আমার পরিচিত একটি মানুষের একদিন খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যায়, এত ভোরে সে সাধারণত ওঠে না। তিনতলার জানালার বাইরে দিনের কোলাহল তখনও শুরু হয় নি, কিন্তু সে শব্দ পেল বৃষ্টির। হেমন্তের শেষ, এখন বৃষ্টি হবার কথা নয়। সে ভাবল ভালই হল, গাছের পাতায় জমা কয়েক মাসের জমাট ধুলো ধুয়ে যাবে।
অথচ সে যখন অফিসের কাজে বাড়ি থেকে বের হল রাস্তা ছিল শুকনো খটখটে। অফিসের সবাই বলল তারা বৃষ্টি দেখে নি, তার পাড়ায় বৃষ্টি হয়েছে শুনে তারা আশ্চর্য হল। অফিসে যেয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সে অভীককে ফোন করল। অভীক ফোন ধরল না, ঘুমাচ্ছিল। সে ভাবল সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে সে প্রতিবেশীকে জিজ্ঞেস করবে, কিন্তু সেদিন অফিস থেকে ফিরে সে ভুলে যায় জিজ্ঞেস করতে।
যে ঘরটিতে সে শুয়ে ছিল তার দেয়ালগুলোতে চুনকাম হয়েছে বেশি দিন হয় নি, রঙের গন্ধ এখনও ভেসে আছে। ঘরে দুটি দরজা। একটি দিয়ে খুব ছোট একটা বসার ঘরে যাওয়া যায়, আর একদিকে বারান্দায়। বারান্দাটা ছোট, সেখানে আমার পরিচিত মানুষটি টবে টোমেটো আর মরিচের চারা লাগিয়েছে। বারান্দায় দাঁড়ালে তিন তলা নিচে রাস্তাটা দেখা যায়। এই রাস্তায় গাড়ি সেরকম চলে না, কারণ দক্ষিণ দিকে কিছুটা যেয়ে সেটা শেষ হয়ে গেছে। এদিক দিয়ে বের হবার উপায় নেই। ঘরের উত্তর দিকে একটা দরজা দিয়ে খুব ছোট একটা রান্নাঘরে যাওয়া যেত, সেটা বন্ধ করে দিয়ে একটা বড় আলমারি। বাইরের ঘর থেকে রান্নাঘরে যাওয়া যায়। দক্ষিণ দিকে জানালাবিহীন দেয়াল। সেখানে একটা বড় ছবি আগে ঝোলান ছিল, চিত্রকর্ম। কিছুদিন আগে যখন ঘরটা রঙ করানো হয় তখন চিত্রকর্মটি নামিয়ে রাখা হয়েছিল, এখনো লাগানো হয় নি।
ঘরের দেয়ালগুলোর রঙ খুবই হালকা একটা গোলাপি, এত হাল্কা যে মনে হবে আবছায়া একটা রঙ মনে খেলা করছে কিন্তু তাকে ধরা যাচ্ছে না। কেন নতুন রঙ করা হয়েছে সেটা একটা প্রশ্ন, হয়তো ঘরে যারা থাকে তারা নতুন করে জীবন শুরু করতে চেয়েছিল। একটি খাট, তাতে আতিশয্য নেই, সে এবং অভীক রাতে তাতে শোয়।
পরদিন দুপুরবেলার দিকে অভীক তাকে ফোন করে বলে, আমি তোমাকে অফিসে যাবার সময় আমাকে জাগিয়ে দিতে বলেছিলাম। খাবার টেবিলে আমার চিরকুট দেখ নি? রেবা দেখে নি।
রেবার সঙ্গে দেখা হলে এই কথাগুলোয় সে আমায় বলে। বলে, দিলু, আমি কি আমার জগৎটাকে হারিয়ে ফেলছি। আমাকে এভাবেই কথা বলে রেবা, ও পৃথিবীটাকে অন্য চোখে দেখে। আমার নাম দিলারা, রেবা আমাকে সেই কবে থেকে দিলু নামে ডেকে বন্ধুত্বটাকে পাকাপোক্ত করেছে। ও বলে, জানিস দিলু, আমি যখন অফিস যাই, ঘরটা ছেড়ে যখন বের হই, অভীক তখনও ঘুমায়, কিন্তু যত দরজার দিকে এগোই ততই অভীক খাটশুদ্ধ ছোট হয়ে যেতে থাকে, আর দরজা পার হয়ে বসার ঘর থেকে যখন পেছন ফিরে দেখি তখন খাটটা একটা বাচ্চাদের খেলনার খাট হয়ে গেছে, তাতে ছোট একটা পুতুল হয়ে অভীক শুয়ে আছে। আর ফ্ল্যাটের বাইরে এসে দরজায় তালা দিতে দিতে মনে হয় অভীক আর নেই। খাটসহ মিলিয়ে গেছে শূন্যে। কিন্তু আমার মনে হওয়াটা যদি পাছে সত্যি হয়ে যায় এজন্য আবার দরজা খুলে ভেতরে যাই না।
রেবার কথা শুনে আমার শরীর হিম হতে থাকে। রেবার জগৎ একটা অসীম সম্ভাবনার জগৎ, সেখানে যে কোনো কিছু ঘটতে পারে, এত ক’টা বছর ওকে দেখে এটা বুঝতে পেরেছি। রেবা বলে, তারপর অফিসের পথে অফিসের গাড়ি থেকে ফোন দিই, অভীক ফোন ধরে না, তখন নিশ্চিত হই যে অভীক নেই, ঘরের সব জিনিসপত্রসহ অদৃশ্য হয়েছে। এরকম ঘন্টাখানেক আমার মনে হত থাকে যে অভীক নেই, তারপর মনে হয় ও ফিরে এসেছে। অফিসে যেয়ে আবার ফোন করি, ও ঘুম-জড়ানো কন্ঠে ঊত্তর দেয়।
রেবার দিকে চেয়ে থাকি, ওর চোয়ালের হাড়দুটো গাল থেকে নেমে তীক্ষ্ণ না হয়ে ছড়িয়ে গেছে ওর মুখমণ্ডলকে একটা চতুষ্কোণ – মাধুর্যপূর্ণ – রূপ দিয়ে। জিজ্ঞেস করি, অভীক কি কাজে ফিরে যেতে পেরেছে? না, দীর্ঘশ্বাস ফেলে রেবা, বলে, ও এখনো তৈরি নয়। কতমাস হয়ে গেল, ভাবি আমি। শহরের একটা ছোট রেস্তোরায় বসে আমরা দুজন কফি খাই। কর্মজীবী মধ্যবিত্ত নারীরা এই রেস্তোরায় আসে না, তাই বেয়ারা বারে বারে আমাদের টেবিলের সামনে দিয়ে ঘুরে যায়। আশেপাশের টেবিলে থেকে, আড়ালে আবডালে নয়, পুরুষেরা সরাসরিই আমাদের দিকে তাকায়, দুটি নারীকে এ’ভাবে স্বস্তিতে গল্প করতে দেখা তাদের সয় না। কিন্তু স্বস্তি আমার হয় না, ভাবি এদের যদি রেবার দৃষ্টি দিয়ে ছোট লিলিপুট করে দিতে পারতাম। তেল চটচটে প্লাস্টিকে ঢাকা থাকে আমাদের টেবিল, তাতে কটকটে লাল রঙের ফুল।
২.
সে রাতে অভীক যখন ফেরে তখন রেবা ঘুমায় অঘোরে খাটের বাঁদিকে। পাশ ফিরে। অভীক শুয়ে পড়ে পাশে। গ্রীষ্মের রাত, মাথার ওপর ফ্যান ঘোরে, সব মশা তাড়িয়ে অভীকের চুলকে এলোমেলো করে রাখে তার হাওয়া। মশারি টাঙ্গাতে ভালবাসে না রেবা, ভালবাসে না অভীকও। অন্ধকারে, দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকে অভীক, ঘুম আসে না অনেকক্ষণ, প্রতিটি রাতের মত, চাপা ব্যথার স্নায়ুর সঙ্কেত নিয়ে একটা লিলিপুট মাথার এ পাশ থেকে ও পাশে যায়। স্মৃতি! বিস্মৃত হতে চায় অভীক। অবশেষে ঘুমিয়ে পড়ে, তারপর অল্প ঠাণ্ডায় জেগে ওঠে, হাত বাড়িয়ে পায়ের নিচে রাখা চাদরটা তুলে নিয়ে গায়ে দিতে চায়। তখনই চোখে পড়ে রেবা খাটের অন্যদিকের দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে, দেয়ালের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে রেবা। সেই দাঁড়ানো অপার্থিব, আরো শীতল হতে থাকে অভীক, আতঙ্ক ও শীতলতার মিশ্রণে তার গায়ের প্রতিটি লোম দাঁড়িয়ে যায়, শরীর কাঁপে তার। হাল্কা গোলাপি দেয়ালে একটা জ্যামিতিক আকার রূপ নিচ্ছে, একটি চতুষ্কোণ আয়তক্ষেত্র আবির্ভূত হচ্ছে। জানালার মত, কিন্তু সম্পূর্ণ কালো। একটা আলকাতরার পলেস্তরা দিয়ে ঢাকা আয়াতক্ষেত্র, তার পৃষ্ঠদেশ দুলছে। দারুণ নিদাঘে রাস্তার পিচ যেমন ফুলে ফেঁপে ওঠে, তার থেকেও প্রবল উন্মত্ততায় সেই কালো আঁঠালো বস্তু ঢেউয়ের মত আছড়ে পড়ে আয়তক্ষেত্রের চারদিকে। আয়তক্ষেত্রটি বড় হতে হতে একটি দরজার আকার নেয়। রেবা এই পুরো সময়টা জুড়ে কালো চতুষ্কোণের সামনে অপেক্ষা করে ধৈর্য ধরে, পৃথিবীর সমস্ত সঙ্কেতকে উপেক্ষা করে। তারপর দরজাটা সম্পূর্ণ হলে সে ঢুকতে থাকে উন্মত্ত আলকাতরার মধ্য দিয়ে দেয়ালের মধ্যে। ঢুকতে ঢুকতে রেবার অন্তর্বাস খুলে পড়ে যায় দেয়ালের এ’পাশে।
আতঙ্কের চাইতে যে বোধটি অভীককে গ্রাস করে তা হলে এক ধরণের বিস্ময়। বিপন্ন বিস্ময়। সে ঘুমিয়ে আছে কিনা বুঝতে পারে না, স্বপ্ন ভেবে নিজেকে জাগাতে চেষ্টা করে, কিন্তু তাতে কোনো কিছুরই পরিবর্তন হয় না, সে চিৎকার করে রেবাকে ডাকতে চায়, শুধু অস্ফূট গোঙানী বের হয় গলা দিয়ে। বিছানা ছেড়ে উঠতে চেষ্টা করে, কিন্তু দেহ মনের আদেশ মানে না। পক্ষাঘাতে পর্যুদস্ত হয়ে সে সিলিংয়ের ফ্যানের ঘূর্ণন দেখে, সেই ঘুর্ণন সময়ের ধারাকে পাক খাওয়ায়, অভীক বুঝতে পারে না কত সময় চলে যায়, তার দৃষ্টি একবার ফ্যান, আর একবার দেয়ালের আলকাতরার দরজার দিকে যায়। দেয়ালে নতুন দরজার গায়ে আলকাতরার সমুদ্র তখনও ফুঁসছে, এক ক্রুদ্ধ জন্তু যেন শান্তি পাচ্ছে না।
এরকমভাবে কতক্ষণ গেল অভীক বলতে পারে না, সে তার পক্ষাঘাতকে যখন মেনে নিচ্ছিল তখন দেয়ালের কালো জীবন্ত দরজা দিয়ে এক নারী বেরিয়ে আসতে থাকে। অদ্ভূত আতঙ্কে অভীক দেখে নারীর হাত, মাথা, স্তন, উরু, তারপর পা ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করে। বেরিয়ে এসে দেয়ালের সঙ্গে সেঁটে দাঁড়িয়ে থাকে নারী, তার সারা শরীর থেকে কালো আলকাতরার মত আঁঠালো জিনিসটা গড়িয়ে গড়িয়ে নিচে পড়তে থাকে। আধো অন্ধকারে তার অবয়বকে বুঝে ওঠার চেষ্টা করে অভীক। অবশেষে তার মনে হল সেই নারী হল রেবা, শুধু এই রেবা আজকের নয়, ত্রিশ বছর আগে যেরকম দেখতে ছিল রেবা, যে রেবাকে অভীক কোনোদিন দেখে নি, তার চতুষ্কোণ চোয়াল মুখমণ্ডলের মাধুর্য ধরে রেখেছিল। এই রেবার তরুণ দেহে কোনো কাপড় ছিল না।
অভীকের চেনার অপেক্ষায় যেন এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল যুবতী, দেয়ালের এ পাশে মাটিতে পড়া অন্তর্বাসটি সে তুলে নিল, জানালা দিয়ে যেটুকু আলো আসছিল তাতে অতীতের রেবার মুখে বিস্ময় দেখল অভীক। এই অন্তর্বাসটি যুবতী যেন প্রথম দেখছে। কিন্তু সেই বিস্ময় ছিল মুহূর্তখানেকের জন্য। তারপর অন্তর্বাসটি মেঝেতে রেখে অভীকের দিকে পিঠ ফিরিয়ে বিছানায় বসল, মিনিটখানেক এভাবে যাবার পর টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল। তারপর পাশ ফিরে অভীককে জড়িয়ে ধরল। যুবতী রেবার দেহ ছিল উষ্ণ, কালো আলকাতরার কোনো চিহ্ন ছিল না আর তার দেহে, কিন্তু কালো জিনিস তার উষ্ণতা রেখে গিয়েছিল। যুবতীর ঠোঁট খুজে নিল অভীকের ঠোঁট, যুবতীর জিভ অভীকের জিভে জড়ালো। তার পা উঠল অভীকের দেহের ওপরে। অভীক ধীরের ধীরে জেগে ওঠে, যুবতী রেবাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে, কিন্তু রেবা অভীকের দেহের ওপর উঠে বসে, এক সুঠাম ঘোড়সোয়ার তার ঘোড়ার জিনে বসে, তার ঘন কালো চুলের এক অংশ এসে পড়ে ডান স্তনের ওপর আর এক অংশ থাকে পিঠে, বাঁ স্তনকে উন্মুক্ত করে। অভীকের বুকের লোমে তার দুটি হাত থাকে, লোমের বন আলতো করে সমান করতে থাকে যেন বহু আগে হারিয়ে যাওয়া কোনোকিছু সেখানে খুঁজে পাবে সে। অভীককে নিজের করে নিয়ে দেহ দোলে তরুণী রেবার। সময় থেকে সময় পার হয়ে অভীকের মনে যে রেবার স্মৃতি ছিল – ওই রেবা ঘোড়সোয়ার ছিল না, ওই রেবার প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল দ্বিধান্বিত, ওই রেবা স্বপ্রণোদিত হয় কোনো শৃঙ্গারের সূচনা করে নি। সব শেষ হলে ঘোড়া থেকে নেমে পাশে শুয়ে পড়ে ঘোড়সোয়ার, বিস্মিত অভীক কথা বলতে চায়, কিন্তু তার আগেই এক গভীর ঘুম তাকে অতল অন্ধকারে টেনে নিয়ে গেল।
সকালে ঘুম ভাঙলে পাশে কাউকে দেখে না অভীক। রেবা অফিসে চলে গেছে? অভীক রেবাকে ফোন করে, জিজ্ঞেস করে, কাল রাতে কী হয়েছিল? রেবা উত্তর দিতে পারে না, শুধু বলে কী হয়েছিল? অভীক ফিসফিস করে নিজেকে বলে, আমি কি উন্মত্ত হয়েছি? তারপর ফোন রেখে দেয়। অভীকের মনে পড়ে রাতে সে এক গভীর খাদে তলিয়ে গিয়েছিল।
৩.
আমার নাম রেবা। কয়েক মাস হল আমি কে সেটা বোঝার চেষ্টা করছি।
সে রাতে আমি নিজেকে আবিষ্কার করি বিছানা ছেড়ে দক্ষিণ দিকের দেয়ালের সামনে। আধো অন্ধকারে দেয়ালের নতুন গোলাপী রঙটা যেন চক্র হয়ে ঘুরছিল, তার মধ্যে জন্ম নিচ্ছিল নীল, লাল, হলুদ রঙ আর আলো। তারপর সব রঙ মিলিয়ে যেতে থাকল একটা অন্ধকারে। ফুটে উঠল একটা কালো জানালা। গলিত আলকাতরার জানালা, জীবন্ত, ফুঁসছিল সে ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ সাগরের মত, উঠছিল বড় ঢেউ। জানালা বড় হতে হতে একটা দরজার সমান হয়ে যায়। সম্মোহিত হতে থাকি আমি, তবু মনে থাকে সব। সেই উন্মত্ত দেয়াল মহাকর্ষের টানে আমাকে আকর্ষণ করে, আমি তাতে আত্মসমর্পণ করি। ধীরে ধীরে দেয়ালের গলিত আলকাতরার মধ্যে ঢুকি। তার মধ্য দিয়ে গলে যাওয়াটা যেন ছিল মাখনের মধ্য দিয়ে হাঁটা, ইট-সিমেন্ট, কাঠ-লোহা কিছুই ছিল না। দেয়ালের ওপাশে বের হলাম, এমনই যেন হবার কথা, এতে আশ্চর্য হই না।
সেই ঘরে ঢুকে দেখলাম একটি ছোট ছেলে বসে আছে একটা টেবিলের পেছনে। তখনই খেয়াল হয় আমার গায়ে কোনো কাপড় নেই, শুধু আমার নগ্ন শরীর দিয়ে নিচে নেমে যেতে থাকে আলকাতরার মত কালো আঁঠালো বস্তুর গলিত ধারা। পাশে একটা আলনা ছিল, তাতে একটা চাদর ঝুলছিল, সেটা টেনে নিয়ে গা ঢাকলাম। আমি কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে চিনতে পারলাম। শান্তনু আমার ছোট ছেলেটা। শান্তনু বলল, মা এই অঙ্কটা পারছি না। সতেরোর সঙ্গে ঊনিশ যোগ করতে হবে। আমি কাছে গিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। বললাম, তুমি এসব অঙ্ক সহজেই করতে পার। শান্তনু আমার দিকে চাইল। ওর ছোট মুখের অসহায়তা দেখে আমার বুকটা হু হু করে উঠল, বললাম, দেখ কত সহজেই এই যোগটা করে। এই বলে ওকে যোগটা দেখিয়ে দিলাম। তারপর হঠাৎ খেয়াল হল শান্তনুর পেছনে একটা খাট, সেখানে কেউ শুয়ে আছে। আর একটু এগিয়ে দেখলাম যে শুয়ে আছে তাকে চেনা লাগছে। অভীক? এই অভীক খুবই তরুণ। অভীক বলল, আমি অভীক, কিন্তু এই অভীককে তুমি দেখ নি। তুমি যে অভীককে প্রথম দেখেছিলে তার থেকেও আমি তরুণ। এখানে এসে বস। আমি যেয়ে ওর পাশে বসলাম। ও বলল, এসো আমরা প্রেম করি। আমি বললাম, প্রেম করব কী করে, শান্তনু বসে আছে এখানে। ও বলল, শান্তনু? শান্তনু তো নেই, শান্তনু তো কবেই চলে গেছে। সত্যিই টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখলাম শান্তনু নেই। শান্তনু তো কবেই চলে গেছে। একটা ভীষণ যন্ত্রণায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম। অভীক খাটে বসে আমাকে জড়িয়ে ধরে, বলে, যন্ত্রণা পেও না, শান্তনু ভালই আছে। আমি অভীকের পাশে শুয়ে পড়তে পড়তে বিড়বিড় করে বলি, শান্তনু ভালই আছে।
৪.
অফিসটা নতুন পাড়ায়। তবে এই শহরে নতুনত্ব বেশীদিন থাকে না। এগারো তলায় লিফট দিয়ে উঠতে হয়। লিফটের ছোট বদ্ধতায় ঘর্মাক্ত পুরুষেরা বিরক্ত হয় একটা নারীকে জায়গা ছেড়ে দিতে। নাক বন্ধ করে রেবা ওঠে ওপরে, অনেকদিনের অনুশীলনে মিনিটখানেক দম রাখতে পারে সে। লিফট থেকে বের হলে সামনে দারওয়ান, ম্যাডামকে সেলাম দেবার জন্য দাঁড়ায়। ভেতরে প্রথমেই একটা বড় ঘর, সেখানে খোপ খোপ করা, তরুণ কর্মচারীরা কাজ করে সেখানে। বড় ঘরটার পাশ দিয়ে একটা করিডর, সেটা যেয়ে পৌঁছায় ম্যানেজারের ঘরে। ম্যানেজারের পাশেই রেবার ঘর, সে সহকারী তত্ত্বাবধায়ক।
চেয়ারে বসতে না বসতেই ঘরে ঢোকে বাহার। বয়সে রেবার থেকে অন্তত বছর পনেরোর ছোট হবে, খুব বেশী দিন হল কাজে ঢোকে নি, কিন্তু এর মধ্যে তার প্রযুক্তির জ্ঞান তাকে অফিসের অপরিহার্য অঙ্গ করে তুলেছে। টেবিলের উল্টো দিক থেকে বলে, রেবা আপা, আপনার স্ক্রিন ফ্রিজ হয়ে যাচ্ছে বলেছিলেন, দেখতে এসেছি।
রেবা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়েছিল। বাহার বলল, উঠবেন না, আমি একটা চেয়ার নিয়ে আসছি। টেবিলের ওদিক থেকে একটা চেয়ার তুলে নিয়ে এসে রেবার পাশে রাখে বাহার। নীল কোট, নিচে সাদা জামা। একটা মৃদু কোলনের গন্ধ ভেসে আসে। কামানো মসৃণ গাল। হঠাৎ রেবার বুক কাঁপে, নিঃশ্বাস ঘন হয়ে যায়। ডান হাত দিয়ে মুখ চাপা দেয়। মনে হয় বুকের ওপর শাড়িটা আর একটু ওপরে তোলা দরকার। বাহারের আঙুলগুলো কিবোর্ডে খুব দ্রুত চলে। রেবার দিকে একবার অল্পক্ষণের জন্য তাকিয়ে হাসে। রেবা বুঝতে পারে তার মুখাবয়ব, দেহ উষ্ণ হয়ে উঠছে। সে তার নিজের প্রতিক্রিয়ার অর্থ বুঝতে পারে না। এখন তার উঠে যাওয়া উচিত, কিন্তু ওঠার সাহস হারিয়ে ফেলে রেবা। বাহার বেশীক্ষণ থাকে না, বলে, সিস্টেম আপডেট করে দিলাম, কম্পিউটার রিবুট করছি, মিনিট পাঁচেক লাগবে, আশা করি আর অসুবিধা হবে না। এই বলে, রেবার দিকে চেয়ে হাসে। হাসিটা স্মিত, সেটার স্থায়িত্বকাল কয়েক সেকেন্ড, সাধারণ হাসির বয়সের চাইতে কয়েক সেকেন্ড বেশী। রেবার মনে হয় ওই কয়েক সেকেন্ড বাহার তার চুল কেমন করে কানের ধার ঘেঁষে নেমে গেছে সেটা দেখছিল। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলে রেবা, নিজের ওপর রাগ হয়, এই বাচ্চা ছেলেটাকে দেখে তার এরকম প্রতিক্রিয়া হবার কথা নয়। একটা অপ্রস্তুত হাসি ফুটে ওঠে। বাহার চেয়ার ছেড়ে ওঠে, ওঠার সময় ওর বাঁ হাতটা ক্ষণিকের জন্য রেবার ডান বাহু স্পর্শ করে। রেবা বুঝতে পারে না সেটা ইচ্ছাকৃত কিনা।
চেয়ারটা আবার টেবিলের ওপাশে রেখে বাহার বেরিয়ে যায়। রেবা বাহারের পেছনে বন্ধ হওয়া দরজাটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে, তারপর তার হাত দুটো নিরীক্ষণ করে, বাঁ হাত দিয়ে ডান বাহুর নীল শিরাটা স্পর্শ করে, সেটাকে অনুসরণ করে পৌঁছে যায় হাতে। ডান হাতের পেছনের হাড়গুলোকে বাঁ হাতের আঙুলগুলো দিয়ে চেপে দেখে – কার্পাস আর মেটাকার্পাস। তালুর ত্বক বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে টিপতে থাকে রেবা, ভাবে বয়স হচ্ছে, শরীরের চামড়া বয়সের ভার নিয়ে বদলাচ্ছে, ধরে রাখতে পারছে না ভেতরের মাংস, কোষ, মন, মস্তিষ্ক, কার্পাস আর মেটাকার্পাস। চামড়ার ওপর ভাঁজ পড়ছে। সব থেকে ভারী মনে হচ্ছে কাঁধ, কিন্তু সে এখন বোঝা নামিয়ে দেবার পথে। এরকমই ভাবছিল রেবা যখন অভীকের ফোন আসে। কাল রাতে কী হয়েছিল, জিজ্ঞেস করে অভীক। কী হয়েছিল? পাল্টা প্রশ্ন করে রেবা। ওপাড় থেকে অভীক বিড়বিড় করে কী যেন বলে রেখে দেয়। কী হয়েছিল? ভাবে রেবা। কাল রাতে সে শান্তনুকে দেখেছে। অনেক কিছু দেখেছে। রেবা উঠে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়, পাশে আগে মাঠ ছিল, এখন আর একটা বহুতল অফিস বাড়ি উঠছে, রাতদিন কাজ চলছে, যেমন চলছে তাদের বাসার দক্ষিণ দিকে। সারা শহর জুড়ে বাড়ি উঠছে। কোথাও নিস্তব্ধতা নেই। এই শহরটাকে সে বুঝতে পারে ভেবেছিল। অতীতে।
৪.
রেবার সঙ্গে আবার যখন আমার দেখা হয় ও যেন পৃথিবীতে ছিল না। আমার কোনো কথাই মনোযোগ দিয়ে শুনছিল না। আমাকে বলছিল, জানিস দিলু, আমি যে কে অনেক সময় বুঝতে পারি না। রেবার কথা বুঝতে আমার অসুবিধা হয়। বললাম, খুলে বল, সহজ করে বল। ও বলল, অভীক আর আমি দুটি জগতে বাস করি। আমরা আর কথা বলি না। প্রেম করি না। তারপরই জিজ্ঞেস করল, তোর মেয়েরা কেমন আছে? বললাম, ভাল, নিজেরাই নিজেদের দেখে। রেবা হাসে, বলে, তোর মেয়েদুটি এত ভাল হয়েছে, আর তুই ওদের নিয়ে কিছু বলতে চাস না। মেয়েদের নিয়ে বেশী কথা রেবাকে বলতে চাই না। ও বোঝে। সন্ধ্যা হয়ে আসে দ্রুত, মনে হয় রেবা আর আমি দুটি মানুষ পৃথিবীতে, আর আমাদের আশে পাশে যারা আছে তারা ঠিক মানুষ নয়, আমাদের ওপর চোখ রাখার জন্য পাঠানো হয়েছে। কাছের মসজিদগুলোতে আজান পরে। এখান থেকে আকাশ দেখা যায় না, এখান থেকে মনে হয় আকাশ কি আদৌ আছে?
রেবা আর আমি দুদিকে যাব, ওকে রিকশায় উঠিয়ে দিতে গেলে আমার হাত ধরে বলে, দিলু, আমাকে ভুলিস না। শঙ্কিত হই, চলে না গিয়ে রেবার পাশে উঠে বসি। আমার সঙ্গে যাচ্ছিস? রেবা প্রশ্ন করে। হ্যাঁ, বলে চুপ করে থাকি। অন্ধকার হতে থাকে আরো।
রেবা বলে, ইদানিং আমি শান্তনুকে দেখতে পাই। রেবার কথাকে আমি অনুবাদ করি, স্বপ্নে দেখছে শান্তনুকে। রাস্তার বাতিগুলো জ্বলে ওঠে, তারই মধ্যে একটা বাতি, আমাদের রিক্সা সেটার নিচ দিয়ে যাবার সময়, জ্বলতে না জ্বলতেই নিভে যায়। জিজ্ঞেস করি, তুই কি এখনো অভীককে দোষ দিস? ও উত্তর দেয়, না রে, কখনই দিই নি। এরপর কী বলব ভেবে পাই না, রিক্সাওয়ালা দাঁড়িয়ে প্যাডেলে চাপ দেয় একটা উঁচু জায়গা পার হবার জন্য। বলি, তোর ডিপ্রেশন হচ্ছে, কোনো ওষুধ খাচ্ছিস? মাথা নাড়ায় ও। বললাম, ডাক্তার দেখা, আমার পরিচিত একজন আছে। দেখাব, বলে রেবা, তুই এখানে নেমে যা, দিলু, অতদূর যেতে হবে না, আমার জন্য ভাবিস না, আমি ঠিক থাকব। যেখানেই থাকি না কেন ঠিক থাকব।
নেমে যাই আমি। রেবার রিক্সা মিলিয়ে যায় আঁধারে।
৫.
এবার লিফটে উঠে একদম পেছনের কোনাটা পেয়েছে রেবা। খোপাটা খুলে যাচ্ছিল, চুলের গোছা এসে পড়ছিল ঘাড়ে। এখনো চুল কালো। বেগুনী তাঁতের শাড়ী পরা রেবার, ব্লাউজের ছোট হাতার নিচে উন্মুক্ত বাহু। লাইনে দু একজনের পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল বাহার, রেবা ওকে খেয়াল করেছিল, বাহারের চোখ যে বারে বারে তার খোলা ঘাড়ের ওপর এসে পড়ছিল সেটাও অলক্ষ থাকে নি। আরো অনেকে দেখছে, চোখ ঘুরিয়ে নিচ্ছি, না পেরে আবার ফিরে আসছে। হয়তো ভাবছে এই নারীর বাড়িতে বস্তাবন্দি হয়ে থাকা উচিত, কিন্তু রেবা এই ১২ তলা অফিস দালানের মানুষদেরকে - বড় কর্তাদের থেকে অগুন্তি দারোয়ান - সবাইকে মেপে ফেলেছে। তার হিসাবে দাড়িপাল্লায় এদের এক এককটাকে বসালে সেই পাল্লা এতই হাল্কা হবে যে হাওয়ায় উড়ে যাবে। তাই অফিসের মানুষের দৃষ্টি রেবার ঘাড়ের ওপর দিয়ে পিছলে যায়। তারা রেবার উন্মুক্ত পিঠের দিকে, কিংবা উন্মুক্ত বাহুর দিকে দৃষ্টি ধরে রাখার সাহস হারিয়ে ফেলে। রেবা বোঝে – ঋজু মেরুদণ্ড, উন্নত গ্রীবা আর জ্বলন্ত, কিন্তু একাগ্র, চাহনীর নিচে এরা সবাই কাগুজে বাঘ।
পাঁচ তলায় লিফট থামলে প্রায় সবাই নেমে যায়, রেবা পেছনে সরে লিফটের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ায়, বাহারের পাশে। বাহার মাথা ঝুঁকিয়ে রেবার উপস্থিতিকে স্বাগত জানায়। আজ তার পরনে টি শার্ট, ওপরে নীল কোট, নিচে জিন্সের প্যান্ট। কোলনের মৃদু গন্ধ ভেসে আসে। আজ রেবাও একটা সেন্ট মেখেছে। রেবা বাহারের কাছে সরে আসে। লিফ্ট ছ তলায় থামে আরো মানুষ নেমে যায়, একজন তাদের দুজনের সামনে দাঁড়িয়ে। রেবার বাঁ কাঁধ বাহারের কোটের আস্তিন ছোঁয়, বাহারের নাকে রেবার সেন্টের গন্ধ ভেসে আসে, বাহারের শ্বাস দ্রুত হয়, কী ধরণের খেলা খেলছেন রেবা আপা?
আট তালায় লিফট থামলে শেষ মানুষটি বের হয়ে যায়, এখন লিফটে মাত্র দুজন। রেবা বাহারের আরো কাছে সরে, বাহারের নাকে রেবার উন্মুক্ত কাঁধ থেকে ভেসে আসে মহাসাগরীয় দ্বীপের গন্ধ। বাহার কোনো মহাসাগরীয় দ্বীপ দেখে নি, কিন্তু এভাবে সেই দ্বীপের গন্ধ সে কল্পনা করত। রেবার শাড়ি সরে যায়, তার উচ্চতা থেকে বাহার রেবার ব্লাউজের নিচে স্তনযুগলের ভাঁজ দেখতে পায়। বাহার সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে নেয়, কিন্তু রেবার বাহুর অপ্রতিরোধ্য চাপ সে অগ্রাহ্য করতে পারে না। সে দেখতে পায় একটি ঘামের বিন্দু রেবার নাক বেয়ে ধীরে ধীরে নামছে। এর মধ্যেই লিফটের দরজা খুলে যায়। ১১ তলা। রেবা দ্রুত বের হয়ে যায়। বিমূঢ় বাহার দাঁড়িয়ে থাকে, লিফট থেকে বের হতে দেখে রেবা দৃঢ় পদক্ষেপে চলে যাচ্ছে, বাহার বোঝে রেবা ইচ্ছাকৃতভাবে নির্দিষ্ট ছন্দে হাঁটে। বাহার রেবার পেছন থেকে দৃষ্টি সরাতে পারে না, লিফট থেকে বের হবার আগেই দরজা বন্ধ হয়ে যায়।
রেবা তার অফিস ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দেয়, টেবিলের পেছনে তার চেয়ারে বসে। জোর শ্বাসে তার বুক ওঠানাম করে। টেবিলে কনুই রেখে দুহাত দিয়ে টেবিলের ওপরে মাথাটি ধরে রাখে, নাকের ডগার ঘামটি মহাকর্ষের অমোঘ টানে টেবিলের সবুজ স্যাটিনে আছড়ে পড়ে গোলাকার রূপ নেয়। শ্বাস শান্ত হয়ে এলে, বুকের ওঠানামে কমে এলে, বাঁ চোখ থেকে একটি জলের ধারা গাল বেয়ে নামে। গালের জলধারা বাঁ হাত দিয়ে মুছতে মুছতে ডান হাত দিয়ে ডানদিকের প্রথম ড্রয়ারটা খোলে, একটি ছবি - ছোট ফ্রেমে আটকানো, তাতে একটি বছর আটেকের বালক, বসে আছে পার্কের বেঞ্চে, ফটোগ্রাফারের দিকে তাকিয়ে, বড় বড় চোখে, পরনে স্কুলের পোষাক সাদা জামা, খাকি প্যান্ট। ছবিটি দুহাতে ধরে দিকে তাকিয়ে থাকে রেবা, এবার জলের ধারা নেমে আসে দু চোখের নিচেই, সিক্ত করে ঠোঁট, যে ঠোঁট কাঁপে, উচ্চারণ করতে চায়, শান্তনু, তোকে আমি রাখতে পারলাম না।
৬.
ওই সন্ধ্যায় রিক্সাটা খানা-খন্দ না দেখে নির্বিচারে চলে, কিন্তু এতদিনে রিক্সায় বসার যথার্থ নিয়মটা আবিষ্কার করে ফেলেছিল রেবা। কোমড় বাঁচিয়ে, মেরুদণ্ডে যাতে আঘাত না লাগে, আবার একই সাথে হঠাৎ জোরে ব্রেক করার সময় সামনে হুরমুড় করে পড়ে না যাবার পদ্ধতি। বাড়ির সামনে রিক্সা থেকে নামতে নামতে রেবা দেখে পাশের মাঠে তখনো কাজ চলছে, পাইলিংএর। শ্রমিকেরা বাইরে হাত দিয়ে লোহার রড বাঁকাচ্ছে। এর মধ্যে একটি সুশ্রী তরুণ জামা-প্যান্ট পরা, সমস্ত শক্তি দিয়ে একটা রডের মাঝখান ধরে ওপরে টানছে, তাকে আবার পেছন থেকে টানছে আর একটি ছেলে যাকে বালক বলাই সঙ্গত। আর রডটির আর এক অংশ মাটিতে শক্ত করে ধরে বসে আছে একজন। যে তরুণটি মূল কাজ করছে তার ঘাড়ের সমস্ত রগ ফুলে উঠেছে, মুখমণ্ডল বিস্ফারিত, তার চুল কোঁকড়ানো। অভীকের কথা ভাবল রেবা। অভীক সকালে খাট ছেড়ে ওঠে না, এককালে অভীক আকাশ ছোঁবার স্বপ্ন দেখত, এখন আর দেখে না। এই তরুণটিও আকাশ ছুঁতে চায়, কিন্তু সে হয়তো দিবাস্বপ্ন দেখে না, দিবাস্বপ্ন দেখার তার সময় নেই। তার রাতের স্বপ্ন কোনো সুন্দরী নারীর হতে পারে, কিন্তু দিনের বেলা সে রড বাঁকায় হাতের পেশী দিয়ে। অভীক নিশিস্বপ্ন দেখে কিনা তা রেবা জানে না। সকালে অভীকের সঙ্গে কথা হয় না, আর রাতে সে ফিরে আসার আগে রেবা ঘুমিয়ে পড়ে।
রেবা ওপরের দিকে তাকায়, নিজের ফ্ল্যাটটা খুঁজে নেয়, সন্ধান করে সেই দেয়ালের যার মধ্যে সে ঢুকে গিয়েছিল। হঠাৎ করে সামনে ভয়াবহ শব্দ করে কংক্রিট মেশানোর মেশিনটা ঘুরতে আরম্ভ করে, তাতে ভাঙা সুড়কি ঢালছে শ্রমিকেরা, মাটিতে ইঁটের ওপর পড়ে কাদার মতন কংক্রীট, ঢেকে দিচ্ছে তার গলিত চলনে সবকিছু। সেটা দেখতে দেখতে রেবা সম্মোহিত হয়ে যায়। তার মনে হয় পায়ের নিচে কংক্রিট তরল ঘুরুতে শুরু করে, সে সেই ঘূর্ণীতে ঢুকে যেতে শুরু করে, কংক্রিটের ধূসর তরল ঘূর্ণী যেন রেবাকে গিলে ফেলবে যেমন করে গোলাপি দেয়ালে আবির্ভূত কালো আলকাতরার দরজা তাকে গিলে ফেলেছিল। ওই মুহূর্তে একটি হাত রেবাকে পেছনে থেকে জড়িয়ে কংক্রীট থেকে সরিয়ে নিয়ে আসে। রেবা মাথা তুলে দেখে তরুণ শ্রমিকটির চুল কোঁকরানো, গালে কয়েক দিনের না-কামানো দাঁড়ি, হাতা গোটানো চেক-কাটা জামা, কালি মাখা নীল প্যান্ট। তীক্ষ্ণ চোয়ালের ওপর জ্বলন্ত চোখে সে রেবার দিকে তাকিয়ে থাকে। লজ্জিত হয়ে রেবা মাথা নামায়, বিড় বিড় করে বলে, থ্যাঙ্ক ইউ। যুবকের মুখমণ্ডলের নিচটা অল্প হাসিতে বিস্তৃত হয়, রেবার হাতটা ছেড়ে দিয়ে, কিছু না বলে, অল্প দূরে মাটির ওপর পাতা লোহার শিকগুলোর দিকে এগিয়ে যায়। রেবা অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ।
ওই রাতে যখন দেয়ালে কৃষ্ণ আয়তক্ষেত্রটি রূপ নিচ্ছিল, অভীক জেগেই ছিল। দেয়ালটায় মনে হল ঘূর্ণীঝড় হচ্ছে, প্রথম একটা লাল আলো ঠিকড়ে বের হল দেয়ালটাকে ফুঁড়ে, তারপর ধীরে ধীরে সেটা হল নীল, অবশেষে সব আলোই নিঃশেষিত হল অন্ধকারে, গোলাপী দেয়ালে কালো জানালার মধ্যে। রেবা যেন ওই মুহুর্তটির জন্য অপেক্ষা করছিল। দাঁড়িয়ে রাতের পোষাকটি আজ দ্বিধাহীনভাবে খুলে ফেলল। তারপর তড়িৎগতিতে ঢুকে গেল সেই কালো দরজার মধ্যে দিয়ে। তারপর শুরু হল অপেক্ষার পালা, অভীক জেগে থাকার চেষ্টা করে, অপেক্ষা করে তরুণী রেবার জন্য, কিন্তু ওপরের ফ্যানটির নিরবচ্ছিন্ন মৃদু আওয়াজ তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়।
স্বপ্ন দেখে অভীক। প্রথমে তার মৃত মা’কে, তারপর একটি অন্ধকার সুড়ঙ্গের। সে অনেক মানুষকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে একটা পাহাড়ের ভেতর দিয়ে, কিন্তু সুড়ঙ্গটা সরু হতে হতে শেষে একটা ছোট ফাটলে রূপান্তরিত হল যেটা দিয়ে একটা মানুষ মাত্র গলে যেতে পারে। তার পেছনের সব মানুষকে ফিরে যেতে বলে অভীক, মনে হয় তাদের মধ্যে মা’ও ছিলেন। আড়াআড়িভাবে ফাটলের মধ্যে ঢুকতে শুরু করে অভীক, অন্ধকারে সব ঢাকা, তার মধ্যে আবছা আলো বিকিরণ করে অনেক কীট জ্বলে দেয়ালে, মাথার ওপরে। আস্তে আস্তে তার পুরো শরীর আটকে যায় ফাটলে, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, ভাবে এর থেকে কি বের হতে পারবে। তখন মনে পড়ে তার এই সুরঙ্গে থাকার কথা নয় এখন, বাসস্ট্যান্ডে শান্তনুর পাশে থাকার কথা। বাসস্ট্যান্ডটা কোথায়? এই সুরঙ্গের বাইরে, নাকি আর একটা শহরে? সেই শহরে কীভাবে পৌঁছাবে, আতঙ্কের মধ্যে ভাবে অভীক, প্লেনে? বাসে? গাড়িতে? কিন্তু তার আগে এই সুরঙ্গ থেকে বের হতে হবে, কিন্তু সুরঙ্গের দুদিকের দেয়াল অভীককে চেপে ধরে, শ্বাস নিতে কষ্ট হয় তার। গোঙায় অভীক, নিজের গোঙানীতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। সকাল হয়ে গেছে। পাশে রেবা নেই। দেয়ালের দিকে তাকায়, দেয়ালের পাশে রেবার অন্তর্বাস পড়ে আছে। ক’টা বাজে - সাড়ে আটটা। রেবা তাহলে অফিসে চলে গেছে। আর রাতে কী হল? তরুণী রেবা কি ফিরে এসেছিল? এই ভাবতে ভাবতে আবার ঘুমিয়ে পড়ে অভীক।
যখন ঘুম ভাঙে তখন সূর্যের আলোতে ঘর ভেসে যাচ্ছে। মোবাইলের ঘড়িতে সময় দেখে সাড়ে দশটা। উঠতে গিয়ে চোখে পড়ে পাশের ড্রেসিং টেবিলের ওপর রেবার ফোনটা। রেবা ফোনটা ভুলে ফেলে গেছে। কিন্তু ভুলে ফেলে গেলে সে কি অভীককে ফোন করত না? ফোনের পাশে রেবার ভ্যানিটি ব্যাগ। দেয়ালের কাছে গিয়ে অন্তর্বাসটা তুলে নেয় অভীক, এ সবই কি স্বপ্ন, কিন্তু স্বপ্ন যদিই হয় অন্তর্বাসটা কেন এখানে থাকবে? বাইরে বসার ঘরে এসে রেবার জুতোর খোঁজ করে সে। ঘরের একপাশে সারি দিয়ে রাখা কয়েক জোড়া জুতো, আজ মনে হল অভীকের এর মধ্যে কোনটা সবসময় রেবা পরে সে সেটা জানে না। রেবার অফিসে পরার জুতো কি দোকানে যাবার জুতো থেকে আলাদা?
নিজের মোবাইল থেকে রেবার অফিসের ফোনে করে অভীক। ফোন বেজে যায়, কেউ ধরে না। এই প্রথম অভীকের মাথায় এল যে রেবার অফিসের আর কোনো ফোন নম্বর সে জানে না, ওই অফিসের কাউকেই সে চেনে না। রেবার বন্ধু দিলারাকে চেনে, কিন্তু দিলারার নম্বর তার কাছে নেই। কী করবে ভাবতে ভাবতে দুপুর পার হয়ে গেল, তারপর মন স্থির করে যখন রেবার অফিসে পৌঁছাল তখন বিকেল হতে চলেছে, ম্যানাজারসহ অনেকেই ততক্ষণে চলে গেছে, বাইরের দারোয়ান জানাল রেবা ম্যাডামকে সে আজ আসতে দেখে নি। রেবার অফিস থেকে বেরিয়ে অভীক ভাবে চট্টগ্রামে রেবার বাড়িতে ফোন করে কথাটা কীভাবে পাড়বে, এই ভাবতে ভাবতেই সময় চলে যায়, বাসায় ফিরে আসে। অবশেষে যখন সে চট্টগ্রামে ফোন করল তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে, রেবার মা ফোন ধরলেন। অভীক জিজ্ঞেস করল, রেবা চট্টগ্রামে গিয়েছে কিনা। না, যায় নি। রেবার মা বললেন, উনি এখনি ঢাকায় রওনা হচ্ছেন।
সে রাতে দক্ষিণ দিকের দেয়ালের দিকে মুখ করে খাটে বসে রইল অভীক, কখন ঘূর্ণিঝড় উঠবে দেয়ালে, কখন আলকাতরা ফুঁসে উঠবে, কালো দরজার আবির্ভাব হবে কখন, কিন্তু গোলাপি দেয়াল তার রঙে অনড় রইল। টানা ছয় ঘন্টা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে ভোরে নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়ল অভীক। ঘুম ভাঙল রেবার মা’র ফোনে, উনি শহরে পৌঁছেছেন, এখনি চলে আসবেন। অভীক পুলিশে খবর দিয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করলেন।
থানায় অভীককে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল পুলিশ, কবে শেষ রেবাকে সে দেখেছে ইত্যাদি, ব্যাপারটাকে তারা সেরকম গুরুত্ব দেয় নি। স্বাভাবিক কারণেই দেয়ালের মধ্যে রেবার প্রবেশের কথাটা সে বলতে পারে নি, কিন্তু দু দিন বাদে রেবার মা ও বোন থানায় তার নামে ডায়রী করল যে অভীক রেবাকে হত্যা করে মৃতদেহ লুকিয়েছে। অভীককে ধরে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ, কিন্তু রেবার মৃতদেহ না পেয়ে তারা তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। সামাজিক মাধ্যমে খবরটা সেরকমভাবে এল না, ওপর থেকেও চাপ ছিল না, পুলিশ রেবার অন্তর্ধান নিয়ে বেশী অগ্রসর হল না।
এরপর প্রতি রাতে অভীক দেয়ালের সামনে বসে থাকে রেবার ফিরে আসার জন্য। বহু রাত আগের তরুণী রেবার সঙ্গে মিলন এখন স্বপ্নের মতন। সে তো স্বপ্নই ছিল, নাকি নয়, ভাবে অভীক।
৭.
এর দু সপ্তাহ পরে এক বিকেলে আমি যাই রেবার বাসায়। রিক্সা থেকে নেমে তিনতলার ওপরে ওদের বারান্দাটা দেখার চেষ্টা করি। প্রথমে বাইরের ঘরে বসায় আমাকে অভীক। বলে, আপনি আমার কথায় বিশ্বাস করবেন না, দিলারা, কিন্তু রেবা অদৃশ্য হয়েছে আমার সামনেই। অভীক এক দেয়ালের কাহিনী বলে, সেই দেয়াল কেমন করে গিলে খেয়েছিল রেবাকে।
আমি শোবার ঘরে যেয়ে দক্ষিণ দিকের দেয়ালটা দেখি, হাল্কা গোলাপি দেয়ালে তখনও নতুন রঙের গন্ধ। জিজ্ঞেস করি, দেয়ালের ওপাড়ে কী আছে? ওপাড়ে কিছু নেই, একটা দোতলা বাড়ি ছিল, মাঠ, সেটা ভাঙ্গা হয়েছে, সেখানে এখন বড় গর্ত, নতুন বহুতল বাড়ি উঠবে। আমি হাত রাখি দেয়ালে, একটা বিদ্যুৎ খেলে যায় আঙুল থেকে কনুই পর্যন্ত, চমকে হাত সরিয়ে নিই।
অভীক বলে, কিছু হল? আমি মাথা নাড়ি, কিছু হয় নি, আমারই নার্ভাস প্রতিক্রিয়া হবে। দু হাতের তালু এবার দেয়ালের ওপর রাখি, এবার কোনো তড়িৎ ক্রিয়া হয় না, কিন্তু হাতের ভেতর দিয়ে দেহকে কী একটা যেন আবেশ করতে থাকে। এভাবে কতক্ষণ কেটে যায় জানি না, অভীক দাঁড়িয়ে ছিল, বোধহয় হাঁপিয়ে যায়, বলে আমি আপনার জন্য চা নিয়ে আসি? আমি উত্তর দিই না।
ও ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে ডান কানটা দেয়ালের ওপর রাখি, নতুন রঙের গন্ধ আসে নাকে। ফিসফিস করে বলি, রেবা, এখানে আছিস নাকি? আমি দিলু। নিঃশব্দতা, বাইরে থেকে রিক্সার ক্রিং, রাস্তায় চিৎকার করে কেউ কাউকে ডাকে। কুকুরের ঘেউ ঘেউ শোনা যায়। আবার বলি, রেবা আছিস? থাকলে উত্তর দে। এবার দেয়ালের ওপাড় থেকে কিসের যেন শব্দ হয়, মেঝের সঙ্গে চেয়ারের পায়ের ঘর্ষণ, তারপর একটা মৃদু পদক্ষেপ। আমার বুক ধক ধক করে।
একটা কন্ঠ ভেসে আসে, মনে হয় সুরঙ্গের অপর প্রান্ত থেকে, বলে, আছি রে। আমার শরীর থরথর করে কাঁপে, এও কী সম্ভব? গায়ে কাঁটা দেয়। রেবারই গলা এতে সন্দেহ নেই। দেয়াল ধরে শরীর সামলাই, তারপর আরো আস্তে ফিসফিস করে বলি, রেবা, তুই, বেঁচে আছিস? অনেকক্ষণ কোনো কথা নেই। তারপর উত্তর আসে, হুঁ। এরপরে কী জিজ্ঞেস করব ভেবে পাই না। অবশেষে বলি, তোকে কি অভীক কিছু করেছে?
একটু সময় যায়, তারপর রেবার কন্ঠে শুনি – না রে। বলি, তুই নিজেকে কিছু করেছিস? একটু পরে উত্তর আসে, না রে। প্রশ্ন করি, এখন কী করছিস। উত্তর এল, জিরোচ্ছি। ভাবি, এর কাছ থেকে তথ্য বার করতে অনেক সময় লাগবে। জিজ্ঞেস করি, জিরোচ্ছি মানে বিশ্রাম করছিস? বেশ জোরেই বলে ফেলি কথাটা, রেবার ওপর রাগই হয়। উত্তর – হ্যাঁ।
অভীক দুটো চায়ের কাপ নিয়ে ঢোকে. ও আমার শেষের কথাটা শুনতে পায়। কাপ দুটো খাটের পাশে কফি টেবিলে রেখে আমার পাশে এসে দাঁড়ায়, আমি ওকে খাটে যেয়ে বসতে বলি, কেন জানি মনে হয় অভীক থাকলে রেবা কথা বলবে না।
বলি, বিশ্রাম করছিস কেন? অনেকক্ষণ কোনো উত্তর এল না, খ্স খ্স শব্দ ভেসে এল। তারপর রেবা বলল, আমি খুব ক্লান্ত। তারপর নিজেই যোগ করে, নতুন জীবনের জন্য। নতুন জীবনের জন্য? বুঝলাম না ও কী বলতে চায়। জিজ্ঞেস করলাম, তুই যেখানে আছিস সেই জায়গাটা কীরকম? কোনো উত্তর নেই। জিজ্ঞেস করলাম, কেমন করে ওখানে গেলি? উত্তর নেই। একটা খস খ্স শব্দ হতে থাকে। আর এখন? এখন কী অবস্থায় আছিস? খ্স খ্স শব্দটা বাড়তে থাকে। রেবা, রেবা! ওপাড় থেকে কেউ সারা দেয় না। কিন্তু আমি খ্স খ্স শব্দটা আর সহ্য করতে পারি না। দেয়াল থেকে সরে আসি। দূর থেকে কোনো শব্দ শোনা যায় না, দেয়াল নিরেট হয়ে থাকে। দেয়াল দিয়ে ঘেরা একটা দূর্গ, সেই দূর্গে রেবা আছে, কিন্তু সেখানে বাইরের কারুর প্রবেশ নিষেধ। দূর্গের চারদিকে একটা পরিখার সৃষ্টি হতে থাকে, আমি তাতে পড়ে যেতে থাকি, অভীক দু হাত দিয়ে ধরে আমাকে বিছানার ওপর বসায়। ঝিম হয়ে বসে থাকি অনেকক্ষণ, রাস্তা থেকে আবার কুকুরের ঘেউ শোনা যায়। অভীক অনেক প্রশ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ওকে কী বলব? দেয়ালের ওপাড় থেকে যা শুনেছি তাই বললাম। রেবার ফ্ল্যাট থেকে নিচে নেমে রাস্তায় হাঁটি, সন্ধ্যা হয়ে আসে, আধো-অন্ধকারে কাজ চলে ওদের বাড়ির পাশে, পাইলিংএর কাজ, নতুন বাড়ি উঠছে। ওপরের দিকে তাকাই, সন্ধান করি সেই দেয়ালের যার মধ্যে রেবা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল।
৮.
শহরে শীত এল। ভোরের সূর্য কুয়াশায় ঢেকে থাকে। ভোরের প্রার্থনার শব্দে ঘুম ভেঙে যাবার পরে অভীকের ঘুম আসে না। জীবনের ঘটনা এক এক করে ভেসে ওঠে, এরকম স্মৃতি বড় কষ্টের, অভীক পুরনো সময় মনে করতে চায় না, কিন্তু মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে না। আর এক শীতের সকালে বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়ানো শান্তনুকে পেছনে স্কুলের বোঝা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। স্ট্যান্ডের পাশের চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে অভীক সবে মাত্র চায়ের গ্লাশটা হাতে নিয়েছে, বেশ গরম, ধোঁয়া উঠছে হাল্কা বাদামী তরল থেকে, সেই সময় চোখের কোনায় দেখে – দূরে – বেপরোয়া দুটি বাস, কে আগে যাবে। সবাই সরে আসে শান্তনুকে একা রেখে।
যন্ত্রণায় অভীক মাথা এ পাশ ও পাশ করে। অতীতের শীতের সকালের চা তাকে শান্তি দেয় না। দেয়াল থেকে একটা খ্স খ্স শব্দ ভেসে আসে, কোনো কীট যেন তার পা দুটো ঘসছে, অথবা খোলস থেকে বের হচ্ছে। তখনই দেখে দেয়ালে ঘূর্ণী উঠছে। হাল্কা গোলাপি মিশে যাছে গাঢ় লাল, তারপর সবুজ হয়ে কালো, যেন পৃথিবীর সব রঙ শুষে নিচ্ছে। কৃষ্ণ গহবর। তারপর পুরো দেয়াল জুড়ে রূপ নেয় কালো আঁঠালো বস্তুর সমুদ্র, তাতে ক্রুদ্ধ উন্মত্ত ঢেউ। ধীরে ধীরে তাতে আবির্ভূত হয় একটি পা, তারপর পুরো দেহ, পুরো দেহ ঢাকা একটা আবরণে, খোসার মতন। খোসাটা ঢাকা কালো আলকাতরার মত জিনিসটায়, তা চুঁইয়ে পড়ে মাটিতে। আঁঠালো কালো বস্তুটা ঝরে পড়লে খোলসের সাদা রঙটা দেখা যায়। তারপর হাল্কা খোসা বিভাজিত হয়ে যেতে থাকে ছোট ছোট অংশে, তারা আলাদা হয়ে ঝড়ে পড়তে থাকে মাটিতে। বাতাসে ভাসে, তারা সময় নেয় মাটিতে পৌঁছাতে। খোলসবিহীন আবরণহীন নগ্ন তরুণীকে চিনতে পারে অভীক। অতীতের রেবা অভীকের দিকে তাকায়, তার ঠোঁট অল্প বিস্ফারিত হয় স্মিত হাসিতে, মুহূর্তের জন্য তার মুখমণ্ডলে এক অনিশ্চয়তা দেখা দেয়, তারপর বারান্দার দিকে এগোয়। বারান্দার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে তার পরিবর্তন হয়। পদক্ষেপ শ্লথ হয়, যুবতীর বয়স বাড়ে, পরিণত হতে থাকে সে বর্তমানের মধ্যবয়সী রেবায়, অন্তত তাই অভীক মন করে। বারন্দায় পৌঁছে রেবা কয়েক সেকেন্ড সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর মাথা ঘুরিয়ে অভীকের দিকে তাকায়। হ্যাঁ, এই রেবাকেই অভীক শেষ দেখেছিল দেয়ালে ঢুকতে। রেবার মায়াময় চোখ ভেসে থাকে মাধুর্যময় চতুষ্কোণ চোয়ালের ওপর। তারপর সামনে তাকায়। দু দিকে দুহাত মাটির সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে তোলে, সেই হাত ও দেহের মধ্যে সূক্ষ্ণ তন্তুর জাল গড়ে ওঠে। সুতো যোগ হয়ে হাতের আঙুল থেকে পায়ের আঙুলে, কনুই থেকে উরুতে, তন্তুর ওপর গড়ে ওঠে মিহি স্বচ্ছ পর্দা। প্রথমে সাদা, তারপর লাল ও হলুদ রঙে পর্দাটি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, তার স্বচ্ছতায় পেছনের আলো দেখা যায়। পর্দা হয়ে ওঠে ডানা, প্রজাপতির ডানা। রেবার শরীর সঙ্কুচিত হতে থাকে, নরম ত্বকের রঙ কালো হতে থাকে। রেবা রূপান্তরিত হয় এক বিশাল প্রজাপতিতে। প্রজাপতি অপেক্ষা করে না, উড়ে যায় ঈষৎ আলোয় আলোকিত ভোরের কুয়াশায়।
পাহাড়ের এক সুড়ঙ্গে আটকা পড়েছে অভীক, সেখানে থেকে বেরিয়ে প্লেনে, বাসে, গাড়িতে চড়ে পৌঁছাতে হবে রেবার কাছে, রেবা এখন অনেক দূরে। অভীকের ঠোঁট নড়ে, বলে, রেবা, আমাকেও নিয়ে যাও।
৯.
অফিসে নতুন সহকারী ম্যানেজার এসেছে, তার কম্পিউটার আপডেট করে বাহার। নতুন ম্যানেজার মহিলা দূরে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে, তার চুল ঢাকা থাকে একটি কালো কাপড়ে। বাহার পাশের শূন্য চেয়ারে রেবাকে কল্পনা করে, মৃদু সেন্টের গন্ধ মনে করতে চায়। জানালা দিয়ে লাল-হলুদ ডানার একটা প্রজাপতি ঘরে ঢুকে উড়ে বেড়ায়। বাহার বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে, এত ওপরে প্রজাপতির ওড়ার কথা নয়। জানালা দিয়ে বেরিয়ে যায় প্রজাপতি। _____________________________
2 মন্তব্যসমূহ
বহুবছর আগের সেই ফেলে আসা স্কুল দিনগুলোর মতো করে এক নিঃশ্বাসে শেষ করলাম।
উত্তরমুছুনদারুণ৷ একটা কেমন কামু-র গায়ের গন্ধ জড়িয়ে আছে৷
উত্তরমুছুন