পাঠপ্রতিক্রিয়া : মধুময় পালের উত্তর আধুনিক উপন্যাস : আলিঙ্গন দাও, রানি

পুরুষোত্তম সিংহ 

গল্প উপন্যাসে কাহিনি বলার দিন আজ শেষ। সত্যি কি শেষ ? তবে কাহিনি সর্বস্ব এতো জঙ্গল লেখা হচ্ছে কেন ? কারা লিখছেন ? জানা নেই ! কারা পড়ছেন সে সব ? অবধারিত উত্তর জানা নেই ! তবে কিছু জানা আছে । কী জানা আছে ? সীমাবদ্ধ বলয়ে চর্চিত কিছু কথাকারের কথা। সীমাবদ্ধ কেন ? আমাদের জেনে নিতে হবে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কথা – যে দুরূহতার জন্ম পাঠকের আলস্যে। সব পাঠকই কি তবে অলস ? না। মনে পড়বে শক্তি চট্টোপাধায়ের ‘ধর্ম আছ জিরাফে নেই’ কাব্যের উৎসর্গ পত্রের কথা – ‘আধুনিক কবিতার দুর্বোধ্য পাঠকের হাতে’।
মোদ্দাকথা দাঁড়াল কিছু পাঠকও অলস, কিছু লেখকও অলস। বিপরীত চিত্রও বর্তমান। একজন লেখক ক্রমাগত পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে আখ্যান গড়ে তুলছেন। এই পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়েই বাংলা উপন্যাসের বেঁচে থাকা। এই বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব কে নেবে ? রাম শ্যাম যদু মধু ? না, একজন কথাকারকেই নিতে হবে ? সব কথাকার নয় কেন ? সবাই ভিন্ন স্রোতে যাবে না। যাবার ক্ষমতাও নেই। অধিক পঠনপ্রক্রিয়া না থাকলে পরীক্ষা নিরীক্ষা সম্ভব নয়। অধিক পঠন প্রক্রিয়া না থাকলে পুনরাবৃত্তি দোষ ঘটতে বাধ্য। সমান্তরাল কাহিনি যেমন ক্রমাগত ভেসে আসে তেমনি একই লেখকের ভিন্ন ভিন্ন উপন্যাসেও একই কাহিনির অনুবর্তন ঘটে থাকে। 

বাংলা সাহিত্য এক বহমান নদী। এর স্রোত ছিল এককালে। আজ আর্বজনায় তা জীর্ণ। নদী থাকলেই জোয়ার-ভাঁটা থাকবে। কিছু মাছের মতো উজানে কিছু কথাকার এগিয়ে যাবেন। কিছু কথাকার যতদিন উজানে এগিয়ে চলেছেন, স্রোতের সঙ্গে সংগ্রামে প্রতিনিয়ত আবদ্ধ রয়েছেন ততদিনই বাংলা উপন্যাসের বেঁচে থাকা। যেদিন উজানে আর কেউ হাঁটবে না, সবার সঙ্গে স্রোতে গা ভাসিয়ে নেবে –সেদিন বাংলা উপন্যাসের মৃত্যু অবধারিত ভাবে। তবে আশা আছে, মধুময় পালরা লিখে চলেছেন। দুই দশক পূর্বে তিনি লিখেছেন ‘আলিঙ্গন দাও, রানি’ উপন্যাস। উপন্যাসের জন্য তিনি বেছে নিলেন একটি সময়। সে সময় দেশভাগ পরবর্তী সময়, উদ্বাস্তু জীবন। আসলে তিনি নিজেও তো উদ্বাস্তু হয়েছেন, দেশ ত্যাগের যন্ত্রণা মর্মে মর্মে বহন করে চলেন। আত্মপরিচয়ে লেখেন –‘’দেশভিখারি তার দেশ খুঁজে বেড়ায়, আর কেবলই হারায়।‘’ উদ্বাস্তু মানুষের বুঝি যন্ত্রণার শেষ নেই। তাই কৃষ্ণদাসরা হারিয়ে যায়। হারাতে বাধ্য হয়। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নিখোঁজ করে দেয়। উপন্যাসের সূচনা হয়েছে –‘যে নির্জনতা কুমির ডেকে আনে’ বাক্য দিয়ে। এ যেন জলে নেমে কুমিরের সঙ্গে লড়াই। উজানে যাওয়া মাছ কুমিরের সঙ্গে লড়াইয়ে নেমেছে। কুমির নামক রাষ্ট্রের সঙ্গে মাছ নামক কৃষ্ণদাসদের লড়াই কি সম্ভব ? অবধারিত ভাবে মৃত্যু উপস্থিত হয়। ব্যক্তি মানুষের লড়াইকে সমষ্টি হারিয়ে দেয়। কী নিয়ে বেঁচে আছে বাঙালি ? সংস্কৃতির ভণ্ডামি। সংস্কৃতির মুখোশ নিয়ে। তাই যন্ত্র সহযোগে লঘুসংগীত ধ্বনিত হয়। গায়ক সংস্কৃতি বিহীন, রুচিহীন পোষাকে মঞ্চে উপস্থিত হয়। রবীন্দ্রসংগীত দিয়ে উদ্‌বোধন শুরু হয়েই চলে হিন্দি গানের পালা। মঞ্চে উপবিষ্ট নেতা মন্ত্রীগণ বা কালচার বিশেষজ্ঞরা মুখে মুখে দুই পংক্তি গেয়েই ভুলে যান, হিন্দি গানে উপবিষ্ট বিশেষজ্ঞের পা দুলতে থাকে। সভ্যতার মুখোশ পরে পা চাপা দিয়ে রাখেন। 

বালক কৃষ্ণদাস এপারে এল। কেন এল ? দেশভাগ। বলা ভালো আসতে বাধ্য হল। আর আছে ইন্ডিয়ার মোহ। ভারত যেন অমৃতনগর। এখানে এলেই উদ্বাস্তুদের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু এখানেও এক শূন্যতা। শূন্যের গোলকধাঁধা। ভেঙে গেল মোহ। শুধু মোহ ভাঙাই নয় বিপর্যস্ত হতে হল। ক্যাম্পে দালালি, হৃদয়হীনতা, সব কিছু নিজের করে নেবার কায়েমিতন্ত্র। রাষ্ট্রের কাঠামো আছে বটে কিন্তু ভিতরে শূন্য। রাষ্ট্রও মার্ডার করে কিন্তু রক্তের দাগ লেগে থাকে না। রাষ্ট্রের মার্ডার সেরিব্রাল অ্যাটাক। ব্যক্তির বুদ্ধিনাশ করে দেওয়া। ব্যক্তির চিন্তাশূন্য করে দেওয়া। বিশ্বাসের থেকেও বড় বিশ্বাসহীনতা। শূন্য স্বাধীনতা। যেন আর এক পরাধীনতা বিরাজ করছে। স্বাধীনতার অমৃত ভোগ করছে এলিট শ্রেণি, সাধারণ মানুষ শুধু শোষিতই হচ্ছে। লেখককে শব্দচয়ন করতে হয় –‘মানবতাবাদী চিটিংবাজ’, অখিলবাবুরা হয়ে যায় ‘দখলবাবু’। নিম্নবিত্তের জীবনযন্ত্রণা নিয়েই উচ্চবিত্তের জীবনযাপন। দুই শ্রেণির যেন বাঘবন্দি খেলা। উচ্চবিত্ত নামক বাঘ নিম্নবিত্ত নামক ছাগলকে ক্রমেই গ্রাস করছে। শ্রেণিহীনতা, দেশহীনতা, সভ্যতাহীনতা। সভ্য নামে দাবি করা মানুষগুলো বড় অসভ্য। বিদ্যাসাগরের নীতিগল্প বাঙালিকে আঘাত করেনি। আঘাত করলেও সময়ের ব্যবধানে তা ভুলে গেছে। বিদ্যাসাগরও বর্জিত ! নইলে মূর্তি ভাঙল কেন ? আর বাঙালি ঘাপটি মেরে বসে রইলবা কেন ! সমাজ যেন কুষ্ঠ হাসপাতাল। সাধেই তো মানিক বাবু আর ‘কুষ্ঠরোগীর বউ’ গল্প লেখেননি। কৃষ্ণদাসের নিবাসের পাশেই কুষ্ঠ হাসপাতাল। চিত্র আছে, বিপরীত বাস্তবও আছে। হাসপাতালের গেটের সামনে হরতুকি গাছ। হরতুকির মতো মানুষগুলো যেন সমাজ থেকে ঝরে যাবে, বিদায় নেবে। বিদায় না নিলেও বিদায় করে দেওয়া হবে। নইলে মুনাফায় ভাগ বসবে। কৃষ্ণদাস দেশভাগ, উদ্বাস্তু জীবন, দুর্নীতি দেখেছে, এবার জীবন দেখল। জীবনের নষ্টামি দেখল। কৃষ্ণদাস সুইসাইডকে মৃত্যু বলে ভাবে না। কিন্তু রাষ্ট্র চায় ব্যক্তি সুইসাইড করুক। এই জীবন দেখতে দেখতেই কৃষ্ণদাস শৈশব থেকে যৌবনে পৌঁছেছে। চক্ষু প্রসারিত হয়েছে। ‘দেখোরে মন নয়ন মেলে’ –এর তত্ত্ব বুঝেছে। সরকার সবাইকে হাতে রাখতে নানা পদের সৃষ্টি করেছে। সব পদের সঙ্গে জয়েন্ট বা অ্যাসিসটেন্ট যুক্ত হয়েছে। ইহা বঙ্গীয় সংস্কৃতির নতুন শব্দ। মণীশ ঘোষ, শচীন সাহারা মৃত্যুবরণ করেছে। কিন্তু কৃষ্ণদাসকে নিয়ে লেখকের চলছিল না। প্রতিনায়ক হিসেবে দেবপ্রিয়কে মঞ্চে আনতে হল। ক্রমে কৃষ্ণদাস রাজনৈতিক দলের কর্মী হয়ে ওঠে। রাজনীতির আবার শৃঙ্খলা ? শৃঙ্খলাহীনতায় যেন তার শান্তি। কুষ্ঠরোগীর মতো উদ্বাস্তুরা ক্ষয়ে যাওয়া মানুষ। রাষ্ট্রের বর্জিত অংশ। এই বর্জিত মানুষগুলো কি আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে ? বড় প্রশ্ন। সংশয়হীন উত্তর। এঁদের মুক্তি ঘটবে কীভাবে ? জীবনহীন জীবন। জীবনের বহুমুখিতা। ভাবনাহীন মানুষ, চেতনাহীন মানুষ, প্রশাসন সর্বস্ব মানুষ। আবার প্রশাসনকে বিরোধীগোষ্ঠী ভাবা মানুষও আছে। সভ্যতা গঠনে মানুষের কি কোন দায়িত্ব নেই ? সংস্কৃতিহীন মানুষ, বুজরুকি মানুষ। একাধিক টুকরো টুকরো ঘটনা সামনে রেখে লেখক জীবনের পরিণাম দেখান। কোনদিকে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের চিন্তাহীন, ভারসাম্যহীন জীবন। নারী শোষণ। বিবাহের কার্ডে সরাসরি লেখা হচ্ছে গ্রেফতারি ভাষ্য। সে ভাষ্য ৪৯৮ ধারার থেকে এক ধারা কম। উপেক্ষাহীন , ভালোবাসাহীন ও বিশ্বাসহীন জীবন। এই ভাবনাগুলো সব আপেক্ষিক। কেননা কিছু ঘটনার সঙ্গে লেখক পরিচয় করাতে চান। আসলে তিনি তো সময়ের সঙ্গে পরিচয় করাতে চান। যে সময়ে বড় হয়ে উঠছে কৃষ্ণদাস, দেবপ্রিয়রা। 

সময়ের ভূত ভবিষ্যৎ আঁকেন। যে ভূত তাড়া করে চলে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে। কৃষ্ণদাসের দিদিমা কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম জপে যায়। নিজের শেকড়কে টেনে ধরে রাখতে চায়। কিন্তু মাটি যেখানে উপড়ে যাচ্ছে সেখানে শেকড় টিকে থাকবে কেমন করে ? বাংলার জীর্ণ নদীর মতো সংস্কৃতিকে বহন করে যায়। লেখক উদ্বাস্তু জীবনের গভীরে প্রবেশ করেন। আলগা আবেগ নয়, সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে মত দান করেন। যে পাঠ অন্য লেখকের সঙ্গে মেলানো সম্ভব নয়। ফলে উপমাতেই ব্যঙ্গ, ভাষা সঞ্চারে শ্লেষ জড়িয়ে থাকে – 

‘’একটি ৮x ৮ ঘর ও ৮ x৩ ঘর বারান্দায় ভাড়াটেদের জীবনে বারান্দাটাই কিচেন-কাম-ডাইনিং স্পেস-কাম-সাধের দুপুরের ড্রয়িং রুম, যেখানে সর্বার্থসাধক পরনিন্দা কয়েতবেলের চেয়েও মুখরুচিতে মাখা হয়। কৃষ্ণদাসের দিদিমা যা হোক করে একটা বেড়া দিতে পেরেছিল।‘’( আলিঙ্গন দাও, রানি, মধুময় পাল, আত্মজা, পরিমার্জিত পুনর্মুদ্রণ, জানুয়ারি ২০১৮, পৃ. ১৬ ) 

উদ্বাস্তু মানেই বর্জিত। সেই বর্জিত মানুষের স্বর লেখক শোনাতে চান। বলা ভালো সময়ের স্বর। কৃষ্ণদাসের দিদা-দাদুর কথোপকথনে সেই সময়ধ্বনি শুনি। আপাত অশ্লীল মনে হতে পারে, কিন্তু ঘটমান বাস্তবে তা নির্ভেজাল সত্য। লোকাচার বিশ্বাস থেকে মৃত্যুর দর্শনে যান। কুকুর পপিকে সামনে রেখে মৃত্যুলীলা আঁকেন। হ্যাঁ মৃত্যুলীলাই বলব। বারবার মরে মরে বাঁচা লীলা নয়ত কী ! পালিয়ে বাঁচতে চান। কিন্তু পরিত্রাণ নেই। কেন থাকবে ? ঈশ্বরের পৃথিবীতে উদ্বাস্তুদের নিজস্ব আবাসভূমি নেই। ভিটেমাটি হারা মানুষ কোনদিন সুখ পায় না। তবে অভিমান আছে। সে অভিমান দেখার পাবলিক নেই। আছে আলগা ধর্মচেতনা। কিন্তু ধর্মবোধ মাঝে মাঝে ভেঙে যায়। মনে আঘাত লাগলে, ব্যক্তিজীবনে ভাঙন দেখা দিলে কৃষ্ণদাসের দাদুদের ধর্মবোধ হারিয়ে যায়-‘’আবার ঠাকুর মাড়াও। মেগে খাওয়ার খোঁচায় কৃষ্ণদাসের দাদু তখন পারলে খুন করার ফর্মে, স্বামীরে জুতাইয়া ধর্ম মাড়াও। মান রাইখ্যা ধম্ম, গোয়ায় হান্দায় জন্ম। কী দিছে তরে তর ঠাকুর ? উনিশ বছরের পোলাটারে খাইছ। ড্যাম ইয়োর গড। ইউ স্টুপিড, ইউ ডোন্ট নো, গড ইজ মেড টু মেক মেন ফুলিশ।‘’(তদেব, পৃ. ১৯ ) 

তিনি আখ্যান গড়েন। কখনও পুরাণ এনে আখ্যানকে ভেঙে দেন। এই ভেঙে দেওয়া ভিন্ন পরিসরে যাত্রার পথ আবিষ্কার। যৌনচেতনা, অশ্লীল শব্দ প্রয়োগে জীবনের গান শোনান। গাছ বড় হলে যেমন শেকড় ভিতরে প্রবেশ করে তেমনি একটি স্থানে মানুষ দীর্ঘদিন থাকলে শেকড় মাটিতে স্থায়ী হয়। গাছের যেমন কান্ডই প্রধান তেমনি মানুষের মস্তিস্ক। অথচ রাষ্ট্র মানুষকে বিকৃত মস্তিস্ক করে দিতে চায়। ভাড়াবাড়ির একঘরে কৃষ্ণদাসরা, অন্য ঘরে রানি ও বিনু। এখানে বেঁচে থাকতে কৌশল অবলম্বন করতে হয়, নানা ফন্দি খুঁজে বেড়াতে হয়। আছে বাড়িওয়ালার নানা বাহানা, আবার ইজ্জতের লড়াই। কৃষ্ণদাসদের প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখার সময় নেই, আবার উপেক্ষাও করতে পারে না। প্রশ্নহীন শ্রেণিজীবন। ভাবে এটাই নিয়তি। লেখক যৌনতার ট্যাবুকে ভেঙে দেন। কৃষ্ণদাস ও দাদু এক বিছানায়। অপর ঘরে বিনু ও রানির যৌনজীবন। যুবক কৃষ্ণদাসের যৌনসত্তা সাড়া দেয়। কিন্তু পথ নেই। আসলে কৃষ্ণদাসের বড় হয়ে ওঠা লেখক অঙ্কন করেন। আদর্শের কোন মূল্য নেই। চারিদিকে লুম্ফেনরাজ বিরাজ করছে। প্রসূনরা টাকা দিয়ে চাকরি পেয়ে আনন্দ করে। আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে , জীবনবোধের ভাঁড়ার শূন্য করে অলীক আনন্দে মত্ত থাকতে ভালোবাসে। যেখানেই শ্রেণি বর্তমান সেখানেই থাকবে মিত্র ও শত্রু। শুভদীপ, দেবপ্রিয়রা একই শ্রেণির মানুষ। তবে শত্রুতা না থাকলেও মিত্রতা নেই। আসলে শ্রেণির ব্যবধান ঘটে গেছে। একই শ্রেণির মধ্যে নানা ক্লাস বিভাজন বড় হয়ে উঠেছে। মালিক-শ্রমিক একই বিজ্ঞানে, তত্ত্বে বিশ্বাসী। ফলে শ্রমিকের কোন মুনাফা লাভ নেই। ফ্ল্যাট কালচার, বৃক্ষনিধন, মধ্যবিত্তের মূল্যবোধের ভাঙন বড় হয়ে ওঠে। মানুষ সর্বদা প্রশাসনের কাছে থাকতে চায়। চলছে ক্রমাগত পার্টির বিস্তার। ভোটে বহু পার্টির প্রতিনিধি। নির্দল প্রার্থী। নেতার প্রকৃত কাজ কী ভুলে গেছে। গণতন্ত্রের কোন মূল্য নেই। নেতার সাফল্য কাজে নয় ভোটের মার্জিনে। একবার পরাজিত হলে ক্ষমতার ফেরা কঠিন। ফলে ক্ষমতার অন্দরমহলে থেকে বাজি মাতের চেষ্টা। প্রশাসনকে মামাতো ভাই পাতিয়ে লুম্পেনরাজ চালানো। বিশ্বাসই বিশ্বাসহীনতার বড় আশ্রয়। শুভদীপের কোন আত্মদর্শন, আত্মসমীক্ষা নেই। চালু হয়েছে আত্মজীবনী লেখার রীতি। নিজের কর্মজীবনকে নিজেই একবার বড় করে প্রদর্শন করা। কিন্তু সেখানেও মিথ্যার মালাগাঁথা। কিছু সত্য বলতে গিয়ে একাধিক মিথ্যার অবতারণা। তথ্য ও সত্যের বিকৃতি –‘’আত্মজীবনী লেখা সভ্য মানুষের অসাধ্য কাজ। কারণ, সভ্যতার বিকাশে মানুষ সত্যি কথা বলার সাহস দুটোয় হারিয়েছে। নিজের জীবন নিয়ে সত্যি বলতে গেলে সংশ্লিষ্ট অন্যের জীবনে কাঠি করা হয়।‘’ ( তদেব, পৃ. ২৬ ) সংস্কৃতিকে দৃষ্টিনন্দনের বদলে দৃষ্টিকটু করে তোলা। গাছে গাছে যৌনতার বিজ্ঞাপন। আর এসব ফুটিয়ে তুলতে লেখক জাদুবাস্তবতা, অলীক বাস্তবতার আশ্রয় নেন। 

আদর্শ নিয়ে বাঁচলে হবে না। আদর্শের প্রয়োগ ঘটাতে হবে। আজ বিপ্লবের বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে। কখনও সে বিজ্ঞাপন মাটিতে গড়াগড়ি খায়। ক্ষমতা-শক্তি-মার্সেল পাওয়ার নব গণতন্ত্রের একমাত্র উৎস। আদর্শ নিয়ে বাঁচা কিছু আঁতেল পাবলিক পার্টিতে শাখা বিস্তার করে, কেচ্ছা প্রচার করে। দল থেকে জন্ম নেয় একাধিক উপদলের। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে বিসর্জন দেওয়া হয় আদর্শের। উঠে আসে সময়দ্বন্দ্ব। ভালো সময় অপেক্ষা খারাপ সময় নিয়েই মানুষের বেঁচে থাকা। ভালো সময়ের স্বপ্ন দেখতে দেখতে আরও বেশি অন্ধকারে ডুবে যায়। ভণ্ড নেতার মুখে স্বদেশীকতার বাণী। আসলে গোটা সিস্টেমটাই বিপর্যস্ত। রাজনীতির কোন আদর্শ নেই, শুধু পার্টি পরিবর্তন। অসাধু ব্যক্তি পার্টির সুবিধা নিতে চায়। কৃষ্ণদাস পার্টির সদস্য নয় বলে অত্যাচারিত হতে হয়। প্রশাসন আজ কেস ধামাচাপা দিতে কিছু নিরীহ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে। বলি হতে হয় কৃষ্ণদাসদের। পুলিশ নিজেই হয়ে ওঠে বড় প্রতারক। প্রশাসন সর্বদা আদর্শকে খুন করে দিতে চায়। তেলি বদনা কংগ্রেসের শেল্টার নিতে চায়নি বলে পার্টি পুলিসকে নজর দিতে বলে। রাজনীতির নামে ব্যক্তি নিধন। বিরুদ্ধ পার্টির কোন অস্তিত্ব রুলিং পার্টি স্বীকার করতে চায় না। রাজনীতির কোন্দলে মিডিয়া, পুলিস আনন্দ পায়। শেষে অনুমান নির্ভর রিপোর্ট জমা। প্রকৃত সত্য উদ্ধার করতে না পেরে নিরীহ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে, অত্যাচার করে মিডিয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে ভালো মশলা প্রয়োগ করে জনরুচির উপযোগী করে তোলা। পুলিস সভ্যতার নামে অসভ্যতার চরম শীর্ষে উপনীত হয় – 

‘’গালাগাল যদি পুলিস ও দুষ্কৃতীর ভোকাল টনিক হয় তা হলে তাই, যদি কাপুরুষতার প্রমাণ হয় তা হলে তাই, পরামর্শের আগে অপরাধ-ভারতের, রাঢ়-বারেন্দ্র-আর্যাবর্তের অশ্লীল বলয়ের ভাষা প্রয়োগ করে, নিরীহতম হল ‘গুদমারানির ব্যাটা’, তারপর পরামর্শটা এই, ওগুলোর একেকটার সারা গায়ে একেক রকম চিহ্ন দিতে হবে।‘’( তদেব, পৃ. ৩০ ) 

হিংসাই সত্য। অহিংসার মুখোশধারীরা হিংসা সৃষ্টিতে সদা প্রস্তুত। কৃষ্ণদাস জানে –‘’হিংসা একটা চলমান প্রক্রিয়া’’। চলতে চলতে তার ডানা গজায়। রাষ্ট্র নিজেই যুদ্ধ সৃষ্টি করে দেশপ্রেমের শ্লোগান দেয়। ধর্ম আজ রাষ্ট্রের বড় হাতিয়ার। যা সাধারণ মানুষ বোঝে না। রাষ্ট্র ধর্মের নাম করে সাধারণ মানুষকে সর্ষে ফুল দেখায়।মার্কসবাদীদের ভিত্তিহীন সিস্টেম। ক্ষমতার দুই পিঠে হিংসা অহিংসা। শুধু ক্ষমতার পরিবর্তন। এ যেন ক্ষমতার আহ্নিক গতি, বার্ষিক গতি। মুখে তত্ত্ব আদর্শ, ভিতরে বুজরুকিতন্ত্র। রাষ্ট্রের কার্যকলাপ বোঝাতে লেখক রূপকথা শোনান। বলা ভালো পাঠককে বিশ্রাম দেন। কিন্তু সেখানেও থাকে রাজতন্ত্র। এ যেন রাজার আসা যাওয়ার খেলা। রাজতন্ত্র থাকে, কাঠামো থাকে, অত্যাচার থাকে। কেউ কেউ সিস্টেম ভাঙতে চায়। কিন্তু প্রচলিত প্রথার মর্মমূলে আঘাত করলেই কিছু প্রাচীন প্রন্থী গর্জে ওঠে। এই প্রাচীন প্রন্থীরাও রাষ্ট্রের স্টক হাতিয়ার। প্রয়োজনে ব্যবহার করে। কিন্তু প্রশ্ন যদি ওঠে-কৃষ্ণদাস হিংসা শিখলো কোথায় ? অবধারিত উত্তর আসে রাষ্ট্রের কাছে। কিন্তু রাষ্ট্র এই গোপনতত্ত্ব পাবলিককে বুঝতে দেয় না। গ্রিক পুরাণের রূপকথার রাজা হেরে যায়। কেননা সে সিস্টেমে আঘাত করেছিল। কৃষ্ণদাস পার্টি ত্যাগ করায় পাড়া ছাড়তে হয়েছে। আছে খুনের নানা রহস্য। ধীরে ধীরে কৃষ্ণদাসকে বিপর্যস্ত করে দেওয়া হয়। চিত্তদাস কৃষ্ণদাসকে রক্ষা করতে পাঠিয়েছে মাধব দাসের কাছে। নামগুলি স্মরণীয়। সবাই যেন রাষ্ট্রের দাস। বিশ্বাস, আদর্শে ঘুণ ধরেছে, ফলে ক্রমেই সন্দেহ হয়। শিক্ষক, ডাক্তার, নেতা আজ আর কেউ মহান নয়, সবাই সাধারণ। নক্‌শাল পর্বে বিপ্লবের বই পড়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দেবপ্রিয়রা চলে যায় দোলাদের বাড়ি। কিন্তু সেখানেই ভিত্তিহীন আদর্শ। পিতা-পুত্র ভিন্ন কেসের উকিল। উকিল বাড়িই যেন শত্রুর বড় শেল্টার পয়েন্ট। রয়েছে আইনের নানা জটিলতা। কোর্ট শুধু তারিখ গুণে যায়। অপরাধহীন কয়োদি এভাবেই জীবন সংকটে ভুক্তে থাকে। পুলিশের কাছে নির্দেশ এসেছে বিপ্লব নিধনের। পুলিশ অপরাধ না জেনেই যুবক নিধনে উল্লসিত হয়েছে। পালাতে বাধ্য হচ্ছে কৃষ্ণদাস, দেবপ্রিয়রা। মৃত্যু ঘটেছে বরেণের। সিস্টেম নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি। কেউ ‘কেন’ এই উত্তর জানতে চায়নি। কেউই জলে নামতে চায় না, লড়াইয়ে যেতে চায় না। জলে কুমিরের বাস। যখন যায় তখন সময় শেষ। চারিদিকে কুমির বিভ্রাট গ্রাস করেছে। ফল হয় শূন্য। অথচ জল কাউকে ছাড়ে না। দোলাদের বাড়ি হয়ে ওঠে –‘রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে সহযোগিতার ঐতিহ্য’। 

লেখক জাদুবাস্তবতায় যেমন যান তেমনি প্রকৃতির চিত্র আঁকেন। বঙ্কিমের বাল্য প্রণয়ের (প্রতাপ, শৈবালিনী ) উপস্থিত ঘটান। দেহ-যৌনতা, প্রেমের আলো অন্ধকার নির্মাণ করেন। তেমনি রয়েছে অভাবেও সাহিত্যপাঠ –‘’ফুল এলে এ-ঘরে মালা হয়, মালা হলে দুটো পয়সা হয়, দুটো পয়সা হলে বিষবৃক্ষ, কপালকুণ্ডলা, আনন্দমঠ, গৃহদাহ, পল্লীসমাজ, শেষ প্রশ্ন, নতুন গামছা, উনুন, মশারি হয়।‘’(তদেব, পৃ. ৪৫ ) বিনুও নিখোঁজ হয়েছে। কেন নিখোঁজ হল তা নিয়ে প্রতিবেশীরা প্রশ্ন তোলেনি, সবার দৃষ্টি স্ত্রীর দিকে। প্রশ্ন তোলা রাষ্ট্রের কাছে অন্যায় কার্যকলাপ। ব্যক্তির নিখোঁজে প্রতিবেশীর কিছু যায় আসে না, বরং নারী মাংসে উল্লসিত হয়। ইন্ধন যোগায় শ্বাশুড়ি। লেখক যৌনতার মিথগুলি ভেঙে দেন। রানি যৌন ব্যবসায় নামতে বাধ্য হয়েছে। সমাজ নিয়েই মানুষের বাঁচা। কিন্তু সমাজ কি ব্যক্তিকে বাঁচতে দেয় ? প্রতি পদক্ষেপে নিপীড়ন করে। পীড়নে আনন্দ পায়। ঠোঁটে বক্রহাসি শোভা ঝিলিক দেয়। নারীর সার্থকতা সন্তান জন্মে। রানি সে সুযোগ পায়নি। নারীকে মাটির সঙ্গে তুলনা করেন। মাটির সার্থকতা ফসলে, নারীর সার্থকতা সন্তান জন্মে। কুপি থেকে রানির শরীরে আগুন লাগে। বাঁচাতে গিয়ে কৃষ্ণদাস আলিঙ্গন দেয়। অবদমিত কামনার কথা কৃষ্ণদাস বলতে পারেনি, ফলে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। অন্যদিকে চলে দেবপ্রিয়-স্বাগতালক্ষ্মীর অবৈধ প্রেম। মুখে সামাজিকতা রক্ষার চেষ্টা ভিতরে কামনা। লেখক সেখানে আলো ফেলেন। তবে সে আলো হ্যারিকেনের আলো, তীব্রতা কম। অবৈধ প্রেমেও রয়েছে ভণ্ডামি। সমাজের চোখে সাধু সাজতে দেবপ্রিয় কিনেছে একটি বালিশ। মুখে নারী স্বাধীনতার কথা বললেও মূল পথ সংসার। সেখান থেকে নারীর মুক্তি নেই। বিশ্বাসহীন সমাজতত্ত্ব, পুরুষকে প্রতি পদক্ষেপে অবিশ্বাস। অফিসে পোস্ট-মডার্নিজমের নামে নারী লাঞ্ছনা। লেখক আটটি বয়ান এনে বাস্তবতার স্তর গুলি ভেঙে দেন। প্রতিক্ষেত্রেই সন্ত্রাস বিদ্যমান। দেবপ্রিয়র জীবনে দুই নারী –রিনি, স্বাগতা। প্রথমজন বৈধ, দ্বিতীয়জন অবৈধ। একজন বিশ্বাস, অপরজন অবিশ্বাস। রিনি আগে থেকেই স্ত্রী, স্বাগতা মুক্ত আকাশে উড়ে যায়। স্ত্রী মানেই বন্ধন, বন্ধনে নানা রহস্য। 

এ উপন্যাস মৃত্যু মিছিলের উপন্যাস। আসলে যে সময়পর্বটিকে লেখক ধরেছেন তখন অবধারিত ভাবে চলছিল মৃত্যুমিছিল। কৃষ্ণদাসের সঙ্গে দাদু দিদিমাও বিদায় নিচ্ছে। আসলে উদ্বাস্তু গোটা পরিবারটাই ধ্বংস হয়ে গেল। দিদিমার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই জল রাখার চৌবাচ্চা আবর্জনা দিয়ে বন্ধ করে দিয়ে নতুন ঘর তৈরি হয়, নতুন ভাড়াটে আসে, মিশ্র সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। রানির মৃত্যু নিয়ে নানা বয়ান আছে। তবে সবটাই আপেক্ষিক। সত্য-মিথ্যার ধোঁয়াশা। কেননা সময়টাই রহস্য। কিছুকেই পুরোপুরি সত্য বলা যাচ্ছে না। উদ্বাস্তু ক্যাম্পে চলছে চোরাকারবারী। প্রতিবাদ করেছিল কৃষ্ণদাসের দাদু যামিনীরঞ্জন। কিন্তু কেউ সত্যের পক্ষ অবলম্বন করেনি। মানুষ নিজের স্বার্থের জন্য অসৎ হয়ে যাচ্ছে। ক্যাম্পে আসাকলীন সময়ে কৃষ্ণদাস ছিল মাতা সুদক্ষিণা রায়ের পেটে। পিতৃপরিচয় সঠিক দিতে না পারায় হেনস্থার স্বীকার হতে হয়েছে। যামিনীরঞ্জনের আছে হিটলার প্রীতি। হিটলারের থেকেও বড় যুদ্ধবাজ, শোষকের জন্ম হয়েছে পরবর্তীকালে। সরকারের আছে যুদ্ধ বাজেট। মুখে দেশপ্রেম, কর্মে দেশশোষণ। রাষ্ট্রের বড় পুঁজি মানুষের অভাব। যেখানে অভাব সেখানেই মানুষের কৃপা প্রার্থনা। আর এই প্রার্থনা যদি সংখ্যা গরিষ্ঠ হয় তবে আরও লাভ। সব নেতাই চোর-কেউ বড়, কেউ ছোটো। সাধারণ মানুষ ভোটে নিহারেন্দু চক্রবর্তীকে জিতিয়ে আনে। কিন্তু পরাজিত কংগ্রেসের ভণ্ড নেতারা নিহারেন্দুর পার্টিতে প্রবেশ করে। রাজনীতির প্রতি মানুষের অবিশ্বাস বদ্ধমূল হতে থাকে। লেখক এক উত্তর আধুনিক আখ্যান গড়ে তোলেন। শুরু হয় যাত্রাপালার রামায়ণ। এ যেন নব রামায়ণ। শোষণের নব ভাষ্য। দাঁতের মাজন বিক্রেতা শচীন দশরথকে ব্যঙ্গ করে। বাস্তবের যন্ত্রণা শচীন ব্যঙ্গ করে পুষিয়ে নেয়। সীতাহরণ লেখকের বয়ানে পৃথিবীর প্রথম কিডন্যাপ-‘’বিপন্ন দাদাকে বাঁচাতে ছুটছে লক্ষণ, পর্ণকুটির ঘিরে আছে বৈদ্যুতিক গণ্ডি, ভিক্ষাজীবী ব্রাহ্মণের বেশে দেখা দিয়েছে রাবণ, এর পরই পৃথিবীর প্রথম কিডন্যাপ, নারী-নিগ্রহ, দর্শক-হৃদয় উন্মুক্ত হয়ে আছে, যাকে বলে ছিলাটান পরিস্থিতি, শচীনের গলার মালার দাম উঠল এক হাজার এক টাকা।‘’( তদেব, পৃ. ৬৩ ) পার্টির সন্দেহ যাত্রাপালার নামে সমাজ দূষণের কারবার চলছে। দেবপ্রিয়ের নেতৃত্বে যাত্রাপালা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিছুদিন পরে রেললাইনে আত্মঘাতী অবস্থায় পাওয়া যায় শচীন ও মণীশকে। আত্মহত্যা না খুন ? জানার অবকাশ নেই। জীবন থেকে তাঁরা হারিয়ে গেল এটুকুই সত্য, কেন হারিয়ে গেল তা জানা যায় না, রাষ্ট্র জানতে দেয় না। 

উপন্যাসের ষষ্ট পরিচ্ছেদে কৃষ্ণদাসের মুক্ত চিন্তা বড় হয়ে ওঠে। মুক্ত পৃথিবীর স্বপ্ন সে মনে মনে লালিত করে। কে না স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে ! কিন্তু এ যে দিবাস্বপ্ন ! অকাঙ্ক্ষিত পৃথিবী ঢের বহুদূর। আখ্যানের সূচনায় জীবনানন্দ দাশের উক্তি রেখে লেখক সে সত্য আগেই আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন। কৃষ্ণদাস আদর্শ আঁকড়ে ধরে বড় হতে চেয়েছে আর দেবপ্রিয় আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে বড় হয়ে উঠেছে। লেখকের বয়ানে কৃষ্ণদাস বড় হয়নি, দেবপ্রিয় বড় হয়েছে। দেবপ্রিয় আদর্শ, মূল্যবোধ, শুভচিন্তা বিসর্জন দিয়ে ক্ষমতা দখলের কায়েমিতন্ত্রের দিকে এগিয়ে গেছে। উপন্যাসের ৬৬ পৃষ্ঠায় কতগুলি টুকরো-টকুরো, বিচ্ছিন্ন সূত্র এনে লেখক বাস্তবতার দংশন ক্ষত অবস্থা দেখিয়ে দেন। রাষ্ট্র, প্রশাসন, বিশ্ববাজার, পুঁজিবাদ, অস্ত্র, পরমাণু , মানুষের ক্ষমতা, মূর্তি গড়া –ভাঙা, সমালোচনা। আসলে কিছুই পাল্টায়নি। বিপ্লব হয়নি। সব অসমাপ্ত। সময় যেন থমকে গেছে। বয়সের সঙ্গে বুদ্ধির বিকাশ ও আত্মন্মোচন সম্পৃক্ত। যেখানে উন্মোচন নেই সেখানে বয়সের বিকাশ অসম্ভব –‘’বাইশ-তেইশ থেকে তুমিও বেরোতে পারোনি, দেবপ্রিয়। আমরা কেউ পেরেছি কি ? যারা পেরেছি বলে দাবি করে, তাদের গ্রোথটা ম্যালিগন্যান্ট। অসমাপ্ত বিপ্লব তোমার বৃদ্ধি স্বাভাবিক হতে দেবে না।‘’( তদেব,পৃ. ৬৬) সমস্ত সিস্টেমটাই ভেঙে গেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, উন্নয়ন সব ধ্বংসের পথে। মন্ত্রীদের কোন দৃষ্টি নেই। আছে শুধু ভোট উৎসব। এই বুজরুকি তন্ত্রের সঙ্গে দেবপ্রিয় মানিয়ে নিয়েছে। কৃষ্ণদাস মানতে পারেনি বলেই প্রশ্ন তুলেছে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুললেই ফতেয়া জারি হয়। রাষ্ট্র কৃষ্ণদাসদের ভ্যানিস করে দেয়। দেবপ্রিয়ের বাড়িতে কৃষ্ণদাসের ডায়েরি পাওয়া যায়। বাস্তবের বহু ঘটনার উল্লেখ কৃষ্ণদাস করে গেছে। রাজনীতি, কায়েমিতন্ত্র, খুন, ধর্ষণ, ছৌনাচ, বিশ্ব রাজনীতি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রসঙ্গ। ডায়েরিতে টুকরো টুকরো বয়ান। সবই সময়ের মন্থন থেকে উঠে আসা বাস্তবতার রূপ। কৃষ্ণদাস আত্মচেতনায় এগিয়ে গেছে। অবশ্যই জাদুবাস্তবে। কেননা উপন্যাসের পরিসর থেকে আমরা জানি কৃষ্ণদাসের মৃত্যু আগেই হয়েছে। মনে প্রশ্ন তাঁর ধারণা সঠিক না ভুল। ভুল হলে কেউ ধরিয়ে দেয় না কেন ! সত্য কীভাবে সমর্থনের অভাবে মিথ্যা হয়ে যাচ্ছে। কৃষ্ণদাস নিজের মুদ্রাদোষে নিজেই একা হয়ে চলেছে। ডায়েরি পড়ে ডাক্তার শুভদীপের মনে হয়েছে পাগল। রাষ্ট্রের এতো জটিল বিধি নিয়ম মাথায় খেলেনি। রাষ্ট্রের দুর্নীতির এতো রহস্য তা মাথায় প্রবেশ করলে পাগল হতে বাধ্য। রাষ্ট্র ইচ্ছা করেই এমন জটিল জাল রচনা করবে যা মেধাবী মানুষ বুঝলেও সাধারণ মানুষের কাছে ধোঁয়াশা। 

বিভিন্ন দেশের গণতন্ত্রের কাঠামোর মধ্যে ভেদ আছে। দোলা আমেরিকা থেকে চিঠিতে ওদেশের গণতন্ত্র নিয়ে দেবপ্রিয়কে জানিয়েছে। ওদেশে ‘পিপুল ভয়েস’ একটা কণ্ঠ, এদেশে নেই। ওদেশে মিডিয়া, আইন স্বাধীনভাবে প্রয়োগশীল হলেও এদেশে রাষ্ট্রের দাস। দেবপ্রিয় সফল কিন্তু মেকি সফল। যেখানে পার্টির ধ্যান ধারণাই ব্যর্থ সেখানে ব্যক্তি সফল হয় কীভাবে ! আছে পার্টি নেতৃত্ব, উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, উৎপাদন, বিনিয়োগ, শ্রমিকের অসহাবস্থান, মিছিল, সমাবেশ, লোক ভরানো, সিন্ডিকেট রাজ, দালাল চক্র। জনগণ থেকে দূরে যাওয়া অথচ জনগণকে ব্যবহার করা। দালালরা নিজের সুবিধার্তে রুলিং পার্টির অন্দরমহলে থাকতে চায়। দেবপ্রিয়ের পার্টি নিজের পরিকাঠামোকে শক্তিশালি করতে দালালদের সাহায্য করে। সেসময় জনগণ কমিউনিস্ট পার্টি থেকে দূরে চলে যায়। উপন্যাসের অষ্টম পরিচ্ছেদের সূচনা হয়েছে দরিদ্র মানুষের উল্টোরথে যাবার প্রবাদ দিয়ে। আসলে এ আখ্যান তো উল্টোপুরাণ। বিপ্রতীপ স্বর। শ্রেণির সহাবস্থান থেকে কৃষ্ণদাস ভিন্ন পথ আবিষ্কার করতে চেয়েছিল। কিন্তু পথে বহু কাঁটা। শাসন ব্যবস্থার স্বরূপ নিয়ে ব্যঙ্গ উঠে আসে – 

‘’নিজেই চলে এলাম। না, পুলিস বা পার্টি আমাকে ধরতে যাবনি। যাওয়ার কথা ছিল কি ? ওরা তো খুব ব্যস্ত। চাষ জমি বাস্তু করছে, নদীনালা-খালবিল ম্যাপ থেকে মুছে দিচ্ছে, ঠিকাদার বানাচ্ছে, ক্রিমিনাল প্রসব করছে, মন খারাপ লাগলে দু-চারটে রেপ করছে, উপাচর্যদের ক্লাস নিচ্ছে কন্ট্রোল রুমে, আরও কত কাজ। তা ওদের সময় কোথায় ?’’(তদেব, পৃ. ৭৭) 

রাষ্ট্রে রাজা থেকেও নেই। আইনশৃঙ্খলা নেই। কৃষ্ণদাসকে আপাত ভাবে পাগল মনে হলেও তাঁর চিন্তা শুভ। ব্যক্তির নিঃসঙ্গতাকে লেখক বড় করে তোলেন। এ উপন্যাস ভিন্ন স্রোতের উপন্যাস। সমান্তরাল কাহিনি পরিবেশন নেই। কিছু চরিত্রকে সামনে রেখে তিনি সময়ের মালা গেথেছেন। কিন্তু কৌশল ভিন্ন। পুরাণ, সংগীত, রূপকথা, ডায়েরি, যৌনতা, জাদুবাস্তবতা এনে আখ্যানের চোরাস্রোতে জীবনের এক বহুস্বরিক ভাষ্য বুনে চলেন। সে সময়ে লেখক নিজেও বড় হয়ে উঠেছেন। আসলে বাস্তব বলে যা আমারা দাবি করি তার ভিতরে আর এক প্রখর বাস্তব বর্তমান। অনকেই বাস্তবতার ওপরের স্তর দিয়ে বিচারণ করেন, তিনি ভিতরে প্রবেশ করে বহুস্তরীয় বাস্তবতার পাঠ নির্মাণ করেছেন। কিন্তু কৌশল ও প্রন্থা ভিন্ন। বলা ভালো এক উত্তর আধুনিক আখ্যান নির্মাণ করেছেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ