কথাসাহিত্যিক মোহিত কামালের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার : জীবনকে যেভাবে দেখার সুযোগ পাচ্ছি, যেভাবে উপলব্ধি করছি, তা সাহিত্যে ঢেলে রেখে যেতে হবে- এ বোধ আমাকে লেখার জন্য তাড়িয়ে বেড়ায়।

মোহিত কামাল (জন্ম ২ জানুয়ারি ১৯৬০) বাংলাদেশের একজন কথাসাহিত্যিক ও মনোশিক্ষাবিদ। শিশু সাহিত্য বিষয়ে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি ১৪১৮ বঙ্গাব্দে শিশু একাডেমি প্রদত্ত অগ্রণী ব্যাংক শিশু একাডেমী শিশুসাহিত্য পুরস্কার এবং কথাসাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৮ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৪৮ টি। এর মধ্যে ১৭টি উপন্যাস, ১০টি গল্পগ্রন্থ, ১০টি শিশুসাহিত্য, ১টি সম্পাদনাগ্রন্থ এবং ১০টি মনস্তত্ত্ব ও গবেষণা বিষয়ক গ্রন্থ। মোহিত কামালের সাহিত্যপাঠ ও লেখালেখি বিষয়ে একটি লিখিত সাক্ষাৎকার গল্পপাঠের পক্ষ থেকে  নিয়েছেন এমদাদ রহমান।পড়ুন--
গল্পপাঠ
কোন লেখক আপনাকে প্রভাবিত করেছেন এবং কীভাবে প্রভাবিত করেছেন? 

মোহিত কামাল : 
ছেলেবেলায় বড় অংশ কেটেছে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ মসজিদ কলোনিতে। কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলার দুটো শাখা সংগঠন ছিল সেখানে- 'নবাঙ্কুর মেলা' ও ভোরের পাখি। ‘নবাঙ্কুর’ ছেলেদের আর ‘ভোরের পাখি’ মেয়েদের। কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলার পরিচালক রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাইয়ের নামে সাহিত্য-সংস্কৃতির বিপুল কর্মযজ্ঞ চলতো সংগঠন দুটোয়। সাহিত্যপ্রেম, ছড়া-কবিতা পাঠ, ছড়া লেখার মূল প্রেরণা তখনই পেয়েছিলাম দাদাভাইয়ের কাছ থেকে। লেখালেখির বুনিয়াদ গড়ে উঠেছিল তখনই। কাদামাটির বয়স পেরিয়ে বড়ো হওয়ার পথে নানাজনে প্রভাবিত করেছেন। চট্টগ্রামের কলেজিয়েট স্কুলের বাংলার শিক্ষক আলী আকবর স্যার, চট্টগ্রাম কলেজের সিরাজ উদদৌলা স্যার, আমার গৃহশিক্ষক আবদুল বাতেন, আমার একমাত্র বোনের স্বামী। তাকে ‘দুলাভাই’ বলে ডাকি। এঁদের সবার অবদান রয়েছে আমার সাহিত্যবুনিয়াদ নির্মাণে। তবে একজনকে স্মরণ করার কথা বললে রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাইয়ের কথা বলতেই হবে।

ক্লাস টু-থ্রি পড়েছিলাম খুলনার খালিশপুর ক্রিসেন্ট জুট মিলস উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শাখায়। একজন মমতাময়ী মিস ছিলেন, নাম রোকেয়া অথবা রাবেয়া বেগম । খুব আদর করতেন। আবৃত্তি শেখাতেন। মনে পড়ে তার কথাও। তিনিও বুকে পুরে দিয়েছিলেন সাহিত্য-সংস্কৃতির বীজ। আর ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়েছি আগ্রাবাদ সরকারি কলোনী উচ্চ বিদ্যালয়ে। এই ইশকুলের অংকের শিক্ষক হেদায়েত স্যারও সাহিত্যসত্তা আলোকিত করে দিয়েছিলেন। অংকের টিচার হয়েও তিনি জোরালোভাবে বলতেন, ‘পড়তে হবে, গল্পের বইও পড়তে হবে, কেবল পাঠ্যবই বা অংকে ভালো করলে চলবে না। সব ধরনের বই পড়তে হবে। ' 

আর কলেজিয়েট স্কুলের আলী আকবর স্যারের মুখে শুনেছি নজরুলের ছোটোবেলার কথা। পড়াশোনার জন্য ছিল নজরুলের দুর্মর তাগিদ। দারিদ্রের কষাঘাতে বিপর্যস্ত নজরুল সব প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রাম থেকে এসেছিলেন সেই ত্রিশালের দরিরামপুরে। কথাটা মাথায় গেড়ে বসেছিল। বড়োবেলায় তাই লেখার রসদ পেয়েছিলাম সেই পুঁতে রাখা বীজের অঙ্কুর থেকে। লিখে ফেলেছি কিশোর উপন্যাস- ‘দুখু’, ‘দুখু- দ্বিতীয় খন্ড’ এবং দুই খণ্ডকে একত্র করে ‘দুরন্ত দুখু’। অনিন্দ্য প্রকাশ বের করেছে বই তিনটি। আলী আকবর স্যারের মুখে আরও শুনেছিলাম নজরুল সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’ পত্রিকাটির কথা - এর প্রথম সংখ্যার জন্য কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুভেচ্ছাবাণী হিসেবে লিখে পাঠিয়েছিলেন কয়েকটি কাব্যচরণ: 

আয় চলে আয়রে ধূমকেতু, 
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, 
দুর্দিনের এই দুর্গশিরে 
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন!... 

তাঁরও আগে, প্রায় দশ বছর বয়সে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম, পরবর্তী সময়ে পড়ারও, শিশু-কিশোর মাসিক পত্রিকা, ‘কচি ও কাঁচা’। বড়োরা হইচই বাঁধিয়ে দিত পত্রিকাটি হাতে পেলে। এর প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক ছিলেন দাদাভাই। তো, নজরুলের 'ধূমকেতু' আর দাদাভাইয়ের ‘কচি ও কাঁচা’ আমার কচি বয়সে একটা জোরালো আকাঙক্ষার বীজ রোপণ করে দিয়েছিল- বড়ো হয়ে একটা সাহিত্য পত্রিকা বের করার। সম্পাদক হব। লেখক হব। স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর মতো বিজ্ঞানী ও লেখক হব। এসব ইচ্ছা-আগ্রহ-উৎসাহ নিজের গহনে ওত পেতে ছিল বললে ভুল হবে। গোপনে গোপনে আমাকে সন্মুখে ঠেলেছিল পেছনে ফেলে আসা সে-যাত্রা পথ। আর বিস্ময়ের সঙ্গে দেখছি লোকে এখন আমাকে বলে মনোবিদ, মনোবিজ্ঞানী, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং কথাসাহিত্যিকও। ইচ্ছাশক্তি কীভাবে আলো ঢেলে আমাকে এ পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিয়েছে, জানি না- সাহিত্যপত্রিকা 'গল্পপাঠ'ও আমার সাক্ষাৎকার প্রকাশ করতে চেয়েছে। খুশি আমি। আরও বিস্ময়কর ঘটনা হচ্ছে এখন ‘শব্দঘর’ নামে একটা মাসিক সাহিত্য পত্রিকাও সম্পাদনা করছি । ‘সম্পাদক, শব্দঘর’ হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছি। 

সাহিত্যজগতের প্রতি আগ্রহের কথা বললাম। শিক্ষক ও সংগঠকের প্রভাবের কথা বললাম। আরও বলব বড়ো হওয়ার পথে স্কুল-বয়সে পড়া কবিগুরুর ‘পোস্ট মাস্টার' ,'হৈমন্তী ', ' কাবুলিওয়ালা'- এসব গল্প আমার বুকের গহনে সাহিত্যের বীজ বপন করে দিয়েছিল। কলেজজীবনেও 'গল্পগুচ্ছ'র অবদান অবিস্মরণীয়। একই সঙ্গে বলব, নজরুলের 'বিদ্রোহী' কবিতা, 'ঝিঙেফুল', কবি সুফিয়া কামালের ' পল্লীস্মৃতি'- 'বহুদিন পড় মনে পড়ে আজি পল্লী মায়ের কোল'… এসব কবিতাও আমার ছেলেবেলাটাকে সাহিত্যের রঙে রাঙিয়ে দিয়েছিল। 


মোহিত কামাল :
এখন কোন বইগুলো পড়ছেন, খাটের পাশের টেবিলে কোন বইগুলো এনে রেখেছেন পড়বার জন্য? 

মোহিত কামাল :
 কয়েক ধরনের বই পড়া হচ্ছে। ব্যাকরণ বিষয়ে কিছুটা ঘাটতি ছিল বলে মনে হচ্ছে। করোনাকালে বিভিন্ন ধরনের বই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পড়ছি পাঞ্জেরি থেকে প্রকাশিত ‘বাংলা ভাষার মজা’ (২০২০) ও ‘ব্যবহারিক প্রমিত বাংলা বানান সমগ্র’। উভয় বইয়ের লেখক ড. মোহাম্মদ আমীন। এছাড়াও টেবিল আছে প্রথমা প্রকাশনের ‘ভাষারীতি’। বইটিতে ব্যাকরণবিধি বা শব্দচয়নের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ গুছিয়ে তুলে ধরা হয়েছে । জানার শেষ নেই। লেখক হিসেবে যে কত ভুল করে থাকি, নবীন-প্রবীণ লেখক, সবাই- এসব বই পাঠ না-করলে আঁধারেই থেকে যেতাম মনে হয়। 

গল্পের বইয়ের মধ্যে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের 'গল্পসমগ্র১', নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের 'শ্রেষ্ঠগল্প', বিনোদ ঘোষালের 'নতুন গল্প ২৫'- এসব বই থেকে একেক সময় একেকটা গল্প পড়ছি। খাটের মাথার পাশে টেবিলে সাজানো আছে আরও বেশ কয়েকটা বই : মুম রহমান অনূদিত 'অনুগল্প কাফকা' (অনর্য ২০১৭), রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী সংকলিত-সম্পাদিত 'সমকালীন লাতিন আমেরিকান গল্প' (কাগজ প্রকাশন ২০১৯), অমিয়ভূষণ মজুমদারের একমলাটে দু'টি উপন্যাস- 'মহিষকুড়ার উপকথা, মধু সাধু খাঁ ', মোজাফফর হোসেনের অনুবাদ, আলোচনা ও সম্পাদিত 'বিশ্বগল্পের বহুমাত্রিক পাঠ' (অণুপ্রাণন ২০১৪), হায়াৎ মামুদের ভূমিকা ও সম্পাদনায় ‘নোবেল ভাষণ এলিয়ট থেকে গুন্টার গ্রাস' (ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ ২০১২) ও 'নোবেল ভাষণ রবীন্দ্রনাথ থেকে ক্লোজও' (ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ ২০০৯), সৈয়দ শামসুল হকের ‘গুপ্ত জীবন, প্রকাশ্য মৃত্যু' (সাহিত্য প্রকাশ ২০০৪), প্রমিত হোসেনের অনুবাদে অরুন্ধতী রায়ের ‘দ্য মিনিস্ট্রি অফ আটমোস্ট হ্যাপিনেস' (অন্যধারা ২০১৮), অরুণসোম অনূদিত মিখাইল বুলগাকভ-এর ‘মাস্টার ও’ মার্গারিতা’ (ভাষাবন্ধন প্রকাশনী ২০১৭), বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ‘শ্রেষ্ঠগল্প ও হেনরি' (ষষ্ঠদশ মুদ্রণ ২০১৬)- আখতার হুসেন সম্পাদিত। কাজী জাওয়াদ অনূদিত কাজুও ইশিগুরো’র ‘বিনোদনের এক শিল্পী' (প্রথমা প্রকাশন ২০১৯), শওকত আলীর ‘অপেক্ষা’ (ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ ২০১৯), শাহীন আখতারের ‘সখী রঙ্গমালা’ (বেঙ্গল পাবলিকেশনস ২০১০), রণেশ দাশগুপ্তের ‘উপন্যাসের শিল্পরূপ’ (প্যাপিরাস ২০১২)। 

গল্পপাঠ
সর্বশেষ কোন শ্রেষ্ঠ বইটি আপনি পড়েছেন? 

মোহিত কামাল :
 সর্বশেষ পঠিত শ্রেষ্ঠ বইয়ের তালিকায় আছে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ‘সেরা ৫০টি গল্প’ (দেশ পাবলিশিং ২০০৭), ফারহানা আজিম অনূদিত নাওয়াল আস-সাদাবি’র ‘শূন্য বিন্দুতে নারী (প্রথমা প্রকাশন ২০২০)। 

গল্পপাঠ
আপনার প্রতিদিনকার পাঠের অভিজ্ঞতার কথা বলুন, কখন কোথায়, কী এবং কীভাবে পড়েন? 

মোহিত কামাল
নানা বিষয়ের বই পড়ি । তবে গল্পের বই বেশি পড়া হয়। উপন্যাসও। আমার জীবনযাপনে বিশৃঙ্খলা নেই। সুশৃঙ্খল আমি । মিনিটের কাটায় ভর করে সময় পার করি। ঘন্টার কাটায় ধরে নয়। ভোরে ঘুম থেকে উঠি। হয় লিখি ১-২ ঘন্টা। অথবা পড়ি। তারপর ট্রেডমিলে হাঁটি। হাঁটার সময় পত্রিকা পড়ি। ছোটখাটো বইও। টেলিভিশনে খবরও দেখি হাঁটার সময়। ট্রেডমিলে ডেস্কের মতো একটা কাঠামো তৈরি করে নিয়েছি। সরানো যায় এ তাকের ওপর রেখে পত্রিকা-বই-ম্যাগাজিন পড়তে পারি হাঁটার সময় । আজও পড়েছি, অর্ধেক পড়ে রেখে দিয়েছি, দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত (দেশ ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০) প্রচেত গুপ্তের ‘গর্তকন্যা’ গল্পটি। অসাধারণ নির্মাণ কৌশল। ধীরেসুস্থে পড়ছি। শেষ হয়ে যাবে আজই। হাঁটা, পড়া, কখনও টিভি নিউজের হেডলাইন দেখা একসঙ্গে চলে। এখন কর্মময় জীবন থেকে অবসরে এসেছি। তবুও পেশাজীবী হিসেবে চিকিৎসাসেবা আগের মতোই চলছে। তারপরও বলব এখন বই পড়ার বেশ সময় পাচ্ছি। আগে খাটে শুয়ে পড়ার অভ্যেস ছিল। সেটা চোখের জন্য খারাপ। বলে দিয়েছেন চোখের চিকিৎসক। তাই শুয়ে পড়ি না আর। শুয়ে টিভি দেখাও খারাপ। চোখে চাপ পড়ে। শুয়ে টিভি দেখাও ছেড়ে দিয়েছি। পড়ার সময় সুবোধ বালকের মতো টেবিলে পড়তে বসি। তবে টেবিল গোছানো থাকে না। গুছিয়ে রাখতে পারি না প্রয়োজনীয় বই, ম্যাগাজিন। একটার পর একটা জমতে থাকে। সব এলোমেলো থাকে। তবু চেয়ারে বসে পড়ার পুরো প্রস্তুতি নিয়ে এখন পড়তে বসি। মুঠোফোনের জ্বালা আর ফেসবুকের টান পড়ার মনোযোগে ক্ষতি করে। এ কারণে পড়তে বসে ফোনসেট দূরে রেখে আসি। আগে এ স্বভাবটা এত প্রকট ছিল না। ইদানীং করোনাকালে ঘরে থাকতে হয়। তাই এর-ওর সঙ্গে যোগাযোগ করা, বিভিন্ন মিডিয়াতে জুম, স্কিমিং, হোয়াটসঅ্যাপ, স্কাইপিতে প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করতে হয়। তাতেও পড়া আর লেখার সময়ের ক্ষতি হয়। লেখার ঝোঁক চেপে ধরলে, মাথায় চেপে বসলে কখনও কখনও সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত টানা লিখতে পারি। এর মাঝে এক্সারসাইজ, খাওয়া, দুপুরে ১-২ ঘন্টা ঘুমও চলে। পড়াশোনার ব্যাপারেও একই রকম অবস্থা- তাড়া না থাকলে টানা পড়তে পারি। এতে চোখে চাপ পড়ে, দেহেও। যেহেতু পড়তে ভালো লাগে - মন বিনোদন খুঁজে পায়, চাপ তখন টের পাই না। 



গল্পপাঠ
কোন বইটি আপনার খুব প্রিয় কিন্তু অনেকেই বইটির কথা জানেন না। 

মোহিত কামাল
কঠিন প্রশ্ন। 'অনেকেই জানেন না '- বলা সত্যিই কঠিন । নিজে কী জানি, কী জানি না, তা বলাও সহজ নয়। তবে বলব মধ্যপ্রাচ্য বিশেষ করে সৌদি আরবের রাজপরিবারের মেয়েদের জীবনযাপন, নিপীড়ন-নির্যাতন নিয়ে একটা বই পড়েছিলাম,' The Princess'। এর লেখক নিউইয়র্ক টাইমস বেস্ট সেলার অথোর Jean Jasson। আমাদের দেশের পাঠকের চোখে বইটি কম ধরা পড়েছে মনে হয়েছে আমার । কৌতূহলের কারণে অসংখ্য বইপোকাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম উপন্যাসটির কথা। না। তাদের কেউ বলতে পারেননি এটির কথা। এ পর্যবেক্ষণের কারণে বলতে পারি, আমি জানি, কিন্তু অনেকেই জানে না বইটির কথা। 


গল্পপাঠ
কোন বইটি জীবনে একবার হলেও প্রত্যেকের পড়া উচিৎ? 

মোহিত কামাল
 বাংলা সাহিত্যে সেরা কবি ও কথাসাহিত্যেকের একজন, আমার চোখে সৈয়দ শামসুল হক। তাঁর ‘তুমি সেই তরবারি’ (বিদ্যাপ্রকাশ) এবং ‘খেলারাম খেলে যা’ উপন্যাস দুটোর কথা আমার প্রজন্মের প্রায় সবার জানা। পরের প্রজন্মের পাঠকের চোখে অনেকটা অজানা রয়ে যাচ্ছে ।এ সময়ের বহু পাঠককে জিজ্ঞেস করেছি। অধিকাংশ বোদ্ধা-পাঠক, এ সময়ের, নাম শুনেছেন, পড়েননি। সৈয়দ শামসুল হকের এ উপন্যাস দুটো অবশ্য সব মেয়েদের পড়া উচিত। ছেলেদেরও। এখানে সিগমুন্ড ফ্রয়েডে থিওরির ‘ইরোস’কে নান্দনিকভাবে উপস্থাপন করেছেন লেখক। ষাটের দশকে লেখা এ উপন্যাসটির ভেতর যে 'প্রিডিকশন' রয়েছে তা এখনো তো বটেই, আরও এক শ' বছর পরও প্রাসঙ্গিক থাকবে। পুরুষ কীভাবে নারীকে ভোগায়, পুরুষের কী ধৈর্য ও মনভোলানো কথায় নারীরা গলে যায়, তা কলমের টানে মূলপ্রবৃত্তি থেকে লেখক তুলে এনেছেন । একইসঙ্গে এ উপন্যাসে গেড়ে বসে আছে দেশভাগ ও দেশত্যাগের মর্মান্তিক কাহিনি, মানবিক উপাদানও। ফলে কেবল ' 'ইরোস' বা প্রবৃত্তির ভেতর ঘুটা দিয়ে লেখক খেলা করেননি, সম্পূর্ণ নতুন মানবিকতার পোশাক পরিয়ে ‘খেলারাম খেলে যা’ উপন্যাসকে শিল্পোত্তীর্ণ উপন্যাসের মর্যাদার শীর্ষ চূড়ায় তুলে দিয়েছেন। এজন্য এ উপন্যাসটি সাহিত্যপ্রেমিক প্রত্যেকের একবার হলেও পড়া উচিত। এ সময়ের অনেক সিনিয়র লেখক-পাঠক হয়তো কেবল বইটির নাম শুনেছেন। একটা মৌখিক জরিপ চালিয়ে বুঝেছি, অধিকাংশের কাছে এটা অপঠিত রয়ে গেছে। 



গল্পপাঠ
ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, সমালোচক এবং কবিদের মধ্যে এখনও লিখছেন এমন কাকে আপনি সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করেন? কেন করেন? 

গল্পপাঠ
লেখক হিসেবে তৈরি হতে কোন বইটি আপনার মনকে শৈল্পিক করে তুলেছে এবং কীভাবে? 

মোহিত কামাল
একসঙ্গে দুটো প্রশ্নের জবাব দিতে চাই : 
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের 'মানবজমিন' (আনন্দ পাবলিশার্স ১৯৮৮), ও 'দূরবীন '( আনন্দ পাবলিশার্স ১৯৮৬) পড়ার পর আমার চোখে সেরা ঔপন্যাসিক হয়ে গেছেন তিনি। ‘দূরবীন’ উপন্যাসে সমান্তরালভাবে তিন প্রজন্মের কাহিনি লিখেছেন শীর্ষেন্দু। প্রজন্মকাল বা সময়ই হয়ে উঠেছে এ উপন্যাসের মূল চরিত্র, নায়ক। হেমকান্ত, কৃষ্ণকান্ত এবং ধ্রুব যথাক্রমে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের মূল চরিত্র, নায়ক। নায়কের জীবনযাপনের ভেতর দিয়ে প্রজন্মকালই উপন্যাসের প্রতিটি শব্দ আর বাক্যজালের ভেতর থেকে আলো ছড়িয়েছে। এ নিরীক্ষাকে সাহিত্যে এক অভাবনীয় কৌশল মনে হয়েছে আমার। প্রজন্মের পারিবারিক গোপন প্রেমময় অ্যাখ্যান ছাড়াও এ উপন্যাসে উনিশ শতকের ভারতের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহও উঠে এসেছে প্রাসঙ্গিকভাবে। কোথাও তা আরোপিত মনে হয়নি। আখ্যানের ভেতরে দিয়ে তা অবলীলায় মিশে একাকার হয়ে গেছে। যেকোনো লেখকের এ কৌশলটি জানা উচিত। কীভাবে গল্পের স্রোতের মধ্যে তথ্য বা ইতিহাস 'পাঞ্চ' করে দিতে হয়, তার ভালো উদাহরণ হতে পারে ‘দূরবীন’। ভালো লাগার আরেকটা কারণ হলো উপন্যাসটির প্রথম অংশ জুড়ে আছে বাংলাদেশ আর দ্বিতীয়াংশ জুড়ে পশ্চিমবঙ্গ। কৃষ্ণকান্ত ও হেমকান্তের সম্পর্ক, আর ধ্রুব ও কৃষ্ণকান্তের সম্পর্কের ভেতর দিয়ে পারিবারিক দুঃখ-যাতনা, প্রেম-অপ্রেম যেমন তীব্রভাবে উচ্চকিত হয়েছে তেমনি উপন্যাসে ফুটে উঠেছে স্বাধীনতার পূর্ব ও পরবর্তীসময়ে বাঙালির জীবনদর্শন, চিন্তা-চেতনা, ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-আচরণ, মূল্যবোধ- এসবও। 

মনস্তত্ত্বের আবহ শীর্ষেন্দুর 'মানবজমিন' উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ একধারা । সম্পর্কের সংকট, তৃষার বিদ্রোহী ব্যক্তিত্ব, উচ্চাশা, সুখ খোঁজার নিরন্তর যাত্রা প্রমাণ করে জৈবিক প্রবৃত্তির আড়ালে চাপা পড়ে থাকে সুখ। সুখ কী পার্থিব? নাকি অপার্থিব? প্রশ্নটার গভীর থেকে উঠে আসে নতুন জীবনবোধ- সুখ আপনা-আপনি আসে ব্যক্তির অনুভবের ভেতর দিয়ে। সুখকে খুঁজে পাওয়া যায় না। খুঁজলে দুর্ভোগ, কষ্ট-যাতনা, জীবনযাপনের সংকট বাড়ে। বলা যায় রিপুতাড়না-লোভ-ঘৃণা-প্রেম-উচ্চাকাঙ্ক্ষা এসব মনস্তাত্ত্বিক উপাদানে ঘোরগ্রস্ত অন্যতম চরিত্র তৃষার জীবনযাপন ঘিরে এগিয়েছে আখ্যান । স্বামী, শ্রীনাথের বড় ভাই, উচ্চাকাঙ্খী, মল্লিনাথের সঙ্গে তৃষার যে-সম্পর্ক আর ওদের ছোটোভাই সোমনাথের সঙ্গে সম্পত্তি নিয়ে যে-সংঘাতে, তা একথায় জীবনখোড়া অ্যাখ্যান। বানোয়াট বা কল্পঘটনার ভেতর ডুবতে ডুবতে জীবনের অতল তলের পর্দা সরিয়ে লেখক দেখিয়ে দিয়েছেন জীবন কী? সবার সঙ্গে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জয়ী হলেও দেখা যাবে তৃষা বার বার হেরে গেছে নিজের সন্তান, সজলের কাছে। চিরন্তন মায়ের মন এমনই। সন্তানের মায়াজাল এমন নিবিড় যে, সে-জাল ছিন্ন করতে পারে না মায়ের প্রবল মমতা, স্নেহ-খুদা। যদিও সামাজিকভাবে প্রশ্ন ওঠে সজল কি আসলেই শ্রীনাথের ঔরসে জন্ম নেওয়া সন্তান, নাকি তৃষার ভাসুর মল্লিনাথের? এমন ক্ষুরধার প্রশ্নের ভেতর দিয়ে আমরা দেখব তৃষা বার বার জয়ী হলেও হেরে যায় সন্তানের কাছে। এই উপন্যাসের সামাজিক সংকট ও মনোসংকটের মধ্য দিয়ে মনস্তত্ত্বের আবেগ, চিন্তন, ব্যক্তিগত ও সামাজিক কগনিশন, বিচার-বিবেচনাবোধ, আবেগতাড়িত জীবনযাপন ও 'বেসিক ইন্সটিঙ্কট' বা জৈবিক প্রবৃত্তির সামঞ্জস্যপূর্ণ ওড়াউড়ি দেখার সুযোগ হয়েছে পাঠক হিসেবে । প্রথম পড়েছিলাম একানব্বই /বিরানব্বই সনে। তখনকার পড়া আর এ সময়ের পড়ার মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। একজন মনোচিকিৎসকের চোখে পড়ার মধ্য দিয়ে বুঝেছি শীর্ষেন্দুর জীবনবোধ, জীবনঘনিষ্ঠতা শুদ্ধভাবে বিজ্ঞানের কলকব্জা খুলে খুলে তুলে ধরে চোখের সামনে। মনস্তত্ত্বকে তিনি নতুনভাবে নির্মাণ করতে জানেন, ইচ্ছাকৃতভাবে এমনটি করেন, তা নয়। স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তিনি আসলে একজন মনোবিদ, জীবনবিশারদ। এমনটাই মনে হয়েছে আমার। এ ছাড়া তার ‘পার্থিব’ উপন্যাসটিও অসাধারণ। কাহিনির গাঁথুনি 'মানবজমিন'র সঙ্গে মিল থাকলেও তা আরও বিস্তৃত হয়েছে। এটিতে নতুনত্ব না পেলেও পরিবেশনায় নতুনত্ব রয়েছে। এসব উপন্যাস শীর্ষেন্দুকে ঔপন্যাসিক হিসেবে ইতিহাসের স্বর্ণচূড়ায় বসিয়ে দিয়েছে বলে মনি করি। আর এ কারণে সবার শীর্ষে আমার প্রিয় ঔপন্যাসিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। ব্যক্তি হিসেবেও আমি তাঁর ভালো গুণটা দেখার সুযোগ পেয়েছি। কাছে যাওয়ার সুযোগ ঘটেছে আমার। ‘শব্দঘর’ পত্রিকার উপদেষ্টা পর্ষদে যোগ দিয়ে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন শব্দঘর-পরিবারকে। সাহিত্যানুরাগীদের উৎসাহ দেওয়াও একজন অগ্রজ সাহিত্যিকের মহান কাজ। সব বিবেচনায় শীর্ষেন্দুই সেরা। 

আর কেউ কি সেরাদের কাতারে নেই?
অবশ্যই আছে : 
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ' চিলেকোঠার সেপাই ', ' খোয়াবনামা ', ‘আগুন পাখি’র স্রষ্টা হাসান আজিজুল হক ; 'গায়ত্রী সন্ধ্যা'র সেলিনা হোসেন, আনোয়ারা সৈয়দ হকের 'তৃষিতা', ‘নূরজাহান’-এর মতো বিশাল উপন্যাসের কথাকার ইমদাদুল হক মিলন, ‘জলপুত্র’ আর ‘দহনকাল’-এর হরিশংকর জলদাস, উড়ুক্কুর মতো অসাধারণ উপস্যাসের কথাশিল্পী নাসরীন জাহানসহ এ প্রজন্মের এবং নতুন প্রজন্মের অনেক ক্ষুরধার লেখক আমার প্রিয় ঔপন্যাসিকের তালিকায় রয়েছেন। প্রাবন্ধিকদের মধ্যে শামসুজ্জামান খান, পবিত্র সরকার, বিশ্বজিৎ ঘোষ ও মফিদুল হক, গল্পকারদের মধ্যে সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম, শাহাদুজ্জামান, মামুন হুসাইন, আহমাদ মোস্তফা কামাল, সমালোচক বা সাহিত্য-বিশ্লেষকদের মধ্যে আখতার হুসেন, মিলটন বিশ্বাস, আহমেদ মাওলা, মোজাম্মেল হক নিয়োগী, স্বপন নাথ, মনি হায়দার, সৈকত হাবীবসহ অনেকে ভালো কাজ করছেন। এখনও লিখছেন, যাঁরা বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাননি, তাঁদের মধ্যে কবি জাহিদ হায়দার, আসাদ মান্নান, ফরিদ কবির, ইকবাল হাসান ও শামীম আজাদ, হারিসুল হক আমার প্রিয় কবিদের তালিকায় আছেন। আর পেয়েছেন এমন কবিদের সবাই প্রিয়, সবাই সেরা। বলতে হবে কবি মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ নাসির আহমেদ, কামাল চৌধুরী, আহমেদ রফিক, নূরুল হুদার কথা । 

সমকালীন ইস্যু কবিদের কবিতায় প্রাধান্য পাচ্ছে। বিষয়টা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। উপন্যাসের মধ্যে প্রাধান্য পাচ্ছে, আমার বিবেচনায়, অনন্য আর অসাধারণ পটভূমি - ‘আগুন পাখি’, 'গায়ত্রী সন্ধ্যা', 'নূরজাহান', 'জলপুত্র', 'দহনকাল' এবং 'উড়ুক্কু' উপন্যাসের কথা বলা যায় উদাহরণ হিসেবে । এসব আখ্যানের বিষয়আশয় আমার সাহিত্যসত্তাকে আলোকিত করেছে বলে মনে করি। আলো পাওয়া এক কথা। তা ধারণ করা আরেক কথা। ধারণ বা বহন করার শক্তি সবার সমান থাকে না। তাঁদের উচ্চতার নাগাল পাওয়া কঠিন।তাঁদের বাক্যবিন্যাস, শব্দ নিয়ে অনন্য পরিচর্যা আমাকে মুগ্ধ করে। মোহিত করে। 

আরও বলব , অল্পকথার আসরে সবার নাম বলার সুযোগ নেই। তবে বলতেই হবে আলোচিত এসব উপন্যাসসহ আরও আরও কথাসাহিত্য আমার মনে শিল্পবোধ, শিল্পচেতনায় আলো ঢেলে দিয়েছে। 



গল্পপাঠ
কোন বিশেষ ভাব কিংবা পরিবেশ কিংবা পরিস্থিতি আপনাকে লিখতে বাধ্য করে? 

মোহিত কামাল
 লিখতে হবে। আমৃত্যু লিখে যেতে হবে। জীবনকে যেভাবে দেখার সুযোগ পাচ্ছি, যেভাবে উপলব্ধি করছি, তা সাহিত্যে ঢেলে রেখে যেতে হবে- এ বোধ আমাকে লেখার জন্য তাড়িয়ে বেড়ায়। পরিবেশ আমি তৈরি করে নিয়েছি। আমার শোবার ঘরের এক কোণে আছে পড়া আর লেখার টেবিল, আছে ট্রেডমিল। টেবিলে আছে টেবিল ল্যাম্প। কেবল বইয়ের ওপর, খাতার ওপর আলো ঢেলে শব্দের মিছিল আমি লুফে নিতে পারি ব্রেনে। চাপে থাকলেও লিখতে পারি। বিশেষ সময়টা আমার লেখকসত্তার জন্য বরাদ্দ। ওই বরাদ্দ সময়ে আমার জগতে অন্য কেউ ঢুকতে পারে না। লেখা হয়ে যায়। আর অলস সময় বলতেও আমার কিছু নেই। শ্রমময় দিনযাপনের ফাঁকে সময় পেলে দিনেও ঘুমিয়ে নিতে পারি। ঘুম থেকে ওঠার পর ব্রেন স্বচ্ছ হয়ে যায়। যা লিখতে চাই, অনবরত তখন লিখতে পারি। বাধ্যবাধকতা নেই। কোনো পরিবেশ আমাকে বাধ্য করে না। ইচ্ছাশক্তির টানেই হাতে কলম ওঠে। রোলটানা কাগজে লিখতে থাকি বলপেন কিংবা জেলপেন দিয়ে। কম্পিউটারে লিখতে গেলে ব্রেন খোলে না। টানা লিখতে পারি না। কলম আর রোলটানা কাগজের খাতা দেখলেই, টেবিলে সাজানো থাকে, মনটা লেখার জন্য টানে। চরিত্ররা টানে, ঘটনা-অনুঘটনা টানে, আখ্যানের কাহিনি-স্রোতও টানে। অনেক সময় মনে মনে সে-স্রোতে ডুবতে থাকি। ভাসতে থাকি। এর ফাঁকে লেখা হয়ে যায়। 

গল্পপাঠ
আপনি কীভাবে আপনার বইগুলোকে গুছিয়ে রাখেন?

মোহিত  কামাল
বই গুছিয়ে রাখতে পারি না। কোথায় কোন বইটা আছে খুঁজে পাই না। ধুলো জমে থাকে বইয়ের তাকে । হঠাৎ তা চোখে পড়ে। বিশেষ বই খুঁজতে যাই যখন, রেগে যাই ধুলোবালি দেখে। । গৃহপরিচারিকাদের নিয়ে তখন ঝাড়মোচ করতে থাকি। চারপাশে বই। বই আর বই। শোবারঘরে বই। বসারঘরে বই। বইঘরে তো আছে বই আর বই। পরিচ্ছন্ন করা দূরূহ। বিষয়টি ঘরের স্বজনেরা মানতে পারে বলে মনে হয় না। সইতে না পারলেও কিছু বলতে পারে না মুখ ফুটে। কারণ বড় ছেলে মাহবুব ময়ুখ রিশাদও ভালো লিখছে। তারও বেশ কয়েকটা উপন্যাস আর গল্পের বই বেরিয়ে গেছে। সে বোদ্ধাদের চোখে পড়েছে নিজের যোগ্যতায়। গিন্নীর তাই বইয়ের প্রতি সহনশীলতা বাড়তে বাধ্য। বেড়েছে মনে হয় । 


গল্পপাঠ
এই বইগুলো পড়ার পর কোন বইগুলো পড়বেন বলে ভেবেছেন? 

মোহিত কামাল
বিশ্বসাহিত্যের অসংখ্য বই আছে কালেকশনে। একজনমে এত বড় পড়তে পারব বলে মনে করি না। আগে পড়েছি এমন বই আবারও পড়ার ইচ্ছা রাখি। এর মধ্যে আছে আলবেয়ার কামুর, 'দ্য প্লেগ'। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মাকের্জের ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা', যোসে সারামাগোর ‘দ্য ব্লাইন্ডনেস’। মধ্যপ্রাচ্যের নারীদের জীবনের নির্মম ঘটনা নিয়ে লেখা বিশ্বের সর্বাধিক বিক্রিত একটা বই ‘The Princess’ আবারও পড়ার ইচ্ছা রাখি। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের 'খোয়াবনামা 'ও। 


গল্পপাঠ 
শব্দকে আপনি কীভাবে অনুভব করেন? আপনি কি কখনও শব্দের গন্ধ পেয়েছেন? 

মোহিত কামাল
বুকের ঘরে শব্দরা খলবল করে। শব্দ নিয়ে, কবিতা লিখতে বসে রবীন্দ্রনাথ যে-খেলা খেলেছেন তা বোঝার চেষ্টা করি। কোনো বিশেষ শব্দ বাক্যে পরে বসালে কী হয়, আগে বসলে কী হয়, এদিক থেকে ওদিক নিলে কী হয়- কাটাকুটি করতে করতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর পান্ডুলিপির মধ্যে যে-ছবি এঁকে ফেলতেন, তা আমাকে চমকে দেয়। আমিও প্রুফ দেখার সময় সে-খেলাটা খেলার চেষ্টা করি। আর ‘শব্দঘর’ নামে তো একটা মাসিকসাহিত্য পত্রিকাও বের করে চলেছি। জটিল শব্দ, সংস্কৃত শব্দের মধ্যে তদ্ভব, তৎসব শব্দ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। প্রমিত বাংলার সহজ সরল রূপটা ধরার চেষ্টা করি। তা প্রয়োগেরও। তবে আমার প্রথম দিকের লেখাঝোকায় এসব কথার সত্যতা মিলবে না। প্রথমদিকের লেখায় দুর্বলতাগুলো এখন কাটাতে চেষ্টা করছি। শিশুতোষ, টিনেজারদের নিয়ে লেখা- কিশোর গল্প বা কিশোর উপন্যাসে শুরু থেকে চেষ্টা ছিল সহজ শব্দ ব্যবহার করার। সেই লেখা আর এখনকার লেখার মধ্যে পার্থক্য করতে পারছি বলে মনে হয়। তবে আমি মনে করি সামগ্রিক কাজ দিয়ে একজন লেখকের শব্দজ্ঞান, শব্দপ্রয়োগের দক্ষতা বা শিল্প নির্মাণকে মূল্যায়ন করতে হবে। বিচ্ছিন্ন কোনো লেখা দিয়ে নয়। ‘শব্দঘর’ সম্পাদনা করতে গিয়ে শব্দ নিয়ে এ পরিচর্যাটারও মূল্য দিয়ে থাকি। সরাসরি শব্দের গন্ধ পেয়েছি,বলা কঠিন । নিজেকে তত ক্ষুরধার অনুভূতিশীল ভাবতে পারলে ভালো হতো। তবে শব্দের অনুভব বুকের ভেতর তোলপাড় করে, শব্দরা ব্রেনে খেলা করে- টের পাই। কোনো পঠিত উপন্যাস-গল্প কিংবা কবিতায় শব্দের নতুন ধরনের বুনোট, কিংবা উপস্থাপনের কৌশল দেখলে তা মগজে ঢুকিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করি। নিজেকে ঋদ্ধ করি। নিজের নতুন বই বেরোলে বইটাকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরি, সন্তানকে আদর করার মতো আদর করি। মমতার অপার্থিব আনন্দ তখন নিজেকে জাগিয়ে তোলে,বইয়ের সারি সারি বাক্য-শৃঙ্খলে লুকিয়ে থাকা শব্দরা বাঁধনহারা হয়ে শোরগোল তোলে।পরোক্ষভাবে তখন ওদের গন্ধও পাই, অলৌকিক গন্ধ । শুনতেও পাই ওদের মরমি ডাক। 


গল্পপাঠ
সাম্প্রতিক কোন ক্ল্যাসিক উপন্যাসটি আপনি পড়েছেন? 

মোহিত কামাল
 'ক্ল্যাসিক' শব্দটার ওজন অনুমান করে বলতে চাই যুগ যুগ ধরে যা সাহিত্যের গাথুনি নির্মাণ করে দিয়েছে, জীবনকে গভীর তল থেকে উঠিয়ে আনতে পেরেছে, জীবনঘনিষ্ঠবোধ ছড়িয়ে দিতে পেরেছে- তা উঁচুমানের সাহিত্য হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এসব গুণ ক্ল্যাসিক সাহিত্যের মাপকাঠি । তারপরও বলব, 'সাহিত্যের কোনো শর্ত নেই'। সুনীলও এ কথা বলে গেছেন। কোনো কোনো ক্ল্যাসিক উপন্যাস সৃষ্টি হয়ে ইতিমধ্যে বসে আছে সম্রাটের আসনে। তাই নতুন সৃষ্ট ক্ল্যাসিক অনেকের চোখ এড়িয়ে যায়। এ রকম বহু উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে নির্মিত হয়ে গেছে। সব ক'টি কি ক্ল্যাসিক হিসেবে নজরে এসেছে ? প্রশ্নটি সামনে রেখে বলব স্বপ্নময় চক্রবর্তীর ‘হলদে গোলাপ’ উপন্যাসটির কথা । এটা ক্ল্যাসিক হবে কিনা বলে দিবে সময়। ২০১২-১৩ সালে লেখা এ উপন্যাসের লেখক অবিশ্বাস্য শ্রম ঢেলে নির্মাণ করেছেন অনন্য, একদম ভিন্ন রকম এক উপন্যাস। লেখক কলম খুঁড়ে তুলে এনেছেন, শারীরবিদ্যা, মনস্তত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান, নৃ-বিজ্ঞান এবং ইতিহাস। জেনেটিকসের প্যাচানো সিঁড়ির ধাপ খুলে খুলে এগিয়েছেন তিনি। মিথের দেয়াল ভেঙ্গে গড়েছেন নতুন মিথ। আশ্চর্য দক্ষতায় তৈরি করেছেন অনন্য এক মায়াময় জগত। বাংলা সাহিত্যে তো বিরল, নাই-ই এমন উপন্যাস। বিশ্বসাহিত্যেও আছে কিনা আমি সন্দিহান। আমার মত হচ্ছে বিশ্বে এমন উপন্যাস একটাই হতে পারে,আর তা হচ্ছে ' হলদে গোলাপ' । কাহিনির স্তরে স্তরে লুকিয়ে আছে বিজ্ঞান। গল্পের মধ্য দিয়ে লেখক অসামান্য দক্ষতায় তা 'পাঞ্চ' করে দিতে পেরেছেন। কোথাও আরোপিত বলে মনে হয়নি। বোদ্ধাপাঠকও এ উপন্যাসে ঢুকতে হলে প্রবল ধৈর্য নিয়ে এগোতে হবে। এটিকে আত্মস্থ না করে এর মূল্যায়ন করা ঠিক হবে না। লিঙ্গ-পরিচয়ের সংকটকে উপজীব্য করে লেখা এ মানবিক উপন্যাস বিশ্বসাহিত্যে নেই- জোর গলায় বলতে ইচ্ছে করছে আবার। আমি বলব, সময়ে বিচারে 'ভিন্ন রকম ক্লাসিক' হিসেবে স্বীকৃতি পাবে এ উপন্যাস। এটাও আমার ইদানীং পড়া উপন্যাস। 


গল্পপাঠট
আপনি যখন একটি বইয়ের কাজ করছেন, লিখছেন, সম্পাদনা করছেন, কাটাকাটি করছেন, সেই সময়টায় আপনি কোন ধরনের লেখাপত্র পড়েন? আবার ঠিক এরকম পরিস্থিতিতে কী ধরনের লেখা আপনি এড়িয়ে চলেন? 

মোহিত কামাল
টেবিলে সাজানো রোলটানা কাগজের ওপর বলপেন দ্রুত ছুটতে শুরু করেছে- এটাই বই সৃজনকাজের সূচনা-ধাপ। কখনও বা চলে জেলপেন। টেবিলটা লেখার উপযোগী করা থাকলে, চালকের মতো আসন নিয়ে গাড়ি স্টার্টের চাবি ব্যবহারের মতো হাতে কলম উঠে যায়।গাড়ি চলার মতো কলমও তখন চলতে থাকে। ভোরে বা দুপুরের ফ্রেশ ঘুম দিয়ে উঠলে লেখার নেশা ধরে যায়। লিখতে শুরু করি। গল্পের কাঠামো কেমন হবে, বিষয়বস্তুকে কীভাবে ঢেলে দেব আখ্যানের ভেতরে, ভাবি না। তবে কোনো কোনো অনুচ্ছেদ লিখতে বসে অগ্রিম আইডিয়া চলে আসে মাথায়। সেই অনুচ্ছেদ ফুটিয়ে তুলতে প্রাসঙ্গিক তথ্য-উপাত্তের প্রয়োজন হতে পারে, বা যখন প্রয়োজন হয় লেখা থামিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে থাকি। প্রাসঙ্গিক বইও ঘাটতে থাকি। তখন লেখা থেমে যায়। আবার উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো বিষয় ঠিক করলে, যেমন নজরুলের ছেলেবেলা নিয়ে কিশোর উপন্যাস লেখার আগ্রহে নজরুল বিষয়ক যত বই আছে, বিশেষ করে তার ছেলেবেলাকে নিয়ে লেখা, তা এনে জড়ো করে রাখলাম টেবিলে। একটার পর একটা পড়ে, তা আত্মস্থ করে নতুন করে কিশোর উপন্যাসের ভাষায় তা লিখে ফেললাম- 'দুখু', 'দুখু- দ্বিতীয় খন্ড,' 'দূরন্ত দুখু'। আবার বলা যায়, চর্যাপদের গীতিকাব্যে একটি পদ ‘চঞ্চল চি এ পইঠা কাল’ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্রেনে নাড়া খেল মনস্তত্ত্বের গভীর থেকে উঠে আসা বোধ: `চঞ্চল মন বিষের ছোবল খায় ‘ কথাটা। সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিলাম চর্যাপদ নিয়ে যত বই আছে জোগাড় করব, পড়ব। এ সবের ভেতর লুকিয়ে থাকা জীবনযাপন, প্রেম-ভালোবাসা, নিষ্ঠুরতা-হিংস্রতা, শোষণ-নিপীড়ন- এসব বিষয়ও জানব। তারপর লিখব চর্যাপদ ঘিরে একটা উপন্যাস- পরিকল্পনা সফলও করে ফেললাম। প্রকাশিত হয়ে গেল ‘লুইপার কালসাপ’ (বিদ্যাপ্রকাশ ২০১৯) উপন্যাসটি। প্রচুর পড়তে হয়েছে, শ্রম ঢালতে হয়েছে এটি লিখতে । ছোটো কলেবরে লেখা উপন্যাসটিকে বোদ্ধারা গ্রহণও করে ফেলেছেন। ভালো লাগছে। প্রথম প্রুফটা থেকেই আমি বার বার পড়েছি । কাটাকুটি করেছি। লেখার চেয়ে বার বার প্রুফ দেখাতেও আমার ক্লান্তি থাকে না। আমার কম্পিউটার অপারেটরও ধৈর্যশীল। আমার বার বার কাটাকুটি নিয়ে সেও বিরক্ত হয় না। যখন কাটি, তা সংশোধন করা হলো কিনা, তাও যাচাই করি । কখনও বা নিজেও প্রুফ কারেকশন করি। নিজের চোখে আরামদায়ক মনে হলে প্রিয় কোনো পাঠককে তা পড়তে দেই। সেও ভুলটুল ধরিয়ে দেয়। নিজের চোখে অনেক সময় তা ধরা পড়ে না। অন্যের চোখ চট করে ধরে ফেলে, কোনো তথ্য পাঞ্চ করে দেওয়ার প্রয়োজন হলে কিংবা ইতিহাস বা চলমান ঘটনা রিপোর্টিংয়ের মতো চরিত্রের দিনযাপনের মধ্যে দিয়ে উপস্থাপনের প্রয়োজন দেখা দিলে,তা করে লেখা শেষ করি। কিন্তু প্রুফ দেখার সময় তার প্রতি বিশেষ নজর রাখি। কাটছাট করি বাহুল্য সংযোজন। আরোপিত মনে হলে হিংস্রতার সঙ্গে তা কেটে ফেলি। তবে অনুগল্প বা ছোটগল্প অনেক সময় নিজেই মুঠোফোনে 'প্রভাত' বর্ণমালা টাচ করে করে লিখে ফেলি। সেখানে কারেকশন করা সুবিধা, বানানেও কম ভুল হয়। একটা বই লিখতে শুরু করলে, সেটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত অন্য লেখায় সাধারণত মন বসে না। ছোটদের জন্য শিশুতোষ লেখা বা টিনএজারদের জন্য কিশোর উপন্যাস লেখার সময় ছোটোদের নিয়ে লেখা বই পড়ি। অথবা ক্লাসিক গল্প পড়ি, ছোটোদের উপযোগী। তখন বড়োদের বই পড়ি না। জটিল উপন্যাস বা বড়োদের জন্য লেখা এড়িয়ে চলি। দুটো সত্তাকে আলাদা করতে পারলেও অনেক সময় দেখা যায় ছোটোদের উপন্যাসে জটিল শব্দ ঢুকে পড়ে। সম্পাদনার সময় তা ধোলাই করি। তারপরও বই বের হওয়ার পর দেখি বা মনে হয়, এই শব্দটা, ওই বাক্যটা আরেকটু সহজ করা যেত। তখন মন খারাপ হয়। বড়োদের উপন্যাসেও আমি শব্দের ব্যবহার নিয়ে নিরীক্ষা করেছি। বিশেষ করে আমার সিরিয়াস ধারার উপন্যাস 'অহনা ' (বিদ্যাপ্রকাশ ২০১২), 'মরুঝড়' (বিদ্যাপ্রকাশ ২০১৩), 'চন্দন রোশনি' (বিদ্যাপ্রকাশ ২০১৫), 'পথভ্রষ্ট ঘূর্ণির কৃষ্ণ গহ্বর' ( বিদ্যাপ্রকাশ ২০১৪),' 'তবু বাঁধন' ( বিদ্যাপ্রকাশ ২০১৭), 'বিষাদনদী' ( অন্যপ্রকাশ ২০১৮), ' দুমুখো আগুন' (বিদ্যাপ্রকাশ ৩০১৮)- এসব উপন্যাসের ভেতর শব্দচয়ন ও বাক্যের ব্যবহার, রূপক উপমার উপস্থাপন নিয়ে নিরীক্ষা করেছি। আবার 'মায়াবতী' কিংবা ‘না’ উপন্যাসে সহজ-সরল শব্দ, বাক্য ব্যবহার করেছি। এসব উপন্যাস মূলত টিনএজার বা তরুণ-তরুণীদের সমস্যা নিয়ে লেখা। এসব উপন্যাস সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে লেখা। সমাজ-উপযোগিতা প্রকাশ পেয়েছে বলে অনেকে মনে করেছেন।'চন্দন রোশনি' ( বিদ্যাপ্রকাশ ২০১৫) উপন্যাসের প্রেক্ষাপট হচ্ছে সৌরজগৎ এবং সাগরের তল। উভয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে চলমান বাস্তব জীবন। অর্থাৎ বাস্তব আর পরাবাস্তবের সংযোগ এ ভিন্নধারায় । এর নির্মাণের সময় প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়েছে সাগর তল আর সৌরজগৎ নিয়ে। সম্পাদনার সময়, বা নতুন সংস্করণে ব্যাপকভাবে কাটছাট করতে হয়েছে, প্রাথমিক দুর্বোধ্যতা কাটিয়ে ওঠার জন্য। ‘মরুঝড়’ (বিদ্যাপ্রকাশ ২০১৩) লিখেছিলাম দুবাইয়ের মরুভূমি ঘুরে এসে। লেখার সময় প্রবল আবেগে লিখে গেছি। ধারাবাহিকভাবে তা প্রকাশিত হয়েছিল দৈনিক জনকণ্ঠের সাহিত্য সাময়িকীতে। অনেক পাঠক তা পড়েছেন। বন্ধু-পাঠকদের অনেকে বলেছেন এ অংশটায় বেশি আবেগ আছে, ওই অংশটায় আছে বাহুল্য- তাদের এসব কমেন্টকে বই প্রকাশের সময় বিবেচনায় রেখেছি। সম্পাদনা করেছি বার বার। আর সর্বশেষ সংস্করণে ভুলচুক কাটিয়ে উঠতে পেরেছি মনে হয়। হয়তো আরও কয়েক বছর পর পড়লে মনে হবে, না এই পর্ব ঠিক হয়নি। এটাকে অন্যভাবেও লেখা যেত! বেশ কয়েকজন' সিনিয়র বন্ধু বলেছেন, 'এ উপন্যাসটি সাহিত্যিক হিসেবে আপনাকে আয়ু দেবে। ' 

' মন '( বিদ্যাপ্রকাশ, ২০০৬) উপন্যাসটি নিয়েও এমন কথা শুনেছি শুভাকাঙ্ক্ষী বিদ্বৎকুলের মুখে। শুভার্থী বন্ধু বলে কথা। শুনতে ভালো লাগে। তাই এ দুটো বইয়ের যেকোনো ভুল শোধরানোর জন্য আমি সিরিয়াস থাকি, বার বার পড়ি ভুল ধরার জন্য। 



গল্পপাঠ
সম্প্রতি পঠিত বইগুলো থেকে এমন কোনও বিস্ময়কর ব্যাপার কি জেনেছেন যা আপনার লেখক- জীবনকে ঋদ্ধ করেছে? 

মোহিত কামাল
হ্যাঁ। এর মধ্যে আছে ‘হলদে গোলাপ’ আর ‘শূন্য বিন্দুতে নারী’। একদম আলাদা, দুটো উপন্যাস। দ্বিতীয়টিতে একদম সেন্সরহীন, নারীর বয়ানে উঠে এসেছে বিশ্বজুড়ে নারী নিপীড়নের চিহ্ন। কী ভয়াবহ, কী করুণ, কী নির্মম ফাঁদে পড়ছে নারীরা, নারী বিষয়ক অনেক অনেক উপন্যাস পড়েছি, এমন শুদ্ধ সত্য উচ্চারণ আর কোথাও পড়েছি বলে মনে হয় না। সত্যকথন, সত্যকে বিকৃত না করে অবিকল উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে যদি উপন্যাসের শিল্প কাঠামো ঠিক রেখে তা ঢেলে দেওয়া যায় তা হয়ে উঠবে ভালো সাহিত্য- এটা মনে হয়েছে। 

‘হলদে গোলাপ’ পড়েও দারুণ নাড়া খেয়েছি। বিশেষ করে আমার নিজের পাঠ্য সাবজেক্টের আলোকে এত বড় মাপের সাহিত্যসৃজন করা যায়, পড়ে-বুঝে অনুপ্রেরণা পাচ্ছি। ভেতর থেকে একটা আত্মবিশ্বাসের ডাক পাচ্ছি- কে যেন বলছে, ‘চেষ্টা করো, লিখতে থাকো, তুমিও পারবে।’ পারব কিনা জানি না, কিন্তু বিশ্বাস জন্মেছে স্বপ্নময় চক্রবর্তী যখন পেরেছে, আমিও পারব। আপাতত এ বোধই আমাকে বিপুলভাবে নাড়া দিয়েছে, ঋদ্ধ করেছে, বলতে পারি। 

গল্পপাঠ
আপনি কোন ধরনের লেখা পড়তে আগ্রহ বোধ করেন, আর কোন ধরনটি এড়িয়ে চলেন? 

মোহিত কামাল
শিশুতোষ গল্প, রূপকথার গল্প সুযোগ পেলে এখনও পড়ি। কিশোর উপন্যাসও। লেখকের নাম ধরে পড়ার অভ্যেস ছিল না। বইয়ের ফ্ল্যাপে লেখা বিষয়বস্তু দেখে পছন্দ হলে তা কিনে ফেলতাম। সব হয়তো পড়া হতো না। কোনো কোনো বই হাতে নিয়ে ছাড়তে পারিনি। কোনো কোনো বই এগোতে পারিনি। বিশেষ করে আমাদের দেশের দু’জন প্রখ্যাত লেখকের বইয়ের ভেতর কখনও ঢুকতে পারিনি। বেশি কঠিন মনে হতো। ছেড়ে দিতাম না পড়ে। পরে দেখতাম তাঁদের ওইসব বইয়ের ওপর বোদ্ধাদের ভালো ভালো সব বিশ্লেষণ । পাঠক হিসেবে হীন আর দীন মনে হতো নিজেকে। চরিত্রদের নামও আমাকে খুব ভোগায়। বিশেষ করে রাশান সাহিত্যের অনুবাদ পড়তে গিয়ে দেখেছি, কঠিন সব নাম। এই নামের কারণে বিশ্বসাহিত্যের অনেক উপন্যাস আমার পড়া শুরু হলেও, শেষ করা হয়নি। কিন্তু মশিউল আলমের একটা মৌলিক উপন্যাস পড়েছি ‘তনুশ্রীর সঙ্গে দ্বিতীয় রাত’ রাশান প্রেক্ষাপটের ওপর, গর্ভাচেভ ও ওদের পতনের সময়কাল ও পেরেস্ত্রৈকা নিয়ে লেখা। মশিউল তাঁর সৃষ্ট চরিত্রদের সহজ ও পরিচিত নামে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর অধিকাংশ চরিত্ররা এ উপমহাদেশের। ফলে শেষ করতে পেরেছি উপন্যাসটি। ম্যাক্সিম গোর্কীর মা’টাও শেষ করতে পেরেছিলাম। তবে কঠিন নামের কারণে শেষ করতে কষ্ট হয়েছে। নামটা খটমটো হলে আমি এগোতে পারি না। পাঠক হিসেবে এটা আমার দুর্বলতা। তবে কাহিনির টানে অনেক উপন্যাস যে পড়া হয়নি, তা নয়। 

সহজ লেখার মধ্যে হুমায়ূন আহমেদের 'মিসির আলী সিরিজ' ও 'হিমু 'সিরিজ পড়তাম। অনেকে হুমায়ূনের এসব সৃষ্টিকে হালকা, চটুল লেখা মনে করেন। বিষয়টা আমাকে কষ্ট দেয়। কারণ একজন মনস্তত্ত্ববিদ হিসেবে আমি মূল্যায়ন করতে পারি, মিসির আলী’র মধ্যে হুমায়ূন যুক্তির খেলা খেলেছেন, আর হিমুর মধ্য খেলেছেন কল্পনাশক্তির খেলা। দুটোই জীবনখোড়া সাহিত্যেরই মূল উপাদান হতে পারে। কারণ যুক্তিবাদ হচ্ছে মেধার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, উপাদান। আর কল্পনা শক্তিও প্রতিভার অনুষদ, সৃষ্টিশীলতার আলোকরশ্মি। কল্পনা বা যুক্তি আরোপের ক্ষমতা লেখালেখির শ্রেষ্ঠ সম্পদ, মনের ক্ষুরধারও । মনকে ব্যবহার করে, তার বিভিন্ন দরজা খুলে খুলে সৃষ্টিশীল রচনা নির্মাণ করা হয়েছে যুগে যুগে। সাহিত্যে কল্পনা আর চিন্তন-যুক্তি ব্যবহারকে হালকা করে দেখার উপায় নেই। না-জেনে, না-বুঝে আমরা অনেক পন্ডিত, অনেক সময় বিরূপ কমেন্ট করি। আমার বিশ্বাস হিমু আর মিসির আলীর পাঠকরা অন্য বই পঠনেও উৎসাহী হয়েছে। হিমু আর মিসির আলী পাঠকের পঠনশৈলীকে ঋদ্ধ করেছে। তারাই আর কেবল হুমায়ূনে আটকে থাকেননি। তাদের জন্য খুলে গেছে বিশ্বসাহিত্যের দরজা। মনে রাখা উচিত এ বিশ্লেষণ। আসলে বলতে চেয়েছি যে-উপন্যাস যুক্তিবাদকে উসকে দেয়, কল্পনা-শক্তিকে শাণিত করে, তা আমার আগ্রহের বড় জায়গা দখল করে রাখে। রবীন্দ্র সংগীতে আমরা কল্পনাশক্তির যে ব্যাপক ও উজ্জ্বল আলো দেখি তা অবশ্যই আমাদের অন্তরকে আলোকিত করে। আর তাই রবীন্দ্রসংগীতে বিভোর থাকি। রবীন্দ্রনাথের ' গল্পগুচ্ছ 'আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম এক বই। আমার ডেস্কের সামনে এখনো তার অবস্থান আলো ছড়ায়। 


গল্পপাঠ
আপনার জীবনে উপহার হিসেবে পাওয়া শ্রেষ্ঠ বই কোনটি? 

মোহিত কামাল
 অনেক বই উপহার পেয়ছি। উপহার হিসেবে বই পেতে ভালো লাগে আমার। আনন্দ পাই বই পেলে। বই উপহারও দেই আমি। স্পেনে গিয়ে বুকস্টলে খুঁজলাম একটা বিশেষ বই। সময় হাতে ছিল কম। স্পেনিশ কথাসাহিত্যের স্বরূপ বোঝার জন্য বিশেষ ক্ল্যাসিক বইটা খুঁজে না-পেয়ে ফেরত আসতে হলো। সময়ের অভাবে আর খোঁজার সময়ও পাইনি। এক প্রকাশক বন্ধুও স্বপরিবারে তখন ছিলেন স্পেনে, ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আমি স্পেন আছি জেনে তিনি আমার সঙ্গে মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করলেন। ফিরে যাচ্ছি হতাশা নিয়ে, তাঁকে জানালাম। এটুকু কথায় কাহিনি শেষ হলে ভালো হতো। কিন্তু না। দেশে ফিরে একমাস পর তিনি আমাকে সেই আকাঙ্ক্ষিত বইটি উপহার হিসেবে পৌঁছে দিলেন। বইটির নাম ‘The Aleph, লেখক Jorge Luis Borges, ইংরেজি অনুবাদক Andrew Hurley. 

আর ওই বন্ধুর নাম কামরুল হাসান শায়ক, প্রকাশক, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেড। ভালোবাসা, প্রিয় শায়ক ভাই। শ্রেষ্ঠতম এক আনন্দ আপনি উপহার দিয়েছেন আমাকে। 



গল্পপাঠ
ছোটবেলায় কেমন বই পড়তেন? সেই সময়ে পড়া কোন বই এবং কোন লেখক আপনাকে আজও মুগ্ধ করে রেখেছে? 

মোহিত কামাল
 একদম শিশুকালে যতটুকু মনে আছে, ছড়ার বই পড়তাম। মুখস্থ ছড়া পড়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতাম। আর রোকনুজ্জামান দাদা ভাইয়ের ছড়া তো ছিল প্রাণের সখা। মনে পড়ে: 

‘বাক্ বাক্ কুম পায়রা 
মাথায় দিয়ে টায়রা 
বউ সাজবে কাল কি? 
চড়বে সোনার পালকি?’ 

তাঁর গাধার কান ছড়াটি স্কুল জীবনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অভিনয়ের ভঙ্গিতে আবৃত্তি করে শোনাতাম। এখনও আংশিক মনে আছে: 

একটা দড়ি দুদিক থেকে টানছে দু’দল ছেলে 
তাই না দেখে বনের বানর লাফায় খেলা ফেলে। 
বনের গাধা দাঁড়ায় মাঝে উঁচিয়ে দুটি কান 
বলে, আমার দুদিক থেকে কান ধরে দে টান 
অমনি দু’দল হেঁইয়ো টানে- গাধার বিপদ ভারি 

কান ছিঁড়ে সব হুমড়ি খেয়ে পড়ল সারি সারি… 

‘ঠাকুমার ঝুড়ি’, বাংলা সাহিত্যে folk tales and fairy tales, বিশেষ করে লালকমল, নীলকমল-এর কথা মনে পড়ছে। উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর টুনটুনির বই, কিংবা সুকুমার রায়ের ‘হ য ব র ল’ এসব বইয়ের নাম মনে পড়ল। রূপকথার গল্প - ‘রাজকুমারীর গল্প', 'সিনডারেলা ' পড়েছি। বার বার নিজেকে রাজকুমারের আসনে ভেবে আনন্দ পেতাম। পরবর্তীকালে বড় হয়ে জেনেছি লাল বিহারী দে ১৮৮৩ সনে ‘ফোক টেলস অব বেঙ্গল’ নামক গ্রন্থে রূপকথা আর লোককাহিনি একটা সংকলন করেছিলেন। তার থেকে নানা গল্প নানাভাবে আমাদের শৈশবকে রাঙিয়েছে। কিছু গল্প মুক্তিযুদ্ধের সময় সন্দ্বীপে নানা বাড়িতে চাঁদনি রাতে উঠোনে পাটি বিছিয়ে শুয়ে শুয়ে শুনেছি বড় মামির মুখ থেকে। তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। আবার বড় হয়ে বই থেকেও পড়েছি। মজার ব্যাপার হচ্ছে এখনও পড়ি এসব বই, কাহিনি। স্কুলে পড়ার সময় তো পড়েছি অনেক রূপকথা । পড়েছি রোমেনা আফাজ'ও(২৭ ডিসেম্বর ১৯২৬ - ১২ জুন ২০০৩)। ২০১০ সালে তিনি স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর দস্যু বনহুর সিরিজ - বনহুরের মানবিক কাজ কি নিজের মধ্যে মানবসেবার বীজ বপন করে দিয়েছিল? হয়তো বা, জানি না। তবে গোগ্রাসে গিলতাম ওই সিরিজের কথাচরিত্রের মানবিক কাজগুলো। মনে পড়ে ১৯৭২-৭৫ সাল পর্যন্ত এ সিরিজ মোহগ্রস্ত করেছিল স্কুল জীবনকে। তখনকার সিরিজটি কারা প্রকাশ করেছিল জানি না। পরে বড়োবেলায় দেখলাম দস্যু বনহুর,নাগরিক দস্যু বনহুর, কাপালি ও দস্যু বনহুর একত্র করে প্রকাশ করেছে সালমা বুক ডিপো (১৯১৮)। বইটা সংগ্রহে ছিল,আছে কোথাও বইঘরে। কাজী আনোয়ার হোসেনের কুয়াশা সিরিজ পড়েছি স্কুলে পড়ার সময়। মাসুদ রানা সিরিজও। এখন এর লেখক নিয়ে বিতর্ক চললেও তখন একনামে কাজী আনোয়ার হোসেন ছিলেন আমাদের বইমুখী করে তোলার বৈঠা হাতে বড় মাঝি। 



গল্পপাঠ
এ পর্যন্ত কতগুলো বই অর্ধেক কিংবা পড়া শুরু করে শেষ না করেই ফেলে রেখেছেন? 


মোহিত কামাল
 অসংখ্য । 

গল্পপাঠ
কোন বইগুলোয় আপনি নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন? 

মোহিত কামাল
 নজরুলের শৈশবের বন্ধু শৈলজানন্দের আত্মস্মৃতিমূলক গ্রন্থ ‘কেউ ভোলে না, কেউ ভোলে’ পড়তে গিয়ে চমকে গেছি। আমার জীবনের সঙ্গে বড়ো একটা মিল দেখতে পেয়েছি। এসএসসি পরীক্ষা (১৯৭৬) চলার সময় আমি বাবাকে হারিয়েছিলাম। তারপরে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য ভীষণ কষ্ট করতে হয়েছিল। আমার মা যে কী নিদারুণ কষ্ট করে আমার খরচ জুগিয়েছেন, আমাদের পরিবারটাকে ধরে রেখেছিলেন, তা অল্প কথায় বলা যাবে না। বাবা হারানোর কষ্ট নজরুলের মধ্যেও দেখেছি । শৈশবে বাবাকে হারিয়ে দারিদ্রের কারণে পড়তে না-পারার তীব্র দহনজ্বালায় কী ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল ওই বয়সী বিস্ময়বালক, জেনেছি। সেই বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রাম থেকে সুদূর ত্রিশালের দরিরামপুর নজরুল এসেছিলেন শুধুমাত্র পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার আশায়। নজরুলের এই কষ্ট, জীবনযন্ত্রণার মধ্য নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলাম। পবিত্র সরকারের সিরিজগ্রন্থ ‘অল্প-পুঁজির জীবন’-এর মধ্যেও নিজেকে আবিষ্কার করেছি। 

এখনকার আমার যে সামাজিক অবস্থান তা দেখে কেউ কখনও ভাবতেই পারবেন না বাবা চলে যাওয়ার পর অল্প-পূঁজির জীবনে কী ভয়াবহ কষ্ট-যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে পেরিয়ে আসতে হয়েছে আমাকে, আমাদের পরিবারকে। 



গল্পপাঠ
কোন বইগুলো জীবনে বারবার পড়েছেন এবং আরও বহুবার পুনর্পাঠ করবেন? 

মোহিত কামাল
 'গল্পগুচ্ছ’। রবীন্দ্রনাথের এই গল্পগ্রন্থটি বহুবার পড়েছি। এখনও সুযোগ পেলে মাঝে মাঝে বিশেষ বিশেষ গল্প বাছাই করে পড়ি। পবিত্র সরকারের ‘অল্প-পুঁজির জীবন’ও। যোসে সারামাগো’র ‘ব্লাইন্ডনেস’ও আমার পঠনশৈলীকে ঋদ্ধ করেছে। কয়েকবার পড়েছি। প্রতিবারই নতুন আলো ধরা দেয়। প্রতিবারই কেবল আমাদের চোখের অন্ধত্বে নয়, মনের অন্ধত্বেও আলো ঢেলে দেয়। লেখকসত্তায় মোচড় দেয়। প্রতিবারই সাহিত্যসত্তাকে আবিষ্কার করি। ২০নং প্রশ্নের উত্তরেরও এই অসাধারণ উপন্যাসটি জায়গা পেতে পারে। এই উপন্যাসের কথক, মধ্যবয়সী নারী, ডাক্তারের স্ত্রীর মতে: ‘তারা কেউ কখনো অন্ধ হয়ে যায়নি, বরাবর তারা অন্ধ ছিল, কিন্তু দেখতে পায় এমন আর কি। অন্ধ, যারা দেখতে পায়, তারা আসলে কিছুই দেখে না।; কথাটার আবেদন চিরন্তন। সারামাগোর এই উপন্যাস থেকে কি শিক্ষা নিয়েছে মানুষ? নেয়নি। এই উপন্যাস মূলত উপহাসের চাবুক মারে মানুষের গড়ে তোলা সভ্যতা নামের অপসৌধের ভিত্তিটায়। পর্তুগীজের লেখক যোসে সারামাগো এ উপনাসটির জন্য ১৯৯৮ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন, এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৫ সালে। 


গল্পপাঠ
লেখালেখির নিরন্তর প্রক্রিয়ার সঙ্গে কীভাবে একাত্ম থাকেন? 

মোহিত কামাল
ভোরে ঘুম থেকে উঠে হাতে কলম ধরতে পারলে পুরো দিনটা ভালো কাটে। স্বস্তি দিয়ে শুরু হয় দিন। আর কোনো কারণে দেরিতে উঠলে, টেবিলে বসার সুযোগ না ঘটলে অতৃপ্তি তখন জড়িয়ে থাকে- শান্তি নেই, স্বস্তি নেই, অশান্তি- এসব নেগেটিভ আবেগে ভরে থাকে মন। আর অলসতা গ্রাস করে ফেলে পুরোদিন। লিখতে বসে কোনো আইডিয়া মাথায় এলে, আর ওই বিষয়টা নিয়ে কম জানা থাকলে, সেখানেই লেখা থামিয়ে দেই। প্রাসঙ্গিক বিষয়টা আত্মস্থ করার জন্য বিষয়ভিত্তিক বই খুঁজে পড়ি, অথবা ‘গুগল স্যার’র কাছে হাজির হই। তখন হয়ত সময় পেরিয়ে গেছে, লেখার সুযোগ ঘটল না, তাতেও মন খারাপ হয় না। লেখার সঙ্গে পড়ার একটা মাখামাখি যোগাযোগ থাকায় তখন অস্বস্থি হানা দিতে পারে না মনে। কেন এ মগ্নতা? কেন এ নিরন্তর লেগে থাকা? জানি না। 

ভেতর থেকে ডাক আসে। লিখতে হবে এ তাগিদ আসে কোত্থেকে? 

তাও স্পষ্ট না। তবে পরিবেশ একটা বড় বিষয়। পারিবারিক সাপোর্টও। হয়তো লিখছি। মাথাগুঁজে লিখছি। হঠাৎ দেখলাম টেবিলে হাজির হয়েছে গ্রীন টি, লেবু চা আর দুটো টোস্ট বিস্কিট। ধোয়ায় ওড়ানো কাপের দিকে একবার হয়তো তাকিয়েছি। লেখার মগ্নতা শেষ তখনও হয়নি। আর তাই কাপ থেকে চোখ ফিরিয়ে নেই। এই তো, ওটুকু লেখা শেষ করে কাপে চুমুক দিব ভাবতে ভাবতে ভুলে যাই চায়ের কথা। কাপ ঠান্ডা হয়ে যায়। হয়তো কিছুক্ষণ পর দেখি কাপটা নেই। আরেক কাপ গরম চা এসে গেছে। তখন কাপটাকে সমাদর করতে হয়। চুমুক দিতেই হয় কাপে। লেখায় মগ্নতার সময় বিশেষ করে অফিস ছুটির দিন, কেউ না-জানিয়ে বাসায় এলে ভীষণ চাপে পড়ে যাই। মন খারাপ হয়ে যায়। হয়তো আপন কেউ এসেছে, কোনো স্বজন বা বন্ধু এসেছে- টেবিল ছেড়ে উঠতেই হয়। মন খারাপ আর বিরক্তি নিয়ে উঠি। আবার যখন তাদের সামনে যাই, হইচইয়ের মধ্যে উড়ে যায় মন খারাপের ঠুনকো ময়লা, আনন্দে ঝলমল করতে থাকি। ছুটিছাটায় সবাই বাইরে যাওয়ার প্রোগ্রাম করে। বাইরে যেতে হয়। আচমকা কোনো অনুষ্ঠানে যাওয়ার প্রয়োজন হলেও মনে চাপ পড়ে। লেখা আর পড়া ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে না। তবু তো যেতে হয়। আর এ কারণে আমার ঘর ভাবে, বন্ধুরাও, আমি বেশ অসামাজিক। বেশি স্বার্থপর। এমনও ভাবে। হয়তো বা কথাটা ঠিক। তবে এর আড়ালে লুকিয়ে আছে সময়টাকে লেখাঝোকায় ব্যয় করার গোপন প্রণোদনা। কিন্তু পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী কোনো সফরসূচি থাকলে, অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার কথা থাকলে, প্রাণের উচ্ছাসে যেতে পারি। বহু সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞের সঙ্গে এর কারণে যুক্ত থাকছি। থাকতে পারি। 


গল্পপাঠ
কে সেই লেখক যাকে আপনি পাঠ করেন গভীর আনন্দের সঙ্গে, যিনি আপনার ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেন? 

মোহিত কামাল
রবীন্দ্রনাথ। 'গল্পগুচ্ছ'। আর রবীন্দ্রসংগীতের মর্মকথা প্রাণে কেবল বাজে না। এর ভেতরের কথা আমাকে বেশি প্রভাবিত করে। আর ‘গল্পগুচ্ছ’ তো জীবনের বিরাট অংশ ও সময় দখল করে নিয়েছে। 'পোস্টমাস্টার' গল্পের রতনের সেই কষ্টগাথা বুকে হু হু কান্নার রোল তুলতো কৈশোরে। এখনও যখন পড়ি, অনুভব করি, রতনের মনের ভেতর মোচড় দেওয়া কষ্টটা। পোস্টমাস্টার নৌকায় পাল তুলে চলে যাচ্ছেন। আর রতন বাড়ির চারপাশে ঘুরছে। তার কোমল বুক ভেঙে যাচ্ছে- বাবু ফিরে আসবেন এ আশা করছে। একদিকে পোস্টমাস্টারের চলে যাওয়া, আরেক দিকে বালিকার শুদ্ধ আশা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম একটা ইমোশনাল এপিসোড । আবেগ প্রকাশের এমন দুর্মর বাস্তবচিত্র, এত শৈল্পিক প্রকাশ বিশ্বসাহিত্যে বিরল। অনেকে মনে করেন ‘সস্তা আবেগ’ দিয়ে কোনো সাহিত্য রচিত হলে সেটা হয় জনপ্রিয় সাহিত্য, হালকা সাহিত্য, মূল্যহীন সাহিত্য। তারা জানেন না সস্তা আবেগ বলে কোনো শ্রেণিবিন্যাস নেই মনস্তত্ত্বে। আবেগের প্রকাশভঙ্গিটা সস্তা হতে পারে। আবেগ সস্তা নয়। তার প্রমাণ 'গল্পগুচ্ছ'। আমরা বার বার, অসংখ্য ঘটনা-অনুঘটনায় দেখব আবেগের শৈল্পিক প্রকাশের চিত্র। সাহিত্য তাই শিল্প, সাহিত্য জীবনখোঁড়া বিজ্ঞানও। সাহিত্যের সেই শিল্প-বিজ্ঞানও পেয়ে থাকি গল্পগুচ্ছে। 'সমাপ্তি' কিংবা 'কাবুলিওয়ালা' কিংবা 'হৈমন্তী' গল্পসহ অসংখ্য গল্পে মানুষের জীবনের কোমল অনুভূতি নিয়ে শৈল্পিক খেলা খেলেছেন রবীন্দ্রনাথ। যেমনটি খেলেছেন তাঁর সংগীতে। 



গল্পপাঠ
গল্প লিখতে শুরু করেন কীভাবে? একজন রিপোর্টারের মতোই কি আপনি চারপাশটাকে অবিরাম পর্যবেক্ষণে রাখেন? আপনি কি নোট নেন? 

মোহিত কামাল
মানবকণ্ঠ নামক একটা দৈনিক পত্রিকার শেষ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত সংবাদে একবার দেখলাম এক কৃষক হাইওয়েতে বসে আছে ধান বিক্রির আশায়। মধ্যস্বত্তভোগী মহাজন ধানের মূল্য কমিয়ে দিয়েছে। অসহায় কৃষকদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। ন্যায্যমূল্য পাওয়ার আশায় তারা সংঘবদ্ধ হচ্ছে। নিউজটা আমাকে চমকে দিল। কলম নিয়ে বসে গেলাম। রোলটানা কাগজের পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ভরে গেল বলপেনের আঁচড়ে। ‘মোড়া’ গল্পটা এভাবে লেখা হয়ে গেল। আগে ভাবিনি যে এমন গল্প লিখব। লিখে ফেললাম। অনেকের মন্তব্য আমার শ্রেষ্ঠ গল্পগুলোর একটা হয়ে গেছে। এটা আমার ‘নেতার আসন গ্রহণ’ গল্পগ্রন্থে নামভূমিকার গল্প হিসেবে সংকলিত হয়েছে। এই নেতা মাটির ঘ্রাণ শুঁকে জীবনপার করা এক কৃষাণীর মনের নেতা। তাঁর স্বামী। কৃষাণী অন্তরের ভালোবাসার গিঁটে গিঁট চালিয়ে বেত দিয়ে নির্মাণ করে একটা মোড়া। সেই মোড়ায় সে স্বামীকে বসিয়ে ভালোবাসার বিজয়কেতন ওড়ায়। 

কোনো কোনো ঘটনা, বিষয় আচম্বিত বুকে নাড়া দেয়। গল্পলেখার পোকাটা তখন টেবিলে টানে। লিখতে শুরু করি। ঘটনাটা অন্তর দিয়ে অনুভব করতে হয়। পরিস্থিতি, পরিবেশকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হয়। এটা ইচ্ছাকৃত পর্যবেক্ষণ না । স্বতঃস্ফূর্ত পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা যার যত বেশি তিনি তত বেশি সাহিত্যকে জীবনঘনিষ্ঠ করে তুলতে পারেন। যা দেখছে, তাই লিখছে, যা ঘটছে তা তুলে ধরছে রিপোর্টার। সাহিত্যিকরা তা করলে তার সৃষ্টিকে শিল্পমানের সাহিত্য বলা যাবে না। সাহিত্যে লেখকের কল্পনাযুক্ত হয়, মেধা যুক্ত হয়, সৃষ্টিশীলতা যুক্ত হয়। বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা যুক্ত হয়, সমস্যা সৃষ্টি ও সমস্যা সমাধানের ক্ষমতাও । তবেই হবে সেটা শিল্পমানের সাহিত্য। কেবল চোখ দিয়ে নয়, অন্তরের আলোয়ও পর্যবেক্ষণ করতে হয়: Perception by five sensory organs and pyception by mind ( without sensory organ) is totally different. রিপোর্টাররা চোখ দিয়ে দেখেন, কান দিয়ে শোনেন। তাদের ক্ষমতা সেখানে শেষ। সেই সীমা অতিক্রম করলে তাকে ভালো রিপোর্টার বলা যাবে না। অতিরঞ্জনের অপরাধে সে রিপোর্ট খারাপ হতে বাধ্য। সাহিত্যিক সীমা লঙ্ঘন করবেন। কল্পনাজগতে ওড়াউড়ি করবেন। কিন্তু চিন্তনের সঙ্গে তার একটা সংযোগ থাকবে, আবেগের সঙ্গেও। অন্তর্গত প্রেষণাও এখানে বড় ভূমিকা রাখে। সব মিলিয়ে সাহিত্যে লেখা হয় জীবন, জীবনের বোধ-বুদ্ধি অনুভবের কথা। আমি এই মতবাদে বিশ্বাসী। নিজে কতটুকু নির্মাণ করতে পেরেছি বা পারব, জানি না। তবে আমি মনে করি সাহিত্য অনেক উঁচুমানের সৃষ্টিশীল কাজ, সৃজনকর্ম-শিল্প। মনে হয়, বিশ্বাসও করি, সাহিত্যিক একজন বিজ্ঞানীও। 


গল্পপাঠ
লেখালেখির সবচেয়ে কঠিন দিক হিসেবে কোনটিকে চিহ্নিত করবেন? 

মোহিত কামাল
 নিজের সাহিত্যসত্তাকে লালন করা, ধারণ করা, পরিচর্যা করা কঠিন কাজ। সাহিত্যসত্তা একদিনে গড়ে ওঠে না। এটার বীজ রোপিত হয়ে যায় শিশুকালে। কাদামাটি বয়সে যে-ছাপ পড়ে তা ক্রমে ক্রমে বিকশিত হয়। সেটার আলোর প্রভা স্থায়ী, দীর্ঘমেয়াদি। চলমান জীবনের পথে পথে তা বাধার সামনে পড়বে। বাধা টপকিয়ে সেই সত্তাকে টেনে নিয়ে চলা চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। কেউ সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জয়ী হয়। কেউ হেরে যায়। কেউ সাহিত্যিক হয়ে জন্মায় না। তাঁকে নিজের গুণেই সাহিত্যিক হতে হয়। সেই গুণের ছটা যখন ছড়াতে থাকবে, চারপাশ থেকে তখন ধেয়ে আসবে কটুকথার বান। হিংসা-ঈর্ষার বিষ-তীর ছুটে আসতে থাকবে সমকালীন লেখকদের দীনতা থেকে। তা বিষ-পিঁপড়ার মতো কামড়াতে থাকবে আলো-ছড়ানো উঠতি সাহিত্যিকের মন-দেহ। সে দহন-জ্বালা মোকাবিলা করে, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, অবহেলা-অপমান সয়ে সয়ে এগোতে হয় লেখককে। সবকিছুর পরও নিজের কাজে ঘোরমগ্ন থাকলে, সৃষ্টিশীলতা তাকে টেনে তুলবেই। কটুকথা, সিনিয়রদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, অপমান গায়ে না-মেখে সম্পাদক প্রকাশকের হুল ফোটানো কথা উপেক্ষা করে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি একজন লেখকের লেখক হয়ে ওঠার বড়ো রসদ। একই সঙ্গে প্রয়োজন ভালো পরামর্শ, গাইড। অনুভূতিশীল একজন অগ্রজ, অনুজের যাত্রাপথকে সহজ করে দিতে পারেন, অভিজ্ঞতার আলোয় লেখকের ভুলভ্রান্তি ধরিয়ে দিয়ে উৎসাহ দিতে পারেন। নিজের লেখার ভুল নিজে ধরতে পারা ভালো গুণ। সেই গুণ না-থাকাও সাহিত্য নির্মাণের পথে একটা বড় বাধা বলে চিহ্নিত করেছি আমি। 

                                                                

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

5 মন্তব্যসমূহ

  1. মোহিত কামালের অনেক কথা জানতে পারলাম। সাহিত্য-সমালোচক বলতে তিনি যাদের কথা বলেছেন, তাঁদের মধ্যে ২জন বাদে অন্যরা তো পুস্তক-সমালোচক। এই অংশের সঙ্গে আমার ভিন্নমত। প্রকৃত সাহিত্য-সমালোচকদের কথা তিনি বলেননি। আর সব বিষয় তো তাঁর নিজের উপলব্ধি! ভাল লাগলো সেসব জেনে। অভিনন্দন গল্পপাঠ ও মোহিত কামালকে।

    উত্তরমুছুন
  2. অনিন্দ্য সুন্দর এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটি অনেক মনোযোগ সহকারে পড়লাম।'গল্পপাঠ' এ প্রকাশিত কথাসাহিত্যিক মোহিত কামালের সাহিত্য পাঠ ও লেখালেখি বিষয়ক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন এমদাদ রহমান।
    তিনি জীবনকে কীভাবে দেখেছেন এবং উপলব্ধি করে তাঁর সাহিত্যের উপকরণ বা বিষয়বস্তুতে রূপান্তরিত করেছেন;তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিষয়গুলো দীর্ঘ কলেবরের সাক্ষাৎকারটির মাধ্যমে ফুটে উঠেছে।কীভাবে একজন মনোশিক্ষাবিদ সাহিত্যিক হয়ে উঠলেন এবং কীভাবে তাঁর মননে সাহিত্য বীজ বপন করে ছোটবেলা থেকেই সাহিত্যানুরাগী বানানো হয়েছে;কার কার থেকে বেশি অনুপ্রাণিত হয়েছেন এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন এসব কিছুই এখানে তুলে ধরা হয়েছে।
    কচি-কাঁচার মেলার পরিচালক রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই এর নাম এবং বাংলার শিক্ষক আলী আকবর স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশও দেখা যায়।ছোটবেলায় স্যারের কাছ থেকেই নজরুলের কথা শুনে তাঁকে হৃদয়ে ধারণ করে লিখে ফেলেছেন কিশোর উপন্যাস 'দুখু' ; 'দুখু-দ্বিতীয় খণ্ড' এবং দুই খণ্ডকে একত্র করে 'দুরন্ত দুখু' আনিন্দ প্রকাশ বের করেছেন বই তিনটি।
    এই সাক্ষাৎকার থেকে আরও জানলাম তাঁর সম্পাদক হওয়ার আকাঙ্ক্ষার সুপ্ত বীজ বপনের কথা।মূলত কচি-কাঁচার মেলার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই আর নজরুলের 'ধূমকেতু' পত্রিকা তাঁর মনে সম্পাদক হওয়ার একটা জোরালো আকাঙ্ক্ষার বীজ বপন করে দিয়েছিল।বর্তমানে তিনি 'শব্দঘর' নামক মাসিক সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক।
    তিনি লেখার রসদ পেয়েছেন ছোট বেলায় পুঁতে রাখা বীজের অঙ্কুর থেকে।এছাড়াও তাঁর সাহিত্যানুরাগী হওয়ার পেছনে রবীন্দ্রনাথ,নজরুল,সুফিয়া কামালের লেখা তাঁর ছোটবেলাকে সাহিত্যের রঙে রাঙিয়ে দিয়েছিল।
    জানতে পারি তাঁর সুশৃঙ্খল প্রাত্যহিক জীবনযাপন সম্পর্কে।করোনাকালে তিনি পড়ছেন পাঞ্জেরী থেকে প্রকাশিত ড.মোহাম্মদ আমীনের লেখা বাংলা ভাষার মজা ও ব্যবহারিক প্রমিত বাংলা বানান সমগ্র।পড়ছেন ভাষারীতি-প্রথমা প্রকাশনের।এছাড়াও প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের বিভিন্ন লেখকদের পাঠক সমাদৃত বইসমূহ।

    কোন বইগুলো আমাদের পড়া উচিৎ সেগুলো পাঠকের সামনে খুব গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেছেন।তাঁর প্রিয় লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় সেটা আমরা সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে জানতে পারলাম।এছাড়াও তাঁর কথায় নানা গল্পকার,প্রাবন্ধিক,সাহিত্য-সমালোচক বা বিশ্লেষক এবং কবিদের নামও উঠে এসেছে।
    লিখতে যেয়ে তিনি সমস্ত প্রাসঙ্গিক বই হাতের কাছে এনে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেন।শব্দের ক্ষেত্রে তিনি সংস্কৃত,তৎসম,তদ্ভব থেকে প্রমিত বাংলার সহজ রূপটা বেশি পছন্দ করেন এবং তার প্রয়োগ ঘটান।বইকে যে তিনি সন্তানের মতন বুকে আগলে রাখেন এবং তাদেরও একটা গন্ধ পান,অলৌকিক সে গন্ধ এ সমস্ত আবেগঘন কিছু মুহূর্তের কথা এখানে উঠে এসেছে।
    তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ বই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পগুচ্ছ। এছাড়াও শ্রেষ্ঠ উপহার পেয়েছিলেন পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিঃ এর প্রকাশক কামরুল হাসান শায়ক এর কাছ থেকে।
    নজরুলের শৈশবের বন্ধু শৈলজানন্দের আত্মস্মৃতিমূলক গ্রন্থ 'কেউ ভোলে না,কেউ ভোলে' পড়তে গিয়ে নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন।পবিত্র সরকারের সিরিজ গ্রন্থ 'অল্প-পুঁজির জীবন' এর মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করেছেন।নিজের সংগ্রামমুখর জীবনের সাথে মিল পেয়েছেন।
    মূলত দীর্ঘ কলেবরের এই সাক্ষাৎকারে ফুটে উঠেছে একজন কথাসাহিত্যিক এর জীবনদর্শন এবং তাঁর লেখক হয়ে ওঠার গল্প।লেখকের ভালো লাগা,মন্দ লাগার বিষয়গুলো সূক্ষাতিসূক্ষ ভাবে তুলে ধরা হয়েছে।তাঁর বইয়ের সংখ্যা এবং জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হওয়া থেকে অমূল্য এই সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তাঁর সম্পর্কে অজানা অনেক তথ্য জানতে পারলাম।ধন্যবাদ স্যার আপনাকে।শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা অশেষ।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. দীর্ঘ কলেবরের এই সাক্ষাৎকারে অনেক কিছু জানতে পারলাম। একজন কথাসাহিত্যিক এর জীবনদর্শন,তার লেখক হয়ে ওঠার গল্প,সে কিভাবে তার প্লটগুলোকে সাহিত্যের বুনিয়াদ দিয়ে গল্প, উপন্যাস লিখেন তা এই সাক্ষাৎকারে ফুটে উঠেছে। লেখকের ভালো লাগা, মন্দ লাগা এই বিষয়গুলো প্রতিভাত হয়েছে। যারা আপনার লিখা পড়েনি, তারা যদি এই লিখাটি পড়ে তাহলে তারাও উপকৃত হবে। শুভকামনা রইলো আপনার জন্য।

      মুছুন
  3. অনিন্দ্য সুন্দর এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটি অনেক মনোযোগ সহকারে পড়লাম।'গল্পপাঠ' এ প্রকাশিত কথাসাহিত্যিক মোহিত কামালের সাহিত্য পাঠ ও লেখালেখি বিষয়ক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন এমদাদ রহমান।
    তিনি জীবনকে কীভাবে দেখেছেন এবং উপলব্ধি করে তাঁর সাহিত্যের উপকরণ বা বিষয়বস্তুতে রূপান্তরিত করেছেন;তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিষয়গুলো দীর্ঘ কলেবরের সাক্ষাৎকারটির মাধ্যমে ফুটে উঠেছে।কীভাবে একজন মনোশিক্ষাবিদ সাহিত্যিক হয়ে উঠলেন এবং কীভাবে তাঁর মননে সাহিত্য বীজ বপন করে ছোটবেলা থেকেই সাহিত্যানুরাগী বানানো হয়েছে;কার কার থেকে বেশি অনুপ্রাণিত হয়েছেন এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন এসব কিছুই এখানে তুলে ধরা হয়েছে।
    কচি-কাঁচার মেলার পরিচালক রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই এর নাম এবং বাংলার শিক্ষক আলী আকবর স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশও দেখা যায়।ছোটবেলায় স্যারের কাছ থেকেই নজরুলের কথা শুনে তাঁকে হৃদয়ে ধারণ করে লিখে ফেলেছেন কিশোর উপন্যাস 'দুখু' ; 'দুখু-দ্বিতীয় খণ্ড' এবং দুই খণ্ডকে একত্র করে 'দুরন্ত দুখু' অনিন্দ্য প্রকাশ বের করেছেন বই তিনটি।
    এই সাক্ষাৎকার থেকে আরও জানলাম তাঁর সম্পাদক হওয়ার আকাঙ্ক্ষার সুপ্ত বীজ বপনের কথা।মূলত কচি-কাঁচার মেলার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই আর নজরুলের 'ধূমকেতু' পত্রিকা তাঁর মনে সম্পাদক হওয়ার একটা জোরালো আকাঙ্ক্ষার বীজ বপন করে দিয়েছিল।বর্তমানে তিনি 'শব্দঘর' নামক মাসিক সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক।
    তিনি লেখার রসদ পেয়েছেন ছোট বেলায় পুঁতে রাখা বীজের অঙ্কুর থেকে।এছাড়াও তাঁর সাহিত্যানুরাগী হওয়ার পেছনে রবীন্দ্রনাথ,নজরুল,সুফিয়া কামালের লেখা তাঁর ছোটবেলাকে সাহিত্যের রঙে রাঙিয়ে দিয়েছিল।
    জানতে পারি তাঁর সুশৃঙ্খল প্রাত্যহিক জীবনযাপন সম্পর্কে।করোনাকালে তিনি পড়ছেন পাঞ্জেরী থেকে প্রকাশিত ড.মোহাম্মদ আমীনের লেখা বাংলা ভাষার মজা ও ব্যবহারিক প্রমিত বাংলা বানান সমগ্র।পড়ছেন ভাষারীতি-প্রথমা প্রকাশনের।এছাড়াও প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের বিভিন্ন লেখকদের পাঠক সমাদৃত বইসমূহ।

    কোন বইগুলো আমাদের পড়া উচিৎ সেগুলো পাঠকের সামনে খুব গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেছেন।তাঁর প্রিয় লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় সেটা আমরা সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে জানতে পারলাম।এছাড়াও তাঁর কথায় নানা গল্পকার,প্রাবন্ধিক,সাহিত্য-সমালোচক বা বিশ্লেষক এবং কবিদের নামও উঠে এসেছে।
    লিখতে যেয়ে তিনি সমস্ত প্রাসঙ্গিক বই হাতের কাছে এনে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেন।শব্দের ক্ষেত্রে তিনি সংস্কৃত,তৎসম,তদ্ভব থেকে প্রমিত বাংলার সহজ রূপটা বেশি পছন্দ করেন এবং তার প্রয়োগ ঘটান।বইকে যে তিনি সন্তানের মতন বুকে আগলে রাখেন এবং তাদেরও একটা গন্ধ পান,অলৌকিক সে গন্ধ এ সমস্ত আবেগঘন কিছু মুহূর্তের কথা এখানে উঠে এসেছে।
    তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ বই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পগুচ্ছ। এছাড়াও শ্রেষ্ঠ উপহার পেয়েছিলেন পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিঃ এর প্রকাশক কামরুল হাসান শায়ক এর কাছ থেকে।
    নজরুলের শৈশবের বন্ধু শৈলজানন্দের আত্মস্মৃতিমূলক গ্রন্থ 'কেউ ভোলে না,কেউ ভোলে' পড়তে গিয়ে নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন।পবিত্র সরকারের সিরিজ গ্রন্থ 'অল্প-পুঁজির জীবন' এর মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করেছেন।নিজের সংগ্রামমুখর জীবনের সাথে মিল পেয়েছেন।
    মূলত দীর্ঘ কলেবরের এই সাক্ষাৎকারে ফুটে উঠেছে একজন কথাসাহিত্যিক এর জীবনদর্শন এবং তাঁর লেখক হয়ে ওঠার গল্প।লেখকের ভালো লাগা,মন্দ লাগার বিষয়গুলো সূক্ষাতিসূক্ষ ভাবে তুলে ধরা হয়েছে।তাঁর বইয়ের সংখ্যা এবং জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হওয়া থেকে অমূল্য এই সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তাঁর সম্পর্কে অজানা অনেক তথ্য জানতে পারলাম।ধন্যবাদ স্যার আপনাকে।শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা অশেষ।

    উত্তরমুছুন
  4. খুব চমৎকার! পড়ে বেশ উপকৃত হলাম। একজন লেখকের ভিতর-বাহির, পাঠ ও সৃষ্টি, আত্মনির্মাণের প্রক্রিয়া আর জীবনের খুঁটিনাটি। কথা গ্রহীতা ও দাতাকে সবুজ সেলাম।

    উত্তরমুছুন