দেবর্ষি সারগীর গল্প : সৈনিক


মাঝরাতে বাথরুম থেকে ফিরে দোতলার হলঘরের ভেতর দিয়ে হাঁটছি। হঠাৎ নাইট বালবের আলোয় চোখে পড়ল কোণের তক্তপোশে কেউ একজন শুয়ে। ঘুমমাখা চোখে বাথরুমের দিকে যাওয়ার সময় নজরে পড়েনি। নভেম্বর বলে একটু হিম পড়েছে। পাখার হাওয়ায় বাথরুমের জন্য প্রায়ই ঘুম ভেঙে যায়। দোতলায় আমি একা থাকি। ঠাকুরদা, ঠাকুমা ও কাজকরা ছেলে নীচতলায়। আর বাবা, মা, দিদি ও বোন তিনতলায়।

বড় আলো জ্বালালাম। দেখি যে ইউনিফর্ম পরা একজন সৈনিক অঘোরে ঘুমোচ্ছে, পাশে রাইফেল, কোমরের চওড়া বেল্টে সারি সারি গুলি। বাড়িতে কখন ঢুকল, কী করে ঢুকল বুঝতে পারলাম না। বারান্দার দরজা খোলা। হয়তো সেখান থেকে ঢুকে পড়েছে। সৈনিকেরা তো শুনেছি হাওয়াতেও ভেসে বেড়াতে পারে। ওদের অসাধ্য কিছু নেই। 

আমি তাকিয়ে থাকলাম লোকটার মুখের দিকে। বয়স মনে হয় তিরিশ-পঁয়ত্রিশের মধ্যে হবে। ফর্সা, ছিপছিপে, মজবুত চেহারা। ঠোঁট একটু ফাঁক করে এমন ঘুমোচ্ছে যেন কোনো মাটির পুতুল ঘুমোচ্ছে। আমার ওকে তুলতে ইচ্ছে করল না। ভয়ও পাচ্ছিলাম না, কারণ লোকটা খারাপ হলে তো ঘুমোবার আগে আমাকে মেরে ফেলতে পারত, বাড়ির অন্যদেরও, যাতে একদম নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারে। সম্প্রতি আমাদের দেশের সঙ্গে যুদ্ধ লেগেছে। পাঞ্জাব ও রাজস্থানের দিকে তো তুমুল গুলিগোলা চলছে। আগাম সতর্কতা হিসেবে কলকাতাকেও সৈনিকেরা ছেয়ে ফেলেছে। রাস্তায় মিলিটারি গাড়িতে সৈনিকের দল, যেন ঘন সবুজ গাছপালা এগিয়ে চলেছে। এই সৈনিকটা হয়তো অনেক রাত ঘুমোয়নি, অর্থাৎ ঘুমোবার সুযোগ পায়নি, তাই এখানে লুকিয়ে একটু ঘুমোচ্ছে। আমি শুনেছি যুদ্ধক্ষেত্রে বা জরুরি অবস্থায় ওরা রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে থাকে। তখন হয়তো দিনের বেলায় একটু ঘুমিয়ে নেয়, জীবজন্তুদের মতো সতর্ক'মস্তিষ্কে। চোখ বন্ধ কিন্তু মাথা জেগে। কিন্তু এই লোকটার মাথাও নিশ্চয় এখন ঘুমোচ্ছে, কারণ বড় আলোটা জ্বালানো সত্ত্বেও ঘুম ভাঙল না, লাফিয়ে উঠে বসল না। ঘুমন্ত মানুষ দেখলে বোঝা যায় মানুষ কত করুণ, অসহায়, প্রিয় একটা জীব। এই লোকটা যে কাউকে খুন করতে পারে, শত্রুর বুকে গুলি চালাতে পারে, বেয়নেটের খোঁচায় চোখ উপড়ে নিতে পারে এই মুহূর্তে একে দেখে বিশ্বাসই হয় না। এমনকী ওর মুখেও গভীর প্রশান্তি যেন। সে আর জানেই না যে পৃথিবীতে যুদ্ধের মতো একটা ভয়ংকর জিনিস আছে এবং সে একজন। 

আমার মনে হচ্ছিল আর কখনো হয়তো কোনো ঘুমন্ত সৈনিকের মুখ দেখতে পাব না। আমার খুব মায়া হচ্ছিল ওর ওপর। সামনে উবু হয়ে বসে ওর ঘুম পাহারা দিতে ইচ্ছে করছিল। বাড়ির অন্যদেরও দেখাতে ইচ্ছে করল দৃশ্যটা। 

প্রথমে নীচে ঠাকুরদার ঘরে গেলাম। ঠাকুরদা অভিজ্ঞ, বিচক্ষণ মানুষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রচুর গোরা সৈনিক দেখেছে কলকাতায়। তখন কলকাতায় এত ভিড় ও ব্যস্ততা ছিল না। চাইলে সৈনিকেরা হয়তো নির্জন রাস্তাঘাট, রোয়াক বা পার্কে একটু ঘুমিয়ে নিতে পারত। ঠাকুরদার ঘরের দরজা খোলাই থাকে। আস্তে করে ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। ঠাকুরদা ও ঠাকুমা দুটো আলাদা খাটে ঘুমিয়ে। মেঝেয় কাজ করা ছেলেটা। হাত ছুঁয়ে ঠাকুরদাকে আস্তে করে তুললাম। তারপর জানালাম দোতলার হলঘরে একজন সৈনিক ঢুকে পড়ে ঘুমিয়ে আছে। ঠাকুরদা অবিশ্বাসীর মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল আমার দিকে। কিছু বলল না। এরপর ঠাকুমাকে তুললাম। ঠাকুমাও অবাক হয়ে তাকাল। তারপর শান্ত গলায় বলল :‘রাইফেলটা অন্তত লুকিয়ে রাখ, যাতে ঘুম থেকে উঠে আমাদের গুলি না করতে পারে’। 

না না, ঠাকুরদা বলল, ‘রাইফেল সরাতে গিয়ে যদি ঘুম ভেঙে যায় তাহলে রেগে গিয়ে সত্যি গুলি করতে পারে। কিছু করার দরকার নেই। যতক্ষণ ইচ্ছে ঘুমোক’। 

‘ওরা শুনেছি টানা তিনদিনও ঘুমিয়ে থাকে’, ঠাকুমা বলল। 

‘তাই ঘুমোবে’। ঠাকুরদা বলল, “কী করা যাবে? এবং এতদিন ধরে ওকে আমাদের বাড়িতে ঘুমোতে দিয়েছি বলে কৃতজ্ঞতাবশত আমাদের কোনো ক্ষতি নাও করতে পারে।

ঠাকুমা চুপ করে থাকল। ‘চল তো দেখি’, খানিক পরে ঠাকুমা বলল। 

কাজ করা ছেলেটাও উঠে পড়েছিল। সবাইকে বললাম কোনো শব্দ না করে আস্তে আস্তে ওপরে উঠতে।

‘বেশি কাছে যাস না,’ সিঁড়িতে ঠাকুমা কাজ-করা ছেলেটাকে বলল ধমকের সুরে।‘তোর লাঠিটা কোথায়?’ 

‘নীচের ঘরে। আনব?’ 

‘না। বোকার মতো ওটা যাতে না আনিস তাই জিজ্ঞেস করছি’। দোতলায় উঠে আমরা চারজন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকলাম, কোনো কথা না বলে, যেন মন্দিরে উপবিষ্ট কোনো দেবতার সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি।

‘ভালো বংশের ছেলে বলে মনে হচ্ছে’, ঠাকুমা বলল সৈনিকটার মুখের দিকে তাকিয়ে ‘এই লাইনে কেন এল মরতে’! 

‘ভালো বংশের ছেলেরাই আসে এই লাইনে’, ঠাকুরদা বলল ঈষৎ শ্লেষের সুরে। লম্বা, উন্নত নাক, প্রশস্ত ললাট। 

‘কিন্তু যা দুঃখের, এই ছেলেগুলোর উচিত দেশের জন্য বেঁচে থাকা। কিন্তু এরাই দেশের জন্য মারা যায়’। 

একটু থেমে ঠাকুমা বলল, ‘কেমন ঘুমোচ্ছে দেখছ? যেন এক মাস ঘুমোয়নি। ফলে ও যদি টানা দু-মাসও এখানে এভাবে ঘুমিয়ে থাকে তাহলেও আমরা বাধা দেব না। ছেলেটাকে আমার ভালো লেগেছে’। 

ঠাকুমার ভালো লেগেছে শুনে নিশ্চিন্ত হলাম। তাহলে লোকটা সত্যি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকতে পারে। আমি ওপরে উঠে বাবা, মা দিদি ও বোনকেও ডেকে আনলাম। আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে ওরাও সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল।

‘থাক ঘুমিয়ে’, বাবা বলল, ‘আমি ঘুমোতে আবার ওপরে গেলাম। ওর ঘুম ভাঙলে আমাকে ডাকিস। গল্প করব। কাল আর অফিস যাব না’।

‘এই সামান্য কারণে অফিস কামাই করার কোনো মানে হয় না’, মা বলল ধমক দিয়ে। ‘আঃ মা, চেঁচিয়ো না। লোকটার ঘুম ভেঙে যাবে’। দিদি বলল। 

লোকটার ঘুম সত্যি ভেঙে গেল, হয়তো হঠাৎ একটু জোরে কথাবার্তা হওয়ার জন্যই। সে তড়াক করে উঠে বসল বিছানায়, তারপরে রাইফেলে হাত দিল। যেন এভাবেই সে রোজ ঘুম থেকে ওঠে লাফ দিয়ে, তারপর রাইফেলে হাত দেয়। রাইফেলটা যেন ওর শরীরেরই একটা অংশ। সে উঠে দাঁড়ালে রাইফেলটাও উঠে দাঁড়ায়। 

দম বন্ধ করে আমরা দাঁড়িয়ে থাকলাম। ছোট বোনটা অবশ্য ওর দিকে না তাকিয়ে মুখ উঁচু করে আমাদের দিকে তাকাচ্ছিল। আমি ওকে কাছে টেনে নিলাম। 

সৈনিকটা চুপ করে বসে থাকল। মুখ নিচু করে, যেন বসে বসেই ঘুমোতে চাইছে। ‘উঠলে কেন?’ঠাকুমা বলে উঠল, অত্যন্ত কোমল, স্নেহভরা গলায়, যেন নিজের কোনো অসুস্থ আত্মীয়কে বলছে। ‘যত ইচ্ছে ঘুমোও। আমরা চলে যাচ্ছি।’ 

সৈনিকটা তাকিয়ে থাকল ঠাকুমার দিকে। তারপর ম্লান হাসল। আমার মনে হল, যত বয়স ভেবেছিলাম, ওর বয়স তার চেয়ে কম। ‘কেউ খুঁজতে এসেছিল আমাকে?' সে হঠাৎ জিজ্ঞেস করে। 

‘না তো’, আমি বললাম। 

সে খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থাকল। ‘কাল আমাকে পাঞ্জাব যেতে বলছে’, সে বলল, “কিন্তু আমি যাব না। পাঞ্জাব ও রাজস্থানে প্রচণ্ড যুদ্ধ হচ্ছে। রোজ প্রচুর সৈনিক মারা যাচ্ছে’। 

‘কোথাও যেতে হবে না’, ঠাকুমা ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল। ‘তুমি এখানেই থাকো। আমি তোমাকে লুকিয়ে রাখব।’ 

ঠাকুমা হঠাৎ ওর চুলে হাত বোলাতে লাগল। এবং আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে তরুণ সৈনিকটা কেঁদে ফেলল। ‘এখানে আছি জানলে ওরা আমাকে গ্রেপ্তার করবে’, সে বলল। 

‘জানবে কেন? আমরা তো তোমাকে লুকিয়ে রাখব’, ঠাকুমা বলল গলায় গভীর আশ্বাস ফুটিয়ে। 

‘অথচ পাঞ্জাবে আমার একদম যেতে ইচ্ছে করছে না’, সৈনিকটা বলতে লাগল অন্যমনস্কভাবে। ‘হঠাৎ কেন যে এমন হল নিজেই বুঝতে পারছি না। বাঁচার ব্যাপারে একটা কুকুর বা বেড়ালও আমার চেয়ে স্বাধীন’। 

‘ঠিকই তো’, ঠাকুমা বলল, ‘ওরা কেমন মনের আনন্দে বেঁচে থাকে। যুদ্ধ করে করে ওরা অকালেই মরে না।’ 

‘অথচ ভিতু বা কাপুরুষ আমি নই’, সৈনিকটা বলল স্বগতোক্তির মতো করে। ‘এর আগে কাশ্মীরে পোস্টিং ছিল। সেখানে তিনজন পাকিস্তানিকে মেরেছি। আসলে এই নভেম্বর মাসটা এলেই এরকম ঝামেলা হয় আমার মনে। এর আগেও দেখেছি। হঠাৎ আর যুদ্ধ করতে ভালো লাগে না। ইচ্ছে করে চুপ করে শুধু শুয়েবসে থাকি।’ 

বাবার চোখ দুটো ছলছল করে উঠল, লক্ষ করলাম। 

‘আমাকে এখানে দেখতে পেলেই ওরা গ্রেপ্তার করবে’, কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সৈনিকটা বিড়বিড় করে বলল। 

‘কেন দেখতে পাবে?’ ঠাকুমা বলে। তুমি নীচে নামবেই না। আমাদের এত বড় বাড়ি। যে কোনো একটা ঘরে লুকিয়ে থাকবে। 

‘আপনার কোনো অসুবিধে হবে না’, দিদি বলল। ‘আপনার যা যা লাগবে আমরাই ব্যবস্থা করে দেব’। 

হঠাৎ লোকটা উঠে দাঁড়াল তক্তপোশ থেকে। রাইফেলটা হাতে ধরে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগল হলঘরটায়। কিছু না বলে আমরা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। এবার ওকে একটু ভয় পাচ্ছিলাম। হয়তো ঠাকুমাও। উদ্বিগ্ন মুখে ঠাকুমা দেখছিল ওকে।

পায়চারি করতে করতে লোকটা রাইফেলের পেছনটা দিয়ে আচমকা দেওয়ালের গায়ে প্রচণ্ড জোরে একটা ঘা মারল। ওখান থেকে পলেস্তারা ও বালি খসে পড়ল। স্ট্যান্ড রোডে গঙ্গার কাছে দাঁড়ানো খুব পুরোনো তিনতলা বাড়ি আমাদের। ইংরেজদের সঙ্গে সিল্ক ও তুলোর ব্যবসা করে ধনী ঠাকুরদার বাবা এটা তুলেছিল। এরপরের বংশধরেরা আর কেউ ধনসম্পদ উপার্জন করতে পারেনি। বাড়িটা ভেঙে পড়েছে। তবু অভাব অনটনের মধ্যেও আমরা কয়েকজন প্রাণী ভালো আছি। হেসেখেলে, পরস্পরকে ভালোবেসে মোটামুটি সুখেই থাকি। উন্মত্ত সৈনিকটা রাইফেলের পেছনটা দিয়ে মাঝে মাঝে আঘাত করে চলেছে হলঘরের দেওয়াল ও থামগুলোকে। আমার মনে হল, এই ঘরের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস দেওয়াল ও থামের গায়ে করা কিছু প্রাচীন দুর্লভ নকশা। সে খুব জোর ওগুলোকেই গুঁড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে আমাদের দরিদ্রতর করে দিতে পারে। তবে এদিক-ওদিক দাঁড়িয়েছিল আরও কিছু জিনিস। সে ওগুলোও ভাঙতে লাগল। প্রথমে ভাঙল মেহগনি কাঠে করা ঈষৎ লালচে রঙের পিয়ানোর টেবিলটা। তারপর ভাঙল নেপাল থেকে আনা একটা পাথুরে মুখোশ। ভাঙল কোনো ইতালিয় বণিকের উপহার দেওয়া দেওয়ালে টাঙানো একজোড়া পোর্সিলিনের ফুলদানি। টেবিলে রাখা ধুলোমাখা একটা বাইবেল বাক্স, যার কাচের নীচে ঠাকুরদার বাবা সত্যি একটা খোলা বাইবেল রাখত। আর প্রতিদিন ওটার একটা করে পাতা উলটে দিত। কলকাতার কোনো ইংরেজ কারিগর দিয়ে করানো একটা ভাঙা চেয়ার, যার পায়াগুলো মেঝেয় ফণা নামিয়ে শুয়ে থাকা চারটে সাপের মতো । ভাঙল একটা বন্ধ হয়ে যাওয়া দেওয়াল ঘড়ি।। এরপর সে দাঁড়াল দেওয়ালে টাঙানো একটা অর্ধবৃত্তাকার আয়নার সামনে। অদ্ভুত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল নিজের মুখের দিকে, যেন অন্য কাউকে দেখছে, যেন চিনতে পারছে নিজেকে। তাকাতে তাকাতে এমনভাবে একটু হাসল যেন কোনো গোপন জটিল সমস্যার সমাধান খুঁজে পেয়েছে হঠাৎ। আচমকা রাইফেলের এক আঘাতে আয়নাটা ভেঙে ফেলল। এরপর হাঁপাতে হাঁপাতে বসে পড়ল মেঝের ওপর। 

‘এসব জিনিস ভেঙে তুমি আমাদের বিশেষ আর্থিক ক্ষতি করোনি’, ঠাকুরদা বলল শান্ত গলায়। ‘কারণ এগুলোর আর কোনো দামই ছিল না। তুমি আঘাত দিয়েছ আমাদের স্মৃতির কোমল পর্দায়। এতক্ষণ ওই পর্দাটাই ছিঁড়েছ। কারণ জিনিসগুলোকে আমার বাবা সত্যি খুব ভালোবাসতেন।’ 

‘আমি পাঞ্জাবে যাব না’, সৈনিকটা একদৃষ্টিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে বিড়বিড় করছিল। ‘শুধু নিজের চেহারাটা কোনোভাবে পালটে ফেলতে হবে, যাতে ওরা আমাকে চিনতে না পারে’। 

হাত ধরে ঠাকুমা ওকে আবার তক্তপোশে নিয়ে গিয়ে বসল। যন্ত্রের মতো সে উঠে গেল। আসলে সে কোনো গভীর ভাবনায় ডুবেছিল। আমি বুঝতে পারলাম। একটু দুধ খাবে কি না, ঠাকুমা জিজ্ঞেস করল। সে উত্তর দিল না।

ভোরে ভালো করে আলো ফোটার আগে একটা মিলিটারি জিপ একেবারে আমাদের বাড়ির সামনে ব্রেক কষল। বাবা দেখতে পেল দোতলার বারান্দা থেকে। সবাই বুঝলাম সৈনিকটার খোঁজে সিনিয়ার আর্মি অফিসাররা এসেছে। ঠাকুমা সৈনিকটাকে তাড়াতাড়ি পেছন দিকের একটা কুঠুরিতে ঢুকিয়ে দিল। সৈনিকটা অন্যমনস্কভাবে অদ্ভুত হাসছিল, যেন কোনো আশ্চর্য স্বপ্নের জগতে ঢুকে পড়েছে। 

সদর দরজায় ওরা ক্রমাগত আঘাত করতে লাগল। মা, বাবা, বোন ও কাজের ছেলেটা বাদে আমরা সবাই নীচে গেলাম। দরজা খুলতেই নীচতলায় সিঁড়িঘরে থাকা আমাদের পোষা কুকুরীটা নিজের পাঁচটা বাচ্চা নিয়ে লাফ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। কিন্তু আমাদের হতবাক করে ওদের সঙ্গে লাফ দিয়ে বেরোল আরও একটা বড়সড় কুকুর। বাইরের আবছা আলোয় কুকুরটাকে চিনতে পেরে আমি ও ঠাকুমা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসলাম। চারপেয়ে জীবটা মাথা নিচু করে বেশ হেলেদুলে বাকি কুকুরদের পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছিল। আমি আবার উপলব্ধি করলাম সৈনিকদের অসাধ্য কিছুই নেই। ক্লান্ত, ঘুমঘুম, টলতে থাকা  সশস্ত্র অফিসাররা ব্যাখ্যা করে বলল একজন পালানো সৈনিকের খোঁজে তারা আমাদের বাড়ি তল্লাশি করতে চায়।

আসুন। আমরা বললাম। 


                                                                             
                                                                              



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3 মন্তব্যসমূহ

  1. বাংলা বানানের এত দৈন্যদশা কেন? আধুনিক বাংলা বানানের কোনও নিয়মই তো মানা হয়নি! কোন অভিধান মানা হয়, সেটা কি জানা সম্ভব? টাইপিস্টের ভুলের কারণেই কি বানান বিভ্রাট?

    উত্তরমুছুন