বিমল লামা 'র গল্প : দীঘির প্রেম

দীপ্যমানের কাছে বন্ধুরা আব্দার করেছে জন্মদিনে ভাল মাল খাওয়াতে হবে। দামি স্কচ। সঙ্গে জুৎসই খাবার দাবার। কিন্তু দীপ্যর কাছে টাকা নেই। তাই সে মন মরা। তার ভাব দেখে দীঘি বলে, 

“কী হল?” 

“মন ভাল নেই।” 

দীপ্যর মন ভাল নেই শুনে দীঘি এমন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে যেন দীপ্যর গুলি লেগেছে। তাও কোমরের ওপরে কোথাও।

“সে কি! মন ভাল নেই কেন? আমাকে বল কী হয়েছে। আমি যা হোক করে...।” 

সে মানে দীপ্য বিরক্তই হয় দীঘির বাড়াবাড়ি দেখে। ঝাঁঝি দিয়্রে বলে, “আরে থামো না। কী শুরু করলে!” 

দীঘি তবু নাছোড়, “না বল না কী হয়েছে?” 

দীপ্য বলে বন্ধুদের আব্দারের কথা। হাজার পাঁচেকের ধাক্কা। শুনে দীঘি চুপ করে যায়। বিষন্ন মুখে চেয়ে থাকে যেন নিজেরই দিকে। কথা বলে না দীর্ঘক্ষণ। এত দীর্ঘ যে দীপ্যর অস্বাভাবিক লাগে। চা সিগারেট শেষ হয়ে গেল। তবু দীঘি নড়ল না চেয়ারের উলটো দিকে। শেষে দীপ্য টেবিলের তলা দিয়ে পা বাড়িয়ে দীঘির কোলে একটা খোঁচা দেয়। হালকা লাথিও বলা যায়। জুতো পরেই। দীঘি চমকে ওঠে। যেন সে একা একা বসে ছিল এক মনে। কি মগ্ন ছিল অন্য কোনও খেয়ালে। 

দীপ্য বিরক্তি দেখিয়েই বলে, “কী হল?” 

“কত লাগবে?” 

“পাঁচ হাজার।” 

দীঘি বলে, “ঠিক আছে। কাল পেয়ে যাবে।” 

আর সত্যি সত্যি পরদিন ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে সবুজ একটা খাম দীঘি তুলে দেয় দীপ্যর হাতে। সবুজ তার প্রিয় রঙ। এই একটা সবুজ থেকে সাত শ' রঙ বেরিয়ে যেন রঙ্গিন করে দিল দীপ্যর জন্মদিন। বন্ধুদের কাছে কত সন্মান বাড়ল তার। দীঘির জন্যই তো। একটা সিনেমা দেখাতে নিয়ে যাবে তাকে। 

আর তাতেই দীঘি আপ্লুত। তৈরী হয়ে বেরনোর সময় এমন করে যেন সে কোনও ফিল্ম স্টারকে ডেট করতে যাচ্ছে। রুম মেটদের বিরক্ত করে মারে তাদের মতামত চেয়ে চেয়ে। দেখতো টিপটা যাচ্ছে চুড়ির সঙ্গে? লিপস্টিক দুলের সঙ্গে? ব্যাগটা জুতোর সঙ্গে? 

অথচ রাতে হস্টেলে ফেরে কাঁদতে কাঁদতে। তার চেহারা একেবারে বিদ্ধস্ত। চোখের কোনে কালি। হনুর হাড়ে কালো ছোপ। দেখে ব্যস্ত হয়ে তার রুম মেট কিনারা বলে, “আরে কী হল দীঘি! তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন?” 

দীঘি বসে বসে দীর্ঘক্ষণ কাঁদে। আর খানিক নিজেকেই বলার মতো করে কিনারাকে শোনায় তার দুঃখের কথা। 

এত করি ওর জন্য। তবু কত দুর্ব্যবহার করে দীপ্য। সেদিন কানের দুল বেচে ওকে পাঁচ হাজার টাকা দিলাম। আজ টিকিটের দাম থেকে শুরু করে রেস্টুরেন্টের বিল, সব দিলাম। যা খেতে চাইল তাই খাওয়ালাম। এমন কি বিয়ার সিগারেট...। তার পরও কথায় কথায় রেগে যায় আমার ওপর। 

“কিন্তু কালশিটে পড়ল কী করে?” 

“মেরেছে।” 

“মেরেছে! গায়ে হাত তোলে...! শুয়োরের বাচ্চা!” 

দীঘি তাড়াতাড়ি কিনারার মুখে হাত দিয়ে তাকে থামায়। বিশ্বাস করতে পারে না কিনারা। বয় ফ্রেন্ড মেরেছে। তাও এমন নির্মম ভাবে! তবু এই বোকা মেয়েটা...। 

“কেন মেরেছে?” জানতে চায় কিনারা। 

দীঘি বলে, “হোটেলে গেছিলাম।” 

“সে তো আগেও গেছিস।” 

“হুঁ..!” 

“তাহলে?” 

“অ্যানাল সেক্স চাইছিল। রাজি হইনি। প্রচুর জোরাজুরি করে। তবু বাধা দিই। তখন আমাকে চড় লাথি ঘুষি...।” 

বলতে বলতে আবার কেঁদে ফেলে দীঘি। কিনারা রাগে চোয়াল শক্ত করে বলে, “বাস্টার্ড!” 

চৌকির ওপর বসেছিল দীঘি। কিনারা তার সামনে দাঁড়িয়ে। তার চোখের জল সে মুছিয়ে দেয়। হাত বুলিয়ে দেয় তার ব্যথার জায়গা গুলোতে। গালে কপালে। চোখের ওপরে। হাত দিয়ে পরিপাটি করে দেয় তার এলোমেলো চুল। তারপর নিজের বুকের ওপর টেনে নেয় তার মাথাটা। 

কিনারার চেনা সুগন্ধ ঢুকে আসে দীঘির মাথার ভেতর। পুরুষালি কোনও ডিও। কিনারা ওটাই পছন্দ করে। সেই পুরুষালি নির্যাসের ভেতর যেন দুটো ভরসাদার হাতের বেষ্টনীতে দীঘিকে টেনে নেয় কিনারা। তার বুকে মুখ গুঁজে সত্যি সত্যি ভীষণ নিশ্চিন্ত লাগে দীঘির। মনে হয় কিনারা তাকে সব কষ্টের হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে। 

দীঘির ঘাড়ে পিঠে দুটো হাত উদার ভাবে বোলাতে বোলাতে কিনারা বলে, “এত কষ্ট দেয় তোকে। তবু কেন যাস ওর সঙ্গে। ও তোর যোগ্য নয়, দীঘি। ও তোর নখের যোগ্যও নয়।” 

তবু দীঘি পর দিন আবার দীপ্যকে খুঁজে বেড়ায় গোটা ক্যাম্পাস। জিজ্ঞেস করে বেড়ায় একে তাকে। ক্লাস কামাই করে করে দীঘি খুঁজে খুঁজে বেড়ায় দীপ্যকে। ক্যান্টিনে কমন রুমে লাইব্রেরীতে ইউনিয়নে...। এমন কি শেষে হানা দেয় বয়েজ হস্টেলে। কোথাও নেই দীপ্য। ফোন লাগছে না। মেসেজের উত্তর দিচ্ছে না। সন্ধ্যের দিকে কেমন পাগলের মতো করতে থাকে দীঘি। কিনারার বলিষ্ঠ বাহু বন্ধনেও সে শান্ত হয় না। 

কিনারা অনেক বোঝায় তাকে, “তোর কালশিটে এখনও মেলায়নি। ব্যথা আছে না কোমরে এখনো? তোর খোঁজ কি একবারও নিল?” 

অপ্রকৃতিস্থ উদ্বেগ দুটো চোখে ফুটিয়ে দীঘি বলে, “কিন্তু ওর যদি কিছু হয়ে গিয়ে থাকে!” 

“কী আবার হবে শয়তানটার!” 

কিনারা মনে মনে বলে, হলে তো ভালই হত। 

দীঘি তখনও চেষ্টা করে যাচ্ছে দীপ্যকে ফোনে ধরার। মেসেজের পর মেসেজ দিয়ে যাচ্ছে হোয়াটস অ্যাপে মেসেঞ্জারে এস এম এসে। উত্তর নেই... উত্তর নেই...। 

শেষে কিনারা কেড়ে নেয় ওর ফোনটা। জোর করে ঠেলে তাকে শুইয়ে দেয় বিছানায়। ঝুঁকে আসে তার ওপর। তারপর দীঘির মুখের কাছে মুখ এনে বলে, “মনে কর আমিই তোর দীপ্যমান। একান্তে একা ঘরে বন্দী আছিস তুই তার সঙ্গে। কেউ ডিস্টার্ব করবে না আমাদের সারারাত।” 

অস্থির দুটো চোখ গোল গোল ঘুরিয়ে দীঘি বলে, “বিন্তি কোথায়?” 

বিন্তি ওদের তৃতীয় রুম মেট। সে আজ নেই। কিনারা বলে, “বাড়ি গেছে। ওর বাপের বিয়ে আজ।” 

“ধ্যাৎ!” 

আহা! কি স্বস্তি হয় কিনারার দীঘির এমন স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেখে। সেও হেসে বলে, “সত্যিই রে!” 

“বিন্তির বাপের বিয়ে?” 

“হ্যাঁ।” 

“আর বিন্তি তাতে গেস্ট?” 

“গেস্ট কেন হবে। বেস্ট ফ্রেন্ড। নিত কনে।” 

দীঘি কৌতূকপূর্ণ কণ্ঠে বলে, “তুই না কিনু, যা তা একটা। বিন্তির বাপের বিয়ে দিলি দে। ওকে সেই বিয়েতে নিত কনে বানিয়ে দিলি!” 

“আরে সত্যি কথা রে। মা কালির দিব্যি বলছি।” 

“রামের দিব্যি খা।” 

“রামের দিব্যি।” 

“না রাম ছুঁয়ে বল।” 

কিনারা নিমেষে ওল্ড মঙ্ক এর বোতল বার করে দুহাতে ভক্তিভরে সেই বোতল ধরে বলে, “রাম ছুঁয়ে বলছি বিন্তি ওর বাপের বিয়েতে বেস্ট ফ্রেন্ড!” 

দীঘি পেট চেপে হাসতে থাকে কিনারার কান্ড দেখে। আর কিনারা মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকে দীঘির দিকে। হাসলে এমন উজ্জ্বল লাগে মেয়েটাকে। যেন.. যেন..। বলেই ফেলে কিনারা, 

“সূর্য লজ্জা পায়। সূর্য লজ্জা পায়।” 

বলতে বলতে আবার তাকে জড়িয়ে ধরে বুকের ওপর। পিষতে থাকে তার মাথাটা নিজের সমস্ত ভাললাগার ওপর। শিহরণের ওপর। পিষে পিষে সে দীঘির মধ্যেও সঞ্চারিত করতে চায় এই ভাললাগা। এই শিহরণ। দীঘি ছেড়ে রাখে নিজেকে আলগা করে। একটুও আড়ষ্টতা নেই তার গোটা শরীরের কোথাও। যেন সেও উপভোগ করছে কিনারার এই গন্ধ স্পর্শ। কিনারার এই আগ্রাসন। 

“আঃ।” 

যন্ত্রণায় আচমকাই চেঁচিয়ে ওঠে কিনারা। ছেড়ে দেয় দীঘির মাথাটা। চিবুক গলায় গেঁথে পরীক্ষা করতে থাকে নিজের বুক। মুখে বলতে থাকে, “একি রে, তুই আমাকে কামড়ে দিলি!” 

দীঘি তখন মুখের ওপর হাত চাপা দিয়ে ভীষণ হাসছে। কিনারা বলে, “আবার হাসছিস! দাঁড়া তোকে দেখাচ্ছি।” 

বলেই কিনারা ঝাঁপিয়ে পড়ে দীঘির ওপর। দীঘি উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে বিছানায়। কিনারা তার ওপর। জড়িয়ে ধরে সে দীঘির ঘাড়ে মুখ গুঁজে দেয়। আর যথেচ্ছ কামড় বসাতে থাকে তার শরীরের না না খোলা অংশে। কৌতুকে আরও জোরে... আরও জোরে হাসতে থাকে... হাসতে থাকে দীঘি। খুনসুটির পরিশ্রমে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে দুজনেই। কিনারা শান্ত হয়। শান্ত হয় দীঘিও। তার ওপর থেকে সরে গিয়ে কিনারা বলে, “সামনে ঘোর।” 

দীঘি সামনে ঘোরে। একেবারে কিনারার মুখোমুখী। তার উজ্জ্বল দুটো চোখের সামনে। চোখের তারা দুটো যেন ঠিকরে পড়ছে দীঘির মুখটা খুঁটিয়ে দেখার জন্য। যেন তারা নিজেদেরই খুঁজে বেড়াচ্ছে দীঘির দীঘির মতো গভীর দুটো চোখে। 

অনেকক্ষণ কিনারা চেয়ে থাকে দীঘির দিকে। দীঘিও কিনারার দিকে। যেন পলক না ফেলার প্রতিযোগিতায় নেমেছে দুজনে। শেষে হার মানতে হয় দীঘিকেই। কারণ কিনারা একটা কান্ড করে বসে। হঠাৎ সে নিজের ঠোঁট দুটো চেপে ধরে দীঘির ঠোঁটের ওপর৷ 

প্রথমটায় দীঘি আঁতকে উঠলেও বাধা সে দেয় না। দিতে পারে না। কারণ আশ্চর্য এক ভাল লাগার শিহরণ খেলে যায় তার সারা দেহে। যেন কিনারার ভাললাগার অংশ অবশেষে সে অনুভব করতে পারে নিজের অন্তরাত্মা জুড়ে। 

ওভাবেই কিনারা দীর্ঘক্ষণ ধরে রাখে দীঘিকে। নিজের দুটো ঠোঁট দিয়ে। দীঘিও ধরা দিয়ে পড়ে থাকে স্বেচ্ছায়। অনড় হয়ে। ধীরে ধীরে তারা চোখ বন্ধ করে। বদলে খুলে দিতে থাকে শরীরের আগল। শরীরের সংবিধান। যাতে আরও সহজ মনে হয় মেনে নেওয়া। মনে নেওয়া। 

এক সময় কিনারা আলগা করে তার ঠোঁটের বাঁধন। মুখ থেকে মুখ তুলে বলে, “দীঘি, ভাল লেগেছে?” 

দীঘি মাথা নেড়ে সায় দেয়। কিনারা হেসে বলে, “তাহলে একটু রাম ঢালি?” 

দীঘি এতেও সায় দেয়। কিনারা দুটো গ্লাসে রাম আর প্লেটে কাজু বাদাম নিয়ে এসে বিছানায় বসে। তারপর দুই বন্ধু মুখোমুখি বসে প্রস্তুতি নেয় রাত জাগবার। কারণ কিনারা বলে, “মনে কর এ রাত জাগরণের রাত।” 

“মানে?” 

“মানে জেগে ওঠবার রাত। যতটুকু চোখ খোলার অনুমতি সমাজ সংস্কার সংবিধান দিয়েছে তার চেয়ে আর একটু বেশি খুলে নেওয়ার রাত। যতটুকু ওরা দেখাতে চায় তার চেয়ে আর একটু বেশি দেখে নেওয়ার রাত।” 

দীঘি রামের গ্লাসে চুমুক দেয়। কাজু কাটে দাঁতে। কিনারার দিকে চেয়ে বলে, “এ সব তোর কথা?” 

“এসব আমাদের কথা।” 

“আমাদের মানে?” 

“মানে যারা সংবিধান মানি না।” 

“দেশের?” 

“না, দেহের।” 

কিন্তু পরদিন আবার ফিরে আসে দীঘির দীপ্যমান ব্যথা। ক্যাম্পাসে জোর খবর ওরা মন্দারমনি গেছে বেড়াতে। 

“ওরা মানে?” জানতে চায় দীঘি। 

“ওরা মানে ওরা চার জন। দীপ্যমান আক্ষরিক আরশি আর লিরিক।” 

“তুই কী করে জানলি?” 

প্রমান দেখায় কিনারা। হোয়াটস অ্যাপে ছবি পাঠিয়েছে আরশি। জলে স্থলে হোটেলের ঘরে একান্ত অন্তরঙ্গ ছবি। দীপ্য আর আরশি। আক্ষরিক আর লিরিক। 

শুনে যতটা ভেবেছিল কিনারা ততটা শোক পায় না দীঘি। কান্না কাটি সে মোটেও করে না। বরং রাগ দেখিয়ে বলে, “আমার পয়সায়!' 

“মানে?” 

“মানে দুল জোড়া বেচে বারো হাজার পেয়েছিলাম। বাকিটা হোটেলের ঘরেই আমাকে মেরে কেড়ে নিয়েছিল দীপ্য।” 

“কত শয়তান, অ্যাঁ!” 

যদিও দীপ্যকে ভুলতে পারে না দীঘি। মন্দারমনি থেকে ফিরে সে দীঘির হাতে পায়ে ধরে ক্ষমা চায়। বলে আরশির প্ররোচনাতেই সে ভুল করে ফেলেছে। এমনটা আর করবে না। কক্ষনও না। 

দীপ্যকে ক্ষমা করতে দীঘির তিন দিন সময় লাগে। তারপর আবার আগের মতোই। যেমন চলছিল। ক্যাম্পাসে প্রেম। দীঘির টাকাতেই হোটেলে ঘন্টা যাপন। না না প্রয়োজনে তাকে শোষণ। আর দীঘি সাধ্যমতো টাকা জুগিয়ে যায় দীপ্যকে। এমন করেই চলে আরও কিছুদিন। 

তারপর আর কিছুই বেচার মতো থাকে না দীঘির কাছে। বাড়িতেও আর টাকা চাওয়ার মুখ থাকে না তার। স্কুল শিক্ষক বাবা আর কত যোগাবে! 

ঠিক এই রকম সময় দীপ্যমান বলে, “কাল আমার দশ হাজার টাকা দরকার। না হলে মরে যাব। প্লিজ ম্যানেজ করো।” 

দারুণ ঝগড়া করে দীঘি সেদিন। রাগ দেখায়। প্রথমবার কটু কথা বলে দীপ্যকে। দীপ্য অবাক হয়ে চেয়ে থাকে দীঘির দিকে। কেমন যেন ক্রুর মুখভাব করে। যেন সে তার প্রেমিকার দিকে নয়, তাকিয়ে আছে শিকারের দিকে। 

শেষে আবার ক্ষমা চায় দীপ্য। আর বলে, “ঠিক আছে, তোমাকে টাকা দিতে হবে না। কাল শুধু একবার হোটেলে চলো। আমার ভীষণ আদর করতে ইচ্ছে করছে তোমাকে।” 

দীঘি বলে, “আমার কাছে সে টাকাও নেই।” 

“লাগবে না। আমি দেব।” 

দীঘি রাজি হয়। দীপ্যর দাবি মতো সবুজ করে সে সাজে সেদিন। এমনকি লিপস্টিক নেলপালিশ, সেও সবুজ। সকাল সকাল রুম থেকে বেরিয়ে যায় উচ্ছ্বল ছন্দে। 

“ও মা, ক্যাব!” 

ক্যাবে করে দীঘিকে হোটেলে নিয়ে যায় দীপ্য। দীঘির সে কি আনন্দ! ভাবে, এই যত্নটাই তো সে চায় দীপ্যর কাছে। ক্যাবে দীপ্য তার কাছ ঘেঁষে বসে। ধরে থাকে তার হাত। কাঁধ ঠেকিয়ে রাখে তার মাথায়। ফিস ফিস করে বলে, “আজ তোমায় পাগল করে দেব, দীঘি।” 

দীঘি বলে, “কিন্তু আমি ওটা করব না আগেই বলে দিলাম।” 

“কোনটা? ও আচ্ছা ব্যাক ফায়ার? না না। আগে জমিয়ে খাবো দাবো। তারপর কলকলাবো।” 

“এই হোটেলে?” 

হোটেল দেখে অবাক হয় দীঘি। বলে, “এর তো অনেক ভাড়া!” 

“তুমি আমার জন্য কত খরচা করেছো। তোমার জন্য আমি একদিন এটুকু করতে পারব না। 

রীতিমতো এ সি স্যুইট বুক করেছে দীপ্য। সোফা সেট সেন্টার টেবিল। বিরাট ফোলা বিছানা। নীল লাল সিলিং লাইট। ইউনিফর্ম পরা ওয়েটারেরা খাবার দিয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে স্কচের বোতল। দুটো গ্লাস। 

দীপ্য টুক টাক মাংসের টুকরো চিবোতে চিবোতে মদ ঢালে দুটো গ্লাসে। একটা দীঘির হাতে তুলে দেয়। তারপর গ্লাসে গ্লাস ঠুকে চুমুক দেয়। দুজনেই। 

কিন্তু কি যে হল আজ। দ্বিতীয় পেগ আর শেষ করতে পারে না দীঘি। সে তো চার পেগের কমে এমনিতে...। কিন্তু আজ ইতিমধ্যেই ঝাপসা দেখছে চারিপাশ। সিলিংয়ের আলো গুলো কেমন ধেবড়ে যাচ্ছে মাথার ভেতর। হাতে পায়ে জোর পাচ্ছে না। নেতিয়ে পড়ছে ঘাড়। 

কেমন যেন ভঙ্গী করে দীঘি ধরতে যায় দীপ্যকে। কিন্তু কি করে দীপ্য ফসকে যায় তার হাত থেকে। আর ভারসাম্য হারিয়ে দীঘি সোফা থেকে নিচে পড়ে যায়। দীপ্য আবার তাকে সোফার ওপর তুলে বসায়। বলে, “কী হল দীঘি?” 

দীপ্য মোবাইল ফোন বার করে বলে, “দাঁড়াও দাঁড়াও। ডাক্তার ডাকি।” আর ফোনে বলে, “ডাক্তার থাকলে একটু পাঠাবেন তো রুমে।” 

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দুজন লোক এসে ঢোকে ঘরে। দীপ্য সরে যায় দীঘির পাশ থেকে। লোক দুটো দীঘির দুপাশে বসে তার হাত ধরে। মুখের কাছে মুখ এনে জিজ্ঞেস করে, “কী কষ্ট হচ্ছে?' 

দীঘি কিছু বলার চেষ্টা করে। কিন্তু তার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয় না। লোকদুটোর গলা তার কানে আসে কেমন যান্ত্রিক শব্দের মতো। একজন বলে, “বিছানায় নিয়ে চলো।” 

তারা ওকে কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে যায়। সেই বিরাট নরম ফোলা বিছানায়। তারপর পরীক্ষা করতে থাকে তার সারা শরীর। দীঘি বুঝতে পারে ওরা তার পোষাক খুলে নিচ্ছে। ধাপে ধাপে তাকে পুরোপুরি বিবস্ত্র করে ফেলছে। তবু সে বাধা দিতে পারে না। মনে হয় কিসের যেন বিকট ভারের তলায় সে চাপা পড়ে যাচ্ছে। দম আটকে আসছে। দীপ্যকে ডাকার চেষ্টা করে দীঘি। কিন্তু তাকে কোথাও দেখতে পায় না। 

তারপর দীঘির আর কিছু মনে নেই। যখন ঘুম ভাঙ্গে দেখে সে বিছানায় শুয়ে আছে। দীপ্য একা বসে আছে সোফায়। সামনে মদ মাংসের উচ্ছিষ্ট অবশেষ। চুষে নেওয়া হাড়। চেটে নেওয়া প্লেট। শেষ চুমুকের পর খালি খালি গ্লাস। আর জানলার কাঁচে ঘন নীল রাত। 

দীঘি ধীরে ধীরে ওঠার চেষ্টা করে। দীপ্য তাড়াহুড়োয় কাছে এসে তাকে সাহায্য করে। আন্তরিক স্বরে বলে, “এখন কেমন লাগছে?” 

দীঘি বুঝতে পারে না তার কেমন লাগছে। সারা গায়ে ব্যথা। যেন তাকে খুব মেরেছে কেউ। মাথাটা ভার। দৃষ্টি স্বাভাবিক। চারিদিকে তাকিয়ে সে জিজ্ঞেস করে, “ক'টা বাজল?” 

তখন সন্ধ্যা রাত। দুজনে হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে আসে। একটা ট্যাক্সি নেয়। ইউনিভার্সিটির গেটে নেমে হেঁটে যায় ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে। গার্লস হস্টেলের দিকে। তখনও কত ছেলে মেয়ে শান্ত হয়ে পাশাপাশি বসে আছে গায়ে গা ঠেকিয়ে। কেউ কোনও কথা বলছে না। হয়ত অনুভব করছে একে অপরের উষ্ণতা। ওজন। ভাললাগা। 

দীপ্যও খুব কাছ ঘেঁষে হাঁটছে দীঘির। প্রায় তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে অসুস্থ দূর্বল মানুষের মতো। হস্টেলের গেটে দাঁড়িয়ে দীপ্য বলে, “সিঁড়ি দিয়ে উঠতে পারবে তো?” 

এই যত্ন দীঘির ভালোই লাগে। ভাবে দীপ্য ছেলেটা এমনিতে খারাপ না। অসৎ সঙ্গে পড়েই...। 

“আমি যাই তাহলে?” 

“এসো।” 

যাওয়ার সময় দীপ্য তার হাতে একটা ছোট খাম তুলে দেয়। বলে, “এতে একটা ওষুধ আছে। রাতে শোয়ার আগে খেয়ে নিও।” 

দীঘি নরম করে বলে, “আচ্ছা।” 

দীপ্য বলে, “আর একটা কথা।” 

“বল।” 

“তোমার মোবাইলে একটা ভিডিও শেয়ার করা আছে। গোপনে একা একা দেখো। আর কেউ যেন না দেখে।” 

তারপর কেমন যেন একটা হেসে “গুড নাইট,” বলে চলে যায় দীপ্য। 

রুমে সেদিনও কিনারা একাই ছিল। দীঘিকে দেখে উঠে আসে তার কাছে। কেমন অভিভাবকের মতো তার কপালে হাত দেয়। গা হাত পরীক্ষা করে দেখে। দীপ্যর দেওয়া খামটা তার হাত থেকে নিয়ে বলে, “কী এটা?” 

“ওষুধ।” 

“কীসের?” 

“জানি না।” 

“জানি না মানে? পেলি কোথায়? 

“দীপ্য দিল।” 

কিনারা তাচ্ছিল্যসূচক একটা শব্দ করে খামটা খোলে। আর ভেতরের ওষুধটা হাতে নিয়ে বলে, “অ..।” 

“কী রে?” 

“কী আবার! মরনিং আফটার। শালার এডস আছে কি না কে জানে। তার কী হবে জিজ্ঞেস করেছিস হারামির বাচ্চাটাকে?” 

দীঘি বলে, “আহা, গালাগাল দিচ্ছিস কেন? জানিস কোথায় নিয়ে গেছিল আজ? আর কী কী সব হল!” 

“চালা রেডিও, শুনেই নি।” 

দীঘি বলে তার সারাদিনের গল্প। সব শুনে কিনারা আবার উঠে আসে দীঘির বেডে। সে শুয়ে শুয়ে বলছিল। কিনারা উদ্বিগ্ন চোখে তার দিকে চেয়ে বলে, “আর ইউ সিউর?” 

আবার সে উদ্বিগ্ন অভিভাবকের মতো তার গা হাত পা দেখতে থাকে। এবার জামা কাপড় তুলে তুলে। দীঘি বিরক্ত হয়ে বলে, “কী করছিস?” 

কিনারা কপাল কুঁচকে বলে, “তোর কোনও সন্দেহ হচ্ছে না?” 

“কীসের সন্দেহ?” 

“আমার তো মনে হচ্ছে ঐ ডাক্তার দুটো তোকে রেপ করেছে!” 

“মানে?” 

মানে বোঝানোর জন্য পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে থাকে কিনারা। বলে, “দীপ্য টাকা খেয়েছে ঐ লোক দুটোর কাছ থেকে। ওদের টাকাতেই হয়েছে এইসব।” 

দীঘি রক্তশূন্য মুখে চেয়ে থাকে কিনারার দিকে। চেয়েও সে কোনও প্রশ্ন করতে পারে না। 

কিনারা আবার বলে, “মানে দীপ্য তোকে...। ওঃ গড। আই কান্ট..!” 

বলতে বলতে কিনারা নিজেই কেঁদে ফেলে। আর জড়িয়ে ধরে দীঘিকে। দীঘি চুপ করে থাকে। ভয়ে শুকিয়ে আসে তার মুখ। ধড়াস ধড়াস করতে থাকে তার বুকটা। 

মোবাইলটা হাতে নেয় দীঘি। দীপ্য বলেছিল ভিডিও আছে। সেই ভিডিওটা চালায় মোবাইলে। হাতে ধরে দুজনে পাশাপাশি বিছানায় বসে দেখে। আধ ঘন্টার ভিডিও। 

খানিকটা দেখেই কিনারা আঁতকে উঠে বলে, “ওঃ গড! দীপ্য তোকে দিয়ে পর্নোগ্রাফি শুট করিয়েছে! আর তুই...।” 


বাকি রাত আর নড়াচড়া করে না দীঘি। কিনারা বহু চেষ্টা করেও তাকে শোয়াতে পারে না। তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। সাধ্য মতো আদর দিয়ে তার যন্ত্রণা লাঘব করার চেষ্টা করে। কিন্তু দীঘি বসে থাকে নিঃসাড়ে। যেন সে নরম পাথরের এক নিষ্প্রাণ নারী মূর্তি। ভার আছে সাড় নেই। নড়াচড়া নেই। কোনও কথাও সে বলে না। শুধু বসে থাকে। বসে থাকে কিনারাও। পাশাপাশি রাত জেগে। যেন সেও সমান জখম ভেতরে ভেতরে। একই উপাচার তারও দরকার দীঘির মতো। 

ভোর রাতের দিকে কিনারা জিজ্ঞেস করে, “আত্মহত্যা করবি?” 

দীঘি এতক্ষণে ফিরে তাকায় কিনারার দিকে। কথা বলে না। কিনারা আবার বলে, “এমন কিছু কি ভাবছিস?” 

তারও কোনও উত্তর দেয় না দীঘি। কিনারা আবার নিজের থেকেই বলে, “আত্মহত্যাই যদি করিস সমাজের একটা উপকার করে দিয়ে যাস দীঘি।” 

দীঘি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় কিনারার দিকে। দীঘি বলে, “খুন করে দিয়ে যাস ঐ বেজন্মাটাকে। যাতে ও আর কারও সঙ্গে এই সব না করতে পারে।” 

দীঘি তবু কোনও কথা বলে না। কিনারা মরনিং আফটার পিলটা কিনারার মুখে দিয়ে বলে, “খেয়ে নে। আগে শয়তানের বাচ্চাটাকে মেরে নে। তারপর শয়তানটাকে মারবি।” 

জলের বোতলটা হাতে নিয়ে নিজেই জল খায় দীঘি। গিলে ফেলে পিলটা। তারপর অস্ফুটে বলে, “একটু ঘুমোব।” 

দীঘি শুয়ে পড়ে। কিনারা পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। তার গালে কপালে চুমু দিয়ে বলে, “আমি আছি দীঘি। সব ঠিক হয়ে যাবে। সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে। আমি তোর সব দায়িত্ব নেব। সারা জীবনের মতো। আমার ওপর ভরসা রাখ। আমি তোর খুব ভালো...।” 


পরদিন ক্যাম্পাসে এসেই দীপ্য দীঘির খোঁজ করে। হয়ত কৌতূহলেই। কী করল! কী ভাবছে! 

কিন্তু দীঘির দেখা মেলে না কোথাও। ফোন করে দীপ্য। সুইচড অফ। শেষে গার্লস হস্টেলের দিকে যায়। রুম নম্বর বলে ডেকে দিতে বলে একজনকে। সে ফিরে এসে জানায়, “রুমে তালা।” 

সারা দিন আর কোথাও খুঁজে পায় না দীপ্য দীঘিকে। খানিক চিন্তা হয় তার। কী জানি কোথায় গেল। বিশেষ করে কিনারা তার সঙ্গে আছে বলে আরও চিন্তা। দীপ্য ওকে ভাল করেই চেনে। একটা মদ্দা মার্কা মেয়ে। সব ব্যাপারে ওভার অ্যাকটিভ। ও-ই যদি বুঝিয়ে সুঝিয়ে পুলিশ কেস করায়। বদনামের পরোয়া না করে। তাই সে খোঁজ করে কিনারারও। কিন্তু তাকেও কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। দুজনেই সকাল থেকেই নিরুদ্দেশ। 

এরপর দশ দিন কেটে যায়। কিন্তু ক্যাম্পাসে দেখা মেলে না দীঘি আর কিনারার। হস্টেলেও ফেরেনি। দীপ্যমান কোথাও আর খোঁজ করতে বাকি রাখেনি। এমন কি দীঘি আর কিনারার বাড়িতেও খোঁজ নিয়েছে গোপনে। বাড়িতেও নেই। মানে দুজনে একসাথেই গা ঢাকা দিয়ে আছে কোথাও। কিন্তু কোথায়? আর কেনই বা! 

ভেবে ভেবে বিরক্ত হয়ে পড়ে দীপ্য। ভীষণ রাগ হয় দীঘির ওপর। ভেবেছিল আগের ভিডিও দিয়ে ব্ল্যাক মেল করে আরও ক'টা শুট করাবে। এমন কি অ্যাডভান্স নিয়ে রেখেছে পার্টির কাছে। কিন্তু হিরোইন লাপাতা। এদিকে চাপ দিচ্ছে পার্টি। ওদেরও তাড়া আছে। প্রোডাক্ট ডেলিভারি দিতে হবে সময় মতো। 

দীপ্য সত্যিই বিরক্ত হয়ে যায়। খানিক চাপেও পড়ে যায় পার্টির তাগাদায়। কী যে করবে ভাবছে যখন হঠাৎ দীঘির ফোন। 

“আরে দীঘি কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেলে কিচ্ছু না বলে?” 

ওপাশ থেকে নির্লিপ্ত স্বরে দীঘি বলে, “চিকিৎসা করাতে গেছিলাম।” 

“ফিরবে কবে?” 

“আরও ক'দিন রেস্টে থাকতে বলেছে ডাক্তার।” 

“কিন্তু আমার যে একটা আরজেন্ট দরকার ছিল তোমার সঙ্গে?” 

“দেখা করবে?” জিজ্ঞেস করে দীঘি। 

“আরে হ্যাঁ, সেই কথাই তো বলছি।” 

দীঘি দীপ্যকে জানায় সে দেখা করতে রাজি আছে। কিন্তু ক্যাম্পাসে সে যাবে না। বাইরে কোথায়। সন্ধ্যের পর। 

ব্যগ্র স্বরে দীপ্য বলে, “কোথায় বলো?” 

“শিবাজী পার্কে এসো। আটটা।” 

“ওকে!” 

সেদিন রাত আটটায় শিবাজী পার্কে হাজির হয় দীপ্য। শহরের শেষ প্রান্তে এমনিতেই নির্জন পার্ক। সন্ধ্যা রাতে আরও নির্জন। কেউ কোত্থাও নেই। শুধু একটা বেঞ্চে বসে আছে একটা কাপল। দেখে স্বামী স্ত্রী-ই মনে হচ্ছে। একেবারে ঘোমটা টানা শাড়ি পরা দেহাতি বৌ। 

পাশের বেঞ্চে গিয়ে বসে দীপ্য। এদিক ওদিক তাকায়। কিন্তু কোথাও দেখা নেই দীঘির। শুধু পিছনের রাস্তা দিয়ে সোঁ সাঁ গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে। পার্কের ভেতরে তার কোনও প্রভাব নেই। গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে আধ ভূতুড়ে অন্ধকার। সামনের জলাশয় যেন এক কৃষ্ণ অতল গহ্বরের হাঁ মুখ। ওতপেতে বসে আছে কারও অধীর অপেক্ষায়। 

একটা সিগারেট ধরাতেই যাচ্ছিলো দীপ্য, হঠাৎ কানে আসে কেউ তাকে ডাকছে। 

“দীপ্য, এদিকে।” 

ঐ ঘোমটা পরা বৌটাই ডাকছে ওকে। দীপ্য উঠে কাছে যায়। গিয়ে দেখে দীঘি। শুধু শাড়ি নয়, সিঁদুর পরে আছে। রাস্তার আলো এসে পড়েছে তার নব বধূ কপালে। 

দীপ্য অবাক হয়ে বলে, “বিয়ে করেছো?” 

“হ্যাঁ।” 

“বর কোথায়?” 

“পাশে বসা মানুষটাকে দেখিয়ে দীঘি বলে, “একে।” 

দীপ্য বলে, “ও তো কিনারা!” 

“হ্যাঁ, ওকেই বিয়ে করেছি।” 

তির্যক হেসে দীপ্য বলে, “ওহ্! ইন্টারেস্টিং!” 

কিনারা উঠে দাঁড়ায়। জিনস আর টি শার্ট পরে তাকে একদম পুরুষ মানুষ মনে হচ্ছে। রীতিমতো সুপুরুষ। সে বলে, “তোমরা কথা বলো। আমি গাড়িতে ওয়েট করছি।” 

পার্কের বাইরেই দাঁড় করানো একটা সাদা এস ইউ ভি। তারই চালকের আসনে গিয়ে বসে কিনারা। 

দীঘি বলে, “বসো।” 

দীপ্য বসে তার পাশে। নামিয়ে রাখা ব্যাগটা নিয়ে দীঘি উঠে দাঁড়ায়। 

“উঠে পড়লে যে?” 

দীঘি তার ব্যাগটা ঘাঁটতে ঘাঁটতে বলে, “না, অনেকক্ষণ বসে আছি। পা ধরে গেছে। বলো কী বলছিলে?” 

দীপ্য সরাসরি বলে, “আর একটা শুট করতে হবে। কালকেই। অ্যাডভান্স নিয়ে রেখেছি। তোমার শেয়ার তুমি পেয়ে যাবে। কিছু দিন করো কাজটা। কোটি পতি হতে বেশি সময় লাগবে না। তারপর না হয় যে যার নিজের...।” 

কথা শেষ করতে পারে না দীপ্য। তার আগেই তার মুখের ওপর এসে পড়ে, যেন এক বালতি ফুটন্ত লাভা। তার মুখ জ্বলে পুড়ে যায় যন্ত্রণায়। সহ্য করতে না পেরে বেঞ্চ থেকে নিচে গড়িয়ে পড়ে দীপ্য। কাতরাতে থাকে গলা কাটা পশুর মতো। 

দীঘি ভীষণ উত্তেজিত স্বরে নিচের দিকে তাকিয়ে বলে, “আমার তোকে প্রাণে মারাই উচিত ছিল। কিন্তু মারলাম না, এরপরও দয়া করে তোর জীবন ভিক্ষা দিলাম। তুই আমার যা করেছিস তার প্রতিদানে শুধু একটু অ্যাসিড দিলাম তোর মুখে। যাতে তুই বেঁচে থেকে ভোগ করতে পারিস আমার যন্ত্রণা। ইউ বাস্টার্ড! নরকের কীট! আমার...।” 

বলতে বলতে চিৎকার করতে শুরু করতে দীঘি। সঙ্গে বুকফাটা কান্না। বেসামাল হয়ে সে অভিশাপ দিতে থাকে দীপ্যকে। 

কিনারা এসে দীঘিকে সামলে ধরে। জড়িয়ে ধরে তাকে টেনে নিয়ে যায়। গাড়িতে চড়ে দুজনে চলে যায় মহানগরের উদ্ভাসিত রোশনাইয়ের দিকে। অন্ধকার পার্কে মাটিতে পড়ে যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে দীপ্যমান। একা একা৷ 

দুজন পথচারী ঢুকে এসেছে পার্কের ভেতর। তারা দীপ্যর থেকে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে মোবাইলে তার ভিডিয়ো তুলছে। 

হয়ত ভাইরাল হবে আজ রাতেই।



লেখক পরিচিতি
বিমল লামা 
কথাসাহিত্যিক
পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়ায় থাকেন। 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ