রুমা মোদকের গল্পের বই : নদীর নাম ভেড়ামোহনা

রুখসানা কাজল 

২০২০ সালের মহান একুশে বইমেলায় মোট চার হাজার পাঁচশত একানব্বইটি বই প্রকাশিত হয়েছে। অভিনয় শিল্পী এবং কথা সাহিত্যিক রুমা মোদক এর ‘নদীর নাম ভেড়ামোহনা ’ বইটি এরমধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। বইটি প্রকাশ পেয়েছে জেনে পড়ার আগ্রহ ছিল। এ আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে গুরুত্ব পেয়েছিল একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে লেখা রুমা মোদকের একটি গল্প। রুমা কেবল গল্প লিখেই থেমে যাননি। বিস্মৃতির মহাযজ্ঞে ভুলে যাওয়ার অন্ধ সময়ে সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে নাটকও রচনা করেছেন। অত্যন্ত শ্রদ্ধা সন্মান এবং তা কৃতিত্বের সাথে নাটকটি মঞ্চস্থ করে তিনি যথেষ্ট প্রশংসাও অর্জন করেছেন। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।

সস্বাক্ষরে লেখকের কাছ থেকে বইটি পেয়ে আমি মুগ্ধ। এটি মূলত গল্পগুচ্ছ। মোট এগারোটি ছোট গল্প নিয়ে নির্মিত। অষ্টআশি পৃষ্ঠার বইটি প্রকাশ করেছে পেন্সিল পাবলিকেশন। ভালো প্রচ্ছদ করেছেন তৌহীন হাসান। বইটির ক্রয় মূল্য দুই শত বাইশ টাকা। 

এই এগোরোটি গল্পের মধ্যে কয়েকটি গল্প রয়েছে যা একেবারেই আমাদের চেনা ছন্দে গাঁথা। ডিজিটাল জীবনের প্রাত্যহিক ঘটনা নিয়ে লেখা। কয়েকটি রয়েছে একেবারে তৃণমূল মানুষের যাপিত জীবন নিয়ে। দু একটি গল্প পড়ে মনে হয়েছে, সুযোগসুবিধে পেলে ত্যাগে এবং ভোগে নারীরাও কম যায় না। পড়তে গিয়ে মনে হল, বইটি নিয়ে লিখি। 

প্রথম গল্পের নাম, ‘দিব্যদৃষ্টি’। এ গল্পটির সাথে উল্লেখ করছি, ‘নদীর নাম ভেড়ামোহনা’ গল্পটি। কারণ কেবল এ দুটি গল্পের মূল কেন্দ্রে রয়েছে পুরুষ। এ ছাড়া অন্য গল্পগুলির মূল কেন্দ্র জুড়ে রয়েছে নারী। যদিও নদীর নাম ভেড়ামোহনা পড়া শেষ হলে চকিতে ভেসে উঠেছিল কয়েকজন অসহায় নারীর ক্রন্দনরত মুখ। প্রকৃতির নিয়ম যে এমন। নারীকে ছুঁয়েই বয়ে চলে জন্ম মৃত্যু বেঁচে থাকার অবিরাম সংগ্রাম। বইটি তাই ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে অবস্থানরত একেকজন নারীর জীবনযুদ্ধের খানিক উন্মোচিত আখ্যান হয়ে উঠেছে। 

গল্পগুলোর বিষয়বস্তু সরল। অভাব, অনটন, ভোগ বিলাস, দেহজ সুখ, প্রতিশোধের পাশাপাশি এসেছে মহান মুক্তিযুদ্ধ। বীরশ্রেষ্ঠের উপাধীর ঘোষণা দিয়েও না দেওয়ার প্রতারণা। বিষয় নির্বাচনে লেখকের কৃতিত্ব অসাধারণ। 

রুমা মোদক লিখেন সমান্তরাল ভারসাম্যে। অনেকটা প্রতিদিনের নিয়মে বাঁধা নির্দিস্ট কাজ সমাধান করার মত ছন্দে। মনে হয় খুব সহজ লেখা। আদতে কিন্তু তা নয়। প্রতি ঋতুতে যে পীত রঙ নিয়ে নির্দিস্ট একটি ফুল ফোটে তার নিত্য ভারসাম্য ঠিকঠাক রাখা মোটেও সহজ সরলের অমিশ্র কাজ নয়। প্রাত্যহিক নিষ্ঠায় রুমা তার গল্পের একেকটি চরিত্র নিয়ে পাপ পূণ্য, নৈতিক অনৈতিকতার মিক্সচারে ঢেলে খেলে একটি শক্ত টেক্সচার করে নিয়েছেন। শব্দ চয়নে উচ্চকিত না হয়েও তিনি যা বলতে চেয়েছেন তা বলে দিতে পেরেছেন। 

বইটির প্রথম গল্প হচ্ছে দিব্যদৃষ্টি। একেবারে সাদামাটা গল্প। কর্মযুদ্ধে ক্লান্ত ব্যর্থ গতানুগতিক নিরুপায় একটি অসৎ চরিত্রকে নিয়ে চিত্রিত হয়েছে মোঃ জাহাঙ্গীর আলম । গল্পটি পড়তে গিয়ে গতানুততিক শব্দটা এ কারণে মনে এলো কারণ এ ধরণের অনেক মানুষ আমাদের চেনাজানা গন্ডির ভেতরেই বসবাস করছে। সন্তান সন্ততি পরিবারসহ নিজেকে কিছুটা ভালো রাখতে অনেকেই এরম আংশিক অসৎ কাজ করে থাকে। চারপাশের চেনাজানা পরিবেশ, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে খুব অচেনা নয় এরা! সুযোগ পেলে যারা জনগনকেও বিক্রি করে দিতে পারে এ ধরণের লোকদের থেকে এরা কিছুটা আলাদা। আংশিক অসৎ ব্যক্তিরা শেষ পর্যন্ত নৈতিকতার গন্ডি পেরুতে পারে না। তাই আত্মজার অসন্মানের ভয়ে অসৎ নিরুপায় মোঃ জাহাঙ্গীর আলমকে লেখক পালিয়ে যাওয়ার একটি সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন। 

যাচিত ঈর্ষা। বইটির দ্বিতীয় গল্প। একেবারেই ডিজিটাল গল্প। শরীর শরীর ! মেসেঞ্জার, ইনবক্স, হোয়া, ভিডিও চ্যাট জুড়ে প্রতি দিনরাত নারী পুরুষের কত যে রমরমা প্রেম তৈরি হয় হচ্ছে ! তাতে মন চলে যাচ্ছে হাতে। মাউস আর কী বোর্ডের ভেতরে। মাঝে মাঝে যখন চুঁইয়ে পড়ে তখন জেনে যায় সবাই। নারী ও পুরুষ যে সতত বহুগামি তার এক জ্বলন্ত উদাহরণ এই ডিজিটাল প্রেমগুলো । কেবল অচেনা শান্তার প্রতি নায়কের অকৃত্রিম ভালোবাসায় নায়িকা দিতির ঈর্ষাটুকুই যা অক্ষয় আর বিকাররহিত। এরকম আরও কয়েকটি গল্প রয়েছে। যেমন, কাগজের নৌকা , তীব্র অমাবস্যার ক্রান্তিবলয়। 

‘নিদানের নিদান চরকি’ গল্পটিতে উঠে এসেছে এক হাহাকারের গল্প। এমনই হাহাকার ফুটে উঠেছে ‘সমাজবিবর্তনের প্রবক্তাদের গল্প’ এ। এরই সাথে যুক্ত হতে পারে, ‘নয়নতারা ও জৈবিকতার গল্প’ টি। ভাত কাপড় সামান্য মাথা গোঁজার ঠাই পাওয়ার জন্যে প্রান্তিক মানুষের সংগ্রামের ইতিহাস থাকে বড় কাঁচা রঙে ছোপানো। শ্রেণী বিন্যস্ত সমাজব্যবস্থায় এসব মানুষের সংগ্রাম তুচ্ছতার ভাগাড়ে চাপা পড়ে যায়। কখনো বন্যায় ভেসে মুছে যায়। কখনও আবার খরায় পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। কে মনে রাখে ! 

মহানগরের বস্তিগুলোতে যে হঠাত হঠাত আগুন লেগে যায় সে কি কেবল বস্তিবাসীদের অসতর্কতার কারণে ? তবে কেন আগুন নিভে যাওয়ার পরেও ফিরে আসে না ছিন্নমূল বস্তিবাসীরা ? কোথায় হারায় তারা ? রুমা সেই সব হারানো মানুষদের তার গল্পে তুলে এনেছেন। 

‘দুঃসহ বিহ্বলতা’ গল্পটি অনেকটাই প্রচলিত গোয়েন্দা কাহিনীর মত লেগেছে। কিছুটা অলৌকিক। ভুতুড়ে। তবে বাংলাদেশের মেয়েদের যথেচ্ছ ধর্ষণ এবং তার বিচারহীন প্রক্রিয়ার ব্যাপারটি থাকায় সময় উপযোগী বলে ভাল লেগেছে। ‘অস্থির নোঙর’ এবং ‘প্রবঞ্চনার উৎসমুখ থেকে’ গল্প দুটি গতানুগতিক। 

যে গল্পটি পড়ার অকুন্ঠ ইচ্ছে থেকে রুমা মোদকের বইটি পড়তে চেয়েছিলাম, সেটি হচ্ছে, ‘নদীর নাম ভেড়ামোহনা’ । আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর সৈনিক বীরশ্রেষ্ঠ (!) জগৎজ্যোতি দাসকে নিয়ে লেখা এ গল্প। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ভাটি অঞ্চল সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা হবিগঞ্জ নিয়ে গঠিত ৫নং সেকটরের টেকেরঘাটএর দাসপার্টির অন্যতম যোদ্ধা ছিলেন বাইশ বছরের তরুণ জগৎজ্যোতি। পাকিস্তাম আর্মি, রাজাকার বাহিনীর কাছে মূর্তিমান বা পাঁচভৌতিক আতঙ্ক ছিল এই দাসপার্টি। আর এ দাসপার্টির প্রাণ ছিলেন জগৎজ্যোতি । 

আমার আগ্রহ শুধু এই অকুতোভয়, নির্ভীক মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতিকে নিয়ে নয় । আমি জানতে চেয়েছি নকশাল আন্দোলনের আলোতে আলোকিত সেই আলোর পথযাত্রী জগৎজ্যোতি দাসকে। শ্রেণীহীন সমাজব্যবস্থা কায়েমের ধারক বাহক স্বাপ্নিক জগৎজ্যোতি দাসকে। 

রুমা মোদক তার মঞ্চ নাটকেও প্রতিষ্ঠা করেছেন জগৎজ্যোতি দাসকে। সরকারীভাবে বীরশ্রেষ্ঠের উপাধী দিতে যারা কুণ্ঠিত তারা নীচ। নিশ্চিত যড়যন্ত্রকারী। জগৎজ্যোতিদের তাতে কিবা এসে যায় ! এই যে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্ম এবং আরও পরের প্রজন্ম তাকে মনে রেখেছে শ্রদ্ধায় সন্মানে ভালোবাসায় । পৃথিবীর মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে ঠিক যতবার উচ্চারিত হবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কথা ও কহন, ততবারই উচ্চারিত হবে শহীদ জগৎজ্যোতি দাসের নাম ও উপাখ্যান। 

রুমার লেখা বর্ণনাভিত্তিক। একঢালা । কোন কোন চরিত্র চিত্রণে অস্পষ্টতা থেকে গেছে। চমক কম। সহজে বোঝা যায় পরবর্তিতে কি ঘটতে যাচ্ছে। কিছু গল্প আরও কয়েকবার ভেঙ্গেচুরে দেখার সুযোগ ছিল। আমি সাহিত্য গবেষক নই। সুতরাং একথা বলতে পারব না যে, কোন লেখকের লেখা বর্তমান সময় অতিক্রম করে যুগ যুগ ধরে বয়ে যাবে। এখন ত পাঠক মাত্রই লেখক। কিন্তু লেখকরা যে পাঠক নন এটুকু বোঝা যায়। 

একজন বুভুক্ষু পাঠক হিসেবে বলতে পারি, যে লেখা পড়তে পড়তে মায়া জাগায়, মমতায় ভরে ওঠে মন, আমি সে লেখার একান্ত ভক্ত। পাড়ার দোকানি কুড়ি টাকার দারচিনি কোন টুকরো কাগজে মুড়ে দিলে সে কাগজের লেখাও পরম আগ্রহে পড়ে ফেলি। এভাবেই পেয়ে গেছিলাম, মহাত্মা লেনিনের প্রিয় বন্ধু ইনেসা আরমান্দের নাম। কোভিড১৯ এর শুরুতে পেয়েছিলাম ‘নদীর নাম ভেড়ামোহন’ বইটি। কোভিড১৯ এর পিক আওয়ারে বসে সে রকম আগ্রহ নিয়েই পড়ে ফেলেছি বইটির গল্পগুলো। 

পড়া শেষ করে নোট রাখতে গিয়ে দেখলাম, বইটির কয়েকটি গল্পের চরিত্র নির্মিত হয়েছে নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত শ্রেণীর নারীদের নিয়ে। তাদের যন্ত্রণা আক্রান্ত সংগ্রামের কথা নিয়ে গল্প বুনেছেন লেখক। চরিত্রগুলোর পরতে পরতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে জড়িয়ে রয়েছে অভাব, দারিদ্র্য, প্রতারণা। এত সবকিছু সহ্য করেও লেখক রুমা মোদকের নির্মিত নারীরা আশ্চর্য সবাক, স্বতন্ত্র, বুদ্ধিমতী এবং যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বাধীন ও দক্ষ। রুমা জল ঢেলে মাটি ছানছেন আশা করি তাতে মায়াবৃক্ষের জন্ম হবে মমতার সুগন্ধ নিয়ে। শুভেচ্ছা লেখকের জন্যে। পাঠক সমাজ পড়ে দেখতে পারেন বইটি।



------------------------------
নদীর নাম ভেড়ামোহনা 
লেখক রুমা মোদক 
প্রকাশ কালঃ অমর একুশে বইমেলা, ২০২০ 

প্রকাশকঃ পেন্সিল পাবলিকেশনস, মুল্য ২২২ টাকা। 





লেখক পরিচিতি
রুখসানা কাজল
গল্পকার। 
ঢাকায় থাকেন। অধ্যাপনা করেন।   

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ