সুমী সিকানদারের পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ ৩২ নম্বর পাশের বাড়ি

''৩২ নম্বর পাশের বাড়ি'' ২৫ অশে মার্চ ১৫ আগষ্ট , লেখক মহিউদ্দিন আহমদ । বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে তাঁর অনেকগুলো বইই পাঠক প্রিয়তা অর্জন করেছে। বাতিঘর প্রকাশিত তাঁর অন্যন্য বই, ইতিহাসের যাত্রী, রাজনীতির অমীমাংসিত গদ্য, বোমাবারুদের চোরাবাজার ,Dream Merchant: Srory of Brac ইত্যাদি। 

২০২০ সালে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারভিত্তিক এই বইটি আমার পড়া একটা অসামান্য চিত্র দৃশ্য সম্বলিত গ্রন্থ। ১৯৭১ এর ২৫শে মার্চ এবং ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট এই দুই রাতে কি ঘটেছিলো এবং কি দেখেছেন বা শুনেছেন আশেপাশের মানুষেরা তাঁর কিছুটা ধারণা এবং ঐহিহাসিক বিবরণ এই বইতে জায়গা করে নিয়েছে।


লেখক মহিউদ্দিন আহমদ পরবর্তী প্রজন্মের অনেক প্রশ্নের বা আগ্রহের জবাব রেখেছেন তার এই বইয়ে। তার মনের মধ্যে জিজ্ঞাসা ছিলো '২৫ শে মার্চের রাতটিকে পাশের বাড়ির প্রতিবেশীরা কিভাবে দেখছেন ?' তিনি ২৫ মার্চের ঘটনা জানার জন্য যথা সম্ভব চেষ্টা করেছেন । এ বছর তাঁর বইতে বিভিন্ন জনের সাথে কথা বলে কথা রেকর্ড করে ইন্টারভিউ নিয়ে বিভিন্ন তথ্য যাচাই সাপেক্ষে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন। আমি যুদ্ধের কিছু দেখিনি কাজেই কারো মুখের কথা কিম্বা লিখিত সরাসরি অভিজ্ঞতার প্রতি সব সময় উদ্গ্রীব। জানার আগ্রহ প্রবল। লেখক কথা বলেছেন সহজ ভাষায়।

ছবি এবং লেখা একত্রে সংযুক্ত করার ফলে বইটি পেয়েছে অনবদ্য মাত্রা। পান্ডুলিপি প্রকাশ করেছে বাতিঘর । এবং প্রচ্ছদ সাব্যসাচি হাজরা ।

ধানমন্ডির ৩২ নাম্বার রোডের বঙ্গবন্ধুর বাড়ির পাশের বাড়িটি ৬৭৬ নাম্বার, বাড়িটি জনাব আহাদ খান চৌধুরীদের। এখানেই বেগম মুজিব তাঁর পরিবারের বাকি সদস্যদের নিয়ে সল্পকালীন আশ্রয় গ্রহন করেছিলেন। এই বিষয়েই ঘটনা গুছিয়ে লেখার প্রচেষ্টাই এই বইয়ের শুরুর কথা ।

কারফিউ চলছে। এর মধ্যে শেখ সাহেবের বাড়ি থেকে যদি কেউ পাশের বাড়িতে আসে , কাউকে না জানিয়ে আসতে চাইলে আসতে হবে সীমানার দেয়াল ডিঙ্গিয়ে । দেয়ালের এপাশে চেয়ার মোড়া সব রাখা হয়েছিলো। রাত তিনটার দিকে বেগম মুজিব , রাসেল ,শেখ কামাল ,শেখ জামাল , মহিউদ্দিন সাহেব যিনি শেখ সাহেবের সিকিউরিটিতে ছিলেন তিনি শ ১১/১২ জন এসেছিলেন। সে রাতে সবাই এই বাসাতেই ছিলেন। পাকিস্থানী সৈন্যরা বুঝেছে শেখ সাহেবের বাসায় কেউ নেই। কিন্তু সে রাতে আর এপাশে ঢুঁ মারেনি। পরের দিন সকালে নাস্তা খাবার সময় সাদা রঙের গাড়ি এসে বেগম মুজিবকেসহ আরো কাউকে কাউকে গাড়িতে নিয়ে চলে গেলো।

বিকেলে একজন মেজর সাহেব এলেন । উনি জিজ্ঞেস করলেন ''আচ্ছা বলুন তো আপনি উনাদের আশ্রয় দিলেন কেন ?''
আমি (আহাদ সাহেব ) বললাম দেখেন , ''আমাদের ধর্ম এ শিক্ষাটি আমাদের দেয় যে তোমার প্রতিবেশীর যদি কোন বিপদ হয় তুমি তাকে সাহায্য কর। আমি ধর্মের কাজ করেছি।'' (পৃষ্ঠা ২৫)

শেখ সাহেব আহাদ সাহেবের বাসায় নিয়মিতই যেতেন এবং দুই পক্ষই প্রতিবেশী হিসেবে সুন্দর সম্পর্ক রেখেছিলেন। শেখ সাহেবের বাসা থেকেও খাবার মাছ এসব আসতো।

২৫ শে মার্চ নিয়ে কথা বলতে বলতে তা ১৫ আগস্টে গিয়ে ঠেকে। ঘটনার ডালপালাকে লেখক গুছিয়ে প্রমাণের ভিত্তিকে পাঠককে জানাবার চেষ্টা লেখক করেছেন যা অত্যন্ত পরিশ্রমের কাজ । আমি এই বইটি পড়ে স্তব্ধ এবং বিস্মিত হয়েছি।

বইয়ের পাতায় পাতায় সেই দু;সহ রাতের স্মৃতিময়তা। যেমন লেখক লিখেছেন, ''রাসেল ছোটবেলায় খুবই হ্যাংলা পাতলা ছিলো। রাতে স্যন্ডো গেঞ্জি আর হাফ প্যান্ট পরে ঘুমাতো। তাকে দেখে প্রেসিডেন্টের ছেলে বলে মনে হতো না। আমরা তাকে খেলার সাথী হিসেবে ট্রিট করতাম।রাতে সে এভাবেই ঘুমাচ্ছিলো। যখন গোলাগুলি শুরু হয় তখন তাঁর ঘুম ভাঙ্গে, সে প্যানিকড হয়ে যায়। ''.

''রাসেল কাঁদছিলো , সে বার বার বলছিলো মায়ের কাছে যাব।ঁ'' মায়ের কাছে যাবে ? আমার সাথে আসো, একথা বলে তাকে নিয়ে যায় তিন তলায়। দোতলায় তখন অলরেডি বেগম মুজিব কে গুলি করা হয়েছে। তিন তলায় তার নতুন দুইটা ভাবী। ভাবীদের পাশে দাঁড় করিয়ে ভাবীদের দিকে ব্রাশফায়ার করেছে কোমর বরাবর। রাসেলের মাথায় গুলি লেগেছে। সে হাইট অনুযায়ী ভাবীদের কোমরের কাছাকছি উচ্চতায় দাঁড়ানো ছিলো। (পৃষ্ঠা ৬৩)।''

ছোট্ট রাসেল মায়ের কাছে যেতে চেয়েছিল । এভাবেই তাকে মায়ের কাছে পৌছে দেয় হানাদার বাহিনীরা। তাঁর মাথার মগজ ছিটকে দেয়ালে আটকে যায়। বহু সময় পর্যন্ত ছাপার এই অক্ষরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এভাবে বিশ্বাস করা দুরূহ।

শেখ নাসের ছিলেন নিচ তলায় । তাঁর পায়ে বোধহয় কোন সমস্যা ছিলো । সিড়ি বেয়ে উঠটে কষ্ট হতো। উনাকে টয়লেটে নিয়ে গুলি করা হয় । তিনি যতক্ষণ জীবিত ছিলেন তেষ্টায় পানি পানি বলে চিৎকার করছিলেন, আর্মিদের একজন আরেকজনকে বলে যা পানি দিয়া আয়। সে গিয়ে পানির পরিবর্তে গুলি করে আসে।

১৫ শে আগষ্টে পাশের বাড়ির লোকেরা যা শুনেছেন এবং দেখেছেন তাদের একটা বিবরণ এখানে তুলে ধরা হয়েছে। কয়েকটি নামও উঠে এসেছে। রমা , আবদুল , মোহিতুল ইসলাম , সেলিম , হাবিলদার কুদ্দুস , নেওয়াজ আহমেদ গর্জন, নুরুল ইসলাম খান।

মোহিতুল ইসলাম//
১৯৭২ সনের ১৩ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে সহকারী হিসেবে চাকরীতে যোগ দে্ন। ১৯৭৫ সালে তিনি রাষ্ট্রপতির পিএ কাম রিসেপটনিস্ট ছিলেন।

উপর থেকে কজের ছেলে আব্দুর রহমান /রমা শেখ রাসেল কে নিয়ে আসে । শেখ রাসেল জড়িয়ে ধরে , ''ভাইয়া আমাকে মারবে না তো?'', শিশু রাসেল কে মারবে না সেই ধারনাতেই আমি বললাম না ভাইয়া তোমাকে মারবে না। ''

কোনও সুস্থব্যক্তি শিশুকে ঠান্ডা মাথায় গুলি করতে পারে না। এরা পশুর অধিক পশু ছিলো। এর পর আর্মি আমার কাছ থেকে শিশু রাসেল কে জো্র করিয়ে ছাড়িয়ে নেয়। তখন রাসেল তাঁর মায়ের কাছে যেতে চাইলে দোতলায় নিয়ে যায় এবং গুলির শব্দ শুনি''।

মেজর হুদা বলে ''অল এর ফিলিশড'' তখন বুঝলাম রাষ্ট্রপতি পরিবারবর্গ ও আত্মীয় স্বজনকে হত্যা করা হয়েছে।

রহমান (রমা)

১৯৬৯ সালে কাজের লোক হিসেবে বংগবন্ধুর বাড়িতে এসেছিলেন। আর্মিদের লক্ষ্য করে বঙ্গবন্ধু বলেন ''তোরা কি চাস ? কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে? ''তারা তখন বঙ্গবন্ধুকে সিড়ির দিকে নিয়ে আসছিল । সিঁড়ির দুইতিন ধাপ নামার পর নিচের দিক থেকে আর্মিরা বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে । গুলি খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু সিঁড়িতে লুটিয়ে পরেন।

সেলিম (আব্দুল )

১৯৬৯ সালে ধানমন্ডির ৩২ নাম্বার রোডে বঙ্গবন্ধুর ৬৭৭ নাম্বার বাসায় কাজ শুরু করেন । ১৯৭২ সাল থেকেমশালচি হিসেবে কাজ করছিলেন ।তার হাতে ও পেটে গুলি লাগে। চার পাচ জন যখন বঙ্গবন্ধুকে তাঁর রুম থেকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিলো তখন আবদুলকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে বঙ্গবন্ধু বলেন , এই ছেলেটা ছোটবেলা থেকে আমাদের বাসায় থাকে। একে কে গুলি করলো?

বঙ্গবন্ধু মৃত্যুর একেবারে সামনে দাঁড়িয়েও বাড়ির কর্মচারির প্রতি উদবেগ প্রকাশ ক্ছিরলেন যা এক মাত্র তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল। তাঁর কিছুক্ষণ পরেই তাকে মেরে ফেলা হয়।

হাবিলদার কুদ্দুস //
কুদ্দুসের বয়ানও সকলের সাথে মিলে যায় । শুধু তাকে আলাদা মোহম্মদপুরের শেরশাহ রোডের কাঠের আড়তে নেয়া হয়। সেখানে মেজর হুদা ১০টা লাশের জন্য ১০টা কাঠের বাক্স বানাতে দিয়ে তাকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি নামিয়ে দিয়ে চলে যায়।শেষ রাতে ১০টা লাশের জন্য
১০টা কাঠের বাক্স নিয়ে আসে। ফজরের আজানের পরে একটি গাড়িতে নয়টি নাশ তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।১৬ আগষ্ট সকাল৯/১০ টার দিকে মেজর হুদা পিকআপে করে বঙ্গবন্ধুর লাশ বিমান বন্দরে নিয়ে যায়। (পৃষ্ঠা ৯৪)

যে কথাটা অত্যন্ত হৃদয় বিদারক , মেজর হুদাকে প্রশ্ন করা হয়েছি্ল ''তোমরা তো তাঁকে (শেখ মুজিব) পেয়েইছিলে , অন্যদের মারতে গেলে কেন ?হুদার জবাব ছিলো ,''শেখ মুজিবকে মেরে ফেলার পর আমরা আর কোন সাক্ষী রাখতে চাইনি।''

ধানমন্ডি ৩২ নাম্বার সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়িটি এখন বঙ্গবন্ধু স্মৃতি যাদুঘর। কিছুদিন আগে পাশের বাড়িটিও কেনা হয়েছে। বাড়ির মালিক আব্দুস সামাদ খান চৌধুরী , শেখ সাহেবের ডাক্তার আজ আর নেই। তাঁর সন্তানেরা আনন্দের সাথেই নিয়মনীতি মেনে বাড়িটি যাদুঘরের কাজে হস্তান্তর করেছেন।

জনাব মহিউদ্দিন আহমদের এই বইটি যদি পুরোটাই লিখে লিখে পাঠকদের জানাতে পারতাম ভাল লাগতো। এই বই দুইহাতে ধরে ্পড়ার বই, উপলব্ধি করার বই। লেখকের আত্মার কাছাকাছি যাবার এবং ২৫শে মার্চ এবং ১৫ই আগষ্টকে খুব কাছথেকে অনুভব করার সোপান। সবারই এই বইটি সংগ্রহে থাকা উচিত। লেখকের প্রতি একনিষ্ঠ শ্রদ্ধা , সম্মান জানাই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. সুমি,পড়লাম। এই স্মৃতিগুলো খুব কাছ থেকে যারা দেখে তাঁদের কেমন লাগে জানিনা। কিন্ত পাঠক হিসেবে আমি ডুবে যাই একাত্তুরে। সুন্দর রিভিউ। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।

    উত্তরমুছুন