাছ থেকে মুক্তি চায়। এ সময়ই নদীতে ওঠে ঝড়। নৌকার হাল ভেঙে যায়। মাঝিরা আর নৌকার দিক ঠিক রাখতে পারে না। নৌকা শেষ পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে কাশেমের বড় ভাই জেকের আলীর ঘাটেই। জেকের আলী তাহাজ্জতের নামাজ পড়ে গভীর রাতে ঘাটে এলে দুই মাঝি আর মতিজানকে দেখতে পায়। মতিজান তখন প্রায় জ্ঞানহারা। নৌকার ভেতর থাকা কথা বলা ময়না পাখি কাশেমের বড় ভাই জেকের আলীকে তখন চিনতে পেরে ডাক দেয় এবং ঘটনার বিবরণ দেয়। ময়না পাখির কাছে সব ঘটনা শুনে জেকের আলী তখন চৌকিদারকে ডেকে এনে দুই মাঝিকে আটক করে। মতিজানকে নিয়ে আসে বাড়িতে। ঘটনার পাকচক্রে দেখা যায় নদীতে ফেলে দেওয়া কাশেম আলীও ঝড়ের ভেতর সাঁতার কেটে চলে এসেছে জেকের আলীর ঘাটে। কাশেম আলী, জেকের আলী আর মতিজানের মিলন হয় । তারপর দুই মাঝিকে সােপর্দ করা হয় আদালতে। কিন্তু মাঝিরা তাদের সব দোষ অস্বীকার করে। এই সময় গল্পের ক্লাইমেক্স দেখা দেয়। ময়না পাখি তখন বলে সে হবে এই মামলার সাক্ষী।
মামলা জজকোর্টেতে, মামলা জজকোর্টেতে লােক জোটে হাজারে হাজার।
ময়না পাখি দিবে সাক্ষী শুনেন চমৎকার।
পাখি সাক্ষী দেয়, পাখি সাক্ষী দেয় বলে যায় ইংরাজিতে বাণী।
হাকিম বাবু হলাে তাজ্জব পাখির বুলি শুনি।
তারপর বাংলায় পড়ে, তারপর বাংলায় পড়ে জিজ্ঞাস করে যতেক বিষয়।
বাংলাতে ইংরাজিতে মিলে পাখি সবই বলে যায়।
কবিতা ইতি হইল, কবিতা ইতি হইল রায় লিখিল, জজ সাহেব তখন।
দুই মাঝির কারাদণ্ড হলাে যাবৎ জীবন।
ধন্য পাখির ভাষা, ধন্য পাখির ভাষা শুনতে খাসা খুশি সর্বজনে—
পাখিকে করিল দান যাহার যা আছে প্রাণে।
দেখলাম একুনেতে, দেখলাম একুনেতে হইবে তাতে টাকা নয় হাজার।
ধন্য ধন্য ময়না পাখি শুনেন সমাচার…।
ময়না পাখির আশ্চর্য এই কেরামতিতে মেমেনা বিস্মিত হয় সে রাতে। ক্ষণিকের জন্য ভুলে যায় কেরােসিনের অভাব। বাতি নিভিয়ে পরস্পরকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকে তারা।
এই পুঁথি পড়বার পরদিনই বজলু গাছ থেকে পড়ে তার পা ভাঙে। উপজেলা হাসপাতাল ঘুরে আসে ঢাকার হাসপাতলে। তারপর হাসপাতালের এক বিচিত্র নাটকীয় পরিস্থিতির ভেতর ঢুকে গিয়ে একসময় হাসপাতালের করিডরেই তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এই তন্দ্রার মধ্যেই কি তার ফুরিয়ে যাওয়া কোরােসিন তেল, কৃষ্ণচূড়াগাছের মগডালে দেখা পাওয়া ভুবন চিল, মতিজানের নৌকা, নদীতে ঝড়, জেকের আলীর ঘাট, ইংরাজি বলতে পারা ময়না পাখি ইত্যাদি সব তালগােল পাকিয়ে যায়?
ঠিক সেই সময়ই কি বজলুর মনের খুব গভীর থেকে মাথা তোলে আদিম সরল কোনো মানব অথবা অতি দক্ষ এক প্রতারক? এমন দু’জনই কি বস্তুত বজিলুর অজান্তে ঘুমিয়ে ছিল তার ভেতর? কিম্বা তারা ঘুমিয়ে থাকে আমাদের সবার ভেতরেই?
কে একজন ধাক্কা দিলে বজলুর তন্দ্রা ভাঙে। চোখ খুলে বজলু দেখতে পায় তার দিকে তাক করা বন্দুকের মতো একটা ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন। মাইক্রোফোন ধরা লোক তাকে জিজ্ঞাসা করে, আপনি কি প্লাজা ফ্যাক্টরির রোগী?
বজলু বলে, হ্যাঁ।
মাইক্রোফোনের লোক, আপনি কি ফ্যাক্টরির শ্রমিক?
বজলু, না।
মাইক্রোফোনের লোক, তাইলে?
বজলু বলে, আমি ফ্যাক্টরির এক মাইয়ারে বাঁচাইছি।
মাইক্রোফোনের লোক, কী হইসিল বলেন তো।
ইতিমধ্যে আরও অনেকগুলো ক্যামেরা, মাইক্রোফোন বজলুর মুখের ওপর এসে দাঁড়ায়।
কেউ একজন সম্ভবত কোনো একদিন বলেছেন, কবিতা হচ্ছে সেই মিথ্যা যা সত্যকে বুঝতে সহায়তা করে। বজলু এই সময় তেমন এক কবিতায় রচনা ব্রতী হয়।
বজলু বলে, সে আসলে এই শহররের এক রিকশাচালক। এক যাত্রীকে নামিয়ে সে ওই প্লাজার পাশের এক রাস্তায় তখন বিশ্রাম করছিল। হঠাৎ সে একটা বিকট শব্দ শুনতে পায়। ভাবে কোথাও বোমা ফাটল বুঝি। তারপরেই দেখে রাস্তার পাশের সেই বহুতল ফ্যাক্টরিটা ধসে পড়ছে। চারিদিক ধোঁয়ায় ধোঁয়াকার হয়ে পড়ে। বহু মানুষের সঙ্গে সে-ও ছুটে যায় সেখানে। সেখানে দাঁড়িয়ে সে ঘটনা দেখতে থাকে। কিছুক্ষণ পর সে দেখতে পায় ফ্যাক্টরির দক্ষিণ কোনায় কিছু মানুষ কারখানার শ্রমিকদের উদ্ধার করার চেষ্টা করছে। বজলু চুলে যায় সেখানে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় উদ্ধারকাজে। সেখানে তারা কংক্রিটের স্তূপের ভেতর একজন নারী শ্রমিকের কান্না শুনতে পায়। বজলু তখন রড, বিম, ইটের ফাঁকফোকর দিয়ে নেমে পড়ে সেই ধ্বংসস্তূপের ভেতর যেখানে আটকে আছে মেয়েটা। দেখতে পায় মেয়েটার একটা হাত বিশাল এক বিমের নিচে আটকা পড়ে আছে। মেয়েটাকে বাঁচাতে হলে তার হাতটা কাটতে হবে। বজলু ওপরে উঠে এলে উদ্ধারকাজে নিয়োজিত এক ডাক্তার তাঁকে বলেন সে মেয়েটার হাত কাটতে পারবে কি না। বজলু রাজি হয়। ডাক্তার তাঁকে একটা রড কাটার করাত আর সিরিঞ্জে ব্যথানাশের ওষুধ দিয়ে আবার ধ্বংসস্তূপের ভেতর পাঠান। বজলু রড, বিম, ইটের ফাঁক দিয়ে আবার ঢুকে যায় ধ্বংসস্তূপের নিচে। সেখানে গিয়ে সে মেয়েটাকে ইনজেকশন দেয় এবং তারপর করাত দিয়ে মেয়েটার হাত কাটে। এরপর সে মেয়েটাকে টেনে ধ্বংসস্তূপ থেকে তুলে পাঠিয়ে দেয় ওপরে উদ্ধারকারীদের হাতে। কিন্তু তারপর নিজে যখন সে সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে আসতে গেছে, তখনই একটা বড় কংক্রিটের বিম তার পায়ের ওপর পড়ে এবং তার পায়ের হাড় ভেঙে যায়। এরপর কারা কখন তাঁকে এই হাসপাতালে নিয়ে এসেছে, সে আর বলতে পারে না।
একটানা এই কবি কাহিনি বলে যায় বজলু। তার কাছে এই কাহিনি শুনবার পর সাংবাদিক, ডাক্তার সবাই তৎপর হয়ে ওঠে বজলুকে নিয়ে। তাঁকে করিডর থেকে ওয়ার্ডের ভেতর একটা বেডে নেওয়া হয়। মোমেনা বিস্ময়ে বজলুকে লক্ষ করে। কানে কানে বলে, তুমি কী কও এই সব?
কিছু বলে না বজলু। তবে কি বজলু নিরীহ গাছি নয়? গাছের চূড়া থেকে পৃথিবীকে দেখতে দেখতে সে হয়ে উঠেছে গভীর চিন্তক। সে জেনে গেছে মানুষ অবিরাম সুতার ওপর দিয়ে হাঁটে—যার একদিকে থাকে সত্য, অন্যদিকে মিথ্যা। সে জেনে গেছে, পরিস্থিতি মোতাবেক সত্য নির্মাণ করা প্রতিভাবানদেরই কাজ।
পরদিন পত্রিকায় প্লাজা ফ্যাক্টরির বীর নামে সংবাদ ছাপা হয় বিভিন্ন পত্রিকার পাতায়। নিজের জীবন বিপন্ন করে যাঁরা বহু শ্রমিকের জীবন রক্ষা করেছেন, তাঁদের কাহিনি ছাপা হয়। সেখানে বজলুর নাম ও ছবি ছাপা হয়। পোশাক মালিক সমিতি, সরকার, বাংলাদেশের পোশাকের অন্যতম ক্রেতা প্রাইমার্ক কাম্পানি বজলুসহ এই বীরদের লাখ লাখ টাকা পুরস্কার দেবার ঘোষণা দেয়। সব মিলিয়ে বজলুর কাছে বিশ লাখ টাকার চেক আসে। উদ্ধারকাজ পরিচালনাকারী সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে বজলু এবং মোমেনার নামে ব্যাংক একাউন্ট খুলে সেই টাকা জমা রাখা হয়।
মোমেনা বাকহীন দর্শকের মতো ব্যাপার দেখতে থাকে। মোমেনা আর বজলু নিজেদের ভেতর এ নিয়ে আর কথা বলে না।
ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে বজলু। হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয় তাকে। তারপর একদিন বজলু ফিরে যায় নিশানদিয়া গ্রামে। যাবার আগে কর্তৃপক্ষ তাকে তার ব্যাংক হিসাব বুঝিয়ে দেয়।
নিশানদিয়া গ্রামের লোকেরা দেখতে পায় বহুদিন পর ফিরে এসে বজলু তার গ্রামের কাঁচা বাড়িটাকে ভেঙে পাকা একতলা দালান করেছে। দেখতে পায় বজলু গাছির কাজ ছেড়ে হাটে একটা কাপড়ের দোকান দিয়েছে। তার বাড়িতে পল্লী বিদ্যুৎ এসেছে। নিশানদিয়া গ্রামের লােকেরা টেলিভিশনে প্লাজা ফ্যাক্টরির দুর্ঘটনার খবর পেয়েছে, তারপর আবার তা ভুলেও গেছে। তারা তাদের পেঁয়াজ চাষ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া প্লাজা ফ্যাক্টরির ঘটনার সাথে বজলুর কোনাে যােগসূত্রের কথা তাদের ভাবনায় আসেনি। তারা শুধু অবাক হয়ে দেখেছে নারকেলগাছ থেকে পড়ে পা ভেঙে ঢাকায় যাবার পর বজলুর কপাল খুলেছে। তারা তার এই কপাল খুলে যাবার রহস্যের কথা ভাবে ঠিকই, কিন্তু সেই রহস্যের কূল খুঁজবার জন্য তেমন ব্যাকুল হয় না। মােমেনা নিজের জন্য নতুন কানপাশা কেনে, মেয়ে শিল্পীর জন্য কেনে দামি জামা, গলার সােনার হার।
মােমেনা ও বজলু পরস্পরের ভেতর প্লাজা ফ্যাক্টরির ঘটনা বিষয়ে এক আশ্চর্য নীরবতা পালন করে।
তবে প্লাজা ফ্যাক্টরির দালান ধসের গভীরে নীরবে প্রচ্ছন্ন থাকা পুঁজির দৌরাত্ম্য, মুনাফার প্রকট লােভ, ক্ষমতার কারসাজির পাশে মােমেনা আর বজলুর এই কপট নীরবতা তুল্যমূল্য কি না, তা ভেবে দেখা যেতে পারে।
একদিন বজলু হাটে গিয়ে দেখা করে কবি আবদুল করিমের সাথে। বলে, ‘করিম ভাই, তুমি একটা নতুন পুঁথি লেখাে প্লাজা ফ্যাক্টরির গল্প নিয়া, আমি তােমারে প্লাজা ফ্যাক্টরির এক গল্প শােনাই।'
অভিনব বিষয়ে পুঁথি লেখায় বরাবরের আগ্রহ আবদুল করিমের। বজলুর গল্প শুনে কবি আবদুল করিম নতুন পুঁথি লেখে :
শােনেন বন্ধুগণ দিয়া মন আশ্চর্য ঘটনা, রিকশাওয়ালা মাতওয়ালা করে অপারেশন প্লাজা ফ্যাক্টরিতে। প্লাজা ফ্যাক্টরিতে দিনে রাতে মেশিন চলে ভারী। সেই মেশিনে পােশাক বানায় কত নর-নারী। পােশাক চলে যায়, পােশাক চলে যায় আমেরিকায় আরও কত দেশে, পুরুষ-নারী কাজে যায় সবাই হেসে হেসে। একদিন দেখতে পায়, একদিন দেখতে পায় হায় হায় দেয়াল গেছে ফেটে। তবু মালিক বলে যেতে হবে কাজে হেঁটে হেঁটে কোনাে মাফ নাই। কোনাে মাফ নাই কাজ চাই এতেক বলিয়া, প্লাজার মালিক রানা মিয়া বাড়ি যায় চলিয়া। তারপর কী ঘটিল…
পরের হাটে পাওয়া যায় আবদুল করিমের প্লাজা ফ্যাক্টরি পুঁথি। বজলু সেই পুঁথি কিনে আনে। কিন্তু মােমেনাকে সে তা পড়ে শােনায় না। তারা এ বিষয়ে নীরবতা পালন করবে মােমেনা আর বজলুর ভেতর যেন এক অলিখিত চুক্তি হয়ে আছে।
দিন যায়। আমরা ঠিক জানি না প্লাজা ফ্যাক্টরির ঘটনা বজলু তার মনের ভেতর কীভাবে মােকাবিলা করছে ।
তারপর বছর তিন পর হঠাৎ নিশানদিয়া গ্রামে একদিন ক্যামেরা, মাইক্রোফোন নিয়ে হাজির হয় এক টিভি চ্যানেলের গাড়ি। টিভির সাংবাদিক হাটের লােকেদের বলে তারা এই গ্রামে প্লাজা ফ্যাক্টরির ঘটনার এক ভুয়া বীরকে খুঁজতে এসেছে। গ্রামে টেলিভিশনের লােকের আসার এই খবর শুনে বজলু নিশানদিয়া গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তের তার বাড়ির বিছানায় শুয়ে পড়ে। শােবার আগে স্ত্রী মােমেনাকে ডেকে কানে কানে কিছু একটা বলে। খাটের নিচে ঠিক তখন তার বাড়ির মুরগিটা ডিম প্রসব করে ধীর পায়ে খড়ের ঝাকা থেকে বেরিয়ে এসে চিৎকার করে তার সদ্য প্রসবযন্ত্রণা লাঘবের ঘােষণা দেয় ‘কক কক কক'। বজলু কি এই দিনটার জন্যই অপেক্ষা করছিল এত দিন?
টিভি চ্যানেলের গাড়ি বজলুর বাড়িতে এসে থামে। সাংবাদিক ক্যামেরা বজলুর দিকে তাক করে জিজ্ঞাসা করেন, আপনার নাম কি মােহাম্মদ বজলু?
বজলু শুয়ে থাকে, কোনাে কথা বলে না।
সাংবাদিক : আপনে উত্তর দেন না কেন?
বজলু তখনাে নিশ্চুপ থাকে।
সাংবাদিক : প্লাজা ফ্যাক্টরির দুর্ঘটনায় কী ঘটছিল সে ব্যাপারে আমাদের জানার আছে। আপনি তখন আমাদের বলছিলেন যে আপনে রিকশা চালান, আপনে কোন গ্যারেজের রিকশা চালাতেন ?
বজলু সাংবাদিকের দিকে তাকিয়ে থাকে কিন্তু কোনাে কথা বলে না।
সাংবাদিক তার স্ত্রী মােমেনাকে জিজ্ঞাসা করে, কী ব্যাপার, উনি কথা বলছেন না কেন?
মােমেনা বলে, তার তাে এক সপ্তাহ হইল জবান বন্ধ । গন্ডপাশা গ্রামের কবিরাজরে খবর দিছি।
বজলু তার রহস্যময় মৌনতার মাধ্যমে কি বস্তুত প্লাজা ফ্যাক্টরির ঘটনাপরম্পরাকে কালের গর্ভে ছুড়ে দেওয়ার পাঁয়তারা করছে?
নাকি সে আসলে এই সাংবাদিককে কৃতজ্ঞতা জানাবার জুতসই ভাষা খুঁজে না পেয়ে নির্বাক হয়ে আছে। কথা সত্য যে এই সাংবাদিক বজলুকে এই অভিনয় মঞ্চ থেকে অব্যাহতি দেবার একটা সুযােগ এনে দিয়েছে।
আমাদের পক্ষে জানা দুষ্কর-- বজলুর মনের ভেতর তখন আসলে কী রসায়ন চলছে ।
1 মন্তব্যসমূহ
নামটাই টেনে নিয়ে গিয়েছিল গল্পে। বাহ্।
উত্তরমুছুন