
আজকাল বাড়ি থেকেই অফিস করা দস্তুর। ব্রজেশ পান্ডেকে দিল্লীর যানজট ঠেলতে হচ্ছে না রোজ রোজ। সীমাপুরী থেকে আবহাওয়া দপ্তর আর না হলেও দেড় ঘণ্টার ধাক্কা। ইদানীং এই বেশী সময়টা বিছানায় ওলমোলে মহাসুখ। বাতাস তেতে উঠছে দিনদিন, সুমিত্রা বাইরে রোদ বাড়ার আগেই এসিটা আর একটু কমিয়ে দিয়ে যায়। এসির গুনগুন আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে ব্রজেশ মৃদুমন্দ নাক ডাকান। একটা ব্যাপার খেয়াল করেছেন যে সকালবেলার ঘুমে নাক ডাকাটা নিজেও বেশ স্পষ্ট বোঝা যায়, বুঝে খুব তৃপ্তি পান পান্ডেজি। সিগারেটের শেষ সুখটানের মত তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেন এই উপরি ঘুমের সময়টা। ঘড়ির কাঁটা নটা ছুঁইছুঁই করলে সুমিত্রা চা সাজিয়ে ডাক দেয়। এটা আর একটা উপরি পাওনা। বারান্দায় বসে চা খাওয়া। লকডাউনে দিল্লীর বাতাসে হঠাত ফেরা স্নিগ্ধতা, আকাশ আবার আকাশী নীল। কান পাতলে পাখিদের কিচির মিচির অবধি শোনা যায়। বারান্দার আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে চায়ে বিস্কুট চুবিয়ে অবাক হয়ে ভাবেন ব্রজেশ পান্ডে। এই পাখিগুলো এতদিন ছিল কোথায়?
লাঞ্চবক্সে রুটি সবজি ভরে হাতে ধরাবার তাড়া নেই আজকাল। তাই সুমিত্রাও চায়ের কাপ হাতে রেলিং ধরে দাঁড়ায়। সকালের হাওয়ায় উড়নিটা ফিনফিন করে ওড়ে। ভোররাত থেকে তাড়ায় না থাকলে মানুষের মুখ বুঝি অনেক নরম হয়। সুমিত্রা মাঝে মধ্যে গুনগুন করে সুর ভাঁজতে থাকে। একসময় রাগ সঙ্গীতে খুব টান ছিল, এখন আর সেরকম চর্চা নেই। বিয়ের পর পর রেয়াজে বসত, আজকাল কালে ভদ্রে। সুরের কোমল ছাপ গালে, মুখে ছড়িয়ে যায় সুমিত্রার।
আহা, এমন গাইতে পারো তো আগের মত। রাগ ভৈঁরো বুঝি? চায়ে চুমুক দিয়ে পান্ডেজি জানতেও চেয়েছেন কখনো সখনো।
সুমিত্রা হেসে ফেলেছেন। এট হল কোমল গান্ধার। বিলম্বিত সকালের রাগ। এমন দম ফেলার মত সকাল আমার ছিল কই?
সুমিত্রার গলায় সামান্য ঠেস দেওয়ার চেষ্টা থাকলেও পান্ডেজির প্রসন্নতায় তেমন বাধাসৃষ্টি হয় না। বরং কখনো বলেছেন, এই লকডাউনটা দেখে মনে হচ্ছে, অবসরজীবনটা নেহাত মন্দ না। এর উত্তরে সুমিত্রা কিছু খোসগল্প করে। এইসব লকডাউনের মধ্যে ডিএ বাড়বে কিনা সেই নিয়ে চিন্তার আদান প্রদান হয়। কথাবার্তা অনিবার্য গতিতে খাওয়ার দিকে এগিয়ে যায়। নাস্তায় আলুর পরোটা খাওয়া হবে নাকি ঘি লিট্টি ভাল হয় সেই নিয়ে খানিক আলোচনা হয়। অনলাইনে আনাজ থেকে শুরু করে সব কিছু বাড়িতে বসেই আনানো যাচ্ছে সেটাও ব্রজেশ পান্ডের একটা আনন্দের বিষয়। না হলে সকালবেলা বার দুয়েক পাড়ার দোকানে ছুটতে হত তাকে। বাঁধাধরা।
মোটের উপর দিনের এই সময়টা জব্বর কাটছে। কয়েক সপ্তাহ এমন কাটার পর এটার পুরোদস্তুর হকদার হয়ে উঠেছেন আবহাওয়া দপ্তরের বড়বাবু। ঘুম থেকে কাজের জগতে অবতরণের এই মসৃন পথ পরিক্রমায় কোন বাধা বিঘ্ন আসতে দেন না মোটেই। কিন্তু আজ সেটাই হল।
সুমিত্রা বিছানা ছেড়ে উঠে গেছে। ব্রজেস ফুরুত ফুরুত করে নিজের নাক ডাকা শুনতে শুনতে ঘুমাচ্ছেন। এরকম সময় তার মোবাইল বেজে উঠল। প্রানপনে ঘুমটাকে অখণ্ড রাখতে রাখতে হাত বাড়িয়ে ফোনটাকে কানের গোড়ায় ধরলেন। জি, পান্ডে।
স্যারজি গজব হো গয়া। ওপাশ থেকে প্রায় ধসে পড়া গলা রবিন্দ্রনের।
ব্যাটা আর ফোন করার সময় পেলো না? আর্মি ভেটারেন রবিন্দ্রন কোনদিন গুড মর্নিং না বলে কথা শুরু করে না মোটেই। আজ সেটাও বলে নি, তার মানে জবরদস্ত কিছু ঘটে গেছে। এটা ভাবতেই এমন ফুলকো ঘুমটা একেবারে চটকে গেল ব্রজেশ পান্ডের। আজকের সকালটা আর কোমল গান্ধারে এলো না। গলাটা পরিষ্কার করে জানতে চাইলেন, ব্যাপারটা কি? সকালবেলা কোন শোকসংবাদ শোনাতে এসেছো?
রবিন্দ্রনকে রোজ একবার অফিসে হাজিরা দিতে হয়, সব ঠিকঠাক আছে কিনা দেখার জন্য। ব্যাটাকে ভাইরাসে ধরল নাকি? তবেই তো খেয়েছে। রবিন্দ্রনের জায়গায় তাকেই রোজ একবার করে অফিসে ঢুঁ মারতে হবে। এই ভাবনাটা নিয়ে ধড়মড় করে বিছানা ছেড়ে উঠে বালিশটাকে পিঠে দিয়ে বসে পড়লেন ব্রজেশ। তাড়তাড়ি জায়গা বদল করতে গিয়ে পিঠে একটা হ্যাঁচকা টান লেগে গেল। মাদারচোত! কাতরোক্তির সঙ্গে বেরিয়ে আসা শব্দটা কোনমতে ফোনের থেকে দূরে রাখলেন পান্ডেজি। ব্যাপারটা কি, এমন হাঁফাচ্ছ কেন সকাল সকাল?
সত্যি সত্যি হাঁফাচ্ছিল রবিন্দ্রন। ঘুমের পর্দাটা পুরোপুরি সরে যেতেই ওর গলার ভয়টা ছুঁয়ে ফেলল পান্ডেকে।
স্যারজি, এক ঘণ্টা ধরে অফিসের উপর নীচ করছি শুধু। আমার তো মাথায় কিচ্ছু আসছে না, ডর লাগছে স্যারজি।
আরে, কি হয়েছে সেটা বলবে তো আগে। যত্তো ধানাই পানাই। ফোনের মধ্যে খিঁচিয়ে উঠলেন ব্রজেশ পান্ডে।
পবন লা পাতা স্যারজি। কথাটা বুকফাটা হাহাকারের মত বেরিয়ে এলো রবিন্দ্রনের গলা থেকে।
কোন পবন? কে পবন?
ঝড় স্যারজি, ঝড়! আমাদের কাছে আর দুটোই তো ঝড় রেডি ছিল। পবন আর আম্ফান। পবনটা ভেগেছে।
আবহাওয়া দপ্তরে ঝড় জমানো থাকে আগের থেকে। সব দেশের থেকে ঝড় নিয়ে নিয়ে ভারত মহাসাগরের জন্য ষাটচৌষট্টিটা ঝড় তৈরী ছিল তাদের। সব কটা ঝড় হয়ে গিয়ে গিয়ে শেষের কটায় ঠেকেছিল। ফনি, আলেয়া, বুলবুল তাদের খেল দেখিয়ে এখন দপ্তরের নথি হয়ে গেছে। বাকি ছিল হাতে গোনা দুটো – এই পবন আর আম্ফান। সেই পবন? ঘড়ঘড়ে গলায় হেঁকে উঠলেন ব্রজেশ পান্ডে। রবিন্দ্রন রোজকার দেখভাল করলেও দপ্তরের বাবু হিসাবে এই ঝড়েরা তার দায়িত্বে। সেই ঝড় কিভাবে ভেগে যেতে পারে মাথায় ঢুকছিল না মোটেই।
হ্যাঁ সারজি। ফোনের মধ্যেও রবিন্দ্রনের মাথা চুলকানো বুঝতে পারলেন ব্রজেশ পান্ডে।
জানলে কি করে? ঝড়ঘরের দরজা খুলেছিলে নাকি? গলার পারদ চড়ছিল পান্ডেজির। নিকম্মা! দাঁতের ফাঁকে গালি বকলেন লোকটাকে।
আমি তো রোজ অফিসে এসে একবার ঝড় ঘরের দিকে রাউন্ড দিয়ে যাই স্যারজি। কান পেতে শুনি সব ঠিকঠাক আছে কিনা, ফিসফাস কথা শুনি ওদের। আজ সকালে দেখি বড় শুনশান।
কথা শুনি মানে? ঝড়ে আবার কথা বলছে কবে? মাথাটা কেমন পাগল পাগল লাগে পান্ডের। রবিন্দ্রনটার হল কি?
এখন তো অফিস ফাঁকা স্যারজি, জনমানুষ নেই কোথাও। একটা পিন পড়লেও শোনা যায়। এমনিতে যে শব্দ গোচরে আসেনা, এখন তারাও ফুটফাট। আমি ঝড়ঘরের বাইরে ঝাড়পোঁছ করতে করতে বেবাক শুনেছি ওদের কথা। পবন বলে ছোকরা ঝড়টা বিশেষ করে। ছটফট করছিল একেবারে।
ছটফট করবে কেন? ঝড় কি কোন কচি খোকা নাকি যে ছটফট করবে?
ওদের মধ্যে তো খোকাই ছিল স্যারজি। একান্নবর্তী পরিবারের কনিষ্ঠ সন্তান। আর সব ঝড়কে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, তারা তাদের দাপট দেখিয়েছে। গাছ উপড়েছে, ব্রিজ ধসিয়েছে, রেল লাইনের দফারফা করে দিয়েছে। যখন যেখানে এসে পড়েছে, এক্কেবারে চাক্কাবন্ধ। সেসব কি এক একেকটা ঝড়! আইলা, ফনি তাদের নাম নিতে নিতে রবিন্দ্রনের বুক গর্বে ফুলে ফুলে ওঠে। তার ঘরের ছেলেমেয়ে যেন সব। স্যারজি, পবন আর আম্ফান এইসব শোনে আর থেকে থেকে আমরাও কম কি, আমরা আর কতদিন ঘরে আটকা থাকবো বলে হেঁকে হেঁকে উঠছিল।
তুমি কেমন করে জানলে এসব?
আমি শুনতাম তো রোজ, দরজায় কান পেতে। পবনটাই ছিল যত নষ্টের গোড়া, আম্ফানটাকে ফুসলাচ্ছিল।
ব্রজেশ পান্ডে প্রায় বেভুল হয়ে গেছিলেন। তার একবার মনে হল ভোরের ঘুমে যেমন ঘুমের ঘোরেও নিজের নাক ডাকা পরিষ্কার শুনতে পান, এখনো বোধহয় তেমনি রবিন্দ্রনের সঙ্গে এককাট্টা হয়ে স্বপ্ন দেখছেন। কিন্তু পুরোপুরি উড়িয়েও দিতে পারছেন না। রবিন্দ্রন লোকটা এমনিতে ফালতু কথা বেশি বলে না, মন দিয়েই করে নিজের কাজ। ও যদি বলছে, সে কথায় কিছু তো ধক আছে।
ধরলাম তোমার কথাই সত্যি। কিন্তু যাবে তো যাবে টা কি করে? ঘরে কোন ঘুলঘুলিও নেই যে কেউ বাইরে হাঁটা মারবে। বলতে বলতে পান্ডের অ্যান্টেনা খাড়া হয়ে গেল। তুমি কেমন করে জানলে যে পবন ঘরের মধ্যে নেই? খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেরা করতে শুরু করলেন এবার লোকটাকে।
আজ সকালে ঝাড়পোঁছ করতে গিয়ে দরজায় কান পেতেছিলাম স্যারজি। কোন ফিসফাস খসখস আওয়াজ পাই না আর। কেমন যেন সন্দেহ জাগল মনে, ছটফট করতে করতে টেঁসে গেল নাকি। হয় না কখনও ওরকম। শুনিনি একেবারেই। তবু-
তাই বলে ঝড় টেঁসে যাবে?
কত নতুন কিছুই তো ঘটছে স্যারজি। বাইরেই দেখুন না, চারদিকে কি সব হচ্ছে। আগে কখনো শুনেছেন এমনধারা?
তার সঙ্গে এর কি?
এই হাওয়াঅফিসের ভিতরেই দেখুন, একটা লোক নেই, শুধু বাতাস খেলছে। এমনটাও কি দেখেছেন কখনো? বলতে বলতে রবিন্দ্রনের গলায় জোর বাড়ছিল। ফিরিস্তিও। দিল্লীর বাতাসে পেট্রলের ঝাঁঝ নেই, সকাল বেলা পাখি ডাকছে এমনটাও কি কেউ কখনো ভেবেছে! এইসব সাত সতেরো যুক্তি খাড়া করা চলতে থাকে রবিন্দ্রনের।
ধানাই পানাই রাখো দেখি তোমার! তুমি করলেটা কি? উতকন্ঠায় গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছিল ব্রজেশ পান্ডের, আর এই মর্কট ভ্যান্তারা কষছে।
আমি ভাবলাম দিই একবার ঘরের মধ্যে উঁকি, দেখি ভিতরে কান্ডটা কি। কি বলবো স্যারজি, এমন চোরাগোপ্তা হামলা করবে পাকিস্তানি দুশমনের মত, কেমন করে জানব। যেই না দরজা খুলে ভিতরে মাথাটা গলিয়েছি, অমনি দরজার ফাঁক দিয়ে সুরুত করে বেরিয়ে গেল।
উত্তেজনায় ঠকঠক করে কাঁপছিলেন ব্রজেশ। এ ব্যাটা কাজে গাফিলতির ধারায় পড়বে নির্ঘাত। নিজেও ডুববে, তাকেও ডোবাবে হারামখোর। সাসপেনসান অনিবার্য। পাকিস্তানি দুশমন বলে কি আর ধামাচাপা দেওয়া যাবে তখন? খিঁচিয়ে উঠলেন, কে বেরিয়ে গেল?
পবন স্যারজি।
কি করে জানলে? কেমন দেখতে তোমার পবনকে?
ঝড়ো হাওয়া সে একটা, দরজা খুলতেই হুশ করে বেরিয়ে গেল। আমি আর যা হোক দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিলাম বলে, না হলে পিছন পিছন আম্ফানটাও যাচ্ছিল আর কি। ওই যে শুনছেন, এখনো দরজা ঠকঠক করছে ওটা। বেরোতে চায়।
ফোনে সেরকম কিছুই শুনতে পেলেন না ব্রজেশ পান্ডে। কতক্ষণ হয়েছে বেরিয়েছে?
আধা ঘণ্টাটাক তো হবেই। অফিস ঘরের জানালা দিয়ে সুরুত করে নিচে ডাইভ মারল, ওই যে পাম ট্রি গুলো আছে লাইন দিয়ে, তার একটাকে চড় চড়াত করে ভেঙ্গে দিয়ে গেল।
চমকে উঠলেন ওয়েদার পান্ডে। বলো কি এর মধ্যেই এতো? বোতলের দৈত্য বেরিয়ে পড়েছে। হাওয়া বাতাস ঠিকঠাক পেলে কি রূপ যে ধারন করবে বলা মুশকিল। শোন রবিন্দ্রন, কাউকে কিছু বলার নেই, চেপে যাও।
ঝড় উঠবে যে স্যারজি, মানুষজনকে কোন খবর জানাতে হবে না?
থাক এখন ওসব, সব ঝড়ই কথায় কথায় এমন দানা বাঁধে না। উপযুক্ত যোগ সাজস না থাকলে যেমন পাড়ার গুন্ডা ভুইফোঁড় নেতা হয়ে যায় না, ঝড়েরও তেমনি মদত লাগে, উস্কানি লাগে, এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার রসদ লাগে। সেসব এই পবন এমনি এমনি পাবে কোথায়? মুখে বললেন, চেপে থাকো, রবিন্দ্রন। এই তুমি জানো, আর আমি জানলাম ব্যাস। পাঁচ কান যেন না হয়।
একটা গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়লে কারো চাকরি যায় না। তবু দিনটা তো মাটি হয়েই গেল। আজ আর কোমল গান্ধার হল না।
ব্রজেশের জন্য মাটি হলেও, পবনের জন্য মোটেও নয়। স্বাধীনতার স্বাদ চেটেপুটে খাচ্ছিল ছোকরা। মৌসম ভবনের মাথার গোল্লাটাকে পাশ কাটিয়ে কলা দেখিয়ে বেরিয়েছিল। হুঁ হুঁ বাবা, সব জানে পবন। এই নষ্টের গোঁড়াটাই না তাদের যাওয়ার পথঘাট ঠাহর করে করে লোকেদের বাতলে দেয়। এত তাড়াতাড়ি মোটেই ওর চোখে ধরা দিচ্ছে না। পাঁচ তলার কার্নিশ ঘেঁসে নেবে সুরুত করে বেরোতেই গদাম ধাক্কা এক ঠ্যাঙে দাঁড়ানো গাছটার সঙ্গে। ব্যাস, চড় চড় চড়াত করে ভেঙ্গে পড়ল পাটকাঠির মত। একদিকে ভালই হল দেখতে গেলে। একটু ভয় ভয় তো লাগছিল এমনিভাবে বেরিয়ে এসে। গাছটা ভেঙ্গে বলভরসা পেলো। সেও পারে! ব্যাস, ঝকাস বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়।
এলো তো এলো, কিন্তু আরও হাওয়া জোটায় কোথা থেকে? জোরালো একটা ঝড় ওঠাতে অনেক হাওয়ার হাতমিলন্তি চাই। তৈরী করতে হয় উদ্দেশ্যে স্থির এক ধারাল চোখ। কোথায় পাবে নিম্নচাপ, ফুলেফেঁপে ওঠার কলকব্জা! বুলবুল, আয়লা এদের কাছে শুনেছে ঘূর্ণি আসার আগে থেকেই চারদিক থমথমে হয়ে যায়, যে যেখানে পারছে ইঁদুরের মত ঘরে সিঁধিয়ে যায় নাকি। তারপর ঘরশুদ্ধুই উড়ে যায়। পথে একপাক মেরে ধুলো উড়ানোর কসরত করেই পবন দেখল যেদিকে দুচোখ যায় জনমনিষ্যি নেই কোথাও। কাকে আর ভয় দেখাবে? না কি লোকে জেনে গেছে তার আসার কথা? পবন বেরিয়েছে সেই খবর চাউর হয়ে গেছে কি চারদিকে? সে তাহলে খবর হয়ে গেছে। একপাক নেচে নিতে ইচ্ছে করল পবনের। কিন্তু নাচল না মোটেই। চেপে চুপে থাকতে হবে এখন। কত ঝড় শুরু হওয়ার আগেই দম হারিয়ে ফেলে, আবহাওয়া দপ্তর থেকে বলে দেয় অমুক ঝড় কেমন আসতে আসতেও এলো না, কিংবা বাঁক ঘুরে লোকালয় থেকে দূরে সমুদ্র সমাধি পেয়েছে। একেবারে আটঘাট বেঁধে নাবতে হবে। সে এমনধারা ঝড় হবে যার নামে কাগজের হেডলাইন বাঁধবে লোকে যেমন ঝড়ের নাম বুলবুল কিংবা ফনি যখন শনি। এক যুগ পরেও নাম শুনে থরথরাবে লোকে। জমিয়ে ভাংচুর করে দুনিয়ার খোল নলচে পাল্টে দিতে না পারলে ঝড় জন্ম তো বৃথাই গেল, নাকি? আশা আকাংখায় টগবগ করছিল পবন। এখন শুধু বুকে অনেক বাতাস চাই। বাইরের থেকে ছোটখাটো হাওয়াদের এককাট্টা করতে পারলেই হয়ে উঠতে পারবে এক বেপরোয়া ঘূর্ণিঝড়, যাকে সামলাতে গিয়ে নাকের জলে চোখের জলে হয়ে যাবে বাবুলোক। সামলাতে না পেরে তাবড় লোকের গদি উল্টাবে, চেনা পৃথিবীটা এক ঝটকায় বদলে যাবে আগাপাশতলা।
কিন্তু বাইরের হাবভাব কিছু বুঝতে পারছে না। পবনের আগেই কি কোন ঝড় এসে হাজির হল? লোদী রোড শুনশান দেখে সেটাই মাথায় এলো। কুছ পরোয়া নেই, হাত মেলাবে তার সঙ্গেই, ধংসের খেলায় নাববে একসঙ্গে। কিন্তু ঝড় যদি, মাথার উপর এত তাত কেন? জব্বর রোদ উঠেছে বটে একখানা। আকাশ ভরা আলোর চাঁদোয়া। ঝড় এলে যেমন পাংশু রং ধরে, তেমনধারা নয়। অথচ পথে একটাও লোক নেই। ফাঁকা পথেই ধুলা ওড়াতে ওড়াতে চলল পবন। হঠাত ওঠা ধুলোয় ভড়কি খেয়ে কিছু কুকুর ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে এলো। কিন্তু লোক নেই জন নেই ধুলো কেন ওড়ে তার কিনারা না পেয়ে ফিরে গেল নিজের নিজের গলিতে। ব্যাস, কাপাসহেরায় পৌঁছানো অবধি আর কাউকে দেখতে পায়নি। সেখানেও কি কেউ ছিল নাকি? হঠাত একটা বাড়ির ভেতর থেকে কে যেন পোঁটলা পুটলি ছুঁড়ে দিল, তার পিছনে পিছনে পোঁটলার মতই হুমড়ি খেয়ে এসে পড়ল আরও জনা চারেক লোক। দুটো তো ছোকরা গোছের, বাকি দুজনার চোখের কোনে মাকড়সার জালের মত কাটাকুটি, দাড়ি ফটফটে সাদা। একটা বুড়ো তো এতোই নড়বড়ে যে লুঙ্গির খুঁট পাকাতে পাকাতে উঠে দাঁড়াতে গিয়েই আবার টাল খেয়ে পড়ল।
ছোকরা দুটো কোথায় বুড়োকে এসে ধরবে, না মাথা গুঁজে মাটি থেকে পোঁটলা পুঁটলি একাট্টা করতে ব্যাস্ত। রাস্তার মাঝখান থেকে এক এক করে সরিয়ে ধার ঘেঁসে রাখছে। এর মধ্যে লাঠি হাতে বেরিয়ে এলো এক ষণ্ডা। বুড়োটা ওকে দেখে কান্নাও জুড়ে দিয়েছে এবার। বাইরে এমন কায়ামত, যাই কোথায় মাইবাপ? মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই লাগে গো কত্তা।
নিজের পাছা হেলিয়ে মুখ বাঁকাল লোকটা। ফিরি থাকবে তাই বলে? তোমার ঠাঁই জোগাবার ঠেকা নিয়েছি আমি? দড়াম করে দরজা লাগিয়ে এবার তালা ঝোলালো। নগদ ঝাড়ো, আবার চাবি পাবে।
ছোকরাদুটো এবার ওর পায়েই ঝাঁপিয়ে পড়ল। আর দুটো রাত্তির থাকতে দ্যান গো কত্তা, তারপর চলে যাবো খনে।
এ হে হে হে, দুরাত থাকলেই হাতে সোনা চাঁদি এসে যাবে হাভাতের দল? গাঁড় মারিয়ে আসবি কোথাও? খ্যাক খ্যাক করে হেসে ক্যাঁত করে এক লাথি কসাল একটা ছোকরাকে।
ছোকরার রক্তে কি কোন তেজ নেই নাকি? পবন পথ থেকে দেখতে দেখতে ভাবছিল। এদের তো চারটে লোক, হোক না দুটো বুড়ো। ভাবল, এক্ষুনি ওরা সব কটা মিলে ঝাঁপিয়ে পড়বে এই লোকটার উপর, হাত থেকে চাবি ছিনিয়ে নেবে হয়তোবা। পারে তো, মানুষের রাগ কি হতে নেই? কিন্তু এসব কিছুই করল না। লাথি খাওয়া কুকুরের মত কুঁই কুঁই করতে করতে রাস্তার ধারে উবু হয়ে বসে রইল। একটা বুড়ো পথে ছড়িয়ে পড়া রুটি কুড়াচ্ছিল। রুটিতে ঘষাঘষি করে ধুলো ঝেড়ে হাতে হাতে ধরাল, খেয়ে লও বাপজান, দোকান বাজার বন্ধ, আবার কোন প্রহরে খাবার জোটে।
ওই ভাবেই পথের ধুলোয় পাছা পেতে রুটি আর নুন খেতে শুরু করল চারজনায়। পবন দেখছিল ওদের মুখের প্রতিটা রেখা কষ্টে বেঁকে যাচ্ছে ওদের শরীরের মত। কিন্তু তবু ছিলেছেঁড়া ধনুক যেন একেকজনা, পালটা দেওয়ার মত হিম্মত নেই। শুধু রুটি খেতে খেতে গুনগুন করছিল।
বাবুদের কি যে বিমার হল, সব ঝাঁপ বুজিয়ে দিল।
পথে না নাবলে আর আসবে কেন লোকে জামা সিলাই করতে!
আমরা যে পথে এসে পড়লাম, আমাদের যদি বিমার হয় ইবার?
রুটি পেটে পড়ে সাদা দাড়ি বুড়ার মুখে হাসি ফুটেছে এতক্ষণে। শক্ত জান রে আমাদের। চার কুড়ি বয়েস পার করলাম, কত কিসিমের বুখার এলো গেলো, এই বুড়ো হাড়ে সেঁধাতে পারল? নিজের শক্তিতে নিজেই আশ্চর্য বোধ করে বুড়োটা।
কিন্তুক যাবো কোথায় চাচা?
কোথায় আবার, ঘরকে যাবা নে।
ঘর থিকেই তো তাড়িয়ে দিল না চাচা?
ই ঘর নয় রে বাপ, নিজের ভিটে। নিজের ভিটের ঘেরান নিয়ে মরণেও শান্তি।
সেতো হাজার মাইল দূরে গো চাচা, টেরেন নেই, বাস নেই সবেতেই হরতাল।
দুই বুড়ো তখন হাঁটার বেত্তান্ত শুনিয়ে জাঁক করে।
দাঙ্গায় কতবার বাড়ি পুড়ল, রাতের অন্ধকারে পালুইনি? কত শতেক মাইল গেছনু সিবার?
বানভাসি হল সিবার, গলা ইস্তক পানি। মাথায় পুঁটলি নিয়ে দূর দূর চলি গেলাম।
গান্ধীবুড়ি মরলি যিবার, সব ঝাঁপ বন্ধ। হাঁটিনি মোরা? যাইনি শহর ছেড়্যা?
আর যদি পুলুসে ধরে?
চোখে ধুল মেরে পলাতে হবে। দরকার পড়লি রাতের আন্ধার আঁকড়ে হাঁটব।
বলতে বলতে ওদের মুখের কষ্ট মুছে যাচ্ছিল। নিজের বাড়ির কলকিফুলের গন্ধ এখন ওদের শরীরের ঘ্রানে। বাড়ি যাওয়ার প্রত্যাশায় শরীর টানটান হয়ে যাচ্ছিল। পবন চাইছিল এই ইচ্ছাগুলো ওদেরকে আগ্রাসী করে তুলুক, ওরা একটা জোরালো হাওয়া তৈরী করুক, সেই হাওয়া জমিয়ে ফুলে ফেঁপে উঠলে তৈরী হবে ঝড়ো বাতাস। কিন্তু ওরা সেসব কিছুই করল না। পিঠে যেমন যার বোঁচকা তুলে নিয়ে ফের হাঁটা মারল। ঘাড়টা একটু ঝুঁকিয়ে, ফাঁকা রাস্তার ধার ধরে ধরে।
পবন আর কি করে, মুখ গোমড়া করে চলল ওদের পিছনে পিছনে। দেখা যাক কোথায় যাচ্ছে। ওদের কথা শুনতে শুনতে ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছিল ব্যাপারটা। রাস্তা ফাঁকা কোন ঝড় তুফানের জন্য নয়। দেশে কোন ছোঁয়াচ রোগ এসেছে, বাবুরা সবাই এখন ঘরে সিঁধিয়েছে। বাইরে কারো যাওয়ার নিয়ম নেই নাকি। তারা শুধু জানালা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারতে পারে, সন্ধ্যা হলে বারান্দায় গিয়ে থালা বাজায় কি উলু দেয়। কেউ কেউ শাঁখও বাজায়। কিন্তু রাস্তায় বেরোয় না।
রাস্তায় শুধু ঘরহীন মানুষেরা। তারা হেঁটে চলেছে। যাদের ঘর নেই, কিংবা ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হয়েছে। কারো মাথায় ছাদ থাকলেও পেটের যোগান নেই। রুজি রোজগারের সব ধান্দা চৌপাট। বিপদের দিনে নিজের পরিবার পরিজনের খোঁজে চলেছে নিজের মুলুক, হাজার হাজার মাইল উজিয়ে যেতে হবে অনেক দূরের সেই দেশে। এই চারটে লোক গিয়ে মেশে ওরকমই আরও দশটা লোকের সঙ্গে। তারপর এরা গিয়ে জোটে আরও পঞ্চাশটা লোকের পিছনে। এসব দেখে পবন মনে বল পেলো। এতগুলো লোক হয়ে গেছে এখন, এবার আসুক না কোন বজ্জাত লোক। এরা আর ভয় পাবে না, দল বেঁধে তেড়ে যাবে। তাদের রোষ থেকে পবনের বুকে হাওয়া জাগবে। পবন সেই বাতাসের ভরসায় আরও বড় ঘূর্ণি তোলার দিকে এগিয়ে যাবে। আশা আর নিরাশার দোলাচলে বুক ঢিবঢিব করে পবনের। সে ঝড় হবে, এরকম এক ঘূর্ণি ঝড় তেমন কেউ দেখেনি কোথাও। আশায় বুক বেঁধে এদের পিছনে ঘাপটি মেরে চলতে থাকে পবন। আসবে, তারও সময় আসবে।
লোকগুলো চলতে চলতে হাঁফিয়ে যায়, মাথায় খটখটে রোদ ঝলসে দেয় ওদের, তেষ্টায় বুকের ছাতি ফাটে, কোমরে বাধা শুকনো রুটি গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে খসে পড়ে। পবনের আশার পারদ চড়চড়িয়ে বাড়ে। আর কতদিন এমন বৌদ্ধ শ্রমনের মত হেঁটে যাবে এরা। একসময় ঠিক বেজে উঠবে চন্ডালের রোষে। তখন ওদের সামনে যারা পড়বে তাদের কুচি কুচি করে দেবে চোখের নিমেষে। খিদে পেলে হই হই করে লুটে নেবে কোন ঝাঁপ ফেলে রাখা মুদী দোকান। নিজেদের গুহায় লুকিয়ে থাকা মানুষ গুলোকে গর্তে সেঁধানো ইঁদুরের মত ঘেঁটি ধরে বের করে আনবে। বলবে অনেক দুনিয়াদারি হয়েছে। হয় আমাদের থাকার জায়গা দে, খাবার দে। নাহলে আমাদের সঙ্গে পথে নাব।
কিন্তু এসব কিছুই হচ্ছে না মোটে। মৌমাছির মত গুনগুন করতে করতে চলছিল, পিঁপড়ের মত সারি দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল ওরা। প্রশ্নহীন সেই হাঁটা, শৃঙ্খলাবদ্ধ। বিষণ্ণতা, বিষাদ, ক্লান্তি গিলে খেতে চায় লোকগুলোকে। অবসাদের পাহাড় উজিয়ে ওরা হাঁটতেই থাকে তবু। হাঁটতে হাঁটতে খালি পেট মানুষগুলো পথের ধারে বসে ঝিমোয় কখনো বা। এক প্রাচীন স্তব্ধতা আস্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে ওদের। তারপর গা ঝাড়া দিয়ে আবারো উঠে দাঁড়ায়। হোঁশ ফেরে, কিন্তু রোষ জাগে না।
মাঝে মাঝে এদের মধ্যে একটা দুটো লোক তবু মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠতে চায়। আমরা মানুষ না নাকি? মাথায় রোদ চড়িয়ে, বাল বাচ্চা নিয়ে পথে নেবেছি। কারো কোন খেয়াল নেই? গরমেন নেই? ডিপুটি নেই?
শুনেই পবনের মন নেচে ওঠে। হাওয়া খেলতে শুরু করছে। খানিক বাদেই ধুলো উঠবে। ভেবেই এক পাক নেচে নেয়। পথের শালপাতা মড়মড়িয়ে ওঠে, রাস্তার ধারে ঝুলিয়ে দেওয়া ফেস্টুন মোচড় দিয়ে ওঠে। বাকি লোকগুলো চমকে ওঠে। আরে, চুপ চুপ। পুলুসের ভয় নেই নাকি মনে? আমরা হলাম অন্য দেশ গাঁয়ের লোক। তোর জন্য এদের হাতে প্যাঁদানি খাবো নাকি? দরকার হলে জোর করে ওর মুখ চাপা দিয়ে দেয়।
আবার সব ঝিমিয়ে পড়ে। ওরা মাথা গুঁজে হাঁটতে থাকে পরাজিত সৈনিকের মত।
কিন্তু এমন কতদূর হাঁটবে সবাই?
কান পেতে বলাবলি করতে শুনল কোথায় নাকি কোন মজদুর স্পেশাল ছাড়বে, সেই স্টেশানের খোঁজে চলেছে ওরা। সেখানে আরও হাজার হাজার লোক আসছে। শুনেই চকচক করে উঠল পবনের চোখ। উঠবে, ঝড় উঠবেই। হাওয়া সে পাবেই। নাম সার্থক করে তবেই থামবে পবন। নিজের উপর বিশ্বাস হারালে চলবে না।
আমাদের হাঁটতে হবে বেন্দাবন, সেখেন থেকে মথুরা, ওখান থেকে ছাড়বে এস্পেশাল ট্রেন।
আমাদের নেবে সেই ট্রেনে?
যদি নেয়। নাহলে ঢেকালবো। মাথায় চড়ে বসবো তা না হলি।
মাঝে পড়বে হাতরাস। ওখেনে রাস্তা ছেড়ে চড়ব রেললাইনে। হাঁটব রেল লাইন বরাবর।
চলতে চলতে ট্রেন এসে গেলে?
এখন তো চলছে না কিছুই। লাইন ধরে গেলে পথ চিনতে সুবিধা হবে।
নারে বাপু, পাশ দিয়ে যাবানে, ঝোপঝাড় ধর্যা।
আরে, না না সাপখোপ থাইকবে। লাইন ধরি গেইলে অনেক সাফ সুতরো।
চলতে চলতে কালো ঘাম নদীর মত কপাল থেকে বুকের খাঁচা ধরে বয়ে যায়। শরীরের ধুলো থেকে ভেজা মাটির গন্ধ ছড়ায়। খিদেয় পেটের মধ্যে পাক মারে। তেষ্টায় জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট চাটে ওরা।
আর পারছি না ভাইয়া। ককিয়ে ওঠে যারা দুর্বল।
ঘুমো তালে খানিক। এখানেই লেটে যা।
কেউ চলতে থাকে। হুই দূরে ইস্টিশানের আলো দেখা যায় রে, ভোরের আগে পৌঁছে ওখেনেই গড়িয়ে নেবো একেবারে। কেউ আর পারে না, রেলের পাটাতনে অঙ্গ এলিয়ে দেয়। জনা কয়েক শুয়ে পড়ে ঘাসের বিছানায়। লাইনের পাথর পিঠে খোঁচা মারে, ঘাসের পোকা কুটকুট করে। কিন্তু এই লোকগুলোর চোখে সীসার মত ভারি ঘুম, কোন ইতর বিশেষ হয় না। মাথায় ছোট ছোট পুঁটলি রেখে বাড়ির স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ে অত গুলো লোক।
বাকি লোকগুলো হাঁটতেই থাকে। পবন চলতে থাকে তাদের পিছন পিছন, স্টেশানে থাকবে আরও অনেক যাত্রী। ওখানে কোন শোরগোল তুলতে পারলে যদি পালে হাওয়া লাগে।
চলতে চলতে পিছনে দেখা যায় ট্রেনের আলো। সঙ্গে সঙ্গে হই হই রব ওঠে। ওরে এস গেল রে, দৌড়ে চল। এতক্ষণ যারা ধুঁকতে ধুঁকতে যাচ্ছিল কোথা থেকে যে শক্তি পেলো, ছুটল পড়ি কি মরি করে। পিছন থেকে ট্রেনের ভোঁ ভোঁ আওয়াজ ওদের তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।
যে লোক গুলো লাইনে পুঁটলি পেতে শুয়েছিল তাদের কি হল? ওরা কি ট্রেনের আওয়াজে চোখ খুলে উঠে পড়েছিল লাফ দিয়ে? পবন মুখ ঘুরিয়ে পিছন দিকে গোঁত্তা মারে। হঠাত হাওয়ার ঘূর্ণি ওঠে যেন। যে লোকগুলো স্টেশানের দিকে যাচ্ছিল তারা হুঁই মা রে বলে আরও জোরে স্টেশানের দিকে দৌড়ায়। পবন হাওয়ার গতি বুকে নিয়ে, সমুদ্রের ঢেউয়ের মত উথাল পাথাল খেতে খেতে পৌঁছে যায় ট্রেনের লাইন ধরে যেখানে ওই লোকগুলো শুয়ে ছিল। যখন পৌঁছাল তখনো ওরা শুয়ে আছে, ওদের মাথায়, বুকে, পায়ে চাঁদের আলো ছিটকে ছতরে পড়েছে। শুধু সেই ক্লান্ত শরীরগুলো আর গোটা নেই, ট্রেন টুকরো টুকরো করে রেখে গেছে। কোথাও পা, কোথাও মাথা। রক্তরাঙ্গা পুঁটলিগুলো ছড়িয়ে আছে বাড়ি ফেরার স্বপ্ন বুকে নিয়ে।
যারা রেল লাইন ছেড়ে ঘাসের জমিতে শুয়েছিল, তারা এসে দাঁড়িয়েছে রেল লাইনের ধার ঘেঁসে। লোকগুলো থরথর করে কাঁপছে, রাতের বাতাসে প্রদীপের সলতের মত।
কাটা শরীরগুলোকে বস্তায় ভরছে রেল পুলিশ। এর মধ্যে কারো সঙ্গে হয়তো ওরা কাল রাতে রুটি ভাগ করে খেয়েছিল, কেউ হয়তো টিউকল চিপেছিল জল খাওয়ার সময়। তাদেরই কেউ কেউ বাড়ির মায়া বুকে নিয়ে কোথায় চলে গেল আজ। ঘসা কাঁচের মত চোখ নিয়ে দাঁড়িয়েছিল বেঁচে থাকা লোকগুলো।
এই হেঠ, ভাগ সব এখান থেকে!
মরেছে বেশ হয়েছে!
রেল লাইনটা কি ঘুমানোর জায়গা শুয়ার?
বাড়ি গিয়ে ঘুমাতে পারিস না?
পুলিসের বচন, সঙ্গে রুলের গুঁতো।
এইবার কেউ রুখে উঠবে। গলার শির ফুলিয়ে বলবে, ঘর কোথায় আমাদের? জানো না কেন হাঁটছি আমরা? কে পাঠালো আমাদের রাস্তায়? প্রদীপের সলতেগুলো মশালের মত জ্বলে উঠবে এবার। এই তো সময়, সেই মাহেন্দ্রক্ষণ যার অপেক্ষায় এদের পিছু পিছু ধাওয়া করেছে পবন।
কিন্তু কেউ টুঁ শব্দ করল না। বরং পুলিশের লাঠির থেকে মাথা বাঁচাতে ওরা নিজের নিজের বোঁচকা নিয়ে স্টেশানের দিকে দৌড় মারল।
লাইনের ধারে ধপ করে বসে পড়ল পবন। থমধরা জ্যোতস্নায় জড়িয়ে থাকা পবনের শরীর হতাশায় এমন গুটলি পাকিয়ে গেছিল যে পুলিশের লাঠির খুঁজে পাবার জো নেই, শুধু লাইনের ধারের উঁচু উঁচু ঘাসের ডগা তিরতির করে দুলে ওর উপস্থিতির জানান দিচ্ছিল। দুঃখ জমা করা ছাড়া আর কি করতে পারে পবন? কোথায় পাবে সেই দমকা হাওয়া যা বুকে নিলে একটা তাণ্ডব সত্যিকারের ঘূর্ণি হয়ে উঠতে পারে, যা দেখে তাবড় তাবড় ঝড়েরা বলবে একটা কান্ড করেছিল বটে পবন নামের সেই তুফান।
পবনের নিজের বিশ্বাসে ঘাঁটা পড়লেও সে যে একটা কিছু না ঘটিয়ে ছাড়বে না, তাতে রবিন্দ্রনের স্থির বিশ্বাস। বলেওছিল পান্ডেজিকে। স্যারজি, চেপে থাকা যাবে না মোটেই, পাঁচকান হবেই।
ভেংচে ওঠে ব্রজেশ পান্ডে। প্যাঁচক্যান হবে! কে বলেছিল তোমাকে দরজা খুলে উঁকি মারতে?
গলতি হয়ে গেছে না স্যারজি। কাঁচুমাচু হয়ে যায় রবিন্দ্রন। কিন্তু এমন একটা ঝড় পালিয়ে গেল, এবার কোথায় কোন শহর, গ্রাম ধংস করে বসবে আর আমরা যদি কোন জানান না দিতে পারি তাহলেও তো চাকরি যাবে, তাই না স্যারজি?
যতোসব ঢপের কীর্তন! কোথাও কোন নিম্নচাপ নেই, কাছে ধারে কোন সমুদ্র নেই অমনি অমনি ঘূর্ণিঝড় হলেই হল? দিল্লির রাস্তায় সাইক্লোন দেখেছে কেউ কোন কালে?
একটা ঝড়কে সাগরের হাওয়া পেতে কি লাগে স্যারজি? সেতো রাজধানি এক্সপ্রেসের থেকে আগে যায়।
গজগজ করতে থাকে পান্ডে। আরামের দিনগুলো বিগড়ে দিয়ে এখন বিদ্যা ফলাচ্ছে। কিন্তু কথাটা যে ন্যায্য সেটাও ফেলতে পারল না। তাহলে?
রবিন্দ্রন বাদামের খোসা ভাংল এবার। রাস্তার ধারে গাছ ভেঙ্গে পড়েছে বলে বড় আধিকারিকের ফোন এসে গেছে স্যারজি।
গুপ্তাজি?
হ্যাঁ জি। আভি আভি আসছেন।
ক্যাঁক করে উঠল পান্ডে। সেটা আগে বলো নি কেন নিকম্মা! খবর দিল কে?
গাছ ভেঙ্গে পড়েছে রাস্তায়, খবর করে দিয়েছে কেউ। আমাকে ডেকে হম্বিতম্বি, আমার অফিসের খবর আমি পাই না অন্য লোক কেমন করে পায়? আমি কি করবো স্যারজি, কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল রবিন্দ্রনের গলা, আপনিই তো বলেছিলেন চেপে যেতে।
সেটা আবার বলেছ নাকি? কিচ্ছু বিশ্বাস নেই এই মর্কটকে। ফোন রেখে উর্ধশ্বাসে ধড়াচুড়ো পড়তে দৌড়াল পান্ডে। নাস্তা মাথায় উঠল, কোমল গান্ধার ডকে, দুপুরের খাবার জুটবে কি না তার এখন আর ঠিক নেই। এমারজেন্সি এমারজেন্সি করতে করতে পান্ডে অফিসের দিকে ছুটল।
গুপ্তাজির গাড়ি দাঁড়িয়েছিল ভাঙ্গা গাছের সামনেই। আড়াআড়িভাবে রাস্তায় পড়ে আছে ইয়া বড় পাম ট্রি। সামনে বশংবদ রবিন্দ্রন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাথা চুলকাচ্ছে। দূর থেকেই স্বদেশ গুপ্তার হেঁড়ে গলা পাওয়া যাচ্ছিল। কোথাও কিছু নেই এই এত্তো বড় গাছটা মুড়ো ভেঙ্গে পড়ল কেমন করে?
প্রকৃতির ব্যাপার স্যার। কখন ভাঙবে, কখন মচকাবে কে বলতে পারে। হাঁফাতে হাঁফাতে বলল ব্রজেশ।
তা বললে তো হয় না পান্ডে, খোদ আবহাওয়া মন্ত্রী লাগিয়েছিল এই গাছ। কথা নেই বার্তা নেই, ঝড় নেই তুফান নেই জলজ্যান্ত একটা গাছ ভেঙ্গে পড়ে গেল, এনকোয়ারি বসাতে হবে।
ঝড় স্যারজি, ঝড়! এনকোয়ারির নামে ভড়কে গিয়ে উগড়ে দিল রবিন্দ্রন।
মর্কট! দাঁত কিড়মিড়ালো পান্ডে। পেটে কথা থাকে না মোটেই। কিন্তু গুপ্তার সামনে কিছু বলতেও পারছে না।
কিসের ঝড়? কোথায় ঝড়? গুপ্তার চোখ এখন ছুঁচের মত সরু।
হাঁ জি, ঝড়! পবন পালিয়ে গিয়েছে স্যারজি।
পবন? কোন পবন?
আনেওয়ালা ঝড় স্যারজি, এরপরের দফায় যে ঝড়ের আসার কথা ছিল।
সেতো ঝড়ের লিস্টিতে থাকে, সেই ফাইল থাকে ঝড়ঘরের মধ্যে। বেরোবে কি করে?
গলতি হয়ে গেল না স্যারজি, সব ঘর ঠিকঠাক আছে কি না দেখছিলাম। যেই দরজা খুলেছি, স্যুট করে পালিয়ে গেল।
ঝড় পালিয়ে গেল? এতদিন মৌসম ভবনের দায়িত্বে আছেন এমন কথা বাপের জন্মে শোনেন নি গুপ্তা। চোখ গোল গোল হয়ে গেল একেবারে। লোকটা কি সকাল সকাল ভাং খেয়েছে নাকি? তুমি নিজের চোখে দেখলে পালিয়ে যেতে? কখন গেল, কবে গেল?
কালকে স্যার। সুরুত করে পালাবার সময় ওই গাছটাকে ভেঙ্গে নিয়ে পড়ল। আমি নিজের চোখে দেখেছি।
তুমি নিজের চোখে পবনকে দেখলে? কেমন দেখতে শুনি? গুপ্তার কিছুতেই বিশ্বাস হয়না। লকডাউনের ফেরে অনেক লোক পাগল পাগল ভাব করছে, বলছিল এরকম টিভিতে।
ওর কি হাত পা দেখা যায় স্যার! একটা ঝড়ো হাওয়া, টিভিতে বেতাল দেখেছেন তো না স্যারজি? অমনি হুশ করে জানালা দিয়ে নেবে গাছ ভেঙ্গে লোদী রোডে ধুলো উড়িয়ে চলে গেল।
তারপর? বাজের মত ফেটে পড়লেন গুপ্তা। পুরো একদিন হয়ে গেছে, কোথায় গেছে কোন পথ ধরেছে তার কোন খবর করেছ পান্ডে?
কিভাবে করবো স্যার? বলেই টনক নড়ল পান্ডের। এত বড় র্যাডারটা যে মৌসম ভবনের উপরে বসানো আছে, সেটা কি এমনি এমনি? হড়বড় করতে করতে দৌড়ায় পান্ডে। এতদিন বাড়িতে বসে বসে প্যান্টটা একটু টাইট হয়ে গেছে, তবু ছুটতে ছাড়ে না। এই বাহানায় গুপ্তার গালিও এখুনি এখুনি শুনতে হল না। রবিন্দ্রন আগে আগে দৌড়ে দরজা খুলতেই হুমড়ি খেয়ে কম্পিউটার মনিটরে চোখ রাখে পান্ডে। র্যাডার তার কাজ করে চলেছে। পবনের গতিপথ মেপে চলেছে ঠিক। মুখে একটু হাসি ফোটে। সেরকম স্ফুর্তি নেই পবনের, এখনো ফুলে ফেঁপে উঠতে পারে নি। গতিও খুব কম। কোনো ঝড়কে এতো ধীরে ধীরে চলতে দেখেনি বাপের জন্মে, যেন পায়ে হেঁটে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেছে। মথুরা পৌঁছে থম মেরে আছে।
এতক্ষণে গুপ্তা হাজির। ইউপি ঢুকে গেছে দেখছি?
কোন দম নেই স্যার, ঝিমিয়ে পড়েছে।
এই তুমি বোঝো? দেখেছো কত বড় হয়ে গেছে? দিল্লি ছাড়ার আগেও কতটুকু ছিল, দুই একটা বিন্দুর মত দেখাচ্ছে। আর এখন ইউপিতে ঢুকে পড়েছে, যেন গোটা পল্টন চলেছে এক সঙ্গে। আড়ে বহরে কেমন বেড়েছে দেখেছো?
মেঘ করলেই তো আর ঝড় হয় না স্যারজি?
তোমার কাছ থেকে আমি ওয়েদার রিপোর্ট চেয়েছি? বাজ পড়ল যেন ঘরে। ফালতু কথা না বলে এরপরে কোনদিকে চলেছে সেটা দেখো।
মনে হচ্ছে তো বিহার স্যার। চশমাটা নাকের উপর ঠেলতে ঠেলতে বললেন পান্ডেজি।
ওখান থেকে উড়িষ্যা কি বঙ্গালের খাঁড়িতে ঢুকে গেলে কি হবে বুঝেছো? কি জবাব দেবো আমি সাঁইজিকে? বলবো যে তোমাদের গাফিলতিতে ঝড় জানলা গলে বেরিয়ে গেছে? আবহাওয়া মন্ত্রী আনন্দ সাঁইয়ের ভাঁটার মত চোখের কথা ভেবেই স্নায়ুদৌর্বল্য বোধ করতে থাকেন গুপ্তা। নিজের মাথার চুল ছেঁড়াটাই শুধু বাকি আছে। তারস্বরে চেঁচালেন, আটকাও, যে কোন ভাবে ওটাকে আটকাও।
এখান থেকে কিভাবে আটকাবো স্যার?
ন্যাকা, জানো না কিছু! ইউপি থেকে বিহারে যেন ঢুকতে না পারে, বর্ডার সিল করে দিতে বলো। ইউপির আধিকারিক দ্বিবেদীকে খবর লাগাও। বিহারের শর্মাকেও জানিয়ে দাও। এদিক দিয়ে দ্বিবেদী আটকাবে, না হলে ওদিক থেকে শর্মা জব্দ করবে। দুদিক থেকে আটঘাট বেঁধে দিলেন গুপ্তা।
কিন্তু এতো আঁটঘাট বাধার কি কোন দরকার ছিল? এইসব প্রস্তুতির কথা জানলে পবন হাসত। এই পথচলা লোকগুলোর মতই তার দুর্দশা এখন। ওইরকমই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেছে। এই নাকি সে একটা ঝড়!
হাঁটবেই বা কি করে লোকে? এতটা পথ, মাথার উপরে ঝাঁ ঝাঁ রোদ। এপ্রিল মাসের গরমে তেতে পায়ের নিচে খাপরা। খালি পায়ে ফোসকা তুলেই চলেছে কতলোক।
ভাল লোকও আছে কিছু। মুঘলসরাইতে রাস্তার ধারে নুন লেবু আর ভাত সাজিয়ে বসেছে।
খানার জন্য সুক্রিয়া বাবুজি, একটা পুরানা চপ্পল পারলে দাও না। পায়ের নিচে চামরা খুলে হাঁ হয়ে গেছে।
সত্র খুলে বসা লোকটার মুখে মেঘ জমে। চপ্পল দিতে চাইলে দেবে কজনকে? একজন হলে নিজের চপ্পল খুলেই বুঝি দিয়ে দিত এই লোক। দুঃখিত মুখে কপালে হাত ঠেকায়। যাকে বলল সেও পা টানতে টানতে এগিয়ে চলে।
ভাতও কি আর অঢেল? ভাতের লাইনে ভাত শেষ হয়ে যায়, সবাই যে পায় তাও না।
খাবার না পেয়ে দিনু আর তার বউ বসে পড়ল পথের ধারে। এক বছরের মেয়েটাকে জল চাড়া আর কিছু খাওয়াবার জো নেই। বউয়ের অপুষ্টি, মাই শুকিয়ে ঝুলছে। এর মধ্যে কোথায় পাবে দুধ? মেয়ে কাঁদছে, বউ কাঁদছে। কান্না শুনে পবন থমকে দাঁড়াল। দীনু লোকটার চোখের সাদাটা বাড়ছে, এবার নিশ্চয় ক্ষেপে উঠবে। একটু একটু করে এমনি ভাবে গরম হাওয়া জমে। লোকটা বউয়ের কাছ থেকে ভাত খাওয়ার অ্যালুমিনিয়ামের থালাটা চাইল। কতদিন দরকার হয় না এই থালার। রাস্তার থেকে একটা ইট মেরে ওর কানাটা উঁচু করল। একটু তেড়াব্যাঁকা হয়ে গেল থালাটা ওদের শরীরের মত। ভিক্ষায় বেরোবে এবার, যদি কিছু জোটে। তবু ডাকাতি করার হিম্মত জোগাড় করতে পারেনি। ফুলে ওঠার বদলে চুপসে গেল পবন। এর সঙ্গে বসে থেকে কোন লাভ নেই। মিছিলের পিছনে জুটে গেল ফের। দেখবে সে শেষ অবধি।
লোকের মিছিল এগিয়ে চলেছে। সারা ভারত আজ হাঁটছে। বাস নেই, ট্রেন নেই, টেম্পো নেই - কিচ্ছু নেই। তবু যাওয়া থাকে। মানুষের এক মিছিলের সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছে অন্য মিছিল নদীর স্রোতের মত। ধীরে ধীরে তৈরী হচ্ছে জনসমুদ্র। মাথায় রোদ ঝনঝনায়, পায়ের নিচে ফোসকা পড়ে, পথ চলতে চলতে মাথা ঘুরে কেউ পড়ে যায়। তবু ওরা হাঁটতে থাকে।
ভাগ্যবানের সাইকেল থাকে। সাইকেল করে ফিরছে মেয়ে, পিছন থেকে জবুথবু হয়ে ধরে আছে বাপ। হাঁটুরেদের থেকে খুব জোরে যে যাচ্ছে তাও নয়। কিইবা বয়েস হবে মেয়েটার? পাশে পাশে চলতে থাকে পবন।
আমারে নাবিয়ে দে জামিল্লা মা, বুইড়া বাপকে এমনি আর কতদূর টানবি?
মাথার চাদর আঁটসাঁট করে নেয় জামিলা, পারতেই হবে যে তাকে। জাপ্টে ধরে এঁটে বসো আব্বাজান, না পারলে বলবো এখন।
অন্তহীন সাইকেল যাত্রা। মেয়ে তাকে সাইকেলে করে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। কেমন করে সম্ভব! সে কোথায় নিয়ে যাবে মেয়ারে! কপাল! তার পা খাইন বাঁকা না হলি - আবদাল্লা ঘন ঘন মাথা নাড়ে। বিন্দু বিন্দু চোখের জল সমুদ্রে মিশতে থাকে।
সাইকেলের খানিক তফাতে চলেছে এক আজব গরুর গাড়ি। মানুষ আর গরু, দুইয়ে মিলে সেই গাড়ী। গরুর গাড়ীর জোড়া গরুর একটা বেচে পথ্য কিনেছে রামচন্দ্র। এখন রাম নিজে কাঁধ দিচ্ছে বাকি চারপেয়েটাকে। বাকি রাস্তাটা যেতে হবে, পরিবার সঙ্গে। পবন উঁকি মেরে দ্যাখে। রামের পেশী ফুলে ফুলে ওঠে, টপটপ করে ঘাম ঝরে। একটু বাদে বাদে ছইয়ের ভেতর থেকে একটা হাত বেরিয়ে এসে লাল ডোরাকাটা ত্যানায় মুছিয়ে দেয়। দুঃখের মাঝখানে সুখের বাতাস ঠেলে ঠেলে ওঠে এই সংসারে।
পথচলতি যাদের শুধু পা ভরসা, সে আবার রামচন্দ্রের দিকে ঈর্ষার চোখে তাকায়। দুঃখের গরম বাতাস এদিক ওদিক উঁকি দেয়। ক্লান্ত চোখে নিজের সঙ্গীর দিকে তাকায়। কিছুই কি পাব না আমরা?
নসিব ভাল থাকলে, মাঝখানে পেয়ে যাবো কোন ট্রাক বা টেম্পো।
কখনো এসেও যায় কোন ট্রাক। দয়ার শরীর হলে থেমেও পড়ে।
ও ভাইয়া নিয়ে নাও না আমাদের?
কোনদিকে যাবে তোমরা?
পূবদিকে।
পূব দিকে মানে?
পথ যেদিকে চলেছে।
পথ তো চলেছে হজরতপুর, পাওলি, গয়া।
হ্যাঁ, হ্যাঁ যাবো, যাবো। চেনা নামের হদিশ পেয়েই সমস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে ক্লান্ত স্বরগুলো।
কজন আছিস তোরা?
এক দুই গিনতি চলতে থাকে।
ট্রাকের উপর বড় বড় ড্রাম, চলেছে কোথাও। যা ঢুকে সব একেকটায়। লাল দাঁত বের করে হাসে ট্রাকওয়ালা। ভগবানের মত মানুষ।
মিছিলের অনেকটা জায়গা খালি হয়ে যায়, সঙ্গে সঙ্গে পিছনের লোকেরা এসে আবার ভরিয়ে দেয়।
কাউকে আবার চলতে চলতে থেমে যেতে হয়। পবনও থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে।
কেউ শরীরটাকে টানতে টানতে পথচলতি গাছের ছায়ায় ঢেলে দেয়। মাথার নিচে সবেধন পুঁটলিটা রাখলো কি রাখলো না চোখে জড়িয়ে আসে ঘুমে। কি গো ভাই, আর আগে যাবা না? সে তখন কোথায়? ঘুমের মধ্যে আর এক যাত্রা শুরু হয়েছে। সেই যাত্রায় পায়ে নাগড়াই থাকতে পারে, চাই কি হাঁটার দরকারই নেই কোন। পেয়ে গেছে কোন টগবগান ঘোড়া। সেই ঘোড়ায় চেপে দূর দিগন্তের ফুটকি সমান বাড়ি দ্যাখ না দ্যাখ হাতের নাগাল এসে বসতবাড়ি হয়ে যায়। নদীর জলের গন্ধ নাকে নিয়ে ঘুমিয়ে থাকে লোকটা।
কারো জন্য জলজ্যান্ত স্বপ্ন এসে ধরা দেয় পথের মধ্যে। ভারাবাঁধার মজুর শামলীর মেয়ে হল এমনি এক গাছের নিচে। হঠাত রাস্তার ধারে পেট চেপে বসে পড়েছিল। আর যে চলতে পারে না। ফোঁসফোঁস করে শ্বাস ছাড়ে। এই হয় কি সেই হয়। এই বিপদে সুবল কোথায় দাই পাবে? কোথায় ডাক্তার? তবু এর মধ্যেই পৃথিবীতে প্রাণ নেবে আসে। তবু তো থামার উপায় নেই। সুবলের এখন একটা সাইকেল দরকার। পথ যে ভাঙ্গতেই হবে। বাড়ি এখনো অনেক দূর। গ্রামের ভিতরে ঢুকে এক বেড়ার ধারে জুটেও গেল কারো কোন ভাঙ্গাচোড়া সাইকেল। চোখে জল এসে যায় সুবলের। আজকেই বাপ হলাম, বাপ থেকে চোর। ক্ষমা করে দিও গো কত্তা, বাপের কাজটা করতে দাও। এই সাইকেলে করে সদ্য বিয়ানো বউরে তুলবো। তার বুকের সঙ্গে লেপটে থাকবে আর একখান পরান। ভালবাসার উষ্ণবাতাস উথলে ওঠে সুবলের মনে।
চলতে চলতে প্রাণ আসে, প্রান যায়ও। একটা টেম্পোয় আমের ঝাঁকার মধ্যে শুয়েছিল পাঁচটা লোক। ট্রাকে আর টেম্পোয় ধাক্কা লাগল। টেম্পোর মধ্যে দলা পাকাল ঘরে ফেরার জন্য উন্মুখ শরীরগুলো। আমের রস আর মানুষের রস একসঙ্গে মিলেজুলে মরনের শরবত। এসব দেখে দেখে পবনের বুকে গুমগুমা ওঠে।
কিন্তু থম মেরে বসে পড়তেও পারে না। জনসমুদ্র থইথই করতে করতে এগিয়ে গিয়েছে। সেখানে কোন জায়গা ফাঁকা পড়ে নেই, বাড়ি যাওয়ার তাড়নায় এগিয়েই চলেছে লোকগুলো। একটাই লক্ষ্য, একটাই হাউশ। জন্মমৃত্যু কিছুই তাদের আটকাতে পারবে না এখন। তাহলে কিভাবে আটকাবে দ্বিবেদী কিংবা শর্মা? তাদের সব লকডাউন ভেঙ্গে এই সমুদ্র আছড়ে পড়ল এক রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে অন্য প্রদেশে। সেই সমুদ্রের মাথায় মাথায় চলে গেল পবনও।
দ্বিবেদী মাথার চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে ফোন লাগাল গুপ্তাজিকে।
গজব হয়ে গেল, আটকাতে পারলাম না কাউকে।
কেন পবন কি খেপে উঠেছে?
না, না এখনো নয়। কিন্তু কি বিশাল মেঘের মত মানুষের রাশি সঙ্গে নিয়ে পেরিয়ে গেল সব বাঁধন। কারো মুখে কোন শব্দ ছিল না, কোথাও কোন হাওয়ার শনশনানি নেই। সবাই পাথরের মত নীরব, একাগ্র।
ওদের চোখে কি দেখলে? আগুন না জল?
কারো চোখের দিকে তাকানো যায় না, যেন ঘসা কাঁচ। দৃষ্টিতে পর্দা ঢেকে অন্যকিছু দেখছে ওরা মনে মনে।
কি বিপদ, স্বপ্ন ওদের মধ্যে ঢুকে গেছে।
আমতা আমতা করে বলে দ্বিবেদী, তাতো জানি না। হবেও বা, কোন স্বপ্ন দেখছে বুঝি।
কিসের স্বপ্ন? জানো কিছু?
কে জানে, হয়তো ভাতের স্বপ্ন।
ভাত? কেন ক্ষুধার্ত মনে হল ওদের? লুটপাট করছিল?
মাথা চুলকাল শর্মা। চালের গুদামের পাশ দিয়েই তো চলে গেল, একবার চোখ তুলেও দেখল না। না তো?
তাহলে হয়তো বাড়ির স্বপ্ন দেখছিল।
জমির স্বপ্ন।
পুকুরপারের স্বপ্ন।
বটতলার মাচানের স্বপ্ন।
সর্বনাশ! ঝড়ের চোখ তৈরী হয়ে গেছে। গুপ্তার গলায় হাহাকার। এই রকম হলেই সর্বনাশের মাথায় বাড়ি! এরপর ওরা স্বপ্নটা সত্যি বলে ভাবতে চাইবে।
সেটা কি ভাল না মন্দ?
ধন্দে পড়ে গেল গুপ্তাজি। মন বলছে ভাল নয়। মনে হচ্ছে একটা মানুষ খেপানো ঝড় তৈরী হচ্ছে। মন্ত্রীজিকে এখুনি বলা দরকার।
সব শুনে আবহাওয়া মন্ত্রী আনন্দ সাঁই চোখ কুঁচকে তাকালেন। এই তিনটে মর্কট কি বলতে চাইছে তাকে? হয়েছেটা কি? অ্যাই ঠিকঠাক করে সব গুছিয়ে বলো আমায়।
শুনতে শুনতে চোখ কপালে ওঠে মন্ত্রীমশাইয়ের। ঘর জুড়ে পাইচারি শুরু করে দিলেন সাঁইজি। উলটে দেবে, এই ঝড় একবার জেগে উঠলে সব উলটেপালটে দিতে পারে।
কিন্তু স্যার, এরা তো একদম শান্ত হয়ে আছে। কোথাও কোন হাঙ্গামা করেনি, ভাংচুর হয়নি। এমন কি জোরে একটা হাওয়া ওঠেনি পর্যন্ত।
চোপ! এই তুমি মৌসম ভবনে আছো? জানো না এই থম ধরে স্বপ্ন দেখার কি ফল হতে পারে?
কি স্যার? ইচ্ছার বিরুদ্ধেই মুখ থেকে প্রশ্নটা ঠিকরে বেরোল।
এখুনি কি বললে তোমরা? ওরা নিজের বাড়ির স্বপ্ন দেখছে, গাঁয়ের স্বপ্ন দেখছে, মাটির স্বপ্ন দেখছে।
তো? মাথা চুলকায় পান্ডেও। মন্ত্রীমশাইইয়ের সামনে যে গুপ্তা সবজানিস্যার সেজে থাকে, তাকেও কেমন বেভুল লাগে। নিজের বাড়ির স্বপ্ন দেখাটা তো একটা হালকা ফুলকা ব্যাপার, তার থেকে ঝড় কেন উঠবে?
অপদার্থ সব তোমরা! মানুষ যখন জেগে জেগে স্বপ্ন দেখে, আর সেই স্বপ্ন সত্যি হয়ে যায় সেটা একটা দেশের জন্য মারাত্মক। ওরা পাওয়ায় বিশ্বাস করতে শুরু করে দেয়, দেশের উপর একটা অধিকারবোধ জন্মে যায়। ছোটলোকদের অত আত্মবিশবাস হয়ে গেলে কি হবে তখন? বুঝতে পারছ না একসঙ্গে এতগুলো লোক যদি এইসব অদ্ভূত স্বপ্নে বিশ্বাস করতে থাকে তাহলে খোল নলচে বদলে দিতে পারে?
উফ, কতদিকে মাথা চালাতে হয় মন্ত্রীমশাইকে। একটা শেখার আবেগ থেকে গদগদ করে চেয়ে থাকে গুপ্তা। কতকিছু শেখার আছে এনার কাছ থেকে। অবসর নিতে আরও বছর দুই, এরপর এর চ্যালা হয়ে ভোটে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দ্যাখে সে। এইসব স্বপ্নে কোন ক্ষতি নেই। একলা স্বপ্ন তো ফ্যাকলা, কোন দোষ থাকে না। তাই হামলে পড়ে উপায় খোঁজার জন্য। ওদের যদি আর বাড়িই না থাকে স্যার?
তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল সাঁই। সত্যি মিথ্যা যাচাই করার সময় তার চোখে ব্যাপারীর দাঁড়িপাল্লা। সেটা কি ভাবে?
ঝড়ে ঝড়ে ঝড়ক্ষয় স্যার।
কথাটা মনে ধরে আনন্দ সাঁইয়ের, তবু ধন্দ যায় না। কেমনভাবে করবে সেটা?
পবনের পর আরো একটা ঝড় আছে স্যার আমাদের হেফাজতে। আমফান। ওটাকে লেলিয়ে দেবো। ওর পিছনে রসদ ঢালব।
হাওয়া জোটাবো।
নিম্নচাপ পাইয়ে দেবো।
রাজার পোষ্যের মত ছুটে যাবে।
এমন তুফান তুলবে যে সাগর নদী উথলে উঠবে।
গাছগাছালি ভেঙ্গে পড়বে।
বাড়ির চাল উড়ে যাবে।
দেওয়াল ধসে পড়বে।
যে নদীর জন্য মন উথলাচ্ছে, সেই নদীর জলে পরিবার ভেসে যাবে।
ভিটেতে পৌঁছে দেখবে, ঘর আর নেই।
চাল নেই।
চুলো নেই।
দাওয়া নেই।
দেওয়াল নেই।
চেনা জগত চৌচির।
স্বপ্ন সফল হবে না।
স্বপ্ন দেখে কোন লাভ নেই সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝে যাবে।
স্বপ্ন দেখার বিশ্রী অভ্যাসটাই চলে যাবে একেবারে।
উত্তেজনায় হাততালি দিয়ে ওঠেন আনন্দ সাঁই। এটা কি সম্ভব? বড় মন্ত্রীকে জানালে বাহবা পাওয়া যাবে খুব। কথায় কথায় হাওয়ার মুখ ঘুরিয়ে দেওয়ার কথা বলেন উনি। ভাবনার মোরগপাখি, দিকবদল করিয়ে দিলেই দিন বদলের ক্ষান্তি। তারপর যেমন নাচাবে, তেমনি নাচবে। উত্তেজনায় হাততালি দিয়ে উঠলেন আনন্দ সাঁই। এখুনি, এখুনি!
ছোট, ছোট, ছোট! বের করো আমফানকে, লেলিয়ে দাও ঝড়ের সেরা এক ঝড়!
তারপর সেই ঝড় উঠল।
বাতাস কাতর হল।
চরাচর নিথর হল।
আকাশ রাঙ্গিয়ে উঠল।
সমুদ্র গুঙিয়ে উঠল।
আমফান ছুটে গেল মাইলের পর মাইল। পথ চলতি ভারতের মাথার উপর দিয়ে। যারা চলছিল তারা হুই বাবা বলে মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। রেল লাইন উপড়াল, রাস্তা বন্ধ হল, গাছ ভেঙ্গে পড়ল, বাঁধ ভেঙ্গে গেল, জল আছড়ে পড়ল। সেকি তার হাওয়ার টান, বাতাসে মৃত্যুর গন্ধ নিয়ে রাজ্য, শহর, গ্রামের ঝুঁটি ধরে উথাল পাথাল করে দিয়ে গেল এক ঝটকায়।
সে এক তুফান বটে বাপরে বাপ।
টেলিভিশানে গলার শির ফুলিয়ে ফুলিয়ে তার আলোচনা হল। গুপ্তাজি, পান্ডেজি সবার ঘনঘন ডাক পড়ল অভিজ্ঞ মতামত দেওয়ার জন্য। ছোট মন্ত্রী, বড় মন্ত্রী সবাই এসে দুচোখ ভাসালেন পর্যাপ্ত পরিমাণে। কথার মাঝে মাঝে গানও গাওয়া হল, ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস কিংবা ঝড় এলো এলো ঝড় ইত্যাদি। সদ্য সদ্য পদ্য লিখে ঝড়ের বেগে ছড়িয়ে দেওয়া হল। মাতলা বাতাসে বিজলির পোল আছড়ে না পড়া অবধি তর্ক বিতর্কে ক্ষান্তি পড়ল না।
ওদিকে
স্বপ্নের দাওয়া ভেসে গেল।
বাড়ির চাল উড়ে গেল।
ফেরার কোন ঘর রইল না।
হাহাকার উঠল পথ চলতি মিছিলে। যে ট্রাক চালাচ্ছিল সে থেমে গেল। যে তার বাবাকে সাইকেলে চাপিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, সে থমকে গেল। গরুর গাড়ির জোয়াল থেকে মাথা তুলে মরদ বউকে বলল, এবার?
চারদিকে ধ্বনি উঠল এবার, এবার, এবার?
যে বাড়ির স্বপ্ন বুকে বেঁধে যাচ্ছিল সেই ঘর তো আর রইল না। নিস্তব্ধ মিছিলে গুঞ্জন ছড়াল। আওয়াজ উঠল এবার, এবার, এবার?
আমফান তার ধ্বংসলীলা সাঙ্গ করেছে, অথচ পবনের এখনো ঝড় হয়ে ওঠা হয়নি। আশা ছাড়েনি পবন, বরং মরিয়া হয়ে উঠেছে আরো। কেন নয়? বাতাস ক্রমেই অস্থির হচ্ছে, ফুলে উঠছে গরম হাওয়া, তার হলকা পাওয়া যাচ্ছে এতদিন বাদে। আনন্দ সাঁই না জানলেও পবন অনুভব করতে পারে স্বপ্ন ভাঙলে লেজের যে ছটফটানি চলে তাকে একাট্টা করতে পারলেও একটা বিদ্ধংসী ঝড় হয়ে উঠতে পারে সে। থমকে থাকা মানুষগুলোকে উসকে দিতে মাথার উপরে আছড়ে ফেলল বাঁধনভাঙ্গার হাওয়া, বাতাসে গোল গোল গোল গোল পাক খেতে খেতে খেতে খেতে বারংবার আওয়াজ তুলতে থাকল এবার, এবার, এবার?
লেখক পরিচিতি
বিশ্বদ্বীপ চক্রবর্তী
গল্পকার,
মিশিগানে থাকেন।
1 মন্তব্যসমূহ
অসাধারণ অদ্ভূত গল্প। পবন বহুদূর যাক। ঝড়ের চোখ হয়ে উঠুক আমাদের স্বপ্ন দেখার চোখ!
উত্তরমুছুন