পঁচিশ বছর আগে স্কুলের ছেলেমেয়েরাও সুর করে পড়া করত। তারা পড়া করত সুরেলা আবৃত্তির ঢঙে গির্জার পুরোহিতের মন্ত্রপাঠ এবং করাতকলের ক্লান্ত গুন-গুনানির মাঝামাঝি সুরে।
কাউকে অশ্রদ্ধা করছি না। চেরা কাঠ আর করাতের গুঁড়ো দুই-ই তো আমাদের দরকার। |
জীবন বিদ্যার ক্লাস থেকে পাওয়া একটা সুন্দর শিক্ষাপ্রদ ছোট কবিতার কথা আমার মনে পড়ে। তার সব চাইতে উল্লেখযোগ্য পংক্তিটি ছিল এই রকম:
“জংঘাস্থিই মানব দেহে্র দীর্ঘতম অস্থি।”
মানুষ সংক্রান্ত সব জাগতিক ও আধ্যাত্মিক ঘটনাগুলিকে যদি এই রকম সুরেলা ও সুশৃংখলভাবে শৈশবেই আমাদের মনের মধ্যে গেঁথে দেওয়া যেত তাহলে সেটা কী এক অমূল্য উপহারই না হত! কিন্তু শারীরসংস্থান বিদ্যা, সঙ্গীত ও দর্শনের কাছ থেকে আমরা তো অতি সামান্য কিছুই পেয়েছি।
এই তো সেদিন আমি বেশ গোলমালে পড়ে গিয়েছিলাম। একটা আলোর রশ্মির দরকার পড়েছিল। আর সাহায্যের জন্য আমি ফিরে তাকিয়েছিলাম স্কুলের দিনগুলোর দিকে। কিন্তু সেদিনের সেই শক্ত বেঞ্চিগুলোর কাছ থেকে যত সব নাকি সুরের শব্দগুলো আয়ত্ত করেছিলাম তার মধ্যে এমন একটা কথাও মনে পড়ল না যাতে সম্মিলিত মানব কণ্ঠস্বরের বিষয়ে কিছু বলা হয়েছে।
অন্য কথায় বলতে গেলে, সম্মিলিত মানবতার মিশ্র স্বর-বাণীর কথা। অন্য কথায়, একটি মহানগরের কণ্ঠস্বরের কথা।
এদিকে, একক কণ্ঠস্বরের অভাব নেই। কবির গান, নদীর কলতান, যে লোকটি পরবর্তী সোমবারের মধ্যেই ৫ ডলার পেতে চায় তার কথার অর্থ, ফারাওদের কবরের উপর খোদাই-করা লিপি, ফুলের ভাষা, কণ্ডাকটারের “সাবধানে পা ফেলুন,” আর ভোর চারটের সময় দুধের পাত্রের গুব-গাব ধ্বনি—এ সবই আমরা বুঝতে পারি। অনেক লম্বকর্ণ মানুষ আবার আরও সব সূক্ষ্ম শব্দের অর্থও বুঝতে পারে বলে দাবী করে থাকে। কিন্তু একটি মহানগরের কণ্ঠস্বরের অর্থ কে বুঝতে পারে ?
সেটা দেখতে আমি বেরিয়ে পড়লাম।
প্রথমে অরেলিয়াকে জিজ্ঞাসা করলাম। তার পরনে ছিল সাদা “সুইচ” এবং ফুল-গোঁজা টুপি, আর ফিতে ও নানান সুতো উড়ছিল পোশাকের এখান থেকে, ওখান থেকে।
আমার নিজস্ব কোন স্বর না থাকায় তো-তো করে বললাম, “আমাকে বলতে এই মানে প্রকাণ্ড—মানে প্রচণ্ড রকমের বড় শহড়টা কি কথা বলে? সে কি কখনও তোমার সঙ্গে কথা বলেছে? তার কথার অর্থ তুমি কেমন করে বুঝতে পার? ব্যাপারটা ভয়ংকর গোলমেলে কিন্তু একটা চাবি তো নিশ্চয় আছে।”
“একটা সারাটোগা ট্রাংকের মত ?” অরেলিয়া প্রশ্ন করল। | “না,” আমি বললাম। “দয়া করে ঢাকানর প্রসঙ্গ তুলো না। আমার একটা ধারণা আছে যে সব নগরেরই একটা ভাষা আছে। প্রতিটি নগরেরই সেই লোকটিকে কিছু বলার আছে যে শুনতে পায়। মহানগর তোমাকে কি কথা বলে ?”
অরেলিয়া বলল, “সব নগর একই কথা বলে। যখনই তারা কিছু বলতে থাকে তখনই ফিলাডেলফিয়াতে তার প্রতিধ্বনি হয়। সুতরাং সকলের একই রা।”
আমি বিজ্ঞের মত বললাম, “এখানে ৪,০০০,০০০ মানুষ একটা দ্বীপে ঠাসাঠাসি করে বাস করে। এত ছোট একটা জায়গায় এত বেশি মানুষ জমায়েত হলে তাদের মধ্যে একটা একত্ব বলা যায় এক জাতীয়ত্ব গড়ে উঠতে বাধ্য, আর সেটাই বাইরে প্রকাশ হয় একটি সমখাতে। এটাকে তুমি ঐক্যবদ্ধ ভাষান্তরও বলতে পার যা একটা মিলিত রূপ গ্রহণ করে যখন আত্মপ্রকাশ করে তখন তাকে বলা যেতে পারে মহানগরের কণ্ঠস্বর। সেটা তা কি তুমি বলতে পার?” | অরেলিয়া আশ্চর্য হাসি হাসল। সে মাথা নিচু করে বসেছিল। দ্রাক্ষালতার একটা উদ্ধত শাখা তার ডান কানের উপর এসে পড়েছে। তার নাকের উপর কাপছে চাঁদের এক ঝলক আলো। কিন্তু আমি তখন বেপয়ারা।
বললাম, “আমি নিজেই বাইরে গিয়ে খোঁজ করব এই মহানগরের কণ্ঠস্বরটা কি। সব নগরেরই ভাষা আছে। থাকতেই হবে। সেটা আমাকে জানতেই হবে।” গলা চড়িয়ে আমি বলতে লাগলাম, “আমার হাতে একটা চুরুট গুঁজে দিয়ে নিউ ইয়র্ক যেন না বলে বুড়ো হে, আমি প্রচারের জন্য কথা বলতে পারি না। অন্য কোন নগর এমন কাজটি করে না। শিকাগো অসংকোচে বলে, ‘আমি বলব;
ফিলাডেলফিয়া বলে, আমার বলা উচিত’; নিউ অর্পিয়ান্স বলে, আমিও বলতেই অভ্যস্ত’; লুইসভিল বলে, সে কথা বলতে আমি কারও পরোয়া করি না, সেট লুইস বলে, আমাকে ক্ষমা করবেন; পিটুস্বার্গ বলে, “ধোঁয়া ছাড়ো। এবার নিউ অরেলিয়া হাসল। “ঠিক আছে,” আমি বললাম, “অন্য কোথাও গিয়ে আমি নিশ্চয় জেনে আসব।”
আমি একটা বড় বাড়িতে ঢুকলাম; পিতলের রেলে পা রেখে সেখানকার সেরা পরিবেশক বিলি ম্যাগনাসকে বললাম :“বিলি, তুমি তো দীর্ঘকাল নিউ ইয়র্কে বাস কর—এই পুরনো শহরটা তোমাকে | কি ধরনের নাচ-গান উপহার দিয়ে থাকে? আমি বলতে চাই—"
বাধা দিয়ে বিলি বলে উঠল, “ক্ষমা করবেন, এক মিনিট; পাশের দরজায় কে যেন বোতাম টিপছে।” | সে চলে গেল; ফিরে এল একটা খালি বালতি নিয়ে; আর সেটাকে ভরে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল; ফিরে এসে আমাকে বলল:
“উনি ম্যাম। তিনি দুইবার ঘণ্টা বাজান। সাপারের সঙ্গে তিনি এক গ্লাস বীয়ার খেতে ভালবাসেন। কিন্তু এবার বলুন তো, আপনার কি চাই?”
“আদা-বীয়ার” আমি জবাব দিলাম।
হাঁটতে হাঁটতে আমি ব্রডওয়ে চলে গেলাম। মোড়ে একটি পুলিশকে দেখতে পেলাম। তার দিকেই এগিয়ে গেলাম।
বললাম, “যদি কিছু না মনে করেন তো একটা কথা জিজ্ঞাসা করছি। আপনি তো নিউ ইয়র্ককে দেখেন সবচাইতে কোলাহলমুখর সময়টাতে। শহরের শব্দসম্ভারের একটা হিসাব রাখা তো আপনার এবং আপনার সহকর্মী বন্ধুদের কাজ। এই নগরের নিশ্চয় এমন একটা ভাষা আছে যা আপনারা বুঝতে পারেন। রাত হলে যখন নির্জন পথে পথে টহল দিয়ে বেড়ান তখন সেই ভাষা আপনি নিশ্চয় শুনতে পান। সেই হৈ-হট্টগোলের সার কথাটা কি? এই মহানগর আপনাকে কি কথা বলে ?”
হাতের গদাটা ঘোরাতে ঘোরাতে পুলিশটি বলল, “আমি তো কিছুই বলি না বন্ধু। উপরওয়ালার হুকুমটা কেবল শুনে নেই। মনে হয়, আপনি সঠিক জবাবটাই পেয়েছেন। কয়েক মিনিট এখানে দাঁড়িয়ে থাকুন এবং চোখ খুলে রাখুন যাতে পরবর্তী টহলদারকে দেখতে পান।” | পুলিশটি পাশের রাস্তার অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
দশ মিনিটের মধ্যেই আবার ফিরে এল। | আধা কর্কশ গলায় বলল, “এইতো গত মঙ্গলবার বিয়ে হয়েছে। ওদের তো আপনি চেনেন। প্রত্যেক দিন রাত ন’টার সময় সেই মোড়টায় আসে একটুখানি—মানে, একবার ‘হ্যালো’! বলার জন্য। আমি সাধারণত যে ভাবেই হোক ওখানে হাজির হই। ভাল কথা—একটু আগেই আপনি কি যেন জিজ্ঞাসা করছিলেন—এই শহরে কি কি আছে? তা--বারোটা ব্লক এগিয়ে গেলেই দু'একটা বাড়ির ছাদে বাগান আছে।”
কাকের ঠ্যাং-এর মত গাড়ির চাকার দাগওয়ালা একটা রাস্তা পার হয়ে আমি একটা ছায়া-ঢাকা পার্কের কাছে পৌছে গেলাম। গম্বুজের উপর সোনালী পাথরে গড়া একটি তেজোদ্দীপ্ত, আকাশচারিণী ডায়ানার মৃর্তি চাঁদের আলোয় ঝিকমিক করছে। দ্রুত পায়ে এগিয়ে এল আমার কবি--মাথায় টুপি, ঘন চুল বাতাসে উড়ছে, মুখে । ফুটছে নানা ছন্দের কাব্য-কলি।
আমি বললাম, “বিল, আমাকে একটা লিফট দাও। আমি একটা কাজে বেরিয়েছি—মহানগরের কণ্ঠস্বর শুনতে হবে। কি জান, এটা একটা বিশেষ হুকুম।
আমরা চাই এই শহরের আত্মার ও তাৎপর্যের একটা কাব্যিক, রহস্যময় ভাষা। এ ব্যাপারে একমাত্র তুমিই আমাকে একটা ইঙ্গিত দিতে পার। কয়েক বছর আগে একটি লোক নায়েগ্রা জলপ্রপাতের কাছে গেছে তার একটা স্বরলিপি আমাদের দিয়েছিল। পিয়ানোর সর্বনিম্ন ‘জি’ থেকেও সেটা ছিল দুই ফুট মত নিচে।
সে ভাবে তো নিউ ইয়র্ক-এর ভাষার স্বরলিপি করা যাবে না। কিন্তু সে যদি মুখটা খোলে তাহলে সে কি বলছে তার একটা ধারণা তুমি আমাকে দাও। সে বাণী অতীব শক্তিশালী এবং সুদূরপ্রসারী হতে বাধ্য।
সেটাকে পেতে হলে আমাদের একত্রে মেলাতে হবে দিনের যান-বাহনের প্রচণ্ড গুরুগম্ভীর শব্দ, রাতের অট্টহাসি ও সঙ্গীত, গাড়ির চাকার কান্না | ও চাপা গুঞ্জন; সংবাদপত্রের এজেন্টদের চীৎকার, ছাদের বাগানের ফোয়ারার ঝিরঝির শব্দ, ফেরিওয়ালাদের হৃাবালু, পার্কে পার্কে প্রেমিক-প্রেমিকাদের গুঞ্জন। এই সমস্ত শব্দ দিয়ে গড়ে উঠবে তোমার প্রার্থিত কণ্ঠস্বর—কেবল একত্র করলে হবে না, একত্রে মেশাতে হবে, আর মিশিয়ে নির্যাস বানাতে হবে, আর সেই নির্যাস থেকে বের করতে হবে সুরাসার—এক শ্রবণযোগ্য সুরাসার, যার একটি ফোঁটা থেকেই গড়ে উঠবে আমাদের প্রার্থিত বস্তুটি।”
কবি মুচকি হেসে শুধাল, “ক্যালিফোর্নিয়ার সেই মেয়েটির কথা কি তোমার মনে পড়ে যার সঙ্গে গত সপ্তাহে আমাদের দেখা হয়েছিল স্টিভার-এর স্টুডিওতে? শোন, আমি তার কাছেই যাচ্ছি। আমার সেই ‘বসন্তের উপহার” কবিতাটিকে সে অক্ষরে-অক্ষরে মুখস্থ করে ফেলেছে। বর্তমানে সেই তো এ শহরের সব চাইতে দুর্লভ বস্তু।
ভাল কথা, এই ‘টাই’টা কেমন দেখাচ্ছে বল তো? এটাকে ঠিক মত পরার আগে চার-চারটে ‘টাই নষ্ট করেছি।”
“আর যে ভাষার কথা তোমাকে শুধালাম তার কি হল ?” আমি প্রশ্ন করলাম।
ক্লিয়ন বলল, “আহ, সে তো গান করে না, কিন্তু সে যখন আমার ‘সৈকত বায়ুর পরী’ কবিতাটি আবৃত্তি করে সেটা একটা শোনবার মত জিনিস।”
আমি এগিয়ে গেলাম। মোড়ের মাথায় একটা সংবাদপত্র বিক্রি-করা ছেলেকে পেলাম। সে তার হাতের কাগজটাই আমার দিকে এগিয়ে দিল।
আমার পেনি পকেটে মুদ্রা খোঁজার ভান করে আমি বললাম, “আচ্ছা বাবা, তোমার কি কখনও মনে হয় না যে এই শহরটাও বোধহয় কথা বলতে পারে। এই যে প্রতিদিন কত উত্থান-পতন, কত মজার কাজ-কারবার আর অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটছে—যদি এই শহরটা কথা বলতে পারত তাহলে এ সব ব্যাপার নিয়ে সে কি বলত বলে তোমার মনে হয়?”
“ও সব বাজে কথা ছাড়ুন,” ছেলেটি বলল। “আপনি কোন্ কাগজটা চান তাই বলুন। নষ্ট করার মত সময় আমার হাতে নেই। আজ ম্যাগি-র জন্মদিন; তার জন্য একটা উপহার কিনতে আমার ত্রিশ সেন্ট চাই।”
এ তো মহানগরের কোন ভাষ্যকার নয়। একটা কাগজ কিনে সব রকম সংবাদশুদ্ধ সেটাকে হাইয়ের টিনে ফেলে দিলাম।
আবার পার্কে ফিরে গিয়ে চাঁদের আলো-ছায়ায় বসলাম। অনেক ভাবলাম; আমি যা চাইছি সেটা কেউ বলতে পারছে না দেখে অবাক হয়ে গেলাম।
তারপরেই একটা স্থির নক্ষত্র থেকে ছুটে আসা আ্লোর মত দ্রুতগতিতে জবাবটা আমার মনের মধ্যে জেগে উঠল। উঠে দাঁড়িয়ে আমি ছুটতে লাগলাম। ছুটে গেলাম আমার নিজের মহল্লায়। উত্তরটা আমি জেনে ফেলেছি; ছুটতে ছুটইে উত্তরটাকে আমি বুকের মধ্যে চেপে ধরে রাখলাম, পাছে অন্য কেউ আমাকে থামিয়ে আমার গোপন কথাটা জেনে নিতে চায়।
অরেলিয়া তখনও সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিল। চাঁদটা আরও উপরে উঠে এসেছে, আর দ্রাক্ষালতার ছায়াটা আরও ঘন হয়েছে। আমি তার পাশে বসলাম; দু’জনে দেখতে পেলাম একটা টুকরো মেঘ সমান চাঁদের দিকে এগিয়ে যেইে কেমন যেন বিবর্ণ ও পরাজিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ল।
আর তারপরেই সব বিস্ময়ের সেরা বিস্ময় এবং সব খুশির সেরা খুশি! কেমন করে যেন আমাদের দুটি হাত পরস্পরকে স্পর্শ করল; আমাদের আঙুলগুলো এক সাথে বাঁধা পড়ল; সে বন্ধন আর খুলল না।।
আধ ঘণ্টা পরে অরেলিয়া তার নিজস্ব ভঙ্গিতে হেসে বলল: “তুমি কি জান, ফিরে আসার পর থেকে তুমি একটি কথাও বল নি?”
বিজ্ঞের মত মাথাটা নেড়ে আমি বললাম, “সেটাই মহানগরের কণ্ঠস্বর।”
সেটাকে পেতে হলে আমাদের একত্রে মেলাতে হবে দিনের যান-বাহনের প্রচণ্ড গুরুগম্ভীর শব্দ, রাতের অট্টহাসি ও সঙ্গীত, গাড়ির চাকার কান্না | ও চাপা গুঞ্জন; সংবাদপত্রের এজেন্টদের চীৎকার, ছাদের বাগানের ফোয়ারার ঝিরঝির শব্দ, ফেরিওয়ালাদের হৃাবালু, পার্কে পার্কে প্রেমিক-প্রেমিকাদের গুঞ্জন। এই সমস্ত শব্দ দিয়ে গড়ে উঠবে তোমার প্রার্থিত কণ্ঠস্বর—কেবল একত্র করলে হবে না, একত্রে মেশাতে হবে, আর মিশিয়ে নির্যাস বানাতে হবে, আর সেই নির্যাস থেকে বের করতে হবে সুরাসার—এক শ্রবণযোগ্য সুরাসার, যার একটি ফোঁটা থেকেই গড়ে উঠবে আমাদের প্রার্থিত বস্তুটি।”
কবি মুচকি হেসে শুধাল, “ক্যালিফোর্নিয়ার সেই মেয়েটির কথা কি তোমার মনে পড়ে যার সঙ্গে গত সপ্তাহে আমাদের দেখা হয়েছিল স্টিভার-এর স্টুডিওতে? শোন, আমি তার কাছেই যাচ্ছি। আমার সেই ‘বসন্তের উপহার” কবিতাটিকে সে অক্ষরে-অক্ষরে মুখস্থ করে ফেলেছে। বর্তমানে সেই তো এ শহরের সব চাইতে দুর্লভ বস্তু।
ভাল কথা, এই ‘টাই’টা কেমন দেখাচ্ছে বল তো? এটাকে ঠিক মত পরার আগে চার-চারটে ‘টাই নষ্ট করেছি।”
“আর যে ভাষার কথা তোমাকে শুধালাম তার কি হল ?” আমি প্রশ্ন করলাম।
ক্লিয়ন বলল, “আহ, সে তো গান করে না, কিন্তু সে যখন আমার ‘সৈকত বায়ুর পরী’ কবিতাটি আবৃত্তি করে সেটা একটা শোনবার মত জিনিস।”
আমি এগিয়ে গেলাম। মোড়ের মাথায় একটা সংবাদপত্র বিক্রি-করা ছেলেকে পেলাম। সে তার হাতের কাগজটাই আমার দিকে এগিয়ে দিল।
আমার পেনি পকেটে মুদ্রা খোঁজার ভান করে আমি বললাম, “আচ্ছা বাবা, তোমার কি কখনও মনে হয় না যে এই শহরটাও বোধহয় কথা বলতে পারে। এই যে প্রতিদিন কত উত্থান-পতন, কত মজার কাজ-কারবার আর অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটছে—যদি এই শহরটা কথা বলতে পারত তাহলে এ সব ব্যাপার নিয়ে সে কি বলত বলে তোমার মনে হয়?”
“ও সব বাজে কথা ছাড়ুন,” ছেলেটি বলল। “আপনি কোন্ কাগজটা চান তাই বলুন। নষ্ট করার মত সময় আমার হাতে নেই। আজ ম্যাগি-র জন্মদিন; তার জন্য একটা উপহার কিনতে আমার ত্রিশ সেন্ট চাই।”
এ তো মহানগরের কোন ভাষ্যকার নয়। একটা কাগজ কিনে সব রকম সংবাদশুদ্ধ সেটাকে হাইয়ের টিনে ফেলে দিলাম।
আবার পার্কে ফিরে গিয়ে চাঁদের আলো-ছায়ায় বসলাম। অনেক ভাবলাম; আমি যা চাইছি সেটা কেউ বলতে পারছে না দেখে অবাক হয়ে গেলাম।
তারপরেই একটা স্থির নক্ষত্র থেকে ছুটে আসা আ্লোর মত দ্রুতগতিতে জবাবটা আমার মনের মধ্যে জেগে উঠল। উঠে দাঁড়িয়ে আমি ছুটতে লাগলাম। ছুটে গেলাম আমার নিজের মহল্লায়। উত্তরটা আমি জেনে ফেলেছি; ছুটতে ছুটইে উত্তরটাকে আমি বুকের মধ্যে চেপে ধরে রাখলাম, পাছে অন্য কেউ আমাকে থামিয়ে আমার গোপন কথাটা জেনে নিতে চায়।
অরেলিয়া তখনও সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিল। চাঁদটা আরও উপরে উঠে এসেছে, আর দ্রাক্ষালতার ছায়াটা আরও ঘন হয়েছে। আমি তার পাশে বসলাম; দু’জনে দেখতে পেলাম একটা টুকরো মেঘ সমান চাঁদের দিকে এগিয়ে যেইে কেমন যেন বিবর্ণ ও পরাজিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ল।
আর তারপরেই সব বিস্ময়ের সেরা বিস্ময় এবং সব খুশির সেরা খুশি! কেমন করে যেন আমাদের দুটি হাত পরস্পরকে স্পর্শ করল; আমাদের আঙুলগুলো এক সাথে বাঁধা পড়ল; সে বন্ধন আর খুলল না।।
আধ ঘণ্টা পরে অরেলিয়া তার নিজস্ব ভঙ্গিতে হেসে বলল: “তুমি কি জান, ফিরে আসার পর থেকে তুমি একটি কথাও বল নি?”
বিজ্ঞের মত মাথাটা নেড়ে আমি বললাম, “সেটাই মহানগরের কণ্ঠস্বর।”
0 মন্তব্যসমূহ