এ শহর দাড়ি বেয়ে, দেরাজ উপচিয়ে, কাপড়ের সেলাই গড়িয়ে পিলপিল করে ইঁদুর বেরুনো হ্যামিলন শহর নয়। আধুনিকতা, পরিচ্ছন্নতা- পাশ্চাত্যের আদর্শের মাপে তৈরি এই শহরের বালি-নোনতার সমুদ্ৰই বুঝিবা হ্যামিলনের ইঁদুরের কথা মনে করিয়ে দেয়। বিশেষ করে আমরা যারা দেখেছি ইতিহাসের সবথেকে বড় সামুদ্রিক বিপর্যয়। গ্যালন গ্যালন তেলে উপচে পড়া করুণ সমুদ্র। তাই হয়তো ফুলে ওঠা শত মাছ, ভেসে যাওয়া মরা ডলফিন, কাছিম, পাখিদের ভিড়ে দেখতে পাই অমন রূপকথার ইঁদুর।
রেস্তোরাঁটা কারো কাছে বাগান বাড়ি, কারো কাছে সাজানো পসরা। খোঁপার কাঁটা, জামা, গয়না, ছবি, পেয়ালা, বালিশ, রান্নার বই, মশলা, তালের রস, নারকোল, ছাঁচের পিঠা সাজানো সবকিছুই চাইলে কিনতে পাওয়া যায়। কারো কাছে এ যেন মন্দির। মন্দিরের ঘন্টার মতো আগমনকে অভ্যর্থনা জানায় দরজায় লাগানো চাইম। তারও আগে রেস্তোরাঁর সামনে গাছের ফাঁকে শান্ত তাকিয়ে থাকে স্পিরিট হাউজ। নমস্কার করে ভেতরে ঢুকতেই ভাগ্যের দেবী নাং কোয়াক হাত তুলে ডাকেন। সাতখানা বুদ্ধ মূৰ্তি আছে, ধ্যানরত। এইসব খাবার ও ঘ্ৰাণ বুঝিবা তীক্ষ্মতর করে তুলেছে তাঁর ধ্যান। সামনে প্ৰতীক্ষায় কাতর সাত গ্লাসে বিনীত জল যেন ভক্ত। অপেক্ষায়, কখনো যদি ক্লান্ত দেবতা করুণা করে মুখে তুলে নেয়। তারও কিছু পরে গুরুর ছবি, প্ৰাৰ্থনা, ছবির পায়ের কাছে চাল, আগরবাতি, টাকার নোট। দরজার ধারেই সৌভাগ্যের ধারক লাফিং বুদ্ধা, পয়সা মুখে জিন চান- লাল চোখের ব্যাঙ।
সাতাত্তর বছর বয়সী রেস্তোরাঁর মালিক পারিয়ানকে ছোট-বড়ো সবাই ডাকে মম। তাঁর কাছে দেবতাই সফলতার স্ট্ৰ্যাটেজি। দেবতার করুণাও হয়তো ঝরে গেছে তাই। চড়াই উৎরাই পেরিয়ে রেস্তোরাঁটা টিকে আছে আজও। পরপর পাঁচ বছর হয়েছে 'বেস্ট এশিয়ান রেস্টুরেন্ট অব দ্যা বে' বিজয়ী। এ শহর ঐতিহ্যের মতো আঁকড়ে রেখেছে রেস্তোরাঁটাকে। গর্ভবতী অথচ মমের হাতের নারকেলের স্যুপ খায়নি, এমন মেয়ে কমই আছে। আঠারো বছরে শহর ছেড়ে চলে যাওয়া ছেলেটা অথবা মেয়েটার সাথে ঝুলে থেকেছে অতীতবিধুরতার মতো একটা খাবারের প্যাকেট, এই রেস্তোরাঁর। ইতিহাস জানে প্রত্যেক টেবিলে ছুঁয়ে আছে একটি করে প্রেমের গল্প। রেস্তোরাঁয় দুটো বিয়েও হয়েছে, তাই ও আছে ঘর বাঁধা গল্পে, আছে নতুন শিশুর গল্পে। কিচেনে কাজ করতো বেড়াল পাগল 'বুড়ো ক্যাট' মারা গিয়েছিল এখানেই, হার্ট এটাকে। এখনও ওর স্মরণে দেয়ালে ঝুলানো সাদা-কালো বেড়ালের ছবিটা তাকিয়ে থাকে। মম বলেন 'ভালো করে তাকালে বুড়ো বেড়ালটার মিঞাও ডাক শুনতে পাওয়া যায়। মানুষটা বিড়াল হয়েই রেস্তোরাঁয় থেকে গেছে।'
আমাদের বন্ধু পার্থ, এ রেস্তোরাঁর পুরনো কর্মচারী, সেদিন অবশ্য অন্য কথা শোনালো- 'পেটে বোধহয় লাথি পড়ার সময় আসছে। কোত্থেকে এক ইঁদুর ঢুকেছে। ল্যাদা পরিষ্কার করতে করতে জান শেষ। একবার কোন কাষ্টমার দেখে ফেললেই রেস্তোরাঁটা বন্ধ করে দেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। মাঝেমধ্যে বিকেলে পার্কিং লটে গাড়ীর নিচ থেকে ছুট দেয় ইঁদুর। সেদিন তো খদ্দেরকে বসতে বলেছে এগারো নাম্বার টেবিলে। আমি পানি রেখে আসতে গিয়ে দেখি চেয়ারে কম্ম কাবার। ভাগ্যিস ওরা রেস্টরুমে গিয়েছিল প্রথমে। খাবলা দিয়ে ল্যাদা নিয়ে আসলাম আর কি। চিন্তা করো বুদ্ধের সামনেও ইঁদুরের ল্যাদা! মম বলেন প্রার্থনায় ঘাটতি হচ্ছে। সব গ্লাসে পানি বদল করলেন, নতুন আগর জ্বালালেন। ইঁদুরের কল আছে কিন্তু ধরা পড়ছে না। পিনাট মিনাট খায় না। কি খায় জানো? জেড প্ল্যান্টের পাতা, চিবিয়ে কিছু ফেলেও যায়। জেড প্ল্যান্ট কি ইঁদুরের জন্যও সৌভাগ্যের?'
আমরা ভাগ্যবতী পাতা খেয়ে ফেলা অদ্ভুত এক ইঁদুরের গল্প শুনি। শুনি কিছু চলমান সমস্যা। ক্ৰেডিট কার্ড মেশিনে কাজ হচ্ছে না, ল্যাণ্ডফোনে সমস্যা, মোবাইলে অ্যাপ চালু করেছে, তাতেও ঝামেলা, এক সপ্তাহে কয়েকশ' ডলার গচ্ছা। একদিন শুনতে পেলাম- এই রেস্তোরাঁর পুরোধা, আহা, মমের মা মারা গেছেন। ইঁদুরের আস্তানা গাড়া মানে আপনজনের মৃত্যু কিংবা দুঃসংবাদ- আমরা এই মিথে সায় দিতে থাকি। তারও বছর খানেক পরে আমরা জানব এই শহরে, পৃথিবীতে নেমে আসবে মহামারী। আর প্রথমেই বন্ধ হয়ে যাবে ব্যুফে রেস্তোরাঁটা। একেক সময় আমাদের মনে হতো সবকিছুর জন্য দায়ী ইঁদুরটা। বিমর্ষ নিয়তির মতো টেনে নিয়ে যাচ্ছে রেস্তোরাঁটাকে, আমাদের। এভাবেই একটা ইঁদুর আমাদের সঙ্গী হয়ে ওঠে। তাই বুঝি হ্যামিলন শহরকে ভীষণ মনে পড়ে আমাদের। অসহায় জলে অবলম্বনের মতো পাওয়া এই শহর আমাদের। মা বলতেন প্রিয় কিছুর জন্য হাহাকার থাকতে হয়। ফেলে আসা ঐতিহ্যের জন্য হাহাকার করা আমাদের বুকে কেমন এক রোখও চাপে। আমাদের বুড়ো আঙুল দেখাও ইন্দুর! আমরা বাঁশির দেশের মানুষ। গোল্লাছুট, লুকোচুরি আমাদের আঙুলের শৈশব। দেবতা থোরাই কেয়ার করা বেয়াড়া ইঁদুর ঠিক বের করে নিয়ে আসবো। জিতে যাবা তুমি? যেমন তুমি বুনো ইঁদুর, আমিও বাঘা বিলাই। 'এই তো আমার নতুন বাসায় পেস্ট কন্ট্ৰোলার ছয় মাসে কিচ্ছুটি করতে পারলো না। পাউরুটির পুরো প্যাকেট নিয়ে যেদিন গেল, রাগে তিন দিনে সাতটা ইঁদুর ধরে ছবি পাঠিয়েছিলাম'- আমিও উস্কে দেই আগুন।
এক দুপুরে আমরা লক্ষ্য স্থির করি। বাঁশি বাজাতে বাজাতে করুণ সমুদ্ৰ থেকে আমরা সূৰ্যাস্তের দিকে হাঁটতে থাকি। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হই, ক্ষিধে পেয়েছে ভাবনার সাথে যুদ্ধ গোছাই। অথচ রেস্তোরাঁটাকে দেখতে পাই না কোথাও আর। ধীমান কম্পাস বের করে। আমরা বাঁশি হাতে খানিক এগুই, পিছুই। কেন যেন ভয় হতে থাকে আমরা বোধহয় কোনদিন আর খুঁজে পাব না ঐ জেসমিন রেস্তোরাঁ। বরাবরই তো বোহেমিয়ান ছিল ও, আমাদের বিশ্বাসের মতো। তবে কোন না কোন মৃত ইঁদুর নিয়ে বিকেল ভাসাবোই- ঈশ্বরের দিব্যি। আমরা ছুটতে থাকি রেস্তোরাঁর পুরনো ঘ্রাণকে কল্পনা করে। সামনে মাস্ক পরা কিছু পুলিশ দাঁড়ায় 'মহামারীতে বের হয়েছেন? জানেন না লকড ডাউন! বীচ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পিছোন! পিছোন!' ধীমান হাত থেকে বাঁশি ছুড়ে মারে পুলিশের দিকে। মহামারীর খবরে কি়ংবা ধীমানের রাগ দেখে আমরা আশ্চর্য হই না, শুধু ধুকপুক বাড়ে। সায়ান দূরে আঙুলে নকশা টানে- ঐসব সমুদ্রের জলে মরা মাছ, কাছিমের সাথে ভেসে যাচ্ছে সারে সারে মানুষের লাশ। আমরা উল্টো ঘুরে দৌড়ুতে থাকি। মুখে চেপে থাকা মাস্কে ঝড়ের মতো দোল খেতে থাকে আমাদের নিঃশ্বাস। মনে হয় ভেসে চলেছি যেমন ভেসেছিল হ্যামিলনের ইঁদুরেরা। কাকতালীয়-ভাবে, আকাশেও তখন ইঁদুরের গায়ের রঙ। ক্লান্ত হতে হতে যখন ভাবি টুকরো হয়ে যাই, (একটা আস্ত যুগ পরেই হবে হয়তো) পরিচিত খাবারের গন্ধ আরাম হয়ে ছুঁয়ে যায় ক্লান্তিতে। বৃষ্টিতে গন্তব্যে পৌছুনোর পর ছাতা বন্ধ করে যেমন আরাম হয়, সেরকম। ঐ তো আমাদের ঘর, দরজা, জানলা, বক সাদা সব দেয়াল- অপেক্ষায়। অথচ ঘরে ফেরে সপাটে দরজা বন্ধ করতেই কেমন এক অস্বস্তি হয়। মনে হয় ফাঁদে আটকে গেছি। গলার কাছে শব্দ গড়াতে থাকে- চিঁ চিঁ চিঁ…
এই করুণ সমুদ্র থেকে সূর্যাস্তের দিক বরাবর হাঁটতে হাঁটতে আমরা যখন ক্লান্ত হই। ভীষণ ক্ষিধে পেয়েছে ভাবনা গোছাই, ঠিক সেখানটাতেই একটা রেস্তোরাঁ দাঁড়িয়ে। প্রথম দিন ইয়ামিন রেস্তোরাঁ দেখে বলেছিল বোহেমিয়ান বাগান বাড়ি। বাইরে সারে সারে গাছের টব সাজানো। এখানেই একদিন কাঠগোলাপ ফুটতে দেখেছিল অনিন্দ্য জীবনের প্রথমবার। হোসাইনের দু’মাস বয়সী মেয়ে জীবনের প্রথম ছুঁয়েছিল ফুল, অপরাজিতা। ভেতরে ছুঁয়ে গেছে গাছ। প্রতিটা খাবার টেবিলে ছোট ছোট বনসাই, মানি প্ল্যান্ট। ব্যুফে বারের পাশে টবে সাদা অলকানন্দা ফুটে থাকাকে কিংবা খাবারের প্লেটের কাছে দুটো একটা শুকনো পাতা ঝড়ে যাওয়াকে মনে হয় অলৌকিক স্নিগ্ধতা। আর ভেতরে ঢুকতেই আড়াই যুগ ধরে প্লেয়ারে একটানা বেজে চলা পিয়ানোর সুর আশ্চর্য কবুতর হয়ে উড়ে আসে আচমকা। এক পিয়ানোবাদক খেতে এসে বলেছিলেন, ‘এরকম সুর ভরা রেস্তোরাঁ দেখেনি আর। আমার বাগানে জেসমিন ফুল আছে। এই যে পিয়ানোর সুর শুনতে শুনতে জেসমিন টি খাচ্ছি, ফুলের সেই গন্ধটা পাচ্ছি।'
রেস্তোরাঁটা কারো কাছে বাগান বাড়ি, কারো কাছে সাজানো পসরা। খোঁপার কাঁটা, জামা, গয়না, ছবি, পেয়ালা, বালিশ, রান্নার বই, মশলা, তালের রস, নারকোল, ছাঁচের পিঠা সাজানো সবকিছুই চাইলে কিনতে পাওয়া যায়। কারো কাছে এ যেন মন্দির। মন্দিরের ঘন্টার মতো আগমনকে অভ্যর্থনা জানায় দরজায় লাগানো চাইম। তারও আগে রেস্তোরাঁর সামনে গাছের ফাঁকে শান্ত তাকিয়ে থাকে স্পিরিট হাউজ। নমস্কার করে ভেতরে ঢুকতেই ভাগ্যের দেবী নাং কোয়াক হাত তুলে ডাকেন। সাতখানা বুদ্ধ মূৰ্তি আছে, ধ্যানরত। এইসব খাবার ও ঘ্ৰাণ বুঝিবা তীক্ষ্মতর করে তুলেছে তাঁর ধ্যান। সামনে প্ৰতীক্ষায় কাতর সাত গ্লাসে বিনীত জল যেন ভক্ত। অপেক্ষায়, কখনো যদি ক্লান্ত দেবতা করুণা করে মুখে তুলে নেয়। তারও কিছু পরে গুরুর ছবি, প্ৰাৰ্থনা, ছবির পায়ের কাছে চাল, আগরবাতি, টাকার নোট। দরজার ধারেই সৌভাগ্যের ধারক লাফিং বুদ্ধা, পয়সা মুখে জিন চান- লাল চোখের ব্যাঙ।
সাতাত্তর বছর বয়সী রেস্তোরাঁর মালিক পারিয়ানকে ছোট-বড়ো সবাই ডাকে মম। তাঁর কাছে দেবতাই সফলতার স্ট্ৰ্যাটেজি। দেবতার করুণাও হয়তো ঝরে গেছে তাই। চড়াই উৎরাই পেরিয়ে রেস্তোরাঁটা টিকে আছে আজও। পরপর পাঁচ বছর হয়েছে 'বেস্ট এশিয়ান রেস্টুরেন্ট অব দ্যা বে' বিজয়ী। এ শহর ঐতিহ্যের মতো আঁকড়ে রেখেছে রেস্তোরাঁটাকে। গর্ভবতী অথচ মমের হাতের নারকেলের স্যুপ খায়নি, এমন মেয়ে কমই আছে। আঠারো বছরে শহর ছেড়ে চলে যাওয়া ছেলেটা অথবা মেয়েটার সাথে ঝুলে থেকেছে অতীতবিধুরতার মতো একটা খাবারের প্যাকেট, এই রেস্তোরাঁর। ইতিহাস জানে প্রত্যেক টেবিলে ছুঁয়ে আছে একটি করে প্রেমের গল্প। রেস্তোরাঁয় দুটো বিয়েও হয়েছে, তাই ও আছে ঘর বাঁধা গল্পে, আছে নতুন শিশুর গল্পে। কিচেনে কাজ করতো বেড়াল পাগল 'বুড়ো ক্যাট' মারা গিয়েছিল এখানেই, হার্ট এটাকে। এখনও ওর স্মরণে দেয়ালে ঝুলানো সাদা-কালো বেড়ালের ছবিটা তাকিয়ে থাকে। মম বলেন 'ভালো করে তাকালে বুড়ো বেড়ালটার মিঞাও ডাক শুনতে পাওয়া যায়। মানুষটা বিড়াল হয়েই রেস্তোরাঁয় থেকে গেছে।'
আমাদের বন্ধু পার্থ, এ রেস্তোরাঁর পুরনো কর্মচারী, সেদিন অবশ্য অন্য কথা শোনালো- 'পেটে বোধহয় লাথি পড়ার সময় আসছে। কোত্থেকে এক ইঁদুর ঢুকেছে। ল্যাদা পরিষ্কার করতে করতে জান শেষ। একবার কোন কাষ্টমার দেখে ফেললেই রেস্তোরাঁটা বন্ধ করে দেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। মাঝেমধ্যে বিকেলে পার্কিং লটে গাড়ীর নিচ থেকে ছুট দেয় ইঁদুর। সেদিন তো খদ্দেরকে বসতে বলেছে এগারো নাম্বার টেবিলে। আমি পানি রেখে আসতে গিয়ে দেখি চেয়ারে কম্ম কাবার। ভাগ্যিস ওরা রেস্টরুমে গিয়েছিল প্রথমে। খাবলা দিয়ে ল্যাদা নিয়ে আসলাম আর কি। চিন্তা করো বুদ্ধের সামনেও ইঁদুরের ল্যাদা! মম বলেন প্রার্থনায় ঘাটতি হচ্ছে। সব গ্লাসে পানি বদল করলেন, নতুন আগর জ্বালালেন। ইঁদুরের কল আছে কিন্তু ধরা পড়ছে না। পিনাট মিনাট খায় না। কি খায় জানো? জেড প্ল্যান্টের পাতা, চিবিয়ে কিছু ফেলেও যায়। জেড প্ল্যান্ট কি ইঁদুরের জন্যও সৌভাগ্যের?'
আমরা ভাগ্যবতী পাতা খেয়ে ফেলা অদ্ভুত এক ইঁদুরের গল্প শুনি। শুনি কিছু চলমান সমস্যা। ক্ৰেডিট কার্ড মেশিনে কাজ হচ্ছে না, ল্যাণ্ডফোনে সমস্যা, মোবাইলে অ্যাপ চালু করেছে, তাতেও ঝামেলা, এক সপ্তাহে কয়েকশ' ডলার গচ্ছা। একদিন শুনতে পেলাম- এই রেস্তোরাঁর পুরোধা, আহা, মমের মা মারা গেছেন। ইঁদুরের আস্তানা গাড়া মানে আপনজনের মৃত্যু কিংবা দুঃসংবাদ- আমরা এই মিথে সায় দিতে থাকি। তারও বছর খানেক পরে আমরা জানব এই শহরে, পৃথিবীতে নেমে আসবে মহামারী। আর প্রথমেই বন্ধ হয়ে যাবে ব্যুফে রেস্তোরাঁটা। একেক সময় আমাদের মনে হতো সবকিছুর জন্য দায়ী ইঁদুরটা। বিমর্ষ নিয়তির মতো টেনে নিয়ে যাচ্ছে রেস্তোরাঁটাকে, আমাদের। এভাবেই একটা ইঁদুর আমাদের সঙ্গী হয়ে ওঠে। তাই বুঝি হ্যামিলন শহরকে ভীষণ মনে পড়ে আমাদের। অসহায় জলে অবলম্বনের মতো পাওয়া এই শহর আমাদের। মা বলতেন প্রিয় কিছুর জন্য হাহাকার থাকতে হয়। ফেলে আসা ঐতিহ্যের জন্য হাহাকার করা আমাদের বুকে কেমন এক রোখও চাপে। আমাদের বুড়ো আঙুল দেখাও ইন্দুর! আমরা বাঁশির দেশের মানুষ। গোল্লাছুট, লুকোচুরি আমাদের আঙুলের শৈশব। দেবতা থোরাই কেয়ার করা বেয়াড়া ইঁদুর ঠিক বের করে নিয়ে আসবো। জিতে যাবা তুমি? যেমন তুমি বুনো ইঁদুর, আমিও বাঘা বিলাই। 'এই তো আমার নতুন বাসায় পেস্ট কন্ট্ৰোলার ছয় মাসে কিচ্ছুটি করতে পারলো না। পাউরুটির পুরো প্যাকেট নিয়ে যেদিন গেল, রাগে তিন দিনে সাতটা ইঁদুর ধরে ছবি পাঠিয়েছিলাম'- আমিও উস্কে দেই আগুন।
এক দুপুরে আমরা লক্ষ্য স্থির করি। বাঁশি বাজাতে বাজাতে করুণ সমুদ্ৰ থেকে আমরা সূৰ্যাস্তের দিকে হাঁটতে থাকি। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হই, ক্ষিধে পেয়েছে ভাবনার সাথে যুদ্ধ গোছাই। অথচ রেস্তোরাঁটাকে দেখতে পাই না কোথাও আর। ধীমান কম্পাস বের করে। আমরা বাঁশি হাতে খানিক এগুই, পিছুই। কেন যেন ভয় হতে থাকে আমরা বোধহয় কোনদিন আর খুঁজে পাব না ঐ জেসমিন রেস্তোরাঁ। বরাবরই তো বোহেমিয়ান ছিল ও, আমাদের বিশ্বাসের মতো। তবে কোন না কোন মৃত ইঁদুর নিয়ে বিকেল ভাসাবোই- ঈশ্বরের দিব্যি। আমরা ছুটতে থাকি রেস্তোরাঁর পুরনো ঘ্রাণকে কল্পনা করে। সামনে মাস্ক পরা কিছু পুলিশ দাঁড়ায় 'মহামারীতে বের হয়েছেন? জানেন না লকড ডাউন! বীচ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পিছোন! পিছোন!' ধীমান হাত থেকে বাঁশি ছুড়ে মারে পুলিশের দিকে। মহামারীর খবরে কি়ংবা ধীমানের রাগ দেখে আমরা আশ্চর্য হই না, শুধু ধুকপুক বাড়ে। সায়ান দূরে আঙুলে নকশা টানে- ঐসব সমুদ্রের জলে মরা মাছ, কাছিমের সাথে ভেসে যাচ্ছে সারে সারে মানুষের লাশ। আমরা উল্টো ঘুরে দৌড়ুতে থাকি। মুখে চেপে থাকা মাস্কে ঝড়ের মতো দোল খেতে থাকে আমাদের নিঃশ্বাস। মনে হয় ভেসে চলেছি যেমন ভেসেছিল হ্যামিলনের ইঁদুরেরা। কাকতালীয়-ভাবে, আকাশেও তখন ইঁদুরের গায়ের রঙ। ক্লান্ত হতে হতে যখন ভাবি টুকরো হয়ে যাই, (একটা আস্ত যুগ পরেই হবে হয়তো) পরিচিত খাবারের গন্ধ আরাম হয়ে ছুঁয়ে যায় ক্লান্তিতে। বৃষ্টিতে গন্তব্যে পৌছুনোর পর ছাতা বন্ধ করে যেমন আরাম হয়, সেরকম। ঐ তো আমাদের ঘর, দরজা, জানলা, বক সাদা সব দেয়াল- অপেক্ষায়। অথচ ঘরে ফেরে সপাটে দরজা বন্ধ করতেই কেমন এক অস্বস্তি হয়। মনে হয় ফাঁদে আটকে গেছি। গলার কাছে শব্দ গড়াতে থাকে- চিঁ চিঁ চিঁ…
-----------
লেখক পরিচিতি
প্রজ্ঞা মৌসুমী
গল্পকার।
যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় থাকেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় থাকেন।
1 মন্তব্যসমূহ
তোমার লেখার ধরনটাই আলাদা। এ তোমার নিজের স্বর যা আমার মতো মানুষকে বিভ্রমে ফেলে দেয়। শুভকামনা।
উত্তরমুছুন