বিপ্লব বিশ্বাসে'র গল্প: বাবার আঁচিল

মানুষটি কেউকেটা ছিল না। জোরাল বাতকর্ম করলে বৈদ্যুতিন মিডিয়ায় ব্রেকিং নিউজ হবে কিংবা প্রিন্ট মিডিয়ার লিড নিউজ বা একনজরি হবে তাঁর বিষয়ে এমনটি ভাবা বাতুলতাই ছিল। তবুও মানুষটি কেউ তো ছিল, কারও কারও কাছে।
যেমন অতি নিকটস্থ থেকে নিকটস্থ আত্মীয়বর্গ, গোরুছাগলের মতো মনুষ্যেতর পুষ্যিবর্গ বা রক্তসম্পর্কহীন জ্ঞানজ সন্তানবর্গ। তাইতো স্কুলফেরত মানুষটি ভেজানো বাতাদরজা ঠেলে উঠোনে সাইকেল ঢোকানোর সঙ্গে সঙ্গে দুর্দান্ত কালী ঘনঘন হাম্বারবে তাকে অভ্যর্থনা জানাত বা জানান দিত - এবার তাকে দোহালের কাজ সেরে হাল্কা করতে হবে বাঁটভার, দিতে হবে জাবনা। মানুষটিকে তড়িঘড়ি জামাকাপড় ছেড়ে কালীকে আগে থামাতে হত, আর তা করতে না করতেই রঙ্গিনীর পাতলা স্বরডাক, খুঁটিতে বেঁধে দিতে হবে কচি কাঁঠালপাতার ডাল। সকালেরটা ফুরিয়ে ন্যাড়া। এইসব রোজকাজ সেরেসুরে তবেই না দুটো বিকেলভাত বা দুধচিড়ে। আবার এই মানুষটির অবিরল চেষ্টায় ফিরোজা খাতুন রাজ্যস্তরে দৌড়ুতে গেছে। ফিরোজার বাবা মাঠমুনিষ, স্বপ্নেও ভাবেনি তার একরত্তি লিকলিকে মেয়েটি ফিতেবাঁধা সোনারঙের বাহারি চাকতিসব আনবে, সঙ্গে মেয়ের নামলেখা ছাপকাগজ আর কিছু টাকাও যা দিয়ে সে একটা রুস্তম এঁড়ে কিনেছিল, বড় করে যদি নিজহালে যুততে পারে কোনওদিন। এসব স্বপ্ন তো তাকে দেখিয়েছিল এই মানুষটিই। তাহলে ' কেউ ' তো ছিলই সে, কারও কারও কাছে।
এমন মানুষের দেহ - জমির কোথাও একটা ঊষা উত্থুপের টিপ মাপের আঁচিল ছিল তা তো তেমন কোনও খবর নয়। এ তো আর ক্যাটরিনার ক্যাট - শিকার বা নুসরাতের কৃমিবিকার নয় যে মিডিয়া ফাটবে আর আ- দেখলা মানুষ চকাম চকাম চাটবে! এত ফুরসত যে আজকের মানুষ কোথায় পায়! আবার বলে সময় কম অথচ কাজ বেশি। যাই হোক, এই মানুষটির আঁচিলের হদিশ তো সকলের জানার কথা নয়। জানবে তার অগ্নি- সাক্ষীর সঙ্গিনী আর একলওতা ছেলেটি। সে জানাতেও তো আদর - আশ্লেষের এক - বুক ফারাক। আসলে ঠিক বুকের বাইরের মাপের নয়, ভেতরের মাপের। সেখানে মাপের তো কোনও নির্দিষ্ট একক থাকে না। বউয়ের আশ্লেষ আর সন্তানের আদর আব্দার কি এক?

অথচ এইতো ক'বছর হল মানুষটি নেই হয়ে ছবির ফ্রেমে আটকে গেছে।
ক বছরই বা! বছর সাতেক। বৎসরান্তে একবার সেই ছবির ফ্রেম একটা মাপমতো মালা পায়। শাদা রজনীগন্ধা বা অমিল হলে নানারঙের গাঁদাতেই কাজ চলে যায়। বাড়ির গিন্নি শাদাতে আস্থা রাখে কেননা তা তো শাদাসরল মনের প্রতিফলন। অথচ সে বোঝে না জীবিত মানুষের মনের যে নানামাপের ফোকর। সেখানে চালাকি - বজ্জাতি- লোক- দেখানির নানান ফিকির। তার আসল রং পিছলে পিছলে যায়। এ তো গেল মালা - সংবাদ। তার সঙ্গে থাকে জল মিষ্টি। ছবির সামনে রাখতে না রাখতেই খেয়ে ফেলার তাড়া। নইলে যে, না, ছবির মালিক নয়, খেয়ে যাবে উটকো পিঁপড়ের দল।
কিন্তু এ সব ছাড়িয়ে সমস্যা দানা বেঁধেছে মলিনের মনে। বিস্মৃতির সমস্যা। তা অ্যালঝেইমার্স, অ্যামনেসিয়া না ডিমেনশিয়া - কোন পরিভাষায় পড়ে তা ভেবে বুড়বুড়ি কেটে লাভ নেই। মোদ্দা কথাটি হল, বাবার সেই আঁচিলটি কাঁধের কোন দিকে ছিল, আজ কদিন স্মৃতিসুতো টেনে হিঁচড়েও মনে আনতে পারছে না মলিন। অবসর সময়ে বসে বসে একবার বাঁ আর একবার ডান কাঁধে হাত বুলিয়ে বুঝতে চাইছে।

- কী গো, ঘাড়ে হাত বোলাও কেন?

- না এমনি।

- ব্যথা হয়? স্পন্ডালাইটিসের ব্যথাটা বেড়েছে নাকি? বলি অত ভারী বাজারব্যাগ টানবে না... তা না...

- আরে না না... তা নয়...
আধখাপচা বললেও ব্যথার কথাটি খুলে বলতে পারে না মলিন। পাগল ভাবতে পারে সব। মলিন ভাবে, বাবার দেহ - লগ্ন একটি আঁচিল ও তার দিকনির্ণয়, এই পড়তি বয়সে এসে খানিক কঠিন বইকি! আর তা স্মৃতিপথ থেকে ছিটকে গেলেও দোষেরই বা কী! সে তো ছিল সেই পিঠে উঠে ঘোড়া - সওয়ার খেলার ছেলেবেলা। আর দুষ্টুমি করে আঁচিলটি খোঁটা। বাবা নকল বকা দিত আর অমলিন মজা পেত মলিন। সে কি আজকের কথা! বাবা ছবি হয়েছে বছর সাতেক। মলিনের বয়সেও পথ পেরোনোর মালিন্য লেগেছে। মাঝখানের দীর্ঘকাল আঁচিলের সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে বয়সটানে। আসলে বয়সের এগিয়ে চলা তো আগেকার আদুরে সম্পর্কগুলিকে মাড়িয়ে থেঁতলে দেওয়া। সে বাবার আঁচিল হোক বা মায়ের আঁচল। এভাবেই গড়ে ওঠে দূরত্ব - স্পর্শের দূরত্ব, স্মৃতিরও। সে অর্থে অনেকদিনই তো হল সেই আঁচিলটির সঙ্গে সহবাস ঘুচে গেছে মলিনের। তাই বোধ হয় মনে করতে পারছে না তার সঠিক অবস্থান। জন্মদাতার ঔরসজাত হয়েও ভুলে যাচ্ছে।

অপরাধবোধ জন্মাচ্ছে তার। ভুলে যাওয়ার অপরাধ। স্মৃতিতে ধরে না রাখার অপরাধ।
মলিন ভাবছে এভাবে কি পুরো মানুষটিকেই ভুলে যাবে! একদিন! ' কেউ ' মানুষটি কি ' নেই ' হয়ে নিক্ষিপ্ত হবে স্মৃতির আস্তাকুঁড়ে! শিউরে ওঠে মলিন। অথচ তার নিজের দেহলগ্ন ক্ষতটি তো ভুলে যায় না সে। ক্ষতটি মানে ক্ষতের কারণটি। তখন তার ক্লাস সিক্স। বায়না ধরেছিল বর্ডার দেখবে। যাবে বাবার সাইকেলে চেপে মাথাভাঙা নদীর ধারে যার ওপারেই ভিনদেশ। সে দেশের লোকজন ঠিক তাদেরই মতো কি না তা জানার অপার কৌতূহল ছিল তার। তা ছাড়া মাঠঘাট, ক্ষেতফসল। আকাশটাও কি আলাদা! এইসব ছেলেমানুষী প্রশ্নে তোলপাড় হতে হতে একদিন সে চেপে বসল বাবার রবিনহুড সাইকেলের লোহারডে। আদুরে যত্নে বাবা সেখানে লুঙ্গি জড়িয়ে বেঁধে দিয়েছিল যাতে করে ছেলের নরম পাছাচামড়ায় আঘাত না লাগে। সেখানে বসেই পা দুটো মুড়ে সামনের চাকার ঢাকনার ওপর রেখেছিল সে। চড়ে বসা অব্দি বাবার সাবধানবাণী, ' পা খুলে নামাবি না, চাকার স্পোকে ঢুকে যাবে। ' সব সময় কি অত তটস্থ থাকা যায়? অচেনার আনন্দে মলিনের মন তখন হাঁকপাঁক করছে। আরবপুর বুড়ো বটতলা পেরোতেই বাঁ পা আলগা হয়ে চলন্ত চাকার ফাঁদে পড়ে ছাল ছড়ে কেটে যায়। বাবা বকাঝকা দিয়ে কী আর করে। পকেটের তোয়ালে রুমাল বের করে কাটা জায়গা বেঁধে দেয়। আর সেই ব্যথা নিয়েই মলিন ঘুরে আসে বর্ডার দর্শন করে।
আজ সে মাথাভাঙা প্রায় পরিচয়হীন এক সীমারেখা মাত্র। এপারে যে মানুষ ওপারেও তাই। তবুও বিস্তর ফারাক যেন! নদীটি নেই কিন্তু থেকে গেছে বাঁ পায়ের সেই ক্ষতচিহ্নটি। তার সঙ্গে দেশভাগের যোগাযোগ না থাকলেও স্মৃতিকাতরতার যোগ তো আছেই। বাবার স্মৃতি, তার আদুরে প্রলেপের অধরা ছোঁয়া।
'কিন্তু বাবা, তোমাকে যে ছুঁয়ে ছুঁয়ে থাকতাম সেই অমল শৈশবে বা বালকবেলায় তাকে তো আর ধরতে পারি না!' মলিন আবার আঙুল চালায় তার কাঁধের এদিক ওদিক । হঠাৎ মনে পড়ল, একবার ঝুরির নাড়ুর ঝুরি ভাজতে গিয়ে বাবার হাতে গরম তেল পড়ে পুড়ে গিয়েছিল। ঘটনাটি মনে আছে, মনে নেই হাতটি। ডান না বাঁ! মনে পড়ে না। মলিন খিন্ন হয়।

মানুষটি ছিল বৃশ্চিক রাশির। খুবই ঠান্ডা মাথার। কিন্তু একটিবার রাগ চেপে বসলে তার প্রকাশ হত ভয়ানক। একেবারে শিবনেত্য করে ছাড়ত। এভাবে রাশিবিচার সে বুঝত না। যুক্তি-বিজ্ঞান সেখানে ছিল বা আছে কি না, মলিন জানে না। তবে বিভিন্ন রাশির মেজাজ-মর্জি ভিন্নতর। সেভাবেই বোঝানো হয়। যেমন মায়ের সিংহ রাশি। অবুঝ জেদ যার সঙ্গী।

যাহোক, মলিনের ছিল অঙ্কভীতি। একদিন অঙ্ক করাতে বসে গসাগু লসাগু গুলিয়ে ফেলায় ক্রোধোন্মত্ত বাবা দরজার হুড়কো চৌকির ওপর দড়াম দড়াম বসিয়ে মুখে চিৎকার, ' আজ তোকে মেরেই ফেলব। ' বাড়ির লোকজন ছেলেটা মরে গেল ভেবে ছুটে এসে দেখে হুড়কোর একটা বাড়িও মলিনকে ছোঁয়নি। সিনেমার মারামারির ঢঙে এদিক ওদিক পড়েছে। মলিন পরে বুঝেছিল, বাবা রাগী হলেও সাবধানী ছিল। আর সেই সচেতন সাবধানতা পাথেয় করেই মলিনের জন্য রেখে গিয়েছিল কষ্টের বেশ কিছু অর্থ যাতে হঠাৎ অনর্থ না ঘটে যায় একমাত্র ছেলের জীবনে।

অথচ সেই বাবার আঁচিলটিই হাতড়ে বেড়াচ্ছে মলিন এখন।

একেই কি বলে জীবন?

জীবনের নিষ্ঠুর চলমানতা!! 
মা আজ প্রায় বিছানাগত। দাপটে কিছুটা টান ধরলেও একেবারে বিদায় নেয়নি। জীবনভর অবুঝ জেদের শিকার সে। মলিনের মনে পড়ে, তখন ক্লাস ফোর - টোর হবে। ছোটকা ফুকত নং টেন। কী এক অমোঘ আকর্ষণে তক্কে তক্কে থাকত সে। কাকু কখন ছুঁড়ে ফেলে শেষের মহার্ঘ অংশটি। ফেলা মাত্রই সবার অলক্ষ্যে তাকে আঙুলের ফাঁদে ফেলে ধানগোলার পেছনে। ধোঁয়া গিলে কাশি, কাশি উগরে ধোঁয়া। মজা মন্দ ছিল না। অচিন মজা। আর বেড়ে ওঠা সেই মজার পথ বেয়ে পড়ল আর এক কাকুর পাল্লায়। গাঁ - তুতো নান্টু কাকু। তার ছিল মুদি দোকান। নাথ পাড়ায়। প্রায়ই আসত মলিনদের বাড়ি। বউদিদের সঙ্গে গপসপ করতে। আর সিগারেট ফুঁকত ফুকফুক। কাছে ঘেঁষতে ঘেঁষতে ঘোর লাগা মলিনকে আড়পে নিল সে। একদিন এন্তার টানটুন শেষে মায়ের পাশে বসেছে। ব্যস, দুর্বাস নাকে যাওয়ায় মা তো অগ্নিশর্মা। তখনও লেবুপাতায় গন্ধ মারার বিদ্যা শেখেনি মলিন। পরে শিখেছিল, সমবয়সী ছোটোমামার কাছে। সে যাই হোক, মায়ের বিচার শুরু হয়ে গেল, ' তুই ফুঁকেছিস, নান্টুর সঙ্গে? আজ তোর একদিন কি আমার একদিন। ' নান্টুকাকু তো ততক্ষণে গালমন্দ খেয়ে সদরদোর পার। আর মা মলিনকে পিটতে পিটতে বাইরের পুকুরে নিয়ে গেল। চুবিয়ে মারবে এই প্রতিজ্ঞায়। বাবা বাড়ি ছিল না। জলে নামিয়ে চোবাতে যাবে এই মুহূর্তে রক্ষাকর্তা হয়ে দাদু হাজির। কোনওমতে বউমার কবজা থেকে নাতিকে ছাড়িয়ে ভেতরবাড়ি। সে ছিল এক স্মরণীয় মার। এরপর মা উঠোনে এসে ধপাস। মায়ের ছিল হিস্টিরিয়া। রাগ মাথায় চড়লে শুয়ে পড়ে গোঁ গোঁ করত আর হাত-পা সিঁটিয়ে ছুঁড়ত। তখন দশ জোয়ানের শক্তি ধরত মা।

বাবার রাগের আড়াল ছিল। মায়ের ছিল না।
আচ্ছা, মা কি বাবার সাকার ছবিটি খোঁজে কখনও! দীর্ঘ আবেশে মিশে থাকা শরীরের কোনও কোনাখামচি! মায়ের ইদানীংকালের একলাসেঁড়ে যাপন দেখে মনে তো হয় না। তবে বাৎসরিক না - দেহী স্বামীর সামনে মেলে দেওয়া শ্বেত কালাকাদের দিকে নজর থাকে এই বয়সেও মিষ্টি - প্রিয় মায়ের। কেউ কেউ মজা করে বলে মায়ের মাঝ দিয়েই বাবা খায়। দীর্ঘ উনষাট বছরের সহ - জীবন কিছুই কি ফেলে যায়নি! আদৌ কি কিছু ফেলে যায়!! তাহলে আর মহাজনেরা বলেছেন কেন, বিংশ শতকে শোকের আয়ু মাত্র...! সেটাই হয়তো নিষ্ঠুর সত্য। নইলে আঁচিলের ঠাঁই খুঁজে পাচ্ছে না কেন মলিন?
এই ভাবনা- পথেই মলিনের হাতে উঠে আসে একটি শাদা কাপড়ের ক্যারিব্যাগ। তার গায়ে লেখা, আই সি সি ইউ, বেড নং ৯। বাবার শেষ কদিনের সাংখ্যিক পরিচয়। নিউমারলজির বিচারে মিল আছে। বাবার জন্মতারিখ সাতাশ - দুই আর সাত। এ দুটো যোগ করলে তো নয়ই হয়! সেই সংখ্যার খপ্পরে পড়েই কি...! আসলে তা ঠিক নয়। মফস্বল শহরের প্রাইভেট হাসপাতালে সঠিক চিকিৎসা হয়নি বাবার। মলিন কলকাতায় শিফট করাতে চেয়েছিল। গম্ভীর ডাক্তার রায় দিয়েছিল, ' এতটা পথ, খুব চাপ হয়ে যাবে। ' এই কথায় কি ভয় - ভাবনা ছিল, নাকি ছিল প্রাপ্তির হিসাব! এখন যেমন ভেন্টিলেশনে ঢোকাতে পারলেই প্রাইভেটের রমরমা। বাবার কিন্তু চিরকালই শরীর নিয়ে ভয়ভীত কম ছিল যা মায়ের নেই। তাই ন দিনের হাসপাতাল বাসের শুরুতেই তার চেহারা ছিল অভূতপূর্ব! ভর্তির দিন সকালে মলিনকে দিয়ে দাড়ি কাটিয়ে নিল। বউমাকে হেঁকে ধোপদুরস্ত ধুতি পাঞ্জাবী পরল। যেন বরযাত্রী যাচ্ছে। চার চাকায় আপত্তি জানিয়ে রিকশা ডাকতে বলল। তাতে চড়তে চড়তে বলল, ' কিচ্ছু হবে না। দু বোতল স্যালাইন নেব, তারপরই ফিরে আসব। '

কম কথা বলা মানুষটি কি বুঝতে পেরেছিল! তাই মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে চিন্তামুক্ত করতে চেয়েছিল গৃহস্থ আপনজনেদের? হুঁঃ... আপনজন!
আজ সেই আপনজন আমরা বাবার শেষ স্মৃতিজড়িত ব্যাগটিতে সবজি জড়িয়ে ফ্রিজপেটে রাখি। কিছুই তো মনে হয় না!

বাবা কিন্তু ফিরতে চেয়েছিল। দিনছয়েক পর থেকেই থেকে থেকে খোঁজ করে বলত, ' মিলন আসেনি? আমাকে নিয়ে যাবে কখন? ' তখন কথা জড়িয়ে এসেছিল বেশ। ঠিক ন দিনের মাথায় ভোরবেলার ধারাপাতের মাঝে বাবা চলে গেছে। সব আশ্লেষ ছিন্ন করে। এখানেও সেই নয় সংখ্যা। যাওয়ার সেই বিধুর ক্ষণে কিছু কি বলতে চেয়েছিল? কাউকে কি দেখতে চেয়েছিল?... অজানাই থেকে গেল সব।
আসলে সংসার, পরিবার নামক ঘেরাটোপে আমরা লগ্ন হয়ে থাকি বটে কিন্তু কেউ কাউকে কি সেভাবে চিনি? জানতে চাই? না। চেনা - জানার ভান করি মাত্র।

এভাবেই দিনাতিপাত। দেখভাল।

আর এভাবেই ফুরিয়ে যাওয়া একদিন।

তাইতো বাবার স্মৃতিবিজড়িত যা কিছু তা নিয়ে তাৎক্ষণিক আবেগে ভাসলেও বিস্মৃতি একটু একটু করে গ্রাস করে সব। তখন ভালোবাসার আঁচিলটিও মুছে যেতে থাকে একটু একটু করে। এটাই জীবন। জীবনের চলমান নিষ্ঠুরতা। স্মৃতিপেষণের গতিময়তা।

- বসে বসে কী ভাবছিস মিলন? পেছনের কথা?

- ' মিলন ' কেন! আমি তো মলিন। আর পেছনের কথা ভাবব কেন? ভাবছি তো সামনের কথা।

- একই তো হল রে মিলন। তোকে সামনে রেখে তুই আমার কথা ভাবছিস। ভেবে কষ্ট পাচ্ছিস। তাই তো?

- তা তো হল কিন্তু মিলন কেন? আমি তো মলিন।

- বাঃ, সেটাও ভুলে গেছিস? তোকে তো মিলন বলেই ডাকতাম। তুই মলিন হতে যাবি কেন?

তাইতো! আমার যে সব গুলিয়ে যাচ্ছে! আমি মলিন না মিলন?

- আবার ধন্দে পড়েছিস? তোর এত মালিন্য কীসের? জড়ো করা স্মৃতির? মনে আছে, মুদি দোকানের ঠোঙা বাঁধার ছোটো ছোটো সুতলি দড়িগুলি না ফেলে আমি বারান্দার লোহার গ্রিলে বেঁধে রাখতাম?
 - হুঁ, মনে পড়ছে। একদিন আমি অশোভন লাগছে দেখে সব...
 - খুলে ফেলে দিয়েছিলি। তোর মায়েরও মদত ছিল। 
- তাই তো! 
- আমি চলে গেলে তোরা তো একে একে সবই বিলিয়ে দিয়েছিস, ফেলে দিয়েছিস, পুড়িয়ে দিয়েছিস। দিসনি? তোর একমাত্র মেয়ে আমার সাধের নাতনি আমার চশমা - জাতীয় একান্তপ্রিয় কয়েকটি বস্তু চোখের জলে শুদ্ধ করে নিয়ে গিয়েছিল। সে সব তো হারিয়ে বসে আছে। তোর কষ্ট হচ্ছে এ সব শুনে? 
- না, মানে... 
- ঠিকই করেছিস তোরা। কত জঞ্জাল আর বইবি? তোর ঠাকুদ্দার কোনও স্মৃতি কি আর আছে তোর কাছে? বাড়ি - জমির দলিলটা ছাড়া?... ওটা যে খুবই দরকার, তোর প্রয়োজনে। তাইতো? 
- এভাবে বলছ কেন তুমি? 
- ভুল বলছি কিছু? আসলে ছবিটা টাঙিয়ে রাখিস সমাজের ভয়ে। যে সমাজ নকলনবিশিতে ভরা। তাই সামান্য আঁচিলের জন্য মন খারাপ করিস না। ওটা উপলক্ষ মাত্র। স্মৃতি মানুষকে বেড়ি পরিয়ে রাখে। ভেঙে বেরিয়ে পড়। চোখ জুড়ে, প্রাণ ভরে উপভোগ কর জীবন, জীবনের রসকষ।...
হঠাৎই সম্বিত ফিরে মলিন ( নাকি মিলন!) ভাবে, বাবা বলত বটে, হেসে নে দুদিন বইতো নয়।

কিন্তু তবু্ও...! মায়ার যে আবছায়া থেকে যায়। তা কি প্রপঞ্চময়! এ সবের সমাধান জানে না সে।
লেখক পরিচিত:
বিপ্লব বিশ্বাস।
গল্পকার। অনুবাদক।
কলকাতায় থাকেন।























একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ