ফারহানা রহমানের অনুবাদ; রোয়াল্ড ডালের গল্পঃ পুলের ভেতরে ডুবে


তৃতীয় দিন ভোরেই সমদ্র শান্ত হয়ে গেলো। এমনকি সেইসব সম্ভ্রান্ত যাত্রীদেরকেও, যাদেরকে জাহাজটি রওনা হওয়ার সময়েও চারপাশের কোথাও দেখা যায়নি, তারাও ক্যাবিন থেকে বের হয়ে রৌদ্রোজ্জ্বল ডেকের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। স্টুয়ার্ড সেখানে তাদের জন্য চেয়ার বিছিয়ে রেখেছিলো, তাছাড়া তাদের পায়ের কাছেও কার্পেট বেছানো ছিল ।
আর সেখানেই তারা জানুয়ারি মাসের উত্তাপহীন সূর্যের নিচে মুখ উঁচু করে বিমর্ষ হয়ে সারিবদ্ধ হয়ে শুয়ে রইলো। 

প্রথম দুদিন সমুদ্র কিছুটা উত্তাল ছিল। হঠাৎ করে চারদিক শান্ত হয়ে গিয়ে জাহাজের ভেতর একটি আরামদায়ক স্নিগ্ধ- মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিলো। সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথে যাত্রীরা তাদের বিগত বারো ঘণ্টার শান্ত আবহাওয়ার কথা ভেবে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছিল। অভিজ্ঞ নাবিকদের দ্বারা প্রচ্ছন্ন আবহাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে তারা রাত আঁটটার সময় প্রধান ডাইনিং রুমটি কানায় কানায় পূর্ণ করে রাতের খাবার ও পানীয় গ্রহণ করতে লাগলো। 

ভোজের অর্ধেক শেষ হতে না হতেই যাত্রীরা তাদের দেহে এবং বসার চেয়ারটিতে হালকা দুলনি অনুভব করে শঙ্কিত হয়ে পড়লো। প্রকৃতপক্ষে বিশাল জাহাজটি আবারও ভীষণ দুলতে শুরু করেছিলো। প্রথমদিকে এটি খুব মৃদু ছিল, পরে ধীরে ধীরে একদিকে ঝুঁকে পড়ছিল তারপর আরেকদিকে কিন্তু সেটাই তাৎক্ষনিকভাবে রুমের ভেতরের সম্পূর্ণ পরিবেশকে বদলে দিলো। কিছু কিছু যাত্রী খাবার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পরের ঝাঁকুনির জন্য অপেক্ষা করে ম্লান-বিপন্ন হাসি নিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকলো, তাদের চোখেমুখে ছিল কিছুটা প্রশ্রয়ের ঝলকানি। 

কেউ কেউ একেবারে নির্বিকার হয়ে রইলো, কেউ কেউ আত্মতুষ্টিতে ভুগছিল, কিছু কিছু আত্মম্ভরি লোকজন ভীতসন্ত্রস্ত যাত্রীদেরকে আরও একটু আতঙ্কিত করার জন্য খাবারদাবার ও আবহাওয়া নিয়ে নানা কৌতুক করতে শুরু করলো। আর তখনই জাহাজটির দুলনি তীব্রভাবে বেড়ে গেলো। প্রথম দোলার পাঁচ ছয় মিনিটের মধ্যেই দেখা গেলো জাহাজটি ভীষণভাবে একদিক থেকে আরেকদিকে হেলে পড়ছে। সেসময় যাত্রীরা এককোণায় হেলে পড়া থেকে বাচার জন্য তাদের বসার চেয়ারটিকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো। 

অবশেষে প্রকৃত ভয়ঙ্কর ঢেউটি আসলো এবং পার্সারের টেবিলে বসা মিস্টার উইলিয়াম বটিবোল দেখল যে তার প্লেট থেকে পোচড টারবট ইউথ হলান্ডেস সসটি হঠাৎ করে কাঁটাচামচের ফাঁক গলে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে। ফলে সেখানে সাঙ্ঘাতিক উত্তেজনা বিরাজ করছিলো। প্রত্যেকেই সেখানে এসেছিল প্লেট ও মদের গ্লাস সংগ্রহ করতে। মিস্টার র‍্যানশ ডানে বসেছিলেন এবং তিনি মৃদু চিৎকার করে পার্সারের হাতের কব্জি আঁকড়ে ধরলেন। 

“একটি ভয়াবহ রাত আসতে যাচ্ছে,” মিস্টার র‍্যানশর দিকে তাকিয়ে পার্সার বললেন। “মনে হচ্ছে জাহাজটি বয়ে চলেছে একটি প্রলয়ঙ্করী রাত আনার জন্যই।” 

পার্সার চলে যাওয়ার পথে অতি উৎসাহে বেহুদা কিছু পরামর্শ দিয়ে গেলেন । 

তাড়াহুড়ো করে একজন স্টুয়ার্ড এসে টেবিল ক্লথের উপর বাসনকোসন থেকে পড়া পানি ছেঁচে নিয়ে গেলো। উত্তেজনা কিছুটা থিতিয়ে এসেছিল। বেশীরভাগ যাত্রীই তাদের খাবার পর্ব আবার শুরু করে দিলো। মিসেস র‍্যানশসহ ছোট একটি দল গোপনে তাদের ভাড়া আদায় করে নিলো এবং একপ্রকার ক্ষিপ্রতার সাথে টেবিলের পাশ দিয়ে দরজার দিকে দ্রুত হারিয়ে গেলো। 

“খুব ভালো,” পার্সার বললেন, “মিসেস র‍্যানশ চলে যাচ্ছেন।” তিনি সম্মতিসূচক দৃষ্টিতে দলটিতে চুপচাপ যারা বসে আছে তাদের দিকে এক পলক দেখলেন, তাদের গর্বিত চেহারায় সম্ভ্রম ফুটে উঠেছে এবং তারা তাকে একজন দক্ষ নাবিকের মর্যাদা দিয়েছে বলে তিনি আত্মতুষ্টি নিয়ে তাদের দিকে তাকালেন। 

ঢেউ শুরুর পর থেকেই মিস্টার বটিবোল যিনি অস্বাভাবিকভাবে নিরব এবং চিন্তিত ছিলেন তিনি খাবারদাবার শেষ হওয়ার পর যখন কফি দেওয়া হোলো তখন হঠাৎ করে উঠে দাঁড়ালেন এবং তার কফির কাপটি পার্সারের পাশে মিসেস র‍্যানশর খালি করে দেওয়া জায়গায় রাখলেন। তিনি নিজেও তৎক্ষণাৎ সেই চেয়ারেই বসে হেলান দিয়ে পার্সারের কানের কাছে গিয়ে দ্রুত ফিসফিস করে জানতে চাইলেন, “দয়া করে কিছু মনে করবেন না, কিন্তু আপনি কি আমাকে ব্যাপারটা একটু খুলে বলবেন?” 

ছোটখাটো, স্থুল, লালচে বর্ণের পার্সারটি ঝুঁকে এসে জানতে চাইলেন, “কী সমস্যা, মিস্টার বটিবোল?” 

“আমি এটাই জানতে চাই যে,” লোকটির ভীতসন্ত্রস্ত চেহারাটি পার্সার দেখছিলেন। “আমি যা জানতে চাই আর সেটা হচ্ছে ক্যাপ্টেন কি এরিমধ্যে একদিনে কতদূর পাড়ি দেবেন সেটা ঠিক করে ফেলেছেন? বুঝতেই পারছেন, পুল নিলামের ব্যাপারে বলছি? আমি বোঝাতে চাচ্ছি পরিস্থিতি আরও উত্তাল হওয়ার আগে?” 

আত্মবিশ্বাসে ভরপুর পার্সারটি তার বিশাল বপু নিয়ে নিজের সিটে কাঁত হয়ে আরাম করে বসলেন। তিনি উত্তর দিলেন “আমার সেটাই বলা উচিত—হ্যাঁ,” লোকটি ফিসফিস করে উত্তর দিচ্ছেন কি না সেটা নিয়ে মাথা ঘামালেন না। অবশ্য তিনি এমনিতেই গলা নিচু করেই উত্তর দিলেন। 

“কতক্ষণ আগে তিনি এটা ঠিক করেছেন বলে মনে করেন?” 

“বিকেলের মধ্যেই কখনো। মূলত তিনি বিকেলেই এটা করেন।” 

“ ঠিক কখন?” 

“ ওহ, আমি ঠিক জানি না। মনে হয় চারটার মধ্যেই হবে।” 

“ এখন আরেকটা ব্যাপার আমাকে জানান প্লিজ। এটা কোন নাম্বারটি হবে সেটা ক্যাপ্টেন কি করে সিদ্ধান্ত নেন?” 

পার্সার মিস্টার বটিবোলের ভ্রু কোঁচকান বিরক্তিকর চেহারার দিকে তাকালেন এবং লোকটি যে বিভ্রান্ত হচ্ছেন সেটা ভালোভাবে বুঝেই তিনি হেসে দিলেন। “আচ্ছা দেখুন, নেভিগেটিং অফিসারদের সাথে ক্যাপ্টেনের ছোটখাটো সম্মেলন চলতেই থাকে এবং তারা আবহাওয়া এবং আরো অনেক ব্যাপার পর্যবেক্ষণ করেই শেষপর্যন্ত ব্যাপারটির একটি মূল্যায়ন করে থাকেন।” 

মিস্টার বটিবোল উত্তরটি নিয়ে এক মুহূর্তের জন্য চিন্তা করে মাথা নাড়লেন। তারপর বললেন, “আপনি কি মনে করেন যে আজকে্র আবহাওয়া যে খাবাপ হবে সেটা ক্যাপ্টেন জানতেন?” 

“আমি আপনাকে এটা বলতে পারবো না” পার্সার উত্তর দিলেন। তিনি তার কালো কুতকুতে চোখের মণিদুটোকে উত্তেজিত করে নাচিয়ে অন্যদেরকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। “মিস্টার বটিবোল, আমি সত্যি আপনাকে ব্যাপারটা নিয়ে কিছু বলতে পারবো না। আমি জানতাম না।” 

“এটা যদি আরো খারাপ হয় তাহলে কম টাকার নাম্বার কিনে রাখা ভালো হবে। আপনার কি মনে হয়?” এখন আরও দ্রুত এবং উদ্বিগ্ন হয়ে মিস্টার বটিবোল ফিসফিস করলেন। 

“সম্ভবত তাই ঠিক হবে,” পার্সার বললেন। “আমার সন্দেহ হচ্ছে বুড়ো লোকটি কি সত্যি রাতটিকে ভয়ানক হতে দেবেন? যখন তিনি তার হিসেবনিকেশ করেছিলেন বিকেলটা তখন কিন্তু ভীষণ শান্ত ছিল।” 

টেবিলে থাকা অন্যান্য সবাই তখন চুপ মেরে কথা শোনার চেষ্টা করছিলেন, তারা সবাই অর্ধ বাঁকা হয়ে থাকা, ঠোঁটগুলো সামান্য খোলা, টানা টানা ভ্রু, মাথা সোজা করে একপাশে কিছুটা ঝুঁকে থাকা, অর্ধ সম্মোহিত পার্সারকে এমনভাবে দেখছিলেন এবং শুনছিলেন যেন তারা ঘোড়দৌড়ের মাঠ দেখতে পাচ্ছেন এবং একজন ট্রেইনার কীভাবে বাজি খেলায় সুযোগ নেয় সেটাই কান পেতে চুপিচুপি কথা শোনার চেষ্টা করছিলেন। তারা এমনভাবে কথাগুলো শুনছিলেন যেন তাদের কাছে আসা কোন ঘোড়ার মুখ থেকেই তারা সরাসরি কথাগুলো শুনতে পাছেন। 

“ ধরুন, এখন আপনি একটি মাত্র নাম্বার কেনার সুযোগ পে্যেছেন তাহলে আজকে কোন নাম্বারটি পছন্দ করবেন?” মিস্টার বটিবোল ফিসফিস করে জানতে চাইলেন। 

“ আমি আজকের পুরো রেঞ্জটা এখনো জানি না,” পার্সার ধৈর্য ধরে উত্তর দিলেন। রাতের খাবারের পর যতক্ষণ না অকশন শুরু হচ্ছে ততক্ষন পর্যন্ত তারা এর পরিধি ঘোষণা করবেন না। আর যাইহোক আমি সত্যি নিলামে খুব একটা পারদর্শী নই। আপনি জানেন যে আমি আসলে শুধুমাত্রই একজন পার্সার।” 

এ সময় মিস্টার বটিবোল উঠে দাঁড়ালেন। “আমাকে আপনারা সবাই ক্ষমা করবেন,” তিনি বললেন এবং তিনি দোলায়িত মেঝের ওপর অন্যান্য টেবিলের মাঝখান দিয়ে সতর্কতার সাথে হেঁটে গেলেন। তাকে জাহাজের দুলনির মাঝে নিজেকে স্থির রাখার জন্য দু’দুবার চেয়ার আঁকড়ে ধরতে হোলো। 

“দয়া করে সানডেকে নিয়ে চলো,” লিফট ম্যানকে তিনি অনুরোধ করলেন। 

খোলা ডেকে পা রাখতেই তার মুখে ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাঁপটা এসে পড়লো। তিনি টলতে টলতে দুহাত দিয়ে শক্ত করে রেলটা ধরলেন এবং অন্ধকারে সমদ্র দেখার জন্য দাঁড়ালেন, সেখানে বিশাল বিশাল ঢেউগুলো তখন আছড়ে পড়ছিল এবং শাদা ঘোড়ার মতো ফেনাগুলো জয়পতাকা নিয়ে পিছনে ধেয়ে আসা বাতাসের বিরুদ্ধে লড়ছিল। 

“ওখানে আবহাওয়া খুব খারাপ ছিল, তাই না স্যার,” লিফটম্যান নিচে নামার পথে জিজ্ঞেস করলো। 

মিস্টার বটিবোল একটি লাল চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে তার নিজের জায়গায় ফিরে আসলেন। “তুমি কি মনে করো এই আবহাওয়ার কারণে আমরা কোনরকম গতি কমিয়েছি?” তিনি জিজ্ঞেস করলেন। 

“ওহ, আমার কথা হচ্ছে হ্যাঁ, স্যার। এ অবস্থা যখন থেকে শুরু হয়েছে আমরা বিলক্ষণ গতি কমিয়েছি। আপনাকে এরকম আবহাওয়ায় গতি কমাতেই হবে নইলে সমস্ত যাত্রীদের জাহাজের ভেতরে চারদিকে ছুঁড়ে ফেলতে হবে।” 

নিচে স্মোকিং রুমে নিলামের জন্য লোকজন জড় হয়েছে। নানা টেবিলে ভদ্রভাবে দল বেঁধে তার নিজেরা একত্রিত হয়েছেন। লোকগুলো তাদের ডিনারের পোশাকে কিছুটা শক্ত হয়ে, হালকা গোলাপি ও দারুণ নিখুদভাবে শেভ করা গাল নিয়ে তাদের সুসজ্জিত-শীতল-ফর্সা রমণীদের পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। 

নিলামের টেবিলের খুব কাছে এসে মিস্টার বটিবোল একটি চেয়ার নিয়ে বসলেন। তিনি পাগুলো আড়াআড়ি করে, হাত ভাঁজ করে নিজের চেয়ারে এমনভাবে স্থির হয়ে বসলেন যেন উত্তাল আবহাওয়ায় মরিয়া হয়ে একটি অভূতপূর্ব সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন এবং কোনকিছুকেই তিনি আর ভয় পান না। 

তিনি নিজেকেই বললেন, পুলটি সাত হাজার ডলার হবে। আর গত দুদিন ঠিক এমনই ছিল যার প্রতিটি তিন থেকে চার শয়ের মধ্যে বিক্রি হচ্ছিলো। ব্রিটিশ জাহাজ হওয়াতে এটি পাউন্ডে বিক্রি হয়েছে কিন্তু তিনি নিজের টাকার কথা ভেবেই সাচ্ছন্দবোধ করছিলেন। সাত হাজার ডলার অনেক বেশি হয়ে যায়। ওহ! কী একটা অবস্থা! এখন তিনি কী করবেন, তিনি কি তাদেরকে একশ টাকার বিল দিতে দেবেন এবং তিনি কি এটি তার জ্যাকেটের পকেটে করে ডাঙায় নিয়ে যাবেন? তাহলে কোন সমস্যা নেই। তাহলে এখনই তিনি, হ্যাঁ এখনই তিনি একটি লিংকন কনভারটিবল কিনবেন। তিনি জাহাজ থেকে যাওয়ার সময় এটিকে নিয়ে নেবেন শুধুমাত্র বাসার সামনের দরজায় এসে এটি দেখে এথেলের হাস্যজ্জল মুখ দেখার জন্য। যখন হালকা সবুজ লিঙ্কন কনভারটিবলটি নিয়ে তিনি বাড়ির দরজায় পৌঁছাবেন তখন এথেলের হাস্যজ্জল মুখটি দেখা কি অনেক বড় ব্যাপার নয়! হ্যালো এথেল সোনা আমার! তিনি খুব স্বাভাবিকভাবেই বলবেন। আমি শুধু তোমাকে একটি ছোট্ট উপহার দিতে চেয়েছিলাম। যাওয়ার পথে আমি এটি জানালার কাছে দেখেছিলাম তাই তোমার কথা ভাবলাম যে এটির জন্য তুমি কতদিন অপেক্ষা করে আছো। তোমার কি এটা পছন্দ হয়েছে সোনা? তিনি জানতে চাইবেন। রঙটি কি তোমার পছন্দ হয়েছে? আর সেসময় তিনি এথেলের মুখটা খেয়াল করতে থাকবেন। 
  
টেবিলের পিছনে দাঁড়িয়ে নিলামদার চিৎকার করলেন, “ভদ্র মহিলা ও মহাদয়গন।” “পাঁচশ পনের মাইলের মধ্যে আজকের দিনের গতির খেলাটি আগামীকাল মধ্যাহ্নের মধ্যেই শেষ করবেন বলে জাহাজের ক্যাপ্টেন নির্ধারণ করেছেন। আমরা স্বভাবতই পরিধি নির্ধারণের জন্য যে কোন দিকের দশটি নাম্বার নেবো। যা পাঁচশ এবং পাঁচ-পাঁচে পচিশ অর্থাৎ পাঁচশ পচিশ বানাবে। এবং অবশ্যই এগুলো তাদের জন্য যারা ভাবে যে প্রকৃত নাম্বারটি আসলে এটি নয় তা হয়তো অনেক দূরের কোন নাম্বার, তাদের জন্য হচ্ছে নিচের ফিল্ডটি আর উচ্চ ফিল্ডও রয়েছে। সেগুলো আলাদা আলাদাভাবে বিক্রি হবে। এখন আমরা প্রথম নাম্বারটি খেলবো। আমরা পাঁচশ বারোতে আছি?” 

রুমটি ভীষণ নীরব হয়ে গেলো। লোকজন স্থির হয়ে তাদের চেয়ারে বসে নিলামদারের দিকে তাকিয়ে রইলো। বাতাসে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছিলো, নিলামের দাম বাড়ার সাথে সাথে উত্তেজনাও ক্রমেই বাড়ছিলো। এটি কোন খেলা বা হাসিঠাট্টা ছিল না; এটা নিশ্চিত যে কেউ জখন বিডের দাম বাড়াছিল তখন একজন আরেকজনের দিকে তাকাচ্ছিলো—হয়তোবা হাসছিল, কিন্তু সেটা ছিল শুধুই ঠোঁটের হাসি, চোখগুলো ছিল শীতল ও উজ্জ্বল।

পাঁচশো বারো নাম্বারটি জিতে নিলো একশো দশ পাউন্ড! পরের তিনটি বা চারটি নাম্বারও প্রায় একই রকম মূল্যেরই হোলো। 

সেসময় জাহাজটি ভীষণভাবে দুলতে লাগলো এবং একেকটি ঢেউ পের হতে না হতেই দেয়ালের কাঠের প্যানেল এমনভাবে চিড়তে লাগলো যেন এটি ভেঙে পড়ে যাবে। যাত্রীরা নিলামে মনোনিবেশ করে তাদের চেয়ারের হাতল শক্ত করে ধরে রাখলো।

“ এখন নিচের ফিল্ড” নিলামদার আওয়াজ দিলো। “পরের নাম্বারটি নিচের ফিল্ডের।” 

মিস্টার বটিবাল সোজা ও চিন্তিত হয়ে বসে রইলো। যতক্ষণ না অন্যদের বিড করা শেষ হচ্ছে ততক্ষণ তিনি অপেক্ষা করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন, তারপর তিনি শেষ মূল্য নির্ধারণে ঝাঁপিয়ে পরবেন। তিনি ধারণা করলেন যে তার বাড়ির ব্যাংকে কম করেও পাঁচশো ডলার আছে সম্ভবত ছয়শোর কাছাকাছি। এটি দুইশো পাউন্ডের মোট—দুইশোর বেশি। টিকেটটি এর বেশি নিশ্চয়ই হবে না। “আপনারা জানেন,” নিলামদার বলছিল, “ নিচের ফিল্ডের সব নাম্বারগুলোই নিলামের রেঞ্জের সবচেয়ে ছোট নাম্বারটিরও নিচে থাকে। তাই আপনারা যদি মনে করেন যে আগামীকাল মধ্যাহ্নের মধ্যে ২৪ ঘণ্টা শেষ হওয়ার আগেই এই জাহাজটি পাঁচশো পাঁচ মাইলের চেয়ে কম দূরত্বে যাবে তাহলে আপনারা বরং এর ভেতরের এই নাম্বারটা কিনতে পারেন। তাহলে আমি আর কি বিড করবো?” 

একশো ত্রিশ পাউন্ড পর্যন্ত শেষ হয়ে গেলো। আবহাওয়া উত্তাল হতে উঠেছে সেটা মিস্টার বটিবোল ছাড়া অন্যন্য সবাই খেয়াল করলো। একশো পঁয়তাল্লিশ পাউন্ডে এসে এটি থামল। নিলামদার তার হাতুড়ি পিটিয়েই চলেছে। 

“ একশো পঞ্চাশে পৌঁছিয়েছে...” 
“ ষাট!” মিস্টার বটিবাল ডাক দিলেন এবং প্রত্যেকে তার দিকে ফিরে চাইলেন। 

“ শত্তুর!” 

“ আশি!” মিস্টার বটিবোল দাম চড়ালেন। 

“ নব্বই!”

“ দু’শ!” মিস্টার বটিবোল হাঁক দিলেন। তিনি কারো কাছে হার মানবেন না আজকে। 

এসময় একটি বিরতি হোলো।

“ কেউ কি আছেন যিনি দু’শোরও বেশি ডাকবেন?” 

স্থির হয়ে বসে তিনি নিজেকে বললেন। ওপরের দিকে না তাকিয়েই একেবারে স্থির হয়ে বসে রইলেন মিস্টার বটিবোল। নিজের দম বন্ধ রাখো। যতক্ষণ না কেউ তোমাকে বিড করছে দম আঁটকে রাখো। 

“ দু’ শো পাউন্ডে শেষ করছি...” নিলামকারীর গোলাপি টাকের ওপর সেসময় মিষ্টি ঘাম চিকমিক করছিলো।
“শেষ করতে যাচ্ছি তাহলে...” 

মিস্টার বটিবোল তখনো দম আঁটকে রেখেছেন। “ শেষ করতে যাচ্ছি কিন্তু...শেষ!” 

লোকটি টেবিলের ওপর ডং হাতুড়ি পেটালো। মিস্টার বটিবোল একটি চেক লিখে নিলামদারের এসিসটেন্টকে দিয়ে দিলেন। তারপর তিনি স্বস্তি নিয়ে নিলামটি শেষ হওয়ার জন্য নিজের চেয়ারে এসে বসলেন। পুলে আরও কত কী আছে তা না দেখে তিনি বিছানায় যাবেন না। 

শেষ নাম্বারটি বিক্রি হওয়া পর্যন্ত সব যোগ করার পর বেজোড় সংখ্যা—একুশ শো পাউন্ড হয়েছিল। যা ছয় হাজার ডলারের কাছাকাছি। নব্বই ভাগ টাকা জয়ীরা পাবে আর দশ ভাগ সমুদ্রের দাতব্য সংস্থার কাছে চলে যাবে। 

ছয় হাজার পাউন্ডের নব্বইভাগ হচ্ছে পাঁচ হাজার চারশো। বাহ! খুব ভালো—যথেষ্ট হয়েছে। তিনি লিংকন কনভারটিবলটা কিনতে পারবেন তারপরও যথেষ্ট টাকা রয়ে যাবে। তিনি সন্তুষ্ট চিত্তে খুশি ও উত্তেজিত হয়ে নিজের ক্যাবিনে ফিরে গেলেন। 

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মিস্টার বটিবোল চোখ বন্ধ করে কয়েক মিনিট নিরবে শুয়ে রইলেন। তিনি শুয়ে শুয়ে বাতাসের প্রবল ধ্বনি শোনার এবং জাহাজের উত্তাল গতি বোঝার চেষ্টা করছিলেন। বাতাসে সেরকম কোন শব্দ ছিল না বা জাহাজটিও খুব দুলছিলো না। তিনি লাফিয়ে উঠে পোর্টহোল দিয়ে বাইরে তাকালেন। হে ঈশ্বর—সমুদ্র তো কাঁচের মতোই স্বচ্ছ! বিশাল জাহাজটি অবশ্যই দ্রুত গতিতে চলেছে এবং নিশ্চয়ই কালকের ধীর গতিতে সময় নষ্ট হওয়াকে পুষিয়ে নিচ্ছে। মিস্টার বটিবোল ঘুরে দাঁড়ালেন এবং ধীর পায়ে এসে নিজের বিছানার কিনারায় বসলেন। একটি সুক্ষ ভয়ের বিদ্যুৎ প্রবাহ তার পাকস্থলির মধ্যে বয়ে গেলো। তার আর কোন আশা নেই। এরপর নিশ্চয়ই উঁচু ফিল্ডের বড় কোন একটি নাম্বার জিতে যাবে। 

“হে ঈশ্বর!” তিনি চিৎকার কর উঠলেন। “আমি এখন কি করবো?” 

হায় রে! উদাহরণ স্বরূপ কী হতে পারে? এথেল কী বলতে পারে? সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে এথেলকে কখনই বলা যাবে না যে সে তাদের তিলতিল করে দুবছর ধরে জমানো সব টাকা জাহাজের পুলের নিমালের বাজি খেলাতে একটি মাত্র টিকিট কিনে তিনি নষ্ট করে ফেলেছেন। কিন্তু এটাকে তো লুকিয়ে রাখাও সম্ভব নয়। এখন তো তাহলে এথেলকে ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে নিষেধ করতে হবে। তাহলে টেলিভিশনের প্রতিমাসের ইন্সটলমেন্টের কী হবে? আর ইন্সাইক্লোপেডিয়া ব্রিটেনিকার? এরমধ্যেই তিনি নারীর চোখের রাগান্বিত দৃষ্টি ও ভয়ানক অবজ্ঞা দেখতে পাচ্ছেন, নীল চোখগুলো ধূসর ও কুতকুতে হয়ে উঠছে যেমন হয় সবসময় রাগান্বিত অবস্থায়। 

“ হে আমার খোদা! বলে দাও আমি এখন কী করবো?” 

যতক্ষণ না জাহাজটি পিছিয়ে গিয়ে পূর্বের সেই মুহূর্তে ফিরে যাচ্ছে ততোক্ষণ তার আর বিন্দুমাত্র কোন সুযোগ রইলো না। এখন যদি তাকে বাজিতে জিততে হয় তাহলে তাদেরকে জাহাজটিকে একেবারেই ফুল স্পিডে উল্টো ঘুরিয়ে ঠিক সেই আগের জায়গায় নিয়ে রাখতে হবে। হুম ঠিক, এখন আসলে তার উচিত জাহাজের ক্যাপ্টেনকে ঠিক সেটাই অনুরোধ করা। তাকে দশভাগ লাভের লোভ দেখানো। যদি তিনি চান তাহলে আরও একটু বেশিও দেওয়া যেতে পারে। মিস্টার বটিবোল মুখ টিপে একা একা হাসতে লাগলেন। এরপর হঠাৎ করে এমনভাবে স্তব্ধ হয়ে গেলেন যে একেবারে চোখমুখ বিস্ফারিত করে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েলেন। এক মুহূর্তের মধ্যেই তিনি একটি বুদ্ধি পেয়ে গেলেন। বুদ্ধিটা তাকে দ্রুত নাড়িয়ে দিলো, তিনি ভীষণ উত্তেজিত হয়ে বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠলেন এবং আবারও দৌড়ে পোর্টহোলের কাছে গিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে লাগলেন। 

বেশ! কেন নয়? কেন কখনোই নয়? সাগর একদম শান্ত এবং তিনি যতক্ষণ না কেউ তাকে সাগর থেকে তুলে আঞ্ছে ততোক্ষণ পর্যন্ত সেখানে সহজেই ভেসে থাকতে পারবেন। কারো না কারো সাথে তো এ ঘটনা আগেও হয়েছে। এমনই একটা অস্পষ্ট ভাবনা তাকে উত্তেজিত করে তুললো। সেও যদি একই কাজ আবারও করে তাতে সমস্যা কী? শুধু জাহাজটিকে একটু থামাতে হবে এবং একটি নৌকা নামাতে হবে আর হয়তো সেই নৌকাটি তাকে আধা মাইল দূর থেকে তুলে এনে জাহাজে পৌঁছে দেবে, এই তো পুরো ব্যাপারটি!

এক ঘণ্টায় তো এটা মোটে ত্রিশ মাইলই যায়। খুব বেশি হলে নাহয় সারাদিনে ত্রিশ মাইলই দূরে থাকবে। তাতে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে? আর তাতেই নিশ্চিতভাবে নিচের ফিল্ডটি জেতা সম্ভব। শুধু একটা ব্যাপারই নিশ্চিত করতে হবে যেন তার সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়াটা কেউ দেখে। এবং সেই পরিস্থিতি তৈরি করাটা একেবারেই কোন ব্যাপার নয়। এবং খুব ভালো হয় যদি সে কোন হালকা কোন পোশাক পরে থাকে যাতে তার সাঁতার কাটতে সুবিধা হবে। স্পোর্টসের ড্রেস পরাটাই ঠিক হবে। তিনি যেন ডেকে টেনিস খেলতে যাচ্ছেন এমনভাবেই তিনি কাপড় পরবেন। শুধু একটি হালকা শার্ট, শর্টস এবং টেনিস খেলার জুতো। এবং তিনি কোন হাতঘড়ি পরবেন না। 

এখন কয়টা বাজে? নয়টা পনেরো। তাহলে শুভস্য শীঘ্রম! এখনই ঝাঁপিয়ে পড় আর সব ঝামেলা থেকে উৎরে ওঠো। যা করার এখনই করতে হবে কারণ দুপুরের মধ্যেই সবকিছু সেরে ফেলতে হবে। স্পোর্টসের পোশাক পরে সূর্যডেকে এসে মিস্টার বটিবোল একাধারে ভীতসন্ত্রস্ত ও উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। তার ছোট্ট দেহে নিতম্বটি প্রশস্ত ছিল, সেখান থেকে ঢালু হয়ে বরাবব উঠে গেছে নিতান্তই সরু কাঁধটি। ফলে এটির একটি সাদৃশ্য আছে। যে কারণেই হোক না কেন এটি অনেকটা জেটিতে দড়ি বাঁধার খোঁটার মতো। কালো লোমে ভরে আছে তার চিকণ শাদা পাগুলো। তিনি খুব সাবধানের সাথে মৃদু পায়ে ডেকের দিকে এগিয়ে আসলেন। ঘাবড়ে গিয়ে নিজের চারপাশ দেখলেন। চোখের সামনে শুধু আরেকজন মানুষই আছে, খুব মোটা গোড়ালির ভীষণ ভারী নিতম্বের অধিকারী একজন বয়স্ক নারী যিনি রেলে ঝুঁকে সাগরের দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি পারস্যের মেষসাবকের লোমের তৈরি একটি কোর্ট পরে আছেন এবং কলারটি এমনভাবে উঁচু হয়ে আছে যে মিস্টার বটিবোল সেই নারীর চেহারাতা দেখতে পারেননি। 

তিনি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে দূর থেকে নারীটিকে লক্ষ করতে লাগলেন। তিনি আপনমনে বললেন, একদম! একে দিয়েই হবে। অন্য যে কারোর মতোই তিনিও সম্ভবত যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এলারম বাজাবেন। কিন্তু এখন কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো, সময় নাও উইলিয়াম বটিবোল, সময় নাও। মনে করো ক্যাবিনে কিছুক্ষণ আগে তুমি নিজেকে ঠিক কি বলেছো? সেটা কি মনে করতে পারো? 

নিকটতম স্থল থেকে এক হাজার মাইল দূরে গভীর সমদ্রে জাহাজ থেকে লাফিয়ে পড়ার চিন্তাটা এই মুহূর্তে মিস্টার বটিবোলকে একজন অত্যন্ত সতর্ক মানুষে পরিণত করলো—অস্বাভাবিকভাবে গভীর মনোযোগী করে তুললো। তার সামনে দেখা মহিলাটিই যে তাকে সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে দেখেই নিশ্চিতভাবে তৎক্ষণাৎ এলারম বাজেবেন সে ব্যাপারে তিনি কোনভাবেই এ পর্যন্ত সন্তুষ্ট হতে পারেননি। 

তার মতে মহিলাটি দুটো কারণে অসফল হতে পারে। প্রথমত তিনি বধির ও অন্ধ হতে পারেন। এটি আসলে নাও হতে পারে তবে অন্যদিকে হতেও তো পারে! কেন শুধুশুধু সুযোগ নেওয়া? ঠিক যা তাকে এখন করতে হবে সেটা হচ্ছে মহিলাটির সাথে সরাসরি কথা বলা। দ্বিতীয়ত—এটাতেই বোঝা যাবে যে একজন মানুষের আত্মরক্ষার সহজাত প্রবৃত্তিতে এবং ভয় পেলে তার মাথা ঠিক কতোটা সন্দিহান হয়ে কাজ করে। এছাড়াও এমনও তো হতে পারে যে মহিলাটি নিলামের উপরের নাম্বারগুলোর অংশের মালিক এবং এতে করে তিনি হয়তো অর্থনৈতিক লোকসানের কথা ভেবেই আর জাহাজটি থামাতে রাজী হবেন না। মিস্টার বটিবোলের খেয়াল হোলো যে মানুষ আসলে ছয় হাজার ডলারের চেয়েও অনেক কম টাকার জন্যও তার বন্ধুদের খুন করে ফেলে পর্যন্ত। নিউজপেপারে এসব ঘটনার বিবরণ প্রতিদিনই দেখা যায়। যাইহোক না কেন কোন ভাবেই কোন সুযোগ নেওয়া যাবে না। যতদূর সম্ভব তোমার সব ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে নাও! খুব ভদ্রভাবে তার সাথে কথা বলার উপায় খুঁজে বের করো। আর এরপর যদি দেখা যায় যে মহিলাটি আসলেই খুব সদালাপী, দুয়ালু স্বভাবের মানুষ, তাহলে সবকিছু নিশ্চিত করেই তিনি হালকা মনে জাহাজ থেকে লাফ দিতে পারবেন। 

একেবারে উদ্দেশ্যহীনভাবে মিস্টার বটিবোল মহিলাটির দিকে এগিয়ে গিয়ে তার পাশে রেলে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। 

“হ্যালো!” তিনি সানন্দে বললেন। 

আশ্চর্য সুন্দরভাবে নারীটি ঘুরে দাঁড়িয়ে হাসলেন, সেটি ছিল অনেকটা প্রেমময় হাসির মতো যদিও নারীটির মুখমণ্ডল ছিল খুবই সাধাসিধে, তিনিও তাকে বললেন “হ্যালো!” 

প্রথম প্রশ্নটি করে পরীক্ষা করো, মিস্টার বটিবোল নিজেকেই বললেন। নারীটি অন্ধ বা বধির কিছুই ছিল না। 
তিনি সরাসরি বললেন, “আমাকে বলুন তো, গতকাল রাতের নিলামের ব্যাপারে আপনার কী মত?”

“ নিলাম?” নারীটি ভ্রুকুটি করে জিজ্ঞেস করলেন, “নিলাম? কীসের নিলাম?” 

“ আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে, গতরাতে ডিনারের পর লাউঞ্জে যেই হাস্যকর পুরানো ঘটনাটা ঘটেছে, প্রতিদিন জাহাজটি কতদূর এগোবে সেটা নিয়ে নাম্বার বিক্রির নিলাম। আপনি এটা নিয়ে আসলে কী ভাবছেন সেটা জানার আগ্রহ ছিল।”

তিনি মাথা ঝাঁকিয়ে আবারও হাসলেন, ভীষণ মধুর হাসি যেন তিনি এ ব্যাপারে ক্ষমা ভিক্ষা করছেন এমনভাবে।

“আমি খুবই অলস,” তিনি বললেন।

“আমি সত্যি খুব তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যাই। এমন কি রাতের খাবারও বিছানায় বসে বসে খাই। বিছানায় বসে ডিনার করাটা খুবই আরামের ব্যাপার।” 

মিস্টার বটিবাল তার উদ্দেশ্যে হাসলেন এবং দূরে সরে যেতে লাগলেন।

“যেতে হবে। এটা আমার ব্যায়াম করার সময়,” তিনি বললেন। 

“ভোরে আমি কখনো এক্সারসাইজ বাদ দেই না আপনার সাথে আলাপ হয়ে খুব ভালো লাগলো...” তিনি দশ কদম পিছিয়ে গেলেন, এবং নারীটি তার দিকে আর ফিরেও তাকালেন না। 

এখন সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। সমুদ্র খুব শান্ত, তিনি সাঁতারের হালকা পোশাক পড়েছেন, আটলান্টিকের এ দিকটায় কোন মানুষ খেকো হাঙর দেখা যায় না এবং সর্বোপরি এখানে এলারম বাজানোর জন্য একজন অত্যন্ত দয়ালু নারীটিও এখানে রয়েছেন। এখন প্রশ্ন একটাই যে জাহাজটি কি তার পক্ষে কাজ করতে গিয়ে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করবে কি না? নিশ্চিতভাবেই সেটা করবে। 

অন্য যে কোন ঘটনায়, তিনি নিজেকে অন্যভাবে খুব কমই সাহায্য করতে পারতেন। লাইফবোটে উঠে বসার ব্যাপারে তার বেশ কিছু অসুবিধা হতে পারে। বেশ কিছুক্ষণ সাঁতার কেটে তাদের কাছ থেকে অজান্তেই আরও দূরে চলে যেতে পারেন তিনি। যেহেতু তারা তার কাছে গিয়ে তাকে লাইফবোটে করে উঠিয়ে আনবে। প্রতিটি সেকেন্ড, প্রতিটি মিনিটিই তাকে তার উদ্দেশ্য সফল করতে সাহায্য করবে। আবারও তিনি রেইল বরাবর যেতে লাগলেন। কিন্তু এবার তাকে আরেকটি নতুন ভয় এসে আতংকে জর্জরিত করে দিলো। তিনি কি প্রোপেলারে আঁটকে পড়বেন? তিনি শুনেছেন বড় জাহাজ থেকে পড়ে গিয়ে অনেকের সাথেই এমন ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ব্যাপারটা হচ্ছে তিনি তো আর পড়ে যাচ্ছেন না, তিনি ঝাঁপ দিতে যাচ্ছেন এবং তা হচ্ছে খুবই ব্যাতিক্রমি একটি ঘটনা। আর এর শর্ত হচ্ছে প্রোপেলারের কাছ থেকে যতদূর সম্ভব দূরে ঝাঁপিয়ে পড়া। 

মিস্টার বটিবোল ধীরে ধীরে মহিলাটির কাছ থেকে ২০ গজ দূরের রেলের কাছে গিয়ে অবস্থান নিলেন। নারীটি এখন আর তার দিকে তাকাচ্ছে না। সেটা খুবই ভালো। তিনি চান না তার লাফিয়ে পড়ার দৃশ্য নারীটি দেখুক। যতক্ষণ না কেউ দেখতে পাবে ততই ভালো। কারণ তিনি পরবর্তীতে সবাইকে বলতে পারবেন যে তিনি দুর্ঘটনাবশত পিছলে পড়ে গেছেন। তিনি চোখ পিটপিট করে জাহাজের পাশের দিকটি দেখলেন। সেখানে বড় বড় গোল ড্রপ ছিল। আরও একটি ব্যাপার নিয়ে চিন্তা আসলো, সোজা হয়ে পানিতে পড়লে খুব খারাপভাবে তিনি তো আঘাতও পেতে পারেন। এমন কি কখনো হয়নি যে অনেক উঁচু থেকে লাফ দেওয়ার পড় তার পেটের ভেতরটা একেবারে ফাঁকা হয়ে গেছে? তাকে অবশ্যই সোজা ঝাঁপ দিয়ে হবে এবং আগে পাগুলোকে ফেলতে হবে। যাতে ছুরির মতো পানির ভেতরে প্রবেশ করতে পারে। হ্যাঁ জনাব! সমুদ্রের জলকে দেখে মনে হচ্ছে খুব ঠাণ্ডা, গভীর ও ধূসর! আর সে দিকে তাকিয়েই তিনি ভয়ে কেঁপে উঠলেন। কিন্তু কথা হচ্ছে হয় এটি এখনি করতে হবে অথবা আর কখনোই নয়। একজন প্রকৃত পুরুষ হয়ে ওঠো উইলিয়াম বটিবোল, প্রকৃত পুরুষ! তবে তাই হোক... এখনই লাফ দিলাম! 

তিনি উঁচু চওড়া কাঠের রেলে উঠলেন, সুস্থির হয়ে সেখানে একটু দাঁড়ালেন, পরবর্তী ভয়াবহ তিনটি সেকেন্ডের জন্য নিজের ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করলেন, এরপর তিনি লাফিয়ে পড়লেন এবং যতদূর তার পক্ষে যাওয়া সম্ভব ততদুরে তিনি “সাহায্য করো” বলে চিৎকার করতে করতে লাফিয়ে পড়লেন।

“সাহায্য করো! সাহায্য করো!” তিনি চিৎকার করতে করতে পড়ে গেলেন। এরপর তিনি পানিতে আছড়ে পড়লেন এবং তলিয়ে গেলেন। 

প্রথম যখন সাহায্য করো শব্দটি বাতাসে ভেসে আসলো সেই নারীটি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন যিনি রেলে হেলান দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি তাড়াতাড়ি চারদিকে তাকালেন এবং দেখলেন বাতাস কাঁটিয়ে কিছু একটা জলে গিয়ে পড়লো, শাদা শর্টস আর টেনিস জুতো পায়ে দেওয়া সেই ছোট্ট সাইজের ব্যক্তিটি চিৎকার করতে করতে ঝাঁপিয়ে পড়লো...। 

কিছুক্ষণের জন্য তার মনে হোলো তিনি কী করবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। একটি লাইফবেল্ট ছুঁড়ে মারবেন? দৌড়ে গিয়ে এলারম বাজাবেন? নাকি শুধু মাত্র ঘুরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করবেন? তিনি রেল থেকে সরে এসে অর্ধেক ঘুরে ব্রিজের ওপর দিয়ে দেখলেন এবং ক্ষণিকের জন্য স্থবির, চিন্তিত ও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগলেন। এরপর তৎক্ষণাৎ তাকে ভীষণ নির্ভার মনে হোলো এবং তিনি যেখানে জাহাজের গতিবেগের ঢেউয়ের স্রোত উপচে পড়ে সেদিকে ঝুঁকে তাকিয়ে রইলেন। তখনই একটি ছোট কালো মাথাকে সেই ফেনার ভেতর থেকে এক মুহূর্তের জন্য ভেসে উঠতে দেখা গেলো, তার ওপর দিয়ে একটি হাতকে তীব্রভাবে একবার, দুবার নড়তে দেখা গেলো এবং অনেক দূর থেকে খুব অস্পষ্ট কণ্ঠস্বরে কিছু বলতে শোনা গেলো যা এতদূর থেকে বোঝা সম্ভব নয়। সেই নারীটি তখনো রেকে ঝুঁকে সেদিকেই তাকিয়ে ছিল, চেষ্টা করছিলো দূর থেকেও কিছু বোঝা যায় কিনা সে দেখার, কিন্তু শিগ্রিই, খুব শিগ্রিই সেটা এতোই দূরে চলে গেলো যে তিনি আর বুঝতেই পারলেন না সেখানে আদৌ কিছু ছিল কী না? 

কিছুক্ষণ পর আরেকজন নারী ডেকের কাছে আসলেন। নারীটি খুব শুকনো ও চৌকোণ মুখের অধিকারী যিনি হাড়ের রীমের একটি চশমা পরে ছিলেন। তিনি প্রথম নারীটিকে খুঁজে পেয়ে তার কাছে আসলেন। তিনি মিলিটারি ফ্যাশনের কুমারী মেয়েদের মতো করে ইচ্ছাকৃতভাবে ডেকের উপর হাঁটছিলেন। 

“ ওহ তাহলে তুমি এখানে?” তিনি জানতে চাইলেন।


মোটা গোড়ালিওয়ালা নারীটি তার দিকে কোন কথা না বলে ফিরে তাকালেন। 

“ এদিকে আমি তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি, প্রত্যেকটি জায়গায় খুঁজে বেড়াচ্ছি।” হাড়সর্বস্ব নারীটি বললেন।

“জানো! এটা খুব অদ্ভুত ছিল!” মোটা গোড়ালিওয়ালা নারীটি বললেন। “একজন মানুষ তার পোশাক গায়ে দিয়েই চলন্ত জাহাজ থেকে এইমাত্র ঝাঁপ দিলো। 

“ যতসব ফালতু কথা!” 

“ সত্যি বলছি! তিনি বলছিলেন তিনি কিছুক্ষণ এক্সারসাইজ করতে চান আর তিনি এমনকি নিজের পোশাক না খুলেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন!” 

“ ভালো হয় যদি তুমি এখন নিচে নেমে আসো!” হাড়সর্বস্ব নারীটি বললো। 

হঠাৎ করেই তার মুখমণ্ডল দৃঢ়, তীক্ষ্ণ আর সতর্ক হয়ে উঠলো। তিনি আগেরচেয়েও রুক্ষস্বরে বললেন,-- 

“আর কক্ষনোই তুমি কিন্তু এভাবে একা একা ডেকে ঘোরাফেরা করবে না বলে দিচ্ছি। তুমি কিন্তু ভালো করেই জানো যে আমাকে ছাড়া তোমার কোথাও যাওয়া নিষেধ।” 

“ তা তো ঠিকই, ম্যাগি!” মোটা গোড়ালিওয়ালা নারীটি উত্তর দিলেন। তারপরেও হাড়সর্বস্ব নারীটির হাত পাকড়ে ধরে ডেক ছেড়ে যেতে যেতে তিনি হাসলেন, ভীষণ কোমল-মোলায়েম ও সহানুভুতির হাসি! 

“ আহা! বড় ভালো ছিল লোকটি!” তিনি বললেন।

“ আমাকে দেখে হাত নাড়ছিলেন।” 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ