সাগুফতা শারমীন তানিয়া'র পাঠপ্রতিক্রিয়া : পাঞ্চজন্য নিয়ে কথা:

গজেন্দ্র মিত্রের ট্রিলজি না পড়ে ঠিক বাঙালীর কৈশোর শেষ করা যায় না। একে একে ‘কলকাতার কাছেই’, ‘উপকন্ঠে’ আর ‘পৌষ ফাগুনের পালা’ পড়েছিলাম, এবং ভেবেছিলাম এই ভয়ানক শক্তিধর লেখককে কেন আরো পড়িনি। আমার বড় প্রিয় লেখক তিনি। গজেন্দ্র মিত্রের 'পাঞ্চজন্য' পড়ছি আরেকবার। এ মহাভারতেরই কাহিনী, কিন্তু গজেন্দ্র মিত্রের চোখ দিয়ে দেখা।

মহাভারতের ভূমিকায় রাজশেখর বসু লিখেছিলেন, জীবন্ত মানুষের চরিত্রে যত জটিলতা আর অসঙ্গতি ততটা গল্পের চরিত্রের বেলায় দেখালে চলে না, রসভঙ্গ হয়। কল্পনার মানবচরিত্র অত বৈপরীত্য এবং ব্যঞ্জনাকে ধারণ করতে পারে না। মহাভারতের চরিত্রগুলোয় তবু খানিকটা বৈচিত্র রয়েছে, কারণ মূল আখ্যান একজনের হলেও পরে বহু লেখক এতে যোগ দিয়েছেন। গজেন্দ্র মিত্রের ‘পাঞ্চজন্য’তে মহাভারতীয় চরিত্ররা মহাভারতের চেয়েও বিচিত্র, আধুনিক মানুষ আর তার যাপিত জীবনের সাথে অনেক কিছুই মিলে মিলে যায়। 

এই ধরুন— খান্ডবপ্রস্থে ক্রমাগত বন কেটে পাহাড় কেটে নগরী নির্মাণ, দানবের চৈত্য এবং মন্দির ভেঙে মানবের প্রাসাদ নির্মাণ, সমুদের সমান পরিখা খনন, ময়দানবকে ধরবার জন্য বিশাল খান্ডব অরণ্য জ্বালিয়ে দিয়ে চারটে পাখির ছানা বাদে সব প্রাণী হত্যা...নিষাদের পরিবার নাশ...বনে আগুন দিয়ে একটিমাত্র নিষ্ক্রমণপথ রেখে সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন কৃষ্ণ আর অর্জুন, পলায়নপর সমস্ত প্রাণীকে নির্বিচারে হত্যা করছেন... মনে হচ্ছে যেন দ্বাপর যুগ থেকে এইই চলছে। আমাদের চোখের সামনেই। বন পুড়ে যাচ্ছে অবিরাম পনের দিন ধরে (যেভাবে পুড়েছিল নালন্দায় রত্নদধির মতো লাইব্রেরি)...যুগশ্রেষ্ঠরা পাহারায় আছেন বনে আত্মগোপন করে থাকা দানবস্থপতিকে ধরবেন, স্থপতি দেবনিন্দ্য প্রাসাদ গড়বেন, সে প্রাসাদ দেখে হিংসায় বুক ফাটবে শত্রুর, মাৎসর্য-বিলাসে প্রাসাদাধিকারী রাজাদের নাম আরো তীক্ষ্ণ উজ্জ্বল হবে। বড় বড় কীর্তির ভেতর এইভাবে মৃতাদপি সুপ্ত থাকে আরো গল্প, মৃতের চেয়েও গভীর নিদ্রায় ঘুমিয়ে থাকে সেইসব হত্যার গল্প, ছেদনের গল্প, দাহনের গল্প, বিনষ্টির গল্প। 


১. পাঞ্চজন্য উপন্যাসে কৃষ্ণ 

‘পাঞ্চজন্য’ উপন্যাসে কেন্দ্রে আছেন বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ, বইয়ের নামেই পরিচয়। আর আছেন অত্যুজ্জ্বলা দ্রৌপদী, যাঁকে রাজসূয়যজ্ঞে দেখেই কর্ণ অনুভব করেছেন পান্ডবরা বাহু আর দ্রৌপদী মস্তিষ্ক। বাসুদেব দ্রৌপদীকে স্বয়ম্বর সভায় একঝলক দেখেই বুঝে ফেলেছেন ইহলোকে এইই হতে পারতো তাঁর সুযোগ্যা সঙ্গিনী, সচিব-সহচরী-প্রিয়শিষ্যা, সিংহের পার্শ্বচরী আসল সিংহী। কিন্তু এ লোভ এ কাম সম্বরণ করতে হয় তাঁকে, এই অযোনিসম্ভূতা নারী কুরুবংশের মৃত্যু নিয়ে এসেছে, বিশেষ উদ্দেশ্যে জন্মেছেন তিনি। যেন সেই প্রথম দেখার অমোঘ আকর্ষণকে রদ করতেই কৃষ্ণ অর্জুনকে বাধ্য করলেন অস্ত্রশালায় ঢুকতে, দ্রৌপদীকে একটিমাত্র বছর কাছে পেয়েছিলেন অর্জুন—আরেকবার পালা আসবার আগেই প্রদীপ্ত বাসনা বুকে করে অর্জুনকে যেন চলে যেতে বাধ্য করলেন কৃষ্ণই। দু’গালে চুমু খেয়ে কৃষ্ণ অর্জুনকে পাঠিয়ে দিলেন ব্রহ্মচর্যব্রতে, যে ব্রহ্মচর্য শুধুই দ্রৌপদীর জন্য প্রযোজ্য, শুধুই কি দেশদর্শন না হলে রাজার মন তৈরি হবে না এমন সদিচ্ছায়? দ্রৌপদীর পক্ষপাতিত্ব অর্জুন পাচ্ছেন সেই ঈর্ষায় নয়? যেভাবে ভীষ্ম একদা কুন্তীর স্বামীকে ভাগ করে দিয়েছিলেন মাদ্রীকে এনে, তেমন করে কৃষ্ণ অর্জুনের কাছে হাতে করে এনে দিলেন নিজের বোন সুভদ্রাকে। কি না দ্রৌপদী মেঘে মেঘে চলিষ্ণু বজ্রশিখা, আর সুভদ্রা বৃষ্টিসজল দীঘি। অর্জুনের জন্য দ্রৌপদীর যুগান্তের প্রতীক্ষাকে আরো দীর্ঘ করে দিলেন কৃষ্ণ, অর্জুনকে দিলেন নারীর অন্য স্বাদ, যে অর্জুন দ্রৌপদীকে পেয়েছেন চিত্রাঙ্গদাকে পেয়েছেন—নারীর ব্যক্তিত্বের জোর মনীষা-কর্তৃত্ব-বন্ধুত্বের জোর আর সহযোদ্ধার মর্মিতা পেয়েছেন...তাঁকে যেন থালায় করে কৃষ্ণ পরিবেশন করলেন সেদ্ধ শাকের মতো নেতানো সুভদ্রা। ভীষ্ম যেমন কুন্তীর প্রতি স্বামী পান্ডুর প্রেমকে বিভাজ্য করে দিয়েছিলেন, কপট কৃষ্ণও যেন তেমনি করে দ্রৌপদীর অর্জুনকে ভাগ করে দিলেন। সয়ম্বরসভায় দেখা-অব্দি বারবার কৃষ্ণের হাতেই অর্জুন আর দ্রৌপদীর পরস্পরের প্রতি টান বিভাজিত হতে থাকলো। সেটা কী শুধুই দ্রৌপদীর প্রতি বাসনার অন্তর্গত রক্তের খেলা? আপন পরিচয় দিয়ে কৃষ্ণ অর্জুনকে জড়িয়ে ধরে ডাকছেন—হে পার্থ, হে জীষ্ণু, আমার বন্ধু হও। আমি হই ভ্রাতা, আমি হই মিতা আমি জন্মজন্মান্তরের আত্মীয়...সুরটায় এত একাগ্রতা এত আকুতি যে তা বিগতস্পৃহ কৃষ্ণের সাথে ঠিক যায় না! 

অনেককাল আগে বোধহয় অমর চিত্রকথায় অর্জুনের জীবন পড়েছিলাম... ভারী সুন্দর সেই শিল্পীর আঁকা ছবি। কুন্তী সুভদ্রার মস্তক আঘ্রাণ করছেন (সম্ভবতঃ তখনই শিখেছিলাম এই আদরের মানে), দ্রৌপদীর কক্ষে ঢুকবামাত্র অর্জুনকে ঈর্ষাকাতর দ্রৌপদী ফিরিয়ে দিচ্ছেন আর বলছেন সুভদ্রার কাছে ফিরে যেতে, বলছেন—প্রথম গ্রন্থি যতটাই সজোরে বাঁধা হোক না কেন, দ্বিতীয় গ্রন্থি পড়বামাত্র প্রথমটা আলগা হয়ে যায়। আমার সেই কথাটি এখনো মনে আছে, মনে আছে রুষ্ট দ্রৌপদীর সেই মুখ। 
কৃষ্ণের পরামর্শে সাধারণ গোপকন্যার বেশে এসে সুভদ্রা দ্রৌপদীকে প্রণাম করলেন, দ্রৌপদী নরম হয়ে গেলেন। সেই সুভদ্রাকে হাতে ধরে জ্যেষ্ঠা দ্রৌপদীর হাতে অর্পণ করে দিচ্ছেন কৃষ্ণ, গজেন্দ্র মিত্র তার ভারী অদ্ভূত এক ছবি এঁকেছেন—যে কৃষ্ণ রাজা, যে কৃষ্ণ অবতার, যে কৃষ্ণ একবার স্পর্শ করলে মদ্যপ নিষাদ কীলক পরিবারহত্যার প্রতিশোধলালসা ভুলে যেয়ে আত্মহারা হয়ে ওঠে সেই কৃষ্ণ বোনকে সতীনের হাতে সমর্পণ করবার সময় দ্রৌপদীর হাত ছুঁয়েছেন, সে হাত যুবতীর, উষ্ণ অথচ ঘামে ভেজা, ফুলের মতো কোমল অথচ বজ্রের মতো বিদ্যুৎবাহী।

“কী একটা পুলকবেদনাতুর শিহরণ অনুভব করেছিলেন বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ—‘দুঃখেষ্বনুদ্বিগ্নমনা সুখেষু বিগতস্পৃহ’ যিনি, যিনি সকল বাসনা-কামনাকে কালীয় নাগের মতো মথিত মর্দিত করে ইন্দ্রিয়জিৎ হয়েছেন—ক্ষণকালের জন্য বোধ করি নিমেষকালের বেশি নয়—একটা বিহ্বলতা, অননুভূতপূর্ব চিত্ত-চাঞ্চল্য অনুভব করেছিলেন—সামান্য তরুণ যুবার মতোই।” যে লোকায়ত দেহ ধারণ করেছেন কৃষ্ণ, সে দেহটিকে লোকোত্তরের অভিনবত্বে নিয়ে গেল দ্রৌপদীর পরিমাপহীন সামান্য সময়ের সেই স্পর্শ। 

দ্রৌপদী, যাঁর অপর নাম কৃষ্ণা, তিনি কৃষ্ণের শরীরে চারিয়ে যাওয়া এই পুলক-আবেশ কি টের পেয়েছিলেন? দ্রৌপদীর মুখে তখন কর্তব্যের হাসি, কিন্তু চোখ নিশ্চল বিহ্বল চেয়ে আছে কৃষ্ণের দিকে। সেই আপাত-ভাবপ্রকাশহীন চোখে কত না ভাবের খেলা! এই কৃষ্ণ দেখেছেন কুন্তীর ‘ভাগ করে খেও’ শুনেও দ্রৌপদী বিপন্না নন, হাস্যোন্মুখ বাসনাকাতর পান্ডবদের মুখের দিকে চেয়ে বরং তাঁর মুখে ফুটে উঠেছে কৌতূহল আর ইপ্সার হাসি। এই কৃষ্ণ দেখলেন তাঁর স্পর্শদষ্ট দ্রৌপদী অতি সাধারণ মানুষের (নিষাদ কীলক যেমন) মতো আত্মহারা হয়ে গেলেন না, তিনি অতিকুশল বিষবৈদ্যের হাতে পালটা ছোবল দেয়া কালসর্পিনী, কৃষ্ণকে স্বয়ং আবিষ্ট করলেন। এই যে একে অপরের কাছে ধরা পড়লেন, এটা মহাকাব্যে অনুক্ত রইলো, কিন্তু দেহকে জয় করা অবতার যে নরদেহধারণের নানান নশ্বরতা আর পরাজয়ে মূহ্যমান হলেন! চলে এলেন নিজের রাজগৃহে। কৃষ্ণপ্রিয়া রুক্সিনী সেই সংকোচকালে কৃষ্ণকে সান্ত্বনা দিলেন, নরদেহ ধারণ করে দেবতা মর্ত্যচারী হলে মর্ত্যের মানুষের অনেক খামতিও বরণ করে নিতে হয়। রুক্সিনী কী করে জানলেন কৃষ্ণের মনের কথা? কী করে জানলেন কৃষ্ণের এই মানবিক বিচ্যুতির কথা? রুক্সিনী যে ভালবেসেছেন, যে অগাধ ভালবাসা মানুষকে অন্তর্যামী হবার সিদ্ধি দেয় সেই রকম ভালবাসা। 

এঁদের সবাইকেই বিশেষতঃ কৃষ্ণকে বড় মাটিতে নামিয়ে এনেছেন গজেন্দ্র মিত্র, কঠিন কাজ। তা মহাভারত অত কী আর রাজারাজড়াদের দেবদেবীদের আখ্যান, জ্ঞাতি ভাইদের (কৌরব আর পান্ডব) ভেতর সম্পত্তির কলহই তো, অন্ধ প্রশ্রয়দাতা বাপ (ধৃতরাষ্ট্র) আর একদেশদর্শী শিক্ষক (দ্রোণাচার্য) যে কত ভয়ানক সেই কাহিনীই তো। গজেন্দ্র মিত্রের কৃষ্ণ তাই হর্তুকি খান, সেটা গুছিয়ে দেন সত্যভামা। রুক্সিনীকে প্রেমভরে দ্বাপর যুগের অবতার কৃষ্ণ বলে বসেন—তিনি রুক্সিনীর যোগ্য নন। ঠাট্টায় যোগ দেন, কৌতুক করেন, মান ভাঙান। কিন্তু তিনি যে ঈশ্বর সেই ইন্ধনটুকু রেখে দিয়েছেন ঔপন্যাসিক, এই যখন— কর্ণ কৃষ্ণের মানবমানস বোঝার প্রায়-ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতায় ভয় পেয়ে যান, সভাস্থলে কৃষ্ণ বসে থাকেন দুর্জ্ঞেয় হাসি মুখে ঝুলিয়ে অথচ শিশুপাল বধের সময় তাঁর ভীষণ ভ্রুকুটির দিকে তাকিয়ে সভায় উপস্থিত কত লোকে মূর্ছা যান, স্ত্রী সত্যভামা বারবার দেখতে পান কৃষ্ণের কাজের পন্থা দুর্বোধ্য—সেই কাজের পেছনের দর্শন আপাত-অর্থহীন—তাঁর ইচ্ছেয় বাধা দেয়ার সব চেষ্টা নিষ্ফল। কৃষ্ণ একবার মনস্থির করলে সেটা হাজার মাথা কুটলেও বদলানো যায় না। মিত্ররূপে যত মানুষের কাছে শ্রীকৃষ্ণ যান, তাঁদের প্রত্যেকের মনে দোলাচল রয়ে যায়, আসলেই কি তিনি মিত্র, আসলেই কি তিনি সর্বশুভাকাঙ্ক্ষী? কুরুসভায় দ্রৌপদী এমন ভয়ানক অপমানিত হবেন তা এই কৃষ্ণ জানেন, তবু তিনি অনুপস্থিত থাকেন, শাল্বরাজাকে মারতে কি আর এতটা সময় লাগবার কথা জগতজয়ী কৃষ্ণের? তবে তিনি এই অজ্ঞাতবাসে কেন ছিলেন? দ্রৌপদী অভিমানভরে যখন জিজ্ঞেস করেন, এমন রথের চাকার মতো করে তাঁর মর্যাদা গুঁড়িয়ে যাবে জেনেও কেন কৃষ্ণ এই যাত্রা ব্যাহত করেননি, তখন কৃষ্ণ বলেন—দ্রৌপদীর মান কেন, প্রাণ নিতে হলেও তিনি এই যাত্রাকে বিঘ্নিত করতেন না। ভবিতব্যকে তিনি হতে দেন। এভাবেই তিনি ঈশ্বর। 

উপন্যাসের শেষদিকে কৃষ্ণ আবার একান্তই মানুষ, ধর্মপত্নী পেলেন অথচ সহধর্মিনী পেলেন না এমনি সব চিন্তা করছেন, হৃদয়ের অন্তিম যবনিকা তুলে দেখছেন সেখানে কতই না মানুষী দুর্বলতা। যে কৃষ্ণের শঙ্খের নামে এই উপন্যাস, সেই শঙ্খ যে যুগের আগমনী নাদ করেছিল, যে যুগের আকাঙ্ক্ষায় কৃষ্ণ পরশুরাম বা ভীষ্মের মতোই নির্মমভাবে পৃথিবীকে নিঃক্ষত্রিয় করতে চেয়েছিলেন, রাজা নয় জনসাধারণের হাতে ক্ষমতার স্থানান্তর চেয়েছিলেন, সেই কৃষ্ণ জ্ঞাতি-রক্তপাতের পর অবসন্ন হয়ে কী ভাবছিলেন জীবনের শেষ মুহূর্তে? 


২. পাঞ্চজন্য উপন্যাসে দ্রৌপদী 

দ্রৌপদীর প্রসঙ্গ এলে আমার সবচেয়ে প্রিয় হয়ে ওঠে একটি মুহূর্ত, সেটি গজেন্দ্র মিত্রও এড়িয়ে যাননি, এড়ানো সম্ভব নয়। যুধিষ্ঠির জুয়ায় সর্বস্ব হেরেছেন, সবশেষে হেরেছেন দ্রৌপদীকে পণ রেখে, গোঁফ মুচড়ে দুর্যোধন বিদুরকে বলছেন দাসী দ্রৌপদীকে নিয়ে আসতে। বিদূর অস্বীকার করবার পরে প্রতিহারীকে দ্রৌপদীর কাছে পাঠিয়েছেন দুর্যোধন, প্রতিহারীকে ক্ষুব্ধ দ্রৌপদী জিজ্ঞেস করছেন, সভায় গিয়ে জিজ্ঞেস করে এসো যুধিষ্ঠির কি আগে নিজেকে পণ রেখে পরাজিত হয়েছেন নাকি তার আগে আমাকে পণ রেখেছিলেন? নিজে পরাজিত হওয়ার পরও কি আমাকে তাঁর পণ রাখবার অধিকার ছিল?” এর নাম স্থিরবুদ্ধি। এর এক সহস্রাংশ থাকলে যুধিষ্ঠির কুরুসভা অব্দি আসতেন না, হারতেন না (এখানে বলে রাখি, যুধিষ্ঠিরকে আমার মহাভারতে এবং ‘পাঞ্চজন্য’এ একবারই ভাললাগে, তিনি ধর্মপুত্র সত্যে-সমর্পিত নিরপরাধ-প্রাণ...তাই তাঁর ক্রুদ্ধ-ব্যথিত চোখ লেগে কৌরবদের যদি অনিষ্ট হয় যদি অভিশাপ লাগে, সেজন্য তিনি চোখ ঢেকে চলে যাচ্ছেন বনবাসে।)। একদিন সম্ভবতঃ তসলিমা লিখেছিলেন কোলকাতার পথঘাট খালি হয়ে গেছিল ‘মহাভারত’ সিরিয়ালে দ্রৌপদীরূপিনী রুপা গাঙ্গুলির বস্ত্রহরণদৃশ্য দেখবে বলে। বোধকরি দ্বাপরযুগের দ্রৌপদী যাঁদের দেখেছিলেন কুরুসভায়, যাঁদের মনে করিয়ে দিয়েছিলেন নিজ মা-বোন-কন্যার লাঞ্ছনা হলে তা ছবির মতো নিশ্চল হয়ে তাকিয়ে দেখতে কেমন লাগবে, তাঁদের সবাই কুরুক্ষেত্রে মারা যাননি। শুধু তাই নয়, তাঁরা দেশে দেশে বেঁচে বর্তে আছেন। সে দুঃখের কথা আর কোথাও। বরং ভীমের কথা বলি। ভীষ্ম, বিকর্ণ কিংবা ধৃতরাষ্ট্র যখন ধর্মাধর্ম বিচার করছেন— দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ কেউ দমিয়ে রাখতে পারছে না...সেই কুরুসভায় তিনিই একমাত্র পান্ডব যিনি খুব সরল ভাবে ধর্মের প্রশ্নই তুলেছিলেন, জিজ্ঞেস করেছিলেন, “অপমানিতা ভার্যার লাঞ্ছনার প্রতিশোধ না নিয়ে পুত্রদের কাছে মুখ দেখাব কী করে?” দ্রৌপদীও বনবাসকালে শ্রীকৃষ্ণকে সেই একই ধর্মের কথা শুনিয়েছেন, তাঁর ভাষ্যে সেটাই ‘সনাতন ধর্ম’, যে ধর্মে স্বামী দুর্বল হলে স্ত্রীকে রক্ষার জন্য প্রাণ পর্যন্ত দেয়, সেই ধর্ম যার নেই সে কীসের ধর্মরাজ! 

শাঁওলি মিত্রের ‘নাথবতী অনাথবৎ’ এর আগেই সম্ভবতঃ ‘পাঞ্চজন্য’ লেখা হয়েছে, যদ্দূর জানি নাথবতী আটের দশকে প্রথম মঞ্চায়িত নাটক। জীবনের শেষ বন্ধুর পথটি অতিক্রম করতে গিয়ে কী করে দ্রৌপদী টের পেলেন এই সাংঘাতিক পুরুষতান্ত্রিক ভূ-ভারতে তাঁর সহায় তাঁর প্রকৃত প্রেম আসলে অর্জুন ছিলেন না, কখনোই না, পাশে ছিলেন ভীম। সেই ইন্ধন শাঁওলি মিত্র গজেন্দ্র মিত্রর ‘পাঞ্চজন্য’ থেকে পেয়েছিলেন কি না জানি না, এ উপন্যাসে সেই ইঙ্গিত খুব স্পষ্ট। ভীম খুব চড়া রঙের চাপড়ে আঁকা বীর, সর্বত্রই, কিন্তু সেই চড়াদাগে একটা চড়া দামে কেনা সত্য অন্তর্নিহিত। বাক্যজাল বিছিয়ে কুরুসভার যে প্রবীণরা আসলে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেন, ধর্মের দোহাই পেড়ে নারীর প্রতি যত অন্যায়কে মানতে বাধ্য করা হয়, তার সবগুলোর বিপরীতে ভীমই উচ্চকিত। নির্লজ্জভাবে প্রিয়নারীর তিনি বশংবদ, অন্যান্য পান্ডবের মতো দ্রৌপদীকে বুকে পাবার অকল্পনীয় গৌরবে- ভাগ্যের হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে সসংকোচ নয়, তিনি সহজে পেয়েছেন, সহজে মেনেছে্ন, সহজে নিয়েছেন। 

দ্রৌপদীকে নিয়ে গান বেঁধেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম, ‘পুত্র তার হলো হত যদুপতি যার সহায়’, একটি সন্তানও বাঁচেনি দ্রৌপদীর। উপন্যাসে রাতের অন্ধকারে এদের হত্যা করে গেছে অশ্বত্থামা (ব্রাহ্মণ হয়ে ক্ষত্রিয়ের মতো যুদ্ধ করেছে সে, তারপর নিষাদের মতো হত্যা করেছে), দ্রৌপদী তদ্দিনে জেনে গেছেন তাঁর সখা কৃষ্ণ মমতালেশহীন, তিনি বিলাপ করতে করতে বলছেন, ভীম ভিন্ন তাঁর স্বামীদের মধ্যে প্রকৃত পুরুষ কেউ নেই, একজন পাষাণের মতো জড়, একজন কৃষ্ণের হাতের খেলনা, আর বাকি দু’জন চিরবালক, শুধু ভীমই চিরদিন তাঁর মানরক্ষাকারী স্বামী। 

অবশ্য ‘পাঞ্চজন্য’এর শেষদিকে দ্রৌপদী যেন মনে বুঝেছিলেন, রক্তমাংসের স্বামী চেয়েছিলেন তিনি, শুধু কীর্তিমান নয়—এমন মানুষ যে কৃষ্ণা দ্রৌপদীর প্রেমে অধীর, প্রভাতের প্রণাম শুধু নয় রাত্রির চুম্বনের আরাধ্য যে, তেমন। সে যে কে, তা জানতে এ উপন্যাস পড়া চাই বৈকি। 


৩. পাঞ্চজন্য উপন্যাসে কর্ণ 

এ উপন্যাসে আর রইলেন কর্ণ, কৃষ্ণের মতোই এ উপন্যাসে কর্ণ বিচিত্র রঙে আঁকা। রাজসূয় যজ্ঞের জন্য আসা ভীমের প্রতি কর্ণের প্রায় পাশবিক স্নেহ, কৃষ্ণের মুখে নিজের জন্ম-ইতিহাস শুনবার পরেও চিরদিন যাঁরা প্রত্যাখ্যান করেছে তাঁদের ফিরিয়ে দেয়ার আত্মাভিমান, কর্ণের বীরত্বের ঠিক সমান্তরালেই বইছে কুরুসভায় কর্ণের সর্বোচ্চ ইতরতা...পরবর্তীকে কর্ণ স্বীকার করছেন সেই ইতর প্ররোচনা আসলে ‘স্ত্রীর অশ্রুতপূর্ব লাঞ্ছনায় পান্ডবদের নির্লজ্জ উদাসীনতা’ দেখেই তাঁর মনে উৎপন্ন হয়েছিল। কর্ণ যেন দ্রৌপদীকে প্রমাণ করে দিতে চাইছিলেন—বংশগর্বে মত্তা দ্রৌপদী মানুষ দেখতে শেখেননি, কাপুরুষ আর বীরপুরুষের প্রভেদ জানেননি। এ উপপাদ্য কর্ণের কাছে এত জরুরী হয়ে উঠলো, যে তিনি ভুলে গেলেন একটিমাত্র রক্তাক্ত কাপড়ে রজস্বলা দ্রৌপদীর প্রকাশ্যসভায় অসম্মানের প্রসঙ্গ, মানুষ কিংবা মনুষ্যত্ব তাঁরও তো গন্তব্য থাকলো না। ‘পাঞ্চজন্য’এ কর্ণ এবং দ্রৌপদীর সম্বন্ধ এবং বৈরীতার আড়ালে নিরুচ্চার প্রেম আমাকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই বিষয়ে লেখা একটি দীর্ঘ কবিতার কথা মনে করিয়ে দেয়, নব্বই দশকে ‘দেশ’এ ছাপা হয়েছিল। দেখা যাচ্ছে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং গজেন্দ্র মিত্র কর্ণ-দ্রৌপদীর এই টানাপোড়েনকে একই ভাবে এঁকেছেন। 

কর্ণের চরিত্রের মূলসুর অভিমান, সেটা কখনো বিকৃতিও লাভ করেছে, কিন্তু সুর বদলায়নি। যে মাতা কুন্তীর স্তন্যে তাঁর আজন্ম অধিকার, তিনি সন্তানজন্মমাত্র ভাসিয়ে দিলেন, মৃত্যুকামনায়ই তো! যে পিতামহের আদরে তাঁর অধিকার, সেই পিতামহ ভীষ্ম তাঁকে রথী বলেই স্বীকার করেননি, চিরদিন নানান ব্যঙ্গবিদ্রুপ করেছেন, কটুকাটব্য করতেও দ্বিধা করেননি। যে গুরুর নিদ্রার ব্যাঘাত না হয় সেজন্য কর্ণ বজ্রকীটের দংশন সইলেন, সেই পরশুরাম দিলেন অভিশাপ। যে নারী ন্যায় প্রতিযোগিতায় জিতবার পর একান্তই তাঁর হতে পারতো, সেই দ্রৌপদী তাঁকে প্রতিযোগী হিসেবেও সুযোগ দিতে চাননি...এত অন্যায্যকে পার হতে গেলে অভিমানের পাহাড় গড়ে ওঠে বৈকি। বরং দুর্যোধন তাঁকে রাজা করেছেন, নীচুবংশের মানুষদের সাথেই কর্ণের বিয়ে এবং আত্মীয়তা হয়েছে, তাতেও দুর্যোধন তাঁকে কখনো অপমান করে কিছু বলেননি। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগে প্ররোচনামোদী কৃষ্ণ কর্ণকে তাঁর জন্মরহস্য বাতলে দিলেন, জানালেন তিনিই আসলে প্রথম পান্ডব (কন্যাদশার সন্তান সেই কন্যার পরিণীত স্বামীর বলেই বিবেচ্য হবে), তিনিই পান্ডুর রাজ্যাধিকারী হতে পারেন, হতে পারেন কুন্তীর স্নেহাধিকারী, পান্ডবদের ভ্রার্তৃস্নেহের অধিকারী, আর দ্রৌপদীর শয্যাধিকারী (প্রতি ষষ্ঠ বছরে)। যে অধিকার তাঁর প্রাপ্য ছিল, সে অধিকার যুদ্ধপূর্ব শলাপরামর্শের শর্ত হিসেবে যেন গছিয়ে দিতে চাইলেন কৃষ্ণ, ভাগ্যের সাথে চিরদিন যুদ্ধ করে পরাস্ত-ভাগ্যাহত-ক্লান্ত কর্ণ তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন। কৃষ্ণের পরে কুন্তী একই সন্দেশ নিয়ে কর্ণর কাছে এসেছিলেন, কর্ণ যে ভাষায় যে অনাগ্রহে আর অসহ অবমাননার সাথে কুন্তীর মাতৃত্বকে তাড়না করেছেন, তার উত্তরে কাতর কুন্তী কেবল প্রশ্ন করতে পেরেছেন, বালকবয়সে কর্ণ কি কোনো অপরাধই করেননি যা জ্ঞানতঃ করা উচিত নয়? কর্ণ তো করেছিলেন, একটি শবরী কিশোরীকে নিজের মতো আরেকটি পিতৃপরিচয়হীন সন্তান দিয়েছিলেন...পান্ডবরাও এমন করেছেন, কিন্তু পান্ডবদের এহেন সন্তানরা পিতার কাছে আসতে পেরেছে, যোগাযোগ ছিল, কর্ণ তার শবরসন্তানের খবর রাখেননি। কর্ণর জীবনের অক্ষ দুই নারী, দ্রৌপদী এবং কুন্তী, দুইয়ের কাছেই সবিশেষ নিগৃহীত হয়েছেন তিনি, কিন্তু এই দুইয়ের কাছে তিনিও অপরাধে অপরাধী, নারীত্বের- নারীজন্মের অবমাননা যে অপরাধ। 

কৃষ্ণকে যেমন করে ‘পাঞ্চজন্য’-এ মানুষের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছেন গজেন্দ্র মিত্র, তেমনি করে কর্ণকেও নামিয়ে এনেছেন মানুষের সমান উচ্চতায়, দেবতার পুত্র তিনি তবু যেন ভাগ্যতাড়িত কোনো নশ্বর মানুষের মতোই তিনি জন্ম-দুর্ভাগা। যে প্রেম পূর্ণতা পায়নি সে প্রেম তাঁকে তাড়িত করেছে আমৃত্যু, যুধিষ্ঠির যখন রাজসূয় যজ্ঞ করে রাজা হলেন তখন সেই যজ্ঞের সর্বত্র দ্রৌপদীর সুব্যবস্থাপনা দেখে কর্ণ ক্ষুব্ধ মনে ভেবেছেন—পান্ডবরা দ্রৌপদীকে পেয়েছে ঠিকই, এরা তাঁর আজ্ঞাবহ ঠিকই, কিন্তু এরা দ্রৌপদীর মূল্য বুঝতে অক্ষম। এমনকি মৃত্যুর আগের রাত্রে যুদ্ধপ্রস্তুতির নির্ঘুম প্রহরেও কর্ণ ভাবছেন দ্রৌপদীর কথা। একটা কথা ভাবতে ভাবতে স্নিগ্ধ কৌতূকে কর্ণর বুক ভরে উঠেছে—দ্রৌপদী এই যে এত পার্থ-পার্থ করেন, কর্ণও তো পার্থ (কুন্তী অর্থাৎ পৃথার পুত্র হিসেবে পার্থ)। একদিন তো দ্রৌপদীও জানবেন কর্ণ পান্ডবদের অগ্রজ, ভাববেন তিনি গলা জড়িয়ে ধরতে পারতেন তাঁর এই স্বামীটির...এমন মনোরম আরাম কল্পনায় কর্ণ জীবনের শেষ দিনের জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রারম্ভে এবং গোটা যুদ্ধের সময়টাতেই গজেন্দ্র মিত্র দেখালেন কর্ণ এই হতভাগ্য জীবন শেষ করে দিতে আগ্রহী, স্বপ্নে দেখেছেন পৃথিবীর ধুলি রক্তপাতের কারণে কাদায় পরিণত হয়েছে আর হাড়ের পাহাড়ে চড়ে যুধিষ্ঠির মনের সুখে ঘিয়ের পায়েস খাচ্ছেন। মহাভারতে কর্ণের মতো এমনি আরো প্রতিভাবান জন্মেছেন, জন্মই যাদের আজন্ম পাপ, ‘নীচকুল’এর গ্লানিকে তাঁরা প্রতিভার জ্যোতিতে জয় করতে চেয়েছিলেন (একলব্য?), মহাভারত তাঁদের জয়যুক্ত করেনি। কর্ণ মানেই শ্রেণীর এক বিষন্ন পরাজয়। 

শ্রেণীর প্রসঙ্গ তুলেছেন গজেন্দ্র মিত্রের অর্জুনও, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের মাঠে দাঁড়িয়ে অর্জুন বলছেন, এইসব বীরযোদ্ধা যদি গতাসু হন, রাজবংশ যদি বিলোপ পায়, তবে যুধিষ্ঠির কাদের রাজা হবেন? শিশুর, নারীর, বৃদ্ধের? এই যোদ্ধাদের অকালবিধবা নারীরা সম্ভোগের তৃষ্ণায় সন্তানের তৃষ্ণায় অনার্য ‘নিকৃষ্ট’ শ্রেণীকে বরণ করবে, বর্ণশঙ্করে ভরে যাবে ভারতবর্ষ! শ্রীকৃষ্ণ ঘটোৎকচকে এগিয়ে দিচ্ছেন কর্ণর একাঘ্নী বাণে মৃত্যুবরণ করবার জন্য, কেননা সে রাক্ষস-জাতের ‘তামসিক বুদ্ধিসম্পন্ন, তামসিক পরিবেশে বাস করতো’, ভীমের প্রথম সন্তান হিসেবে ঘটোৎকচই বোধ করি পান্ডবদের প্রথম পুত্র, সেই পুত্রের মৃত্যুকালে কৃষ্ণ অর্জুনের রথে চড়ে রীতিমতো নাচছেন, কর্ণের অস্ত্র অপব্যয়িত হলো বলে, অর্জুনবধের আর উপায় রইলো না বলে। 


৪. পাঞ্চজন্যকে নিয়ে বাকি কথা 

আচ্ছা, একটা কথা বলতে ভুলে গেছি, এ উপন্যাসে যদিও এই শিশুর প্রসঙ্গ সামান্য। অমর চিত্রকথার অর্জুন হাতে করে চিত্রাঙ্গদা আর তাঁর সন্তান বভ্রুবাহনকে মনিপুররাজের কোলে দিচ্ছেন সেই ছবিটার কথা আমি কখনো ভুলতে পারি না। বভ্রুবাহন শিশু, উত্তমাঙ্গে জামা নেই, সে রাজার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছে, হাসন্ত শিশুর বুক যেমন করে ফুলে থাকে সামান্য, তেমনি ফুলে আছে আঁচড়কাটা ছবির একটিমাত্র দাগে, সে জানে না তার জীবন বদলে গেল এক কোলবদলে...বাপ তাকে আসলে ত্যাগই করলো, মা তাকে সেই বাপের পাশে যুদ্ধ করবার জন্য প্রস্তুত করবে, উৎসর্গীকৃত পশুর জীবন যেন তার। কিন্তু বভ্রুবাহন হাসছে, অসম্ভব ক্ষমতা নিয়ে জন্মানো মানবশিশু যেমন চারদিকে তাকিয়ে ‘আমিই স্বয়ম’ ভেবে হাসে। যে পৃথিবীতে সে এসেছে, গজেন্দ্র মিত্র জানাচ্ছেন—সে পৃথিবীতে যুদ্ধের অমাবস্যা ঘনিয়ে এসেছে, চকোর ধর্মের শিবিরে আর শকুন অধর্মের শিবিরে ছায়া ফেলছে, প্রসন্নচিত্তে কর্তব্যবোধে তাড়িত সৈন্য কাতারে কাতার এসেছে যুদ্ধ করবে বলে, কিন্তু যুদ্ধের নারকীয়তার কল্পনায় ঘোড়া কাঁদছে হাতি গর্জন করছে। কেবল তারাই যেন জানতে পেরেছে এই ‘কীর্তি’ এই ‘যাত্রা’ এসবের মহিমাকে ছাপিয়ে এই প্রাণক্ষয় কত নিরর্থক। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি প্রাণসংহার করেছিলেন কে? বোধ করি ভীষ্ম। এই ভীষ্ম যুদ্ধের আগে এবং যুদ্ধকালে বারবার বলছেন—যে পক্ষে সত্য, যে পক্ষে ধর্ম ও ন্যায়, সে পক্ষ পরাজিত হবে না। কিন্তু ভীষ্মের মতো বীরকে যখন অন্ন-ঋণ শুধতে দুর্যোধনের পক্ষে আমৃত্যু যুদ্ধ করতে হয় (জীবন সম্পর্কে বীতস্পৃহ হয়ে তিনিই পান্ডবদের বলে দিয়েছিলেন কী করে তাঁকে মারতে হয়), উভয়পক্ষে যখন অত লোকক্ষয় হয়, একজনের উন্মাদনায় যখন অন্যের অত প্রাণনাশ হয়, তারপরে সত্য কি সত্য থাকে? ন্যায় কি ন্যায় থাকে? ধর্মের আসন অবিচলিত থাকে? যুদ্ধের পর ধর্মশক্তির জীবনে কি শান্তি নেমে এসেছিল সত্যিই? রামায়ণে কিংবা মহাভারতে? 

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের শেষে যখন কৃষ্ণের ইঙ্গিতে ভীম অন্যায়ভাবে দুর্যোধনকে নাভির নীচে গদার আঘাত করে উরুভঙ্গ করেছেন, তখন এ উপন্যাসে কৃষ্ণভ্রাতা বলরাম বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, কৃষ্ণ তুমি ন্যায়ধর্মের সুবিধেমতো এই যে ব্যাখ্যা করছ, কালে কালে ক্ষত্রিয়দের যুদ্ধশাস্ত্রের এইসব নীতি তো লোপ পাবে, তখন মনুর সন্তান এই মানবগণ যুদ্ধে পিশাচের মতো আচরণ করবে। বলরামের সেই আশংকা আমরা সত্য হতে দেখেছি। অস্ত্রগুরুরা অস্ত্র প্রদান করবার সময় সতর্ক করে দিতেন যে এই অস্ত্র ‘সৃষ্টিবিধ্বংসী বহ্নিমন্ডল’ তৈরি করতে সক্ষম, এর প্রয়োগে শুধু ব্যক্তি নয় একটি বিরাট জনপদও একমুহূর্তে দগ্ধ হতে পারে (ব্রহ্মশির), আমরা হিরোশিমাকে উল্কা-উজ্জ্বল ভয়ানক অস্ত্রে মুহূর্তে পুড়ে যেতে দেখেছি। এই গ্রহ আবার প্রাণী-বিলোপের দিকে এগিয়ে চলেছে, গান্ধারীর মতো করেই হয়তো অদূরভবিষ্যতে মাতা বসুন্ধরা কেঁদে জিজ্ঞেস করবেন, আমার শত শত সন্তানের একজনকেও বাঁচতে দিলে না কেন? 






সাগুফতা শারমীন তানিয়া
কথাসাহিত্যিক

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ