![]() |
‘দেহ মাগীর বিগার দেহ। আশ্বিন যায়, তবু ত্যাজনি কমে। শইলডা ভরা খালি ত্যাজ আর ত্যাজ। বানেও ত্যাজ, ভাটায়ও ত্যাজ। একবার ফাইতাম তোরে হাতের মুইডো। দেখতাম, অত ত্যাজ রাহস কই’- আপন মনে বকে নৌকা বেয়ে চলে সন্তোষী।
রোদে খাঁ খাঁ করছে চারদিক। ক্ষেপাটে ঘোড়ার মত বইছে বাতাস। শনি ফুলে ফেঁপে ওঠছে। তালে তালে দুলছে নৌকা। ঢেউয়ের বায়ে সন্তোষী তাল হারায়। শক্ত হাতে বৈঠা টেনে ধরে। খেঁকিয়ে ওঠে। ‘ছিনালের ঘরের ছিনাল, তোর ত্যাজরে সন্তুষী ডরায়? ডরায় না। তোরে যারা ডরায় তুই হেরার কাছে যা। আমারে ডর দেহাইয়া লাভ নাই, ডরের দিন শেষ।’ সন্তোষী বৈঠাখানা ডানপাশ থেকে বামপাশ, বামপাশ থেকে ডানপাশ করে। গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে শনির পাক থেকে নৌকা নিয়ে ফিরে। পাড় ঘেষে ভেসে যায়। কখনো বৈঠা হাতে নতমুখে জলকে দেখে। কখনোবা আকাশ দেখে।
উপরে আসমান নিচে দরিয়া। সন্তোষী ভেসে যায়। স্মৃতির ভেলা ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
তখন বৈশাখের মাঝামাঝি। ধানের শিষে রঙ লেগেছে। পালা করে কৃষকরা জমিতে যাচ্ছে। শেষ প্রহরে যাচ্ছে। ফিরছে সন্ধ্যায়। ধান কাটতে হবে তাড়াতাড়ি। শঙ্কা চারদিকে। ঝড়ের মৌসুম। একবার বৃষ্টি শুরু হলে থামার জো নেই। চারদিকে সেবার ধান আর ধান। বৈতালী হাওয়ায় সোনাধানের ঘ্রাণ। নয়াধান।
নিবারণের ছিল কাঠা দশেক জমি। পরপর তিন বছর একমণ ধানও ঘরে তুলতে পারেনি। বেপারী দিয়ে ধান কাটানোর সাধ্য নেই তার। থাকার মধ্যে আছে একটা বউ। ঠাকুরাকোনার মেয়ে। ধান কাটেনি কোনদিন। তবু ধান বাঁচাতে গিয়ে কাচি নেয় হাতে। দুইজনে মিলে কিছু ধান কাটলেও ঘরে তুলতে পারেনি ক’বছর। সব চলে গেছে রাক্ষুসীর পেটে। তবে এবার ধানে টুইটুম্বুর। মেঠো হাওরে সুখের বাতাস। সুখে মাতোয়ারা কৃষকের মন।
যতদূর চোখ যায় শুধু ধান আর ধান। এ ধান ঘরে এলে চাঁদনী পসর। না এলে অমাবস্যা। যে অমাবস্যা একবার নেমে এলে চলে বছরভর। চারদিকে তখন খিদে আর কান্না ছাড়া কিছু থাকেনা।
কয়েকদিন খুব বৃষ্টি গেল। নদী ভরভর। কৃষকদের হৃদয়ে দামামা বাজছিল। এবারও বুঝি সব গেল কিন্তু পলকেই ঘনঘোর মেঘ গিয়েছে পালিয়ে। সোনারোদে ছেয়ে গেছে চারদিক। হুগলার শাখায় ঝলমল করছে দুধসাদা নাকফুল। জমিতে জল জমেছে। সেই সুখেতে পানকৌড়িরা হুমরি খেয়ে পড়েছে। ধূসর রঙা লেজ উঁচিয়ে টুপ করে ডুব দিয়ে ওঠে। আশা জাগানিয়া রোদ স্বপ্ন ছড়িয়ে দিয়েছে হাওর পাড়ে। কৃষকেরা নাওয়া খাওয়া ছেড়ে ধান কাটতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে।
তিন কাঠা জমির ধান আজ নিবারণ একাই কেটে ফেলেছে। সন্তোষী মাথায় করে বয়ে নিয়ে এসেছে ধান। গোপন আনন্দে নিবারণ আত্মহারা। অনটনের দিনগুলোতে যে বউয়ের সাথে দুটো ভালো করে কোথাও বলেনি। গাঁজায় বুদ হয়ে থেকেছে। নিশাচর পাখীরমত ঘুরে বেরিয়েছে। স্ত্রী সন্তান খেলো না উপোস গেলো খোঁজও রাখেনি। সেই নিবারণ ভাত খেয়ে আজ বাইরে যায়না। চকিতে উঠে বসে। ঘুমন্ত কন্যার চুলে হাত বুলায়। মিটিমিটি হাসে। নরম স্বরে স্ত্রীকে ডেকে ওঠে।
-সন্তষী ও সন্তষী । ধান উঠলে আর চিন্তা কিতা?
সন্তোষী কথায় সায় দিতে দিতে এঁটো থালাবাসন তুলে নিয়ে বাইরে বের হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর ফিরে আসে গোবর আর মাটি নিয়ে। এঁটো মাটিতে গোবর ছিটিয়ে দেয়। নিবারণ বলে যায়।
-ধান কাইট্টা কাহিল অইয়া গেছিরে। একটু ঘুমান লাগবো।
- ঘুমাইন।
-চিন্তা অয়রে। দিনের ভাও বালানা।
-হু
-কততবছর পরে কয়ডা ধান! বাবা মরণের পরে অত ধান আর দেখছিনা। আতুরগরে আহ্লাদীর কান্দন হুইন্যা যেমন ভালা লাগছিন আইজ এমনই লাগদাসে।
মেয়ের জন্মের সময় যে নিবারণের এত আনন্দ হয়েছিল এই কথা সন্তোষী আজ প্রথম শুনলো। ইচ্ছে করছে কড়া দু’কথা শুনিয়ে দিতে। সারাদিন ধান টেনে, রান্না করে, মেয়েকে খাইয়ে, ঘরকন্নার কাজ করে করে সে নিজেও ক্লান্ত। তাই বলতে গিয়েও ইচ্ছে হয়না। ঘর নিকানোতে মন দেয়। সন্তোষীর ব্যস্ততা দেখে নিবারণের রাগ হয়। আজ অনেকদিন পর তার কথা বলতে ইচ্ছে করছে। ধানের কথা, সুখের কথা, সংসারের কথা।
-তা রাইত বিরাইতে এত লেপালেপির কিতা অইছে? তাত্তারি ঘুমাইলে ভালা হইতো।
-লেইপ্পা রাখলাম। নতুন ধান ভিটায়। লক্ষ্মী ঠাকুরাইন কহন কার ঘরে হাঁটাচলা শুরু করুইন। গরিবের ঘরে পাও রাখলে দেখবাইননে, সন্তোষী হেইনরে কলা বাতাসা না দিত পারলেও নিয়ম নিষ্ঠায় কোন কমতি করে না।
নিবারণ কথা বাড়ায় না। মেয়েকে আগলে শুয়ে থাকে। এঁটো বাসন ধুয়ে, গুছিয়ে, দুয়ারে খিল এঁটে সন্তোষী বিছানায় আসে। মাকে কাছে পেয়ে মেয়েটি চুকচুক শব্দ তুলে।
-ঘুমান নাই?
- হুম! তোরারে ঠিকমত খাওয়াইতে পিন্দাইতে পারি না!
-গোলায় ধান ওঠুক! কয়ডা ধান তুইল্যা গপ্প জুরছুইন। অহন ঘুমাইন।
- দুঃখে দুঃখে তিতা হইয়া গেলামরে। জলের লগে যুদ্ধে মন লয় না। শরীরও দেয় না! এইবার কষ্ট সব শেষ হইবো মন কয়। ধান ঘরে আইলে খোরাকি অইবো। কিছু বেচনও যাইবো। খালি শয়তান যাতে না ক্ষেপে।
-রাত বিরাইতে লক্ষ্মীছাড়া কথা! খেপলে সব দিব ভাসাইয়া!
- কয়ডা বছর দইরা পেট ভইরা খাইতে পাইনা। তুই ছিরা শাড়ি পিইন্দা ঘুরস। ছেরিডার শইল বাড়ে না!
-আইচ্ছা, ঘুমাইন।
-ডর লাগেরে!
-আহ্লাদির বাপ, মন ডাহে, ফসল এইবার ওঠবো। ডরাইন না যে। ধান উঠলে আফনের দুইটা লুঙ্গি কিনবাইন। আইচ্ছা, আবুর দুইটা নূপুর বানান যাইবো?
-যাইবো। আবুর নূপুর আর তোর শাড়ি
সন্তোষী ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে। কত দুখের দিন গেছে। আজ ক্ষেতভরা ধান। দুইটা দিন যদি পায় তবে চিন্তা নেই। এই আশা আর শঙ্কার কথা বলতে বলতে দুজন ঘন হয়ে আসে। হাওরের আকাশে চাঁদ তখন মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলায় মেতেছে।
বাইরে এলোপাথারি চিৎকার। নিভু বাতিতে দেখা যায় না কিছু। দুজনেই হুরমুর করে ওঠে বসে। নিবারণ ঝড়ের বেগে ছুটে বাইরে যায়। সন্তোষী যায় পিছু। এমন সময় আহ্লাদি কেঁদে উঠে, সন্তোষী ঘরে যায়। মেয়েকে নিয়ে ছুটে যায় পাশের ঘরে। মালতী রানী একা। ফসল ডোবা ঠেকাতে পীর শাহ আরেফিন কে ডাকছে। সন্তোষী বৃদ্ধার পাশে আহ্লাদীকে শুইয়ে দেয়।
-খুড়িমা, ধান কাটতে যাই। আহ্লাদিরে রাইখা গেলাম। দেহুইন যে।
- যাও! কিন্তু চোহে দেহি না ভালা! ওইঠ্যা কান্দা শুরু করলে তো সামলাইতাম পারতাম না বউ।
- জাগলে একটু ভাত চটকাইয়া দেইনযে। খিদা না থাকলে বিরক্ত করতো না। সব মন অয় ভাইসা গেলো গো।
- যাও মা। দোহাই শারফিন। যা দেহনের হেইন দেখবাইননে। ফিইরো তাড়াতাড়ি। আমার উপরে ভরসা কইরো না মা। আমি তো ঠাওর পাই না জানো।
ঝড়ো হাওয়ার মত ছুটে যায় সন্তোষী।
কালঘুম। কিচ্ছুটি টের পেলো না। কাচি, দা নিয়ে যে যার মত চলে গেছে। নিবারণকে কেও ডাকলো না! অবশ্য ডাকবেই কে? কে ঘরে, কে বাইরে কার খোঁজ কে রেখেছে। শনির পাকে সবাই হাবুডুবু খাচ্ছে। চারদিকে সবাই ছুটছে।
এক নাগাড়ে বৃষ্টি চলছে। আফর উপচে নদীর জল হাওরে ঢুকে যাচ্ছে। একটি পানকৌড়িও ক্ষেতে নেই। হুগলা ফুল ভিজে একাকার। একখানা কালো চাঁদরে ঢেকে গেছে আকাশ। দ্রুমদ্রুম গর্জে উঠছে মেঘ। প্রাণপনে সকলে ধান কাটছে। যে কোন সময় বাঁধ ভেঙ্গে যেতে পারে। সন্তোষী নিবারণের কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে জল কোমর সমান হয়ে যায়। নিবারণ ডুবে ডুবে ধান কাটছে। মাছের মতো মানুষ চারদিকে। ডুবছে আর ভাসছে। ধান কাটছে। আঁটি বাঁধছে। যারা পারছে নৌকায় করে ডাঙায় রেখে আসছে। জলময় জমিতে কাচি আর ধান। সবাই সবার অচেনা। যে পারছে নিজের ধান কাটছে। যে পারছে পরের ধান কাটছে। নয়নভাগা চলছে এখন। যেই ধান কাটবে তার ভাগেই সব।
ভোর থেকে ভিজতে ভিজতে ক্লান্ত হয় সন্তোষী। নিশ্বাস নিতে গিয়ে টের পায় ঠোঁটে কিছু একটা সেঁটে আছে। ‘ওমা!’ শক্ত মোটা একটা জোঁক! এক ঝটকায় সেটিকে ছুঁড়ে দেয় শনির জলে ! নিবারণ ধানের গুছি হাতে জলের উপরে ভাসে।
-রক্ত! কিতায় কামড়াইছে ? হাপ?
-হাপ না জোঁক! পারতাছি না আহ্লাদির বাপ! আর পারতাছিনা! দম পাইনা, ঠোঁট জ্বলে, বুক জ্বলে।
আইচ্ছা। তোর কাডন লাগদোনা। তুই যা, নাউ লইয়া আয়। বাও বালানা, বান ভাইঙ্গা গেলে সব শেষ। তাড়াতাড়ি যা।
নিবারণ ধান কাটে। সন্তোষী নৌকায় বসে আঁটি বাঁধে। বুক সমান জল। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে নেতিয়ে গেছে শরীর। হাত টনটন করছে। টনটন করছে কোমর। পা দুটো ফুলে ঢোল। ভাঁজে ভাঁজে জ্বলছে সন্তোষীর উরু। কিছু একটা পিলপিল করছে। বেয়ে বেয়ে ওঠছে। বৃষ্টির ছাঁটে চারদিক ঝাপসা। সবাই ব্যস্ত। সন্তোষী হাত বুলায়। চার পাঁচটা জোঁক। উরুতে আটকে গেছে। রক্ত খেয়ে ঢোল, নড়তে পারছে না। সন্তোষী আৎকে ওঠে! নিবারণ ডুব দিয়ে নৌকা ধরে দাঁড়িয়েছে মাত্র। সন্তোষী চিৎকার করে। নিবারণ রেগে যায়।
- ঐ চিল্লাস কেরে।
- জোঁক!
- জোঁক আর দেকছস না মাগী। লিলা করছ ? ধর, মুইট ধর।
সন্তুষী ধানের শিষ কটা নিয়ে নৌকায় রাখে। মন শক্ত করে। উরুতে বসে থাকা জোঁক চিমটি দিয়ে ফেলে দেয় শনির বুকে। জলের দেখা পেয়ে ওরা কিলবিলিয়ে চলে যায়।
হৈহৈ রৈরৈ। আহম্মক খালীর বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। চোখের পলকে জল ঢুকে একাকার। কোথায় জমি, কোথায় বাজার। যেদিকে তাকাও জল আর জল। ফসল সব জলের গর্ভে। কাচি দাঁ ফেলে কৃষকরা নৌকায় ওঠে আসে। নিবারণও আসে। রক্তখেঁকো জোকগুলো ঘাপটি মেরে পড়ে থাকে আঙ্গুলের ফাঁকে ফাঁকে। নিবারণ নড়ে না। নিথর দৃষ্টি জল জুড়ে ধান খুঁজে ফেরে। সোনা ধান ভেসে যায়। জলের নীচে ডুবে যায়রে, ডুবে যায়!
কত কষ্টের ধান! কত গুলো দিন! রোয়া বুনলো। চোখের সামনে একটু একটু করে বড় হল। ধান গজালো। কাঁচা ধান সোনা হল। রাতের পর রাত কাটিয়ে দিল এই ধানের আশায়। মূহূর্তেই সব তলিয়ে গেলো! অন্ধ বধির অপয়া লক্ষ্মী। এ কোন অনাচার! নিবারণের চোখের জল ঝরঝর ঝরে পরে। ইচ্ছে করে দুহাত দিয়ে হাওরের সব জল সেচে দিতে।
- ‘শনিরে শনি! একটু সময় দিলি না!’
ঢেউয়ের পরে ঢেউ আসছে। নিবারণ নৌকা ভিড়াচ্ছে না!
- আবুর বাপ, জলদি চলেন!
নিবারণ তাকায় না। বৈঠা নেয় না। সে কাচি নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। সন্তোষী ডুকরে ওঠে।
- অত রাইতে কই যাইন আহ্লাদির বাপ? পাগলনি!
- ধান ডুবনের দিতাম না। নাউডা লইয়া তুই আমার লগে আয়। অতসহজে ধান দিতাম না।
এত জলে কেও কোনদিন ধান খুঁজে পায় না। ধান পাবার সময়ও এটা নয়। নিছক নিবারণের পাগলামী। স্রোতের সাথে শরীরের নিস্ফল যুদ্ধ। বৃথায় উন্মাদের মতো ধান খুঁজে বেড়ায় নিবারণ। স্রোতে ভাসতে ভাসতে নিবারণ খড়কুটোর সাথে ভেসে যায়।
সন্তোষী নিজেও বুঝতে পারেনা সে কোথায়। কোথায় বা তাদের জমি। নৌকাটাই বা কোথায় ভেসে যাচ্ছে! পাগলের মত সে স্বামীকে খোঁজে। ডাকে। ঝড়ো বাতাসে তার ডাক উড়ে যায়। চারদিকে শোকের বিলাপ। প্রাণ বাঁচাতে সকলে নৌকা নিয়ে ফিরছিল। তাই কে ওঠলো, কে ডুবলো, সে খেয়াল কেও করেনি।
সন্তোষী যাকে পায় তাকে জিজ্ঞাসা করে। কেউ মনে করতে পারে না কখন নিবারণকে শেষ দেখেছিল। তবু তারা মনে করবার চেষ্টা করে। হাঁক ছেড়ে ডাকে।
-নিবারণরে......নি...বা....র....ণ
শনির তর্জন গর্জনের কাছে কাকভেজা মানুষগুলোর কন্ঠস্বর এক পসলা বৃষ্টির মতো উধাও হয়ে যায়।
ঝড় থেমে গেছে। হাওর এখন শান্ত। সন্তোষী নৌকা নিয়ে ফিরে এসেছে। আসেনি নিবারণ। নিবারণের নিখোঁজের খবর এরই মধ্যে গ্রামে ছড়িয়ে গেছে। এক এক করে সবাই জড়ো হচ্ছে তাদের উঠানে। সন্তোষীকে ঘিরে বসে আছে সবাই।
সন্তোষী একধ্যানে শনির হাওরের দিকে তাকিয়ে থাকে। পড়শিরা সন্তোষীর পিঠে, চুলে হাত বুলায়। সান্ত্বনা দেয়।
-বউরে, মন শক্ত কর। আহ্লাদি আছে। তারে কেডা দেখবো? ওঠ, যাও কাপড় বদলাও। ভিজা শইল, জ্বরটর আইবো।
এতক্ষণ পর সন্তোষীর মেয়ের কথা মনে হয়। মেয়ের নাম ধরে বিলাপ করে ওঠে।
ওরেরররররররর আহ্লাদী। তোর বাপ কই গেল? তোমরা কেডা আছ, বাছারে একটু আমার কোলে দেও। আহ্লাদীরেরেরেরে.....
আহ্লাদী কইরে? অভাগীর কোলে আইন্যা দে ছেরিডারে। কি গো খুড়ীমা আহ্লাদী কই?
ভাত খাইয়া তো ঘরের মধ্যে পুতলি লইয়া খেলতাছিন। যাওছেন কেও। একটু আইনা দেও।
বৃদ্ধার কথা শেষ হতে না হতেই একজন দৌড়ে যায় ঘরে । কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে আসে।
চহির নিচে, ডোলার নীচে, রান্দা ঘর সব দেখলাম। আহ্লাদীতো নাই ঠাম্মা।
মা গো মা! আমার, ছেরি কই? কেডা নিছ আমার ছেরিরে? কেও কথা কও না কেরে? আমার আহ্লাদী কই? জেঠী মা............মাগো……...আমার ছেরিরে দেইন................আফনের পাও ধরি আমার ছেরি.........
মালতী রানী ঠকঠক করে কাঁপছে। কয়েকজন ধরাধরি করে তাকে ঘরে রেখে আসে। সবাই নিবারণের কথা ভুলে গিয়ে আহ্লাদীকে খোঁজে। সবেমাত্র হাঁটতে শিখেছে। অজানা ভয়ে সকলে কুঁকরে যায়। ধানের কষ্ট, নিবারণের কষ্ট, আহ্লাদীর কষ্ট সব মিলিয়ে অমাবস্যার চেয়ে অন্ধকার নেমে আসে শনিরপাড়ে। টানা ঝড়ের রাত ঘুটঘুটে অন্ধকারের চাইতেও কালো মনে হয়।
ভেজা আকাশে সূর্য উঁকি দিচ্ছে। কারো তখনো ঘুম ভাঙেনি। কারো কারো ঘুম আসেইনি। হঠাৎ সুনীল দাশের চিৎকার।
আইলা নাগো তোমরা? এই যে আহ্লাদী।
কেউ একজন বলে উঠে, এইযে পাওয়া গেছে। এই টুকু শুনেই কেও উলু দিল। কেও শাহ্ আরফিনের দরগায় মোম জ্বালাবে বলে দুহাত কপালে ঠেকায়। কেও কেও হরির নাম করে করে ছুটে যায়।
সুনীল দাশ হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে পৈতা ধরে বিরবির করছে। সামনে আহ্লাদী। মৃদু ঢেউয়ে কুলকুল করে ভাসছে।
রোদে খাঁ খাঁ করছে চারদিক। ক্ষেপাটে ঘোড়ার মত বইছে বাতাস। শনি ফুলে ফেঁপে ওঠছে। তালে তালে দুলছে নৌকা। ঢেউয়ের বায়ে সন্তোষী তাল হারায়। শক্ত হাতে বৈঠা টেনে ধরে। খেঁকিয়ে ওঠে। ‘ছিনালের ঘরের ছিনাল, তোর ত্যাজরে সন্তুষী ডরায়? ডরায় না। তোরে যারা ডরায় তুই হেরার কাছে যা। আমারে ডর দেহাইয়া লাভ নাই, ডরের দিন শেষ।’ সন্তোষী বৈঠাখানা ডানপাশ থেকে বামপাশ, বামপাশ থেকে ডানপাশ করে। গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে শনির পাক থেকে নৌকা নিয়ে ফিরে। পাড় ঘেষে ভেসে যায়। কখনো বৈঠা হাতে নতমুখে জলকে দেখে। কখনোবা আকাশ দেখে।
উপরে আসমান নিচে দরিয়া। সন্তোষী ভেসে যায়। স্মৃতির ভেলা ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
তখন বৈশাখের মাঝামাঝি। ধানের শিষে রঙ লেগেছে। পালা করে কৃষকরা জমিতে যাচ্ছে। শেষ প্রহরে যাচ্ছে। ফিরছে সন্ধ্যায়। ধান কাটতে হবে তাড়াতাড়ি। শঙ্কা চারদিকে। ঝড়ের মৌসুম। একবার বৃষ্টি শুরু হলে থামার জো নেই। চারদিকে সেবার ধান আর ধান। বৈতালী হাওয়ায় সোনাধানের ঘ্রাণ। নয়াধান।
নিবারণের ছিল কাঠা দশেক জমি। পরপর তিন বছর একমণ ধানও ঘরে তুলতে পারেনি। বেপারী দিয়ে ধান কাটানোর সাধ্য নেই তার। থাকার মধ্যে আছে একটা বউ। ঠাকুরাকোনার মেয়ে। ধান কাটেনি কোনদিন। তবু ধান বাঁচাতে গিয়ে কাচি নেয় হাতে। দুইজনে মিলে কিছু ধান কাটলেও ঘরে তুলতে পারেনি ক’বছর। সব চলে গেছে রাক্ষুসীর পেটে। তবে এবার ধানে টুইটুম্বুর। মেঠো হাওরে সুখের বাতাস। সুখে মাতোয়ারা কৃষকের মন।
যতদূর চোখ যায় শুধু ধান আর ধান। এ ধান ঘরে এলে চাঁদনী পসর। না এলে অমাবস্যা। যে অমাবস্যা একবার নেমে এলে চলে বছরভর। চারদিকে তখন খিদে আর কান্না ছাড়া কিছু থাকেনা।
কয়েকদিন খুব বৃষ্টি গেল। নদী ভরভর। কৃষকদের হৃদয়ে দামামা বাজছিল। এবারও বুঝি সব গেল কিন্তু পলকেই ঘনঘোর মেঘ গিয়েছে পালিয়ে। সোনারোদে ছেয়ে গেছে চারদিক। হুগলার শাখায় ঝলমল করছে দুধসাদা নাকফুল। জমিতে জল জমেছে। সেই সুখেতে পানকৌড়িরা হুমরি খেয়ে পড়েছে। ধূসর রঙা লেজ উঁচিয়ে টুপ করে ডুব দিয়ে ওঠে। আশা জাগানিয়া রোদ স্বপ্ন ছড়িয়ে দিয়েছে হাওর পাড়ে। কৃষকেরা নাওয়া খাওয়া ছেড়ে ধান কাটতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে।
তিন কাঠা জমির ধান আজ নিবারণ একাই কেটে ফেলেছে। সন্তোষী মাথায় করে বয়ে নিয়ে এসেছে ধান। গোপন আনন্দে নিবারণ আত্মহারা। অনটনের দিনগুলোতে যে বউয়ের সাথে দুটো ভালো করে কোথাও বলেনি। গাঁজায় বুদ হয়ে থেকেছে। নিশাচর পাখীরমত ঘুরে বেরিয়েছে। স্ত্রী সন্তান খেলো না উপোস গেলো খোঁজও রাখেনি। সেই নিবারণ ভাত খেয়ে আজ বাইরে যায়না। চকিতে উঠে বসে। ঘুমন্ত কন্যার চুলে হাত বুলায়। মিটিমিটি হাসে। নরম স্বরে স্ত্রীকে ডেকে ওঠে।
-সন্তষী ও সন্তষী । ধান উঠলে আর চিন্তা কিতা?
সন্তোষী কথায় সায় দিতে দিতে এঁটো থালাবাসন তুলে নিয়ে বাইরে বের হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর ফিরে আসে গোবর আর মাটি নিয়ে। এঁটো মাটিতে গোবর ছিটিয়ে দেয়। নিবারণ বলে যায়।
-ধান কাইট্টা কাহিল অইয়া গেছিরে। একটু ঘুমান লাগবো।
- ঘুমাইন।
-চিন্তা অয়রে। দিনের ভাও বালানা।
-হু
-কততবছর পরে কয়ডা ধান! বাবা মরণের পরে অত ধান আর দেখছিনা। আতুরগরে আহ্লাদীর কান্দন হুইন্যা যেমন ভালা লাগছিন আইজ এমনই লাগদাসে।
মেয়ের জন্মের সময় যে নিবারণের এত আনন্দ হয়েছিল এই কথা সন্তোষী আজ প্রথম শুনলো। ইচ্ছে করছে কড়া দু’কথা শুনিয়ে দিতে। সারাদিন ধান টেনে, রান্না করে, মেয়েকে খাইয়ে, ঘরকন্নার কাজ করে করে সে নিজেও ক্লান্ত। তাই বলতে গিয়েও ইচ্ছে হয়না। ঘর নিকানোতে মন দেয়। সন্তোষীর ব্যস্ততা দেখে নিবারণের রাগ হয়। আজ অনেকদিন পর তার কথা বলতে ইচ্ছে করছে। ধানের কথা, সুখের কথা, সংসারের কথা।
-তা রাইত বিরাইতে এত লেপালেপির কিতা অইছে? তাত্তারি ঘুমাইলে ভালা হইতো।
-লেইপ্পা রাখলাম। নতুন ধান ভিটায়। লক্ষ্মী ঠাকুরাইন কহন কার ঘরে হাঁটাচলা শুরু করুইন। গরিবের ঘরে পাও রাখলে দেখবাইননে, সন্তোষী হেইনরে কলা বাতাসা না দিত পারলেও নিয়ম নিষ্ঠায় কোন কমতি করে না।
নিবারণ কথা বাড়ায় না। মেয়েকে আগলে শুয়ে থাকে। এঁটো বাসন ধুয়ে, গুছিয়ে, দুয়ারে খিল এঁটে সন্তোষী বিছানায় আসে। মাকে কাছে পেয়ে মেয়েটি চুকচুক শব্দ তুলে।
-ঘুমান নাই?
- হুম! তোরারে ঠিকমত খাওয়াইতে পিন্দাইতে পারি না!
-গোলায় ধান ওঠুক! কয়ডা ধান তুইল্যা গপ্প জুরছুইন। অহন ঘুমাইন।
- দুঃখে দুঃখে তিতা হইয়া গেলামরে। জলের লগে যুদ্ধে মন লয় না। শরীরও দেয় না! এইবার কষ্ট সব শেষ হইবো মন কয়। ধান ঘরে আইলে খোরাকি অইবো। কিছু বেচনও যাইবো। খালি শয়তান যাতে না ক্ষেপে।
-রাত বিরাইতে লক্ষ্মীছাড়া কথা! খেপলে সব দিব ভাসাইয়া!
- কয়ডা বছর দইরা পেট ভইরা খাইতে পাইনা। তুই ছিরা শাড়ি পিইন্দা ঘুরস। ছেরিডার শইল বাড়ে না!
-আইচ্ছা, ঘুমাইন।
-ডর লাগেরে!
-আহ্লাদির বাপ, মন ডাহে, ফসল এইবার ওঠবো। ডরাইন না যে। ধান উঠলে আফনের দুইটা লুঙ্গি কিনবাইন। আইচ্ছা, আবুর দুইটা নূপুর বানান যাইবো?
-যাইবো। আবুর নূপুর আর তোর শাড়ি
সন্তোষী ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে। কত দুখের দিন গেছে। আজ ক্ষেতভরা ধান। দুইটা দিন যদি পায় তবে চিন্তা নেই। এই আশা আর শঙ্কার কথা বলতে বলতে দুজন ঘন হয়ে আসে। হাওরের আকাশে চাঁদ তখন মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলায় মেতেছে।
বাইরে এলোপাথারি চিৎকার। নিভু বাতিতে দেখা যায় না কিছু। দুজনেই হুরমুর করে ওঠে বসে। নিবারণ ঝড়ের বেগে ছুটে বাইরে যায়। সন্তোষী যায় পিছু। এমন সময় আহ্লাদি কেঁদে উঠে, সন্তোষী ঘরে যায়। মেয়েকে নিয়ে ছুটে যায় পাশের ঘরে। মালতী রানী একা। ফসল ডোবা ঠেকাতে পীর শাহ আরেফিন কে ডাকছে। সন্তোষী বৃদ্ধার পাশে আহ্লাদীকে শুইয়ে দেয়।
-খুড়িমা, ধান কাটতে যাই। আহ্লাদিরে রাইখা গেলাম। দেহুইন যে।
- যাও! কিন্তু চোহে দেহি না ভালা! ওইঠ্যা কান্দা শুরু করলে তো সামলাইতাম পারতাম না বউ।
- জাগলে একটু ভাত চটকাইয়া দেইনযে। খিদা না থাকলে বিরক্ত করতো না। সব মন অয় ভাইসা গেলো গো।
- যাও মা। দোহাই শারফিন। যা দেহনের হেইন দেখবাইননে। ফিইরো তাড়াতাড়ি। আমার উপরে ভরসা কইরো না মা। আমি তো ঠাওর পাই না জানো।
ঝড়ো হাওয়ার মত ছুটে যায় সন্তোষী।
কালঘুম। কিচ্ছুটি টের পেলো না। কাচি, দা নিয়ে যে যার মত চলে গেছে। নিবারণকে কেও ডাকলো না! অবশ্য ডাকবেই কে? কে ঘরে, কে বাইরে কার খোঁজ কে রেখেছে। শনির পাকে সবাই হাবুডুবু খাচ্ছে। চারদিকে সবাই ছুটছে।
এক নাগাড়ে বৃষ্টি চলছে। আফর উপচে নদীর জল হাওরে ঢুকে যাচ্ছে। একটি পানকৌড়িও ক্ষেতে নেই। হুগলা ফুল ভিজে একাকার। একখানা কালো চাঁদরে ঢেকে গেছে আকাশ। দ্রুমদ্রুম গর্জে উঠছে মেঘ। প্রাণপনে সকলে ধান কাটছে। যে কোন সময় বাঁধ ভেঙ্গে যেতে পারে। সন্তোষী নিবারণের কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে জল কোমর সমান হয়ে যায়। নিবারণ ডুবে ডুবে ধান কাটছে। মাছের মতো মানুষ চারদিকে। ডুবছে আর ভাসছে। ধান কাটছে। আঁটি বাঁধছে। যারা পারছে নৌকায় করে ডাঙায় রেখে আসছে। জলময় জমিতে কাচি আর ধান। সবাই সবার অচেনা। যে পারছে নিজের ধান কাটছে। যে পারছে পরের ধান কাটছে। নয়নভাগা চলছে এখন। যেই ধান কাটবে তার ভাগেই সব।
ভোর থেকে ভিজতে ভিজতে ক্লান্ত হয় সন্তোষী। নিশ্বাস নিতে গিয়ে টের পায় ঠোঁটে কিছু একটা সেঁটে আছে। ‘ওমা!’ শক্ত মোটা একটা জোঁক! এক ঝটকায় সেটিকে ছুঁড়ে দেয় শনির জলে ! নিবারণ ধানের গুছি হাতে জলের উপরে ভাসে।
-রক্ত! কিতায় কামড়াইছে ? হাপ?
-হাপ না জোঁক! পারতাছি না আহ্লাদির বাপ! আর পারতাছিনা! দম পাইনা, ঠোঁট জ্বলে, বুক জ্বলে।
আইচ্ছা। তোর কাডন লাগদোনা। তুই যা, নাউ লইয়া আয়। বাও বালানা, বান ভাইঙ্গা গেলে সব শেষ। তাড়াতাড়ি যা।
নিবারণ ধান কাটে। সন্তোষী নৌকায় বসে আঁটি বাঁধে। বুক সমান জল। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে নেতিয়ে গেছে শরীর। হাত টনটন করছে। টনটন করছে কোমর। পা দুটো ফুলে ঢোল। ভাঁজে ভাঁজে জ্বলছে সন্তোষীর উরু। কিছু একটা পিলপিল করছে। বেয়ে বেয়ে ওঠছে। বৃষ্টির ছাঁটে চারদিক ঝাপসা। সবাই ব্যস্ত। সন্তোষী হাত বুলায়। চার পাঁচটা জোঁক। উরুতে আটকে গেছে। রক্ত খেয়ে ঢোল, নড়তে পারছে না। সন্তোষী আৎকে ওঠে! নিবারণ ডুব দিয়ে নৌকা ধরে দাঁড়িয়েছে মাত্র। সন্তোষী চিৎকার করে। নিবারণ রেগে যায়।
- ঐ চিল্লাস কেরে।
- জোঁক!
- জোঁক আর দেকছস না মাগী। লিলা করছ ? ধর, মুইট ধর।
সন্তুষী ধানের শিষ কটা নিয়ে নৌকায় রাখে। মন শক্ত করে। উরুতে বসে থাকা জোঁক চিমটি দিয়ে ফেলে দেয় শনির বুকে। জলের দেখা পেয়ে ওরা কিলবিলিয়ে চলে যায়।
হৈহৈ রৈরৈ। আহম্মক খালীর বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। চোখের পলকে জল ঢুকে একাকার। কোথায় জমি, কোথায় বাজার। যেদিকে তাকাও জল আর জল। ফসল সব জলের গর্ভে। কাচি দাঁ ফেলে কৃষকরা নৌকায় ওঠে আসে। নিবারণও আসে। রক্তখেঁকো জোকগুলো ঘাপটি মেরে পড়ে থাকে আঙ্গুলের ফাঁকে ফাঁকে। নিবারণ নড়ে না। নিথর দৃষ্টি জল জুড়ে ধান খুঁজে ফেরে। সোনা ধান ভেসে যায়। জলের নীচে ডুবে যায়রে, ডুবে যায়!
কত কষ্টের ধান! কত গুলো দিন! রোয়া বুনলো। চোখের সামনে একটু একটু করে বড় হল। ধান গজালো। কাঁচা ধান সোনা হল। রাতের পর রাত কাটিয়ে দিল এই ধানের আশায়। মূহূর্তেই সব তলিয়ে গেলো! অন্ধ বধির অপয়া লক্ষ্মী। এ কোন অনাচার! নিবারণের চোখের জল ঝরঝর ঝরে পরে। ইচ্ছে করে দুহাত দিয়ে হাওরের সব জল সেচে দিতে।
- ‘শনিরে শনি! একটু সময় দিলি না!’
ঢেউয়ের পরে ঢেউ আসছে। নিবারণ নৌকা ভিড়াচ্ছে না!
- আবুর বাপ, জলদি চলেন!
নিবারণ তাকায় না। বৈঠা নেয় না। সে কাচি নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। সন্তোষী ডুকরে ওঠে।
- অত রাইতে কই যাইন আহ্লাদির বাপ? পাগলনি!
- ধান ডুবনের দিতাম না। নাউডা লইয়া তুই আমার লগে আয়। অতসহজে ধান দিতাম না।
এত জলে কেও কোনদিন ধান খুঁজে পায় না। ধান পাবার সময়ও এটা নয়। নিছক নিবারণের পাগলামী। স্রোতের সাথে শরীরের নিস্ফল যুদ্ধ। বৃথায় উন্মাদের মতো ধান খুঁজে বেড়ায় নিবারণ। স্রোতে ভাসতে ভাসতে নিবারণ খড়কুটোর সাথে ভেসে যায়।
সন্তোষী নিজেও বুঝতে পারেনা সে কোথায়। কোথায় বা তাদের জমি। নৌকাটাই বা কোথায় ভেসে যাচ্ছে! পাগলের মত সে স্বামীকে খোঁজে। ডাকে। ঝড়ো বাতাসে তার ডাক উড়ে যায়। চারদিকে শোকের বিলাপ। প্রাণ বাঁচাতে সকলে নৌকা নিয়ে ফিরছিল। তাই কে ওঠলো, কে ডুবলো, সে খেয়াল কেও করেনি।
সন্তোষী যাকে পায় তাকে জিজ্ঞাসা করে। কেউ মনে করতে পারে না কখন নিবারণকে শেষ দেখেছিল। তবু তারা মনে করবার চেষ্টা করে। হাঁক ছেড়ে ডাকে।
-নিবারণরে......নি...বা....র....ণ
শনির তর্জন গর্জনের কাছে কাকভেজা মানুষগুলোর কন্ঠস্বর এক পসলা বৃষ্টির মতো উধাও হয়ে যায়।
ঝড় থেমে গেছে। হাওর এখন শান্ত। সন্তোষী নৌকা নিয়ে ফিরে এসেছে। আসেনি নিবারণ। নিবারণের নিখোঁজের খবর এরই মধ্যে গ্রামে ছড়িয়ে গেছে। এক এক করে সবাই জড়ো হচ্ছে তাদের উঠানে। সন্তোষীকে ঘিরে বসে আছে সবাই।
সন্তোষী একধ্যানে শনির হাওরের দিকে তাকিয়ে থাকে। পড়শিরা সন্তোষীর পিঠে, চুলে হাত বুলায়। সান্ত্বনা দেয়।
-বউরে, মন শক্ত কর। আহ্লাদি আছে। তারে কেডা দেখবো? ওঠ, যাও কাপড় বদলাও। ভিজা শইল, জ্বরটর আইবো।
এতক্ষণ পর সন্তোষীর মেয়ের কথা মনে হয়। মেয়ের নাম ধরে বিলাপ করে ওঠে।
ওরেরররররররর আহ্লাদী। তোর বাপ কই গেল? তোমরা কেডা আছ, বাছারে একটু আমার কোলে দেও। আহ্লাদীরেরেরেরে.....
আহ্লাদী কইরে? অভাগীর কোলে আইন্যা দে ছেরিডারে। কি গো খুড়ীমা আহ্লাদী কই?
ভাত খাইয়া তো ঘরের মধ্যে পুতলি লইয়া খেলতাছিন। যাওছেন কেও। একটু আইনা দেও।
বৃদ্ধার কথা শেষ হতে না হতেই একজন দৌড়ে যায় ঘরে । কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে আসে।
চহির নিচে, ডোলার নীচে, রান্দা ঘর সব দেখলাম। আহ্লাদীতো নাই ঠাম্মা।
মা গো মা! আমার, ছেরি কই? কেডা নিছ আমার ছেরিরে? কেও কথা কও না কেরে? আমার আহ্লাদী কই? জেঠী মা............মাগো……...আমার ছেরিরে দেইন................আফনের পাও ধরি আমার ছেরি.........
মালতী রানী ঠকঠক করে কাঁপছে। কয়েকজন ধরাধরি করে তাকে ঘরে রেখে আসে। সবাই নিবারণের কথা ভুলে গিয়ে আহ্লাদীকে খোঁজে। সবেমাত্র হাঁটতে শিখেছে। অজানা ভয়ে সকলে কুঁকরে যায়। ধানের কষ্ট, নিবারণের কষ্ট, আহ্লাদীর কষ্ট সব মিলিয়ে অমাবস্যার চেয়ে অন্ধকার নেমে আসে শনিরপাড়ে। টানা ঝড়ের রাত ঘুটঘুটে অন্ধকারের চাইতেও কালো মনে হয়।
ভেজা আকাশে সূর্য উঁকি দিচ্ছে। কারো তখনো ঘুম ভাঙেনি। কারো কারো ঘুম আসেইনি। হঠাৎ সুনীল দাশের চিৎকার।
আইলা নাগো তোমরা? এই যে আহ্লাদী।
কেউ একজন বলে উঠে, এইযে পাওয়া গেছে। এই টুকু শুনেই কেও উলু দিল। কেও শাহ্ আরফিনের দরগায় মোম জ্বালাবে বলে দুহাত কপালে ঠেকায়। কেও কেও হরির নাম করে করে ছুটে যায়।
সুনীল দাশ হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে পৈতা ধরে বিরবির করছে। সামনে আহ্লাদী। মৃদু ঢেউয়ে কুলকুল করে ভাসছে।
--------------
লেখক পরিচিতি
জয়শ্রী সরকার
কথাসাহিত্যিক
14 মন্তব্যসমূহ
বাহ, অনেক ভাল লিখা
উত্তরমুছুনকৃতজ্ঞতা।
মুছুনDidi, you write so well. When I was reading, every character's eyes floated in front of me.
উত্তরমুছুনDidi, you write so well. When I was reading, every character's eyes floated in front of me.Didi, you write so well. When I was reading, every character's eyes floated in front of me.
উত্তরমুছুনধন্যবাদ হেলেনা।
মুছুনধন্যবাদ হেলেনা।
মুছুনঅপূর্ব হয়েছে গল্পটা। খুব ভালো লাগল পড়ে
উত্তরমুছুনকৃতজ্ঞতা দীপ্র।
মুছুনঅপূর্ব হয়েছে গল্পটা। খুব ভালো লাগল পড়ে
উত্তরমুছুনগল্পটা উনার অন্যান্য লেখার মতোই খুব টাচি, শব্দ-বুনট উনার এতোই সহজাত যে, প্রতিটা গল্পই যেন ছবির মতো চোখের সামনে ভাসিয়ে তোলে। কিন্তু আমার একটাই কথা - উনার বেশিরভাগ গল্পই কেন স্যাড টোনে লেখা হয়? এতো বিষাদ ক্নেন? আর কেনইবা প্রায় সময়েই ট্র্যাজিক এন্ড?
উত্তরমুছুনগল্পটা উনার অন্যান্য লেখার মতোই খুব টাচি, শব্দ-বুনট উনার এতোই সহজাত যে, প্রতিটা গল্পই যেন ছবির মতো চোখের সামনে ভাসিয়ে তোলে। কিন্তু আমার একটাই কথা - উনার বেশিরভাগ গল্পই কেন স্যাড টোনে লেখা হয়? এতো বিষাদ ক্নেন? আর কেনইবা প্রায় সময়েই ট্র্যাজিক এন্ড?
উত্তরমুছুনঅশেষ ধন্যবাদ। আপনার মন্তব্য পড়ে আমি ভাববার চেষ্টা করলাম কেনো বেশিরভাগ গল্পেই বিষাদের সুর বাজে। আসলে, আমার গল্পের বিষয়বস্তু আমাকে টেনে নিয়ে যায়। যে গল্পে আমি ঢুকে যাই, প্রত্যেকটির যাপনেই একধরণের জানাশোনার প্রয়োজন হয়। সেই জানাশোনায় যে দৃশ্যখুঁজে পাই তারই একটা চিত্র আঁকার ইচ্ছে বলতে পারেন। সে জীবনের সংকটগুলো তুলে ধরাও একটা গোপন বাসনা বলতে পারেন। আমার রাজনৈতিক দর্শণের একটা সূত্রতা এখানে খুঁজে পাই।
মুছুনঅনবদ্য আপু
উত্তরমুছুনগল্প যেন চোখে ভাসছিল ..........
অনবদ্য আপু
উত্তরমুছুনগল্প যেন চোখে ভাসছিল ..........