ময়ূরী মিত্র'র গল্প : FOOLবাস

১ . 

মা - নৌকোয় খুকু-মাঝি । নৌকায় দুলতাম । জল বাজাত বাজনা --ছলাৎ ছলাৎ । বর্ষাজলে ভরা আমাদের বেলগাছিয়া বাড়ির সেই গলিপথ । আমায় কোলে নিয়ে সে জল পারাপার করছেন মা --পাছে স্কুলের জুতো মোজা ভিজে যায় ! 

নদী দেখা তখনো হয়নি আমার । দেখা হয়নি একটি পূর্ণ ও অহর্নিশি বয়ে যাওয়া জলরাশি । আর তাতে নানা জলযানের নানারকমে চলাচল । তাই বর্ষার জল নামলেই ভাড়াবাড়ির ঐ গলিটাই হয়ে যেত আমার নদী ।

হয়ে যেত চোখের পাতা ফেলতে না ফেলতেই । ধরুন , বেলাবেলি আকাশ মন করেছে জল ঝরাবে । আর আমি চোখ বুঝে ঘাপটি মেরে আছি কখন আমার চলাহাঁটার রাস্তাটি হয়ে উঠবে নদী। 

আমি বলতাম গলিনদী । আমার বয়সী খুকুরা রাস্তায় জল জমলে কাগজের খেলনা ভাসাত । আর আমি মায়ের কোলে চড়ে জলরাস্তা পার হতে হতে মাকেই ভাবতাম নৌকা । সেসময় মায়ের কোলে চড়ার স্টাইলটাই বদলে যেত আমার । দু পা ছড়িয়ে দিতাম মায়ের 'মাংস মাংস ' পেটের দুপাশে । আর ' লালরঙা আলুরদম ' পিঠে সমানে চাটিয়ে যেতাম । ফটাস ফটাস । দুহাতের তেলো দিয়ে । আমার হাত বৈঠা আর আমার দাঁড় টানা । যদি পড়ে যাই ---- পিঠে লাগা সত্ত্বেও মা হজম করতেন আমার প্রচণ্ড প্রহার , আমার মনপছন্দের দাঁড় টানা । গলি যত শেষ হত, শুকনো পথ যত কাছে আসতো, মায়ের পিঠে দাঁড়ের পিটুনি বাড়ত । বেড়ে চরমে উঠত । বোধহয় নদী ফুরিয়ে আসার রাগে । 

একদিন । একদিনের কথা বেশ মনে আছে আমার । খুব বরিষণ । গলিনদীটি লম্বা হয়ে হয়ে বড়ো রাস্তা ছাড়িয়েছে । সেদিন কোলে নিয়ে আর আমায় টানতে পারছিলেন না মা । পিটি পরীক্ষা বলে কোল থেকে নামতেও পারছিলাম না । নামলেই জুতো মোজা ভিজে যাবে যে । আমাকে বওয়া থেকে নিস্তার আর জুটছিল না মার । ফোলা শরীর গুচ্ছের ঘাম ছড়াচ্ছিলো । ঘামের fine গন্ধ । 

কিন্তু আমার মা'টার আজ যে বড়ো হাঁফ ধরছে । বড্ড ব্যাথা জাগছিল । কোলে বসেই হাত বাড়িয়ে গলিপথের ধারে দেয়াল ফেটে বাড়তে থাকা গাছের পাতা , ডাল ,কখনো বা একটুকরো বেগুনি ফুল গুঁজে দিতে লাগলাম মায়ের মাথায় । বর্ষার জল পেয়ে ভাড়াবাড়ির দেয়ালের খাঁজে ভাঁজে কত না পাতা লতা ডাগর হয়ে উঠেছিল । সাজাতে সাজাতে মায়ের কালো চুল ঢেকে যাচ্ছিল সবুজে । আর সেই অগুনতি সবুজে কী বাহারই না খুলেছিল মার ফিকে কালো কোঁকড়া চুলে । সেদিন মায়ের পিঠে দাঁড় টানা বন্ধ রেখেছিল খুকু মাঝি । মাঝি সেদিন কেবল সাজিয়ে চলেছিল তার নৌকাটিকে । খুকুমাঝি আর তার মা-নৌকা ! ওরে এ যে আমার মননৌকো। সবুজে চুলবুল ! নধরকান্তি !

২ 

স্কুলে আসছিলাম । পথে দেখি এক বৃদ্ধ দম্পতি বাজার সেরে ফিরছেন । তেমন সঙ্গতি নেই । থলের সজনে , সবজি সব একটু বেশি বেশি শুকনো মনে হলো । খেয়াল করলাম, বৃদ্ধের একপাশ পঙ্গু । বাড়ি অব্দি পুরো রাস্তা একসাথে হাঁটার ক্ষমতা নেই । তাই বুড়িবউটাকে নিয়ে থপ করে বসে পড়লেন বাজারের ধারের এক বেঞ্চিতে । বুড়ি কিন্তু খুব সমর্থ । একদম সুঠাম গুণ্ডা । সমানে বকে চললো বুড়োকে ।

----" এটুকু রাস্তা যেতে পারো না ? আস কেন তাহলে রোজ আমার সাথে ? "

হাসিখুশি বুড়োবরের জবাব----" না এলে দুটো ব্যাগ বইতে তোমার কষ্ট হবে যে ! " 

আরে নিঠুর বুড়ি ! ততক্ষণে টেনেমেনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে বুড়োকে । বরের সুস্থ হাতটায় একটা থলে ধরিয়ে দিয়ে কঠোর নির্দেশ ---" এগোও ! আমি আসছি ।" 

নাগেরবাজারে একের পর এক বাস ছুটে আসা রাস্তার মধ্যে টলমল করে এগোচ্ছে বুড়ো । কী করি ? বুড়োর হাতখানা বেশ করে বগলে ভরলাম । তারপর দয়াহীন বুড়িটাকে রাম ঝাঁঝিয়ে বললাম ----" একটা রিকশায় তুলে দিতে পারেন না অসুস্থ মানুষটাকে ?" খ্যারখেরে গলায় --- " পয়সা নেই । " 

বুড়োকে নিয়ে রাস্তা পার হলাম।। ওমা ! পাশের ডবকা যুবতীকে ফেলে ওপারে বউয়ের দিকে তাকিয়ে মিঠে হাসছেন বর । হাত তুলে আমায়ও দেখতে বললেন বউকে । আহা ! কী এক মস্ত দেখার জিনিষ ! দেখি , কটকটে রোদ্দুরে মাটিতে গুছিয়ে বসে হাঁকডাক করে ফল কিনছেন বউ বুড়ি ! কানের কাছে ফিসফিসিয়ে এপারের বর বললে --' আমার জন্য কিনছে । রিকশায় চড়ালে আমার ফল হবে কী করে ? আমার অপুষ্টি বুড়ি মোটে সইতে পারে না যে ! " 

শুঁটকো ফলে ভর্তি রোদ্দুর । চুমু খাওয়াটা বাড়াবাড়ি হবে ভেবে বুড়োর গালদুটো ভালো করে টিপে দিলাম । আর ওপাশের প্রণয়িনীর জন্য একটি deep flying kiss । আমার যুগল কিসমিস । সজনে গাছে দোল দোল জোড়া হলুদে ফুল । 

মৌটুসীর চোখে অক্ষর ।


৩ 

আমি যে স্কুলে পড়াই সেই স্কুলে রোজ একটি মেয়ে পড়তে আসে । রোজ রোজই আসে সে । নীলরঙা স্কুল পোশাকটি নিখুঁত ভাঁজে গায়ে দিয়ে , ছোট করে কাটা কুচো চুলে থাকে থাকে ক্লিপ সাজিয়ে সে আসে । হাতে দোলে হলুদ স্কুলঝুলি । স্কুলব্যাগের এমনই নাম দিয়েছে সে বখতিয়ার মেয়ে । বকবক করে বলে আমিই তার নাম দিয়েছি বখতিয়ার । ছোট করে -- ' বখা ' । অপুষ্ট দুপায়ে বিশেষ ধরনের গামবুটের দুমদুম আওয়াজ তুলে স্কুলের গেটের কাছে যখন সে দাঁড়ায় ---- বুঝে যাই আজো এলো । 

পড়ায় ভীষণ নেশা । ঠাট্টা করে বলি---" উফ বাবা রে বাবা! তোর যে দেখি বইযের বড় টান । বই কি তোর কোকাকোলার বোতল ? --- যে কোনো বয়সের যে কারোর বই দেখলেই খামচে ধরিস ! সব বই কি বুঝিস তুই ? নে না তোর ক খ ছবির বই ! বাকিগুলো ছাড় ! " দিদিমনির গাল শুনে মুখে রাগে ক্রমাগত নাল ঝরতে থাকে বখার । আশ্চর্য control এ নাল মুখের ভেতরে টেনে নেয় সড়াত করে । আর তারপর চিললে মিললে একসা করে । আরো জোরে জোরে উডপেন্সিল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খাতায় গোল্লা আঁকে । তাতে রঙ ভরে । লালের পাশে গোলাপি । তারপরেই কমলা । রংগুলো যে কাছাকাছি , এ রংগুলোর মাঝে যে জমে না কোনো Contrast এটুকুও বোঝার সাধ্য কই ? 

পড়তে পড়তে তার বয়স গড়ায় । আমার বত্রিশ বছরের ছাত্রী কখন যেন আমার প্রিয় বান্ধবী হয়ে যায়। ভরদুপুরে রোগা পা ছড়িয়ে বকবক জমায় আমাদের বখতিয়ার । মন ভালো থাকলে তার প্রিয় কালো গজার হাফ দেয় আমায় । ঠিক যেন পুকুরপাড়ে সাতসংসার মাথায় নিয়ে নাইতে নেমেছে পুরোনো হয়ে যাওয়া বধূ । 

কদিন ধরেই দেখছি , বগল অব্দি দুটো হাতমোজা পরে স্কুলে আসছে বখতিয়ার । ওই আজকাল স্কুটার চালানো মেয়েরা পাঞ্জা থেকে কনুই পর্যন্ত যে হাতঢাকাগুলো গলাচ্ছে না --- ঐরকম ! যত বলি , " হ্যাঁ রে বখা এত গরমে কেন পরছিস রে ওগুলো ?" --- ততই দেখি নানাভাবে পাশ কাটাচ্ছে বখতিয়ার । কখনো বলে ," বাবা কিনে দিয়েছে । বাবা যা ভালোবেসে কিনে দেয় জিন্দেগীতে তা গা থেকে নামাই না আমি " । কখনো বলে, " হাতমোজা না পরলে মশায় খায় আমায় " । কেন জানি আমার মনে হচ্ছিল , নিজেকে লুকোচ্ছে বখতিয়ার । আমায় দেখিয়ে শুন্যে হাত তুলে কল্পিত মশা খুঁজছে ! তারপর মুখেই চটাস চটাস শব্দ তুলে সেগুলো মারছে । হাত দিয়ে মশা মারার ক্ষমতাই বা কোথা তার ! 

সেদিন স্কুল ছুটির সময় আকাশে মেঘ জমল । বললাম , " চ , বখতিয়ার আজ তুইও হাতমোজা খোল আর আমিও শাড়ির আঁচল কাঁধ থেকে খসাই । চ না ! দুজনে একটু অসভ্য হয়ে ভিজি । আজ নাহয় পথের মানুষ একটু লোভী হোক । খোলা চোখে দেখুক তোর আমার জলধোয়া শরীর । আমাদের পিছলা পিছলা হাত মুখ চোখ চুল । " 

বখতিয়ার চুপ । একদম গুম । নাল পড়ছে double স্রোতে । বললে, " ধুর আমার হাতগুলো দিন দিন রোগা হয়ে যাচ্ছে গ ! বৃষ্টির ফোঁটা হাতে দাঁড়ায়ই না মোটে । ফোঁটাখানি গড়িয়ে এল কি এল না --- তলিয়েই গেল মাটিতে । দেখো না দেখো ! রোগা হতে হতে হাতগুলো কেমন আরো আরো কালো দেখাচ্ছে ! প্লাস্টিক চুড়িও পরিয়েছে মা । ঢলঢলে হয় । লোক হাসে ! এই হাতে ঝরতে হলে বৃষ্টি মরবে । লজ্জায় মরবে ।" 

বাদলধারার মাঝেই হাত নাড়ে বখতিয়ার । জোলো বাতাসে, রাস্তার জলে তার বুটের স্টেপ তখন আরো গদাম। মায়ের গায়ে শরীর ঢেলে অটোতে চেপে বসে বত্রিশের ছাত্রী। 

সলাজে আঁচল টেনেছে ময়ূরাবতী ! উছল বাদলে আঁচল খোলার সাধ মিটেছে তার। জন্মের শোধ। শোধবোধ রে বখতিয়ার !




লেখক পরিচিতি
ডঃ ময়ূরী মিত্র 
শিশুশিক্ষিকা , প্রাবন্ধিক , নাট্যাভিনেত্রী ও নির্দেশক |
ডঃ পবিত্র সরকারের তত্বাবধানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি মধ্যবিত্তের রাজনৈতিক উত্তরণ ও নাটকে রাজনীতি' বিষয়ে গবেষণা করেছেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3 মন্তব্যসমূহ

  1. অমর চট্টোপাধ্যায়৯ জুন, ২০২০ এ ৪:০০ AM

    এ অনুভূতি-কথন । যার বাজে তার‌ই সাজে । আলাপে রসে টান পরে । অনুভবের চেষ্টা করি

    উত্তরমুছুন
  2. এই সব লেখা তোর কলমের জন্য অপেক্ষা করছিল।

    উত্তরমুছুন
  3. কখন যে মন খারাপ হয়ে ওঠে আর কখন যে আবার ভালো হয়ে যায়...
    দেখা শোনা অনুভবের একটা নতুন জানালা...আপনার লেখায়...কথনে...চলমান চিত্র নির্মাণে।

    উত্তরমুছুন