দুপুরের খাওয়া সেরে বিছানায় এসে বসেছে সনাতন। প্রতিদিনই এইসময় আয়েশ করে একটা সিগারেট টানে সে। এই সুখবিলাস বেশ উপভোগও করে। সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে ভাবে তার বয়ে যাওয়া অতীত। কিংবা বর্তমানের গলিঘুঁজি। এমন সময় তার জানালার উপরে আচমকা উড়ে এসে বসল একটা পাখি। বেশ বড়সড় চেহারার পাখিটাকে দেখে সনাতন যুগপৎ বিস্মিত ও ভয়ার্ত। এ তো যে-সে পাখি নয়, বাজপাখি! এলো কোথা থেকে? এইরকম লোকালয়ে তো বাজপাখি আসার কথা নয়!
চড়াই পাখি ছাড়া সাধারণত তার ঘরের জানালায় কোনও পাখি বসে না। একটা চড়াই প্রায় প্রতিদিনই সকালের দিকে জানালায় বসে তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। সনাতন খুব মজা পায় পাখিটাকে দেখলে। একা মানুষ সে। পুরুষ চড়াইটাও আসে একাকীই। তবে সে খেয়াল করে দেখেছে, চড়াইটার সঙ্গিনী আছে। তারা দুজনে আমগাছের কোনও ডালে বসে ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে কিছু-একটা বলে। তাদের সেই আলাপচারিতা দেখতে বেশ লাগে সনাতনের। অবশ্য শনি-রবি বা ছুটির দিন ছাড়া তার এই অপূর্ব মুহূর্ত দেখা হয়ে ওঠে না। সে নিশ্চিত, প্রতিদিনই চড়াই দম্পতির এই আলাপচারিতা চলে। পুরুষ চড়াইটার কি নিঃসঙ্গ সনাতনকে দেখে দুঃখবোধ হয়? কিংবা অনুকম্পা ফুটে ওঠে তার ছোট্ট ছোট্ট চোখে? বুঝতে পারে না সে।
কালেভদ্রে তার জানালায় চড়াই ছাড়া অন্য কোনও পাখি বসে। বক্স জানালা। তাতে বড় ফাঁকওয়ালা গ্রিল লাগানো। তার মধ্যে দিয়ে অনায়াসে বড় পাখিও গলে এসে বসতে পারে। তাই হয়তো দু-একবার কাক এসে বসেছে সেখানে। তবে যেহেতু সনাতনের কাছে কোনও খাবারদাবার পাওয়া যায় না, তাই কাক খানিকক্ষণ অপেক্ষা করেই উড়ে চলে যায়। বাজপাখিটাও সেভাবেই এইমাত্র তার জানালার গ্রিলে শরীর গলিয়ে দিয়ে ঢুকে পড়েছে। বসে বসে স্থির চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। শিকারি পাখিটার তীক্ষ্ণ নিরীক্ষণ দেখে একটা ভয় তার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল। যদি চোখ খুবলে নেয়! কিংবা যদি আঁচড়ে দেয় তাকে? অবশ্য সেই ভয় খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। পাখিটার নরমসরম চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে খানিকটা আশ্বস্ত হয় সে। তবে সংশয় থেকেই যায়।
বাজপাখিটা যেন তার সংশয় ভাবটাকে কিছুক্ষণ ধরে রাখার সুযোগ দিল। জানালার কাছ থেকে সরে এল ভেতরে। দু-পায়ের ওপর ভর দিয়ে সামান্য লাফিয়ে এসে বসল টেবিলের ওপরে। কিছু পুরনো কাগজ ডাঁই করে রাখা। একটা অ্যান্টিক টেবিল ক্লক। বাবা-মায়ের সাদা-কালো বাঁধানো ছবি। বড়সড় টেবিলটায় এইসব জিনিস আছে। মোটামুটি সাজানো আছে বলে পাখিটা খানিকটা নড়াচড়ার সুযোগ পাচ্ছে। ঘাড় ঘুরিয়ে সেসব দেখল সে। তারপর ঘরের এদিক-ওদিক চোখ রাখল।
মাসখানেক আগে তাদের অফিসে একজন এসেছিল। ফর্সা, সৌম্যদর্শন লোকটা বিতনুর মাসতুতো ভাই। নাম মনে নেই। আবুধাবিতে থাকে। কলকাতায় এসেছে দিন তিনেকের জন্য একটা বাণিজ্যিক কনফারেন্সে যোগ দিতে। সুযোগ বুঝে দাদার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। সনাতনের পাশের টেবিলেই বিতনু কাজ করে। দুই টেবিলের মাঝখানে বসে সেই লোকটা নানা গল্প করছিল। কথায় কথায় বলছিল, আবুধাবিতে নাকি বাজপাখিদের জন্য একটা হাসপাতাল আছে। একটা শিকারি পাখির জন্য হাসপাতাল! লোকটা বাজপাখির অনেক গল্প বলেছিল। মধ্যপ্রাচ্যে শিকারি বাজপাখি পোষার রেওয়াজ আছে। শুনে খুব আশ্চর্য হয়েছিল সনাতন। তখন থেকেই তার মাথায় ঘুরছে বাজপাখির কথা। এদেশে বাজপাখি পোষে নাকি কেউ? পুষলেও তার জানা নেই। কোথায় পাওয়া যায় তাও জানে না সে। সেদিন থেকেই বাজপাখি সম্পর্কে নানা খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেছে সনাতন।
এর মধ্যে অনেককিছু জেনেও ফেলেছে সে। যেমন, স্লোভাকিয়ার স্টিয়াভনিৎস্কে বানিয়ে নামে একটা পাহাড়ি গ্রাম আছে। সেখানকার স্কুলের পাঠ্যবিষয় শিকারি পাখি। ক্লাশ সেভেন থেকে নাইনের ছাত্রছাত্রীদের শিকারি পাখি সম্পর্কে পড়াশোনা, তাদের দেখভাল করা বাধ্যতামূলক। বাজ, ঈগল এইসব পুষতে হয়, তাদের জন্য নানা কাজ করতে হয়। এতে ছাত্রছাত্রীরা সিদ্ধান্ত নিতে শেখে, দায়িত্ব নিতে শেখে। এভাবেই সনাতন জেনে গেছে, ক্রুসেডের সময় একটা শিকারি বাজপাখি খ্রিস্টান শিবির থেকে মুসলিমদের শিবিরের দিকে উড়ে এসেছিল। পাখিটি ছিল সাদা এবং গায়ার ফ্যালকন প্রজাতির। দুই পক্ষে এই নিয়ে খুব টানাপোড়েন চলেছিল অনেকদিন। সেই ক্রুসেডের মধ্যেও দু-পক্ষই সাদা বাজপাখির জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠে। খ্রিস্টানরা চেয়েছিল তাদের বাজ যেন মুসলমানরা ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু শেষপর্যন্ত খ্রিস্টানরা পাখিটাকে ফেরত পায়নি। মিশর ও সিরিয়ার রাজা সালাউদ্দিন বাজপাখিটাকে হস্তগত করেছিলেন। পাখিটা ছিল ফ্রান্সের রাজা ফিলিপের। ফ্রান্স সম্রাট এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা পর্যন্ত দিতে চেয়েছিলেন সালাউদ্দিনকে। কিন্তু সালাউদ্দিন রাজি হননি, নিজের কাছেই রেখে দিয়েছিলেন পাখিটা। সেইসময় সাদা গায়ার ফ্যালকন ছিল মর্যাদার প্রতীক। তাই এমন একটা পাখিকে নিয়ে আগ্রহ থাকা স্বাভাবিকই। বাজপাখি নিয়ে নানা খবরাখবর নিতে গিয়ে একসময় সনাতনের মনে বাজপাখি পোষার প্রবল ইচ্ছে জেগে উঠেছিল।
এই বাজপাখিটাও কি ফ্যালকন প্রজাতির? ভাবে সনাতন। যদিও পাখিটার গায়ের রঙ সাদা নয়, বাদামি; কিন্তু হতেও তো পারে ফ্যালকন! বাদামি বা কালো ফ্যালকনও হয়। পাখিটার ঘরের ভেতরে ঢুকে-আসা এবং চলাফেরা দেখে সে ভাবে, যদি তারও এইরকম একটা বাজ থাকত? তার ইচ্ছেপূরণের জন্যই কি বাজটা ধরা দিতে এল? নিজে থেকেই একেবারে ঘরে ঢুকে পড়ল! এদেশে ফ্যালকন বাজ থাকলে মর্যাদা কিছুই বাড়বে না, কেননা এখানে এসবের কদর নেই। কিন্তু লোকে ঘাড় ঘুড়িয়ে তার দিকে তাকাবে নিশ্চিত। সেটাও তো মর্যাদা বৃদ্ধিই! সনাতনের চোখ চকচক করে ওঠে।
শুভ অপরাহ্ণ, স্যার।
শুভ অপরাহ্ণ। সনাতনের মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এল শব্দটা। কিন্তু কে বলল? অকৃতদার, প্রৌঢ় সনাতনের ঘরে সচরাচর কেউ আসে না। এখন কারও আসার কথাও নয়। আচমকা পাখিটার দিকে চোখ গেল তার।
ভালো আছেন স্যার? আমাকে চিনতে পারছেন?
আশ্চর্য! পাখিটার ঠোঁট নড়ছে, মাথা দুলে উঠল! বাজপাখি কথা বলছে? চোখ সরু করে দেখে সে। ভালো করে দেখার পর তার মনে হয়, একে আগে কোথায় যেন দেখেছে! ইন্টারনেটের ছবিতে? নাকি কোনও বইয়ে? সনাতন কিছুটা সপ্রতিভ হয়ে বলে ওঠে, হুম, চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু কোথায় দেখেছি ঠিক…
ব্যাবিলনে স্যার। ক্যালডীয় সভ্যতাতেও দেখেছেন আমাকে।
অ্যাঁ? ব্যাবিলনে? ক্যালডীয় সভ্যতায়?
হ্যাঁ স্যার। মেহেরগড় বা সিন্ধুসভ্যতাতেও দেখেছেন আমাকে। গ্রিসে, চৈনিক সভ্যতায়, মিশরে…। শতাব্দীর পর শতাব্দী আমি আর আপনি…
মাথাটা বনবন করে ঘুরছে সনাতনের। অস্ফুটে বলে ওঠে, তুমি সবকটা সভ্যতাতেই ছিলে? আমিও?
হ্যাঁ স্যার, ছিলাম। বর্তমান সভ্যতাতেও আছি। আমরা ছাড়া সভ্যতা চলবে না যে!
মানে? বিস্ময়ে তার চোয়াল ঝুলে পড়ে। ইতিহাসের সঙ্গে বাজপাখির একটা যোগাযোগ আছে সে জানে। দ্য এপিক অব গিলগামেসেও বাজপাখির কথা লেখা আছে। সেইসময় বাজপাখিকে দিয়ে শিকার ধরা হত। কিন্তু সে নিজেও যে ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, এমন কথা শুনে বিস্মিত হয়। সেই কারণেই প্রশ্নটা বেরিয়ে এল তার মুখ থেকে। সনাতনের বিস্ময়মাখা দৃষ্টি দেখে বাজপাখিটা তাকিয়েই থাকে তার দিকে। অবিচল। বেশ বিরক্ত হয় সনাতন। বাজটার কেমন যেন হামবড়া ভাব মনে হচ্ছে না! মানুষের সভ্যতার সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দেখাতে চাইছে! যেন তাকে ইতিহাসের পাঠ দিতে চাইছে পাখিটা। সমস্ত সংশয়, ঘোর-লাগা অবস্থা থেকে নিজেকে বের করে আনে সনাতন। মনে মনে দ্রুত নিজেকে গুছিয়েও ফেলে সে। আর সেইসঙ্গে তাবৎ মনুষ্য প্রজাতির প্রতিনিধি মনে করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, তুমি ইতিহাস শেখাতে এসেছ নাকি হে আমাকে?
না স্যার, শেখাতে নয়। তবে এটা তো জানেন যে আমি-আপনি ইতিহাসের সঙ্গেই হাত ধরাধরি করে চলেছি।
মানুষের সভ্যতা এগিয়েছে মানুষেরই বুদ্ধি আর পরিশ্রমের কারণে। এর সঙ্গে বাজপাখির কোনও সম্পর্ক নেই। জোর দিয়ে বলে সনাতন। শিরদাঁড়া টানটান করে বসে সে। তার এই জোরালো মতামতকে তেমন একটা আমল দিল না পাখিটা। সেই প্রসঙ্গ এড়িয়েই গেল। বরং বলে চলল, আপনিই তো স্যার একদা ছিলেন রাজা তুতেনখামেন। মনে পড়ে না আপনার? বাজপাখি ছিল আপনার প্রিয় পোষ্য। আপনাকে যখন মমি করে সমাধিস্থ করা হয়, তখন আপনার কানে বাজপাখির প্রতিকৃতি দিয়ে দুল বানিয়ে পরানো হয়েছিল।
অজান্তে নিজের কানে হাত বোলাতে থাকে সনাতন। পাখিটা একটু নড়েচড়ে ওঠে। মাথা দুলিয়ে জিজ্ঞাসা করে, আপনার নিশ্চয়ই মনে পড়ছে মহামান্য তুতেনখামেন?
তুতেনখামেন! আমি রাজা তুতেনখামেন ছিলাম?
হ্যাঁ মান্যবর। আপনি আমার অভিবাদন গ্রহণ করুন। আমি গায়ার ফ্যালকন প্রজাতির বাজ। শ্বেতশুভ্র বাজপাখি নিয়ে রাজারাজরাদের অহংকারের সীমা ছিল না। আমি বাদামি বলে আমাকে তেমন কেউ গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু মহামান্য ফ্যারাও, আপনি আমাকে পছন্দ করতেন। সাদাই হোক বা বাদামি কিংবা কালো, আপনি সব ধরনের ফ্যালকনকেই মর্যাদা দিতেন। এই কারণে আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ ছিলাম। আজও কৃতজ্ঞচিত্তে আপনার সেই স্নেহ-ভালোবাসা স্মরণ করি। আপনি অল্প বয়সে মারা গেলেন...
সনাতনের মনে পড়ল, তুতেনখামেনের মৃত্যু নিয়ে একটা রহস্য রয়ে গেছে। নানা মত উঠে এসেছে নানা সময়ে। এমনকি ডিএনএ টেস্টের পরেও। তাই তিনি প্রশ্ন করেন, তুত কীভাবে মারা গেলেন তুমি জানো না?
না মহামান্য, আমার জানা নেই। বাজপাখির চোখে একটুকরো ছায়া খেলা করে বেড়ায়। সে চোখ নামিয়ে নেয়।
ফ্যারাও নিজে তোমাকে পছন্দ করতেন। তার মানে রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে তোমার তো অবাধ যাতায়াত ছিল। তাহলে জানতে পারা উচিত ছিল।
আমাদের মতো পোষ্যের জিজ্ঞাসা করার কোনও অধিকার ছিল না মহামান্য। আপনার স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে বলে মনে করতে পারছেন না। তবে আমি শুনেছিলাম আপনি মারা গেছেন ম্যালেরিয়াতে। কিংবা এমনও হতে পারে, কারও অস্ত্রের আঘাতে আপনার মৃত্যু হয়েছে। কেউ বলেছে পড়ে গিয়ে পাথরের আঘাতে আপনার পা ভেঙে গিয়েছিল। প্রকৃত সত্য আমি জানতে পারিনি। হাওয়ায় ভেসে-আসা নানা সম্ভাবনা শুনেছি মাত্র।
সনাতন একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে বাজপাখিটার দিকে। তার চোখ দেখেই পাখিটা বুঝে ফেলে, স্মৃতিভ্রষ্ট ফ্যারাও তার কথা বিশ্বাস করেনি। তাই সে অনেকটা কৈফিয়তের ভঙ্গিতে বলে যায়, রাজাদের যেমন প্রতিপত্তি থাকে, তেমনি শত্রুরও অভাব থাকে না মহামান্য। আর আপনি তো ছিলেন অল্পবয়সী এক রাজা। হিংসা, লোভ, ক্ষমতার ঘন কালো অন্ধকার প্রাসাদের অন্দরে অন্দরে ঘুরে বেড়ায় অবিরত। রাজবাড়ির ঘটনাপ্রবাহে আমাদের জড়ানো হত না। পোষ্য হিসাবে যেটুকু প্রাপ্য ছিল, তাতেই আমাদের মতো ইতর প্রাণীদের খুশি থাকতে হত। তবু আপনি আমাকে অনেকটাই দিয়েছেন...
বিস্ময়ে বাজটার দিকে তাকিয়ে থাকে সনাতন। গায়ার ফ্যালকন বাজ! আমি একদা ফ্যারাও তুতেনখামেন ছিলাম! ফ্যালকন প্রজাতির বাজপাখিদের গুরুত্ব স্বীকার করতাম? এসব কী বলছে পাখিটা? তার মনের কথা পড়ে ফেলতে পারল যেন বাজ।
হ্যাঁ মহামান্য, আপনি ফ্যারাও ছিলেন। যুগে যুগে আপনি নানা মানুষ রূপে জন্মেছেন। আর আমি ছিলাম আপনার সঙ্গী।
আমার রূপান্তর হয়েছিল নানা সময়ে? বারবার মানুষ হয়েই জন্মেছি? তিরতির করে হাওয়া বয়ে যাচ্ছে, সেই স্নিগ্ধ হাওয়াতেও সনাতনের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে শরীরে।
আপনি বেশি চিন্তা করবেন না স্যার, আমি আপনাকে আপনার সুদূর অতীত দেখানোর ব্যবস্থা করব। তাতে আপনার প্রত্যয় হবে যে আপনি যুগে যুগে নানা রূপে জন্মেছেন।
কীভাবে দেখাবে? কৌতূহলে সনাতনের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
এক্ষুণি দেখাব। আপনি দেখতে থাকবেন। সেই ফাঁকে আমি একবার একটু ঘুরে আসছি। কিন্তু কোথায় যাবে, বলে না সে। তার মনে হচ্ছে, আশেপাশেই হয়তো কোথাও আছেন রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রেডারিক। তিনিও ছিলেন একজন বাজপাখিপ্রেমী। নানা শিকারি পাখি পোষ মানিয়ে শিকার ধরার নানা কৌশল আবিষ্কারের নেশা ছিল তাঁর। এই নিয়ে তিনি নানা গ্রন্থের খোঁজখবরও রাখতেন। সনাতন নিজে তুতেনখামেন ছিল জেনে ঘোরের মধ্যে আছে। তারপর যদি শোনে রোমান সম্রাটের কথা, কিংবা মারকোপোলোর কথা, তাহলে সংকট বাড়বে হয়তো। মারকোপোলোর বিবরণে আছে, মোঙ্গলরাজ কুবলাই খান দশ হাজার বাজপাখি পালন করতেন। আর তাদের দেখাশোনার জন্য ছিল ষাট জন ম্যানেজার। এসব কথা আর তুলতে চাইল না বাজপাখি। নীরবেই কিছুক্ষণ এখান থেকে চলে যেতে চাইল সে। সেই সময়টায় বরং নিজের সুদূর অতীত একবার দেখে নিতে পারবে সনাতন। ভাবে পাখিটা।
তুমি চলে যাচ্ছ?
একেবারেই চলে যাচ্ছি না মহামান্য। একটু ঘুরে আসি, কেমন? তাড়াতাড়িই চলে আসব। কথাটা বলেই নিজের শরীর থেকে একটা বাদামি পালক খুলে সনাতনের দিকে বাড়িয়ে দিল বাজপাখিটা। হাত বাড়িয়ে বাজের ঠোঁট থেকে পালকটা তুলে নিল সে। অপলক তাকিয়ে থাকল সেদিকে।
এটা হাতে রেখে আপনি চোখটা বন্ধ করুন স্যার। মনঃশ্চক্ষে সব দেখতে পাবেন। বাকি কথা পরে হবে। পাখিটা দ্রুত জানালার গ্রিল গলে বেরিয়ে উড়াল দিল।
পালকটা হাতে নিয়ে সনাতন চোখ বন্ধ করল। পাখিটা তাকে সত্যিসত্যিই কী দেখাবে, বুঝতে চায় সে। অনেকটা রূপকথার মতো মনে হচ্ছে সব। চোখ বন্ধ করার কিছুক্ষণের মধ্যেই একে একে দেখতে পেল নানা টুকরো দৃশ্য। পাথর ঘষে অস্ত্র তৈরি করছে কিছু মানুষ, যাদের পরনে গাছের ছাল। সেই মানুষগুলোর মধ্যে নিজেকেও দেখতে পাচ্ছে সনাতন। একটু বাদেই চোখে ভেসে উঠল অন্য একটা চিত্র। কয়েকজনের সঙ্গে ধরাধরি করে একটা বড় গাছের গুঁড়ি কেটে কেটে চাকা বানাচ্ছে সে। রুখাশুখা জমিতে পাথরের লাঙল চালিয়ে চাষ করছে, কখনও পাহাড় ভাঙছে, পিরামিড তৈরি করছে। নিজে মাঝে মাঝে চাবুক হাতে দাঁড়াচ্ছে শাসক হয়ে, তখন তার চোখেমুখে হিংসা ফুটে উঠছে। আবার পরক্ষণেই শাসকের চাবুকও আছড়ে পড়ছে তার পিঠে। তখন সে অনাবৃত ঊর্ধ্বাঙ্গে হাঁটুমুড়ে বসে আছে। এইসব দৃশ্যে সে প্রবল অস্বস্তি অনুভব করছে। সারা শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল তার। চকিতে চোখ খুলে দেখতে পেল বাজপাখিটা আবার আগের জায়গায় এসে বসে আছে। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সনাতনের মনে হল, একটা ক্রুর হাসি যেন লেগে আছে পাখিটার ঠোঁটে।
আপনি স্যার সভ্যতা গড়েছেন আর তার মধ্যেই আবর্জনাও ছুঁড়ে ফেলেছেন। আর আমি সেই আবর্জনা, মৃত শরীর ছোঁ মেরে নিয়ে গেছি দূরে।
একটা ঘোরের মধ্যে ছিল সনাতন। পাখির কথায় সেই ঘোর কেটে গেল। চরম বাস্তবে ফিরে এল সে। বাজপাখির কথা শুনে বিরক্তিতে তার চোখমুখ কুঁচকে উঠল। একটা ইতর প্রাণীর থেকে জ্ঞানের কথা শুনতে সে প্রস্তুত নয়, তাই ধমক দিয়ে ওঠে সনাতন, কী যা-তা বলছ হে?
আপনি স্যার জ্ঞানপাপী। বরাবরই তাই। কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ সব জানেন। কিন্তু মন্দ কাজ করলেও মানতে চান না, বিশ্বাস করতে চান না।
সনাতন রক্তিম চোখে তাকিয়ে থাকে। এর মধ্যেই হেসে জিজ্ঞাসা ছুঁড়ে দেয় বাজপাখিটা, আপনার প্রেমিকার কথা মনে পড়ে?
এই প্রশ্নে বিরক্ত হওয়ার কথা ছিল সনাতনের। কিন্তু তার বদলে বিষণ্ণতা ঘিরে ধরল তাকে। সে অনেক কাল আগের কথা। মিলির সঙ্গে কবেই আমার সব চুকেবুকে গেছে।
মিলির কথা বলছি না স্যার, মিলি তো এই জীবনের পরিচিতা। এনাকে ঠিক প্রেমিকা বলা যায় না। একটা ইনফ্যাচুরেশন বলতে পারেন। কিংবা দুজনের হিসাবনিকাশের সম্পর্ক। অর্থসম্পদের পারস্পরিক বোঝাপড়া। প্রেম কোথায়! আমি হেলেন অব ট্রয়ের কথা বলছি। মনে পড়ে তাঁকে? বা ধরুন ক্লিওপেট্রা? চিনের রানি উ জেতিয়ান? আর…
আবার কেমন যেন সব গুলিয়ে যাচ্ছে সনাতনের। বারবার তাকে কোন অন্ধকার গর্ভে ঠেলে দিচ্ছে বাজটা? কিছুটা ধাতস্থ হয়ে সে বলে, তুমি যাদের নাম বলছ তাদের সঙ্গেও আমার প্রেম ছিল? নাকি আমার সঙ্গে মজা করছ?
বাহ্, আপনাকে যখন ফ্যারাও বললাম, তখন খুশি হলেন, গর্বও ফুটে উঠতে দেখেছিলাম আপনার মুখে। আর প্রেমিকার কথা শুনে মজা করলাম মনে হল? প্রেম আপনার এই জীবনে ব্যর্থতা বয়ে এনেছে বলে এসব বলছেন?
সনাতন প্রকাশ্যে স্বীকার করতে চাইল না যে, সেইসব প্রেমিকার কথা শুনে তার রোমাঞ্চ হচ্ছে। যদি স্মৃতিতে ধরা পড়ত, তাহলে কী আনন্দই না হত! তাদের সঙ্গসুখ সে অনুভব করত। কেমন একটা যন্ত্রণা তাকে ঘিরে ধরে। সেই যন্ত্রণার উপশম খুঁজে পেতে সে এবার বাজপাখিকে পালটা আঘাতের কথা ভাবে। প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, আমি তো যুগে-যুগে অনেক কিছুই অর্জন করেছি। আর তুমি?
আমি অর্জন করেছি অতিরিক্ত ডানা। উড়াল দিতে পারি সময়ের পিঠে। কিন্তু আপনি কি পারেন? অবশ্য আপনি চাইলে আমি সাহায্য করতে পারি। আপনাকে দিতে পারি একজোড়া ডানা।
ডানা! ডানা দেবে বলছে আমাকে? তাহলে সময়ের ঝুঁটি ধরে চলাফেরা করে বেড়াতে পারব? তুতেনখামেন হয়ে উঠতে পারব? সুন্দরী ক্লিওপেট্রার সঙ্গসুখ পাবো? আরও আরও সুন্দরীদের সঙ্গে দেখা হবে? নানা ভাবনায় নড়েচড়ে ওঠে সনাতন। আচমকা বাজটা জানালার কাছে লাফিয়ে চলে যায়। তারপর তার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে, আমি এখন চলে যাচ্ছি স্যার। তবে আবার আসব।
আবার? কবে? কখন? সম্বিত ফেরে সনাতনের।
তা ঠিক বলতে পারব না। হয়তো আগামীকাল, কিংবা পরশু। কিংবা আরও অনেক পরে কোনো একদিন।
একেবারে থেকে যাওয়া যায় না? আমার পোষ্য হিসাবে?
এবার বাজটা বেশ জোরেই হেসে ওঠে। পোষ্য? হা হা হা। সনাতনের প্রস্তাবে আমলই দিল না সে। বরং এদিক-ওদিক তাকিয়ে ডানা ঝাপ্টে উড়ে যেতে উদ্যত হল। উড়বার আগে বলে উঠল, আপনাকে ডানা দিয়ে যাব বলেছিলাম। এই নিন ডানা...
একজোড়া সূক্ষ্ম আলোর ডানা উড়ে এল সনাতনের দিকে। আনন্দে ঝলসে উঠল তার চোখ। সে দুহাত বাড়িয়ে ধরতে পারল সেগুলো। কিন্তু কীভাবে শরীরে ডানা লাগাতে হয় তার জানা নেই। সনাতন বারবার আলোর ডানা দেহের দুপাশে লাগাতে চেষ্টা করে, প্রতিবারই ব্যর্থ হয়। এর মধ্যেই অনেক দূরে চলে গেছে বাজটা।
আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল সনাতন, উড়তে উড়তে মেঘের ছায়ায় হারিয়ে গেল বাজপাখিটা। হতাশ সনাতন ডানাদুটো বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বসেই থাকে বিছানায়। তার মাথা ক্রমশ ঝুঁকে পড়ে বুকের কাছে। আর অপেক্ষা করতে থাকে, আবার কখন ফিরে আসে বাজপাখিটা! ক্লান্তিতে তার চোখ বুজে আসে।
----------
লেখক পরিচিতি
যুগান্তর মিত্র
কথাসাহিত্যেক।
গোকূলপুর, কাঁটাগঞ্জে থাকেন।
23 মন্তব্যসমূহ
ভীষণ ভালো লাগল
উত্তরমুছুনভালোবাসা
মুছুনমানুষের চলার ইতিহাস। পাথর যুগ হয়েছে মিশরীয় সভ্যতা, ক্রুসেড, অত্যাচার করা ও অত্যাচারিত হওয়া সবকিছুই উঠে এসেছে এই গল্পে। বাজ ও কথকের কথাবার্তাও খুব সুন্দর। দুর্দান্ত গল্প।
উত্তরমুছুনশুভেচ্ছা দেবাশিস।
মুছুনদারুণ গল্প। অসাধারণ একটা বার্তা আছে। আমার খুব খুব ভাল লেগেছে।
উত্তরমুছুনভালোবাসা
মুছুনদারুণ গল্প। অসাধারণ একটা বার্তা আছে। আমার খুব খুব ভাল লেগেছে।
উত্তরমুছুনখুব সুন্দর গল্পটা
উত্তরমুছুন
মুছুনশুভেচ্ছা
অসাধারণ বিষয়বস্তু।বলার ভঙ্গিমাটিও বেশ ভালো;শেষের মেসেজটিও।
উত্তরমুছুনভালোবাসা
মুছুনগল্পের বিষয়বস্তু বেশ নতুনত্বের দাবি রাখে। খুব ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুনভালোবাসা
মুছুনভালো গল্প । অভিনব। ভিন্ন স্বাদের লেখা।
উত্তরমুছুনভালোবাসা
মুছুনবাজপাখি ___ চুপ করে সেই আলোর ডানা খুঁজছি
উত্তরমুছুনবেশ।
মুছুনখুব সুন্দর বিষয় ভাবনা। পড়ে খুবই ভালো লাগলো। শুভেচ্ছা নিরন্তর।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনএকদম অন্যরকম গল্প। তথ্য এবং উপস্হাপনা অভিনব। শুভেচ্ছা রইল আর প্রণাম।
উত্তরমুছুনভালোবাসা শম্পা
মুছুনআমার প্রিয় লেখকের প্রিয় গল্প
উত্তরমুছুনআনন্দ আনন্দ!
উত্তরমুছুন