এ সময়ের অন্যতম কথাসাহিত্যিক তন্বী হালদার পশ্চিমবঙ্গের বাংলা আকাদেমির 'সোমেন চন্দ স্মৃতি পুরস্কার' পেয়েছেন 'মজুররত্ন' গল্প সংকলনের জন্য। জলাভূমি উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন বাংলা একাডেমির 'সুতপা রায়চৌধুরী স্মারক পুরস্কার'। এ পর্যন্ত লিখেছেন শতাধিক ছোটো গল্প এবং ৮ টি। নাটক লেখেন। লেখেন কবিতাও।
তন্বী হালদারের সাহিত্যপাঠ ও তাঁর লেখালেখি নিয়ে গল্পপাঠের পক্ষ থেকে নিয়েছেন এমদাদ রহমানের লিখিত প্রশ্নের উত্তর পত্রস্থ হলো।

গল্পপাঠ
কোন লেখক আপনাকে প্রভাবিত করেছেন এবং কিভাবে প্রভাবিত করেছেন?
তন্বী হালদার
সত্যি কথা বলতে আমাকে একজন লেখক প্রভাবিত করেছেন এমনটা না। সাহিত্যের আঙিনায় এসে অনেকেই অনেকভাবে প্রভাবিত করেছেন। একজনের নাম বলতে পারবো না। ধরুন রবীন্দ্রনাথ যখন পড়ছি তখন অদ্ভুত মোহমুক্তি কেন্দ্রিকতায় প্রভাবিত হচ্ছি। আবার কম বয়েসে শরৎচন্দ্র পড়তে বসে কেঁদে ভাসিয়েছি। অদ্ভুত মূল্যবোধের দ্বারা তাড়িত হয়েছি। বঙ্কিমও আমাকে প্রভাবিত করেছেন তার কপালকুন্ডলাতে।
এভাবেই প্রেমেন্দ্র মিত্র, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, সাবিত্রী রায়, সুলেখা সান্যাল, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় কতজনের নাম করবো। তারাশঙ্কর, মানিক, বিভূতিভূষণ এনারা কোনও না কোনও ভাবে প্রভাবিত করেছেন। এরপর অমর মিত্র, সাধন চট্টোপাধ্যায়, সোহারাব হোসেন, রামকুমার মুখোপাধ্যায়, তৃপ্তি সান্ত্রা, তপন বন্দ্যোপাধ্যায় এনাদের লেখা শুধু প্রভাবিত না, অনুগত শিক্ষানবীশের মতো শিখেই চলেছি। নিজের সমসাময়িক বন্ধু তৃষ্ণা বসাকের লেখাও আমাকে প্রভাবিত করে। আমি ঔপোন্যাসিক ও গল্পকার বলে এই আঙিনার মানুষজনের কথাই বললাম। কারও দ্বারা ফর্ম, কারও কাছ থেকে বিষয়বস্তু নির্বাচন, কারও কাছে না গল্পের ভেতর গল্প বলার টেকনিক, একটা গানকে যেভাবে আরোহ-অবরোহ দিয়ে ধরে তেহাই দিয়ে ছাড়ে সে সব কিছুই কোনও না কোনও ভাবে প্রভাবিত করেছে বা করেই চলেছে।
গল্পপাঠ
এখন কোন বইগুলো পড়ছেন? খাটের পাশের টেবিলে কোন বইগুলো এনে রেখেছেন পড়ার জন্য?
তন্বী হালদার
আমি একসঙ্গে দু-তিনটে বই পড়ি। নিজে একটা সমকাম, সমপ্রেম নিয়ে নভলেট লেখার জন্য অজয় মজুমদার ও নিলয় বসুর লেখা ‘সমপ্রেম’ নামে একটা বই পড়ছি। এছাড়া আমি প্রতিদিন গীতাঞ্জলি ও গীতা পড়ি। এগুলো আমাকে আমার সকল আসক্তি মুক্ততার পথে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। অফিসে কাজের ফাঁকে মনোরঞ্জন ব্যাপারীর ‘জিজীবিষার গল্প’ পড়ছি। আমি লেখালেখিতে বাইসেক্সুয়াল এবং অবশ্যই বহুগামী। আমার এই বহুগামীতার মধ্যে একটা গমন প্রান্তিক মানুষদের জীবন ও তাদের লড়াই নিয়ে। তাই এই বইটা পড়তে আমার ভালো লাগছে। বাড়িতে রাতে মূলতঃ আমি বসিরহাটের ইতিহাস পড়ে চলেছি অনেক দিন ধরে। এটি আমার ‘যোজনগন্ধা’ উপন্যাস রচনাতে বিশেষ ভাবে কাজে লাগছে।
আমার পড়ার কোনো টেবিল, চেয়ার নেই। খাটে ছড়িয়ে, ছিটিয়ে বসি। অগোছালো ভাবে। তা সেখানে কিছু তো অপেক্ষমাণ আছেই। এ বছর বইমেলা থেকে অনেক বই কিনেছি। মূলতঃ সেগুলো থেকেই একটা একটা করে পড়ছি। এই উত্তর লেখার সময় যে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে তার নাম - ছাদ পেটানোর গান, বৈষ্ণব দর্শন ও বৈষ্ণব সাহিত্য, রাজদ্রোহ। এছাড়া কিউতে আছে অনেক।
গল্পপাঠ
সর্বশেষ কোন শ্রেষ্ঠ বইটি আপনি পড়েছেন?
তন্বী হালদার
মানব চক্রবর্তীর ‘মার্শাল হেমব্রম’।
গল্পপাঠ
আপনার প্রতিদিনকার পাঠের অভিজ্ঞতার কথা বলুন, কখন কোথায় কিভাবে পড়েন?
তন্বী হালদার
প্রতিদিনকার পাঠ বলতে এখন সত্যি নিয়ম করে কিছু হয় না। তা প্রায় বছর দুই ধরে। আমার কিছু ব্যক্তিগত কারণে। কিন্তু একজন লেখক সবার আগে তার পাঠকের কাছে দায়বদ্ধ। কিন্তু আমার এই নির্বীজ সময়টার আগে আমি সত্যি নিয়ম করে পড়তাম। এখনও যখন পড়ি তিনটে করে বই একসাথে পড়ি। সকালে, অফিসে এবং রাতে।
গল্পপাঠ
কোন বইটি আপনার খুব প্রিয় কিন্তু অনেকেই বইটির কথা জানেন না?
তন্বী হালদার
হুমায়ুন আহমেদের ‘কোথাও কেউ নেই’ বইটি আমার খুব প্রিয় কিন্তু মনে হয় অনেকেই জানেন না।
গল্পপাঠ
কোন বইটি জীবনে একবার হলেও প্রত্যেকের পড়া উচিৎ?
তন্বী হালদার
আমার মনে হয় এই প্রশ্নের উত্তর ব্যক্তি বিশেষে আলাদা হবে। আমি যেটা মনে করি তা হল ডস্টয়ভস্কির ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’।
গল্পপাঠ
ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, সমালোচক এবং কবিদের মধ্যে আপনি এমন কাকে বেশি শ্রদ্ধা করেন এবং কেন?
আমি অনেককেই শ্রদ্ধা করি। কিন্তু একজনের নাম করছি উনি সাহিত্যিক অমর মিত্র। ওনার লেখনীর গুণ তো বটেই এছাড়া বয়ঃকনিষ্ঠ ওনার যারা যেমন আমি, আমার মতো অনেকেই তাদের উনি অসম্ভব উৎসাহ দেন। ভালো লিখলে মুক্তকণ্ঠে বলেন। এমন গুণ সত্যি অনেক স্বনামধন্যদের ভেতরেই পাওয়া যায় না।
গল্পপাঠ
লেখক হিসাবে তৈরি হতে কোন বইটি আপনার মনকে শৈল্পিক করে তুলেছে এবং কিভাবে?
তন্বী হালদার
দেখুন আমি মনে করি যে কোনো ভালো বই একজন লেখককে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়। শিশু যেমন ভূমিষ্ঠ হয়েই হাঁটতে, দৌড়োতে, কথা বলতে পারে না। এও তেমনি। তবে এখানে যেহেতু একটি বইয়ের নাম উল্লেখ করতে বলা হয়েছে, তাই বলছি, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুন্ডলা’। কপালকুন্ডলা উপন্যাসের ভেতর অদ্ভুত এক নৈর্ব্যক্তিক নির্লিপ্তী এবং উদাসীনতা আছে। যা আমাকে অসম্ভব টানে। এক ধরনের ফ্যাণ্টাসি আছে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের, সেই ফ্যান্টাসিতে আমি আচ্ছন্ন হই। কোনোকিছু আঁকড়ে ধরার পর নির্মম ভাবে ছেড়ে যাওয়ার স্পর্ধা দেয় আমাকে কপালকুন্ডলা উপন্যাস।
গল্পপাঠ
কোন বিশেষ ভাব কিংবা পরিবেশ কিংবা পরিস্থিতি আপনাকে লিখতে বাধ্য করে?
তন্বী হালদার
বিশেষ ভাব কিনা সঠিক জানি না। তবে একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করছি, দিনটা ছিল একটা বিশেষ দিন। চাঁদ আর পৃথিবী কত বছর পর যেন আবার খুব কাছাকাছি আসবে। খবরটা জানবার পর থেকে ভেতরে ভেতরে অদ্ভুত উত্তেজিত হচ্ছিলাম। মনে হয়েছিল আমি দেখবো সেই মোহময় রাত। কেমন হবে সে রাত রূপোর জলে ধোয়া চরাচরের রূপখানি। আমি তাকে ছোঁব। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সত্যি সত্যি ছাদে যাই। কেঁদে ফেলেছিলাম। এরপর ‘জ্যোৎস্নাপ্রেম’ নামক একটি গল্প লিখি। পাঠকের কাছে গল্পটি বেশ আদরণীয় হয়। আনন্দবাজার রবিবাসরীয়তে গল্পটি প্রকাশ হয়। পরিবেশ, পরিস্থিতি শত অনুকূলে থাকলেও আমার মনে হয় ভবের ঘরে ভাবের উদয় না হলে লেখা আসে না।
গল্পপাঠ
আপনি কিভাবে আপনার বইগুলি গুছিয়ে রাখেন?
তন্বী হালদার
আমি গুছিয়ে রাখলে আর তা খুঁজে পাই না। হা হা। তাই বরাবর এটি আমার স্বামী করেন। বইয়ের আলমারী, বুকশেলফ ও মূলতঃ গুছিয়ে রাখে।
গল্পপাঠ
এই বইগুলো পড়ার পর আপনি কোন বইগুলো পড়বেন বলে ভেবেছেন?
তন্বী হালদার
এই মুহূর্তে বেশ কিছু লেখার চাপ আছে। তাই সেই লেখাগুলোর কাজে লাগবে এমন সব বই পড়তেই হবে। যেমন দেশভাগের উপর কিছু লিখবো ইচ্ছা আছে। তা দেশভাগের অনেক পরে আমার জন্ম, সে নিয়ে ব্যক্তি অনুভূতি কিছু নেই। আর আমার মনে হয় অন্যের মুখে শোনা গল্প-কাহিনী তা সে যত সত্যই হোক সেটা রেখাপাত করে না নিজের মনে। অগত্যা পুঁথির পাতায় মনোনিবেশ করতে হবে। তাই দেশভাগ নিয়ে কিছু পড়ব। আমার ‘যোজনগন্ধা’ উপন্যাসের জন্য সুন্দরবন, স্বাধীনতা সংক্রান্ত কিছু পড়াশোনা করতে হবে। এছাড়া আমি সমপ্রেম, সমকাম নিয়ে একটা নভলেট লিখছি সেখানেও কিছু পড়াশোনা খোঁজ-খবর নিতে হচ্ছে।
গল্পপাঠ
শব্দকে আপনি কিভাবে অনুভব করেন? আপনি কি কখনও শব্দের গন্ধ পেয়েছেন?
তন্বী হালদার
আমি প্রথমেই বলেছিলাম লেখাতে আমি বাইসেক্সুয়াল ও বহুগামী, তাই একটা শব্দ আমার কাছে নানাভাবে ধরা দেয়। কিছু কিছু শব্দকে মনে হয়, ‘তারে ধরি ধরি মনে করি, ধরতে গেলে আর পেলাম না’। বাউল মননে আমি ব্যক্তি জীবনে বিশ্বাসী। বাউল সাধনার আধার না কিন্তু। নিজেই সাধক বলো সাধক, সাধিকা বলো সাধিকা। তাই শব্দ ছাড়া কোনো সম্পর্ক হয় না। পুরুষ নিবেদন পছন্দ করে। সে নিজেকে আধার করতে চায় না সাধন সঙ্গিনীর। মেয়েরা বুঝতে পারে না বা চায় না কিংবা ভয় পায়। তাই শব্দের কাছে ঘুরে ঘুরে ফিরি। ফিরে ফিরে কাঁদি। তাই মনে হয় এই শব্দ সাধনার রস সারাজীবন ধরেই ভিয়েনে জারিত হয়ে চলে। ঠিক যতটা একটা শব্দ কাছে নিয়ে আসে আবার দূরেও নিয়ে যায়। যেমন ‘ভালোবাসা’ শব্দটি ঠিক যতটা কাছে নিয়ে আসে আবার অতি ব্যবহারে একঘেয়েমি নিয়ে আসে। আবার একদম না ব্যবহারে আসে অবহেলা। শব্দ আমার বুকে ‘মরমে জ্বালায় আগুন, সে আগুন আর নেভে না’। হ্যাঁ শব্দের গন্ধ কেন, আমি স্বাদও পাই। সে স্বাদ-গন্ধেরও রকমফের হয়। একবার রাত্রিবেলা এক অনুষ্ঠানে যাচ্ছিলাম। আকাশে মেঘ ছিল। চাঁদের গায়ে মেঘের ছায়া পড়েছিল। আমার মনে হয় ‘চাঁদের গতরে যেন শুঁয়োপোকা লেগেছে’। ব্যস আমি কনসিভ করে ফেললাম। প্রসব করলাম, ‘ইউথানাশিয়া’ গল্পটি। যার প্রথম লাইন ছিল ঐ ‘চাঁদের গতরে যেন শুঁয়োপোকা লেগেছে’।
গল্পপাঠ
সাম্প্রতিক কোন ক্ল্যাসিক উপন্যাসটি পড়েছেন আপনি?
তন্বী হালদার
শুভঙ্কর গুহ’র ‘বিয়োর’।
গল্পপাঠ
আপনি যখন একটি বইয়ের কাজ করছেন, লিখছেন, সম্পাদনা করছেন, কাটাকাটি করছেন, সেই সময়টায় আপনি কোন ধরনের লেখাপত্র পড়েন? আবার এরকম পরিস্থিতিতে কি ধরনের লেখা আপনি এড়িয়ে চলেন?
তন্বী হালদার
আমার নিজেকে মনে হয় যেন, সবসময় একটা ঘোরের মধ্যে থাকি। সেটা কোনো মানুষ, পশু, শব্দ, বাক্য, গল্প, উপন্যাস যে কোনও কিছু। সেই ঘোরে থাকার সময় বা যা নিয়ে ঘোরে থাকি সেখান থেকে কোনও প্রত্যাখ্যান আসলে নিতে পারি না। অসম্ভব কষ্ট পাই। দম বন্ধ হয়ে আসে। আবার এই অবস্থাটা সয়ে গেলে সেটা নিয়ে বিন্দুমাত্র আর কিছু মনে হয় না। মনে হয় এসব যেন অন্য কারও জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা। তাই লেখাও ওইরকম। লেখাটা যখন চলছে একরকম অনুভূতি কিন্তু শেষ হয়ে গিয়ে তাকে নিয়ে কাঁটাছেড়া করার সময়টা বিরক্তিকর। তাই এসময় কোনো বইকেই এড়িয়ে চলার মানে নেই আমার কাছে। সব কিছুই গ্রহণযোগ্য।
গল্পপাঠ
সম্প্রতি পঠিত বইগুলি থেকে এমন কোনও বিস্ময়কর ব্যাপার কি জেনেছেন যা আপনার লেখক জীবনকে ঋদ্ধ করেছে?
তন্বী হালদার
হ্যাঁ। অনিতা অগ্নিহোত্রীর ‘কাস্তে’ উপন্যাসটিতে মধ্যপ্রদেশের এক জায়গায় কন্যা ভ্রূণ হত্যা নিয়ে লেখা। যা পড়তে পড়তে সেখানকার ভূগোল, সেখানকার অর্থনৈতিক ইতিহাস, অদ্ভুত যাপন চিত্র জানতে জানতে শিউড়ে উঠেছি। আঁখ কাটনিদের চরম দুর্দশার কথা জানতে পেরেছি। পেরেছি কন্যাভ্রূণ হত্যা করে বিশাল চৌবাচ্চায় ফেলে দিয়ে কুকুরদিয়ে খাইয়ে দেওয়ার মতো নারকীয় ঘটনা। ঘুমাতে পারি নি। হ্যাঁ এই উপন্যাসটি আমাকে মানুষের জীবনযাপন যে কতরকম হতে পারে এবং কত ঘৃণ্য হতে পারে লোভ-লালসা তাদের জেনেছি। আদ্যন্ত মানুষের কথা বলা একটা ক্ল্যাসিক উপন্যাস এটি।
গল্পপাঠ
আপনি কোন ধরনের লেখা পড়তে আগ্রহ বোধ করেন, আর কোন ধরন এড়িয়ে চলেন?
তন্বী হালদার
একটা সময় ছিল যা পেতাম গোগ্রাসে পড়তাম। কোনো বাছ-বিচার ছিল না। বা হয়তো বুঝতামও না। এমনকি ঠোঙার লেখাও পড়তাম। ছাপার অক্ষরে কিছু পেলেই হত। কিন্তু সময়ের সাথে রুচি বলুন বা পছন্দ বলুন পাল্টেছে। প্রান্তিক মানুষদের জীবনের কথা, প্রকৃতির কথা আর দার্শনিক মনস্তত্বের কথা আমাকে খুব টানে। আগ্রহ বোধ করি পড়তে। আমি আক্ষরিক অর্থে নারীবাদী নই। কেন জানি না মনে হয় জীবনের মৌলিক চাহিদা, মৌলিক যন্ত্রণাগুলো নারী-পুরুষ ভেদে সমান। তাই নারী হয়ে নারীকে সম্মান করেই বলছি শুধু এই ধরনের বই আমি এড়িয়ে চলি।
গল্পপাঠ
আপনার জীবনে উপহার হিসেবে পাওয়া শ্রেষ্ঠ বই কোনটি?
তন্বী হালদার
ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ উপন্যাসটি। এটি ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় আমার জন্মদিনে আমার বন্ধু ঋতু দিয়েছিল।
গল্পপাঠ
ছোটোবেলায় কেমন বই পড়তেন? সেই সময় পড়া কোন বই এবং কোন লেখক আপনাকে আজও মুগ্ধ রেখেছে?
তন্বী হালদার
আগেই বলেছি একসময় পড়বার ব্যাপারে আমার কোনো বাছ-বিচার ছিল না। তবুও ছোটো বেলাটা যার বইতে বুঁদ থেকেছি তিনি হলেন সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ। ওনার জঙ্গলের পটভূমিতে রচিত বিভিন্ন রোমান্টিক উপন্যাসগুলো এক ধরনের নেশা তৈরী করেছিল। নিজেকে যে কত উপন্যাসের নায়িকার জায়গায় রেখে দেখতে পেরেছি সে সময় তা বলবার না। এছাড়া খুব শরৎচন্দ্রও পড়েছি। লাইব্রেরী থেকে বই নিয়ে পড়তাম তো। মূলতঃ যেগুলো পাওয়া যেত।
তন্বী হালদার
বুদ্ধদেব গুহের ‘একটু উষ্ণতার জন্য’ আজও মুগ্ধ করে আমাকে, কিন্তু লেখক আর করেন না।
গল্পপাঠ
এ পর্যন্ত কতগুলো বই অর্ধেক কিংবা পড়া শুরু করে শেষ না করেই ফেলে রেখেছেন?
তন্বী হালদার
খুব বেশি না। এই মুহূর্তে নাম মনে করতে পারছি না।
গল্পপাঠ
কোন বইগুলোয় নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন?
তন্বী হালদার
আসলে এগুলো মনে হয় সময়, পরিস্থিতি, পরিবেশের উপর নির্ভর করে। কিশোরী বেলায় যে বইয়ে নিজেকে খুঁজে পেতাম এখন আর সে বইতে পাওয়া সম্ভব না। তাই এগুলো এখন মিলবে না। তবুও বলছি, সমরেশ মজুমদারের ‘সাতকাহন’, হুমায়ুন আহমেদের ‘কোথাও কেউ নেই’, বুদ্ধদেব গুহের ‘একটু উষ্ণতার জন্য’ এবং বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপাল কুন্ডলা’র মধ্যে একসময় নিজেকে খুঁজে পেতাম। এখন আর কিছুতে পাই না।
গল্পপাঠ
কোন বইগুলো আপনি জীবনে বারবার পড়েছেন এবং আরও বহুবার পুনর্পাঠ করবেন?
তন্বী হালদার
অবশ্যই কপালকুণ্ডলা, গীতা এবং গীতাঞ্জলি।
গল্পপাঠ
লেখালেখির নিরন্তর প্রক্রিয়ার সঙ্গে কিভাবে একাত্ম থাকেন?
তন্বী হালদার
না, এ ব্যাপারে আমার প্রচন্ড ঘাটতি আছে। অনেক সময়ই এসবের সাথে আমার কোনো যোগ থাকে না। আসলে আমি খুব সংসার ভালোবাসি এবং বাসতাম। গুছিয়ে সংসার করার ভেতরেই জীবনের সব স্বার্থকতা আছে এখনও যেন মনে হয়। আর সেই ভূতটা যখন নড়ে বসে আমার আর কিচ্ছু ভালো লাগে না। ভীষণ মন খারাপ করে। ডিপ্রেসড হয়ে যাই। নিজের ভেতর অন্য একটা মানুষের জন্ম হয়ে যায়। নানারকম কাজ, ঘটনা ঘটিয়ে ফেলি যার সাথে এই লেখা, সাহিত্যের কোনো সংশ্রবই নেই। একটা ঘোর চলতে থাকে। কিছুদিন এই সার্কেলটা চলে। তারপর আবার সেই গানের তেহাইয়ের পর সমে ফেরে মন। কখনও খুব ক্লান্ত হয়, কখনও খুব ঝলমল করে। এভাবেই চলছে।
গল্পপাঠ
কে সেই লেখক যাকে আপনি পাঠ করেন গভীর আনন্দের সঙ্গে? যিনি আপনার ওপর সব থেকে বেশি প্রভাব ফেলেন?
তন্বী হালদার
এখানে আমি দু-জনের নাম উল্লেখ করব। লেখক হিসেবে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহকে আমি গভীর আনন্দের সঙ্গে পাঠ করি। আর সোহারাব হোসেনের লেখক ও মানবিক সত্ত্বা আমার উপরে সব থেকে বেশি প্রভাব ফেলেছে। উনি আমার কলেজের শিক্ষকও ছিলেন। পরিণত বয়েসে আমাদের মধ্যে খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায়। উনি আমাকে শেখান বাউল হতে। বাউলানী নয়। আধার খুঁজতে। আধার হতে নয়। উনি বলতেন, ‘মাঝ সমুদ্র সবসময় শান্ত, কিন্তু গভীর’। আমাদের এদিকে চাষের জমিতে প্রচুর বক আসে। এক পায়ে ঝিম মেরে বসে থাকে। সেগুলোকে বলে, সন্ন্যাসী বক। বসে থাকতে থাকতে ছোঁ মেরে শিকার ধরে। উনি আমায় শিখিয়ে গেছেন কীভাবে সেই ‘সন্ন্যাসী বক’ হয়ে যাওয়া যায়। কি অসম্ভব শারীরিক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও উনি লিখে যেতেন। কি অসম্ভব মনের জোর ছিল ওনার। অকাল মৃত্যু তাঁকে কেড়ে নিল সকলের কাছ থেকে। তবুও তাঁর দেওয়া শিক্ষা থেকে মনে হয় যদি শিকিভাগও অর্জন করে বাস্তবে প্রয়োগ করতে পারি জীবনটাই অন্যরকম হয়ে যাবে।
গল্পপাঠ
গল্প লিখতে শুরু করেন কিভাবে? একজন রিপোর্টারের মতোই কি আপনি চারপাশটা অবিরাম পর্যবেক্ষণে রাখেন? আপনি কি নোট নেন?
তন্বী হালদার
খুব ছোটোবেলা থেকে লেখার ভূতে আমাকে ধরেছে, এটা একদম তিন সত্যি। কবিতা লিখতাম। প্রথম গল্প লিখি তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি। যুব উৎসবের প্রতিযোগিতায়। সর্বসাধারণের জন্য ছিল প্রতিযোগিতাটি। গল্পটার নাম ছিল, ‘রামুর দুঃখ’। তৃতীয় স্থান পেয়েছিল গল্পটা। প্রাইজ দিলেন যিনি, নাম মনে নেই, মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, ‘বাহ! এতটুকু মেয়ে!’ কথাটা প্রেস্টিজে লেগেছিল।
হা করে চারপাশ দেখা আমার ছোটোবেলা থেকেই অভ্যাস। একই জিনিস, একই মানুষ, একই গাছ তাও হা করেই দেখি। সেটা রিপোর্টারের মতো হয় কিনা জানি না। না কোনো নোট নেই না। আর এখন যেহেতু খুব ভুলে যাই তাই অনেক কিছুই মনে থাকে না।
গল্পপাঠ
লেখালেখির সব থেকে কঠিন দিক হিসেবে আপনি কোনটিকে চিহ্নিত করবেন?
তন্বী হালদার
উফফ্, এ ব্যাপারে অবশ্যই বলবো বানান। কি যে ভুল হয়। লিখতে গিয়ে সব যেন ঘেঁটে ‘ঘ’ হয়ে যায়।
গল্পপাঠের পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন এমদাদ রহমান
12 মন্তব্যসমূহ
পড়লাম ভালো লাগলো। সাক্ষাৎকারে প্রশ্নগুলো ভালো। আর তন্বী হালদারের উত্তরগুলি অনবদ্য ও খুবই যুক্তিযুক্ত। প্রিয় লেখককে ভালোবাসা।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনপুরোটা পড়লাম। প্রশ্ন এবং লেখিকার উত্তর দুটোই অনবদ্য।
উত্তরমুছুনপুরোটাই পড়লাম। খুব ভালো লাগলো
উত্তরমুছুনপুরোটাই পড়লাম।ভীষণ ভালো লাগল।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনখুব ভালো লাগলো...
উত্তরমুছুনভীষণ সুন্দর....
খুব সুন্দর । ভালো লাগলো ।
উত্তরমুছুনখুব ভাল লাগল।
উত্তরমুছুনআপনার মত সাহিত্যিকের সাথে পরিচয় আছে এটা ভেবে গর্ব বোধ করি।ভালো থাকবেন।
উত্তরমুছুনশুভাশিস
ধন্যবাদ
মুছুনসকলকে অনেক অনেক ধন্যবাদ
উত্তরমুছুন