অনুবাদ আশফাক স্বপন
শরতের এক দিনে বাড়িওয়ালিকে দেখতে পেলাম। তখন মাত্র চার মাস হলো আমার বিয়ে হয়েছে। কাউ লেন-এ তার দেখা পেলাম – সে এক অদ্ভুত জায়গা, পাথুরে পথটায় একটা গায়ে-পড়া পুরনো পুরনো ভাব আনবার চেষ্টা – তাকে দেখামাত্র আমি মুখ ফিরিয়ে এমন ভাণ করলাম যেন দোকানের ঢোকার জায়গাটাতে ফেলে রাখা সস্তা বাড়তি পণ্য দেখছি। অতি সাধারণ কাঁচের জানালাওয়ালা দরজাটা কেনাকাটার ব্যাগ হাতে খদ্দেরদের বেরোবার সময় বারবার দুলে দুলে খুলছে।
ফুটপাথে বাড়িওয়ালি দাঁড়িয়ে। মৃদু বৃষ্টি হয়েছিল, তাই সব ঝকঝক করছে। ও থেমে ফোনে কী যেন পড়ছিল। সেই কত বছর আগে আমার বেইজ্জতির কলকাঠি নেড়েছিল, এতদিন পর সে দেখতে একইরকম আছে। যদিও ওকে দেখার মানসিক পূর্বপ্রস্তুতি ছিলনা – আজতো এমন কিছু ঘটেনি যাতে এই সাক্ষাতের ইঙ্গিত ছিল – ওর প্রতি মনটা উদার হয়ে উঠল। ইচ্ছে হলো তাকে বলি, আপনাকে দেখতে দারুণ লাগছে। সব সময় আপনাকে দারুণ লাগে, আপনার মধ্যে কেমন যেন একটা চৌকশ ভাব আছে। দেখে মনে হলো তার বয়স এখন অন্তত পঞ্চাশ।
কী করা যায় ভাবতে ভাবতে ঘুরে দাঁড়িয়ে, ওকে এড়িয়ে, চলে এলাম। ও আমাকে দেখতে পাবার আগেই পাথুরে রাস্তায় জুতোর খটখট শব্দ তুলে দুম করে চলে এলাম।
ডেম স্ট্রিট এলে মনে হয় জলের থেকে ডাঙায় এলাম। থামলাম এখানে। হাতের আঙুলে তুড়ি বাজালাম। কোন বড় সিদ্ধান্ত নিতে গেলে এমনটা করা আমার অভ্যাস। আমার পেছনে টেম্পল বার-এ যাবার ঢালু পথটা খালি। ক্যাথেড্রাল থেকে বাস বেরিয়ে সশব্দ হুঙ্কার দিয়ে কলেজ গ্রিন-এর দিকে চলে গেল।
ভাবলাম, এখনো নিজের উত্তেজনা কমেনি। এই মুহূর্তেও এসব ভেবে উৎফুল্ল হয়ে উঠছি। তবে একথা অবশ্যই মানবো যে এই অনুভূতি পিষ্ট হয়ে একটা আলপিনের মাথার রূপ নিয়েছে – যেন একটা কড়া উল্কির ছাপের মতো – তারপর মুক্তি পেয়ে একগুচ্ছ হরিৎ স্মৃতির বন্যায় আমাকে ভাসিয়ে নিল। ঠিক এই মুহূর্তে প্রায় ছয় বছর পার হতে চলল আমি তাকে অথবা হ্যারিকে দেখিনি – আমার বয়স এখন ত্রিশ – যদিও ময়নাতন্তের মত সব কিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মনে গাঁথা রয়েছে আমার।
আমি আমার মাত্র চার মাসের পুরনো স্বামীর সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। কিন্তু পদক্ষেপ ধীর হয়ে গেল। এটা একটু আশ্চর্যের ব্যাপার – সচরাচর আমি সবখানে হনহন করে চলি। বাড়িওয়ালিকে দেখার পরও আমার চলাফেরা কিছুটা ধীর হয়েছিল – খানিকটার আতঙ্কের ভাব যেন – চারপাশে সবখানেই যেন কীসের ইঙ্গিত।
খুব বেশিদিন হয়নি আমার বিয়ে হয়েছে। হঠাৎ করেই ব্যাপারটা ঘটল।
আমি আমার স্বামীর সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।
আমি ভীড় ঠেলে আমার পথে এগিয়ে চললাম। ক্যাথেড্রালের ঘণ্টা সজোরে বেজে ওঠার সাথে সাথে পাখিরা দিক-বিদিক ছিটকে গেল, গাংচিল ধনুকের মতো দৃঢ়ভাবে পাখা ছড়িয়ে ঘাসে পর্যটকদের উচ্ছিষ্ট খাবার খুঁজতে লাগল। ভাবছি, তেইশ বছর বয়সে হ্যারির সাথে এই ঘটনার কতটুকু আমি স্বামীকে বলেছি। ভেবেটেবে বুঝলাম, প্রায় কিছুই বলিনি। কিন্তু ঘটনাটাতো ঘটেছে, সেই বিষয়ে সন্দেহ নেই। আমার জীবনেই ঘটেছে।
ঘটনার তথ্য ঠিকমত দিইনি – একথাটা বলতে একটু কেমন যেন লাগে। কারণ তাতে আমাকে কেমন যেন বোকা বোকা দেখায়।
আমার বয়স যখন তেইশ, তখন আমি লণ্ডনে থাকি। আমার চাইতে বয়সে বড় এক লোকের সাথে দেখা হয়। ও বিবাহিত, পেশায় লেখক। আমি ওর প্রেমে পড়ে যাই। সেবারও হঠাৎ করেই ঘটনা নাটকীয় মোড় নেয়। সেই পুরুষ আর আমি, আমরা লন্ডন ছেড়ে আমার দেশ আয়ারল্যান্ড-এ চলে আসি। এপ্রিল মাসের মৃদু আবহাওয়ার আগমনে আমাদের দেখা হয়; আয়ায়ল্যান্ডে আমরা আসি আগস্ট মাসে। একটা সরু গলি যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে, সেইখানে একটা ছোট্ট বাড়ি – সেই বাড়িতে আমরা থাকা শুরু করি। বাড়িটা ওর। ও-ই ভাড়া নিয়েছে, ও বাড়িটা ভালোভাবে চেনে।
একটা কারুকার্যকরা পাখা খুলে দেখার মতো আমি এই বিষয়টি পরতে পরতে খুলে দেখবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমরা তো সেই ছোট্ট বাড়িটিতে মাত্র তিন সপ্তাহ ছিলাম, কারণ সেই বসবাসে ছেদ টানা হয়, আর তখন আমি যেন আমার পুরো জীবনটা পেছনে ফেলে চলে আসি।
পরে বহু বছর হঠাৎ করে নানান জিনিস আমাকে সেই ছোট বাড়ির স্মৃতি মনে করিয়ে দিত; হয়তো ধুলোয় মলিন কোন বেগুন, বা ফিনিক্স পার্কে রক্তিম সাঁঝের বেলায় একগুচ্ছ গাছ; ভ্যাপসা আবহাওয়া অথবা কাঠ পোড়ার গন্ধ। একবার ফিল্ম ইন্সটিটিউটে চেয়ারের নীচে আমার কোট ভাঁজ করে রাখার পর যখন উঠে বসলাম তখন যেন সেই ছোট্ট বাড়ির ঘ্রাণ পেলাম – কারো কাপড়ে ধোঁয়ার গন্ধ, কাঠের গন্ধ। হঠাৎ এক অদ্ভুত সুতীব্র মর্মভেদী বেদনা আমাকে গ্রাস করল।
বিশেষ বিশেষ পরিবেশে আমার এই বিষয়ের কথা মনে পড়ে। এক ধরনের অলস সন্ধ্যা, বিশেষ করে পাড়াগাঁয়ে। আকাশটা কে যেন টেনে টেনে প্রসারিত করে খুঁটির সাথে বেঁধেছে, মাটিতে পানির ভেজা ঘ্রাণ, তামাকের কটু গন্ধ, বদ্ধ জলাশয়, জলে ভেজা পাতা, আর সেই সাথে সাইকেল, খুর বা মানুষের বুট জুতোয় চেরা মাটি। আমার মনে পড়ে গলিতে আমি খালি পায়ে দাঁড়িয়ে, গোসলের সময়, আসন্ন রাতের লোভনীয় সুশীতলতা আর শারীরিক কষ্ট – মাঠ আর প্রান্তরকে আঁধারের ধীর সুনিবিঢ় গ্রাস, আকাশে তারার ছিটকানো আলো, এমনভাবে রাত আসে যেন কেউ কালো বালি দিয়ে বালতি ভরছে।
মনে হলো এখানে আজীবন থাকতে পারব। তখন বয়স কম ছিলতো, অল্পতেই মনটা তেতে উঠত।
কাউস লেন-এ বাড়িওয়ালিকে যখন দেখলাম, যখন আমার বিয়ের পর মাত্র চার মাস কেটেছে, আর ঘটনার পর ছয় বছর পেরিয়ে গেছে, তখন কিন্তু সব স্মৃতি যে হুড়মুড় করে আবার আমার কাছে ফিরে এলো, তা নয়। আসল কথা হচ্ছে, এই স্মৃতিগুলো সব সময়ই আমার চেতনায় ছিল, আমার খুব কাছাকাছি, বছর বছর ধরে স্বাক্ষরের মতো আমার নানান সিদ্ধান্তের মধ্যে মিশে ছিল – সেসব নতুনভাবে সংস্কৃত হয়, নতুন আঙ্গিক গ্রহণ করে, নতুনভাবে গোছগাছ করে, সমস্ত বিভ্রান্তি শুদ্ধ করে, সমস্ত বিস্মৃত খুঁটিনাটি নবকল্পিত করে, তার সমৃদ্ধি করে, তার হিসেব করে।
বাড়িওয়ালি সেদিন দূর্দান্ত একটা উজ্জ্বল সবুজ একটা কোট পড়েছিল। ঐ কোট ডনেগাল-এ বোনা হয় আর লোকে সারাজীবন সেই কোট যত্ন করে রাখে। বয়স যেন একটুও বাড়েনি, বরঞ্চ আরো সুন্দরী লাগছে। তাকে দেখে আমার খুব আনন্দ হয়েছে। যেন এতটা সময় আমি আবার নিজেকে আবিষ্কারের অপেক্ষায় ছিলাম।
সত্যি এই স্মৃতিগুলো সবসময় আমার সাথে থাকে, আছে। একেবারে হাতের কাছে। হয়ত অবয়বে, শুধু নির্যাসটকু। একেবারে ভেতরের সারবস্তু।
যেমন ধরা যাক ছোট্ট বাড়ির কোন এক সকাল। বাড়িটির বাইরে, সেই চড়াই গলিতে। এইদিন সকালে – হুবহু মনে করতে পারছিনা – একটা গাছের ঝাড়ে পেচ্ছাব করছি, ঘাড়ে উলের চাদর – এমন সময় বাড়িওয়ালি আমাকে দেখল। ওকে দেখতেই চীৎকার করে ক্ষমা চেয়ে সোজা উঠে দাঁড়ালাম। হ্যারি তখন বাড়ির ভেতর ঘুমাচ্ছে।
বাড়িওয়ালী বলল সর্বনাশ হয়ে গেছে, কুকুরটা কোথায় পালিয়েছে, আমি বললাম, ঠিক ফিরে আসবে, তখন সে যেন কোন স্থান থেকে ঝুলে আছে, এমনভাবে খানিকটা কাত হয়ে এক মূহূর্ত বিরতি নিয়ে থামল। মুখ বিকৃত, আমি ভাবলাম আমার ওপর খাপ্পা, তবে আজ ভেবে মনে হয় সেটা শ্রেফ দুশ্চিন্তার যন্ত্রণা ছিল।
আরেক দিন। খুব ভোর। এইত, ও কুকুরের পিছু পিছু ছুটছে। আমি আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে যেন সারা শরীরে অনুভূতির বিস্তৃতি উপভোগ করলাম, বিশেষ করে আঙুলগুলো যেন সরু শলাকার মতো গাছের কাণ্ডের ফোকলা হাসিকে ছুঁয়ে দেখছে, বাতাসে পচনের মাদক ঘণ ঘ্রাণ, রাস্তাটার নানা চড়াই-উতরাই। মনে হলো ও আরো লোকজন সঙ্গে এনেছে, সবাই আমাকে দেখছে। কিন্তু না, আশেপাশে কেউ নেই।
ছোট্টবাড়ির শোবার ঘরটাতে ফিরে গেলাম। আচ্ছা, আমি বুঝি না পুরুষমানুষ ওভাবে ঘুমায় কীভাবে। ওদের নজরের আড়ালে আমরা কী করতে পারি সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা হয় না?
ঠিক এইভাবে আমার স্বামীকে ঘুমন্ত দেখেছি। কী সম্পূর্ণ খোলামেলাভাবে,সরল বিশ্বাসে, নিশ্চিন্তে ঘুমায়! এমন সময় ক্যারাভাজিও-এর বাইবেলের কাহিনি-ভিত্তিক চিত্রকর্মের মতো আপনি জুডিথ হতে পারতেন, করাত দিয়ে মাতাল জেনারেল হোলোফের্নেস-এর মুণ্ডু কেটে ফেলতে পারতেন; বা ‘মলিস চেম্বারস’ গানের মলির মত প্রেমিককে জব্দ করার জন্য ওর পিস্তলে পানি ভরে ঘরে ম্যাজিস্ট্রেটকে ডাকতে পারতেন। এসবই এলোমেলো অলস চিন্তা, মনের গভীর থেকে আপনা-আপনি উঠে আসছে।
সেদিনই, পরে এক সময় – তখন হ্যারি অন্য কোথাও, কাজে ব্যস্ত – আমি সন্ধ্যাবেলায় সিড়িতে বসে গাছে ঘেরা পথ, গাছের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া শুষ্ক বাতাসের শব্দ, রোয়ান গাছে ছোট্ট লাল ফল – এসব লক্ষ করছি, কাতরভাবে চেষ্টা করছি এই সমস্ত অভিজ্ঞতাকে উপলব্ধি করার, এর অর্থ বোঝার, চেষ্টা করছি এমন এক অমর বাক্য রচনা করতে যাতে এইসব কিছুর অর্থ আমার কাছে পরিষ্কার করবে।
আজ মনে পড়ছে যে এত বড় কাজ করতে গিয়ে বেশ দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম, কারণ বেশিরভাগ গাছই আমি চিনিনা।
মনে পড়ে আমার উন্মাদনার কথা – সে একধরনের খর্বিত যন্ত্রণা বলা যেতে পারে – যখন হ্যারি আমাকে বলে, তুমি বড্ড জটিল একটা মেয়ে।
আমার তখনকার ছবিটি আমার চোখে এইরকম: যেন একটা মেয়ে নির্দেশের অপেক্ষায়, তার হাঁটু বুকের কাছে ঠেকানো। মনে হয় একধরনের বিক্ষুব্ধ স্থিরতা, বা কোন জ্বলজ্বলে, নৈরাশ্যের অপেক্ষায় আছি – এমন সব কল্পনায় আমি এক কষ্টকর একাকীত্বে ভুগছি। এর চাইতে ঢের, ঢের কঠিন সুস্থির মস্তিষ্কে দূর থেকে ঐ মানুষটা – মানে হ্যারি-এর – নাগাল পাওয়া। ও কী ভাবছিল, পুরো বিষয়টি নিয়ে আদৌ কিছু ভেবেছে কিনা, আমার মনে আগ্রহ সৃষ্টি করে অকস্মাত আমাকে ত্যাগ করেছে কিনা। অথবা কোন খারাপ উদ্দেশ্য ছাড়া, বা যথেষ্ট সহমর্মিতা ছাড়া – বা আমি কি সত্যি সেই শেষ দিনটাতে উত্তরে যা বলেছিলাম তাতে ওর মনে আঘাত দিয়েছিলাম কিনা।
উত্তরে বলেছিলাম, আমি তোমার শুচিশুভ্র রক্ষিতার আসরে যোগ দেবনা! তুমি আমাকে খেলনার মতো একটা বাক্সে ভরে রাখতে পারবে না।
বলতেই হবে, বেশ উদ্ধতভাবেই কথাটা বলেছিলাম। রীতিমতো বেয়াদপের মতো।
ডেম স্ট্রিট-এ ডাঙায় আসার পর, মুখ ফিরিয়ে হাঁটতে লাগলাম। চোখের কোণে দেখছি বাড়িওয়ালিকে দেখা যায় কিনা। আমার চোখের দৃষ্টি আমার দিকে ধাবমান মানুষের মুখের ওপর আছড়ে পড়তে লাগল, পাছে উল্লেখযোগ্য আর কোন মানুষ বা জিনিস দেখে ফেলি, পাছে দিনটাতে কোনো সমান্তরাল ঘটনাচক্রের নাটক সৃষ্টি হয় – যখন নিয়তির চাকাটা একটু বেশি দ্রুত ঘোরে তখন আমার মনে হয় এমনটা হতে পারে। আমি একটু অপেক্ষাও করলাম, সময় দিলাম রাস্তাটাকে আমাকে নতুন কিছু জানাতে – আমি আরো আস্তে হাঁটলাম, চিন্তার গতি ধীর করলাম – কিন্তু নতুন কিছুই আর জানা হলো না।
তখন ভাবলাম, যে আমি আসলে অপেক্ষা করছি। আমি পুনরাবিষ্কৃত হবার জন্য অপেক্ষা করছি, বহুদিন ধরে আমি ওর ফেরার জন্য অপেক্ষা করছি। আমার মনে এই ছিল অনুচ্চারিত আশা, অলীক আশায় প্রহরা, তবে স্বামীর সাথে পরিচয় হবার পর সেই ভাবনা অনেকটাই কমে গিয়েছে। এতটাই কমে গিয়েছে যে সেই প্রবণতাটাকে আমি আজ দূর থেকে প্রত্যক্ষ করলাম আর যেই মানুষটা – মানে আমি - এভাবে অপেক্ষা করছিল তার জন্য খুব মায়া হলো। ঈষৎ তাচ্ছিল্যে আর কিছুটা সুখের সাথে ভাবলাম, একটা মানুষ তার কুড়ি বছরে গোটা একটা দশক ওভাবে বরবাদ করে কীভাবে? তার উত্তর সবার জানা। খুব সহজেই পারে।
এসেক্স স্ট্রিট পার হবার সময় আমি এটাও ভাবলাম জীবন কত গতানুগতিক, আকর্ষণহীন হতে পারে। মানুষও। আমাদের অনুভূতি আর আচরণ এত অবদমিত বলেই এই দুর্গতি সামাল দিতে স্বাভাবিকভাবেই আমরা নানান বর্ণাঢ্য আশাপূর্ণ কল্পনার ফানুস উড়াই।
বাকিটা পথ মনের মধ্যে এই চিন্তা এলো যে আমার স্বামী হয়ত আমার আগেই বাস স্টপে এসে গেছে, হয়ত আমার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু পার্লামেন্ট স্ট্রিটের চুড়ায় এসে মনে হলো একদম বোকার মতো চিন্তা করছি – ও কক্ষণো আমার জন্য অপেক্ষা করেনা। হাঁটতে হাঁটতে আবার ইলশেগুড়ি বৃষ্টি শুরু হলো, হাল্কা বৃষ্টি, আমি কোটের সাথে লাগানো টুপিটা তুলে মাথা ঢাকলাম। কোটটা স্কটিশ চেক ডিজাইনের কারণে চড়ুইভাতির চাদরের মতো দেখতে। হঠাৎ আমার কোটটা খুব বিরক্তিকর লাগল, মনে হলো ওই কোটে আমাকে অতি সাধারণ দেখায়। আমার স্বামী সব সময় দেরি করে আসে। আমাকে যেদিন বিয়ের প্রস্তাব করে, সেদিনও দেরি করে আসা এবং অন্যান্য কীসব কাণ্ডের জবাবদিহি করার থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ও বিয়ের প্রস্তাব করে।
বৃষ্টি নদীর পারে পানি উস্কোখুস্কো করে দিচ্ছিল। সন্ধ্যা নেমে আসছে। একটা বাস এসে থামল। আমি চলে যেতে দিলাম বাসটাকে। হুমড়ি খেয়ে বাসটা আবার ট্রাফিকে ঢুকে গেল। ভাবতে লাগলাম, এক দিন কি স্বামীকে ছাড়াই বাসে লাফ দিয়ে উঠব? এক দিন কি সম্পূর্ণভাবে ধৈর্য হারাব? ঐ আসছে। দেখলাম নীল কোটে, ঘাড়ে ক্যানভাসের ব্যাগ দুলছে, মুখে কাতর হাসি। ওর ত্বকে বহুবছর গরম আবহাওয়ায় কাজ করার চিহ্ন – ও স্পেনে বহুদিন থেকেছে। ওর চোখের ভারি পাতায় অলস আরামপ্রিয়তার আভাস দেখে আমার মনে প্রশান্তি আসে। ওকে দেখামাত্র আমার বিরক্তি যে কোথায় পালাল!
ছোট্ট বেড়াল, ছোট্ট কিট – আমায় আদর করে বলল। কিট ওর দেওয়া ডাকনাম। কারণ আমি হাল্কা পাতলা আর আমি কামড়ে দিই। ঘড়ির ডিজিটাল পর্দায় একটু তাকিয়ে বলল সাত মিনিট মাত্র। মন্দ না, কী বল?
ভাবলাম, অতীতের এক ধরনের শক্তিও আছে, আবার ঝুঁকিও।
আজ কাজে কেমন সময় কাটল? শুধালাম।
একগাল হেসে বলল, আমার বাচ্চাটা দাবা টুর্নামেন্ট জিতবে। ও স্কুলে ইতিহাস পড়ায়, সেখানে এক ছাত্রকে দাবা খেলা শেখায়, তার কথা বলছে।
ওহ, তোমার তো তাহলে জীবন সার্থক, আমি টিটকারি মারলাম।
আরে ওতো এখন আমাকেও হারাতে পারে, ও বলল।
হাসিটা খাঁটি, উল্লাস আর উত্তেজনাও তাই। শিক্ষকতা, মানুষকে পথপ্রদর্শন করা এবং নিজেকে পথপ্রদর্শক হিসেবে ভাবা – এসব বিষয়ে ও বড্ড ছেলেমানুষ। আমি এই ব্যাপারটা বরাবর কিছুটা তাচ্ছিল্যের সাথে দেখেছি। আমি তৃতীয় শ্রেণীতে পড়াই, এবং এই বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র বিকার নেই। আজ বুঝি সেটা বেশ দেখানোপনা দৃশ্যমান ছিল এবং সেটা মোটেও ভালো ছিল না।
আমাদের টুর্নামেন্টে এসো না, স্বামী বলল।
আমি বাবা সরকারী স্কুলে পড়েছি, আমি দাবার নিয়মকানুন জানিনা, ঠাস করে জবাব দিলাম। তারপর হেসে উঠলাম। বললাম, বেশতো, যাব। দেখব। স্কুলটা দেখে ভালো লাগবে।
তোমাকে আগে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ পাশ করতে হতে পারে।
হ্যা গরীব সরকারী স্কুলে যখন পড়েছি, সেতো হতেই পারে।
আমি জানি ও আর আমাকে যাবার জন্য বলবে না। আমাকেই খোঁজ নিতে হবে, ততদিনে সব বন্দোবস্ত করার আর সময় থাকবে না। দুজন এখনো দুজনকে ভালোভাবে চিনিনা তো, তাই আমরা পরস্পরের ওপর নির্ভর করি অদ্ভুত সব কায়দায় – কখনো একে অপরকে ধাপ্পা দিয়ে, বা সাহসের পরীক্ষা করে; চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে, কিছু জিনিস গোপন রেখে। তবে আমাদের বিয়ে নিয়ে, বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে খুব একটা কথা বলি না। যেন এই সম্পর্কটার চিরকাল অস্তিত্ব ছিল এমন ভাবে আমরা চলি।
সব ঠিক তো? আমাকে প্রায়ই ও জিজ্ঞেস করে। জিজ্ঞেস করে আড়চোখে আমাকে দেখে। আমি ভাণ করি যেন কিছুই জানিনা।
হ্যারিও আমাকে আড়চোখে দেখত।
হ্যারি এখন আমার মনে এসে উপস্থিত হয়েছে, আমার চিন্তাভাবনায় বারবার এসে বাগড়া দিচ্ছে।
বাস স্টপে দাঁড়িয়ে মনে পড়ল – আমরা একসাথে যখন প্রথমবারের মত খেতে বসেছিলাম – হ্যারি আর আমি – এবং সেই খাবার একেবারে দুর্ভিক্ষের খাবার। শামুকের সুরুয়া, হলদে রঙের পাইন কাঠের টেবিলে মোমবাতি জ্বলছিল, আর ও অপলক দৃষ্টিতে আমার খাওয়া লক্ষ করছিল। যেন পাত্র থেকে ঠোঁট অবধি ওর চোখ আমার খাওয়া অনুসরণ করছিল – এবং প্রতিবার ওয়াইনের গ্লাস তুলতেই সেটার দিকে আড়ষ্টভাবে তাকাচ্ছিল। আমরা বোরো মার্কেট-এ এক গ্রীষ্মের সন্ধ্যা কাটাচ্ছিলাম। সে সময় আমি ডিকেন্স-এর ‘লিটল ডোরিট’ উপন্যাসটি পড়ছিলাম। সেটা নিয়ে আলোচনা করতে করতে বলছিলাম উপন্যাসটা আমার একেবারে রসকষহীন লাগছিল। বেশ বুঝতে পারছিলাম আমার উষ্মার ফলে আমাকে খানিকটা ছেলেমানুষ, সরল আর আকর্ষণীয়া লাগছিল।
এগুলো সব চাল মারছি, তখন ভেবেছিলাম – নিজেকে বকুনি দিয়েছিলাম: তুমি একটা আস্ত চালবাজ। ভেবে বেশ লজ্জিত হয়েছিলাম।
বাস স্টপে অপেক্ষা করতে করতে আমার স্বামী আমার কোমরের পেছনে হাত রাখল। কোনকিছু না ভেবে আপনা থেকে এই হাত রাখাটার মধ্যে আমার ওপর একটা মালিকানা ঘোষণার ইঙ্গিত ছিল সেটা আমাকে অভিভূত করে, শরীরে ঝড় তোলে।
মনে পড়ল হ্যারিও স্বতস্ফূর্তভাবে আমার পায়ের নীচের অংশ চেপে ধরত। আমি ওর মোটরবাইকে ওঠার ঠিক আগে। পা’টা চেপে ধরায় কৃতজ্ঞতায়, প্রেমের উত্তেজনায় শরীর শিহরিত হতো। তখন আমার ২৩ বছর বয়স – পুরুষমানুষ সম্বন্ধে তখনো কিসসু জানিনা, তবে এখন কিছু কিছু জানি।
মনের জানালায় এই দুইজন পুরুষকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে বুঝলাম দুজনে একদম আলাদা। আমার স্বামী, বুঝলেন, প্রেমে আমার জন্য দিওয়ানা হয়ে গিয়েছিল। বা হয়ত আমার প্রেমে ঠিক নয়, আমার প্রতি প্রচণ্ড নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল – এই নির্ভরশীলতা ওর আমাকে দেখার আগে থেকেই ছিল, এবং নিঃসন্দেহে অন্য নারীর প্রতিও সেই নির্ভরশীলতা গড়ে উঠেছিল – তার তীব্রতা এত বেশি যে সেটা শেষপর্যন্ত আর টেকে না। অন্যদিকে হ্যারির কিন্তু কখনোই আমাকে প্রয়োজন ছিল না, শুধু মাত্র আমার শরীর, বা শরীরকে কীভাবে ব্যবহার করি তাই নিয়ে উন্মত্ত হয়ে হঠাৎ কখনো কখনো ও আমাকে চাইত। আমার শরীর এলোমেলোভাবে এলিয়ে বসার অভ্যাস। একবার বোরো মার্কেটে এই রেস্তোরায় টেবিলের নীচে পা ছড়িয়ে বসেছিলাম, পায়ের যেই জায়গাটা কামাইনি, সেটা লোমশ, কিন্তু আমার সেদিকে খেয়াল নেই। পা ছড়িয়ে বসে আছি, জংঘার হাড় এমনভাবে ছড়ানো যেন আতঙ্কে চোয়াল আটকে গেছে।
হ্যারিকে খুব সম্ভ্রমের চোখে দেখতাম। আমার স্বামীকে মোটেও না, আজকাল তো আরো না। আমার স্বামীর ভালোবাসাটাতে কেমন যেন আদিখ্যেতা আছে, একটা কাতর ভাব – অন্তত সেরকমই লাগে – প্রচণ্ড ছেলেমানুষি আকুতি। আমাদের এই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য আমার স্বামী ছলচাতুরির আশ্রয় নেয়, বা নিয়ে থাকতে পারে। হ্যারি কখনো আমার সাথে ছলচাতুরির আশ্রয় নেয়নি। ও বরাবর আচরণে মসৃণ, আপনাতেই সম্পূর্ণ – ওর অফিসের ভেতরে বসে আমাকে বাইরে রেখে দরজায় তালা দিয়ে রাখত। আমার জন্য ঐ সময়ে ও যেন একটা বিশাল ক্যানভাস, যার মধ্যে আমি আমার আকাশকুসুম কল্পনাগুলো নিয়ে খেলতে পারতাম। বাস স্টপে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ভাবলাম, কিন্তু এজন্য তো আমার স্বামীকে দোষ দিতে পারিনা।
লাইব্রেরিতে কেমন কাটল, স্বামী আমাকে জিজ্ঞেস করল।
মন্দ না, আমি বললাম। আমি গোম্ব্রিচের একটা বই পড়ছিলাম তখন। বইটা মায়া নিয়ে। আমার ওই বিষয়ে বরাবরই আগ্রহ।
বাস এলো। শহরের মধ্য দিয়ে আমরা চলতে লাগলাম। বৃষ্টি কমতে কমতে সন্ধ্যাবেলা সূর্যালোকের অন্তিম একটা ঝাপটা আমাদের অবাক করে দিল, একটা রক্তাভ আভা রেখে গেল। তাই আমি বললাম – আজ সন্ধ্যায় হাঁটতেই হবে, বাড়ি পৌঁছামাত্র। বাড়ি গিয়ে জিনিসপত্র রেখেই সাথে সাথে বেরুতে হবে। আবার বৃষ্টি শুরু হবার আগে।
বাসে কোনো বসার জায়গা ছিলনা, শুধু দাঁড়াবার স্থান। বাস দুলকি চালে উত্তর দিকে চলতে লাগল, আর যাত্রীরা সব খুঁটি ধরে দুলতে লাগল।
শহরতলীর পুরনো গাছগুলোর পাতা তাম্রবর্ণ ধারণ করেছে, পাতায় পাতায় ভরে উঠেছে। বিশপস প্যালেসের গাছগুলো দেয়াল উপচে পড়েছে, ফুটপাথে গাছের লতাগুল্ম মণিমানিক্যের মতো জ্বলজ্বল করছে। সবখানে বাড়িওয়ালি – বা হুবহু অমন একজন – যেন দেখতে পাচ্ছি। আমি বেশ চেষ্টা করে ভেবে দেখার চেষ্টা করলাম, আচ্ছা, সে এখন কী করছে? সে কি এখনো সেই পুরনো আমলের খামারবাড়িতে থাকে? সে কী হ্যারিকে এখনও বাড়ি ভাড়া দেয়? আমাকে কি তার মনে আছে? হ্যারিই বা এখন কোথায়? আমি ধরে নিয়েছিলাম ও চলে গেছে – লডনে বা আর কোথাও। আমি ভাবতে পারিনা ডাবলিন শহরের মতো জায়গায় ও থাকবে। ডাবলিনের সাথে ওর জগতের গ্রহ গ্রহান্তরের ফারাক।
আমার স্বামী ফোনে মেসেজ পাঠাতে লাগল। খুব মনোযোগ দিয়ে, সিদ্ধ হাতে। ওর দিকে তাকালাম। ও দেখতে ভালো। ওর চোখদুটো অসাধারণ, চুল সোনালি, না কাটলে আলুথালু। যদিও বয়স বছর চল্লিশ, ওর শরীর, তার বিশালতা যা কোনকিছু পরোয়া না করে এতখানি জায়গা অধিকার করে রয়েছে, ওর নায়কের মতো ঠোঁট – পুরুষমানুষের পক্ষে একটু বেশি পুরু – আর ওর ত্বক সময়ের চাপে এততাই জীর্ণ যে এত রূপ সত্ত্বেও ওর বয়সটা আর চাপা থাকে না। ওর সবকিছুই এখনো আমাকে উত্তেজনায় শ্বাসরুদ্ধ করে। ভেবে দেখলাম, ওকে বিয়ে করার একটা বড় কারণ শরীরের আকর্ষণ। শারীরিক মিলনে ও অপটু, কেমন আসুরিক ধ্বস্তাধ্বস্তি করে, অবারিত, মাঝে মাঝে শারীরিক পীড়ন করতে ছাড়ে না। যেন জীবনের অনেকটা সময় ওর শারীরিক চাহিদা মেটেনি। ওর জীবনের এই ব্যাপারটা আমি একদম বুঝতে পারিনা। আহা দেখতে যখন ও এত ভালো, সেটা দিয়ে মেয়েদের যেন বাগে আনা যায় না। যেন ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না।
কনোলি স্টেশনের প্লাটফর্মে আমার স্বামীর সাথে প্রথম দেখা। শুষ্ক সকাল, তখন নয়টা বাজে। মঙ্কসটাউনে বন্ধুদের বাড়ি বেড়িয়ে আমি বাড়ি ফিরছিলাম। দিনটা খুব শান্ত, চুপচাপ। সমুদ্র আর বুটার্সটাউনের কর্দমাক্ত উর্বর জমি থেকে বাষ্প উঠে এসে কেমন একটা মাদকতা সৃষ্টি করেছে। হাউথ এর বিশাল এলাকাটা যেন গরুর এক মস্ত চাকা মাংসের টুকরোর মতো মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। আমার পরনে লম্বা উলের কোট, যেন পিকনিকের চাদর – ঠিক এই কোটটাই আমি এখন পরে আছি – আর হাতে আমার সবুজ আঙুল খোলা দস্তানা। অবারিত মুখমণ্ডল, সকালটায় চারপাশে কী ঘটছে তাতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। বাসন ছুরি দিয়ে চাঁছার মতো অস্ফূট ঘষার চড়া আওয়াজ করে ট্রেনটা হামাগুড়ি দিয়ে স্টেশনে ঢুকতেই নড়েচড়ে বসলাম। এমন সময় হঠাৎ অথচ সাবলীলভাবে এক লোক ঝপ করে আমার পাশের আসনটায় বসে পড়ল। লোকটা আয়ত ফিকে রঙের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আচ্ছা, এটা খুব উদ্ভট লাগবে আপনার কাছে – কিন্তু আমি কি আপনার ফোন নম্বরটা পেতে পারি?
মোহিত হলাম। অবশ্য সেই সময়ে আমি নিজেও বেশ মোহনীয় ছিলাম। দূর থেকে আমাকে দেখেই যে কেউ আঁচ করতে পারত যে আমার তখন তেমন কেউ নেই। ওর দিকে তাকিয়ে এমন করে মুচকি হাসলাম যেন ঠিক ঐভাবে ঝুপ করে আমার জীবনকে আবিষ্ট করবে বলেই আশা করছিলাম। টিকিটে আমার ফোন নম্বর আর আমার নাম – এ্যালানা – লিখে বললাম, এই তো আমার ট্রেন এসে গেছে, এখন ছুটতে হবে!
ঝড়ের মতো ট্রেনের কামরায় প্রবেশ করলাম, যেন কোন ছবির নায়িকা। আমার ট্রেন রওয়ানা দিতে দিতে ও আমায় হাত নাড়াল বা আমার নাম ফোন নম্বর পড়লো কি না সে দিকে ফিরেও তাকালাম না। আমার লজ্জা লাগছিল। তার বদলে বাথরুমে ঢুকে দরজাটা আস্তে বন্ধ হতে দিলাম, তারপর আয়নায় নিজেকে দেখলাম। ও পুরো একটা দিন অপেক্ষা করেছিল, ফোন করেছিল পরদিন। ঐ সময়টুকু আমার ভয় হয়েছিল আমায় বুঝি ভুলেই গেল। অথচ এদিকে আমি আমাদের প্রথম দেখার ঘটনার কথা ভেবে রোমাঞ্চিত হচ্ছিলাম – স্টেশন, সেই ট্রেন, সেই গায়ে কাঁটা দেওয়া সুশীতল চোখের দৃষ্টি – ভাবলে এখনো মনে হয় যেন এক গপ্পো ফেঁদেছি।
শেষে ও ফোন করার পর আমি সাইকেল চেপে ওর কাজের পর বোটানিক এভিনিউ-এ দেখা করতে গেলাম। উদ্ধত, আবার ত্রস্ত। কয়েক মিনিট কেউ কথা বলতে পারলাম না। আরো দু’বার কফি খেতে দেখা করে নীরব আবেশের মৌতাত উপভোগ করলাম, তারপর আস্তে আস্তে সঙ্কোচের বরফ গলতে শুরু করলো।
আমি প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। সোজা-সাপ্টা, সরল কথাটা হলো এই। আমাকে আটকাবার মতো কেউ ছিলনা। আমার আর কোনরকমের আকর্ষণ ছিল না।
বহুবছর আগে যখন লণ্ডনে ছিলাম – যখন হ্যারির সাথে দেখা হয় – তখনো আমার এই অবস্থা, কিছু করার নেই, একঘেয়েমিতে ক্লান্ত – আসলে অনেক কাজ ছিল, কিন্তু সেসব দায়িত্ব থেকে মনটা কেমন যেন আলগা হয়ে গিয়েছিল। তাই হয়ত ব্যাপারটা কাকতালীয় নয়। দুই ক্ষেত্রেই আমাকে আটকাবার মতো কেউ ছিলনা, কেউ আমার ওপরে নজর রাখছিলনা। কারণ সাধারণত আমি বেশির ভাগ সময় একা থাকি, এবং সেটা খুব পছন্দ করি। বরাবরই তাই।
আমাদের তৃতীয় সাক্ষাতে প্ল্যাটফর্মে দেখা লোকটি আর আমি বোটানিকাল গার্ডেনে গেলাম। পাম গাছের ঘর, নীল ডালপালাওয়ালা সুপুষ্ট গাছ, কাঁটাওয়ালা ক্যাক্টাস গাছ – যেন অত্যাচারের যন্ত্রপাতি – এসবের মধ্য দিয়ে হাঁটলাম। কথাবার্তায় দুজনেই সংযমী, শান্ত, পরিহাসতরল। অন্তত আমার বেলায় সেটা সত্যি। শেষে বললাম, এবার তোমার কী বলার আছে সেটা বল। শুক্রবারে কীসে আটকে গিয়েছিলে?
একটু অপেক্ষা করো, ও উত্তর দিল।
বাইরে সূর্য ঝলমল করছে, গাছগুলো কড়া আলোয় সুস্পষ্টভবে দৃশ্যমান। দুপাশে গাছের সারির মধ্য দিয়ে ছোট আমরা হাঁটতে লাগলাম। বুড়ি নানি-দাদিরা ছোট্ট বাচ্চাদের প্র্যামে ঠেলছে। ও প্রথমবারের মতো এক হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে কাছে টেনে নিল। বেশ জোরের সাথে।
কী ব্যাপার বলতো, আমি জোর দিয়ে বললাম। কী, তোমার কি ঘরে বৌ আছে নাকি? নাকি পুলিশের থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছ? ব্যাপারটা কিন্তু আর তামাশা নয়।
ও আমার চুলে মুখ গুঁজল। দুয়েক মূহূর্ত আমরা ওভাবেই থাকলাম। তারপর ও কোথাও বসতে চাইল। রুপালি বার্চ গাছের সারিমুখো এক ঢালু জায়গায় একটা বেঞ্চ পেলাম, সেখানে বসলাম দুজনে।
ও বলল, আমার কথা শুনে ঠিক তুমি এখান থেকে উঠে পালাবে। আমাকে আঁকড়ে ধরে ও সামনের দিকে তাকিয়ে রইল।
হায় আল্লাহ! ওকে একটু হাল্কা করার চেষ্টা করলাম। বললাম, কী করেছ কী, কোন খুন-টুন নাকি?
কিছু না বলে আমার কপালে একটা চুমু দিল। তখনো আমরা শারীরিকভাবে অন্তরঙ্গ হইনি, তাই এটাই আমাদের সবচাইতে কাছাকাছি আসা। ও আমার বুকের খাঁচার হাড়গুলো ও তার ফাঁকের গর্তে আঙুল আলতো করে বুলাচ্ছিল – হাড়ে হাল্কা চাপ দিচ্ছিল আর হতাশ নয়নে সামনের দিকে তাকিয়েছিল – খানিকটা অবাক হয়ে হ্যারির হাতের কথা ভাবলাম। ও ঠিক এইভাবে বুকের খাঁচার হাড়ে আর মধ্যবর্তী ফাঁকে চাপ দিত, গুণত। ভরদুপরে ভূতের মতো চিন্তাটা কোথায় পালাল। শুধু দৃষ্টির সীমানা থেকে পালাল অবশ্য, মনের ভেতর রয়ে গেল, যেন কীসের অপেক্ষায়।
আমাকে বল, এবার আদেশের সুরে বললাম। কারণ আমার এবার মনে হচ্ছে ঠিক তোমার ঘরে বৌ আছে। ভাবলাম, হায় খোদা! দুনিয়াতে নতুন বলে আর কিছু নেই।
আমি বিয়ে করিনি, ও বলল। তারপর চোখ বন্ধ করে খুব মৃদু কণ্ঠে বলল, আমার একটা ছোট্ট মেয়ে আছে। এক বছরও বয়স হয়নি।
সাথে সাথে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি ওর মায়ের সাথে থাক?
না।
কিন্তু পরস্পরকে চেন?
এক সময় সম্পর্ক ছিল। অনেক বছর ধরে কখনো কখনো আমরা কাছাকাছি এসেছি।
কিন্তু এখন আর না।
এখন কথা হলেই ঝগড়া শুরু হয়ে যায়। কিন্তু। ও চারপাশে একবার তাকিয়ে নিল। ওর ভাইদের মধ্যে কেউ যদি আমাকে এখানে দেখে ফেলে, তাহলে আমাকে আচ্ছা ধোলাই দেবে।
ও আরো বলল, মেয়েটা আমার একমাত্র বাচ্চা না। আমি যখন কলেজে পড়ি, আমার এক বান্ধবী ছিল। ও অন্তঃসত্ত্বা হয়। আমার আরেকটা মেয়ে আছে, ও এখন কিশোরী, বিদেশে বড় হয়েছে।
আমি স্তব্ধ হয়ে আস্তে আস্তে বললাম, তুমি তো বয়সে আমার বড়। অতীত ইতিহাস অবশ্যম্ভাবী। আমার নিজেরও অতীত আছে, আমি বললাম। মনে মনে ভাবলাম, আমার অতীত ইতিহাস সঙ্গী, সন্তান আর দায়িত্বে পূর্ণ নয়, সেখানে বিদেশ শব্দটা নেই, তাই সেটা আরো অনেক হাল্কা লাগে। আমার অতীত যেন শুধু মনের ভেতর একটা অনুভূতির আলোড়ন, যার কোন নাম নেই। নিজেকে ক্ষুদ্র ভেবে কষ্ট হলো।
আমাদের কাছে একটা ঘাস কাটার গাড়ি ঘরঘর শব্দ করে বাতাসে কাটা ঘাসের টুকরো ছড়াচ্ছিল। বার্চ গাছগুলো আলতো করে কেঁপে কেঁপে উঠছিল, আকাশটা পরিষ্কার। ও আমাকে চেপে ধরে জিজ্ঞেস করল, কী, পালাতে চাও? আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাও?
কিন্তু আমিতো পালাতে চাই না। কারণ ব্যাপারটা আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। মনে হল আমার হৃদয়ে ঔদার্য পল্লবিত হয়েছে, সেখানে গ্রহণ করার, মমতার, সুশীলতার পাপড়িগুলো একে একে খোলার জন্য আঁকুপাকু করছে। আমরা পাম গাছের ঘর পার হলাম। ঘরটা গুমোট, এতটুকু বাইরের বাতাস সেখানে ঢোকে না, নিরাপদ। একটা কাঁচের বদ্ধ খাঁচাতে যেন সুক্ষ্ম এক কারুকার্যময় জটিলতা দেখলাম। তাছাড়া ভাবলাম, এইসব তো আমার ঝামেলা নয়, তাই না?
বললাম, আমাকে ভেবে দেখতে হবে। আমাকে সাইকেল পর্যন্ত এগিয়ে দিতে চাও?
এতে স্বস্তি পেয়ে ও হেসে উঠল। মাথা নাড়তে নাড়তে আমার দিকে তাকিয়ে বারবার বলতে লাগল, সাইকেল পর্যন্ত এগিয়ে দেব। তারপর বলল, আরেকটু থাকবে না?
ওকে বললাম, যেতে হবে। এমনিতে দেরি হয়ে গেছে। আমি সাইকেলে চেপে শহরে চললাম। সন্ধ্যা নেমে আসছে। বসন্ত আসছে। এবার বসন্তটা খুব সুন্দর হবে।
ফুটপাথে বাড়িওয়ালি দাঁড়িয়ে। মৃদু বৃষ্টি হয়েছিল, তাই সব ঝকঝক করছে। ও থেমে ফোনে কী যেন পড়ছিল। সেই কত বছর আগে আমার বেইজ্জতির কলকাঠি নেড়েছিল, এতদিন পর সে দেখতে একইরকম আছে। যদিও ওকে দেখার মানসিক পূর্বপ্রস্তুতি ছিলনা – আজতো এমন কিছু ঘটেনি যাতে এই সাক্ষাতের ইঙ্গিত ছিল – ওর প্রতি মনটা উদার হয়ে উঠল। ইচ্ছে হলো তাকে বলি, আপনাকে দেখতে দারুণ লাগছে। সব সময় আপনাকে দারুণ লাগে, আপনার মধ্যে কেমন যেন একটা চৌকশ ভাব আছে। দেখে মনে হলো তার বয়স এখন অন্তত পঞ্চাশ।
কী করা যায় ভাবতে ভাবতে ঘুরে দাঁড়িয়ে, ওকে এড়িয়ে, চলে এলাম। ও আমাকে দেখতে পাবার আগেই পাথুরে রাস্তায় জুতোর খটখট শব্দ তুলে দুম করে চলে এলাম।
ডেম স্ট্রিট এলে মনে হয় জলের থেকে ডাঙায় এলাম। থামলাম এখানে। হাতের আঙুলে তুড়ি বাজালাম। কোন বড় সিদ্ধান্ত নিতে গেলে এমনটা করা আমার অভ্যাস। আমার পেছনে টেম্পল বার-এ যাবার ঢালু পথটা খালি। ক্যাথেড্রাল থেকে বাস বেরিয়ে সশব্দ হুঙ্কার দিয়ে কলেজ গ্রিন-এর দিকে চলে গেল।
ভাবলাম, এখনো নিজের উত্তেজনা কমেনি। এই মুহূর্তেও এসব ভেবে উৎফুল্ল হয়ে উঠছি। তবে একথা অবশ্যই মানবো যে এই অনুভূতি পিষ্ট হয়ে একটা আলপিনের মাথার রূপ নিয়েছে – যেন একটা কড়া উল্কির ছাপের মতো – তারপর মুক্তি পেয়ে একগুচ্ছ হরিৎ স্মৃতির বন্যায় আমাকে ভাসিয়ে নিল। ঠিক এই মুহূর্তে প্রায় ছয় বছর পার হতে চলল আমি তাকে অথবা হ্যারিকে দেখিনি – আমার বয়স এখন ত্রিশ – যদিও ময়নাতন্তের মত সব কিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মনে গাঁথা রয়েছে আমার।
আমি আমার মাত্র চার মাসের পুরনো স্বামীর সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। কিন্তু পদক্ষেপ ধীর হয়ে গেল। এটা একটু আশ্চর্যের ব্যাপার – সচরাচর আমি সবখানে হনহন করে চলি। বাড়িওয়ালিকে দেখার পরও আমার চলাফেরা কিছুটা ধীর হয়েছিল – খানিকটার আতঙ্কের ভাব যেন – চারপাশে সবখানেই যেন কীসের ইঙ্গিত।
খুব বেশিদিন হয়নি আমার বিয়ে হয়েছে। হঠাৎ করেই ব্যাপারটা ঘটল।
আমি আমার স্বামীর সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।
আমি ভীড় ঠেলে আমার পথে এগিয়ে চললাম। ক্যাথেড্রালের ঘণ্টা সজোরে বেজে ওঠার সাথে সাথে পাখিরা দিক-বিদিক ছিটকে গেল, গাংচিল ধনুকের মতো দৃঢ়ভাবে পাখা ছড়িয়ে ঘাসে পর্যটকদের উচ্ছিষ্ট খাবার খুঁজতে লাগল। ভাবছি, তেইশ বছর বয়সে হ্যারির সাথে এই ঘটনার কতটুকু আমি স্বামীকে বলেছি। ভেবেটেবে বুঝলাম, প্রায় কিছুই বলিনি। কিন্তু ঘটনাটাতো ঘটেছে, সেই বিষয়ে সন্দেহ নেই। আমার জীবনেই ঘটেছে।
ঘটনার তথ্য ঠিকমত দিইনি – একথাটা বলতে একটু কেমন যেন লাগে। কারণ তাতে আমাকে কেমন যেন বোকা বোকা দেখায়।
আমার বয়স যখন তেইশ, তখন আমি লণ্ডনে থাকি। আমার চাইতে বয়সে বড় এক লোকের সাথে দেখা হয়। ও বিবাহিত, পেশায় লেখক। আমি ওর প্রেমে পড়ে যাই। সেবারও হঠাৎ করেই ঘটনা নাটকীয় মোড় নেয়। সেই পুরুষ আর আমি, আমরা লন্ডন ছেড়ে আমার দেশ আয়ারল্যান্ড-এ চলে আসি। এপ্রিল মাসের মৃদু আবহাওয়ার আগমনে আমাদের দেখা হয়; আয়ায়ল্যান্ডে আমরা আসি আগস্ট মাসে। একটা সরু গলি যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে, সেইখানে একটা ছোট্ট বাড়ি – সেই বাড়িতে আমরা থাকা শুরু করি। বাড়িটা ওর। ও-ই ভাড়া নিয়েছে, ও বাড়িটা ভালোভাবে চেনে।
একটা কারুকার্যকরা পাখা খুলে দেখার মতো আমি এই বিষয়টি পরতে পরতে খুলে দেখবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমরা তো সেই ছোট্ট বাড়িটিতে মাত্র তিন সপ্তাহ ছিলাম, কারণ সেই বসবাসে ছেদ টানা হয়, আর তখন আমি যেন আমার পুরো জীবনটা পেছনে ফেলে চলে আসি।
পরে বহু বছর হঠাৎ করে নানান জিনিস আমাকে সেই ছোট বাড়ির স্মৃতি মনে করিয়ে দিত; হয়তো ধুলোয় মলিন কোন বেগুন, বা ফিনিক্স পার্কে রক্তিম সাঁঝের বেলায় একগুচ্ছ গাছ; ভ্যাপসা আবহাওয়া অথবা কাঠ পোড়ার গন্ধ। একবার ফিল্ম ইন্সটিটিউটে চেয়ারের নীচে আমার কোট ভাঁজ করে রাখার পর যখন উঠে বসলাম তখন যেন সেই ছোট্ট বাড়ির ঘ্রাণ পেলাম – কারো কাপড়ে ধোঁয়ার গন্ধ, কাঠের গন্ধ। হঠাৎ এক অদ্ভুত সুতীব্র মর্মভেদী বেদনা আমাকে গ্রাস করল।
বিশেষ বিশেষ পরিবেশে আমার এই বিষয়ের কথা মনে পড়ে। এক ধরনের অলস সন্ধ্যা, বিশেষ করে পাড়াগাঁয়ে। আকাশটা কে যেন টেনে টেনে প্রসারিত করে খুঁটির সাথে বেঁধেছে, মাটিতে পানির ভেজা ঘ্রাণ, তামাকের কটু গন্ধ, বদ্ধ জলাশয়, জলে ভেজা পাতা, আর সেই সাথে সাইকেল, খুর বা মানুষের বুট জুতোয় চেরা মাটি। আমার মনে পড়ে গলিতে আমি খালি পায়ে দাঁড়িয়ে, গোসলের সময়, আসন্ন রাতের লোভনীয় সুশীতলতা আর শারীরিক কষ্ট – মাঠ আর প্রান্তরকে আঁধারের ধীর সুনিবিঢ় গ্রাস, আকাশে তারার ছিটকানো আলো, এমনভাবে রাত আসে যেন কেউ কালো বালি দিয়ে বালতি ভরছে।
মনে হলো এখানে আজীবন থাকতে পারব। তখন বয়স কম ছিলতো, অল্পতেই মনটা তেতে উঠত।
কাউস লেন-এ বাড়িওয়ালিকে যখন দেখলাম, যখন আমার বিয়ের পর মাত্র চার মাস কেটেছে, আর ঘটনার পর ছয় বছর পেরিয়ে গেছে, তখন কিন্তু সব স্মৃতি যে হুড়মুড় করে আবার আমার কাছে ফিরে এলো, তা নয়। আসল কথা হচ্ছে, এই স্মৃতিগুলো সব সময়ই আমার চেতনায় ছিল, আমার খুব কাছাকাছি, বছর বছর ধরে স্বাক্ষরের মতো আমার নানান সিদ্ধান্তের মধ্যে মিশে ছিল – সেসব নতুনভাবে সংস্কৃত হয়, নতুন আঙ্গিক গ্রহণ করে, নতুনভাবে গোছগাছ করে, সমস্ত বিভ্রান্তি শুদ্ধ করে, সমস্ত বিস্মৃত খুঁটিনাটি নবকল্পিত করে, তার সমৃদ্ধি করে, তার হিসেব করে।
বাড়িওয়ালি সেদিন দূর্দান্ত একটা উজ্জ্বল সবুজ একটা কোট পড়েছিল। ঐ কোট ডনেগাল-এ বোনা হয় আর লোকে সারাজীবন সেই কোট যত্ন করে রাখে। বয়স যেন একটুও বাড়েনি, বরঞ্চ আরো সুন্দরী লাগছে। তাকে দেখে আমার খুব আনন্দ হয়েছে। যেন এতটা সময় আমি আবার নিজেকে আবিষ্কারের অপেক্ষায় ছিলাম।
সত্যি এই স্মৃতিগুলো সবসময় আমার সাথে থাকে, আছে। একেবারে হাতের কাছে। হয়ত অবয়বে, শুধু নির্যাসটকু। একেবারে ভেতরের সারবস্তু।
যেমন ধরা যাক ছোট্ট বাড়ির কোন এক সকাল। বাড়িটির বাইরে, সেই চড়াই গলিতে। এইদিন সকালে – হুবহু মনে করতে পারছিনা – একটা গাছের ঝাড়ে পেচ্ছাব করছি, ঘাড়ে উলের চাদর – এমন সময় বাড়িওয়ালি আমাকে দেখল। ওকে দেখতেই চীৎকার করে ক্ষমা চেয়ে সোজা উঠে দাঁড়ালাম। হ্যারি তখন বাড়ির ভেতর ঘুমাচ্ছে।
বাড়িওয়ালী বলল সর্বনাশ হয়ে গেছে, কুকুরটা কোথায় পালিয়েছে, আমি বললাম, ঠিক ফিরে আসবে, তখন সে যেন কোন স্থান থেকে ঝুলে আছে, এমনভাবে খানিকটা কাত হয়ে এক মূহূর্ত বিরতি নিয়ে থামল। মুখ বিকৃত, আমি ভাবলাম আমার ওপর খাপ্পা, তবে আজ ভেবে মনে হয় সেটা শ্রেফ দুশ্চিন্তার যন্ত্রণা ছিল।
আরেক দিন। খুব ভোর। এইত, ও কুকুরের পিছু পিছু ছুটছে। আমি আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে যেন সারা শরীরে অনুভূতির বিস্তৃতি উপভোগ করলাম, বিশেষ করে আঙুলগুলো যেন সরু শলাকার মতো গাছের কাণ্ডের ফোকলা হাসিকে ছুঁয়ে দেখছে, বাতাসে পচনের মাদক ঘণ ঘ্রাণ, রাস্তাটার নানা চড়াই-উতরাই। মনে হলো ও আরো লোকজন সঙ্গে এনেছে, সবাই আমাকে দেখছে। কিন্তু না, আশেপাশে কেউ নেই।
ছোট্টবাড়ির শোবার ঘরটাতে ফিরে গেলাম। আচ্ছা, আমি বুঝি না পুরুষমানুষ ওভাবে ঘুমায় কীভাবে। ওদের নজরের আড়ালে আমরা কী করতে পারি সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা হয় না?
ঠিক এইভাবে আমার স্বামীকে ঘুমন্ত দেখেছি। কী সম্পূর্ণ খোলামেলাভাবে,সরল বিশ্বাসে, নিশ্চিন্তে ঘুমায়! এমন সময় ক্যারাভাজিও-এর বাইবেলের কাহিনি-ভিত্তিক চিত্রকর্মের মতো আপনি জুডিথ হতে পারতেন, করাত দিয়ে মাতাল জেনারেল হোলোফের্নেস-এর মুণ্ডু কেটে ফেলতে পারতেন; বা ‘মলিস চেম্বারস’ গানের মলির মত প্রেমিককে জব্দ করার জন্য ওর পিস্তলে পানি ভরে ঘরে ম্যাজিস্ট্রেটকে ডাকতে পারতেন। এসবই এলোমেলো অলস চিন্তা, মনের গভীর থেকে আপনা-আপনি উঠে আসছে।
সেদিনই, পরে এক সময় – তখন হ্যারি অন্য কোথাও, কাজে ব্যস্ত – আমি সন্ধ্যাবেলায় সিড়িতে বসে গাছে ঘেরা পথ, গাছের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া শুষ্ক বাতাসের শব্দ, রোয়ান গাছে ছোট্ট লাল ফল – এসব লক্ষ করছি, কাতরভাবে চেষ্টা করছি এই সমস্ত অভিজ্ঞতাকে উপলব্ধি করার, এর অর্থ বোঝার, চেষ্টা করছি এমন এক অমর বাক্য রচনা করতে যাতে এইসব কিছুর অর্থ আমার কাছে পরিষ্কার করবে।
আজ মনে পড়ছে যে এত বড় কাজ করতে গিয়ে বেশ দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম, কারণ বেশিরভাগ গাছই আমি চিনিনা।
মনে পড়ে আমার উন্মাদনার কথা – সে একধরনের খর্বিত যন্ত্রণা বলা যেতে পারে – যখন হ্যারি আমাকে বলে, তুমি বড্ড জটিল একটা মেয়ে।
আমার তখনকার ছবিটি আমার চোখে এইরকম: যেন একটা মেয়ে নির্দেশের অপেক্ষায়, তার হাঁটু বুকের কাছে ঠেকানো। মনে হয় একধরনের বিক্ষুব্ধ স্থিরতা, বা কোন জ্বলজ্বলে, নৈরাশ্যের অপেক্ষায় আছি – এমন সব কল্পনায় আমি এক কষ্টকর একাকীত্বে ভুগছি। এর চাইতে ঢের, ঢের কঠিন সুস্থির মস্তিষ্কে দূর থেকে ঐ মানুষটা – মানে হ্যারি-এর – নাগাল পাওয়া। ও কী ভাবছিল, পুরো বিষয়টি নিয়ে আদৌ কিছু ভেবেছে কিনা, আমার মনে আগ্রহ সৃষ্টি করে অকস্মাত আমাকে ত্যাগ করেছে কিনা। অথবা কোন খারাপ উদ্দেশ্য ছাড়া, বা যথেষ্ট সহমর্মিতা ছাড়া – বা আমি কি সত্যি সেই শেষ দিনটাতে উত্তরে যা বলেছিলাম তাতে ওর মনে আঘাত দিয়েছিলাম কিনা।
উত্তরে বলেছিলাম, আমি তোমার শুচিশুভ্র রক্ষিতার আসরে যোগ দেবনা! তুমি আমাকে খেলনার মতো একটা বাক্সে ভরে রাখতে পারবে না।
বলতেই হবে, বেশ উদ্ধতভাবেই কথাটা বলেছিলাম। রীতিমতো বেয়াদপের মতো।
ডেম স্ট্রিট-এ ডাঙায় আসার পর, মুখ ফিরিয়ে হাঁটতে লাগলাম। চোখের কোণে দেখছি বাড়িওয়ালিকে দেখা যায় কিনা। আমার চোখের দৃষ্টি আমার দিকে ধাবমান মানুষের মুখের ওপর আছড়ে পড়তে লাগল, পাছে উল্লেখযোগ্য আর কোন মানুষ বা জিনিস দেখে ফেলি, পাছে দিনটাতে কোনো সমান্তরাল ঘটনাচক্রের নাটক সৃষ্টি হয় – যখন নিয়তির চাকাটা একটু বেশি দ্রুত ঘোরে তখন আমার মনে হয় এমনটা হতে পারে। আমি একটু অপেক্ষাও করলাম, সময় দিলাম রাস্তাটাকে আমাকে নতুন কিছু জানাতে – আমি আরো আস্তে হাঁটলাম, চিন্তার গতি ধীর করলাম – কিন্তু নতুন কিছুই আর জানা হলো না।
তখন ভাবলাম, যে আমি আসলে অপেক্ষা করছি। আমি পুনরাবিষ্কৃত হবার জন্য অপেক্ষা করছি, বহুদিন ধরে আমি ওর ফেরার জন্য অপেক্ষা করছি। আমার মনে এই ছিল অনুচ্চারিত আশা, অলীক আশায় প্রহরা, তবে স্বামীর সাথে পরিচয় হবার পর সেই ভাবনা অনেকটাই কমে গিয়েছে। এতটাই কমে গিয়েছে যে সেই প্রবণতাটাকে আমি আজ দূর থেকে প্রত্যক্ষ করলাম আর যেই মানুষটা – মানে আমি - এভাবে অপেক্ষা করছিল তার জন্য খুব মায়া হলো। ঈষৎ তাচ্ছিল্যে আর কিছুটা সুখের সাথে ভাবলাম, একটা মানুষ তার কুড়ি বছরে গোটা একটা দশক ওভাবে বরবাদ করে কীভাবে? তার উত্তর সবার জানা। খুব সহজেই পারে।
এসেক্স স্ট্রিট পার হবার সময় আমি এটাও ভাবলাম জীবন কত গতানুগতিক, আকর্ষণহীন হতে পারে। মানুষও। আমাদের অনুভূতি আর আচরণ এত অবদমিত বলেই এই দুর্গতি সামাল দিতে স্বাভাবিকভাবেই আমরা নানান বর্ণাঢ্য আশাপূর্ণ কল্পনার ফানুস উড়াই।
বাকিটা পথ মনের মধ্যে এই চিন্তা এলো যে আমার স্বামী হয়ত আমার আগেই বাস স্টপে এসে গেছে, হয়ত আমার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু পার্লামেন্ট স্ট্রিটের চুড়ায় এসে মনে হলো একদম বোকার মতো চিন্তা করছি – ও কক্ষণো আমার জন্য অপেক্ষা করেনা। হাঁটতে হাঁটতে আবার ইলশেগুড়ি বৃষ্টি শুরু হলো, হাল্কা বৃষ্টি, আমি কোটের সাথে লাগানো টুপিটা তুলে মাথা ঢাকলাম। কোটটা স্কটিশ চেক ডিজাইনের কারণে চড়ুইভাতির চাদরের মতো দেখতে। হঠাৎ আমার কোটটা খুব বিরক্তিকর লাগল, মনে হলো ওই কোটে আমাকে অতি সাধারণ দেখায়। আমার স্বামী সব সময় দেরি করে আসে। আমাকে যেদিন বিয়ের প্রস্তাব করে, সেদিনও দেরি করে আসা এবং অন্যান্য কীসব কাণ্ডের জবাবদিহি করার থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ও বিয়ের প্রস্তাব করে।
বৃষ্টি নদীর পারে পানি উস্কোখুস্কো করে দিচ্ছিল। সন্ধ্যা নেমে আসছে। একটা বাস এসে থামল। আমি চলে যেতে দিলাম বাসটাকে। হুমড়ি খেয়ে বাসটা আবার ট্রাফিকে ঢুকে গেল। ভাবতে লাগলাম, এক দিন কি স্বামীকে ছাড়াই বাসে লাফ দিয়ে উঠব? এক দিন কি সম্পূর্ণভাবে ধৈর্য হারাব? ঐ আসছে। দেখলাম নীল কোটে, ঘাড়ে ক্যানভাসের ব্যাগ দুলছে, মুখে কাতর হাসি। ওর ত্বকে বহুবছর গরম আবহাওয়ায় কাজ করার চিহ্ন – ও স্পেনে বহুদিন থেকেছে। ওর চোখের ভারি পাতায় অলস আরামপ্রিয়তার আভাস দেখে আমার মনে প্রশান্তি আসে। ওকে দেখামাত্র আমার বিরক্তি যে কোথায় পালাল!
ছোট্ট বেড়াল, ছোট্ট কিট – আমায় আদর করে বলল। কিট ওর দেওয়া ডাকনাম। কারণ আমি হাল্কা পাতলা আর আমি কামড়ে দিই। ঘড়ির ডিজিটাল পর্দায় একটু তাকিয়ে বলল সাত মিনিট মাত্র। মন্দ না, কী বল?
ভাবলাম, অতীতের এক ধরনের শক্তিও আছে, আবার ঝুঁকিও।
আজ কাজে কেমন সময় কাটল? শুধালাম।
একগাল হেসে বলল, আমার বাচ্চাটা দাবা টুর্নামেন্ট জিতবে। ও স্কুলে ইতিহাস পড়ায়, সেখানে এক ছাত্রকে দাবা খেলা শেখায়, তার কথা বলছে।
ওহ, তোমার তো তাহলে জীবন সার্থক, আমি টিটকারি মারলাম।
আরে ওতো এখন আমাকেও হারাতে পারে, ও বলল।
হাসিটা খাঁটি, উল্লাস আর উত্তেজনাও তাই। শিক্ষকতা, মানুষকে পথপ্রদর্শন করা এবং নিজেকে পথপ্রদর্শক হিসেবে ভাবা – এসব বিষয়ে ও বড্ড ছেলেমানুষ। আমি এই ব্যাপারটা বরাবর কিছুটা তাচ্ছিল্যের সাথে দেখেছি। আমি তৃতীয় শ্রেণীতে পড়াই, এবং এই বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র বিকার নেই। আজ বুঝি সেটা বেশ দেখানোপনা দৃশ্যমান ছিল এবং সেটা মোটেও ভালো ছিল না।
আমাদের টুর্নামেন্টে এসো না, স্বামী বলল।
আমি বাবা সরকারী স্কুলে পড়েছি, আমি দাবার নিয়মকানুন জানিনা, ঠাস করে জবাব দিলাম। তারপর হেসে উঠলাম। বললাম, বেশতো, যাব। দেখব। স্কুলটা দেখে ভালো লাগবে।
তোমাকে আগে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ পাশ করতে হতে পারে।
হ্যা গরীব সরকারী স্কুলে যখন পড়েছি, সেতো হতেই পারে।
আমি জানি ও আর আমাকে যাবার জন্য বলবে না। আমাকেই খোঁজ নিতে হবে, ততদিনে সব বন্দোবস্ত করার আর সময় থাকবে না। দুজন এখনো দুজনকে ভালোভাবে চিনিনা তো, তাই আমরা পরস্পরের ওপর নির্ভর করি অদ্ভুত সব কায়দায় – কখনো একে অপরকে ধাপ্পা দিয়ে, বা সাহসের পরীক্ষা করে; চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে, কিছু জিনিস গোপন রেখে। তবে আমাদের বিয়ে নিয়ে, বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে খুব একটা কথা বলি না। যেন এই সম্পর্কটার চিরকাল অস্তিত্ব ছিল এমন ভাবে আমরা চলি।
সব ঠিক তো? আমাকে প্রায়ই ও জিজ্ঞেস করে। জিজ্ঞেস করে আড়চোখে আমাকে দেখে। আমি ভাণ করি যেন কিছুই জানিনা।
হ্যারিও আমাকে আড়চোখে দেখত।
হ্যারি এখন আমার মনে এসে উপস্থিত হয়েছে, আমার চিন্তাভাবনায় বারবার এসে বাগড়া দিচ্ছে।
বাস স্টপে দাঁড়িয়ে মনে পড়ল – আমরা একসাথে যখন প্রথমবারের মত খেতে বসেছিলাম – হ্যারি আর আমি – এবং সেই খাবার একেবারে দুর্ভিক্ষের খাবার। শামুকের সুরুয়া, হলদে রঙের পাইন কাঠের টেবিলে মোমবাতি জ্বলছিল, আর ও অপলক দৃষ্টিতে আমার খাওয়া লক্ষ করছিল। যেন পাত্র থেকে ঠোঁট অবধি ওর চোখ আমার খাওয়া অনুসরণ করছিল – এবং প্রতিবার ওয়াইনের গ্লাস তুলতেই সেটার দিকে আড়ষ্টভাবে তাকাচ্ছিল। আমরা বোরো মার্কেট-এ এক গ্রীষ্মের সন্ধ্যা কাটাচ্ছিলাম। সে সময় আমি ডিকেন্স-এর ‘লিটল ডোরিট’ উপন্যাসটি পড়ছিলাম। সেটা নিয়ে আলোচনা করতে করতে বলছিলাম উপন্যাসটা আমার একেবারে রসকষহীন লাগছিল। বেশ বুঝতে পারছিলাম আমার উষ্মার ফলে আমাকে খানিকটা ছেলেমানুষ, সরল আর আকর্ষণীয়া লাগছিল।
এগুলো সব চাল মারছি, তখন ভেবেছিলাম – নিজেকে বকুনি দিয়েছিলাম: তুমি একটা আস্ত চালবাজ। ভেবে বেশ লজ্জিত হয়েছিলাম।
বাস স্টপে অপেক্ষা করতে করতে আমার স্বামী আমার কোমরের পেছনে হাত রাখল। কোনকিছু না ভেবে আপনা থেকে এই হাত রাখাটার মধ্যে আমার ওপর একটা মালিকানা ঘোষণার ইঙ্গিত ছিল সেটা আমাকে অভিভূত করে, শরীরে ঝড় তোলে।
মনে পড়ল হ্যারিও স্বতস্ফূর্তভাবে আমার পায়ের নীচের অংশ চেপে ধরত। আমি ওর মোটরবাইকে ওঠার ঠিক আগে। পা’টা চেপে ধরায় কৃতজ্ঞতায়, প্রেমের উত্তেজনায় শরীর শিহরিত হতো। তখন আমার ২৩ বছর বয়স – পুরুষমানুষ সম্বন্ধে তখনো কিসসু জানিনা, তবে এখন কিছু কিছু জানি।
মনের জানালায় এই দুইজন পুরুষকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে বুঝলাম দুজনে একদম আলাদা। আমার স্বামী, বুঝলেন, প্রেমে আমার জন্য দিওয়ানা হয়ে গিয়েছিল। বা হয়ত আমার প্রেমে ঠিক নয়, আমার প্রতি প্রচণ্ড নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল – এই নির্ভরশীলতা ওর আমাকে দেখার আগে থেকেই ছিল, এবং নিঃসন্দেহে অন্য নারীর প্রতিও সেই নির্ভরশীলতা গড়ে উঠেছিল – তার তীব্রতা এত বেশি যে সেটা শেষপর্যন্ত আর টেকে না। অন্যদিকে হ্যারির কিন্তু কখনোই আমাকে প্রয়োজন ছিল না, শুধু মাত্র আমার শরীর, বা শরীরকে কীভাবে ব্যবহার করি তাই নিয়ে উন্মত্ত হয়ে হঠাৎ কখনো কখনো ও আমাকে চাইত। আমার শরীর এলোমেলোভাবে এলিয়ে বসার অভ্যাস। একবার বোরো মার্কেটে এই রেস্তোরায় টেবিলের নীচে পা ছড়িয়ে বসেছিলাম, পায়ের যেই জায়গাটা কামাইনি, সেটা লোমশ, কিন্তু আমার সেদিকে খেয়াল নেই। পা ছড়িয়ে বসে আছি, জংঘার হাড় এমনভাবে ছড়ানো যেন আতঙ্কে চোয়াল আটকে গেছে।
হ্যারিকে খুব সম্ভ্রমের চোখে দেখতাম। আমার স্বামীকে মোটেও না, আজকাল তো আরো না। আমার স্বামীর ভালোবাসাটাতে কেমন যেন আদিখ্যেতা আছে, একটা কাতর ভাব – অন্তত সেরকমই লাগে – প্রচণ্ড ছেলেমানুষি আকুতি। আমাদের এই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য আমার স্বামী ছলচাতুরির আশ্রয় নেয়, বা নিয়ে থাকতে পারে। হ্যারি কখনো আমার সাথে ছলচাতুরির আশ্রয় নেয়নি। ও বরাবর আচরণে মসৃণ, আপনাতেই সম্পূর্ণ – ওর অফিসের ভেতরে বসে আমাকে বাইরে রেখে দরজায় তালা দিয়ে রাখত। আমার জন্য ঐ সময়ে ও যেন একটা বিশাল ক্যানভাস, যার মধ্যে আমি আমার আকাশকুসুম কল্পনাগুলো নিয়ে খেলতে পারতাম। বাস স্টপে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ভাবলাম, কিন্তু এজন্য তো আমার স্বামীকে দোষ দিতে পারিনা।
লাইব্রেরিতে কেমন কাটল, স্বামী আমাকে জিজ্ঞেস করল।
মন্দ না, আমি বললাম। আমি গোম্ব্রিচের একটা বই পড়ছিলাম তখন। বইটা মায়া নিয়ে। আমার ওই বিষয়ে বরাবরই আগ্রহ।
বাস এলো। শহরের মধ্য দিয়ে আমরা চলতে লাগলাম। বৃষ্টি কমতে কমতে সন্ধ্যাবেলা সূর্যালোকের অন্তিম একটা ঝাপটা আমাদের অবাক করে দিল, একটা রক্তাভ আভা রেখে গেল। তাই আমি বললাম – আজ সন্ধ্যায় হাঁটতেই হবে, বাড়ি পৌঁছামাত্র। বাড়ি গিয়ে জিনিসপত্র রেখেই সাথে সাথে বেরুতে হবে। আবার বৃষ্টি শুরু হবার আগে।
বাসে কোনো বসার জায়গা ছিলনা, শুধু দাঁড়াবার স্থান। বাস দুলকি চালে উত্তর দিকে চলতে লাগল, আর যাত্রীরা সব খুঁটি ধরে দুলতে লাগল।
শহরতলীর পুরনো গাছগুলোর পাতা তাম্রবর্ণ ধারণ করেছে, পাতায় পাতায় ভরে উঠেছে। বিশপস প্যালেসের গাছগুলো দেয়াল উপচে পড়েছে, ফুটপাথে গাছের লতাগুল্ম মণিমানিক্যের মতো জ্বলজ্বল করছে। সবখানে বাড়িওয়ালি – বা হুবহু অমন একজন – যেন দেখতে পাচ্ছি। আমি বেশ চেষ্টা করে ভেবে দেখার চেষ্টা করলাম, আচ্ছা, সে এখন কী করছে? সে কি এখনো সেই পুরনো আমলের খামারবাড়িতে থাকে? সে কী হ্যারিকে এখনও বাড়ি ভাড়া দেয়? আমাকে কি তার মনে আছে? হ্যারিই বা এখন কোথায়? আমি ধরে নিয়েছিলাম ও চলে গেছে – লডনে বা আর কোথাও। আমি ভাবতে পারিনা ডাবলিন শহরের মতো জায়গায় ও থাকবে। ডাবলিনের সাথে ওর জগতের গ্রহ গ্রহান্তরের ফারাক।
আমার স্বামী ফোনে মেসেজ পাঠাতে লাগল। খুব মনোযোগ দিয়ে, সিদ্ধ হাতে। ওর দিকে তাকালাম। ও দেখতে ভালো। ওর চোখদুটো অসাধারণ, চুল সোনালি, না কাটলে আলুথালু। যদিও বয়স বছর চল্লিশ, ওর শরীর, তার বিশালতা যা কোনকিছু পরোয়া না করে এতখানি জায়গা অধিকার করে রয়েছে, ওর নায়কের মতো ঠোঁট – পুরুষমানুষের পক্ষে একটু বেশি পুরু – আর ওর ত্বক সময়ের চাপে এততাই জীর্ণ যে এত রূপ সত্ত্বেও ওর বয়সটা আর চাপা থাকে না। ওর সবকিছুই এখনো আমাকে উত্তেজনায় শ্বাসরুদ্ধ করে। ভেবে দেখলাম, ওকে বিয়ে করার একটা বড় কারণ শরীরের আকর্ষণ। শারীরিক মিলনে ও অপটু, কেমন আসুরিক ধ্বস্তাধ্বস্তি করে, অবারিত, মাঝে মাঝে শারীরিক পীড়ন করতে ছাড়ে না। যেন জীবনের অনেকটা সময় ওর শারীরিক চাহিদা মেটেনি। ওর জীবনের এই ব্যাপারটা আমি একদম বুঝতে পারিনা। আহা দেখতে যখন ও এত ভালো, সেটা দিয়ে মেয়েদের যেন বাগে আনা যায় না। যেন ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না।
কনোলি স্টেশনের প্লাটফর্মে আমার স্বামীর সাথে প্রথম দেখা। শুষ্ক সকাল, তখন নয়টা বাজে। মঙ্কসটাউনে বন্ধুদের বাড়ি বেড়িয়ে আমি বাড়ি ফিরছিলাম। দিনটা খুব শান্ত, চুপচাপ। সমুদ্র আর বুটার্সটাউনের কর্দমাক্ত উর্বর জমি থেকে বাষ্প উঠে এসে কেমন একটা মাদকতা সৃষ্টি করেছে। হাউথ এর বিশাল এলাকাটা যেন গরুর এক মস্ত চাকা মাংসের টুকরোর মতো মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। আমার পরনে লম্বা উলের কোট, যেন পিকনিকের চাদর – ঠিক এই কোটটাই আমি এখন পরে আছি – আর হাতে আমার সবুজ আঙুল খোলা দস্তানা। অবারিত মুখমণ্ডল, সকালটায় চারপাশে কী ঘটছে তাতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। বাসন ছুরি দিয়ে চাঁছার মতো অস্ফূট ঘষার চড়া আওয়াজ করে ট্রেনটা হামাগুড়ি দিয়ে স্টেশনে ঢুকতেই নড়েচড়ে বসলাম। এমন সময় হঠাৎ অথচ সাবলীলভাবে এক লোক ঝপ করে আমার পাশের আসনটায় বসে পড়ল। লোকটা আয়ত ফিকে রঙের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আচ্ছা, এটা খুব উদ্ভট লাগবে আপনার কাছে – কিন্তু আমি কি আপনার ফোন নম্বরটা পেতে পারি?
মোহিত হলাম। অবশ্য সেই সময়ে আমি নিজেও বেশ মোহনীয় ছিলাম। দূর থেকে আমাকে দেখেই যে কেউ আঁচ করতে পারত যে আমার তখন তেমন কেউ নেই। ওর দিকে তাকিয়ে এমন করে মুচকি হাসলাম যেন ঠিক ঐভাবে ঝুপ করে আমার জীবনকে আবিষ্ট করবে বলেই আশা করছিলাম। টিকিটে আমার ফোন নম্বর আর আমার নাম – এ্যালানা – লিখে বললাম, এই তো আমার ট্রেন এসে গেছে, এখন ছুটতে হবে!
ঝড়ের মতো ট্রেনের কামরায় প্রবেশ করলাম, যেন কোন ছবির নায়িকা। আমার ট্রেন রওয়ানা দিতে দিতে ও আমায় হাত নাড়াল বা আমার নাম ফোন নম্বর পড়লো কি না সে দিকে ফিরেও তাকালাম না। আমার লজ্জা লাগছিল। তার বদলে বাথরুমে ঢুকে দরজাটা আস্তে বন্ধ হতে দিলাম, তারপর আয়নায় নিজেকে দেখলাম। ও পুরো একটা দিন অপেক্ষা করেছিল, ফোন করেছিল পরদিন। ঐ সময়টুকু আমার ভয় হয়েছিল আমায় বুঝি ভুলেই গেল। অথচ এদিকে আমি আমাদের প্রথম দেখার ঘটনার কথা ভেবে রোমাঞ্চিত হচ্ছিলাম – স্টেশন, সেই ট্রেন, সেই গায়ে কাঁটা দেওয়া সুশীতল চোখের দৃষ্টি – ভাবলে এখনো মনে হয় যেন এক গপ্পো ফেঁদেছি।
শেষে ও ফোন করার পর আমি সাইকেল চেপে ওর কাজের পর বোটানিক এভিনিউ-এ দেখা করতে গেলাম। উদ্ধত, আবার ত্রস্ত। কয়েক মিনিট কেউ কথা বলতে পারলাম না। আরো দু’বার কফি খেতে দেখা করে নীরব আবেশের মৌতাত উপভোগ করলাম, তারপর আস্তে আস্তে সঙ্কোচের বরফ গলতে শুরু করলো।
আমি প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। সোজা-সাপ্টা, সরল কথাটা হলো এই। আমাকে আটকাবার মতো কেউ ছিলনা। আমার আর কোনরকমের আকর্ষণ ছিল না।
বহুবছর আগে যখন লণ্ডনে ছিলাম – যখন হ্যারির সাথে দেখা হয় – তখনো আমার এই অবস্থা, কিছু করার নেই, একঘেয়েমিতে ক্লান্ত – আসলে অনেক কাজ ছিল, কিন্তু সেসব দায়িত্ব থেকে মনটা কেমন যেন আলগা হয়ে গিয়েছিল। তাই হয়ত ব্যাপারটা কাকতালীয় নয়। দুই ক্ষেত্রেই আমাকে আটকাবার মতো কেউ ছিলনা, কেউ আমার ওপরে নজর রাখছিলনা। কারণ সাধারণত আমি বেশির ভাগ সময় একা থাকি, এবং সেটা খুব পছন্দ করি। বরাবরই তাই।
আমাদের তৃতীয় সাক্ষাতে প্ল্যাটফর্মে দেখা লোকটি আর আমি বোটানিকাল গার্ডেনে গেলাম। পাম গাছের ঘর, নীল ডালপালাওয়ালা সুপুষ্ট গাছ, কাঁটাওয়ালা ক্যাক্টাস গাছ – যেন অত্যাচারের যন্ত্রপাতি – এসবের মধ্য দিয়ে হাঁটলাম। কথাবার্তায় দুজনেই সংযমী, শান্ত, পরিহাসতরল। অন্তত আমার বেলায় সেটা সত্যি। শেষে বললাম, এবার তোমার কী বলার আছে সেটা বল। শুক্রবারে কীসে আটকে গিয়েছিলে?
একটু অপেক্ষা করো, ও উত্তর দিল।
বাইরে সূর্য ঝলমল করছে, গাছগুলো কড়া আলোয় সুস্পষ্টভবে দৃশ্যমান। দুপাশে গাছের সারির মধ্য দিয়ে ছোট আমরা হাঁটতে লাগলাম। বুড়ি নানি-দাদিরা ছোট্ট বাচ্চাদের প্র্যামে ঠেলছে। ও প্রথমবারের মতো এক হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে কাছে টেনে নিল। বেশ জোরের সাথে।
কী ব্যাপার বলতো, আমি জোর দিয়ে বললাম। কী, তোমার কি ঘরে বৌ আছে নাকি? নাকি পুলিশের থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছ? ব্যাপারটা কিন্তু আর তামাশা নয়।
ও আমার চুলে মুখ গুঁজল। দুয়েক মূহূর্ত আমরা ওভাবেই থাকলাম। তারপর ও কোথাও বসতে চাইল। রুপালি বার্চ গাছের সারিমুখো এক ঢালু জায়গায় একটা বেঞ্চ পেলাম, সেখানে বসলাম দুজনে।
ও বলল, আমার কথা শুনে ঠিক তুমি এখান থেকে উঠে পালাবে। আমাকে আঁকড়ে ধরে ও সামনের দিকে তাকিয়ে রইল।
হায় আল্লাহ! ওকে একটু হাল্কা করার চেষ্টা করলাম। বললাম, কী করেছ কী, কোন খুন-টুন নাকি?
কিছু না বলে আমার কপালে একটা চুমু দিল। তখনো আমরা শারীরিকভাবে অন্তরঙ্গ হইনি, তাই এটাই আমাদের সবচাইতে কাছাকাছি আসা। ও আমার বুকের খাঁচার হাড়গুলো ও তার ফাঁকের গর্তে আঙুল আলতো করে বুলাচ্ছিল – হাড়ে হাল্কা চাপ দিচ্ছিল আর হতাশ নয়নে সামনের দিকে তাকিয়েছিল – খানিকটা অবাক হয়ে হ্যারির হাতের কথা ভাবলাম। ও ঠিক এইভাবে বুকের খাঁচার হাড়ে আর মধ্যবর্তী ফাঁকে চাপ দিত, গুণত। ভরদুপরে ভূতের মতো চিন্তাটা কোথায় পালাল। শুধু দৃষ্টির সীমানা থেকে পালাল অবশ্য, মনের ভেতর রয়ে গেল, যেন কীসের অপেক্ষায়।
আমাকে বল, এবার আদেশের সুরে বললাম। কারণ আমার এবার মনে হচ্ছে ঠিক তোমার ঘরে বৌ আছে। ভাবলাম, হায় খোদা! দুনিয়াতে নতুন বলে আর কিছু নেই।
আমি বিয়ে করিনি, ও বলল। তারপর চোখ বন্ধ করে খুব মৃদু কণ্ঠে বলল, আমার একটা ছোট্ট মেয়ে আছে। এক বছরও বয়স হয়নি।
সাথে সাথে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি ওর মায়ের সাথে থাক?
না।
কিন্তু পরস্পরকে চেন?
এক সময় সম্পর্ক ছিল। অনেক বছর ধরে কখনো কখনো আমরা কাছাকাছি এসেছি।
কিন্তু এখন আর না।
এখন কথা হলেই ঝগড়া শুরু হয়ে যায়। কিন্তু। ও চারপাশে একবার তাকিয়ে নিল। ওর ভাইদের মধ্যে কেউ যদি আমাকে এখানে দেখে ফেলে, তাহলে আমাকে আচ্ছা ধোলাই দেবে।
ও আরো বলল, মেয়েটা আমার একমাত্র বাচ্চা না। আমি যখন কলেজে পড়ি, আমার এক বান্ধবী ছিল। ও অন্তঃসত্ত্বা হয়। আমার আরেকটা মেয়ে আছে, ও এখন কিশোরী, বিদেশে বড় হয়েছে।
আমি স্তব্ধ হয়ে আস্তে আস্তে বললাম, তুমি তো বয়সে আমার বড়। অতীত ইতিহাস অবশ্যম্ভাবী। আমার নিজেরও অতীত আছে, আমি বললাম। মনে মনে ভাবলাম, আমার অতীত ইতিহাস সঙ্গী, সন্তান আর দায়িত্বে পূর্ণ নয়, সেখানে বিদেশ শব্দটা নেই, তাই সেটা আরো অনেক হাল্কা লাগে। আমার অতীত যেন শুধু মনের ভেতর একটা অনুভূতির আলোড়ন, যার কোন নাম নেই। নিজেকে ক্ষুদ্র ভেবে কষ্ট হলো।
আমাদের কাছে একটা ঘাস কাটার গাড়ি ঘরঘর শব্দ করে বাতাসে কাটা ঘাসের টুকরো ছড়াচ্ছিল। বার্চ গাছগুলো আলতো করে কেঁপে কেঁপে উঠছিল, আকাশটা পরিষ্কার। ও আমাকে চেপে ধরে জিজ্ঞেস করল, কী, পালাতে চাও? আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাও?
কিন্তু আমিতো পালাতে চাই না। কারণ ব্যাপারটা আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। মনে হল আমার হৃদয়ে ঔদার্য পল্লবিত হয়েছে, সেখানে গ্রহণ করার, মমতার, সুশীলতার পাপড়িগুলো একে একে খোলার জন্য আঁকুপাকু করছে। আমরা পাম গাছের ঘর পার হলাম। ঘরটা গুমোট, এতটুকু বাইরের বাতাস সেখানে ঢোকে না, নিরাপদ। একটা কাঁচের বদ্ধ খাঁচাতে যেন সুক্ষ্ম এক কারুকার্যময় জটিলতা দেখলাম। তাছাড়া ভাবলাম, এইসব তো আমার ঝামেলা নয়, তাই না?
বললাম, আমাকে ভেবে দেখতে হবে। আমাকে সাইকেল পর্যন্ত এগিয়ে দিতে চাও?
এতে স্বস্তি পেয়ে ও হেসে উঠল। মাথা নাড়তে নাড়তে আমার দিকে তাকিয়ে বারবার বলতে লাগল, সাইকেল পর্যন্ত এগিয়ে দেব। তারপর বলল, আরেকটু থাকবে না?
ওকে বললাম, যেতে হবে। এমনিতে দেরি হয়ে গেছে। আমি সাইকেলে চেপে শহরে চললাম। সন্ধ্যা নেমে আসছে। বসন্ত আসছে। এবার বসন্তটা খুব সুন্দর হবে।
মূল গল্প: This Happy by Niamh Campbell
------------
লেখক পরিচিতি: নিয়াম ক্যাম্বেল আইরিশ লেখক। লন্ডনের কিংস কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে পি.এইচ.ডি. ডিগ্রী লাভ করেন এবং মেনুথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইরিশ গবেষণা কাউন্সিলের পোস্টডক্টোরাল ফেলো হিসাবে কাজ করেন।ডাবলিন রিভিউ, থ্রি এ.এম ম্যাগাজিনে তিনি নিয়মিত ছোটগল্প, প্রবন্ধ লিখে থাকেন। 'দ্য ড্রেডফুল(The Penny Dreadful)', 'বানশিই(Banshee)', 'গর্স(gorse)', 'দ্য কালেকশন এটনমি' ইত্যাদি তাঁর উল্লেখ রচনা।
অনুবাদক পরিচিতি:
স্বপন আশফাক।
অনুবাদক। প্রবন্ধকার।
যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন।
0 মন্তব্যসমূহ