মেঘ অদিতি'র গল্পঃ অতল ভ্রমণে


নিম হিজলের গাছগুলোর অর্ধেক শরীর এখন পানির তলে। ভরা শ্রাবণে সোমেশ্বরীরও আর কোনো আগল নাই। নেমেছে উজানের ঢল। কালভার্ট ভেঙে পড়েছে। পলকা বিল, ঢোলী বিল ফুলেফেঁপে একাকার। স্রোতের টানে কলমিলতা, কচুরিপানা দিশাহীন ভেসে চলেছে।

ভরা পোয়াতির মত সংসার, লাউমাচান, রাস্তাঘাট. আসমান জমিন এক করে যতদূর চোখ যায় কেবল পানি আর পানি। পুরো তল্লাটে ওই আহমদনগর স্কুলের পাকা দ্বিতল দালানই একমাত্র ভরসা। নিঃস্ব পরিবারগুলোর আপাত আশ্রয়কেন্দ্র। থেকেথেকেই কলার ভেলায় করে একএকটি নিঃস্ব পরিবার আশ্রয়ের খোঁজে স্কুলের বারান্দায় এসে ভিড়ে। বারান্দা ছুঁইছুঁই পানিতে হাঁস মুরগি আর গবাদি পশুর জায়গা হয়েছে একতলায়।

দোতলা আর ছাদে আশ্রয় নিয়েছে বহু মানুষ। প্রতিবছর বন্যা আসে। বন্যা যায়। ঘরবাড়ি, ফসল, গবাদি পশু এমনকি তরতাজা কত প্রাণ ভেসে যায় বানের জলে।

সরকারের ত্রানের নাও তখন আপদকালীন শুকনা খাবার, বিশুদ্ধ পানি, প্রয়োজনীয় ওষুধ নিয়ে আসে। ওই পর্যন্তই। বন্যা পরবর্তী সময়ে এই অসহায় মানুষগুলোর অবস্থা শোচনীয়ই থাকে। তাদের ভাগ্য আর ফেরে না। হতভাগ্য মানুষগুলো নিজের ভাগ্যকেই তাই অভিসম্পাত করে মাথা চাপড়ে চলে। মাথায় হাত পড়েছে মেহেরুন বিবিরও। সে বসে আছে ছাদের পুব কোণে। এখান থেকে দুই ক্রোশ পুবে তার বাড়ি ছিল। বাড়ি বলতে ওই একখানা বাঁশের ঠেকনা দেওয়া হেলে পড়া ঘর, তবু তো ছিল। পানির তোড়ে সে ঘর কোথায় আজ.. বারোদিন ধরে পানিবন্দি মেহেরুন তাই এখানেই বসে থাকে। ভেলা ভিড়লে উঁকি মারে, যদি মানুষটার দেখা মেলে। বারোটা দিন, না তো বারোটা বছর যেন, সে মানুষ তাকে খুঁজতে খুঁজতে এইদিক দিয়েই তো আসবে।

একটানা তাকিয়ে থাকে তাই।

লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিউল আযিম .. অনবরত ঠোঁট নড়ে তার। আর থেকেথেকে ভুখা পেটের নাড়িভুড়ি পাক খেয়ে ওঠে। মরার আসমান ফুটা হইয়া গ্যাছে য্যান.. ছাদের ধার ঘেঁষে বসে বিড়বিড় করে। আচমকা তখনই পুব আকাশ চিরে একটি বিজলি শিখা মেহেরুনের চোখ ধাঁধিয়ে দিলে মেহেরুন বিবি চোখ বুঁজে ফেলে। দুরুদুরু বুকে জোরেজোরে পড়তে থাকে লা হাওলা ওয়ালা..


বিবি ডরাইসোনি? কানের কাছে ফিসফিসে পুরুষকন্ঠ। সে টের পায় তার পাশ ঘেঁষে বসেছে কেউ। লোবানের গন্ধে ভরে উঠেছে চারপাশ। সে চোখ খোলে না। গমগমে কন্ঠ আবার বলে ওঠে, ডরাইয়ো না বিবি, তোমার মরদে ভাল আছে। চিন্তা কইরো না। তারপর খসখস আওয়াজ ওঠে। শনশন পাখা মেলে উড়ে যাবার শব্দ আসে। গায়ে জারকাঁটা টের পায় সে..

অভুক্ত শরীর জুড়ে তীব্র কাঁপুনি..

কী আচানক কথা.. কেমুন গায়েবী আওয়াজ.. চোখ মেলতে সাহস হয় না তার।

নাও আইতাছে, ওই যে নাও..

সম্মিলিত গুঞ্জন আর অনেকগুলো পা সচল হয়ে ওঠা শব্দে চোখ খোলে মেহেরুন। মানুষগুলো দুদ্দাড় ছাদ থেকে নিচে নেমে যাচ্ছে। কিন্তু একই ভঙ্গিতে বসে থাকে মেহেরুন। আরও কিছু সময় অতিক্রান্ত হলে ছাতা মাথায় দেওয়া জনাকয় সওয়ারি আর সারসার বস্তা বয়ে আসা নৌকাটি তার চোখে স্পষ্ট হতে শুরু করে। আর হঠাৎ ভয়ভীতি দোওয়া-তাসবিহ সব ভুলে প্রবল খিদে মোচড় দিয়ে ওঠে পেটে।

আজ দুইদিন, শুকনা খাবার আর পানির তীব্র সংকট।

মেহেরুন বিবি সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে। স্কুলের বারান্দায় এসে ভিড়ে ঠেলেঠেলে সামনে এগুতে চায়। আশ্রয়কেন্দ্র তখন আবার উচ্চকিত হয়ে ওঠে, ভ্যালা আইতাছে, ভ্যালা..।

মেহেরুন নৌকার বদলে ভেলাটি দেখতে আরও একটু পরিশ্রম করে।, ঠেলাগুঁতো দিয়ে সামনে এগোয়। ভেলা বাওয়া লোকটাকে দূর থেকে তার কেমন যেন চেনা ঠেকে। কাছে এলে বুঝতে পারে উত্তরপাড়ার জমির শ্যাখ। আর ভেলায় শায়িত যে.. হঠাৎ যেন মেহেরুন মরীয়া হয়ে ওঠে। এক ধাক্কায় সবাইকে সরিয়ে আরও সামনে এগিয়ে আসতে আসতে

আসমানের দিকে চোখ মেলে থাকা মুখটার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তারপর শরীরে কাঁপন তুলে চিলচিৎকার দেয়, আল্লা গো..ও..ও.. মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে থাকা মেহেরুনের শরীর ফুলেফুলে ওঠে। আশ্রয়হীন মানুষগুলো একে একে ঘিরে ধরে মেহেরুন বিবিকে। ত্রানের নৌকা এসে থামে। মেহেরুনকে একলা করে মানুষগুলো দ্রুত আবার সেদিকে ভিড়তে শুরু করে।

মেহেরুন বিবির কান্না তখন সাত আসমান ভেদ করে আল্লাহর আরশ কাঁপাতে চাইছে। জমির শ্যাখ অসহায়মুখে দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে বলে ওঠে, কিতাই বা কই ভাবীসাব.. ছাওয়ালরে খবর দ্যান। বাপেরে শ্যাষ দ্যাখাটা তো দ্যাখন লাগে। মেহেরুন পাথর ভঙ্গিতে বসে থাকে। ইতিউতি তাকিয়ে বুদ্ধি করে নিজেই জমির শ্যাখ ত্রাণ কর্মকর্তাদের কাছে মোবাইল ফোনের আশায় দৌড়ে যায়। ফিরে এসে মেহেরুন বিবিকে বলে, পোলার নম্বর আছে নি? মেহেরুন ভেজা আঁচলের শক্ত গিঁট খুলে আঙ্গুলের কসরতে একটুকরো পলিথিনে মোড়ানো কাগজ যত্ন করে বের করে আনে। একটা গাঢ় দীর্ঘশ্বাস তার শরীর বিদীর্ণ করে বেরিয়ে আসে। জমির দৌড়ে যায় ত্রাণ কর্মকর্তাদের কাছে।

 মরার আর টাইম পাইলি না! অহনই মরা লাগল?

গজগজ করতে করতে মোবাইলফোন বিছানায় ছুড়ে হঠাৎ উঠে দাঁড়ায় সুরুজ। লুঙ্গির প্যাঁচ খুলে শক্ত করে আবার গিঁট দিয়ে পরে। বিরক্তির ভাঁজগুলো এঁকেবেঁকে সুরুজের মুখ জুড়ে বসেছে। সমাজকল্যাণ অফিসের পিওন গাট্টাগোট্টা সুরুজের সাত আট বছরের ছেলে রতন তখন মেঝেতে বসে নারকেল কাঠি বাঁকিয়ে তাতে ঘুড়ির রঙিন কাগজ সাঁটছিল।

বাবার ঝাঁঝালো কন্ঠে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে ওঠে কী হইছে আব্বা? রতনের মা ভাতের হাঁড়ি নিয়ে ঘরে ঢুকতে গিয়ে দরজায় দাঁড়ায়। চোখে প্রশ্ন। চোখ পড়তেই তিরিক্ষি স্বরে সুরুজ বলে ওঠে, তোর আবার কী হইল? ঠাডা পড়ছেনি যে ইস্টেচু হয়া গেলি? মরার বিষ্টি, পানি জমছে এক হাঁটু মহল্লার রাস্তায়, বেলা কত সে খেয়াল তোর নি আছে?

ঘরের একদিকে একটা আম কাঠের সস্তার টেবিল পাতা। রতনের মা টেবিলে ঠকাস করে ভাতের হাঁড়ি রাখে। ঢাকনা সরাতেই গরম ভাতের চনমনে সুবাস ঘরের ভেতর ছড়িয়ে যায়। প্লেটে দু’হাতা ভাত বাড়ে রতনের মা, সামান্য নুন প্লেটের কোণে সাজিয়ে দেয়। গ্লাসে পানি ভরে।

রতন সুতোতে মাঞ্জা দেওয়া ছেড়ে পুনরায় প্রশ্ন করে, আব্বা.. কী হইছে? • তোর দাদা, মইরা গ্যাছে। লাশ দাফন করতে অহনে বাড়িত যাওন লাগব।

রতনের মার হাত থেমে যায়, ও আল্লা কন কী! ক্যাম্নে, কবে মরল? সুরুজ মুখ বেঁকিয়ে বলে ওঠে, তর দেহি পিরীত অহনে উথলায় উঠল। এত খবরে তোর কাম কী? খাইতে দিতে কইছি। দিলে দে না দিলে ক’ আমি বাইরাই। সুরুজের তেড়ে ওঠা কথায় রতনের মার মুখে শোকের ছায়া বসি বসি করেও দূরে সরে যায়। যন্ত্রের মত থালায় পুঁইডাটার চচ্চড়ি আর তিতপুঁটির ছালুন বেড়ে টেবিলের সামনে থেকে সরে যায় রতনের মা।

সুরুজ ভাত খেতে বসলে রতন বাপের গা ঘেঁষে বলে, তোমার লগে আমিও যামু আব্বা। আমারে নিয়া যাবা? রতনের মা সহসা চিৎকার জুড়ে দেয়, আমারে নিয়া যাবা? কী কাম তর ওইহানে শুনি? বিপদের মধ্যে যাওনের কাম নাই। একে তো রতন তার সবেধন একটাই সন্তান তার ওপর রতনের মা বাগড়ে দিলে তার বিপরীতে কথা না বললে সুরুজের পেটের ভাত চাল হয়ে ওঠে। তড়বড় করে ওঠে সুরুজ, ওরে নিয়াই যামু। একখনি তারে রেডি কইরা দিবি তুই। রতনের মার মুখে অন্ধকার ঘনায়। আর রতনটাও তেমন, এত বাপ ন্যাওটা হয়েছে বলার না। কথা না বাড়িয়ে রতনের জামা প্যান্ট পালটে নতুন জামা পরিয়ে দেয়। এতবছর ঘর করেও মানুষটাকে চিনে উঠতে পারলো না। তুচ্ছ সব কারণে এমন তেড়ে


ওঠে যে রতনের মা বুঝেই উঠতে পারে না কোন কথাটা বলা উচিত তার কোনটা নয়। কেবল কি তার সাথেই এমন তেঁতো ব্যবহার তার, এক রতন ছাড়া দুনিয়ার সবার ওপর সে বীতশ্রদ্ধ এমনকি নিজের জন্মদাতা বাপ তার মৃত্যুসংবাদ শুনেও কী অশ্রদ্ধা কর কথা বলছে সে। সেই কোন গ্রামে তারা বছরের পর বছর পড়ে, বিয়ের পর একবারই তাদের দেখেছিল রতনের মা। যখন সে নতুন বউ ছিল। যখন সে রতনের মা না, কে্বল সাহেরা নামের মানুষ ছিল। ওই একবারই তাকে নিয়ে তাদের গ্রামে গেছিল সুরুজ। দুটো দিন স্বপ্নের মত কেটে গেছিল যেন। ঘোমটার ফাঁক দিয়ে দেখেছিল সুরুজের সাদাসিধে মা মরচে পড়া একটা টিনের তোরঙ্গ খুলে বের করে আনছে একজোড়া রুপার মাকড়ি। কানে পরিয়ে দিতে দিতে বলছে, আর তো কিছু নাই রে মা যে এমন সোনার পুতুলেরে বরণ করমু।

আড়াল থেকে শুনেছিল সুরুজের বাবার দীর্ঘশ্বাস, সুরুজ সংসার পাতল শহরে, কত আশা ছিল ঘরের ছাওয়াল ঘরে ফিরা আইব..

সুরুজ ফেরেনি। না সুরুজ তাদের দেখতে যায়, না কোনো খোঁজ রাখে। হঠাৎ রতনের মায়ের শরীর হিম হয়ে আসে। রতনও তো তাদের একমাত্র সন্তান..

জমির শ্যাখই খবর দেয়, সুরুজ রওনা হয়েছে। সুরুজের রওনা হবার খবরে মেহেরুন বিবির কান্না থেমে যায়। সেই থেকে চুপ মেরে গেছে মেহেরুন।

সুরুজ..

ছেলের পাতে ভাত বাড়তে বাড়তে যেদিন মেহেরুন বলেছিল, বাজান, চাকরি তো হইল।

এইবার থিতু হ। বউ আনমু বাপ। টাকাপয়সা কিছু জমায়া এই ঘরখান একটু সারাই কইরা দিস বাজান। নতুন বউ আনলে থাকব কই!

সুরুজ সেদিনই রা কাড়েনি কোনো। একমনে খেয়ে উঠে গেছিল।

তার দুমাস পর সুরুজ বাড়ি এসেছিল সদ্য বিয়ে করা বউ নিয়ে। বাপ গণি মিঞা ছেলের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে সেদিন তাকিয়ে ছিল কেবল।

মনে পড়ে মেহেরুন বিবির, পরের বার বছর না ঘুরতেই সুরুজ আরও একবার এসেছিল বটে। রতন হবার পর খবরটা জানাতে। যাবার সময় বলেছিল, টাকাপয়সার বড্ড টানাটানি। বাড়িতে টাকা পাঠানো এখন থেকে আর সম্ভব নয়। ওই শেষ।

সিরাজুল চৌধুরীর জমিতে বর্গা খেটে দু মুঠো অন্নের ব্যবস্থার বাইরে গণি মিঞার তেমন কিছু আয়রুজি ছিল না। ভিটেমাটি বলতে সামান্য ওই ঘর আর দাওয়া। তাতেই সামান্য শাক পাতার চাষ করত মেহেরুন। দুটো প্রাণ, বাঁচতে যেটুকু না হলেই নয়। পরপর দুটো গর্ভ নষ্ট হবার পর তৃতীয়বারের মাথায় সুরুজের জন্ম। সেও এক বানের বছর ছিল।

মেহেরুন বিবির মনে পড়ে রোগা শরীরে মেহেরুন যেন ওইটুকুনি পুটুলির মতো শিশুটির ভারও বইতে পারত না। একহাতে গণিমিঞাই তখন সব সামলেছে। ছেলেটাকে বুকে করেই যেন বড় করেছে গণি মিঞা। বাড়তি আয়ের বুদ্ধি মানুষটার কোনোকালেই ছিল না কিন্তু স্বপ্ন দেখত ছেলেকে পড়ালেখা শিখিয়ে মানুষ করবে। তারপর একদিন এই অভাবের দরিয়া থেকে এই ছেলেই উদ্ধার করবে তাদের। মাদ্রাসায় পড়া শেষে কাজের সন্ধানে সুরুজ শহরমুখো হয়। সরকারি অফিসে একটা চাকরিও জুটিয়ে ফেলে। প্রথম মাসের বেতন নিয়ে দুদিনের ছুটিতে সুরুজ যখন বাড়িতে আসে সে বার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল মেহেরুন আর গণি মিঞা দুজনেই। খোদা বুঝি মুখ তুলল এবার। তারপর সোমেশ্বরীর ঢে কতবার জেগেছে, চলেও গেছে। প্রথম প্রথম কিছু টাকা মেহেরুন বিবির হাতে গুঁজে দিলে ক্রমে টাকা পাঠানোও বন্ধ হয়ে গেছে। যোগাযোগ বলতে ছমাসে বছরে গঞ্জের মোবাইলের দোকানে গিয়ে গণি মিঞার ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকে সুরুজের সাথে দু চারটা কথা।

দশ বারোদিন পর আহমদনগর স্কুলের ছাদে তাঁবু ফেলেছে ত্রাণ পুণর্বাসন কেন্দ্রের লোকেরা। সেখানে দ্বিতীয় রাত কাটছে সুরুজের। ডানপাশে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছে রতন। তার পাশে তার মা মেহেরুন বিবি। গতকাল আসার পরপর গবাদিপশু আর পানিবন্দী নানা মানুষের বাসি জামাকাপড়ের উৎকট গন্ধের ভেতর দিয়ে ফুলে ওঠা বাপের লাশের পাশে দাঁড়িয়ে প্রথমে গা গুলিয়ে উঠেছিল। আজ অল্প হলেও সয়ে গেছে। গতরাতেই শহর থেকে আনা কাফনের কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে সোমেশ্বরীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে গণি মিঞার

শরীর। মাটি কই যে গোর হবে..

রাত ঘন হলে, মেহেরুন বিবিকে ফিসফিসিয়ে বলে, জাইগা আছো?

মেহেরুন বিবি জেগেই। ঘুম কই তার। কিন্তু সে নড়েচড়ে না। নিরুত্তর থাকে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে সুরুজ ফের বলে উঠেছে, একখান ভাল খবর আছে মা। বন্যায় স্বজন হারানো পরিবাররে সরকার দুই লাখ ট্যাকা দিব বইলা ঘোষণা দিছে। মাস ছয় সময় দ্যাও, এইবার ঘর তুইলা দিমু তোমারে বুঝলা মা।

দীর্ঘ অনভ্যাসের ‘মা’ ডাক অথবা একটা নতুন ঘর তুলে দেবার কথাতেও মেহেরুন বিবির কোনো হেলদোল থাকে না।

- তয় কই কি মা, রতনরে এইখানে সাতদিন রাখা ঠিক হইব না, তুমারে আর রতনরে শহরে রাইখা টাকাটা না দেওয়া পর্যন্ত আমিই এইখানে থাকমু।

মেহেরুন মলিন স্বরে এবার জিজ্ঞেস করে, কবে?

- কাল সকাল সকালই রওনা হমু।

সকাল হতেই সুরুজ উঠে পড়ে। রতনকে ঘুম থেকে টেনে তুলে নিজেই শুকনো চিড়ে ভিজিয়ে, গুড় মাখিয়ে রতনকে নিজেহাতে খাইয়ে দেয়। রওনা হতে হবে সকালসকালই। এদের পৌঁছে দিয়ে অফিস থেকে ছুটি বাড়িয়ে আজই আবার ফিরতে হবে। কিন্তু মা বা রতন কাউকেই সে খুঁজে পায় না। এদিকসেদিক ঘুরে কাউকেই না পেয়ে আবার ছাদেই যায়। সেখানে সারসার তাঁবু পড়েছে। ফাঁক ফোঁকড় দিয়ে চলা ফেরা মুশকিল। খুঁজতে খুঁজতে সুরুজ দেখতে পায়, মেহেরুন বিবি রতনকে কোলে নিয়ে ছাদের পুবকোণে, ছাদের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে।

মুহূর্তে পিলে চমকে যায় তার। পা হড়কালে যে কোনো মুহূর্তে দুর্ঘটনা ঘটে যাবে।

রতনের কিছু হলে সে বাঁচবে না। রতন, বাজান.. ডাকতে গিয়েও নিজের মুখ চেপে ধরে পা টিপেটিপে এগোয় সে। সাবধানে দুজনকেই সেখান থেকে সরিয়ে আনে সুরুজ।

রতনকে নিয়ে ওই জায়গায় ক্যান দাঁড়াইছিলা তুমি? যদি কিছু হইত? সুরুজের এমন প্রশ্নের মুখে মেহেরুন বিবি এই প্রথম সোজা সুরুজের চোখের দিকে তাকায়। তারপর বলে রতন আমাগো ভিটাডা কই আছিল সেইডা দেখনের বায়না ধরছিল। তাকে দেখাইতে নিছিলাম।

নাওয়ে তখন বৈঠা পড়েছে।

ভিটা.. ভিটা.. সুরুজ হঠাৎ রতনের জায়গায় নিজেকে দেখতে পায়। রতনকে জিগ্যেস করে, অ বাজান, আমাগো ঘর কই আছিল দেখবা? খাঁড়াও, দেখাই, আসো। সুরুজ নাও ঘোরাতে বলে পুবের দিকে। ছইয়ের ভেতর থেকে রতনকে বের করে কোলে তুলে নেয়। বৃষ্টি থেকে রতনকে আড়াল করতে চকচকে কালো ছাতাটা মেলে ধরে মাথার ওপর। তারপর  পূর্ণদৃষ্টিতে ভিটে খুঁজতে থাকে।

রতন বাপের গলা জড়িয়ে প্রশ্ন করে, আব্বা ঘর কই?

যেদিকে তাকায় ওরা সেদিকেই পানি আর পানি। সুরুজ ভিটে খোঁজে। পানি মাপে। নিশানা মেলে না। দিশেহারা সুরুজ মাঝিকে নাওয়ের মুখ ঘোরাতে বলে একবার এদিক তো আবার
সেদিক।

পুব, পশ্চিম, উত্তর দক্ষিণ, নৌকার মুখ ঘুরতে থাকে। ঘুরতেই থাকে।

একসময় চিৎকার করে ওঠে সুরুজ, ও মা, তুমি চুপ ক্যান? কুনখানে আমাগো ঘর আছিল
দেখাও না ক্যান?

মেহেরুন বিবির শরীর তখন হাসির দমকে ফুলেফুলে উঠছে...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. অসাধারণ এক সৃষ্টি । শিকড় হারানোর এমন করুন ছবি গল্পের আদলে বহুদিন পঠিত হয়নি। ধন্যবাদ অদিতি।
    - প্রবুদ্ধ মিত্র

    উত্তরমুছুন