ক্যাথরিন ম্যান্সফিল্ডে'র গল্প: হানিমুন


অনুবাদ : যশোধরা রায়চৌধুরী

লেসের দোকান থেকে যখন ওরা বেরিয়ে এল, ওদেরই কোচোয়ান ওদের সেই গাড়িটা নিয়ে পাম গাছের তলায় দাঁড়িয়েছিল। মানে যে ভাড়াগাড়িটাকে ওরা নিজস্ব গাড়ি বলে ডাকা শুরু করেছিল আর কি! কী কপাল! কপাল না? ফ্যানি তার স্বামীর হাতটা চেপে ধরল। এই সব অলৌকিক ব্যাপার শুরু হয়েছে সেই কবে থেকে - যবে ওরা বিদেশে এল। আচ্ছা, ও-র ও কি এইরকম আশ্চর্য লাগছে সব?

কিন্তু জর্জ ত ফুটপাতের কিনারাতে দাঁড়িয়ে নিজের লাঠিটা তুলে " হেই" বলে একটা খেঁকুরে হাঁক দিল। ফ্যানির মাঝে মাঝে জর্জের ক্যাব ডাকার ভঙ্গি দেখে কেমন যেন অস্বস্তি হয়। কিন্তু কোচোয়ানরা কিছু মনে করে না ত! তার মানে জর্জ ঠিকই করে। মোটাসোটা, সদাশয়, হাসিখুশি কোচোয়ানরা নিজেদের হাতের খবরের কাগজটা গুটিয়ে রাখে, ঘোড়ার ওপর থেকে সুতির আচ্ছাদনটা বেতের খোঁচায় টেনে সরিয়ে নেয়, তারপর ওদের সামনে এসে দাঁড়ায় বাধ্যটির মত।

"বলছি যে, ধরো যদি ঐ গলদা চিংড়ির জায়গাটায় গিয়ে আজ চা খাই? ইচ্ছে করছে তোমার? " জর্জ ফ্যানিকে বলল। গাড়িতে ওঠার সময় জর্জ ওকে ধরে ওঠাচ্ছিল।

"আরে, দারুণ!!!" ফ্যানি যেন আনন্দে অধীর হয়ে গেল। তারপর আরাম করে এলিয়ে বসে ভাবতে লাগল, জর্জ যেকোন ব্যাপারকে এমনভাবে পেশ করতে পারে, যাতে সবটাই চমৎকার হয়ে ওঠে। কীভাবে করে এটা!

বে-বেশ। বিয়াঁ! জর্জ তার পাশে বসে। আলে!! চলো ভাইয়া! সোৎসাহে চেঁচিয়ে ওঠে জর্জ। গাড়ি রওনা হয়ে যায়।



চলল ওরা, কোচোয়ানের ছিপটির হালকা দুলুনিতে, পাম গাছের সারির সবুজ সোনালি ছায়ার ভেতর দিয়ে। ছোট ছোট রাস্তার ভেতর দিয়ে। বাতাসে ভাসছে লেবু আর তাজা কফির গন্ধ। ফোয়ারা দেওয়া চক পেরিয়ে গেল। মহিলারা গাছে জল দেবার ঝারি হাতে তুলে ওদের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে দেখছিল, নিজেদের গল্পগাছা থামিয়ে । একটা কোণ ঘুরে ওরা এগলো, সেই কাফের পাশটা দিয়ে, যেখানে গোলাপি আর সাদা ছাতা মেলে দেওয়া আছে, সবুজ টেবিল আর নীল সাইফন, আর তারপর সোজা দেখা যায় সামনে সমুদ্রটা।

একটা হাওয়া , হালকা আর উষ্ণ, সীমাহীন সমুদ্রের ওপর দিয়ে বয়ে এল। জর্জকে ছুঁল, ফ্যানির চারিপাশে সে হাওয়াটা অনেক ক্ষণ যেন থেকে গেল, ওরা তখন ঝিকিমিকি ওঠা জলটার দিকে চেয়ে আছে। "দুর্দান্ত, না? " জর্জ বলল। আর ফ্যানি কেমন স্বপ্নের ভেতর থেকে বলল, যেভাবে সে এই বিদেশ আসার পর থেকে প্রতিদিন অন্তত বার বিশেক বলে আসছে - "কী অসাধারণ লাগছে ভাবতে, না, যে এখানে শুধু আমি আর তুমি আছি, আর কেউ নেই! কেউ আমাদের বাড়ি যেতে বলবে না, কেউ আমাদের তাড়া দেবে না, কারুর কথা শুনতে হবে না?"

জর্জ এসব কথার কোন উত্তর দেয়না। "দারুণ!" এটূকু বলে জানাই কথা ও এবার ফ্যানিকে চুমু খাবে। কিন্তু আজ ও কেন যেন ফ্যানির হাতটাকে হঠাৎ খপ করে ধরে নিজের পকেটের ভেতর পুরে নিল। আঙুলগুলোতে চাপ দিতে দিতে বলল, "আমি ছোটবেলায় একটা সাদা ইঁদুর পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম!"

"তাই বুঝি?" ফ্যানি সাগ্রহে বলল। জর্জ জীবনে যা কিছু করেছে, সবেতেই ফ্যানি তুমুল উৎসাহী। "তোমার খুব ভাল লাগত বুঝি সাদা ইঁদুর?"

"ওই আর কি!" জর্জ দায়সারাভাবে বলল। ও অন্যকিছু দেখছে তখন, স্নানের জন্য তৈরি করা ধাপগুলোর ওপাশে কী যেন নড়ছে চড়ছে। হঠাৎ ও নিজের আসন থেকে প্রায় লাফিয়ে উঠল যেন। "ফ্যানি!" চীৎকার করে উঠল ও। "ওখানে একটা লোক, স্নান করছে। দেখতে পাচ্ছ? জানতাম না ত স্নান করা শুরু হয়ে গেছে! আমার এখানে এসে থেকেই খুব ইচ্ছে করছে ত জলে নামতে। "

জর্জ লোকটার লালচে মুখ, লালচে হাতদুটো হাঁ করে দেখছিল। যেন ও ওদিক থেকে দৃষ্টি ফেরাতে পারছে না। "কাল সকালে আমি নাইতে নামবই। আমাকে কেউ আটকে রাখতে পারবে না। "

ফ্যানির বুকটা ফাঁকা হয়ে গেল কেমন। বহুবছর ধরে সে শুনে আসছে ভূমধ্যসাগরের জল ভীষণ বিপজ্জনক। যেন এক ভয়াবহ মরণ ফাঁদ। সুন্দরী, ছলনাময়ী ভূমধ্যসাগর! এখানে সে যেন গুটিয়ে শুয়ে আছে, সাদা রেশমি থাবা দিয়ে তটভূমিকে এই ছুঁয়ে দিচ্ছে ত পরক্ষণে দূরে । ... কিন্তু, ও ত বিয়ের বহু বহু দিন আগেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে ও স্বামীর কোন সুখের পথে অন্তরায় হবে না, সেইরকম স্ত্রী সে নয়। তাই ও হালকা ভাবে শুধু বলল, সাঁতারে খুব ভাল হতে হয়, কারেন্টগুলোকে সামলাতে, তাইনা?

ওহ, তা জানিনা, লোকে ত যা পারে হাবিজাবি বলে, বিপদের কথাটথা। জর্জ বলল।

এবার ওরা যেখান দিয়ে যাচ্ছে, ডাঙার দিকে সেখানে একটা উঁচু পাঁচিল, ফুলে ভরা হেলিওট্রোপলতায় ঢাকা । ফ্যানি ছোট্ট নাক তুলে সে শ্বাস নিল। "ওহ জর্জ, কী চমৎকার গন্ধ। স্বর্গীয়!"

""টপিং ভিলা"। দেখ, পাম গাছের ফাঁক দিয়ে দেখাও যাচ্ছে। "

ফ্যানি বলল ,"বড্ড বড় না?" ও, কেন যেন, কোন ভিলা দেখলেই, নিজেরা সেখানে থাকলে কেমন হবে এইটা না ভেবে পারে না।

"ওখানে যদি থাকতে যাও, এক গাদা লোক লস্কর সঙ্গে থাকতে হবে। নইলে ভীষণ মরা মরা লাগবে। বাড়িটা কেমন যেন ভেঙে পড়ছে না? কার বাড়ি কে জানে? "

কোচোয়ানের পিঠে টোকা দিল জর্জ।

অলস, হাসিখুশি কোচোয়ানটি, বিন্দুমাত্র ধারণা ছাড়াই, যেমন সবসময় বলে, বলে দিল ধনী এক স্পেনীয় পরিবারের সম্পত্তি ওটা।

এই সমুদ্রের ধারে প্রচুর স্পেনের লোক থাকে। জর্জ বলল। আবার এলিয়ে বসল। তারপর তারা দুজনেই চুপ। যতক্ষণ না মোড় ঘুরে, একটা বিশাল, হাড়ের মত সাদা রঙ করা হোটেল-কাম-রেস্তোরাঁর দেখা পাওয়া গেল।

সামনে দিকে সমুদ্রের মুখোমুখি একটা ছোট খোলাছাতের মত বানানো আছে, ছাতা -পাম বসানো,টেবিল সাজানো। আর ওরা যখন সেদিকে এগুলো, ছাতের থেকে , হোটেলের ভেতর থেকে , ওয়েটাররা দৌড়ে এল ওদের অভ্যর্থনা করতে, ফ্যানি আর জর্জ অন্য কোথাও চলে যাওয়ার যাতে কোন সম্ভাবনাই না থাকে সেজন্য পাকড়াও করে নিয়ে যেতে নিজেদের রেস্তোরাঁয়।

"বাইরে বসবেন ত?"

আরে হ্যাঁ অবশ্যই বাইরে বসবে ওরা। ঝাঁ চকচকে ম্যানেজারটি, যাকে ফ্রক কোট পরা চমৎকার একটা মাছের মত দেখাচ্ছিল, যেন হাওয়া সাঁতরে সামনে এল।

"এডিকে আসুন মসিঁয়-স্যার ! আমাদের খুব সুন্দর একটা ছোট্ট টেবিল আছে।" যেন খাবি খেতে খেতে বলল সে। "ঐ কোনের ডিকে ঠিক আপনাদের মটো শোট্টো একটা টেবিল , মসিঁয়-স্যার ! এডিকে..."

জর্জের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সে ভীষণ বিরক্ত হচ্ছে। ফ্যানিও চেষ্টা করছে ভাব করতে, যেন কিছুই হয়নি, যেন বছরের পর বছর তারা অপরিচিত লোকেদের ভেতরে দিয়ে হেঁটে বেড়াতে এভাবেই অভ্যস্ত। জর্জের পেছন পেছন সে গেল।

এখানে মসিঁয়-স্যার । এখানে আপনারা খুব ঠিকঠাক ভাবে বসতে পারবেন। ম্যানেজার যেন ছেলেভোলানোর মত করে বলল। টেবিল থেকে ফুলদানিটা তুলে আবার ফুলদানিটা বসাল। যেন বাতাস থেকে যাদুকর একটা নতুন ফুলের তোড়া আমদানি করেছে। জর্জ তখুনি বসতে চাইল না। সে চারিদিকে তাকালো, এই লোকগুলোকে সে বুঝে গেছে। অত সহজে সে এদের মত মেনে চলবে না বাপু। এই লোকগুলো সর্বদা চেষ্টা করে চটপট যাহোক কোথাও একটা বসিয়ে দেবার। তাই সে নিজের পকেটে হাতদুটো ঢোকালো, ফ্যানির দিকে ফিরে খুব শান্ত স্বরে বলল, "এই জায়গাটা তোমার ঠিক লাগছে? না অন্য কোন টেবিলে বসবে? ওই টেবিলটায় বসলে কেমন হয়?" জর্জ অন্য প্রান্তের একটা টেবিলের দিকে দেখাল।



একেই বলে বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন দুনিয়াদার মানুষ! জর্জকে ভেতর থেকে প্রবলভাবে তারিফ করল ফ্যানি। কিন্তু এখন ও চাইছিল একবারে বসে পড়তে। যাতে কেউ ওদের দিকে আর না তাকায়।

"আমার- আমার ত এটাই ভাল লাগছে।" ও বলল।

বেশ, জর্জ বলল, তাড়াহুড়ো করেই । আর বসেও পড়ল প্রায় ফ্যানির আগেই । আর খুব দ্রুত অর্ডার করল। "দুজনের জন্য চা আর চকলেট এক্লেয়ারস। "

চমৎকার,স্যার । ম্যানেজার বলল। মুখটা খুলে আবার বন্ধ করল । যেন এখুনি আবার জলে ঝাঁপ মারবে। "একটু টোস্ট দিয়ে শুরু করবেন স্যার ? আমাদের টোস্টের খুব নামডাক, স্যার ।

"না। "জর্জ স্বল্পকথায় সারল। "তোমার টোস্ট চাইনা , তাই ত, ফ্যানি? চাই?"

"ওহ, না না, জর্জ, লাগবেনা , থ্যাঙ্কিউ! " ফ্যানি বলল আর ভাবল এবার ম্যানেজারটা বিদেয় হোক।







"চা আসার আগে ম্যাডাম একবার আমাদের জলে রাখা গলদা পিংড়িগুলোকে দেখে আসবেন নাকি?"

বলে ম্যানেজার দাঁত কেলালো, দ্যাখন হাসি হেসে নিজের হাতের ট্রেটাকে একবার মাছের পাখনার মত দুলিয়ে দিল।


জর্জের মুখটা পাথরের মত শক্ত হয়ে গেল। সে আবার "না" বলল, আর ফ্যানি টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ল। নিজের দস্তানাগুলোর বোতাম খুলতে লাগল। যখন মুখ তুলল, ততক্ষণে লোকটা চলে গেছে। জর্জ ওর টুপি খুলে একটা চেয়ারের ওপর ছুঁড়ে ফেলল, আর নিজের চুলটাকে হাত দিয়ে পাট করল।

"বাঁচা গেল! লোকটা এতক্ষণে গেছে। এই বিদেশিগুলোকে আমি বেশিক্ষণ বরদাস্ত করতে পারিনা। এদের তাড়ানোর একটাই উপায়। দেখলে ত আমি কীরকম চুপ করিয়ে দিলাম! এতক্ষণে শান্তি!"

জর্জ আবার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। ফ্যানি ওর বাড়াবাড়িরকম আবেগ দেখে হয়ত ভেবেই ফেলত যে ও নিজে যেমন ম্যানেজারটাকে ভয় পচ্ছিল, জর্জও তাই পেয়েছে , যদি না বুঝত জর্জের এটা মজা করেই করা। ফলত, ফ্যানির ভেতরে জর্জের জন্য ভালবাসার একটা ঘুর্নি উঠল । ওর বিশাল দুটি বাদামি হাত তখন টেবিলের ওপরে । ফ্যানির কত না চেনা দুটি হাত। ওর খুব ইচ্ছে হল, একটা হাত নিজের হাতের ভেতর তুলে নেয়, নিয়ে চেপে ধরে। আশ্চর্য হয়ে ও দেখল জর্জ ঠিক সেটাই করল। টেবিলের ওপর দিয়ে ঝুঁকে পড়ে ওর হাতের ওপর নিজের হাতদুটি রেখে, ওর দিকে না তাকিয়ে, বলল, "ফ্যানি, ডার্লিং, ফ্যানি!"

ওহ, জর্জ!

ঠিক সেই স্বর্গীয় মুহূর্তেই ফ্যানি শুনতে পেল একটা টুং টুং টুট টুট শব্দ। একটা হালকা গিটারের তার টানার আওয়াজ। গান বাজনা হবে এবার, ফ্যানি ভাবল। কিন্তু গানবাজনার দিকে তখন ওর মন ছিল না। ভালবাসা ছাড়া আর কিচ্ছু এখন জরুরি নয়। হালকা হাসিমুখে ও তাকিয়ে রইল ঐ উল্টোদিকের হাসিমুখটির দিকে। এই অনুভূতিটাই এত শান্তির আর সুখের যে ওর ইচ্ছে হল জর্জকে বলে, "এখানেই থাকি আমরা- এখন যেমন আছি, এই ছোট্ট টেবিলটায় বসে। নিখুঁত এ জায়গাটা, সমুদ্রটাও একদম ঠিকঠাক। এখানেই থাকি...। " কিন্তু তার বদলে ওর চোখে গাম্ভীর্যের ছায়া নেমে এল।

"ডার্লিং! তোমাকে আমি একটা জিনিস জিগ্যেস করতে চাই। খুব ভয়ংকর গুরুত্বপূর্ণ এই ব্যাপারটা আমার কাছে। কথা দাও উত্তর দেবে। কথা দাও।" ফ্যানি বলল।

"কথা দিলাম।" জর্জ বলল। ফ্যানির মত গম্ভীর হতে গিয়ে যেন গোমড়াই হয়ে গেল সে।

ফ্যানি এক মুহূর্ত থেমে , নিচে তাকিয়ে আবার ওপরে তাকাল। "ব্যাপারটা এই...। তোমার কি মনে হয়, তুমি এখন আমাকে সত্যি করে জেনেছ? সত্যি, সত্যিকারের জানা? আমাকে? " নিচু গলায় ও বলল।

প্রশ্নটা জর্জের পক্ষে একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল। ওর ফ্যানি, তাকে জানা? শিশুসুলভ চওড়া একটা হাসি হাসল ও। "আরে , এ আবার একটা কথা। জানি ত। জানব না আবার?" বেশ একটু জোর দিয়ে সে বলল। "কেন, কী হয়েছে?"

ফ্যানির মনে হল জর্জ বুঝতেই পারেনি প্রশ্নটা । ও দ্রুত বলল," আমি যা বলতে চাইছি, সেটা এই। কত সময় দেখা যায়না, মানুষ পরস্পরকে ভালবাসে কিন্তু একে অপরকে পুরোটা বোঝেনা, জানে না?... এটা ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারছি না আমি। আসলে ওরা জানতে চায়ও না। আর সেটা আমার কাছে ভীষণ ভয়াবহ। সবচেয়ে বেশি জরুরি বিষয়টাতেই ওরা ভুল করে ফেলে। পরস্পরকে ভুল বোঝে। " ফ্যানির মুখটা ভয়ে যেন বিকৃত হয়ে গেছিল। "জর্জ, আমরা এরকম করব না নিশ্চয়ই, আমাদের এরকম হবে না ত?"

"আরে ধুত, হবে না হবে না", জর্জ হেসে বলল। তখনই ও ফ্যানিকে বলতে যাচ্ছিল, ওর ছোট্ট নাকটা ওর কত পছন্দ। কিন্তু তখুনি ওয়েটার চা নিয়ে এল। আর ব্যান্ড বেজে উঠল। একটা বাঁশি, একটা গিটার, একটা বেহালা। এত খুশির একটা বাজনা বাজছিল যে ফ্যানির মনে হল খুব সাবধানে নাড়াচাড়া না করলে কাপ ডিশগুলোও পাখা মেলে উড়ে যেতে পারে। জর্জ তিনখানা চকলেট এক্লেয়ারস আত্মস্থ করল। ফ্যানি দুটো।

চা -টার স্বাদটা যেন কেমন। "কেটলির ভেতরে গলদা চিঙড়ি রেখেছিল বোধ হয়!" বাজনার ওপরে দিয়ে চেঁচিয়ে বলল জর্জ। ...ভালই ছিল চা টা। ... ট্রে টা সরিয়ে রেখে জর্জ ধূমপান করছিল। এতক্ষণে ফ্যানির একটু সাহস হল অন্য লোকেদের দিকে তাকানোর। কিন্তু সবচেয়ে টানছিল আলো আঁধারে থাকা গাছগুলোর একটার তলায় জটলা বেঁধে দাঁড়ানো ব্যান্ডটাই। গিটারে সুর ঝালানো মোটা লোকটা পুরো ছবির মতন। বাঁশি যে বাজাচ্ছে সে একটু কালোপানা, ভুরুটা বার বার তুলছে, যেন নিজের বাঁশি থেকে বেরিয়ে আসা আওয়াজে সে নিজেই অবাক। বেহালাবাদক পুরোপুরি ছায়ায় ঢাকা।

বাজনাটা ঠিক যেরকম হঠাৎ শুরু হয়েছিল তেমনি হঠাৎ থেমে গেল। আর তখনই ফ্যানি লক্ষ করল একজন লম্বা বুড়ো লো্ক, সাদা চুল, বাজনদারদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। অদ্ভুত লাগল যে এতক্ষণ এঁকে লক্ষই করেনি ও। লোকটার পোশাকে চোখে পড়ার মত একটা উঁচু মাড় দেওয়া কলার, একটা কোট যার সেলাইয়ের ধারগুলো সবজেটে হয়ে গেছে। করুণ, দুর্দশাগ্রস্ত বোতাম দেওয়া বুটজুতো পায়ে। এই লোকটাও কি আরেকজন ম্যানেজার? নাহ, ওকে ত ম্যানেজারদের মত দেখতে না। অথচ লোকটা ওখান থেকে সব টেবিলগুলোর দিকেই তাকিয়ে আছে। অথচ যেন এসব কিছুই দেখছে না , আরো দূরে অন্য কিছুর দিকে তার নজর। লোকটা কে হতে পারে?

ঠিক যখন ফ্যানি ওকে লক্ষ করছিল, লোকটা নিজের কলারের কোণাগুলো আঙুল দিয়ে ছুঁল। তারপর অল্প কাশল। তারপর ব্যান্ডের দিকে অর্ধেকটা ফিরে দাঁড়াল।বাজনা আবার বাজতে শুরু করল। কিছু একটা যেন উচ্ছ্বল, বাধাবন্ধহীন, ঝড়ের মত, ছড়িয়ে গেল। ছড়িয়ে গেল সুরের আগুন বাতাসে। উত্থিত হল, ঐ শান্ত লোকটার দিকে ধেয়ে গেল। লোকটা নিজের হাতদুটো জড়ো করে রেখেছে, তখনো চোখদুটো সেই অনেক দূরের দিকে ফেরানো। লোকটা গাইতে শুরু করল।

"ওরেব্বাস রে!" জর্জ বলল। মনে হল অন্যেরা, সবাই একইভাবে চমকে গেছে। ছোট ছোট বাচ্চারা যারা আইসক্রিম খাচ্ছিল তারাও হাঁ করে লোকটাকে দেখছে, চামচগুলো শূন্যে স্থির। অথচ একটা হালকা আবছা সরু গলা ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছে না। যেন একটা কন্ঠস্বর নয়, কন্ঠস্বরের স্মৃতি শুধু। স্পেনীয় ভাষায় কিছু গাইছে। গাইতে গাইতে থামছে, আবার এগুচ্ছে, উঁচুতারের স্বরগুলোতে লাগছে, আবার পড়ছে, যেন অনুনয় করছে, আবদার করছে, ভিক্ষাপ্রার্থনা করছে কোনকিছুর জন্য...। তারপর আবার সুরটা পালটে গেল, এবং এবার যেন সে মেনে নিয়েছে, নিচু হয়ে ফিরে গেছে হতাশায়...। যেন জেনে গেছে যে সে প্রত্যাখ্যানের মানে।

গান প্রায় যখন শেষ, একটা ছোট্ট বাচ্চা জোরে হেসে উঠল, সেই রিনরিনে হাসির আওয়াজ শুনে ও দেখল সবাইই হাসছে। শুধু ফ্যানি আর জর্জ ছাড়া। জীবনও কি তবে এইরকম? ফ্যানি ভাবল। মানুষও ত এইরকমই হয়। এই ত বেদনা। এই ত কষ্ট। সে অপরূপ সমুদ্রের দিকে তাকাল, তীরে এসে এসে আছড়ে পড়ছে যেন কত প্রেম নিয়ে...। আর আকাশ, সন্ধে হবার আগের মুহূর্তের উজ্জ্বলতা নিয়ে উজ্জ্বল।

জর্জ আর তার কি এতটাই সুখী হওয়া উচিত? এতটা সুখী হওয়া কি কীরকম একটা নিষ্ঠুরমত ব্যাপার নয়? জীবনে অন্য আরো অনেককিছু ত আছে, যা এই সমস্ত কিছু্কে সম্ভব করেছে... সেটা কী? ও জর্জের দিকে ফিরল।

কিন্তু জর্জের অনুভূতিগুলো ফ্যানির থেকে আলাদা ছিল। ওই বুড়ো লোকটার গলাটা কেমন যেন হাস্যকর, তবে হে ঈশ্বর! এ থেকেই ও বুঝতে পারছে, জীবনের, যৌবনের একেবারে শুরুতে বিরাজ করছে তারা, এটা কত দুর্দান্ত একটা ব্যাপার। আহা, সে আর ফ্যানি এখন যেমন আছে। সবকিছু তাদের শুরু হচ্ছে সবে। জর্জও, উজ্জ্বল, যেন নিশ্বাস প্রশ্বাসে উতরোল জলের দিকে চেয়ে থাকল। ওর ঠোঁট ফাঁক হয়ে গেল, যেন পান করতে উদ্যত । সবকিছু কেমন চমৎকার! সমুদ্রের মত কিচ্ছু নেই সত্যি একজন পুরুষকে সুস্থ চনমনে করে তুলতে। আর ওই ত বসে আছে ফ্যানি। তার ফ্যানি। একটু ঝুঁকে। আস্তে আস্তে ওর নিশ্বাস পড়ছে।

"ফ্যানি!" ডাক দিল জর্জ।

ও যখন জর্জের দিকে ফিরে তাকাল, ওর নরম , বিস্ময়স্পৃষ্ট চোখদুটো দেখে জর্জের মনে হল, আর কিচ্ছু চাইনা, এখুনি সে টেবিলের ওপর দিয়ে লাফ দিয়ে ফ্যানিকে কোলে তুলে নিতে পারে যে কোন মূল্যে।

"শোন না, বলছি কি," জর্জ ভীষণ তাড়ায় বলল। " চলো এবার যাওয়া যাক। যাবে? হোটেলে ফিরে যাই চলো। এসো। ফ্যানি, চলো চলো! এখুনি চল বেরোই। "

ব্যান্ড আবার বাজতে শুরু করেছিল। জর্জ প্রায় আর্তনাদ করে বলল। "ওরে বাবারে! চলো শিগগির পালাই । এখুনি ওই বুড়ো ভামটা আবার ক্যাঁকর ক্যাঁকর করতে শুরু করে দেবে !"

আর, তার মুহূর্তখানেক পরেই, ওরা ওখান থেকে চলে গিয়েছিল। 

--------------

মূল লেখকঃ ক্যাথেরিন ম্যান্সফিল্ড

জন্ম; ১৫ অক্টোবর, ১৮৮৮ খৃষ্ঠাব্দ, ওয়েলিংটন, নিউজিল্যান্ড। মৃত্যু ৯ জানুয়ারি, ১৯২৩ খৃষ্টাব্দ। লেখালেখির ভাষা, ইংলিশ। পরিবারে পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। মাত্র পঁয়তিরিশ বছরের স্বল্পায়ু জীবনের শেষ প্রান্তে আন্তর্জাতিক পরিচিতি পাওয়ার পর পরই যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হন। তবু কলম থামিয়ে দেননি। প্রথাগত সাহিত্য ধারার বাইরে এই নারীবাদী লেখক বেশ কিছু আধুনিক ছোটো গল্প লেখেছেন। তাঁর প্রেরণা ছিলেন ভার্জিনিয়া উলফ , ডি এইচ লরেন্স, আন্তন চেখভ, প্রমুখ সাহিত্যিকরা।
অনুবাদক পরিচিতি:
যশোধারা রায়চৌধুরী
অনুবাদক, গল্পকার
                                                                             



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ