কয়েকমাস আগে এখানে একবারই এসেছিলাম। তখন আমার স্ত্রী সঙ্গে ছিলো, একমাত্র কন্যা ছিলো। আমার কাঁধে ছিলো ব্যাগ, তাতে একটা লুঙ্গি, একটা জামা, গেঞ্জি ছিলো কিনা মনে নেই, তবে ঠোঙায় কিছু মুড়ি ছিলো । তাড়াতাড়ি পালানোর সময় হাতের কাছেই ব্যাগটা পেয়েছিলাম, হাতের নাগালের মধ্যে ছিলো লুঙ্গি ও জামা, টেবিলের ওপরেই মুড়ির ঠোঙাটা। রুবী সবসময় যে ব্যাগটি ব্যবহার করে সেটি নিতে ভোলে নি, পথ চলতে চলতে একসময় আমাকে ফিসফিস করে বলেছিলো, ওতে ওর গহনাগাটি আছে। এ-রকম যে হতে পারে রুবী আগেই আঁচ করে ব্যাগে সব রেডি করে রেখেছে, আমাকে বলে নি।
ওর বুদ্ধি ও দৃরদৃষ্টি দেখে আমি অবাক হয়ে যাই, মনে পড়ে জিজ্ঞেসও করেছি, টাকা পয়সা কিছু আনো নি? রুবী কোনো জবাব না দিয়ে ব্যাগটা দেখিয়ে বোঝালো পথে ঠেকে গেলে গহনাগুলো তো আছে। আমার ভবিষ্যতের চিন্তা মুহূর্তে মন থেকে মুছে গিয়ে তখন সামনে বিপদের পথ কিভাবে পাড়ি দেবো দুশ্চিন্তা বেশি পেয়ে বসে। সে চিন্তারও জবাব রুবী দেয়, বেলা ডোবার বেশি বাকি নেই, রাতটা না হয় ঝোপে-জঙ্গলেই কাটিয়ে দেয়া যাবে। এ চিন্তাটা আমার মাথায় আসে নি। স্পষ্ট মনে আছে, রুবীর এই সমাধানের জবাবে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে, শরীরের দিকে তাকিয়ে নিচে নামতে নামতে পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম পা খালি, আমার কন্যার পা-ও খালি। আমারও পায়ে কিছু ছিলো না। কী আশ্চর্য দেখুন, আমরা পালাচ্ছি প্রাণের ভয়ে, তখনও আমার মনে পড়ে আলনায় একেবারে নিচের তাকে আমাদের তিনজনের স্যান্ডেল ও জুতো পাশাপাশি সাজানো আছে, এমনও মনে পড়ে সকালেই আমি আমার ও রুবীর স্যান্ডেলে কালো কালি ও কন্যার জুতোয় ব্রাউন কালি লাগিয়েছি। রোদেও দিয়েছিলাম। রোদ লেগে জুতো স্যান্ডেলগুলো চকচক করছিলো। চকচক করার কারণ আছে। কালিটা ছিলো বিলেতি। জুতোর চামড়া দেশি হলেও এত নরম যে কেনার সময়েই দোকানি হেসে বলেছিলো, মরক্কো লেদার মনে করতে পারেন। স্যান্ডেলের চামড়াও ভালো ।
মাসখানেক আগেই আমার কেনা। কিনেই লিলির ছোট বোনের বিয়েতে পায় দিয়ে গিয়েছিলাম । লিলি আমার দীর্ঘদিনের প্রতিবেশিনী। আমাদের দু'জনের কেউই জানিনে কবে একে অপরকে বেশ ঘন ঘন মনে করতে শুরু করেছি। দু'জনের কাছেই ব্যাপারটা প্রকাশ পেলো হঠাৎ আমাদের বাসায় একদিন এসে মার চোখ এড়িয়ে আমার ঘরে এসে বললো, আপনি বেশ শুকিয়ে গেছেন। আমি বললাম, তাই ? লিলি তার জবাব না দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে এমনভাবে তাকিয়ে রইলো যেন অবাধ্য স্বামী শরীরের যত্ন নিচ্ছে না বলে স্ত্রী অভিমান করে আছে। ওই পর্যন্তই এবং ওইরকম সংলাপ ওই একবারই। লিলির যেদিন বিয়ে হয়ে যায় সেদিন গভীরভাবেই মনে হয়েছিলো আমার আরো একটু সিরিয়াস হওয়া উচিত ছিলো।
আমি জানি এই শহরের সবাই প্রাণ-ভয়ে পালাচ্ছে। কারো কোনো ঠিকানা নেই। আমাদেরও নেই। অথচ এইরকম আমার স্ত্রী ও আমি একবার পথে বেরিয়েছিলাম। এখন যে ব্যাগটা কাঁধে, সেবারেও একটা ব্যাগ ছিলো, তবে সেটা ছিলো এটার চেয়ে বড়, তাতে আমার দুটো লুঙ্গি, একটা প্যান্ট-শার্ট, একটা পাজামা-পাঞ্জাবি ছিল, আর ছিলো রুবীর চারটে নাইলনের শাড়ি, ব্লাউজ গোটা পাঁচেক, অতিরিক্ত ব্রা একটা আর পেটিকোটও একটা সব সুতি শাড়ি বাদ দিয়ে নাইলনের শাড়ি কেন নিচ্ছো জিজ্ঞেস করাতে কাপড় ভাঁজ করতে করতেই রুবী জবাব দেয়,কক্সবাজারে আমাদের জন্যে ঝি-চাকর আছে নাকি ? এ-কথাটা আমার মাথায় আসে নি। আমরা যাচ্ছি স্রেফ বেড়াতে, বিয়ের আট মাস পরে হলেও ব্যাপারটা আমাদের কাছে হানিমুন-হানিমুন লাগছিলো। আসলে আমাদের হাত-পা একেবারে ঝাড়া, রুবীর পেটে তখন বাচ্চার কোনো নাম গন্ধই নেই। আমরা এক বছর কোনো বাচ্চাকাচ্চা চাই নি।
এক বছর বাচ্চা নেই! মা তো রীতিমতো অস্থির হয়ে উঠলেন। একদিন ঝপ করে বলেই বসলেন, হ্যারে, বৌকে ডাক্তার দেখাবি না? আমি এই দেখাচ্ছি দেখাবো করতে করতে আরো মাস পাঁচেক কাটিয়ে দেবার পর একদিন বললাম, মা, রুবীর শরীরটা মনে হয় খারাপ । মা মিটমিট করে হাসতে হাসতে কল-পাড়ে রুবীর ওয়াক-ওয়াক দেখলেন। কোনো-কোনো অসুস্থতা যে মানুষকে খুশি করে আমি সেই প্রথম দেখলাম। সেই থেকে রুবীর যত্নআত্তি বেড়ে গেলো, মা ওকে কোনো ভারি কাজ করতে দেন না, আমি মাঝে-মাঝেই ওর পেটে হাত বুলিয়ে দিই, কান চেপে ধরি। রুবী হাসে। একবার পেটে কান বেশী জোরে চেপে ধরেছিলাম বলে আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলেছিল বাচ্চা মেরে ফেলবে নাকি? আমি তখন উত্তেজনায় হাপাচ্ছি, হাঁপাতে হাঁপাতে বলি, তুমি বলো বাচ্চা নড়ে, কই, আমি তো বুঝি না! হেসে ফেলে রুবী পাশ ফিরতে ফিরতে বললো, ও তুমি বুঝবে না। জবাব শুনে আমার বেশ কষ্ট হয়।
এসব মেয়েদের ভেতরকার ব্যাপার আমরা পুরুষরা তেমন কিছু না বুঝলেও মনে হয় রুবী এখনই বাচ্চাকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছে। আমি রাগ করে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে শুয়ে রইলাম। একটু পর অবাক হয়ে দেখলাম রুবী আমার দিকে কাত ফিরেই যেন কিছুই হয় নি ভাবে ঘুমাচ্ছে। ও মাঝে-মাঝে অবশ্য আমাকে রাগিয়ে বা ক্ষেপিয়ে কিংবা উত্তেজিত করে তোলার জন্যে এরকম শিশু পন্থা নেয়। আমি প্রথমে ওর মুখের দিকে স্থির তাকিয়ে রইলাম । চোখের পাতা পিটপিট করছে না। নাকের কাছে হাত রাখলাম। গভীর নিঃশ্বাস। তারপরই দেখলাম
ঠোঁটের কোণা দিয়ে লালা গড়িয়ে আসছে। তাহলে গভীর ঘুম । প্রচণ্ড রাগ হয় আমার। ইচ্ছে হয় প্রবল ধাক্কায় তুলে দিয়ে বলি, তুমি ভেবেছো কী ? ধাক্কা দিতে যাবো ঠিক সে সময় মনে পড়ে রুবী বিকালেই বলছিলো, এ যে কী কষ্ট তোমরা বুঝবে না, শরীর ভেঙে আসতে চায়। তখনি আমার রাগ গলে পানি হয়ে যায়।
মা আশা করছিলেন ছেলে হবে । সবাই মনে হয় তাই করে। আমাদের দু'জনের আশা আমাদের সন্তান হবে। প্রথম সন্তান। সেই সন্তানকেই বুকে চেপে অজানা গন্তব্যে পা বাড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের একেক সময় মনে হয় পথের শেষ কোথায়। অথচ সবই আমার চেনা পথঘাট | ছেলেবেলায় স্কুলে কয়েকজন দুষ্টামো করছিলাম বলে অংক স্যার রমেশ বাবু আমাদের প্রথমে নীলডাউন করালেন, তাতে রাগ মিটলো না, হাতে বেত মারলেন, তাও রাগ পড়ে না, ঘাড় ধরে বের করে দিলেন। তিনি ভাবলেন ঘাড় ধরার মতো বড় অপমান আর নেই । কিন্তু আমাদের চার বন্ধুর ফুর্তি দেখে কে! চিত্ত বললো, বেরই যখন করে দিয়েছে তখন চল বেড়িয়ে আসি। কোথায়, কোথায় চিন্তা করতে করতে, চল যাই, মেন্টাল হাসপাতালের কাছে পদ্মা দেখে আসি। পদ্মা তখন শুকনো । তাও তার যা চেহারা, বুকে কাঁপন লাগে।
সেই টগবগে বয়সে ইছামতি, সাধুপাড়া, কুঠিপাড়া , বাজিতপুর পার হয়ে যখন পদ্মার চরে পড়ি আকাশ তখন আগুন ঢালছে, কিন্তু সেই আগুন আমাদের কাছে হার মেনে যায়, পায়ের তলায় গরম বালি পায়ের পাতার কিছুই করতে পারে না। চরে এখানে ওখানে মানুষ-সমান উঁচু ঘাসের বনে শিয়ালের বাসায় শিয়াল দেখে 'পণ্ডিত পশাই, ও কাত্লা' বলে পিছু ধাওয়া করলে শিয়াল সে যে একটা দৌড় দিলো, সে একটা দেখার মতো ব্যাপার বটে । রমেশ বাবুর মুখটা ছিলো বড়, কাতলা মাছের মতো! এখনও সেই গরমকালের পদ্মার চর রুবী ও আমার পায়ের নিচে, কেবল আকাশ থেকে আগুন নামছে না, নিচে থেকে কেবল ভাপ উঠছে। কিন্তু আগুন আছে ও পাড়ায়, সে পাড়ায় । আমাদের পাড়ার রঞ্জু হাপাতে হাপাতে এসে বলে, পালান, শিগগির পালান, মিলিটারী শালগাড়িয়া পর্যন্ত এসে গেছে, বাড়ি ঘর পোড়াতে আসছে, সামনে যাকে পাচ্ছে মারছে। এই খবর শোনার পর কে আর ঘরে থাকে। জীবনের সব সহায় সম্পদ শুধু একটা ঠুনকো তালার জিম্মায় রেখে বেরিয়ে আসতে আসতে দেখি রুবী বারবার পেছন ফিরে তাকায় আর চোখ মোছে। শুধু বললাম, কেঁদো না। আমাদের সৎ পয়সার জিনিস হলে থাকবে । জানি এটা শুধু সান্ত্বনা, আমার বুকের মধ্যেও যে তোলপাড় হচ্ছে তার কিছুটা যদি রুবী টের পায় তাহলে ঠিক পাটখড়ির মতো ভেঙে পড়বে । বুঝতে দিই নি। আমার বারবারই মনে হচ্ছে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। মাথা ঠাণ্ডা রাখতে গিয়েই রুবীর স্যান্ডেল, জুতোর কালি এ-সব অর্থহীন কথাগুলো মনে হয়েছিলো।
যে রুবী কিছু আগেই ঝোপে-জঙ্গলে রাত কাটিয়ে দেবার কথা বলে আমাকে সাহস দেবার চেষ্টা করেছিল, সেই রুবীই মাটিতে বসে পড়ে বলে, আর কত দূর ? আর কত দূর ? কী জবাব আমি দেবো! আমার নিজেরও তো জানা নেই আর কত দূর গেলে ওই আগুন আর গুলি আর মৃত্যু আমাদের নাগাল পাবে না। আমরা যখন এই চরে পা রাখি তখনই গুলির যে আওয়াজ হয় তাতে বুঝতে বাকি থাকে না ওরা শহরের এই পশ্চিম মাথার কাছে এসে পড়েছে। পদ্মার চর শহরের পশ্চিমে। আমরা এখন ধু-ধূ চরে । পশ্চিমের আকাশ লাল টকটকে হয়ে আছে। ছোটবেলায় আব্বা বলেছিলেন হাসান হোসেনের রক্তে বেলা ডোবার আগে পশ্চিমের আকাশ লাল টকটকে হয়ে যায় । থমকে দাঁড়িয়ে পড়ি। রুবী যদি টের পায় আমার মনে আকাশের লাল আমাকে ছেলেবেলায় নিয়ে গিয়েছিলো তাহলে ঠিক বলবে, তুমি কি একটা মানুষ ?
রুবীর হাত ধরে টেনে তুলতে গিয়ে দেখলাম মানুষ শরীরের ভার ছেড়ে দিলে কিরকম ভারি হয়ে যায়। সেজন্যেই মড়া মানুষের ওজন বেশি। মা মারা গেছেন সাড়ে চার পৌনে পাঁচ মাস আগে। মরার আগে শুকোতে শুকোতে এমন অবস্থায় এসে গিয়েছিলেন যে আমি ইচ্ছে করলে বা হাত দিয়েই তুলতে পারি। সেই মানুষটা মরার পর যেন তিন-চারগুণ বেশি ভারি হয়ে গেলেন। আমাদের বাড়ি থেকে গোরস্থান মাইল দেড়েকের মধ্যে। আমি ছেলে, অতএব খাটিয়া বয়ে নিয়ে যাওয়া ও কবরে লাশ নামানোর দায়িত্ব বা অধিকার আমারই বেশি। গোরস্থান পর্যন্ত তিন চারবার কাঁধ বদল ছাড়া আর কাউকে নিতে দিই নি। হঠাৎ মনে হয় এই অবস্থায় যদি রুবী মরে যায় তাহলে এই নির্জন ধূ-ধূ চরে একা কী করবো। একা নয়, দু'জন, আমার ন’মাস বয়সী মেয়ে। নাম রত্না। রত্না নামটা হঠাৎ রাখা। মা কোলে করে আদর করতে করতে “ওরে আমার মানিক, ওরে আমার রতন' বলছিলেন। রতনটা ধরে ফেলে রুবী। রুবী তখন বাচ্চার গায়ে গরম তেল দেবার জন্যে সর্ষের তেল রোদে দিচ্ছিলো। তেলের খোরা হাতেই রুবী উঠে আসে। বলে, মেয়ের নাম রত্না রাখলে কেমন হয়? বললাম, রত্না, ভালোই তো! আমি আসলে বেশ কিছুদিন থেকে একটা কাব্যিক নামের জন্যে সমানে সঞ্চয়িতা ঘাটছিলাম। আমার জবাবে তেমন জোরালো সমর্থন না পেয়ে রুবী নামটা যে অর্থপূর্ণ সেটা বোঝানোর জন্যে জোর দিয়েই বলে, আমার রুবী ও তোমার রকিবের “র' দিয়ে রত্না। বেশ মিল না ? আবিষ্কারটা অভিনব না হলেও মায়ের কাছে আনন্দটাই বড় বলে আর আপত্তি করি নি।
পশ্চিম আকাশের লাল তখন ধূসর হয়ে আসছে। একটু পরই সারা আকাশ ছেয়ে অন্ধকার নেমে আসবে। ফাঁকা জায়গায় অন্ধকার ক্রমেই হাত পা ছড়াতে-ছড়াতে আকাশ ও মাটি গ্রাস করে ফেলে। ওই অবস্থায়ই মানুষ নিশির খপ্পরে পড়ে। আমাদের পাড়ার ছেলে রমজান যমুনার চরে বালিতে মুখ থুবড়ে মরে ছিলো। কোনোভাবেই প্রমাণিত হয় নি ওটা খুন। পাড়ার মসজিদের ইমাম সাহেব বললেন, শয়তানের ফেরেব। রমজানের কথা মনে হতেই আমার গায়ের রক্ত হিম হয়ে যায়। পেছনে লোকালয় ছাড়া তিন দিকে বালি, মরা কাশ আর যেখানে পলির সর পড়েছে সেখানে তাজা ঘাস ছাড়া আর কিছু নেই। মনে হয় ফিরে যাই। রুবীর কাছে ইচ্ছাটা প্রকাশ করি। না, না করতে করতে ছিঁটকে দাঁড়িয়ে রত্নাকে বুকে এমনভাবে চেপে ধরে উদ্দেশ্যহীন দৌড় লাগায় যে মনে হয়, আমাদের নয়, শুধু রত্নাকে কেড়ে নেবার জন্যই পেছনে লোক দাঁড়িয়ে আছে। আমি হতভম্ব হয়ে যাই। ঠিক তখনই শুনি শহরের পশ্চিম সীমানায় গুলির আওয়াজ। একটা গুলি লাল হয়ে ফিকে অন্ধকার ছিঁড়েফুঁড়ে উর্ধ্বাকাশে উঠে গেল। আমি তখন রুরীর পেছনে যাওয়া বাদ দিয়ে
মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ি। তখন বৌ-বাচ্চা অর্থহীন না মহামূল্যবান কিছুই মনে হয় না।
যখন উঠি রত্না তখন কাঁদছে। ওর কান্নার শব্দই আমাকে জাগিয়ে দেয়। সহসা বুঝতে পারি ও কান্নাটা চিৎকারের কাছাকাছি চলে যাচ্ছে। তখনই গলা ছেড়ে ডাকি, রুবী রত্না, তোমরা কোথায় ? নিজের গলার স্বরে নিজেই চমকে উঠি, এ স্বর কার ? আমি যে বাতাস ফালাফালা করে চিৎকার করতে পারি তা কোনোদিন জানতাম না। অসহযোগ আন্দোলনের সময় মিছিলের স্বাভাবিক গলায় খেই ধরানো শ্লোগানের জবাবে বাংলাদেশ-বাংলাদেশ, বাংলাদেশ স্বাধীন করো, শেখ মুজিব-শেখ মুজিব শুনে ঠিক পেছনে সহকর্মী আজমত সাহেব বললেন, গলা তোলেন, গলা তোলেন। আমার
চিৎকার শুনতে পায় রুবী। চেঁচিয়ে জবাব দেয়, এখানে । এখানে কোথায় দেখতে গিয়ে চোখে পড়ে অদূরে মরা কাশের আড়ালে একটা ছায়া হাত নেড়ে ডাকছে। অন্য সময় হলে সন্ধ্যার অশরীরী অমন করে ডাকে বলে কিছুতেই যেতাম না। আসছি বলে ছুটে যেতেই দেখলাম মাথার কিছু ওপর দিয়ে একটা আগুনের গোলা ছুটে গেলো। আমার তক্ষুণি মনে হয় ফাঁকা জায়গার কথা বাতাসের আগে ধায়। আস্তে বললেই অনেক দূরের লোক শুনতে পায়। মাথা নিচু করে ছুটতে ছুটতে মরা কাশের আডাঁলে গিয়ে দেখলাম রুী প্রাণপণে রত্নার কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। মরিয়া হয়ে বলি, রুবী, কান্না থামাও। বুঝতে পারছি হিস হিস করে বলতে গিয়েও গলা চিরে আওয়াজ বেরিয়ে আসছে। রুবী তখন এক হাতে আমার মুখে থাবা মেরে চাপা গলায় বলে, চেঁচিও না। আমি কী করে বোঝাই যে আমি চেঁচিয়ে আমাদের অবস্থানের কথা ওদের জানতে চাই না । চেঁচানোর সূত্র ধরে ওরা ধরে ফেললে আমাদের কী অবস্থা হবে বোধ হতেই প্রথমে আমি, পরে রুবী রত্নার মুখে হাত চাপা দিয়ে ফেললাম । মনে হলো আমাদের দু'জনের থাবা রত্নার গোটা মুখটা ঢেকে রাখলেও দু'জনের হাতের মাংস হাড় ও শিরা-উপশিরা ভেদ করে শব্দ বেরিয়ে আসছে। এ শব্দ বের হতে দেয়া না, না। ভয় হয় বাতাস ধরে ধরে শব্দ ওদের কানে পৌঁছুলে ওই শব্দই ধরে ধরে ওরা এখানে চলে আসবে। সন্দেহ যায় না। রত্না আর চিৎকার করছে কিনা শোনার মতো সময় আমাদের নেই । আমরা দু'জনেই রত্নাকে আমাদের শরীরের মাঝে রেখে গায়ে
যত জোর আছে খাটিয়ে একে-অপরকে আলিঙ্গন করে দাঁড়িয়ে থাকি। আমাদের দু'জনের শরীর ভেদ করে কান্না বাইরে যেতে পারে না।
অনেকক্ষণ পর মনে হয় রত্নার কান্না থেমে গেছে। ঘুমিয়েও গেছে হয়তো । আপনারা যা ভাবছেন, তাই। রত্না মরে গেছে। অথচ আমরা কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমার ছোট মামা মারা গেলে নানী স্বাভাবিকভাবে আজাহার ঘুমিয়েছে বলে উঠে গেলেন। শুধু উঠে গেলেও হতো । গিয়ে সর্ষে মাখানো কাটোয়ার ডাঁটা দিয়ে পেট ভরে ভাত খেয়ে আজাহারের ঘুম ভাঙলো কিনা দেখতে এসে টের পান, ছেলে ঠাণ্ডা। রত্নার ঘুম মনে করে রুবীকে বললাম, ওকে শুইয়ে দাও। রুবী বালিতেই আঁচল পেতে রত্নাকে শুইয়ে দিয়ে ক্লান্ত গলায় বললো, ও না থামলে কী হতো? রত্না থেমেছে ও আমাদের কিছুই হয় নি পুরোপুরি বোঝবার পরপরই আমার খুব খিদে পায়। বললাম, মুড়ি আছে না ? রুবী আস্তে হু জবাব দেয়। আমি ব্যাগ হাতড়ে ঠোঙায় যে পরিমাণ মুড়ি পাই তাতে দু'জনের বড় জোর ছ'গাল হতে পারে। সবটুকু
আমারই লাগবে মনে করে এক গাল মুখে পুরে চিবুতে গিয়ে বুঝতে পারি প্রতিটি চিবোনোর সঙ্গে আমার ক্ষিদে মরে যাচ্ছে। চিবোনো মুড়ি গেলা হয় নি। থুক থুক করে ফেলে দিতে গেলে রুবী বললো, খেলে না ? ওই অবস্থায়ই জবাব দিলাম ইচ্ছে নেই। রুবী হাঁ না কিছুই বলল না। মুড়ির দানা ও কণাগুলো গালে থাকতে থাকতেই তেষ্টা পেলো। কিন্তু প্রশ্ন দাঁড়ালো, পানি কোথায়! আরো মাইল দেড়েক পশ্চিমে গেলে আমাদের ভাসিয়ে নেবার জন্যে পদ্মা আছে, শহরে ফিরে গেলে কলসি ভরা পানি আছে, কিন্তু দু'দিকের কোনোদিকেই যাওয়ার সাধ্য নাই। হাত-পা ছেড়ে রুবীর পাশেই বসে পড়ি। রুবীও ডান বাহু বালিশ বানিয়ে “দ' হয়ে শুয়ে পড়ে । আকাশের লাখলাখ তারার আলোকমালায় স্ত্রী ও কন্যা পাহারা দিতে দিতে আমার বারবারই মনে হয়, এই নতুন জীবনের শেষ কোথায় ?
হঠাৎ চমকে উঠি, কী ? কী ও দুটো? মাটি থেকে হাত দেড়েক ওপরে জ্বলজ্বল চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে ? বিকৃত গলায় ডাক দিই, রুবী। গলার আওয়াজ পেয়ে চোখ দুটো মুখ ঘুরিয়ে পালিয়ে যেতে থাকলে মনে হয়, হয় খাটাস
হঠাৎ চমকে উঠি, কী ? কী ও দুটো? মাটি থেকে হাত দেড়েক ওপরে জ্বলজ্বল চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে ? বিকৃত গলায় ডাক দিই, রুবী। গলার আওয়াজ পেয়ে চোখ দুটো মুখ ঘুরিয়ে পালিয়ে যেতে থাকলে মনে হয়, হয় খাটাস
না হয় বাগডাসা। আমরা মরে ধরে লাশ হয়ে আছি ভেবে মানুষের মাংসে আজ রাতের খাবার সেরে ফেলার জন্যে এসেছিলো । তখনো আমি জানি না রত্নার মৃতদেহের গন্ধ ওদের নাকে ঠিকই পৌঁছেছে। ওরা ঠিকই বুঝতে পারে। আমি বসেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম । নইলে আকাশ ছাপিয়ে চাঁদ উঠলো কখন? তারার আলোয় যে ম্লান পৃথিবী দেখেছিলাম তা আর এখন নেই। এখন আমার সঙ্গে চাঁদ রয়েছে। চাঁদের আলো রুবীর মুখে পড়েছে। রত্না আছে কাত হয়ে । ওর চোয়ালে
পড়েছে। রুবী ফর্সা। ওর পেটের কাছে কাপড় নেই। সেখানে চাঁদের আলো মিশে গেছে। কিছুক্ষণ তাকিয়েও থাকি। থাকতে থাকতেই পেশাব অনুভব করি। ওখানে বসেই সেরে ফেলা যায়। কিন্তু বৌ বাচ্চা পেশাব একসঙ্গে নিয়ে থাকা মনে হতেই গা ঘিন ঘিন করে ওঠে । অথচ বাড়িতে রত্না আমাদের ঘুমের মধ্যে পেশাবে জবজবে কাঁথাতেই ঘৃমায়। গন্ধে মাঝে-মধ্যে ঘুমও ভেঙে যায়। আমি অনেকদিন রুবীকে না জাগিয়ে রত্নার কাঁথা পাল্টে দিয়েছি। গন্ধ লাগে নি। উঠে পনেরো বিশ হাত দূরে বসতে যাবো, ঠিক সেই সময় রুবী চিৎকার করে ওঠে, তুমি, তুমি কোথায়? আধবসা অবস্থায়ই জবাব দিই, এখানে । রুবী আরো জোরে চিৎকার করে ওঠে, রত্না, রত্না নেই!
ওই দশ-পনেরো বিশ হাত পথ ছুটে আসতে আসতে প্রথমেই মনে পড়ে খানিক আগে যে খাটাশ না বাগডাসা দেখেছি সে ঠিক রত্নাকে টেনে নিয়ে গেছে। কিন্তু কাছে এসে দেখলাম, রুবী রত্নাকে একবার উপুড়, একবার চিৎ, একবার এ-কাত, একবার ও-কাত, একবার দু'পা উপরে তুলে মাথা নিচু করে ঝাঁকায়, একবার বুকের সঙ্গে কান চেপে ধরে হৃদপিণ্ড পর্যন্ত স্পর্শ করতে চায়, একবার মুখের সঙ্গে মুখ ঘষে, না, তাও রত্না কোনো সাড়া দেয় না দেখে আমার কোলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলে, দ্যাখো , দ্যাখো, রত্না ঠাণ্ডা ।
সহসা দিগন্ত ভেঙে বাতাস বইতে শুরু করে। বাতাসের সঙ্গে বালি উড়তে শুরু করে। আমাদের দু'জনের চিৎকার বালিতে আর বাতাসে মিশে যেতে শুরু করে। ওই অবস্থায় আমি কী করতে পারতাম । ছুটে শহরে ডাক্তারের খোঁজে যাবো, সে উপায় নেই । উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিমে যাওয়া অর্থহীন, আমাদের শূন্যে দুহাত বাড়িয়ে বাতাস আর বালি আঁকড়ে ধরা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। আর আমরা সারা রাত তাই করলাম । কখন বাতাস ও বালি থেমে যায় জানিনে, কখন চাঁদের আলো ফিকে হয়ে আসে জানিনে, পুব আকাশ ফর্সা হয় বলতে পারবো না। শুধু হাতে বালি সারিয়ে রত্নার শোবার মতো জায়গা বানিয়ে শুইয়ে রাখলাম এটা বলতে পারি। শোয়ানোর সময় দেখলাম বালিতে বালিতে ভুরু সাদা চুল সাদা সারা শরীর সাদা, কিন্তু বাতাসে চুল উড়ছে। চুল যতক্ষণ পর্যন্ত পৃথিবী দেখেছে ততক্ষণ পর্যন্ত উড়েছে। ঝুঁটি বাঁধার মতো চুল ওর হয়েছিলো । রুবী মাঝে মাঝে ফিতে বেঁধে গিটটা ফুল বানিয়ে দিতো।
আমাদের বাড়ি ফিরে আসার বিবরণ আপনাদের দেবো না। যখন ফিরে আসি তখন লোকালয়ে অনেক লোক এসে গেছে। যারা চেনে তারা বললো, রত্না কোথায়? আমি বললাম, পদ্মায় ।
দ্বিতীয়বার যখন এখানে আসি তখন আমি একেবারে মুক্ত। রুবী মারা গেছে। রত্না রত্না করে করে রুবী মাঝে মাঝে এতো মাথা কুটতো যে আমি নিরুপায় হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতাম । আমাদেরই দোষে রত্না মারা গেল একথা ভুলতে না পারলেও আমাকে স্বাভাবিক থাকতে হয়। অফিস যেতে হয়। বাজারে যেতে হয়, পায়খানা-পেশাব করতে যেতে হয়, কখনো স্ত্রী সঙ্গমও করতে হয় । আশা করেছিলাম আরেকটি রত্না এলে হয়তো স্বাভাবিক হবে । নিজেই ঠিক করেছিলাম মেয়ে হলে নাম রাখবো রত্না, ছেলে হলে রতন। পেটে বাচ্চাও আসে। কিন্তু ওই যে মাথা কোটা, বাচ্চা নষ্ট হয়ে গেলো । রত্নার সময় পেটে কান চেপে ধরলে রুবী আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেবার পর ভেবেছিলাম ও আমাকে বাচ্চা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছে, আর এখন স্রেফ একদলা রক্তপিণ্ড উপহার দেয়া দেখে মনে হয়, ও আমাকে
কোনোদিনই সন্তান কোলে নিতে দেবে না। ওকে কিছুতেই বোঝাতে পারিনে রত্নার মৃত্যুতে দু'জনেরই ভূমিকা ছিলো। ওটা এমন একটা সময় যখন সুস্থভাবে, মাথা ঠাণ্ডা করে চিন্তা করার অবকাশ ছিলো না। কিন্তু কে শোনে?
রুবী মারা গেল মাঝরাতে। আর আমি সবার অলক্ষ্যে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখলাম আকাশ ধুয়ে চাঁদ আলো দিচ্ছে। আপনাদের মনে হতে পারে আমি পাড়ার লোক জড়ো করে শাবল কোদাল নিয়ে কবর খুঁড়তে যাওয়ার ব্যবস্থা করছি। না। আমি সোজা হাঁটা দিলাম পদ্মার দিকে । আজ ক'দিন থেকেই বোঝা যাচ্ছে রুবী আমাকে ছেড়ে যাবে। আর সত্যিই যখন গেল তখন প্রথমেই মাথায় আসে, রত্না যেখানে পদ্মা বুকে নিয়ে শুয়ে আছে সেখানে গিয়ে কথাটা বলে আসা দরকার। রত্নার ছোট্ট ঘরবাড়ির দরোজা খুলে বলে আসা দরকার, তোর মা আসছে।
1 মন্তব্যসমূহ
একটি রত্না ও পদ্মানদী। শেষ দিকে এসে এরকমই চাওয়া ছিলো।
উত্তরমুছুন