অনির্বাণ বসু'র গল্প : অস্ত্রের গৌরবহীন একা

মুখোমুখি তাকিয়ে নাবিক দেখল, মেয়েটি আর্দ্র অনুভব করছে এবং একটি অপ্রত্যাশিত হাওয়ায় বর্ষার ভেজা স্বাদ শ্বাস ফেলছে। মুখমণ্ডল ঢাকা। এলোমেলো চুলে। সে কপালে আর গলায় আর বুকে হাত—রুমালের মতো—বোলাতে লাগল, কারণ বৃষ্টি আসার আগে সে মুছে ফেলতে চাইছিল তার রোমকূপে জন্মানো প্রতিটি স্বেদবিন্দু। বৃষ্টি মাখবে বলে সে দোতলার ডক পর্যন্ত উঠে গেল তারপর।
ঝড়ের ঠিক আগে শরতের সমস্ত লক্ষণ ছিল আকাশে : কম কিন্তু তুলোট মেঘ যা পুরোনো ফসলের মতো মরা হলুদ থেকে শ্যামবর্ণের হয়ে উঠবে কিছু পরেই, সেই মেঘেদের পিছনে আশ্চর্য জ্যোতির্বলয়ের মতো অগভীর সূর্য যা এখন একটি তামার মুদ্রাবিশেষ, আপাতত এখন একটি হলুদ উল্লাসের উদ্ভাস এবং ঘনশ্যাম মেঘগুলি ফুলে উঠছে ক্রমে। সমুদ্রের উপর, ঊর্ধ্বে মেঘমালা, তাদের ঘনত্ব দ্রুতগতি। নাবিক তার নিজস্ব ঘরে চলে যায় এবং ফিরে আসে কম্পাস-স্ট্যান্ড নিয়ে। সেখানে কয়েক মিনিটের জন্য একটি পালতোলা চার্টের উপর চোখ রেখেছিল সে এবং তাতে কোন বিবেচনার কী সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ, বুঝে নিতে চেয়েছিল চকিতে। নিশ্চিতভাবেই সে হাওয়ার গতিপথ অতিক্রম করতে পারল না, যাতে সমুদ্র-উপকূলে তার পাল ছিঁড়ে-যাওয়ার ঝুঁকি নিয়ে বজরা চালানো ঠিক হবে। সবচেয়ে যুতসই ধারণা ছিল যে, ঝড়টি বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে ডান দিকে ঠেলে দেবে এবং তারপরে সী-কোস্ট ধরে খোলা সমুদ্রের মধ্যে দিয়ে পৌঁছলেও পৌঁছানো যেতে পারে রেঙ্গুনের তীরে। সবশেষে, প্রস্থানটি তার কাছে একেবারে আকস্মিক কিংবা নতুনও ছিল না : বস্তুত, বদলের পর অকারণে জেলে-ভরা বহু রাজনৈতিক কর্মীদের আটক করার আগেই এই ভবিতব্য চুপিচুপি গৃহীত হয়ে গিয়েছিল। আকাশ ছিল আলোয় ভরা, মেঘের ছিটেফোঁটাও ছিল না দূর-দূরতক, যখন নাবিক পালতোলা বজরা ভাসিয়ে দিয়েছিল রেঙ্গুনের অভিমুখে। সে কখন পৌঁছতে পারত রেঙ্গুনে? যদি সবকিছু ঠিক হয়ে যায়, সম্ভবত নভেম্বরের মাঝামাঝি, সম্ভবত ডিসেম্বরের মধ্যে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল : গুরুতর অভিযোগের কাছে হেরে গিয়ে আপনি প্রতিটি গণহত্যার শহিদদের স্মৃতির নিন্দা জানিয়েছিলেন, আপনি প্রচুর খারাপ উপকরণে প্রতিটি সাধারণ মানুষের জন্য বানিয়েছিলেন গলাবন্ধ—মালকিন যেমন বেঁধে রাখে নিজের পালতু কুত্তার গলায়—তারপর সেসব পৌঁছে দিয়েছিলেন রানির ভোজসভায় : কুকুরেরা, খাবারের গন্ধে, ভোজসভা লাগোয়া আস্তাকুড়েই ঘোরাফেরা করে বেশি।

তবু, এখন, সেই মেয়েটি, যার নাম জানে না নাবিক কিন্তু দোতলার ডকে বৃষ্টি আসার আগে সোঁদা গন্ধ শরীরে মেখে নিচ্ছে যে, জোলো হাওয়ায় এলো চুল উড়ছে, নিচ থেকে মুখ দেখা যাচ্ছে না স্পষ্ট, এখনও পর্যন্ত তার মুখ ঠিকমতো দেখতে পায়নি রেঙ্গুনের দিকে বজরা ভাসিয়ে দেওয়া সেই নাবিক; যে কিনা ততটাও সমুদ্রযাত্রায় অভিজ্ঞ নয়, যে কিনা আসলে পলাতক। ঝোড়ো হাওয়া বইতে শুরু করেছিল যখন, তার আগে বজরায় লোকটি একাই ছিল; সঙ্গে ছিল কিছু শুকনো খাবার, কাঁচা ডিম, ঘিয়ের বড়ো কৌটো একটা, সামান্য ফল—বাড়িতে মাসকাবারি যা কিছু যৎকিঞ্চিত ছিল, তার থেকেই তাড়াহুড়োয় বেছে নেওয়া—আর একটা খাতা। সমুদ্রে ভেসে পড়ার পর, যখনও দুলুনি প্রাণ ওষ্ঠাগত করে তোলেনি, তখন খাতাটার প্রথম পৃষ্ঠায় সে শুধু লিখেছে : ইতিহাসের সমাপ্তি এবং সেই শেষ মানুষটির দাস্তান।

তবু, এখন, এই সামান্য বৃষ্টির মধ্যে, এই মুহূর্তে তার শরীর জুড়ে খেলা করে শিহরণ। রোমকূপ জানান দেয় নিজেদের অস্তিত্ব। শিরশিরানি। তলপেটে মোচড়। শিশ্ন—যার কারণে সে পুরুষ—উত্থিত, সজাগ। পলাতক শুধু ভিজে-যাওয়া মেয়েটিকে একটি বারের জন্য দেখতে চায়। জল কীভাবে কেটে বসেছে, স্পষ্ট করে তুলেছে মেয়েটির শরীরী বিভাজিকা : স্তন নাভি যোনি জঙ্ঘা। দেখতে চায়। গিলতে চায়। সবটাকে। মেয়েটাকে। ভেজা চুল আঙুল চালিয়ে পিছনে টানে সে, গড়িয়ে-পড়া বৃষ্টির জল—কামুকের মতো—ঠোঁটের কোণ থেকে চেটে নেয় জিভ।

বেশ কিছুক্ষণ ওই বৃষ্টির মধ্যে, কোনওক্রমে ঢাউস একটা প্ল্যাস্টিক মাথায়, দাঁড়িয়ে থাকে লোকটি। তার মনেও পড়ে না, একটা সময় ছিল যখন প্রবল রোদই হোক বা প্রচণ্ড বৃষ্টি, ছাতা নিত না সে; যে-কোনও ঋতুতে—শীতকালীন সপ্তাহব্যাপী ওই শৈত্যপ্রবাহের দিনগুলো বাদে—শার্টের উপরের বোতামখানা খুলে ঘুরে বেড়াত, সেই ফাঁক গলে উঁকি মারত তখন কয়েক গাছি লোম, কিছু উপরের দিকে মুখ করা, কিছু নিচের দিকে। তখন সে ভিড়ে-ভরা পদাতিক : মিছিলের মুখ। জীবন তখন মিটিং-মিছিলের দশটা-পাঁচটা। চতুর্দিকে ব্যস্ততা। ততোধিক ব্যস্ততার ভাণ। বৃষ্টির তোড় বাড়তে শুরু করলে, সঙ্গে হাওয়ার প্রবল বেগ, বজরা থেকে নোঙর—বাধ্যত—ফেলে দিতে হয় জলে। এরপর বজরা আপাত স্থির, সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ে টালমাটাল, পলাতক দেখছিল, চারপাশ ঝাপসা, ছাইরঙা। বুঝি-বা তাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে নিরাপত্তার এক সুরক্ষাবলয়; তাকে হন্যে হয়ে খুঁজে-বেড়ানো জিঘাংসুর দল, এই ঘেরাটোপে যেহেতু সে বহির্জাগতিক দৃষ্টির বাইরে, হদিশ পাবে না তার। ব্রহ্মতালুর সামান্য নিচে অদৃশ্য টিকিখানা থেকে মায় গোটা শরীরটাই তার এখন, এই গর্জনশীল বর্ষণের মধ্যে, সকলের—প্রত্যেকের—নাগালের বাইরে।

সুস্থির। হয়তো—।

অস্থির। হয়তো—।

মন তার বিলক্ষণ অস্থির : উপরের পাটাতনে বৃষ্টি মেখে চলেছে যে-মেয়েটি, এখনও পর্যন্ত তার মুখের যৎসামান্য আদলও ঠিকমতো ধরা পড়েনি তার কাছে। পুরুষ তার সহজাত প্রবৃত্তিতে নারীর দিকে, একবার অন্তত, তাকায়; নারীর ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয় না। সেই কারণেই মেয়েটির মুখ দেখতে না-পাওয়া অবধি মনের ভিতরের খচখচানি কাটে না নাবিকের৷ তার উপর এই আদিগন্ত সমুদ্রের মাঝে এমন এক রহস্যময়ী চলেছে তার সঙ্গে, তার সহযাত্রী হয়ে, যাকে সে চেনে না তাই নয়, বজরা নিয়ে ভেসে পড়ার মুহূর্তে কিংবা তার আগে, কখনওই দেখেনি সে। নাবিক কয়েকবার চিৎকার করে মেয়েটির দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে; কিন্তু নির্বাধ এই জলের জগতে হাওয়ার বেগ প্রচণ্ড, ফলত এক পাটাতনের যথেষ্ট শব্দও পৌঁছয় না অন্য পাটাতনে; কিংবা এমনটাও হতে পারে যে, শব্দ—দূরাগত মনে হলেও—তার দ্রুতি হারিয়ে শ্রুতিতে আঘাত করে ঠিকই, কিন্তু মেয়েটি ঘুরে তাকায় না শব্দের উৎসে। যদিও এই দ্বিতীয় সম্ভাবনাটি মাথায় আসে না নাবিকের। বজরার বাইরেটায়, পাটাতনে, এই হাওয়ায় দাঁড়িয়ে-থাকাটা একটা অসম লড়াইয়ের মতোই মনে হয় তার আর এমনটা মনে হতেই তখনকার মতো তার চিন্তাস্রোত সরে যায় মেয়েটির উপর থেকে, সে চলে আসে ঘরে, শোবার ব্যবস্থা করেছিল যেখানে, সেখানে পড়ে-থাকা খাতাটা তুলে নেয়, পৃষ্ঠার কোণে আটকে-রাখা ইউজ অ্যান্ড থ্রো পেনটা—ডজন খানেক সঙ্গে নিয়ে ভেসেছে সে—খুলে নেয় সেখান থেকে এবং লিখতে শুরু করে তারপর। নোঙর ফেলা থাকলেও ঝড়ের কারণে দুলুনি থামেনি তখনও। হাতের লেখা কেঁপে আঁকাবাঁকা হয়ে যায়, তবু সে ওরই মধ্যে লিখে চলে :

পচা দুর্গন্ধ ভেসে আসে চারপাশ থেকে : মড়া পচার গন্ধ অনেকটা। দেখা মেলে না কোনও মানুষের; মানুষ নেই কোথাও। যাকেই ধরা পড়ে চোখে, চতুষ্পদ শুধু—পশুর দল। গাছগাছালির ঘনবসতে ওই ঈশান কোণে বনভোজন। উনুনে আগুন। রন্ধনশালা। খাওয়া শেষে ঢেকুর। সে-শব্দও এক-একজনের এক-একরকম। উপভাষা। গোলটেবিল। বৈঠক। আলোচনা। মত। বিরুদ্ধ মত। তর্কাতর্কি। প্রস্তাব। পালটা প্রস্তাব। কর্মসূচি গ্রহণ। সাতদফা—

১| দ্বিপদী ও খেচর মাত্রেই শত্রু।

২| মিত্র শুধুমাত্র চতুষ্পদ।

৩| সব পশুই সমান।

৪| পশুরা পরস্পরকে হত্যা থেকে বিরত থাকবে।

৫| পশুরা নেশা করবে না।

৬| পশুরা ঘুমোবে না।

৭| পশুরা পোশাক পরবে না।

সিদ্ধান্ত, অতএব, সর্বসম্মতিক্রমে। উপস্থিত সকলের—রাজি থেকে নিমরাজি—স্বাক্ষর। সেইসব পাঁচ কিংবা সাত দফা ভাবনার বাইরে, নজর এড়িয়ে থেকে যায়, সরীসৃপ।

প্রথমে আসে কচ্ছপ, বুকে ঠেলে। চলে-ফিরে বেড়ায়। নিজের মতো। বিরক্ত করে না কাউকেই। বাকিদের তেমন নজরও, ফলত পড়ে না তার উপর। কচ্ছপ দেখে শুধু৷ খোলসের ভিতর থেকে। ঘাপটি মেরে। সব; সব। ঘটে চলেছে যা-কিছু। একমনে। মতামতহীন। দীর্ঘায়ু সে। তাই দেখে চলে। নির্বিকার। অবিরাম। এইসব ও সেইসব দেখা—ভরে রাখে শক্ত খোলে। নির্মম কঠিন সেই খোলের উপর ফুটে ওঠে, খোদাই হয়ে চলে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি : এই মুহূর্তে সদ্য গৃহীত এই সাতদফা কর্মসূচি, টীকা-ব্যাখ্যাহীন, কুঁদে উঠেছে তার পিঠে। ঋতু থেকে ঋতু, আবর্তনের প্রতিটি বাঁকে সে হাজির থাকে; কেউ ডাকে না তাকে, তবু বিনা নিমন্ত্রণেই এসে পড়ে সে এবং যথারীতি কাউকে ন্যূনতম বিরক্ত না-করে, একটা কোণে বসে চুপচাপ, ধরে রাখে ইতিউতি ঘটে-যাওয়া ছোটো-বড়ো টুকরো ঘটনাগুলো। কচ্ছপ জানে, যদি কারও কখনও প্রয়োজন পড়ে, এই চন্দ্র-সূর্যের একে-অপরকে ধরতে চাওয়ার খেলায়, তার প্রতিটি আলোড়নই তখন সে জেনে নিতে পারবে তার পিঠের নিষ্ঠুর ও অকরুণ খোলস থেকে। যেহেতু কচ্ছপ, যুগপৎ চতুষ্পদ এবং সরীসৃপ, ফলে সে কোনওদিকেই কল্কে পায় না : চতুষ্পদী কিংবা সরীসৃপ—দু'দিকেই সে ব্রাত্য; আর তাই তার এই ঘটনাগুলোকে অনুপুঙ্খ ধরে-রাখায় কোনও ঊর্ধ্বতনের প্রভাব কিংবা রক্তচক্ষু—কোনওটাই প্রভাব ফেলে না। একইসঙ্গে যেহেতু কচ্ছপ কোনও ঘটনার সঙ্গেই সরাসরি জড়িয়ে নেই, তাই একটা আপাত দূরত্ব থেকে বিচার করে এইসব ঘটনাবলি সে ধরে রাখে ভবিষ্যতের জন্য, যতটা সম্ভব নির্মোহ দৃষ্টিতে।

জঙ্গলের অভিজ্ঞতা পশুদের অন্তরে আলো আনে। একবার তারা জিরাফকে তাদের প্রধান ঠাওরেছিল; আর প্রধানের স্বীকৃতি পাওয়ার পর-পরই জিরাফের ঘাড় চড়চড় করে বেড়ে যেতে থাকে এবং প্রায় আকাশকেই ছুঁয়ে ফেলে যেন। তখন, প্রাথমিকভাবে, মনে হয়েছিল যে, অত উঁচু থেকে দেখার কারণে প্রধানের দৃষ্টিতে বেশ-একটা নিরপেক্ষতা থাকবে—এই ভেবে আর-সব পশুরা নিশ্চিন্তে দিন কাটাতে থাকে৷ কিন্তু একটা সময় পর দেখা যায়, মাথা আকাশচুম্বী হওয়ার ফলে জিরাফের সঙ্গে উপরতলার—পাখিদের, বিশেষত শিকারী পাখিদের—একটা যোগসাজশ গড়ে উঠেছে। ওদের এই আঁতাত প্রথম-প্রথম বুঝতে পারেনি বাকিরা। যখন একের-পর-এক তাদের সদ্যোজাত সন্তানেরা উধাও হয়ে যেতে থাকে, তখন তারা ঠিক করেছিল পালা করে পাহারা দেবে। তখনই গোলমাল সামনে আসে৷ তারপর যেমন হয় : সবাই মিলে একজোট হয়ে প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দেয় জিরাফকে। যদিও কচ্ছপ জানে, জিরাফের সেই অপসারণ মোটেও সহজে হয়নি। কেন-না, প্রধান হওয়ার পর পশুদের এই সামাজিক ব্যবস্থাকে অনেকটাই নিজের মতো গড়ে-পিটে নিয়েছিল জিরাফ—সকলেই নেয় যেমন।

এরপর বিভিন্ন পশু বিভিন্ন সময়ে প্রধান হয়েছে। যদিও দেখা গেছে, প্রধান হয়ে-বসার পর থেকেই, একটা নির্দিষ্ট সময়—কারও ক্ষেত্রে কিছু কম, কারও কিছু-বা বেশি—পর, প্রত্যেকের মধ্যেই বদল আসে এবং সে জঙ্গলকে ভুলতে থাকে যার পরিণাম হিসাবে কখনও কাঠঠোকরা তার বড়ো আর কড়া ঠোঁট দিয়ে রক্তাক্ত করে দেয় কাঠবিড়ালিকে, কখনও বাঘ কিংবা সিংহের খাবার, তাদেরই অজান্তে, খুবলে খেয়ে যায় হায়নার দল—খুঁটে খাওয়াই ওদের জীবন, এই জঙ্গলে ওরা কখনওই প্রধান হয়নি। আপাতত তাই পশুদের কোনও প্রধান নেই। পশুরা, প্রত্যেকেই এখন—সে ওদের মধ্যে কেউ চাক বা না-চাক—সকলে একসঙ্গে মিলেমিশে থাকে। যে-কোনও সিদ্ধান্তের আগে সবাই একজোট হয়, আলোচনা চলে, তারপর সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। পশুরা জানে, সব স্বাভাবিক ছন্দে আছে; কচ্ছপ বোঝে, দূর থেকে যাকে নিস্তরঙ্গ ঠেকে, তার ভিতরে জমা হয়ে থাকে ক্ষোভ, অসন্তোষ, লোভ, অপ্রাপ্তি, বিরোধিতা, আন্দোলন।

এসবই কচ্ছপ দেখেছে, এসবই তার জানা; এইসব ওঠাপড়া ভরা আছে তার কঠিন খোলসে। সে শুধু দেখে চলে। নির্বাক। বরাবরের পক্ষ না-নেওয়া দর্শক মাত্র; আপাত নিরপেক্ষ, সুবিধার পক্ষে অতএব।

হাওয়ার ঝাপটা এসে লাগে নাবিকের মুখে। সঙ্গে এলোপাথাড়ি বৃষ্টি। খাতা থেকে মুখ তুলে সে দেখে, কাচের গোল জানলাগুলোর একটা খুলে গেছে কোনওভাবে, সেই ফাঁক গলে ভিতরে ঢুকে আসছে হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টির দাপট। লেখার মধ্যে ডুবে-থাকার কারণে উত্তাল সমুদ্রের দুলুনি এতক্ষণ বুঝতে পারেনি, এখন তড়িঘড়ি বিছানা ছেড়ে জানলা বন্ধ করতে গিয়ে টলে যায় সামান্য; আর তখনই জানলার বাইরে, মাত্র এক ঝলক, তার মনে হয়, মেয়েটি যেন উঁকি দিয়েই হারিয়ে গেল আবার। যেই-না ওই পলকের জন্য মেয়েটির আবছা অবয়ব—কানের উপর দিয়ে নুয়ে-পড়া ভেজা চুল, সেই জলকণা ধরে-রাখা ঘাড় আর গলার মাঝখান—দেখল সে, কামনা আর ভয়, যুগপৎ, ফিরে এল তার মনে। শরীরে উত্তেজনা এসেও শুধু ভয়ের কারণেই অন্তর্বাসের ভিতর পুরুষাঙ্গখানা নিরুত্তাপ, নিস্তেজ, নেতিয়ে রইল। খাতা বন্ধ করে দ্রুত পায়ে নয়, ভয় জমতে-থাকার ফলে ধীরে, সে বেরিয়ে এল ঘর ছেড়ে—ডেকের উপর।

পলাতকের মধ্যে ভয় এমনভাবে ছড়াতে শুরু করল, তার একবার মনে হল, রানি নিজেই হয়তো তাকে অনুসরণ করছেন; কেন-না, একবার যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, সে আবারও তা করতে পারে : রাজা-রানিরা মানুষকে বিশ্বাস করেন না, ওঁরা আসলে মানুষকে ভয় পান—সেই মানুষ একাই থাক কিংবা দলেই থাক। ক্ষমতা এবং ক্ষমতাহীনতার প্রাক্-ইতিহাস ওঁদের বুঝিয়েছে : ক্ষমতার বাইরে-থাকা মানুষ, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে, দুর্বল থাকে না আর; কিন্তু ক্ষমতার কাছাকাছি যারা থাকে, অর্থাৎ মাঝামাঝি অবস্থানে, তারা ঘৃণ্য কুকুরের মতো : যে খেতে দেবে, সে তার। এইসব মানুষগুলো ঘৃণ্য, এদের কোনওভাবেই বিশ্বাস করা চলে না। সময়বিশেষে এরা অনায়াসে এবং সীমাহীন নির্লজ্জতায় নিজেদের প্রভু বদলে ফেলে। ক্ষমতা আসলে এইসব প্যাঁচ-পয়জার বুঝিয়ে দেয় রাজা-রানিকে যেমন, এইসব মানুষগুলোকেও তেমন। আজ নতুন করে ক্ষমতা বদলের সামান্য ইশারায় প্রাণ হাতে করে পালাতে-থাকা এই পলাতকের আশঙ্কা ফলত নিছক অমূলক নয়। ডেকের উপর এসে সে এদিক-ওদিক মেয়েটিকে খোঁজে। মেয়েটির মুখ, তার পরিচয় না-জানা পর্যন্ত পলাতকের ভয় কাটবে না। মেয়েটির পরিচয় জানার পর হয়তো ভয় কাটবে, হয়তো আরও বেশি করে চেপে বসবে, এই মুহূর্তে তার কিছুই বলা যায় না; এমন-কি, পলাতকও যে তা বুঝছে না, তা নয়; তবু মানুষের মনে কৌতূহল অদম্য, তাকে জানতেই হবে এই রহস্যময়ীর পরিচয়, দেখতেই হবে তার মুখ।

পায়ে-পায়ে সে চলে আসে ডেকের অন্য পাশটায়, যদি-বা নারীটি এই দিকটায় থাকে—আশায়। নীল-কালো মেঘগুলো ক্রমশ কালো হয়ে আসছে, ওই ঝঞ্ঝার মাঝেই মরে আসছে দিনের আলো, সন্ধে নামছে। এই অবস্থায় বেশিক্ষণ ডেকে থাকা ঠিক নয়। ডেকের এদিকটায় এসে মেয়েটিকে কোথাও দেখতে পায় না সে, এই অবস্থায় খোঁজাটাও বাতুলতা, আকাশে চাঁদের দেখা নেই, একটা কি দুটো তারাও নিদেনপক্ষে চোখে পড়ে না, অন্ধকার নামছে বজরার উপর, সঙ্গে অঝোর বৃষ্টি—দ্বিরুক্তি না-করে ঘরে ফিরে গেল নাবিক।

বিছানার উপর বন্ধ খাতা, মুখবন্ধ পেন, দূরে এককোণে পথের রসদ—অবিন্যস্ত, তার জীবনের মতোই অনেকটা—পড়ে আছে। নাবিকের মনে পড়ে বদলের কথা। পাড়ায়-পাড়ায় প্রথমে স্তব্ধতা সেদিন, বেলা বাড়তেই পটকাবাজির উল্লাস; আবির উড়ছে জ্যৈষ্ঠের হাওয়ায় আর সে তখনও, কী করা উচিত—এই নিয়ে দ্বিধায়। অভিযোজনের কারণে, নিজেকে আলাদা করে শনাক্তকরণের জন্য সে, অতএব, খুব বেশি অপেক্ষা করে না, গিয়ে ভেড়ে রানির শিবিরে। প্রথম-প্রথম শিবিরে আগে থেকে-থাকা সৈন্যরা আড়চোখে জরিপ করত তাকে। সে বুঝত, ওরা তাকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না। এই চুনোপুঁটিরাই যখন অবিশ্বাস করছে, তখন খোদ রানি যে তাকে বিশ্বাস করবেন না—বুঝতে পেরে ভিতরে-ভিতরে তৎপর হয়ে উঠেছিল পলাতক। ফলত সে সময়ে-সময়ে তার ভাঁড়ার থেকে উপুড় করছিল সঞ্চয়—যেখানে যতটুকু দরকার। তার সেই তথ্যের উপর ভিত্তি করে আরও ফুলে-ফেঁপে উঠছিলেন রানি, তার এতদিনকার সাথীরা মাথা নিচু করে ঢুকে পড়ছিল রানির শিবিরে, অন্যথায় তাদের পুরে দেওয়া হচ্ছিল কালকুঠুরিতে—জেলের অন্ধকারে। ধনে-মানে বেড়ে উঠছিল সেও : শুকনো রুটির বদলে জুটে যাচ্ছিল রসালো পিঠে।

'তোমার বন্ধুরা আজ জেলে পচছে, আর তুমি কিনা পিঠে খাচ্ছ?'

'রানিমা তো প্রত্যেককেই সম্মান দিয়েছেন, দিচ্ছেন। ওদের যদি সুখে থাকার চেয়ে ভূতের কিল খাওয়ার ইচ্ছা হয় তো আমার দোষ?'

'কিন্তু এ-কথা কি তুমি অস্বীকার করতে পারো যে, তোমার কারণেই আজ তারা জেলের ঘানি টানছে?'

'আমার কারণে নয়, আমার কারণে নয়। আমি বরং বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম। ওরা বুঝতে চাইল না। এতে আমি কী করতে পারি? শেষের দিকে ওরা যা করেছে, তাতে জনগণের এই আক্রোশ স্বাভাবিক।'

'তোমার কথামতো যদি ধরেও নিই যে, শেষের দিকে তোমার বন্ধুরা লাগামছাড়া হয়ে পড়েছিল, তাহলেও তুমি নিজের দায় এড়াতে পারো না। তুমিও সেই একই দোষে দোষী। তুমিও তো সেদিন ওদের সঙ্গে ছিলে। আর দয়া করে কোনও বিশেষ একজনের নির্দেশ বা চোখরাঙানিকে জনগণের নামে চাপিও না।'

'রাজসাক্ষী বোঝো? রাজসাক্ষী? আমি রাজসাক্ষী হয়েছি। ওদের আমি বোঝাতে চেয়েছি, ওরা বোঝেনি। গোঁয়ার কোথাকার! এখন ফল তো ভুগতেই হবে।'

'বাহ্, পিঠ বাঁচানোকে তবে আজকাল রাজসাক্ষী বলে! তা ছাড়ো ওসব, এটুকু অন্তত বলো যে, তোমার বন্ধুরা যারা জেলে এখন, তাদের পরিবার দু' বেলা ঠিকমতো খেতে পারছে না আর তুমি কী সুন্দর পিঠে খাচ্ছ—তোমার গলা দিয়ে নামছে?'

'শোনো, কেউ খেতে পারছে না বলে আমি খাব না—বিষয়টা এমন নয়। বরং সবাই যাতে একদিন এই পিঠে, শুধু পিঠে কেন, তার চেয়েও ভালো কোনও খাবার খেতে পারে—তার জন্যই আমাদের লড়াই। রানিমা আমাদের অভয় দিয়েছেন, জয় আমাদের হবেই।'

পলাতকের মনে পড়ে গিয়েছিল পরিবর্তনের সেই প্রথম দিককার ঘটনার কয়েকটা, যার একটা ছিল পিঠে খেয়ে বেসিনে মুখ ধোয়ার সময়ের : কুলকুচি করে এমন-কি মুখের ভিতর আঙুল চালিয়ে সাফসুতরো হয়ে মুখ তুলতেই সামনের আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখেছিল সে। নিজের সেই প্রতিবিম্বের ঠোঁটে ব্যঙ্গ দেখেছিল সে, যদিও পাত্তা দেয়নি সেদিন। আপনি বাঁচলে বাপের নাম। নিজেই যদি বেঁচে না-থাকলাম, তবে বিপ্লব কী আর লোকের উপকারই বা কী—মনে-মনে নিজেকে আশ্বস্ত করেছিল সে আর সরিয়ে এনেছিল আয়নার সামনে থেকে।

মন থেকে পুরোনো স্মৃতি ঝেড়ে ফেলে বিছানায় এসে বসে নাবিক। বন্ধ খাতাটা খোলে। ডান হাতে পেন। চিন্তাসূত্র ছিঁড়ে গিয়েছিল বৃষ্টি আর হাওয়ার তোড়ে। লেখার শেষটুকু পড়ে। শেষ অনুচ্ছেদটুকু পড়লে পর ফিরে আসে ভাবনারা :

শুরুর সেই দিনে ডাইনোসর ছিল, স্তন্যপায়ী পশুরা—মাংসাশী কিংবা শাকাহারী—তখন থাকত মাটির নিচে, গর্ত করে, লুকিয়ে। জলে ছিল ইয়াব্বড়ো কুমির সব৷ ডাইনোসরদের ভয় পেত পশুরা, তাই লুকিয়ে থাকত। কুমিরদের ভয় পেত ডাইনোসররা, তাই জল খাওয়ার সময় ঝগড়া ভুলে এক হয়ে থাকত সব। তারপর একদিন নীল আকাশ লাল হয়ে দেখা দিল। আকাশ থেকে বিশাল একখানা আগুনের গোলক এসে আছড়ে পড়ল হ্রদে। ডাইনোসররা, যারা কাছাকাছি ছিল, মরবার আগে তারা গরম জলের বৃষ্টিতে ভিজল অনাবিল। তারপর মরে গেল সব৷ জলে সেই যে আগুন লাগল, তাতে ঝলসে গেল ওই বড়ো-বড়ো কুমিরের পাল। আগুন নিভল না তখনই। সব জল বাষ্প হয়ে গেলে পর আবহাওয়া গরম হয়ে উঠল। কচ্ছপ তখন খোলসের মধ্যে মাথা ভরে নিয়ে নির্জীবের মতো পড়ে রইল একপাশে। গরম বাড়তে লাগল ক্রমে।

আবহাওয়া যখন আবার ধীরে-ধীরে ঠান্ডা হতে শুরু করল, খোলসের ভিতর থেকে মুখ বের করে কচ্ছপ দেখেছিল, আকাশ ছাইরঙা, ধূসর; আর তাকে দৃশ্যপট বানিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে বড়ো-বড়ো সব পাখির দল। বিশাল তাদের ডানা আর বিরাট তাদের ঠোঁট। তখনও সবটা শীতল হয়নি, সেই শীত এবং আতপের মধ্যেই এল প্রলয়ঙ্কর এক ঘূর্ণিঝড়। সেই ঝড় লণ্ডভণ্ড করে দিল পাখিদের ভ্রমণপথ। কচ্ছপের চোখের সামনে ঝটিতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল তারা। ঝড় থেমে গেলে পর সে দেখল, মাটির নিচের গর্ত থেকে বেরিয়ে আসছে আজকের পশুর দল।

তারপর তো তাদের মধ্যে থেকে পালা করে একজন করে প্রধান হতে শুরু করল। বাকি পশুরা মিলে একজোট হয়ে কোনও-একজনকে বেছে নিত। তারপর তার কথামতো চলত জঙ্গলের নিজস্ব নিয়ম। কিছু সময় পর দেখা যেতে লাগল, জঙ্গলের স্বাভাবিক নিয়ম পিছনে চলে গেছে, বদলে এসে জুটেছে প্রধানের নিজের বানানো নিয়মাবলি। যেমন, বাঘ। যেমন, সিংহ। যেমন, জিরাফ। কচ্ছপ শুধু দেখে, সবাই মিলে প্রধানকে বেছে নেয় আর একটা সময় পর তার নীরব অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সেই বাকি সবাই মিলেই সরিয়ে দেয় তাকে। এই করতে-করতে এখন তাদের কোনও প্রধান নেই। তারা এখন শুধু জঙ্গলের নিয়ম মানে। সেই নিয়ম, যা তাদের সভ্যতার আদিতে ছিল।

খাতা-পেন বন্ধ করে বাইরে এল নাবিক। বৃষ্টিটা এখন আর তেমন হচ্ছে না। কখন যে ধরে এল, ঘরের মধ্যে থেকে বুঝতেও পারেনি সে। তবে বৃষ্টি থামলেও আকাশে তারার দেখা নেই। হাওয়ার তোড় আগের মতো প্রবল না-হলেও, এখনও বেশ জোর। মাঝে-মাঝে আকাশের গায়ে বিদ্যুৎচমক। নোঙর তুলে সে ডেকের উলটো দিকটায় চলে আসে, যেখানে আকাশ-ভাঙা বৃষ্টির মধ্যে শেষবার নারীটিকে দেখেছিল।

বজরার অন্য দিকে এসে মেয়েটিকে কোথাও দেখতে পায় না নাবিক। সে এদিক-ওদিক তন্নতন্ন করে খোঁজে; মেয়েটির পরিচয় জানতে সে ব্যাকুল—এ-কথা ঠিক; সঙ্গে এটাও একটা কারণ যে, এই সামুদ্রিক জীবনে সে সততই একা, সামান্য কথালাপটুকু না-হলেও মেয়েটির উপস্থিতি তাকে বোঝায়, বলে যে, এই লবণাক্ত জীবনে সে একা নয়, নিঃসঙ্গ নয়—এই অনুভবটুকুও তাকে দিয়ে খুঁজিয়ে নিতে চায় ওই মেয়েটিকে।

বজরার দু'টি তলা ছানবিন করে নাবিকের খিদে পায়। মেয়েটিকে পায় না। সে আবারও এসে ঘরে ঢোকে। নিভে-আসা প্রদীপের সলতেখানা উসকে দেয়। আলো ছড়িয়ে যায় ঘরে। সে খাতা টেনে নিয়ে লিখতে বসে আবার :

পশুরা সাতদফা কর্মসূচি ঘোষণা এবং বলবৎ করার পর দিব্যি চলে যাচ্ছিল তাদের জীবন। তারা দ্বিপদী এবং খেচর প্রজাতিদের নিজেদের শত্রু বলে ঠাহর করেছিল। ফলত শত্রুর প্রতি যেমত ব্যবহার স্বাভাবিক, সেমত ব্যবস্থাই তারা করে রেখেছিল নিজেদের মধ্যে, গোপনে; কারণ রণকৌশল যত অপ্রকাশ্য থাকে, ততই ভালো। যদিও পশুরা কর্মসূচি তৈরির সময় বিস্মৃত হয়েছিল সরীসৃপদের অস্তিত্ব সম্পর্কে। একদিন কচ্ছপ দেখল, বুকে ভর দিয়ে হেঁটে আসছে একটি সাপ—বিষধর। তবু কচ্ছপ সাবধান করল না কাউকে : তার কাজ শুধু দেখে-চলা, সে শুধু দেখে যায়। কচ্ছপ এরপর যেমন-যেমন ভেবেছিল, ঠিক তেমন-তেমনই ঘটল। সাপের ছোবলে একে-একে সব পশু মারা গেল অচিরেই। কিন্তু কচ্ছপ যা ভাবেনি একবারের জন্যও, এরপর তাই হতে দেখল সে : নিধনকার্য সমাধা করে নিজের খোলস ছাড়ল সাপটি এবং মাথা তুলে দাঁড়াল একটি মানুষ, জলজ্যান্ত—বিষধর, বিষাক্ত।

এই অবধি লিখে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। ঘুম ভাঙতেই আবারও খিদে পায় তার। প্রদীপের আলো মরে এসেছে। সে আবারও জ্বালিয়ে দেয় আগুন। সেই আপাত অনুজ্জ্বল মায়াবী আলোয় সে দেখে, তার জন্য খাবার সাজিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই নারী; মুখ ভিজে চুলে ঢাকা, ভেজা শাড়ি সাদা রঙের, আঁকড়ে ধরেছে শরীর। আলতো হাওয়ায় প্রদীপের শিখা কাঁপে, সামনে দাঁড়ানো সেই শরীরী নারীমূর্তিও যেন কেঁপে-কেঁপে ওঠে। তার পরিচয় জানতে চেয়ে প্রশ্ন করতে যায় নাবিক, দেখে, মুখবিবর তার শুকিয়ে খটখটে, কথা সরছে না ফলত। কোনওমতে, প্রায় জোর করেই সে প্রশ্ন করে। তার প্রশ্নের পিঠেই খিলখিল করে হেসে ওঠে সেই নারীমূর্তি। গোটা ঘর জুড়ে খেলা করে তার অনুরণন। প্রদীপটা হাতে নিতে গিয়ে নাবিক দেখে, তার হাত কাঁপছে; ভয়ে না উত্তেজনায়—বুঝতে পারে না, শুধু প্রদীপটাকে সামনে তুলে ধরে। সেই ম্লান আলোয় দেখা যায় অম্লান এক নারী, সাদা শাড়ি জুড়ে চাপ-চাপ রক্তের দাগ, খাবারের থালা হাতে দাঁড়িয়ে। নাবিক এবার এগিয়ে আসে তার সামনে, কাঁপা-কাঁপা হাতে মুখের উপর থেকে সরিয়ে দেয় ভেজা চুলের গোছা, তারপর প্রদীপটাকে তুলে ধরে তার মুখের কাছে। মেয়েটি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পলাতকের দিকে। সেই চোখে চোখ রেখে পলাতক মুহূর্তে গিয়ে পড়ে তার অতীতে : পরিবর্তনের পর যখন সে ভিড়েছিল রানির শিবিরে, রানির লোকেরা যখন পর্যন্ত তাকে মনে করতে পারেনি তাদেরই একজন বলে, তখন পুরোনো সঙ্গীদের বিরুদ্ধে সে যা-যা করেছিল সেইদিন, তারই একটির কথা মনে পড়ে যায় তার।

মিছিল থেকে ছিটকে বেরিয়েছিল জনা পাঁচ-ছয়ের একটা দল। তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সে। সদ্য যুবতী মেয়ের সামনে বাবাকে হত্যা করেছিল ওরা, শুধুমাত্র বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে। তারপর সেই মেয়ের মুখ চেপে তুলে নিয়ে গিয়েছিল প্রাইমারি স্কুলের লাগোয়া মাঠে। সেই মাঠেরই এককোণে উড়ে পড়েছিল মেয়েলি পোশাক—শালওয়ার-কামিজ এবং ওদের সঙ্গে সেও প্রবেশ করেছিল মেয়েটির অভ্যন্তরে। কাজ শেষ করে মেয়েটিকে খালাস করতে ইটের পাঁজা থেকে ইট তুলে, একাদিক্রমে, পলাতক বসিয়ে দিয়েছিল তার মাথায়। রক্তাক্ত কপাল ঠুকে গিয়েছিল সবে তৈরি হচ্ছিল যে-শহিদবেদি, তাতে। রক্ত গড়িয়ে নামছিল বেদি থেকে। দেখে মনে হয়েছিল, নতুন বউ, উজ্জ্বল এক সীমন্তিনী, গড় করছে তুলসীতলায়।

পরের দিন সকালে সামান্য কোনও চিহ্নও ছিল না গতরাতের রক্তপাতের। শুধু নাবিক দেখেছিল, রক্ত শুকিয়ে-যাওয়া শহিদবেদি হয়ে উঠেছে ঠাকুরের থান।

ঝড় থেমে গিয়েছিল একটা সময়। বজরা এরপর ভাসতে-ভাসতে এসে আটকেছিল সন্দ্বীপের চরে। চরের মানুষজন—মৎস্যজীবীরা—কৌতূহলে উঠে পড়েছিল বজরায়। সেখানে বাসি এবং পচা খাবার পেলেও, জীবিত কিংবা মৃত, কোনও মানুষেরই দেখা পায়নি ওরা। তাছাড়া পাওয়ার মধ্যে পেয়েছিল কিছু পেন—ইউজ অ্যান্ড থ্রো—আর একটি খাতা যার প্রথম পৃষ্ঠাটি আগে থেকেই ছিঁড়ে রেখেছিল কেউ, যাতে একদিন লেখা হয়েছিল : ইতিহাসের সমাপ্তি এবং সেই শেষ মানুষটির দাস্তান।






লেখক পরিচিতি:
অনির্বাণ বসু 
গল্পকার।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

4 মন্তব্যসমূহ

  1. যা কিছু বলার ছিলো বলা হয়ে গেছে সব । অতএব এবার যা বলতে হবে তার জন্য চাই বলার অভিনব রীতি । এই সংকট থেকেই জন্ম নিচ্ছে নতুন নতুন গল্প । পাঠকের সমস্যা:তিনি হয়তো এই নবাগত ধারাকে বুঝতে চাইবেন পুরোনো পাঠাভ্যাসের নিরিখেই । সমকালীনতার থেকে এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও সময়ই বলে দেবে আখ্যায়নের এমন ধারার সময়োত্তীর্ণ হওয়ার শক্তি ছিলো কতটা । চিন্তা ও প্রয়োগের প্রাতিষ্ঠানিকতাকে প্রত্যাহ্বান জানানোর কাজ প্রচলিত সাহিত্য যে করবে না, তা স্বাভাবিক । কিন্তু আশঙ্কাও থাকে যেহেতু সাহিত্যও স্বভাবধর্মে আধিপত্যপ্রবণ । যা কিছু স্বচ্ছ ও স্বতস্ফূর্ত, তাকেই তরল বলে মনে হওয়ায়, যদি উন্নাসিকতার পিঞ্জর তৈরি হয়ে যায় কোথাও কোথাও,তাহলে পরেও লিখতে আসবেন যাঁরা, তাঁদের ক্ষেত্রে এমন হতেও পারে যে দেখা গেল, প্রেক্ষিতের যথার্থ স্বীকরণ না-হওয়ার জন্য সত্তা লিখন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েও কার্যতঃ রয়ে গেল বিযুক্ত ।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. ধন্যবাদ,অভিরূপ-দা। তবে স্বচ্ছ ও স্বতঃস্ফূর্ত মাত্রেই তরল নয়; যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে সম্ভাবনা তেমনই দেখা যায়।

      মুছুন
  2. অসহমত হতে পারার মতো উদাহরণের বড়ই অভাব । তবে একটা কথা । মনে হয় এ-ধরণের গল্পগুলো নিয়ে সহঃলেখক ও বিশ্লেষক-পাঠকরা যদি পাঠ-নিবিড় আলোচনা করেন লিঙ্কের মধ্যেই তাহলে ধীরে ধীরে বদল আসতে পারে সামগ্রিক পাঠক-রুচিতেও । একটা কাঙ্ক্ষিত পাঠক-সমাজ গড়ে তোলার জন্য এটা বোধহয় কৌম দায় হিসেবে বিবেচ্য হওয়া উচিত ।

    উত্তরমুছুন