
এই ওয়াই-র দুটো ডাঁটি যে ফুটকিটায় মেশে, সেখানেই মকবুলের দোকান। চায়ের দোকান, কিন্তু ঝুপড়ি দোকান নয়, বেশ বড় পাকা ঘর, সেখানে টেবিল, চেয়ার পাতা দেখে মনে হয় টিফিন খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। দুপুর তিনটের সময় অবশ্য দেখা গেল ভেতরটা ফাঁকা, ঠিক ফাঁকা নয়, দু চারজন চায়ের গ্লাস নিয়ে বসে আছে, টিভি দেখছে। একজন বুড়ো এসে জিগেস করল ‘কটা থেকে খোলা দোকান?’ মকবুল বলল ‘সেই চারটেয় নামাজের সময় থেকে’ আরও কেউ কেউ জিগ্যেস করলে তাদেরও একই কথা বলল মকবুল। নামাজের কথা বলছে কেন মকবুল বারবার? সে কি নিজেকে ধর্মপ্রাণ প্রমাণ করার চেষ্টা করছে?
একটু পরে একজন মাস্টার এল, সে কাঁদছিল। শুক্রবার মেয়েরা ছুটি চাইছিল, মাস্টার দেয়নি বলে গ্রাম ঝেঁটিয়ে এসে তাকে মেরে গেছে, এমনকি মেয়েদের বাথরুম পশ্চিমমুখো হয়নি বলে বাথরুম ভেঙে দিয়ে গেছে। অনেক কষ্ট করে বাথরুম করা। স্বচ্ছ ভারতের টাকায় বাঞ্চোত প্রধানের বাড়ির মেঝে পাথর হয়েছে, উঠোনে আবার একটা ছোট মতো মন্দিরও হয়েছে। মাস্টার নিজের গাঁটের কড়ি খরচ করে মেয়েদের বাথরুম বানিয়েছিল। কত দূর দূর থেকে আসে মেয়েরা। সেই চকখালি, সোনাটিকরি, মোমেদপুর। অতক্ষণ বাথরুম চেপে থাকলে পড়ায় মন বসবে? মন আনচান করবে যে। ছেলেরা বলতে এসেছিল ‘আমাদের কি পেচ্ছাপ পায় না স্যার?’ মাস্টার তাদের ধমক দিয়ে ভাগিয়েছে। ‘তোদের আবার কী রে? মাঠে যা।’ বলল বটে, তবু কথাটা ফেলনা না, কিন্তু টাকা কোত্থেকে আসবে? সেই বাথরুম ভেঙ্গে দিল ওরা। কয়েকটা মেয়েকে সামনে রেখে। যদিও বেশিরভাগ মেয়ে কাঁদছিল। একজন, সালেহা, কবিতা লেখে, পরে তাঁর হাতে একটা কাগজের টুকরো গুঁজে পালিয়ে গেল, তাতে লেখা ‘ গাঁইতি এসে ঘা মারল কলজেতে মোর, পালটা দেব এমন নাহি গায়ের জোর’
মাস্টার বিজ্ঞানের লোক, তবু তার কানে লাগল, কোথাও একটা গোলমাল আছে ছন্দে, শব্দগুলো ঠিক কারো সঙ্গে কারো মিশ খায়নি, খারাপ রাঁধুনীর পাঁচমিশেলি তরকারিতে যেমন প্রতিটা সব্জি আলাদা আলাদা চেয়ে থাকে। তবে ওর বুকের কষ্ট টুকু তো সত্যি। সে সালেহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিল, শুধু বলল ‘পালটা দিতে গেলে গায়ের জোর না, মনের জোর লাগে পাগলী। পড়া ছাড়বি না, তাহলেই ওরা পালিয়ে যাবে।’ পরে মাস্টার ভাবল ওকে মালালার গল্প শোনালে হত। কিন্তু নাহ, কী হবে এসব করে!
এখন মাস্টার বেঞ্চে বসে বলছে ‘এদেশে আর থাকব না। মকবুল ভালো করে চা বানা এক গেলাস’।
এই মোড়টা পেরোলেই সব শুনশান। একটা বেড়া ঘেরা কবরখানা আছে। তাতে গহন বাঁশবন। এর নিচে যারা শুয়ে আছে, তারা বেঁচে গেছে। মকবুল ভাবছিল। তাদের কেউ তাড়াতে পারবে না। কিন্তু বাঁশবনে যখন হাওয়া ওঠে, তখন কি মাটির নিচের বুক ধুকপুক করে ওঠে না?
এইসব যখন ভাবছিল মকবুল, দুপুরের দিকেই হবে, কারণ, এইসময় সকালের টিফিনের পর্ব খতম হয়ে যায়, বিকেলের চায়ের পাটও শুরু হয় না। সে এক অমীমাংসীত সময়। এই সময় ভোরে জ্বালানো রাক্ষুসে উনুনটা জ্বলতে জ্বলতে একেবারে নিভে যায়, বিকেলে আর উনুন জ্বালায় না মকবুল, তখন জ্বলবে গ্যাস, আর ছোট খুচরো দরকারে ইগনিশন। হ্যাঁ, হ্যাঁ মকরমপুরের মকবুলের ইগনিশন আছে। শুধু তাই নয়, এই এলাকায় কারো কোন ঝিঞ্চ্যাক জিনিস লাগলে সবাই মকবুলের কাছেই আসে। শুধু মকরমপুর নয়, দুধনই, কাটাপোল, চকবেড়ে, বেগমপুর, গড়চণ্ডীপুর। কেউ স্মার্ট ফোন কিনবে, কেউ ফোনে টাকা পাঠাতে চায়, কেউ দুবাইতে থাকা ছেলের সঙ্গে ভিডিও কল করতে চায়, সবাই এসে মকবুলের পায়ে পড়ে। এই তো একটা বাবা এসে বসে আছে, ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া ছেলের টাই কিনবে। একটা টাই কিনতে বাড়ি সুদ্ধ এসেছে। একটা মোচ্ছব হচ্ছে যেন। প্রথমে তারা মকবুলের দোকানে বসে চা খেল, তারপর গম্ভীর মুখে নিজের মনে বলল ‘এর জন্য একটা টাই কিনতে হবে’ মকবুল নিজের চাহিদা ধরে রাখার জন্যে আজকাল কিছু কায়দা করে। লোকে হাওয়ায় কোন কথা ভাসিয়ে দিলেই সে হড়বড় করে সেটা ধরতে যায় না, সে অপেক্ষা করে কখন তাকে সরাসরি বলা হবে ‘ও মকবুল ভাই, একটা উপায় করে দ্যান,’ তাই এই বাপের কথা শুনেও সে ঠোঁট টিপে দুধের প্যাকেট কাটছিল, যেন কিছুই হয়নি। মকবুলের দোকানে সব প্যাকেটের মাল, হুঁহুঁ, বাবা। আর একটা ফ্রিজও আছে। এ এলাকায় প্রথম তার দোকানেই ফ্রিজ আসে।
মকবুল ধীরেসুস্থে দুধের প্যাকেট ঢালে, গ্যাসে সসপ্যান বসায়, দুধ জ্বাল দেওয়া খুব কঠিন কাজ, একটু মন সরে গেলেই দুধ উপচে পড়ে শুধু যে দুধ নষ্ট হবে তা নয়, গ্যাস মোছার ভারি ঝঞ্ঝাট। দোকানের সব কাজ নিজের হাতে করে মকবুল, সে ভারি পিটপিটে লোক, কারো কাজ পছন্দ হয় না। দু চারটে ছেলে রাখে, আবার ছাড়িয়ে দেয়, এ ব্যাপারে তার পটার সঙ্গে ভারি মিল। পটা এ এলাকায় খবরের কাগজ দেয়, এতগুলো বাড়ি একা পারে না, তাই ছোট ছেলে রাখে, দুচারদিন পরপর মুখগুলো বদলে যায়। কাগজ একখানার জায়গায় দুখানা রাখতে হয় মকবুলকে। সকালে লোক চা খেতে এসেই কাগজের খোঁজ করবে, পড়তে জানুক ছাই না জানুক, বসে থাকবে মুখে নিয়ে, বেলা বাড়লে সে কাগজ দুটোর ল্যাজামুড়ো কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। একটা পাতা উনুনের পাশে লটপটি খাবে, তো অন্য পাতাটা বাসরাস্তায় চলে যাবে উড়ে উড়ে। মকবুল দুপুরে বসে বসে দেখবে রাশি রাশি তাজা খবর কীভাবে হাওয়া আর ধুলো খেতে খেতে কত দূরে চলে যাচ্ছে। কাগজ তুলে আনার কোন ইচ্ছে তার হবে না, সে শুধু তাকে এখনো বানান করে করে পড়তে হয় বলে নয়, তার হাতে স্মার্ট ফোন, দোকানের দেওয়ালে টিভি আছে বলেও নয়, সে সারাদিনে ওইটুকু সময় জীবনের নশ্বরতা নিয়ে ভাবতে পারবে বলে, ওইটুকু সময় পয়সা দিয়ে কেনা একটা জিনিসের প্রতি উদাসীনতা দেখাতে পারবে বলে।
নইলে সে তো সারাক্ষণ কিছু না কিছুর পেছনে ছুটছে। দুধ, খদ্দের, হাসিনা। হাসিনা যত তাকে না করছে, তত তার জেদ চেপে যাচ্ছে। হাসিনার সমস্যাটা কী? ধরতে গেলে কিছুই না। মকবুলের হাতের চা ভালো লাগে, মকবুলের হাতের ঘুগনি, ছেঁড়া পরোটা, আলুরদম, অমলেট ভালো লাগে, তার মানে মকবুলকেও ভালো লাগা উচিত। মকবুল কি তার হাতের চা, ঘুগনি, আলুরদমের চেয়ে আলাদা কিছু? এসবের মধ্যেই তো সে মিশে আছে। কিন্তু হাসিনা ন্যাকড়াবাজি করছে, বলছে তার বাপ নাকি কাগজ দেখতে চায়, কাগজহীন ছেলের হাতে মেয়েকে তুলে দিতে মোটেই রাজি নয় সে। তবিজ মিয়া দেখাতে চায় সে খুব পুরোনো লোক, পুরোনো এবং আল্লার কাছের লোক। শেষবার হাসিনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল কাঠ চেরাই কলের পেছনে পুরনো পোলে। এই পোলে কোন গাড়ি যায় না, ভারি, হালকা কোন গাড়িই যায় না, একেবারেই পরিত্যক্ত এ পোলে ছাগল নিয়েও পার হয় না কেউ। যেমন পরিত্যক্ত এই পোল, তেমনি এর নিচের জলধারা। শীর্ণ হাতের ঢলঢলে বালার মতো যেন খুলে এসেছে নিজের গতিপথ থেকে। এই নদীটির নামও কেউ মনে রাখেনি। কেউ কেউ বলে ঢেমনি নদী। কিন্তু সে নাম সবার কাছে মান্যতা পায়নি। সব গ্রামেই দু চারজন স্বভাবকবি থাকে। তাদের কেউ কেউ এর নাম দিয়েছে সোহাগী। একসময় নাকি সোহাগী নামে সাবান ছিল। পুরনো লোকরা বলে। দারুণ তার খুশবু। সেই সাবান যেমন নেই, তেমনি তার খোশবাইও আর নেই। আর নদীটাও কি আর আছে? তবু হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে এই জায়গাটাই পছন্দ মকবুলের। এখানে দাঁড়ালে সে খুব পুরনো একটা গন্ধ পায়। আসলে সেটা কাঠেরই গন্ধ। বড় বড় গাছের গুঁড়ি কাটা পড়ে থাকে, গোল গোল রিং তার গায়ে, সেটা থেকে নাকি গাছের বয়স বোঝা যায়। গুনতে গিয়ে তল পায়নি মকবুল, কত কত বছর ধরে এদেশের মাটি কামড়ে ছিল! গাছ, এমন একটা জিনিস, মকবুল ভেবে দেখল, যে কেটে ফেললেও গাছ মরে না। কারো ঘরে দরজা, কারো বারান্দায় চেয়ার, কারো ঠাকুরের জলচৌকি হয়ে নতুন জীবনে চলে যায়। এই পুরনো পোলে দাঁড়িয়ে কাঠের গুঁড়ির গন্ধ, কাঠ গুঁড়োর গন্ধ বুক ভরে টানতে টানতে, আরও একটা গন্ধ পায় মকবুল। হাসিনার গায়ের গন্ধ। হাসিনা আগে শাড়ি পরত, ফুলছাপ শাড়ি কিংবা সবুজ খোল সোনালি পাড় শাড়ি, আঁচল মাথায় ফেরতা দেওয়া। ভেবে দেখলে মাথা যদি ঢাকতেই হয়, ঘোমটার থেকে এতে সুবিধে বেশি। মাঠেঘাটে কাজ করতে পারা যায়। আজকাল হাসিনা বেশি সালোয়ার পরে, ওড়নাটা বুকের ওপর না দিয়ে মাথায় তোলা। তাই আগে শাড়ির আড়ালে যে দুটির খবর পায়নি, সেই স্থলপদ্মের মতো বুকদুটি তার হাতের নাগালে ফুটে থাকে আর তাদের গন্ধ পাগল করে দেয় মকবুলকে।
কিন্তু বেকার পাগল হয়ে লাভ আছে? হাসিনা কব মান যায়েগি, কে জানে। মানবেই না এ জন্মে, সে মানলেও, তার হোঁতকা বাপ তমিজ মিয়াঁ, যে খালি বোঝে জমি, কাগজ আর উসুল। যতদিন বাঁচবে, সবকিছু উসুল করে যেতে হবে। মকবুলকে দেখলেই খালি জিজ্ঞেস করবে, সে সারাদিনে কটা নমাজ পড়ল, ইদে কটা রোজা রাখতে পারল। মকবুল দোকান সামলাবে না এসব করবে? দ্বিতীয় কেউ নেই যে তার পাশে দাঁড়ায়। একবার সে সাহস করে তমিজ মিয়াঁকে বলেছে ‘আপনার মেয়ে এসে দোকানের হাল ধরলে আমি একটু ধম্মকম্ম করতে পারি সার’ সম্ভাব্য শ্বশুরকে সার বলেও সে তাঁকে গলাতে পারল না। উলটে তিনি ক্ষেপে গিয়ে বললেন ‘ আমার মেয়ে গিয়ে মোড়ের মাথায় দোকানে বসবে? কেন, সে কসবি নাকি? মকবুল মিয়াঁ, তোমার মাথায় এমন গোবর পোরা থাকলে, তুমি শাদির আশা ছেড়ে দাও’।
এত অপমানের পরেও মকবুল হাসিনাকে পুরনো পোলে আসতে বলল একদিন। হাসিনা সেদিন এল ঠিকই, কিন্তু ওকে দেখে একটু হতাশ হল মকবুল। সে শাড়িও পড়েনি, সালোয়ারও না, বাড়িতে পরা ম্যাক্সি না নাইটি, কী যেন বলে, সেটাই পরে এসেছে, বুকের ওপর ওড়না ফেলে। ওর গা দিয়ে রসুনের তীব্র গন্ধ বেরোচ্ছে, যার মানে ও পাক করতে করতে দৌড়ে এসেছে। এসেই সে বলল ‘যা বলবে খর খর বল, রান্না চাপিয়ে এসেছি।’
মকবুল লোভীর মতো বলল ‘কী রাঁধছিলে?’
‘ফেসবুকে একটা নতুন রেচিপি শিকলুম, মুরগা বানারসী’।
‘যাহ, হতেই পারে না, কাশী বেনারস দিয়ে মাংস রান্নার নাম হয় কখনো? ঝামেলা হয়ে যাবে’।
হাসিনা একটু চিন্তা করে, চিন্তা করার সময় ওর ভুরু দুটি মসজিদের খিলানের মতো হয়ে যায়, সে দৃশ্য এত অপরূপ যে রসুনের গন্ধ কোথায় ভেসে যায়। হাসিনা চিন্তা করে বলে ‘ভুল বললুম। মুরগা বানারসী নয়, আনারসী। কয়েকটা আনারসের টুকরো দিতে হবে নামানোর সময়’।
‘আনারস পাবে এখন?’
‘নাহ, কদু দেব। যা বলবে তাড়াতাড়ি বল , গ্যাস সিম করে এসেছি’।
মাংসে কদু! মকবুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। না জানি কেমন হবে সেই রান্না! এ জন্মে সে স্বাদ আর পাবে কি সে? মকবুল হাসিনার সদ্য রসুন ছোলা আঙ্গুল ঠোঁটে ছোঁয়ায়, হাসিনা বাধা দেয় না, মকবুল সাহস পেয়ে ওকে আর একটু কাছে টানে। সে লক্ষ্য করে স্বচ্ছ ওড়নার নিচে ম্যাক্সির তিনটে বোতামের ওপরের দুটো খোলা। তার মনে হয় ওই বোতামখোলা ম্যাক্সির নিচে এক অনাবিস্কৃত দেশ আছে। হাসিনার যদিও আগে একবার বিয়ে হয়েছিল, তবু সবাই কি সব কিছু খুঁজে পায়? মকবুল ওড়না ওঠাতে সাহস পেল না, কিন্তু কাছে টানার সময় হাসিনার পানের ডাবরের মতো বুক তার হাত ছুঁয়ে গেল। এক লহমার জন্যে মকবুল ভুলে গেল এই মকরমপুরের কথা, তেমাথার মোড়, চায়ের দোকান, রোজ রাশি রাশি দুধের প্যাকেট কাটা, নীলচে সাদা দুধ গড়িয়ে গড়িয়ে দাগ রেখে যায় মেঝেতে, ভাঙ্গা ডিমের খোলা, গামলা ভরতি মটর সেদ্ধ, আলুর ছাড়ানো খোসা, স্মার্ট ফোন কিনে তার গায়ে হামলে পড়া হাটুরে লোক। তার গলায় কী যেন পাকিয়ে ওঠে। কেমন একটা কষ্ট হয়। একবার যেমন হয়েছিল, কলকাতায় গিয়েছে, তারাতলায় কী একটা কাজে। ফেরার সময় টিপু সুলতানের মসজিদ দেখতে গেছে। মসজিদের ভেতরের থেকে বাইরেটা খুব পছন্দ হল তার। কত বড় বড় গাছ, একটি দুটি পরিশ্রান্ত ভিখিরি শুয়ে আছে, বাইরে যে ওরকম একটা ব্যস্ত শহর, হাঁকডাক, গাড়ি, বাস, অটো, মানুষজন, বোঝাই যায় না, এক টুকরো সবুজ দ্বীপ যেন। সেই জায়গাটা ছেড়ে আসতে যেমন কষ্ট হয়েছিল, হাসিনার বুকে হাত লেগে যাওয়ায় তেমন ঝনঝন ব্যথা লাগল। সে খুব, খুব ভালো একটা কথা খুঁজতে লাগল এই মুহুর্তটির সঙ্গে যা খাপ খায়। পশ্চিমের আকাশ লাল হয়েছে, দিপীকা পাড়ুকোনের কোমরের মতো সরু সোহাগী নদীর বুকে ছিটছিট রক্ত। কাঠচেরাইয়ের ঘসঘস আওয়াজ আসছে, পোলের নিচে ঘাস খেতে গিয়ে একটা ছাগল আর ঢালু বেয়ে ওপরে উঠতে পারছে না, সে কাতর গলায় এমন ম্যা ম্যা করছে যেন তার ইন্তেকালের দিন এসে গেছে। এই সব শব্দ দৃশ্যের মধ্যে দাঁড়িয়ে মকবুল হাসিনাকে বলল ‘ দেখ হাসিনা, এই যে গ্যাসে মুরগা আনারসী রাঁধছ, যার রেচিপি আবার ফেসবুক থেকে পেয়েছ, এই গ্যাসের লাইন, স্মার্ট ফোন, ফেসবুক সব কিন্তু আমি করে দিয়েছি।’
হাসিনা কি গ্যাসে রান্না চাপিয়ে ছুটতে ছুটতে এই কথা শোনার জন্যে এসেছিল? কে জানে! সে তার হাতের ঝিলিমিলি সবুজ, নীল, সোনালি চুড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে বলল ‘আমি তার কী জানি! আব্বু কাগজ চায় যে’।
মকবুল এবার খিস্তি মেরে বলল ‘বালের কাগজ! আরে আমার জন্মের ঠিক নেই, এতিমখানায় বড় হয়েছি, এ কথা কে না জানে!’
হাসিনা তবু মুখ গোঁজ করে বলল ‘কী করব, আব্বু’।
মকবুল এবার আরও ক্ষেপে গিয়ে বলল ‘শালি তোর আব্বুর কেঁতায় আগুন! তমিজ হারামজাদার বাপের ঠিক নেই, সে আবার কাগজ চায়! গিয়ে তোর বাপকে বল, মকবুলের কাগজ নেই, বাংলাদেশের এতিমখানা থেকে গরুর লেজ ধরে এখানে এসে দোকান খুলেছে। কোন খানকির ছেলে কী করবে করুক’
মকবুল হাঁপাতে হাঁপাতে দেখল হাসিনা পাছা দোলাতে দোলাতে সুদূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। কাঠের গুঁড়োর গন্ধ, তার সারা শরীরে ঢুকে যাচ্ছিল। তার ভয় করছিল আর একটু দাঁড়ালে হয়তো সোহাগী নদীর বুকের ওপর একটা লকলকে চাঁদ উঠে বসবে। সে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিল, সে কি কিছু ভুল বলেছে?
মাস্টার উঠি উঠি করছিল। মকবুল উদাসীনভাবে বলল ‘সত্যি কি চলে যাবা নাকি গো?’
মাস্টার হাঁ করে টিভি দেখতে দেখতে বলল ‘যাব, তার আগে একটা ফোন কিনতে হবে। তুই দেখ তো একটু’।
‘আগে টাই কিনে দি ওদের। কখন থে বসে আছে’।
এইসময় অটো থেকে দুজন নামল, জিনস কুর্তি পরা মেয়েমানুষ আর বেটাছেলে, মেয়েটা হুশহুশ করে সিগ্রেট খাচ্ছে। বেটাছেলেটা এসে বলল ‘চা হবে ভাই?’
মেয়েছেলেটা বলল ‘লিকার হবে?’
‘আরে, এসব জায়গায় দুধ চা খেতে হয় সোনা’।
মকবুল বুঝল না, মেয়েছেলেটার নাম সোনা, নাকি, অমনি করে ডাকছে? তার কান ঝাঁঝাঁ করে উঠল। সে ইগনিশনটা ধরিয়ে স্পেশাল কড়ক চা বানাতে লাগল গম্ভীর মুখে। মেয়েছেলেটা জিজ্ঞেস করল ‘ভাই, এ দোকান কতদিন হল আপনার?’
মকবুল চোখ সরু করে তাকায়। শহর বাজার থেকে আসা এরা কারা?
বেটাছেলেটি জিজ্ঞেস করল ‘আপনি কি এখানকারই লোক? বেশ দোকান,’।
মেয়েছেলেটি হেসে গড়িয়ে বলল ‘ওকে জিজ্ঞেস করো না, হেমন্তকে চেনে কিনা’।
চা ঢালতে গিয়ে মকবুলের হাত কাঁপছিল। হেমন্ত কে? কোন জঙ্গি অনুপ্রবেশকারী?
চা খেতে খেতে অনিমেষ আর তূর্ণা পরস্পরের চোখে গাঢ়ভাবে তাকাল। তারা সেই কখন কলকাতা থেকে বেরিয়েছে, ট্রেন, অটো ধরে এসেছে হেমন্তের দুপুরে একটা নির্জন জায়গার খোঁজে, যেখানে দাঁড়িয়ে তারা একটা দীর্ঘ, গভীর চুমু খাবে। সেই জায়গাটা কি পাওয়া যাবে?
বাঃ, বেশ ভালো লাগলো গল্পটা!
উত্তর দিনমুছুনঅসাধারণ এক গল্প।একরাশ ভালো লাগা।
উত্তর দিনমুছুনভাল লাগল
উত্তর দিনমুছুন