কুসুরগুড়ের বৈয়ামে খানিক পানি ভরে বৈয়ামের মুখ বন্ধ করে ভাল মত ঝাঁকিয়ে আবার গ্লাসে ঢেলে নেয় ফজর আলী।বৈয়ামের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে কাচিয়ে কুচিয়ে যেটুকু গুড় পাওয়া গেছে তাতে একগ্লাস সরবত ও ঠিকমতো মিষ্টি হচ্ছিল না দেখে অগত্যা বৈয়াম ধুয়ে নেওয়ার এই কৌশল ।একটু বাদেই মাগরিবের আজান দেবে।মাসখানেক পর আজ দুপুরে সে শূন্যহাতে বাড়ি ফিরেছে।ছেলেদুটো তাকে দেখে দৌড়ে গিয়ে 'আব্বায় আইছে,আব্বায় আইছে 'বলে জড়িয়ে ধরেছিল কিন্তু তাদের হাতে দেওয়ার জন্য সামান্য চকলেট, বিস্কুটও ছিল না সাথে।
অন্যবার কিছু না কিছু হাতে করে আনে ,ছেলেদুটো সেই আশাতেই দৌড়ে এসেছিল কিন্তু এবারের কথা আলাদা । কোন রকমে জান নিয়ে পালিয়ে আসতে পেরেছে সেটাই ভাগ্য নাহলে হয়তো এতক্ষণে তার লাশ ভাসতো কালিগঙ্গার জলে।গিলন্ডো থেকে তরা ব্রীজ পর্যন্ত পথটুকু রাতের অন্ধকারে হেঁটে কোথাও বা ঝোপের আড়ালে গা ঢাকা গিয়ে পরিস্থিতি আঁচ করে আবার হেঁটে ভোরের দিকে ব্রীজের গোড়ায় এসে আরিচাগামী বাসে উঠে বরংগাইল বাসস্ট্যান্ডে নেমেছিল,সেখান থেকে ট্যাম্পুতে করে ঘিওর বাজারে এসে নিজের দোকানে ঢুকে ঝাপ বন্ধ করে কতক্ষণ শুয়ে টুয়ে থেকে দুপুরে বাড়ি ফিরেছে।ভেবেছিল পোয়াতি বউ হয়তো রোজা রাখতে পারছে না ,তাছাড়া ছেলেদের জন্য হলেও ঘরে ভাত-তরকারি রান্না করা থাকবে সেখান থেকে ঠিকই কিছু না কিছু খাবার জুটে যাবে কিন্তু বাড়িতে পা রেখেই টের পেয়েছে পরিস্থিতি ভীষণ থমথমে।বৌ যেন বটিতে শান দিয়েই রেখেছে যেকোনো ছুতায় ঝুপ করে কোপ বসিয়ে দেবে!যেভাবে চোখ পাকিয়ে তাকাচ্ছিল তাতে মনেহল গত রাতের ঘটনা বুঝি এরই মধ্যে সব জেনে ফেলেছে।জানতেও পারে,অসম্ভব কিছু না ।এই মেয়ের মাথায় জটা আছে।যেখানে যত গোপনেই সে যাকিছু করে না কেন কীভাবে যেন এই মেয়ে বাতাসের বেগে সব জেনে যায় ।সবখানেই কী তার চর আছে?তাকে খবরাখবর জানিয়ে দেয়? তা কীভাবে সম্ভব?অতএব মাথায় জটা আছে এটাই সত্য।দুপুরে ছেলেদুটো ভাতের জন্য কান্না শুরু করলে তাদের বেদম মারতে দেখে ফজর আলী সতর্ক হয়ে গেছিলো।কোন উচ্চবাচ্য না করে ক্ষুধার কথা গোপন রেখে রোজার ভান ধরেছিল।ইফতারের আর বেশি দেরি নাই দেখে কলপাড় থেকে ওজু করে টুপি মাথায় দিয়ে ঘরের মেঝেতে পাটি পেতে বসেছে ।তারের মিটসেফ খুঁজে ছোট একটা প্লাস্টিকের কৌটায় মুঠোখানি পুতিয়ে যাওয়া চানাচুর পেয়েছে আর এই সামান্য গুড়।এই দিয়েই এখনকার মতো কাজ চালিয়ে দিতে হবে তারপর দেখা যাক রাতে কী হয়, এরকম ভাবনা মাথায় নিয়ে শরবতের গুড়টা চামচ দিয়ে নাড়তে থাকে সে ।বাবাকে অনুকরণ করে সাড়ে পাঁচ আর চার বছরের ছেলেদুটোও কলপাড় থেকে হাত পা পানি দিয়ে ভিজিয়ে এসে বাবার পাশে বসে ।
অন্যবার কিছু না কিছু হাতে করে আনে ,ছেলেদুটো সেই আশাতেই দৌড়ে এসেছিল কিন্তু এবারের কথা আলাদা । কোন রকমে জান নিয়ে পালিয়ে আসতে পেরেছে সেটাই ভাগ্য নাহলে হয়তো এতক্ষণে তার লাশ ভাসতো কালিগঙ্গার জলে।গিলন্ডো থেকে তরা ব্রীজ পর্যন্ত পথটুকু রাতের অন্ধকারে হেঁটে কোথাও বা ঝোপের আড়ালে গা ঢাকা গিয়ে পরিস্থিতি আঁচ করে আবার হেঁটে ভোরের দিকে ব্রীজের গোড়ায় এসে আরিচাগামী বাসে উঠে বরংগাইল বাসস্ট্যান্ডে নেমেছিল,সেখান থেকে ট্যাম্পুতে করে ঘিওর বাজারে এসে নিজের দোকানে ঢুকে ঝাপ বন্ধ করে কতক্ষণ শুয়ে টুয়ে থেকে দুপুরে বাড়ি ফিরেছে।ভেবেছিল পোয়াতি বউ হয়তো রোজা রাখতে পারছে না ,তাছাড়া ছেলেদের জন্য হলেও ঘরে ভাত-তরকারি রান্না করা থাকবে সেখান থেকে ঠিকই কিছু না কিছু খাবার জুটে যাবে কিন্তু বাড়িতে পা রেখেই টের পেয়েছে পরিস্থিতি ভীষণ থমথমে।বৌ যেন বটিতে শান দিয়েই রেখেছে যেকোনো ছুতায় ঝুপ করে কোপ বসিয়ে দেবে!যেভাবে চোখ পাকিয়ে তাকাচ্ছিল তাতে মনেহল গত রাতের ঘটনা বুঝি এরই মধ্যে সব জেনে ফেলেছে।জানতেও পারে,অসম্ভব কিছু না ।এই মেয়ের মাথায় জটা আছে।যেখানে যত গোপনেই সে যাকিছু করে না কেন কীভাবে যেন এই মেয়ে বাতাসের বেগে সব জেনে যায় ।সবখানেই কী তার চর আছে?তাকে খবরাখবর জানিয়ে দেয়? তা কীভাবে সম্ভব?অতএব মাথায় জটা আছে এটাই সত্য।দুপুরে ছেলেদুটো ভাতের জন্য কান্না শুরু করলে তাদের বেদম মারতে দেখে ফজর আলী সতর্ক হয়ে গেছিলো।কোন উচ্চবাচ্য না করে ক্ষুধার কথা গোপন রেখে রোজার ভান ধরেছিল।ইফতারের আর বেশি দেরি নাই দেখে কলপাড় থেকে ওজু করে টুপি মাথায় দিয়ে ঘরের মেঝেতে পাটি পেতে বসেছে ।তারের মিটসেফ খুঁজে ছোট একটা প্লাস্টিকের কৌটায় মুঠোখানি পুতিয়ে যাওয়া চানাচুর পেয়েছে আর এই সামান্য গুড়।এই দিয়েই এখনকার মতো কাজ চালিয়ে দিতে হবে তারপর দেখা যাক রাতে কী হয়, এরকম ভাবনা মাথায় নিয়ে শরবতের গুড়টা চামচ দিয়ে নাড়তে থাকে সে ।বাবাকে অনুকরণ করে সাড়ে পাঁচ আর চার বছরের ছেলেদুটোও কলপাড় থেকে হাত পা পানি দিয়ে ভিজিয়ে এসে বাবার পাশে বসে ।
-----আব্বা,শরবত কী মিডা অইছে?
-----না,পানছা।
-----খাইয়া দেহি?বেশি না,দুইজন দুই চুমুক খামু।
----তোরা এহন যা এইহান থিকা।ইসতার খুইলা নই, পরে তগো চিড়্যাখানার বাঘের গপ্পো হুনামু।ইয়া বড় বাঘ, বিশাল বিশাল দাঁত।যা এহন ।
----- ঐ চানাচুর কী আপনে খাইবেন?হেইদিন আমি খাইতে চাইছিলাম, মায় কইছে ওইগুলাতে চ্যালাচুরা পায়খানা করছে ।খাইলে প্যাটখারাপ অইবো।
-----আইচ্ছা খামুনা, যা ।
---- শরবতটা এট্টু চুমুক দিয়া যাই, আব্বা?
ফজর আলী চোখ গরম করে,তা দেখে দমে গিয়ে বড়টা ছোট ভাইয়ের হাত ধরে টেনে সরিয়ে নিতে চায় ।চল যাইগা, আব্বায় রাগ অইছে।ইসতার খুইলা নোক পরে আইসা বাঘের গপ্পো হুনমুনে।অনিচ্ছায় উঠে আসতে গিয়ে পাটির কোনায় ছোটটার পা বেঁধে গিয়ে হোঁচট খায় আর সাথে সাথে শরবতের গ্লাসটা ঢেলে মাটিতে পড়ে যায় ।ঘটনার আকর্ষিকতায় ভীত হয়ে দুই ভাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করে ।ফজর আলী ওদের ঘাড় চেপে ধরে সমানে চড় থাপ্পড় মারতে থাকে ।কুত্তার বাচ্চা..এই আখাইক্ক্যার বাচ্চাগুলারে জন্ম দেওয়াই আমার ভুল অইছে।ইচ্ছা করে মাটির তলে পুইতা থুই। খালি বৈয়াম, পড়ে থাকা গ্লাসসহ পাটিটাতে সজোরে লাত্থি মেরে, হ্যাঁচকা টানে টুপিটা মাথা থেকে ছুঁড়ে ফেলে ঘর থেকে হনহনিয়ে বেরিয়ে যায় সে।
মাঝারি উচ্চতা,ময়লা ধাঁচের গায়ের রংয়ের ফজর আলীর বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি ।কিন্তু সরকারি রাস্তায় দুরমুজ পিটিয়ে যেমন ইট-সুরকি সমান করা হয় তেমনি একহারা পেটানো শরীরের লোকটাকে দেখলে বড়জোর পঁয়ত্রিশ, চল্লিশের স্বাস্থ্যবান পুরুষ বলে ভুল করে সবাই ।একমাথা কোঁকড়া চুলের বাহারি বাবড়ি আর ঠোঁটের উপর পুরু গোঁফ তার চেহারায় বাড়তি একটা তরতাজা ভাব এনে দিয়েছে। ঘিওর বাজারে বেশ কয়েকটা সাইকেল রিকশার পার্টস বিক্রির দোকান থাকলেও তার দোকানেই ভীর বেশি।এই ভীরের সবাই অবশ্য ক্রেতা-খদ্দের এমন না,বেশির ভাগই নিছক আড্ডা লোভী অলস মানুষ ।
সে নিজে পান-বিড়ি আসক্ত , তার দোকানে আসলে মুফতে চা-পান-বিড়ি পাওয়া যায় উপরন্তু নানান আজগুবি খবরাখবর,মেয়ে মানুষ নিয়ে রসাত্নক আলাপ সালাপ শোনা কার না ভাল লাগে তাই দোকানের বড় কাঁচের বাক্সের ওপাশে দুটো কাঠের বেঞ্চে সবসময়ই লোক ঠাসাঠাসি ।কাঁচের বাক্সের ভিতরে বেয়ারিং,বেল, সিটবল,টিউব,স্পোক ইত্যাদি ছোট খাট পার্টস সাজানো।দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা আছে টায়ার, পাম্পার ইত্যাদি ।কারো চাকার হাওয়া চলে গেলে সে যদি নিজে পাম্পার দিয়ে হাওয়া দেয় তাহলে একরকম চার্জ আর ফজর আলী পাম্প করে হাওয়া দিলে আরেক রকম চার্জসহ সকল পার্টসের লেমিনেশন করা মূল্য তালিকাটা কাঁচের বাক্সের উপর আঠা দিয়ে লাগানো।বাক্সের ভিতরের পাশে একটা গদিওয়ালা পুরনো চেয়ারে ফজর আলী আরাম করে বসে থাকে আর কিছুক্ষণ পর পর কাউকে উদ্দেশ্য করে কিংবা এমনিতেই বাক্সটার উপর জোরে চাটি মেরে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গিতে একেকটা কথা বলে হো হো করে হেসে ওঠে ।সেই অট্টহাসির ঢেউ সামনের লোকগুলোর চোখেমুখে অনেকক্ষণ যাবৎ খেলে বেড়ায়।পরিবেশ থিতিয়ে এলেই অনুরূপ পুনরাবৃত্তি ।সকাল থেকে রাত অবধি এভাবেই চলে, চলতে থাকে।রাস্তার সাথে বাড়ি বলে উঠানে কয়েকটা টিনবেঁধে,মুলি বাঁশের বেড়া দিয়ে রিক্সা,ভ্যানের গ্যারেজ করেছে। সেখান থেকে ভাড়া বাবদ যা আসে আর এই দোকানের আয় দিয়ে তার সংসার ভালো মতোই চলে যাওয়ার কথা।কিন্তু তার স্বভাবই যত নষ্টের গোড়া। নিজের মন্দ স্বভাবের কারণেই বহুদিন পর্যন্ত সে বিয়ে না করার গোঁ ধরে বসেছিল।খেয়াল খুশি মত চলতো ফিরতো,ইয়ার দোস্তদের নিয়ে বাড়িতে গানের আসর বসাতো,রাতজেগে যাত্রাপালা দেখতো-- এরকমই চলছিল ।কিন্তু বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে দেখে বছর সাতেক আগে জোর করে মা তার উড়নচন্ডী ছেলেকে সংসারী করতে অল্পবয়সী শরীফাকে পছন্দ করে ঘরে আনে।নিজের প্রায় অর্ধেক বয়সী মেয়েকে বৌ হিসাবে পেয়ে, শরীরের ঘোরে ঘুরপাক খেয়ে কিছুদিন বেশ আমোদেই কেটেছে ফজর আলীর। তারপর যথারীতি পূর্ববৎ বহাল হয়েছে।
বিয়ের পর ছেলের গুণপনা ঠারেঠোরে নিজেই জানিয়ে তাকে শক্ত করে আঁচলে বাঁধতে খুব বুদ্ধি পরামর্শ দিত শরীফার শ্বাশুড়ি।
-----মনে রাখবি বউ,ব্যাটাছাওয়ালেগো স্বভাব অইলো কুত্তার নাহান।কুত্তারে যতই পোলাও কোর্মা খাওয়াস না ক্যান পতের গু দেখলে হে চাটা দিবোই।তেমনি ব্যাটাছাওয়ালরাও সুযুগ পাইলেই অইন্য মাইয়ামাইনষের গায় গতরে নজর দিবো।কাজেই সুযুগ যাতে না পায় হেইমতন আটকাইয়া রাখবি।
কিন্তু বুনো শুয়োরকে পোষ মানায় সাধ্য কার?শরীফাও পারেনি।বিয়ের বছর দেড়েক পর দোকানের মাল আনতে ঢাকা যাচ্ছে বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে,ফিরেছিল পাঁচদিন পর।সেই যে শুরু ।এরপর এই উছিলা সেই উছিলায় কিছুদিন পর পরই একসপ্তাহ, দশ দিন করে কোথায় যেন হারিয়ে যেত।বড় ছেলেটার জন্মের পর একদিন এক বুড়ি এসেছিল ফজর আলীর খোঁজে।সে বলেছিল তার বাড়ি কাশিমপুর। ফজর আলী নাকি তার বিধবা মেয়েকে গার্মেন্টসে চাকরি দেওয়ার কথা বলে দৌলতদিয়া খারাপ পাড়ায় বেচে দিয়েছে ।স্বাক্ষী সাবুদ সব আছে প্রয়োজনে সে থানা পুলিশ করবে, বলে হাউমাউ করে কান্নাকাটি করে অভিসাপ দিয়ে ফিরে গেছিল বুড়িটা।সে চলে যাওয়ার পর শরীফার হাতদুটো চেপে ধরে খুব কেঁদেছিল তার শ্বাশুড়ি,
----মাগো আমারে তুই মাফ কইরা দিস।এমুন পোলা প্যাটে ধরছি জানলে তরে আমি ঘরে আনতাম না।
সেই রাতেই ঘরের পিছনে কাঁঠাল গাছের ডালে ঝুলে কুপুত্র জন্ম দেওয়ার গ্লানি থেকে মুক্তি নিয়েছিল সে।ফজর আলী বাড়ি ফিরেছিল তারও সপ্তাহ খানেক পর ।বুড়ির অভিযোগ, মায়ের মৃত্যু এসব নিয়ে কথা বলায় শরীফার গলা টিপে ধরে শাসিয়েছিল,
----একদম চোপ খানকি মাগী,বেশি ফাল পারলে তরেও ঘাটে পার কইরা দিমু।
শরীফাও দমে যাওয়ার মেয়ে না।এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে বটি নিয়ে তেড়ে এসেছিল।সেদিনের পর থেকে ফজর আলীর আর কোন উছিলার দরকার হয় না।হঠাৎ করেই উধাও হয়ে যায়, ইচ্ছামত ফিরে আসে দিনকয়েক পর।এসবের ভিতর দিয়েই দ্বিতীয় ছেলের জন্ম, তৃতীয়বারের মতো পোয়াতি শরীফা।ঝগড়া, মারপিট,দারিদ্র্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সংসারে টিকে আছে সে।ফজর আলীর অপরাধী মনে তাই কোথাও একটা ভয়,সমীহ কাজ করে তার প্রতি ।
শরীফা রাতে স্বপ্ন দেখছিল গালভরা পান খেতে খেতে শ্বাশুড়ি তাকে কোলের কাছে বসিয়ে চুলে তেল মেজে দিচ্ছে আর তার মৃত সই মানে শরীফার মায়ের সাথেকার আনন্দময় শৈশব,কৈশোরের গল্প শোনাচ্ছে।মায়ের স্মৃতি শরীফার কিছুই মনে নেই ।শ্বাশুড়ির মুখে গল্প শুনে তাই কেমন যেন একটা আবছা মায়া মায়া বোধ হয় ।তারচেয়ে বরং শ্বাশুড়িকেই অনেক আপন মনেহয় তার।মায়ের আদর বঞ্চিত জীবনে অল্প ক'দিনের জন্য হলেও শ্বাশুড়িই তার মা হয়ে উঠেছিল।ঐ ক'টাদিনের স্মৃতি বড়ো সুখের।খুব কষ্টের মূহুর্তে শ্বাশুড়ির পুরনো শাড়িতে মুখ গুঁজলে যে গন্ধটা পাওয়া যায় তা তাকে আরাম দেয়।রাতে এই স্বপ্ন দেখার পর ভোরের দিকে পানি ভাঙা শুরু হয়।পরিস্থিতি বুঝতে পেরে সকালে ছেলেদের দিয়ে প্রতিবেশী দাঈ জোছনার দাদিকে ডাকতে পাঠিয়ে শ্বাশুড়ির শাড়িটা দলা পাকিয়ে বুকের কাছে চেপে ধরে বসে ছিল সে।সন্তান জন্মানোর পর নাড়ী কেটে ন্যাকড়ায় পেঁচিয়ে শরীফার বুকের কাছে শুইয়ে দিয়ে জোছনার দাদি টিপ্পনী কেটেছিল,
-----নে লো মাগী, হাশুড়িরে দুধ খাওয়া।ফজর আলীর মায় আবার ফিরা আইছে দেহি।
মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বাম হাতে চোখের পানি মুছে শরীফা বলেছিল,
-----হ দাদি,এইডা আমার সালেহা বেগমই।তয় হাশুড়ি না, মা।মা।'
মেয়ের জন্মের পর শরীফার মধ্যে কী যেন একটা ঘটে গেছে,আগের চেয়ে আরো বেশি ধীরস্থির হয়েছে।দেখলেই মনেহয় কোনকিছু নিয়ে চিন্তামগ্ন হয়ে আছে।ফজর আলী নাই তাই দোকানও বন্ধ।শুধু গ্যারেজের ভাড়া আর পাশের বাড়ি থেকে বর্গা আনা গাই গরুটার দুধ বেচা সামান্য ক'টা টাকায় কোনমতে ছেলেমেয়ে নিয়ে দিন পার করছে।গিলন্ডোর ঘটনার পরদিন সকালে রিকশাওয়ালা নুরু মিয়ার কাছে জেনেছিল ফজর আলী ভুয়া নাম,পরিচয়ে ঐ গ্রামের তালাকপ্রাপ্তা এক মেয়েকে বিয়ে করে কয়েকদিন যাবৎ তাদের বাড়িতেই থাকছিল।সেদিন রাতে মেয়েটা হঠাৎ ফোনে কথাবলা শুনে বুঝে ফেলে যে তাকে বিক্রির দরদাম করা হচ্ছে।তখন চিৎকার করে বাড়ির সবাইকে জড়ো করতে করতেই ফজর আলী সটকে পড়ে।পরে লাঠিসোটা নিয়ে অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করেও তাকে পাওয়া যায় নাই।ঐ বাড়ির পাশেই নুরুমিয়ার শ্বশুরবাড়ি আর ঐরাতে সে শ্বশুরবাড়িতেই ছিল।সকালে উঠে রিক্সা নিতে গ্যারেজে এসেই শরীফাকে বিস্তারিত জানায় তবে বারবার করে অনুরোধ করে যে,সে যে কথাটা বলেছে এটা যেন ফজর আলী না জানে কারণ খারাপ মানুষের সাথে ঝামেলায় যাওয়ার ইচ্ছা নাই তার।নেহায়েত শরীফার ভালো চায় তাই খবরটা দেওয়া।কেউ কিছুই জানবে না বলে নুরুমিয়াকে আশ্বস্ত করে মনেমনে নিজের করনীয় ঠিক করে নিয়েছিল শরীফা কিন্তু সুযোগের অভাবে বাস্তবায়ন করতে পারেনাই।মাসখানেক পর সেদিন দুপুরে ফজর আলী বাড়িতে এসেছিল ঠিকই তবে সন্ধ্যায় ছেলেদের মারধোর করে বেরিয়ে যায়।তারপর প্রায় তিনমাস নিখোঁজ থেকে সম্প্রতি আবার ফিরে এসেছে। তবে এরমধ্যে মেয়ের জন্মের ধকল কাটিয়ে একটু একটু করে শক্তি সঞ্চয় করছে শরীফা।এতবড় একটা কাজ সমাধা করতে শারীরিক, মানসিক দুই রকম শক্তিই দরকার।নিখোঁজ থাকার সময় মাঝে মাঝে তার মনে হত অপকর্মের প্রতিশোধ নিতে কেউ হয়তো ফজর আলীকে খুনটুন করে ফেলেছে। তার আর ঝামেলা করতে হবে না বরং বালাই দূর হয়েছে ভেবে একধরনের স্বস্তি বোধ হতো।কিন্তু অনুমান ভুল প্রমাণ করে ফিরে আসায় এখন আর দ্বিতীয় কোন পথ খোলা থাকলো না।মেয়ের মুখের দিকে তাকালেই কাজটা সম্পন্ন করার তাগিদ তীব্র হয়।হাত নিসপিস করে।মনেহয় এভাবে চলতে থাকলে ক্ষতিগ্রস্থ কারো ছেলে বা ভাই যদি ফজর আলীর উপর রাগ থেকে তার মেয়ের কোন ক্ষতি করে ফেলে?করতেও তো পারে!ঘুমিয়ে যাওয়া মেয়ের মুখ থেকে দুধের বোঁটা সরিয়ে নিয়ে ব্লাউজের বোতাম আটকাতে আটকাতে মন ঠিক করে নেয় সে।যা করার আজই করতে হবে।
আজ রাতেই।
এ যাত্রায় ফজর আলী বাড়ি ফেরার পর শরীফা কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় নাই।না ভাল,না মন্দ।বড় ছেলেটা বোনকে কোলে নিয়ে বাবাকে দেখিয়েছে
‐----আব্বা দ্যাহেন আমাগো এট্টা বোইন অইছে।মায় অর নাম থুইছে সালেহা।আমি বুজান কইয়া ডাকলেই হাইস্যা দেয়।কী সোন্দর হাসে;দ্যাহেন, দ্যাহেন।
মেয়ের নাম শুনে একটু কি চমকে উঠেছিল ফজর আলী?মায়ের কথা মনে পড়েছিল?তাও খেয়াল করে নাই সে।কিন্তু আজ রাতে দোকান থেকে ফেরার পর নিজে ভাত তরকারি এগিয়ে দেয়।খাওয়া শেষে একখিলি পান নিয়ে গা ঘেঁষে বসে,
-----জর্দা নাই,বেশি কইরা তামুক পাতা আর ভিজা গুইয়্যা দিয়া বানাইছি খাইয়া দ্যাহেন।দুকান বন্দ কইরা কই গেছিলেন,এত রাইত অইলো?আইজকাও ব্যাপারী পারায় আসর বইছিলো?জীবনডা খালি বাইরে বাইরেই কাটাই দিলেন,ঘরের দিক চাওনের টাইম অইলোনা আপনের।আমার নছিবডাই খারাপ।
কথার ইঙ্গিত বুঝতে পারে ফজর আলী ।
-----পোলাপান ঘুমাইছে ?তোমার শইল গতর ঠিক আছে?
বুকের ভিতরে বিষাক্ত হিসহিসানি গোপন করে শরীফা বুকের উপর থেকে কাপড়ের আঁচল সরিয়ে ফেলে। ফজর আলীর ডান হাতটা টেনে নিয়ে উদাম বুকে রেখে কানের সাথে মুখ লাগিয়ে ফিসফিস করে বলে,
-----নিজেই দেইহ্যা নন শইল গতর ঠিক আছে কী নাই।
বিছানায় নিয়ে কথায়,কৌশলে একেবারে মাতাল করে তোলে সে ।আর পানের সাথে মেশানো ওষুধের প্রতিক্রিয়া তো ছিলোই।তারপর প্রথম সুযোগেই কাজ শেষ করে রক্তমাখা, নোংরা,অভিশপ্ত পুরুষাংগটা ফজর আলীর দিকে আক্রোশে ছুঁড়ে মারে।মুখভর্তি থুথু ছিটিয়ে কেউটের মত ফুঁসতে থাকে,
------কুত্তার ল্যাজ কুনুদিন সুজা অয় না, তুইও বালো অবিনা ।ল্যাজই যুদি না থাহে তয় তো সব ঠান্ডা?আমি তর ল্যাজ কাইটা ঠান্ডা কইরা দিলাম।আর কারো সব্বোনাশ করতে পারবিনা।
কুত্তা..শুয়োর ..বেশ্যার দালাল কুনহানকার।
গগন বিদারী চিৎকারের পর ফাঁদে আটকা ইঁদুরের মতো চিঁই চিঁই শব্দে কাতরাতে থাকে ফজর আলী।পাড়া প্রতিবেশী জড়ো হয়ে হৈচৈ,দরজা ধাক্কাধাক্কি শুরু করে ।দরজার খিল খুলে শরীফা দেখে পুবের আকাশ ফর্সা হয়ে এসেছে,ভোর হচ্ছে ।
---------------
লেখক পরিচিতি:
সালমা সিদ্দিকা।
গল্পকার।
বাংলাদেশে থাকেন।
1 মন্তব্যসমূহ
ভয়ংকরভাবে উঠে এসেছে বাস্তব।
উত্তরমুছুন