অতঃপর সিদ্ধান্ত হয়, আজ রাতেই হানা দেয়া হবে।
দিনের বাদবাকি সময়টুকুতে পাখিটির যাওয়া-আসা অর্থাৎ মুভমেন্টের উপর সার্বক্ষণিক নজর রাখার দায়িত্ব দেয়া হয় দলের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য মঞ্জুকে। আর এ ধরনের দায়িত্ব পেয়ে ভিতরে ভিতরে ভীষণ উৎফুল্ল হয়ে ওঠে সে এবং তার চোখের ঝিলিকে এই উৎফুল্ল বার্তাটি প্রকাশিত হলে দলের বাকি সদস্যত্রয় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এ ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আর ঠিক এ সময় কাকতালীয় যে দৃশ্যটি তৈরি হয় মঞ্জু সেদিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সচেষ্ট হলে সবাই বিস্ময়ে দেখে যে, এই একটু আগে যাকে নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছিল সেই লাল-হলুদ পাখিটি এখন নির্ভাবনায় বাসার দিকে ফিরে আসছে এবং এসে পরম নিশ্চিন্তে, আম গাছের দুটো স্বাস্থ্যবান শাখার সন্ধিস্থলে খড়কুটো দিয়ে নির্মিত নিজ বাসগৃহে বসে মাথা উঁচু করে আকাশের দিকে তাকায়। তার এই তাকানোর ভিতরে স্বাধীন ও নিরাপদ ভাবটি আবিষ্কার করে বালকেরা।
পাখিটির এই স্বাধীন ও নিরাপদ ভাবটিই অতঃপর বালক চতুষ্টুয়ের ক্রোধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
দিন-মাসের ব্যবধান ছেড়ে দিয়ে বালক চতুষ্টয়ের বয়স ৯, ১০, ১০ ও ১২। মঞ্জু ৯, ববী ১০, পল্টু ১০, ইলাহী ১২। এর মধ্যে দৃশ্যত ইলাহী বয়সে বড় হলেও পল্টুর যেহেতু দু’ দু’বার থানা সফরের অভিজ্ঞতা রয়েছে অতএব সে নিজেকে দলটির ক্যাপ্টেন ভাবতে শুরু করে এবং তার এই ভাবনায় ইলাহী, ববী কিংবা মঞ্জু কেউই বাগড়া দ্যায় না বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে পল্টুর বিচক্ষণতার সুনাম করতে দ্যাখা যায় তাদের। পল্টুর প্রথমবার থানা-গমন-নির্গমনের ঘটনাটি মোটামুটি সংক্ষিপ্ত : রেললাইনের ওপারে হাজারো গর্তঅলা লাল ইটের যে রাস্তাটি দু’পাশের দোকানপাট, স’মিল, মসজিদ, কাঁচাবাজারের সামনে দিয়ে তরল জলের মতো প্রবাহিত হয়ে শেষে ধান ক্ষেতের মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে, সেই রাস্তায় এক সন্ধ্যায় দুমদাম দু’দু’টি শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরিত হলে পুরো এলাকা ভূমিকম্পের মতো কেঁপে ওঠে। এই ঘটনার ঘণ্টখানেকের মধ্যেই পুলিশ পুরো এলাকা কর্ডন করে তরুণ, কিশোর, নারী-পুরুষ, ডাক্তার, কম্পাউন্ডার, দোকানি, সবজিআলা, ফেরিঅলা, পার্টটাইম দেহজীবী, মাছ বিক্রেতা--যাকে যেখানে পায়, গণএ্যারেস্ট করে থানায় নিয়ে আসে।
শ’দেড়েক লোককে ধরে থানায় আনা হলে [যার মধ্যে পল্টুর আতঙ্কিত মুখটিও দেখা যায়] স্থান সংকুলান সমস্যা হয় এবং সে কারণে ক্রিমিনাল ক্রিমিনাল চেহারার ৫০/৬০ জনকে হাজতে রেখে বাকিদের বসিয়ে রাখা হয় বারান্দা এবং থানার মাঠে। সে রাতে সহসা বিদ্যুত চলে যাওয়ায় যে কয়েকজন থানার বারান্দা ও মাঠ থেকে কেটে পড়তে সক্ষম হয় পল্টু তাদের অন্যতম। আর একবার মতিঝিলে পাটা-পুতার ঘষাঘষির মতো জনতা বনাম পুলিশের ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়ার মধ্যে পল্টু গ্রেফতার হয়ে যাবার পর পুলিশের প্রতি ইট-পাটকেল ছোড়ার প্রাথমিক ধারণা তার বয়স ও শরীরের সঙ্গে ম্যাচ করে না বিধায় কপালজোরে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। থানা গেটের একপাশে ইলাহীকে দেখে পল্টু, দেখে যে ভয়ে ইলাহীর জবুথবু অবস্থায় ‘মারে নাই তো’--ইলাহীর ভয়ের উত্তরে বুকটান পল্টুকে বলতে শোনা যায়, ‘মারবো ক্যা? মুই কি করছি?’ প্রশ্নের মধ্যেই উত্তর নিহিত এবং এই উত্তরের মধ্যেই যেন পল্টু সাহসী হয়ে ওঠে। তার বয়স বেড়ে যায়।
বন্ধু চতুষ্টয়ের মধ্যে মঞ্জু ও ববীর জীবনে কোনো গল্প তৈরি হয়নি এখনো। যে কারণে আজকের রাত্রটি সম্পর্কে তাদের উৎসাহ অন্তহীন , যেন বাকি জীবন বলার মতো, স্মরণে রাখার মতো একটা গল্পের জন্ম হতে চলেছে আজ রাতে। আর ইলাহী, যেহেতু সে একটু বোকা বোকা বলে কিংবা হতে পারে কোনো ঘটনাই সে মনে রাখতে পারে না বলে কোনো কিছুর প্রতি অতিরিক্ত উৎসাহ দেখায় না অতএব, যে ঘটনাটি আজ রাত্রে ঘটতে যাচ্ছে বলে সিদ্ধান্ত হয় ইলাহী তার নীরব দর্শক হয়ে থাকতে চায় শুধু। তবে দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে এমন আশংকায় সে তার মনোভাব গোপন রাখাই সাব্যস্ত করে।
শীতের রাত হাত-পা ছড়িয়ে বসার পরপরই ওরা চারজন রেললাইনের ওপারে মাঠের কোণে মাথা ভর্তি ডালপালা নিয়ে দাঁড়ানো আম গাছটির নিচে গাঢ় হয়ে শুয়ে থাকা অন্ধকারে এসে দাঁড়ায় এবং এর মধ্যে ইলাহীকে নির্দেশ দেয়া হয় বড় রাস্তার দিকে নজর রাখতে, ববীকে বলা হয় টু শব্দটি না করতে, ফাইনাল চেক করা হয় মঞ্জুর পকেটে কালো ফিতেটি আছে কিনা এবং এভাবে যখন সব কিছু নিয়ন্ত্রণে আছে ধারণা হয় ঠিক তখন ঘুমন্ত পাখির বাসায় হানা দেয়া এবং পাখিটিকে ধরে নিয়ে আসার দায়িত্বটি নিজেকেই অর্পণ করে পল্টু। কারণ, তার ধারণায় আজকের এই কাজটিই হচ্ছে সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ। আর এই গুরুত্বপুর্ণ কাজটি তো আর বোকা, গাধা আর পুঁচকেদের হাতে ছেড়ে দেয়া যায় না। সময় নেয়া ওরা, আর অন্ধকারকে তাড়িয়ে দিয়ে পৃথিবীর এই অঞ্চলের মানুষদের ঘুম পাড়ানোর দায়িত্ব নিয়ে মস্ত এক চাঁদ ওঠে মাথার উপর এবং এই চাঁদের আলোয় পাখির বাসাটি স্পষ্ট ভেসে ওঠে পল্টুর চোখে। দেয়ালে টিকটিকি যেমন খুব ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় শিকারের দিকে, ঠিক তেমনি পল্টুর হাত খুব সাবধানে পৌঁছে যায় আম গাছের দুই শাখার সন্ধিস্থলে।
পাখিটি টু শব্দ করে না। ঘুমন্ত পাখিটি হয়তো ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে যায়, কিংবা হতে পারে নিজের নিয়তি উপলব্ধি করতে না পারার অক্ষমতা নিঃস্পৃহ করে রাখে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই হাতের ভিতর পাখিটির শরীরের কাঁপন অনুভব করে পল্টু।
গাছ থেকে পাখিটি পাকড়াও করার সময়ই পাখিটির একাকিত্ব নিয়ে তারা যে ধারণা করেছিল এতোদিন তা মিথ্যা প্রমাণিত হয় এবং কিছুটা বিস্মিত হয়ে সে দেখে যে, পাখিটি আসলে একা নয়; তারও সংসার আছে এবং সে সংসারে আর একটি পাখি যার রং পরিষ্কার দেখা না গেলেও জ্যোৎস্নায় কোমল ও মোলায়েম মনে হওয়ায় সে যে স্ত্রী-পাখি তা নিয়ে সন্দেহ থাকে না পল্টুর এবং স্ত্রী-পাখির ডানার পাশে দুটো শিশু-পাখির উপস্থিতি তাকে স্বল্পক্ষণের জন্য বিস্মিত করলেও সে স্বপ্ন, ঘুম আর সংসারের মায়া-মমতার বন্ধন থেকে এক রকম ছোঁ মেরে পাখিটিকে ধরে ফেলে।
চারজনের ছোট দলটি এগিয়ে যায় মাঠের ঢালুর দিকে, সেখানেই পরিত্যক্ত একটা ছাপড়া ঘরের বারান্দায় তাদের বাস। এগিয়ে যাওয়া অর্থাৎ মাঠের ঢালুর দিকে নামার আগে মঞ্জু হিসহিস করে বলে, ওস্তাদ চোখ বাঁনবা না, শালা তো সব দেখবো, পরে যদি ঠোকর মারে আমাগো--মঞ্জু বয়সে ছোট হলেও যুক্তি হয় ওর কথার; অতএব মঞ্জু পকেটের সেই কালো ফিতেটি এগিয়ে দিলে চোখ বাঁধা হয় পাখিটির।
ছাপড়া ঘরের নিচে এসে পাখা ও পায়ের গোড়ালি বেঁধে ফেলে ববী। পাখিটির মধ্যে তখন পা ও পাখাদ্বয় নাড়াচাড়া করার প্রবণতা দেখা যায়, লেজও নড়ে ওঠে বার কয়েক, আর তখন পাখিটির এই দুঃসাহস ক্রোধান্বিত করে তোলে পল্টুকে। সে তার হাতে ছোট্ট লাঠি দিয়ে পায়ে আঘাত করলে পাখিটির মুখ থেকে চিৎকারের মতো শব্দ বেরোয় এবং বালকদের কাছে তা কান্নার মতো শোনালেও তারা পাখিটির ডানা থেকে পালক ছিঁড়তে শুরু করে। এরই মধ্যে ববী, যাকে মনে হতে পারে দলের সবচে নিরীহ সদস্য, কোথা থেকে একটি সুঁই নিয়ে আসে, বলে, ওস্তাদ শালার ডানা, হাঁটু আর পায়ের নখে ঢুকিয়ে দাও, দেখবে শালা জানে বেঁচে গেলেও আর জীবনে দাঁড়াতে বা উড়তে পারবে না। সারা জীবন পঙ্গু হয়ে থাকবে।
ডানার কয়েক জায়গায়, হাঁটুতে এবং পায়ের আঙুলে সুঁই ঢোকানোর পর পাখিটিকে বার কয়েক ডানা ঝাঁপটাতে, পা নাড়তে দেখা যায়, তারপরই সে নিথর হয়ে পড়লে মঞ্জুর ধারণা হয়, পাখিটি বোধহয় মারা গেছে। কিন্তু পরক্ষণেই পাখিটির নড়েচড়ে ওঠায় সে যে এখনো জীবিত তা প্রমাণিত হয়। ফলে বালকদের মধ্যে ফিরে আসে উৎসাহ। আর ইলাহী, যাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল রাস্তার দিকে নজর রাখার, দৃশ্যটি থেকে দূরে থাকায় যদিও সে কিছুই দেখতে পারছিল না তবু তার আতঙ্ক হচ্ছিল, ওরা বোধহয় পাখটিকে মেরেই ফেলবে। সে জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়া পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে শুধুই ভাবছিল, কেন, কেন ওরা পাখিটিকে মেরে ফেলছে? সে কি শুধু গত পরশু মাঠ পেরিয়ে রেললাইনের ওপারে যাবার সময় লাল হলুদ পাখিটি বাতাসে যে মলত্যাগ করেছিল তা পল্টুর মাথায় এসে পড়েছিল বলে, নাকি অন্য কোন অজ্ঞাত কারণে? নাকি পল্টু স্রেফ প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেই এই পরিকল্পনা ফেঁদেছে? কিছুই বুঝতে পারে না ইলাহী, শুধু ফ্যালফ্যাল করে দূরে বাড়িঘরের উপর স্তব্ধ হয়ে থাকা চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকে সে।
অনতিদূরে ছাপড়ার নিচে পাখিটা তখন কাৎরাতে থাকে তার ঠোঁট থেকে বেরিয়ে আসা ধ্বনি গোঙানির মতো, চি হি চি হি, চি...হি...চি--ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে আসা এই স্বরধ্বনি প্রতিধ্বনির মতো শোনায়--তখন বালকত্রয়ের মধ্যে মঞ্জুর ধারণা হয়, যে, পাখিটির হয়তো তৃষ্ণা পেয়েছে। যদিও পাখির ভাষার অনুবাদ মানুষের পক্ষে অসম্ভব, পারতেন একজনই, সোলেমান পয়গম্বর, তিনি বুঝতেন পাখির ভাষা; অই সব শব্দধ্বনির অনুবাদে মানুষেরা সাধারণত নিজেদের বুদ্ধি-বিবেচনাকেই প্রাধান্য দেয়, এই যেমন এখন, মঞ্জুর ধারণা--ওর তৃষ্ণা পেয়েছে খুব।
কাত হয়ে পড়ে থাকা পাখিটির ঠোঁটের কাছে পানি রাখা দরকার, আর এই প্রয়োজনীয়তার কথা বয়োঃকণিষ্ঠ মঞ্জুর মুখ থেকেই প্রথম উচ্চারিত হলে ধমকে ওঠে পল্টু, বলে--এতো রাইতে পানি কোথায় পামু? তুই প্যাণ্ট খোল শালা, নুনু বার করে হিসু কর ওর ঠোঁটের সামনে। তেষ্টা লাগলে মুতই খাবে। ও এখন আমাদের হাতে বন্দী। শালা, বন্দী বুঝিস? তুই কিছু বুঝিস না, তুই এখনো পিচ্চি।
মঞ্জুকে নুনু বের করে পাখিটির ঠোঁটের সামনে হিসু করতে বলায় যতটা রাগ না হয় তারচে ঢের বেশি রাগ হয় তাকে পিচ্চি বলায়। পল্টুর থেকে সে মাত্র বছরখানেক ছোট, তাই বলে তাকে পিচ্চি বলা! সে অন্ধকারে প্রায় চিৎকার করে ওঠে-- ফের যদি আমারে পিচ্চি বলেন পল্টু ভাই, আমি তাইলে এমন জোরে চিক্কইর দিমু, পুরা পাড়া চইলা আইবো।
পল্টু তখন সত্যি সত্যি ঘাবড়ে যায়। বলে, না না চিৎকার করিস না। তোরে আর পিচ্চি বলুম না। আইজ থাইক্কা তুই বড়দের দলে। দে বাবা, এখন প্যান্ট খুলে হিসু করে দে।
মঞ্জু ভাবে কিছুক্ষণ। প্যান্ট খুলবে কি খুলবে না, এমন একটা দ্বিধা আটকায় তাকে। সে বলে, পাখি মুত খায় না।
এ কথায় খুব হাসি পায় পল্টুর। সে অন্ধকারে হেসে ওঠে, বলে, আয় কাছে আয়। তারপর একটা আদুরে হাত মঞ্জুর কাঁধের উপর রেখে বলে, বন্দীর কাছে পানি আর মুতের ফারাক নাই। সবই সমান।
ভোররাতের দিকে ওরা চারজন পাখিটিকে মিটফোর্ড হাসপাতালের ইমারজেন্সির শীতল বারান্দায় রেখে আসে।
পরদিন সকালে কাগজে পাখিটির মৃত্যুসংবাদ পরিবেশিত হয় এভাবে: দুষ্ট ছেলেদের হেফাজতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আরো একটি পাখির মৃত্যু।
[বি:দ্র: গল্পটি সাংবাদিক বন্ধু সালিম সামাদকে উৎসর্গ করা হলো। ই.হা.]
0 মন্তব্যসমূহ