হামিরউদ্দিন মিদ্যার গল্প - পীর সাহেবের আস্তানা

অনেক বছর ধরে অন্ধকারে পড়ে আছে জায়গাটা। এখানে ছিল কোন আমলের সব ঢাউস ঢাউস সাইজের গাছ।বট,অশ্বত্থ,নীম,শিরীষের গভীর ছায়া পথচলতি মানুষকে হাতছানি দিয়ে ডাকত। রোদে হাঁপিয়ে আসা মানুষ দু'দন্ড দাঁড়িয়ে মনে শান্তি পেত। পিপাসা পেলে নহুবাবুড়ির কুঁড়েঘরে পানি খেয়ে যেত। কেউ কেউ পীরের থানের দিকে তাকিয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করে নীম গাছের সঙ্গে সাঁটা বক্সে ভরে দিত দশ পয়সা,কুড়ি পয়সার খুচরো কয়েন। সকাল সন্ধ্যায় গৃ্হস্থের বউ মাথায় ঘোমটা টেনে থানে ধূপ-মোমবাতি জ্বেলে দিয়ে যেত। রমজান মাসে সবেবরাতের রাতে মোমবাতির আলোয় এমন সুন্দর সেজে উঠত—সে এক দেখার মতো দৃশ্য ছিল!


মেহেবুব হাসান মারা যাবার পর ওর ছেলেরা গাছপালা কেটে,সাফসুতরো করে জায়গাটা ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছে।চারিধার কঞ্চির বেড়া দিয়ে সারি সারি ইউক্যালিপটাসের গাছ লাগিয়েছে।গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে তাকালে এখনও পীরের থানটি নজরে পড়বে,তবে এখন আর ধূপধুনো পড়ে না।

ধূপধুনো পড়বেই বা কেন!সেই যে কোথা থেকে একবার মসজিদে জামাতের লোক এল,আর বলে গেল,পীর মানা সেরেকি গোনাহ।সব গোনাহর ক্ষমা আছে,কিন্তু সেরেকি গোনাহর কোনো ক্ষমা নেই।তখন থেকেই মানুষের মনে ভাঙন ধরল।শুধু কি এই জামালপুর গ্রামে?ওদিকে মজলিনগর,হাসিরডাঙা,ভাঙনগোড়ে সব গ্রামে একই অবস্থা। কোথাও কোথাও পীরের থানগুলো ভেঙে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হল।যেখানে রইল,সেখানে মানুষ দুটো দলে ভাগ হল।পীরপন্থিরা গ্রামে গড়ে তুলল আলাদা মসজিদ।

কিন্তু জামালপুর তো খুব ছোট গ্রাম।ক'ঘর মুসলমানেরই বা বাস!তেমন পীরপন্থি গজিয়ে উঠল না।দু-একজন যারা ছিল,এতদিনের বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিল,তাদের ওপর হল অত্যাচার।

নহুবাবুড়ির ছেলে সিদ্দিক মন্ডল পীরের থানে ধুপ দিতে গেলে নামাজ পড়ে ফেরার পথে কয়েকজন মুসুল্লি দেখে ফেলে।সিদ্দিকের হাতটা খপ করে ধরে পথ আটকে দাঁড়ায়।বলে,আমরা গোটা গ্রামের মানুষ একদিকে,আর তুই খুব এঁড়ে মরদ হয়ে গেছিস?ওসব চলবেনি এখানে।একই মসজিদে নামাজও পড়বি,আবার পীরও মানবি,মগের মুল্লুক পেয়েছিস!

সিদ্দিক বলে,আমি আমার বিশ্বাস নিয়ে আছি,তাতে তোমাদের কী!

—বটে!বাড় বেড়েছে তাহলে।ঠিক আছে,ষোলোয়ানার মাঝে কথাটা বলবি।

সেদিন সন্ধ্যেবেলায় গ্রাম ষোলোয়ানার ডাক দেওয়া হল।তিন পাড়ার মাঝে 'আস্তানা' নামে এই জায়গাটাতেই বরাবর বিচার বসা হত।পীরের স্থান।কেউ মিথ্যে অভিযোগ করবে না,এই আশা নিয়েই বসার জায়গাটা এখানে ঠিক হয়েছিল।এখন বাগানের পাশেই রাস্তার ধারটায় বসা হয়।রাতে গাড়ি তো খুব একটা চলে না।অন্ধকারে ডাঁড়াশ সাপের মতো বুক চিতিয়ে শুয়ে থাকে রাস্তাটা।মাঝেমধ্যে দু'চাকার মোটর বাইক ছুটে যায় সদরের দিকে।আর কখনও যদি চারচাকা ঢুকে পড়ে,তখন উঠে পেরনোর জায়গা করে দিতে হয়।

জুতো খুলে থ্যাপসা গেদে বসে পড়েছে সব।কেউ বা বসার জন্যে এনেছে খড়ের আঁটি।

এতক্ষণ সব হৈ হট্টগোল করছিল।হঠাৎ গ্রামের মাথা ছাত্তার সেখ এসে পড়ায় সব চুপ করে বসল।ছাত্তার গ্রামের মুরুব্বি মানুষ। অনেকদিন ধরেই বিচার করে আসছেন।আরও কিছু প্রবীণ মানুষ আছেন,কিন্তু সবার ভরসা ছাত্তারের ওপরেই।

মসজিদের মাইকে যখন ঘোষণা করা হল,আজ গ্রাম ষোলোয়ানার ডাক আছে।তখনই কার মুখে যেন বৃত্তান্তটি শুনেছিলেন ছাত্তার।

একটা বিড়ি ধরিয়ে ছাত্তার সেখ বললেন,সিদ্দিক কই?ওকে ডেকে আনো কেউ।

ষোলোয়ানার পক্ষ থেকেই দু'জনকে সিদ্দিক মন্ডলের বাড়ি পাঠান হল।কিছুক্ষণের মধ্যেই সিদ্দিক গটগট করে হাজির হল।কয়েকজন সরে গিয়ে ওকে বসার জায়গা করে দিল।

ছাত্তার সেখ এবার গলা ঝেড়ে কাশল,তারপর সম্মিলিত মানুষগুলোকে শুনিয়েই বলল,সিদ্দিক ভাই,কী আলফাল শুনছি তোমার নামে?তুমি নাকি পীরপন্থি!ধুপ দিচ্ছ থানে?

—হ,দিচ্ছি।কী হয়েছে তাতে?তোমাদের কাউকে তো মানতে বলিনি।

সিদ্দিকের মুখে এমন জোরালো উত্তরের আশা করেনি কেউ।

—তাহলে তো তোমাকে গ্রাম ছাড়তে হবে।এই গ্রামেই বাস করবে,আর বসে বসে সব অনাশিষ্টি কাজ করে যাবে,তা তো চলবে না ভাই।

—আজ তোমরা সব অনাছিষ্টি কাজ বলছ!কেন, আমার মায়ের কথা ভুলে গেলে সব?কেউ কোনো উপকার পাওনি?

নহুবাবুড়ির কথা উঠতে অনেকেই চূপ করে যায়।তখন একজন চ্যাংড়া ছেলে দাঁড়িয়ে হুট করে বলে ওঠে,শুনো চাচা,ওসব পীর-ফিরের যুগ শেষ।তোমার ওই পচা কথা এখন বাদ দাও তো।থানটা ভেঙে দিলেই সব সমস্যা দূর হয়ে যাবে।

—চূপ কর ছ্যামড়া!গুরুজনের মাঝে হুটহাট কথা বলিস কেন!তবে তোরাই বিচারটা কর।গর্জে উঠল ছাত্তার সেখ।

মনোয়ার মাস্টার এতক্ষণ গ্যাঁট হয়ে বসেছিল একধারে।আর থাকতে না পেরে বলে উঠল,থান ভাঙার কথা কেউ বল না।ও তো কারও ভাতে ধুলো দেয়নি।এক ধারে পড়ে আছে,পড়ে থাকুক।

পীর মানা ছাড়লেও থানটি ভাঙার ইচ্ছা অনেকের নেই।কয়েকজনের ভেতরে ভেতরে একটা দূর্বলতা কাজ করে।কেউ এতক্ষণ বলার সাহস পাচ্ছিল না।মনোয়ার মাস্টারের কথাতে তারাও সমর্থন জোগাল।

ছাত্তার সেখ এবার সিদ্দিকের দিকে তাকিয়ে বলল,তাহলে কী বলতে চাইছ সিদ্দিক ভাই,একটু স্পষ্ট করে বলো তো।তুমি কারও কথায় মানবে না, তাই তো?

সিদ্দিক মন্ডল আর কোনো কথা বলল না।মাথা নামিয়ে চুপ করে বসে থাকল।

পাশ থেকে কয়েকজন বলে ওঠে,ছাত্তার চাচা,এতো তেল মেরে লাভ নেই।আসল কথাটা এবার জানিয়ে দাও।

ছাত্তার সেখ এবার আদেশের সুরে গলা চড়িয়ে বলল,তাহলে শুনে রাখো সিদ্দিক।হয় পীর মানা ছাড়ো,নয়তো সমাজ থেকে তোমাকে 'একঘরে' হতে হবে।বলো কোনটা চাও?

একঘরে করে দেওয়া মানে হল,সে গ্রামের সমস্ত সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত।কেউ তার সঙ্গে কথাও বলবে না।এমনকি তার পরিবারের কেউ মারা গেলে,সেই লাশটি পর্যন্ত গোরস্থানে কবর দিতে দেবে না।

সিদ্দিক গ্রাম ষোলোয়ানার কাছে ভাবতে সময় নিল কয়েকদিন।

সিদ্দিকের বউ জহুরা বিবি বলল,শুনো গো!তুমি মাথা গরম কর না।বিশ্বাস থাকে মানুষের অন্তরে।তুমি নাইবা লোক দেখিয়ে ধূপ- মোমবাতি দিতে গেলে।গাঁয়ের মানুষ সব নিমকহারাম!আজ তোমার মা যদি বেঁচে থাকত,তাহলে কি এই কান্ড হত!

(দুই)

এবছর চৈত্র মাস পড়তে না পড়তেই ছাঁতিফাটা রোদ।মাটি ফেঁটে চৌচির। ডাঙা-ডহর-টিলা সব পানির জন্য খাঁ খাঁ করছে।ক্যানেল ধারে,নদীর ধারে যাদের নীচু জমি,তারা বোরো চাষ করত—এবছর তাও নেই।কিছু চাষী জমিতে তিল ছড়িয়ে ছিল।চারাগাছ শুকিয়ে দড়দড়ি।খাদ্যের আকাল পড়েছে।

এমন অসময়েই জামালপুরে এল দুটি মেয়েমানুষ। একজন বুড়ি,সঙ্গে একটি ছোকরা বউমানুষ।বউটির মাথায় লাল টকটকে সিঁদুর,হাতে শাখা।

বুড়ি জানাল অনেকবছর আগে,যখন তার বউ বেলা, তখন একবার এসেছিল আস্তানায়।লোকজনের কাছে শুধিয়ে সাধিয়ে তবে আসতে পারল।

ঘুরেফিরে বাগানটা দেখছিল এতক্ষণ।যে ছেলেগুলি তেমাথার মোড় থেকে পথ দেখিয়ে আস্তানায় এনেছে, বুড়ি ওদের দিকে ঘুরে ঘাড় নেড়ে বলল, না না বাপু।এ সে জায়গা লয়।বললিই হল!বুড়ো নীমগাছটা কই? আর নহুবাবুড়ির কুঁড়েঘরটা?

ছেলেগুলি কৌতুহলী হয়ে বুড়িকে দেখছে,আর ততো অবাক হচ্ছে।বাপ চাচাদের মুখে নহুবাবুড়ির কথা শুনেছে বটে,কিন্তু কখনও চাক্ষুষ দর্শন করার ভাগ্য কারও জুটেনি।ওদের মধ্যেই একটি ছেলে বলে উঠল,নহুবাবুড়ি তো কোন কাল আগে মরে গেছে।এটাই সেই আস্তানা।—বলে ছেলেটি আঙুল বাড়াল বাগানের ভেতর দিকে, হুই দেখো পীরের থানটা।

বুড়ি খুব হতাশ হল।বলল,সেই ভোরের ঝুঁঝকো আলো থাকতে ঘর থেকে বেরয়ছি বাবারা।ছিলামপুরের ঘাটে নদী পেরিয়ে,দামুদরের এপার থেকে বাস ধরে চড়কতলা।তারপর আবার হাঁটা!

বুড়ির সঙ্গের বউটি একটা কথাও বলেনি।দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব জব্দ হয়ে গেছে। রোদে রোদে এসে ডগডগে মুখটা শুকিয়ে আমসি।হাতে একটা থলে ধরে রাস্তার একপাশে ছায়া মত জায়গাটায় দাঁড়িয়ে।গড়গড় করে ঘামছে।

এতক্ষণ কেউ খেয়াল করেনি থলের ভেতরে কী আছে।হঠাৎ ঝটপট করে কী যেন ভেতরে নড়ে উঠল।ছেলেপুলের দল কৌতূহলী হয়ে তাকাল সেদিকে।বউটি খুব লজ্জা পেয়ে গেছে।

বুড়ি হেসে বলল,জোড়া মোরগ আছে ওতে।মানত করেছি বাবারা।সবাই খেয়ে যাবি।একটু দম নিয়ে বুড়ি আবার বলল,নাতনিকে নিয়ে কত আশা করে এলাম—কিন্তু কোথায় কী!আগে কী ছিল জায়গাটা!নহুবাবুড়ি বড়োই আমল ওয়ালী মানুষ ছিল রে!উয়ার তাবিজ,কবজ,জড়িবুটির ওষুধ খুব কাজে লাগত।

বাগানের ভেতরে বুড়ি ঢুকে গেল,খালি পা।নাতনিটি জুতো খুলে ঠাকুমার পিছু পিছু।থানের কাছে গিয়ে দু'জনেই প্রণাম করল।

গ্রামের মাঝখানে এই যে 'আস্তানা' নামে জায়গাটা,যার খোঁজে বুড়ি এতদূর থেকে তার নাতনিকে নিয়ে হাজির হয়েছে,এই জায়গাটার একটা ইতিহাস আছে।এখানে আগে হিন্দু-মুসলমান প্রচুর মানুষের সমাগম হত।জায়গাটার নাম 'আস্তানা' কেন হল?কাদের আস্তানা এখানে?নহুবাবুড়ির সঙ্গে কীসেরই বা সম্পর্ক? — এর উত্তর খুঁজতে গেলে বেশ কিছু কাহিনী বেরিয়ে পড়ে।

সিদ্দিক মন্ডলের মা নহুবাবুড়ি ছিল বরাবরই একটু অন্য জগতের মানুষ। রাতের বেলা ঘুমের ভেতর নানারকম খোয়াব দেখত সে,আর সেই খোয়াব নাকি বাস্তবের সাথে মিলেও যেত।অনেকের খোয়াবের মানে বলে দিতেও পারত।জামালপুরের মানুষ খুব শ্রদ্ধা ভক্তি করত বুড়িকে।

একদিন খোয়াবে দেখল,কালো ঘোড়ার পিঠে চেপে গ্রামের ঈশান কোণ থেকে সাদা আলখাল্লা পরা,মাথায় পাগড়ি,মুখে চাপদাড়ি ওয়ালা এক বান্দা নাকি আল্লাহর প্রেরিত কোনো অলি টগবগ টগবগ শব্দ তুলে ঝড়ের গতিতে এসে আস্তানার বুড়ো নীম গাছটার তলায় থামল।পিঠ থেকে নেমে ঘোড়াটাকে গাছের সঙ্গে বেঁধে দিয়ে,ওই আলখাল্লা পরা বান্দা নাকি আল্লাহর প্রেরিত অলি কিছুটা দূরত্বে একটা ঝোপের ভেতর ঢুকে গেল। নীমগাছের নীচে বাঁধা ঘোড়াটা হাপুস নয়নে কাঁদছে,আর মুখ দিয়ে অস্পষ্ট গোঙানির মতো কেমন একটা শব্দ বেরচ্ছে।বুড়ি খোয়াবের ভেতরেই অপেক্ষা করতে থাকে।অপেক্ষা করতে করতে সকাল হয়ে যায়,কিন্তু ওই বান্দা নাকি অলি কিছুতেই ঝোপ থেকে বেরিয়ে আসে না।তখন নহুবাবুড়ির মনে সন্দেহ জাগে।

সকালে উঠেই নহুবাবুড়ি ডেকে-হেঁকে জড়ো করল জামালপুরের মানুষকে। কাটারি,কোঁদাল,গাঁইতি নিয়ে বেশ কিছুজন বুড়ির নির্দেশ মতো আস্তানার সেই ঝোপটার কাছে হাজির হল।না জানি বুড়ি খোয়াবে কোন গুপ্তধনের সন্ধান পেয়ে গেছে!সবার আস্থা আছে নহুবাবুড়ির ওপর।ঝোপঝাড় পরিস্কার করে মাটি খুঁড়তে আরম্ভ করল কয়েকজন।অনেকেই কৌতূহলী হয়ে ভিড় জমিয়েছে।হঠাৎ একজনের কোঁদালে কীসে যেন ঠোক্কর লেগে 'ঠং' শব্দ হল।শব্দটা শুনেই সবার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।যারা কোঁদাল চালিয়ে আলাতন হয়ে পড়েছিল,তাদেরও কাজের গতি বেড়ে গেল।

খোঁড়ো খোঁড়ো মাটি খোঁড়ো

তুলো জলদি বাছাধন

মাটির ভেতর রাখা আছে

সাত রাজার গুপ্তধন।

গুপ্তধনই বটে।কত যুগ ধরে যে মাটির তলায় চাপা ছিল!কয়েকটা ইঁট।পানি টেনে টেনে পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেছে।কেউ বুঝতে না পেরে এ ওর মুখের দিকে তাকাল।একজন রেগে বলে উঠল,বুড়ির ভীমরতি ধরেছে!খোয়াবে কী দেখেছ,সেটাও তো স্পষ্ট করে বলছ না।সেই থেকে খেটেখুটে শেষমেষ কয়েকটা ইঁট!

নহুবাবুড়ি গালে হাত দিয়ে কী যেন ভাবছিল এতক্ষণ। লোকটির কথা কানে যেতেই ধ্যান ভাঙল। নরম গলায় বলল,ফালতু খুঁড়তে বলিনি রে বাপ।যা ভাবছিলাম,তাই সত্যি।এখানে এক পীর সাহেব দেহ রেখেছিলেন। তেনার গোর ছিল এখানে।আমি খোয়াবে দেখেছি তেনাকে।জ্যোৎস্নার রেতে টগবগ শব্দ শুনিসনি কেউ?উনি ঘোড়ার পিঠে চেপে ঘুরতে বের হন।

যারা খালে নেমেছিল,তারা ভয়ে উঠে পড়ল সব।

নহুবাবুড়ি বলে চলে,সেই কোন যুগ আগে তেনার আবির্ভাব হয়িছেল এই দ্যাশে।এ গাঁ,সে গাঁ ঘুরে ঘুরে ধর্মপ্রচার করি বেড়াতেন।অনেক ভক্ত সঙ্গীও হয়িছেল।যে গাঁয়ে আঁধার ঘনিয়ে সন্ধ্যা নামত,সেই গাঁয়েই আশ্রয় নিতেন তিনি।কারও বাড়িতে ঢুকতেন না।নদীর ধারে,পাহাড়ের কোলে,গাছের নীচে রাত কাটাতেন।সকাল হলে আবার রওনা।

তেমনি একদিন আমাদের জামালপুরে আঁধার ঘনিয়ে এল।আস্তানার বড় বড় গাছগুলি দেখে পীর সাহেবের জায়গাটা খুব মনে ধরে।সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে এখানেই আশ্রয় নিলেন তিনি।

পীর সাহেবের আসার খবর মুখে মুখে পৌঁছে গেছে আশপাশের গাঁয়ে।হাজার হাজার মানুষ ভেঙি পড়িছে তেনাকে দর্শন করতে।খোলা আসমানের নীচে তিনি ওয়াজ করছেন।ধর্মের কথা শোনাচ্ছেন।বড় বড় কড়াইয়ে খিচুড়ি রান্না হচ্ছে।খাওয়াদাওয়ার পর অনেকেই রাত গভীর হলে নিজের নিজের ঘরে ঘুমতে চলি গেল।ঘুম নেই পীর সাহেবের চোখে।তেনাকে কেমন এক নেশায় পেয়ি বসে।এত ভক্ত এর আগে কোথাও দেখেননি তিনি।ভক্তরা ওয়াজেরর মাঝে মাঝেই জয়ধ্বনি দিয়ে উঠছে।জয়ধ্বনি শুনে তেনার গলার জোর আরও বেড়ে যেতি থাকে।রাত পেরায় শেষের মুখে।দু'চারজন ভক্ত যারা শ্যাষ পর্যন্ত জেগি ছেল,তারাও ঘুমে ঢুলে পড়ছে।হঠাৎ হার্ট ফেল করেন পীর সাহেব।বুকে হাত দিয়ে চিরদিনের মত লুটিয়ে পড়েন আস্তানার মাটিতে।

কোন দ্যাশে জন্ম, কোথায় ঘর কেউ জানে না।ভক্তরা কেঁদে কেঁদে ভিজিয়ে দিলে আস্তানার মাটি।সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নিল,উনি যেখানে লুটিয়ে পড়েছেন,তার নীচেই দেওয়া হোক কবর।জায়গাটা তেনার খুব মনে ধরিছেল যে।

সবাই চোখ গোল করে শুনছিল নহুবাবুড়ির কথা।গ্রামের কিছু প্রবীণ মানুষও ভিড়ের মধ্যে বসেছিল।তারা বলে উঠল,তুমি এতো কথা জানলে কী করে বুড়ি?

— আমার কী জগতের কোনো কথা জানতে বাকি থাকে রে!এখন আমাদের জায়গাটা পরিচর্চা করি রাখতে হবে।

ঘরে ঘরে টাকা-পয়সা,ধান-চাল আদায় করে ইঁট সিমেন্ট দিয়ে একটা থান বানাল জামালপুরের মানুষ। রোজ সকাল সন্ধ্যায় ধুপ-মোমবাতি পড়তে লাগল।কে যেন রাতের অন্ধকারে পোঁড়ামাটির ঘোড়া নামিয়ে গেল একজোড়া।জেগে উঠল আস্তানার মাটি।

আর ওদিকে নহুবাবুড়িকে কী যে রোগে ধরল!প্রতিদিন রাতে বিরেতে খিঁচুনি আরম্ভ হত।চারটে লোকেও ধরে রাখতে পারত না।মনসাপূজোর ভর ওঠার মতো মাটিতে গড়াগড়ি দিত। আর বার বার আস্তানায় ছুটে চলে যেত।রাত্রে খেয়ে দেয়ে হয়ত বিছানায় শুয়ে পড়েছে,সকালে দেখা গেল বিছানা খালি।আস্থানায় পীরের থানের গোড়ায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।চোখেমুখে পানির ছিঁটা দিলে আবার ঠিক হয়ে যায়।নহুবাবুড়িকে নিয়ে সবাই পড়ল চিন্তায়।

যে সমস্যার সমাধান নহুবাবুড়ি নিজেই করেছিল।একদিন ভর ওঠার সময় গম্ভীর গলায় বলল,নহুবাকে তোরা কেউ বাঁচাতে পারবি না।যদি গ্রামের ভালো চাস,তো সুর সুর করে আস্তানায় একটা ঘর তুলে দে।

এ তো নহুবাবুড়ির গলা নয়!পুরুষমানুষের মতো গলার আওয়াজ! — শুনে চমকে উঠল গ্রামের মানুষ।সবাই ভয়ে অতিষ্ঠ।

পরেরদিন থেকেই লেগে ভেগে সবাই বাঁশ,খড়,মাটি দিয়ে একটা কুঁড়েঘর বানিয়ে দিল আস্তানায়।প্রথম প্রথম শিকড়-বাঁকড়,জড়িবুটির ওষুধ দিত নহুবাবুড়ি। পরে তাবিজ-কবজ,হাত চালানো, বাতা চালানো,বাণ মারা সব বিদ্যায় রপ্ত করেছিল।গ্রাম ছাড়িয়েও মানুষের মুখে মুখে দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়ল নহুবাবুড়ির নাম।প্রতিদিন নানারকম রোগীরা হাজির হত তার কাছে।কেউ কেউ হাঁস,মুরগী, ছাগল মানত করে যেত।প্রায় দিনই উনুন চড়ত আস্তানায়।পীরের সিন্নি রান্না হত।কত যে মানুষ পাত পেড়ে খেত!

(তিন)

সিদ্দিক মন্ডল খবর পাওয়ার আগেই জনা পাঁচেক মুসুল্লির কানে কথাটা পৌঁছে যায়।সাবেরালী, জমিরউদ্দিন,বদরুল সেখ সহ কয়েকজন আস্থানায় হাজির হল।এই সময়টিতে সবাই যে যার কাজে চলে যায়।

বুড়ি জামালপুরের হালচাল জানে না।সবাইকে শুনিয়েই অভিযোগ করল,গাঁয়ে এতগুলো মানুষ থাকতে আস্তানার এ কি হাল গো!

সাবেরালী নির্দেশ দিল,আর খামোকা গাঁ লাচাতে আসো না বুড়ি।সুর সুর করে চলে যাও।এখানে কিছুই করতে দেওয়া হবে না।

বুড়ি ব্যাপারটা বুঝতে পারে না।আমতা আমতা করে বলল,আমি গাঁ লাচাতে আসিনি বাপ!এতদূর থেকে মানত করে এইছি।শুধু হাতে ঘুরে যাব!একটু রেঁধেবেড়ে খাওয়াব ছেলেপুলেদের।—একটু দম নিয়ে বুড়ি আবার বলে,নহুবাবুড়ির ছেলেপুলে কেউ বেঁচে নাই?একবার দেখা করে যেতাম।

বদরুল সেখের নির্দেশে একটা ছেলে সিদ্দিককে ডাকতে গেল।কিছুক্ষণের মধ্যেই হাজির হল সিদ্দিক।

সিদ্দিক পথে আসতে আসতে ছেলেটির মুখেই শুনেছে কিছু কথা।এসেই দেখল বেশ কয়েকজন জড়ো হয়েছে আস্তানায়।

বুড়ি অবাক হয়ে সিদ্দিককে দেখল।গদগদ হয়ে বলল,তোমার মায়ের কাছে অনেকবছর আগে একবার এসেছিলাম।আজ নাতনিকে নিয়ে আবার আসতে হল।নহুবাবুড়ি তো আর নাই।উয়ার নিজের পেটের ছেলে তুমি।তোমার হাতে থানের গোড়া থেকে কিছুটা মাটি নিয়ে যেতে চাই।

—এ আর এমনকি ব্যাপার!ঠিক আছে নিয়ে যাও,তাতে সমস্যা কী হয়েছে?

—বুড়ো ভাম!সমস্যা কি বোঝ না?জোড়া মোরগ মানত করেছে,এখানে সিন্নি রান্না করবে বলছে।বুড়ি জবাব দেবার আগেই বদরুল সেখ বেশ উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল।

—আমাদের গাঁয়ের তো কেউ নয়।আর মোসলমানও নয় এরা।একদিনের ব্যাপার করলিই বা!সিদ্দিক নরম গলায় জবাব দেয়।

—করলিই বা?এ বুড়োটাকে নিয়ে হয়েছে যত সমস্যা!মরনকালে কী যে গতি হবে!

মনোয়ার মাস্টারও খবর পেয়ে হাজির হয়েছে।অনেকদিনের রিটায়ার্ড হলেও মাস্টার তকমাটা নামের সঙ্গে সেঁটে গেছে।ওনাকে গ্রামের মানুষ একটু মান্য করে।সিদ্দিক তাই মোক্ষম সুযোগটাই ব্যবহার করে।

—মনোয়ার ভাই,তুমি তো একজন শিক্ষিত মানুষ।এতদিন যা বলেছে,তাই মুখ বুজে মেনে নিয়েছি।আজ অন্তত আমার একটা অনুরোধ রাখো।এতবছর পেরিয়ে গেল,মায়ের মরার পর তেমন কেউ তো আসেনি আস্তানায়।আজ এতদূর থেকে এরা এসেছে,ঘুরিয়ে দেওয়া কি ঠিক হবে?

মনোয়ার মাস্টার একটুক্ষণ কী যেন ভাবল।তারপর জড়ো হওয়া মানুষগুলোর কাছে অনুরোধ করল,একটা দিনের ব্যাপার,তাই মেনে নাও গো সব।না জেনে এসেছে যখন।যার আপত্তি আছে,সে তার ছেলেকে পীরের সিন্নি নাও খেতে দিতে পারো।

আর কেউ কিছু বলল না,সবাই যে যার ঘরে চলে গেল।নড়ল না ছেলেগুলো।মনোয়ার মাস্টার খানিক দাঁড়িয়ে থেকে বলে গেল,সিদ্দিক ভাই তুমি ওদের সাথে থাকো।ওরা দু'জনে এতোকিছু সামলাতে পারবে না।

বুড়ি কাছের দোকান থেকে চাল-ডাল কিনে আনল।বাকী সব ব্যবস্থা সিদ্দিক নিজেই করে দিল।

বুড়ি নিজের মনেই বলল,এখানের মাটির বড়ই গুণ গো!আস্তানায় এসেই তো আমি ছেলের মা হয়েছিলাম।

—ঠাকুমা তুমি থামবে!না বকবক করেই যাবে?— এতক্ষণে কথা বলল বুড়ির নাতনি।

—থামব কেনে লো,থামব কেনে? বুড়ি সিদ্দিককে শুনিয়ে বলল,খুবই লাজুক মেয়ে। এই পোঁড়াকপালির জন্যেই তো এলাম গো!তিনবছর বিয়ে হল,এখনও ছেলেমেয়ের মুখ দেখলনি।কত যে চিকিচ্ছে করানো হল!শ্বশুরবাড়ির লোকজন কথায় কথায় 'বাঁজা' বলে খোটা দেয়।নাত জামাইয়ের মনটিও এবার নড়েচড়ে বসেছে।মেয়ের মুখে বেত্তান্ত শুনেই আমি আস্তানায় আসব ঠিক করি,আমার কথা তো বাপু কেউ শুনেনি।

সিদ্দিক বলল,মা যদি বেঁচে থাকত,তাহলে সব সমস্যায় দূর হয়ে যেত।এখন তো আর কেউ পীর মানে না,—একটু ঢোক গিলে আবার বলে, এই যে পুরো জায়গাটা দেখছ,এটা মেহেবুব হাসানের।মা খোয়াব দেখার পরেই এটা পীরের জায়গা বলে দান করে দেয়।মেহেবুব ভাই ইন্তেকাল করার পর ওর ছেলেরা আবার দখল নিল।

বুড়ি বলল,এইছি যখন মানতটা করে যায়।পীরের মনে যদি দয়া জাগে জাগুক।

বাগানের এক পাশে কিছুটা জায়গা পরিস্কার করে,মাটি খুঁড়ে ইঁট দিয়ে উনুন বানানো হয়েছে।বেশকিছু ছোট ছোট ছেলেমেয়ে ভিড় জমিয়েছে।খেতে পাওয়ার আনন্দে সবার চোখগুলো চকচক করছে।নিজেদের মধ্যে কলরব করতে থাকে ওরা।সিদ্দিক বলল,এখন চিল্লাস না বাপধনরা।রাঁধা হোক।সবাই ঘর থেকে থালা আনবি।

অনেক বছর পর আবার আস্তানার মাটিতে উনুন জ্বলে উঠল।বড় হাঁড়িতে খিচুড়ি ফুটছে টগবটিয়ে।যার গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে।গন্ধটা ডেকে আনে ক্ষুধার্ত ছেলেমেয়ে গুলোকে।শুধু কি মুসলমান পাড়া থেকে? থালা বাটি হাতে নিয়ে বাগদীপাড়া,রায়পাড়া থেকেও বেশ কয়েকজন হাজির হয়েছে।কারও খালি গা,কোমরে ঘুনসি আঁটা হাফপ্যান্ট, কেউ বা মলিন গেঞ্জি গায়ে।সিদ্দিক সবাইকে বাগানের ভেতরে বস করিয়ে দিল।

খিচুড়ির গন্ধটা সিদ্দিককে ছেলেবেলায় ফিরিয়ে নিয়ে গেল।গাছে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে কেমন একটা ঘোরের আবেশে তলিয়ে যায় সে।দৃশ্যমান জগৎ ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে যায় চোখের সামনে থেকে।সিদ্দিক দেখল একটা কালো ঘোড়া টগবগ শব্দ তুলে ছুটে আসছে ঝড়ের গতিতে।যার লাগাম ধরে আছে সাদা আলখাল্লা পরা,মাথায় পাগড়ি,মুখে চাপ দাড়িওয়ালা এক বান্দা।শুধু তিনিই নন,ওনার পেছনে বসে আছে আরও একজন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ