আমি আঙ্গুল তুলে তূর্যকে দেখালাম-ওই যে পুঁইশাকের ঝোপে গঙ্গাফড়িংয়ের দল উড়ে বেড়াচ্ছে, দ্যাখ একবার!
'দ্যাখ! কী সুন্দর সবুজ রঙটা!'
ওর দৃষ্টি এখনো মাটির দিকে। নিচু হতে হতে চিবুকটা বুক ছুঁয়ে যাচ্ছে। একটু পরেই বড় বড় ফোটায় জল গড়াবে চোখ দিয়ে। আমি অবশ্য না দেখার ভান করে আছি।
ছাদে বসে এই একটু আগেই তূর্যকে মেঘ চেনাচ্ছিলাম। আলটোকিউমুলাস হলো পেঁজা তুলো মেঘ, ঝিরিঝিরি মেঘ সেরোকিউমুলাস। আর যে মেঘ ঝুপঝাপ বৃষ্টি ডেকে আনে তার নাম কিউমুলোনিম্বাস। তূর্য খুব মন দিয়ে শোনে। ওর প্রশ্ন শুনলেই সেটা বোঝা যায।
না রে, ওটা হলো আলটোকিউমুলাস!
আমার হাসি দেখে তূর্যও হেসে ফেলে। ওর হাসিটা আমার মতোই, অবিকল। শুধু হাসি কেন, ওর কথা বলার ভঙ্গি, চোখ ছোট করে তাকানো সবটাই আমার। এই নিয়ে ওর মায়ের মনে চোরা দুঃখ আছে।
আমি ঋতিকে বলি -ছেলে তোমার মতো শান্ত হয়েছে বলেই বেঁচে গেছো, আমার মতো চঞ্চল হলে বুঝতে!
ঋতি ম্লান হাসে। বলে- তূর্যও কিছু কম নয়!
ঋতি অনেক শাসন করে ছেলেকে। তা যতই বকুনি দিক না কেন ঘুম থেকে জেগে রাতের খাওয়া অব্দি, অহর্নিশি মাকেই চাই তূর্যের। আমার সবটা পেলেও ছেলে আসলে হয়েছে একদম মা ন্যাওটা।
সেই তূর্য, মা ভক্ত ছেলেটা দুদিন ধরে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, মাকে এড়িয়ে চলছে। ঋতি চা খেতে খেতে আজ সকালে ব্যাপারটা আমাকে জানালে আমি রীতিমতো অবাক হয়ে গেলাম। তূর্যকে ডেকে এনে কথা বলবো ভাবছিলাম। কিন্তু তখুনিই ঋতির মায়ের বাড়ি থেকে ফোনটা এলো। আজকে ওদের বাড়িতে দুপুরে খেতে বলা হলো আমাদের। মাসখানেক ধরে ঋতির বাবার শরীরটাও ভালো নেই। তাকেও দেখতে যাওয়া উচিত। আমরা বের হলাম, প্রসঙ্গটা তাই তখন চাপা পড়ে গেল।
তূর্য খুব ছুটোছুটি করে দাদুবাড়িতে বেড়াতে এলে। একতলা বাড়ির পাঁচিলের ভেতরে অনেকখানি খোলা জায়গা। গাছের ছায়া, পাখির ডাক, বেড়াল ছানা-আমাদের ফ্লাটবাড়িতে তার লেশমাত্র নেই। ছেলের আনন্দ দেখে আমরাও খুশি।
বাড়ির ছাদটাও সুন্দর, ছিমছাম। একপাশে পুঁইশাক,মরিচগাছের ঝোপ। আরেকপাশে টবভর্তি নানান রঙের গোলাপ, টগর। কিছু চারাগাছ, কিছু প্রাপ্তবয়স্ক। তূর্য তক্কে তক্কে আছে ফুল ছেঁড়ার জন্য। একবার ডাক দিতেই ভদ্রলোকের মতো চুপচাপ এসে আমার পাশে বসলো।
আমি ওকে মেঘের গল্প শোনালাম। আর মনে মনে প্রস্তুত হলাম। সকাল সকাল কথাগুলো শুনে মনটা একদম খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বলতে বলতে ঋতি তো প্রায় কেঁদেই ফেলেছিল। ওকে সান্ত্বনা দিয়ে ছেলের সাথে বোঝাপড়ার দায়িত্বটা তাই আমিই নিলাম।
তোর গোলাপ ভালো লাগে?
হ্যাঁ, বাবা, খুউব! কত বড় বড় পাপড়ি দেখো!
হুম! এখানে আরো কত রঙের ফুল আছে দ্যাখ... তুই কোনটা নিবি?
আমি নেব বাবা? কিন্তু দিদা বকবে না ফুল ছিঁড়লে?
তাহলে?
আচ্ছা, চুপিচুপি নেব? নিই না, একটাই তো নেবো!
দিদা টের পেলে কী বলবি?
বলবো -আমি জানি না!
হাত দিয়ে মুখ ঢেকে হাসি চেপে রাখার চেষ্টা করে তূর্য। আমার ভেতরটা কেমন করতে থাকে। ছেলেটা কবে এসব শিখলো! ও কি বদলে যাচ্ছে? তাই মাকে এড়িয়ে চলছে দুদিন ধরে?
কী হলো বাবা? আমি ফুল নেব?
চুপিচুপি কিছু নিতে নেই রে। নেবার আগে দিদাকে জিজ্ঞেস করতে হবে।
উঃ! না, আমি জিজ্ঞেস করতে পারবো না। দিদা তো মাকেও বলে দেবে!
তাহলে আর কি। নিবি না। কখনো কারো কিছু না বলে নিতে নেই। নিয়ে ফেললেও সাথেসাথে ফিরিয়ে দিবি। নইলে সবাই কী বলবে জানিস? বলবে- তূর্য চোর, ওর বাবা মা ওকে চুরি শিখিয়েছে। এমন শুনলে আমাদের ভালো লাগবে? মা কত কষ্ট পাবে একবার ভেবে দ্যাখ?
তূর্য সেই যে মাথা নিচু করে ফেলেছে আর মুখ তুলছেই না। কাঁদছে হয়তো। ওর ছোট শরীরটা একটু একটু করে কাঁপছে।
আমি ঋতিকে ডাকতে গিয়ে দেখি রাগ পড়েনি ওর, আজ নাকি কথাই বলবে না ছেলের সাথে। তূর্যের স্কুলের ব্যাগে আয়ানের রঙপেন্সিলের বাক্সটা ঋতিই খুঁজে পেয়েছে। দু'দিন আগে আয়ানের মা যখন টিচারকে জানালো ঋতি তখন ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি তূর্যই কাজটা করেছে। খুব মন খারাপ হয়েছে ওর।
আমি কিছুক্ষণ ওকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম। ঋতি চুপচাপ শুনলো আমার কথা। তারপর বললো- 'তোমার লাই পেয়েই ছেলে এমন করেছে'। এরপর আমি আর কথা খুঁজে পেলাম না। বেরিয়ে পড়লাম। একাএকাই রাস্তায় এলোমেলো ঘুরলাম কিছুক্ষণ।
এই জায়গাটায় বেশ একটা মফস্বলী ঘ্রাণ আছে। অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম আমাদের ওদিকটায় কেমন ইটসুরকির ঠাঁসাঠাসি জীবন। ছিরিছাঁদ নেই। মসৃণ রাস্তায় পা রাখলেই ভিমড়ি খেতে হয়। একটু বেখেয়ালেই হাতটা বা মাথাটা চলে যায় চাকার নিচে। আর এদিকটায় কেমন দিব্যি মাঝরাস্তায় হেঁটে বেড়াচ্ছি!
খানিকটা এগিয়ে ফুটপাতেই পরিষ্কার জায়গা দেখে বসলাম আমি। রাস্তার ওপারে আকাশমণির সারি। আমার স্কুলবেলার কথা মনে পড়ে। আমাদের স্কুলের মাঠেও এমন সারি সারি আকাশমণি ছিল। কত স্মৃতি!
টুটুলের কথাও মনে পড়ছে আজ। সকাল থেকে ওর নম্বরে কয়েকবার ফোন করলাম, ধরলো না। ফোন বেজে বেজে থেমে গেলো একবার, দুইবার, তিনবার। টুটুলের কথা মনে এলে সেই বাইনোকুলারটাও চোখে ভাসে। এত দারুণ ছিল দেখতে। চকচকে কালো রঙ! ওর মামা জন্মদিনে উপহার দিয়েছিল ওকে। টিফিন পিরিয়ডে টুটুলের কী কদর ছিল কয়েকটা দিন! বাড়িতে ফিরে মাকে বলতেই কান মলে দিয়েছিল আমার। মায়ের যুক্তিগুলো কিন্তু ভালো ছিল। টুটুল প্রতি বছর ফার্স্ট হয়, কত ভদ্র ছেলে। ওরকম উপহার ওকেই মানায়। এরপর থেকে আমি প্রায়ই টুটুল আর ওর বাইনোকুলারের কথা ভাবতাম।
ঋতিকে কখনো বলিনি, কাউকেই বলিনি যে আমিও স্কুলে একবার চুরি করেছিলাম। তখন অবশ্য ব্যাপারটাকে চুরি বলে ভাবতে পারিনি। একটা ঘোরের ভেতর ছিলাম আমি।
সেদিন ক্লাসরুমে কেউ ছিল না আর টুটুলের ব্যাগের চেইনটাও খোলা ছিল। আমি খুব সাবধানে বাইনোকুলারটা বাড়িতে এনে স্টোররুমে পুরনো বইয়ের ঝুড়ির ভেতর রেখে দিলাম। মাঝেমাঝে দুপুরবেলা লুকিয়ে ছাদে উঠে দূরের গাছপালা, পাখি এসব দেখতাম। তারপর আবার লুকিয়ে রাখতাম।
আমার মনে পড়ে, সেদিন টুটুল খুব কেঁদেছিল। কাঁদতে কাঁদতে ওর ফর্সা মুখটা লাল হয়ে গিয়েছিল। আর স্যার খুব রেগে গিয়েছিলেন। একবার ভেবেছি জিনিসটা ফিরিয়ে দিবো। কিন্তু খুব ভয় পেয়েছিলাম আমি। স্যার মাফ করলেও বাড়িতে মা ছিল, জানতে পারলে ঘরেই ঢুকতে দিত না আমাকে।
আমি অবশ্য ধরা পড়িনি। টুটুলটা একদিন পর নালিশ করায় জিনিসটা সরিয়ে রাখতে পেরেছিলাম। এই ব্যাপারটা ওকে কখনো বলতে পারিনি। একই কলেজে পড়েছিলাম আমরা, এখনো মাসে ছ'মাসে দেখা হয় আমাদের। তবু বলা হয়নি। আজ তূর্যের ব্যাপারটা জানার পর থেকেই কেমন অস্বস্তি লাগছে আমার।
টুটুলের সাথে কথা হলো শেষ পর্যন্ত। আমরা রাতের খাবার খেয়ে ছেলেকে নিয়ে তখন সবেমাত্র বাসায় ফিরেছি। টুটুল ফোন করে ওর মেয়ের জন্মদিনে আমাদের সবাইকে নিমন্ত্রণ দিল। কিছুক্ষণ এটা ওটা গল্পও করলো। ফোন রেখে সেই বাইনোকুলারটা খুঁজে বের করে র্যাপিং করতে বসলাম আমি।
অনেক রাত অব্দি ঘুম এলো না আমার। তূর্য মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়েছে। ঘুমোবার আগে কানেকানে মাকে স্যরি বলেছে কয়েকবার। আমি চুপচাপ ওদের দেখছিলাম। ঘুমন্ত মুখ দু’টো দেখতে দেখতে আমার সারাদিনের অস্বস্তিটা একটু হালকা হলো। জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই জলগন্ধী হাওয়ার ঝাপটা লাগলো নাকেমুখে। টের পেলাম সকালের কিউমুলোনিম্বাস মেঘগুলোও আর ভার বইতে না পেরে ঝরতে শুরু করেছে।
লেখক পরিচিতি:
নিবেদিতা আইচ।
গল্পকার।
7 মন্তব্যসমূহ
এই দুদিন আগে আমার ছোট্ট মেয়ে কাজিনের একটা ছোট্ট মিকি না বলে নিয়ে এসে কি যে খুশি। বুকে নিয়ে ঘুমায়। কবে ফেরত দেবে জিজ্ঞেস করলে বলে কালকে। পরদিন জিজ্ঞেস করলে বলে- কালকে। ওর কালকে আর ফুরোতে চায় না। বাজার থেকে মিনি কিনে আনা হলো, মিকি ফেরত গেল। কিন্তু ঠিক যেন ফেরত গেল না। আমাদের সবারই বুঝি গোপন একটা বাইনোকুলার থাকে। এই চোরাকাটা নিয়ে আমরা ঝোপঝাড় বানাই। গল্পটা চমৎকার। আপনার লেখায় নরম মাটি থাকে,সবসময় ছুঁয়ে যায়।
উত্তরমুছুনঅনেক ধন্যবাদ প্রিয় কথাশিল্পী। আপনার প্রতিক্রিয়া পেয়ে সত্যিই অনুপ্রাণিত হলাম।
মুছুনবই থেকে পড়েছিলাম গল্পটা। তখনই আদরের গল্প ছিল আমার। গুরুগম্ভীর থিমে হরেক চেষ্টা করে গল্প লিখতে লিখতে আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম জীবনের বাইনোকুলারে সাদামাটা একটা সত্য বা মিথ্যে অনুভবের গল্পও পাঠকের মনে গাঢ় দাগ রাখতে পারে। ভালোবাসা বোন। নিজেকে ছাড়িয়ে যাও ক্রমাগত।
মুছুনএমন আন্তরিক কথাগুলো আমাকে শক্তি দেয়। লেখার প্রয়াস চালিয়ে যেতে পারি। নিরন্তর ভালোবাসা প্রিয় অগ্রজ।
মুছুনএই গল্পটা এত নরম কোমল। মন খারাপ হয়, মন ভালো হয় পড়লে।
উত্তরমুছুনভালোবাসা জেনো প্রিয় দেবদ্যুতি।
মুছুনভালোবাসা জেনো প্রিয় দেবদ্যুতি।
মুছুন