‘কিগো বিরজুর মা, নাচ দেখতে যাবে না?’
বিরজুর মা রাঙাআলু সেদ্ধ করে আপন মনেই রাগ করছিল নিজের উঠোনে বসে। সাত বছরের ছেলে বিরজু রাঙাআলুর বদলে চড় খেয়ে উঠোনে লুটোপুটি করে সারা গায়ে মাটি মাখছিল। চম্পিয়ার মাথায় পেত্নী ভর করেছে ...
আধ উঠোন রোদ থাকতে সেই যে গেছে সাহু বৌয়ের দোকানে ছোয়া গুড় আনতে, তো এখনও ফেরেনি; সাঁঝবাতির বেলা হয়ে গেল। আসুক আজ ফিরে! ধাড়ি ছাগলের গায়ে কুকুর-মাছি এঁটে বসেছে, বেচারা ছাগল থেকে থেকে লাফালাফি করছিল। বিরজুর মা ছাগলের ওপর মনের রাগ মেটানোর অজুহাত খুঁজে বার করে ফেলল ... বাড়ির পেছনের দিকে ফলন্ত লঙ্কার গাছ! ঐ ছাগল ছাড়া কে আর তছনছ করবে ? ছাগলটাকে মারার জন্য সে মাটির একটা ছোট ঢেলা সবে তুলেছে, এমন সময় প্রতিবেশী মাখ্নি পিসির ডাক শোনা যায়, ‘কিগো বিরজুর মা, নাচ দেখতে যাবে না?’
‘বিরজুর মার সামনে বাঁধন, পেছনে টান না থাকলে তবেই তো, পিসি!’
রাগের গরমে জলন্ত চোখা কথা পিসির দেহে বেঁধে যায়, বিরজুর মা হাতের ঢেলা এক পাশে ছুঁড়ে ফেলে ...... বেচারা ছাগলটাকে কুকুর-মাছি বিরক্ত করছে! আ-হা,আয়......আয়! হর-র-র-র! আয়-আয়!
বিরজু শোয়া অবস্থায় ছাগলটাকে এক লাঠি কষিয়ে দেয়। বিরজুর মার ইচ্ছে হয়, গিয়ে ঐ লাঠি দিয়ে বিরজুর ভূত ভাগিয়ে দেয়; কিন্তু নিম গাছের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জলভরলিদের খিলখিল হাসি শুনে থেমে যায়। বলে, ‘দাঁড়া, তোর বাপ বডড হাত ছুট করে দিয়েছে তোকে! বড্ড হাত চলে সবার ওপর। দাঁড়া !’ মাখনি পিসি নিম গাছের পাশে বাঁকা কোমর থেকে ঘড়া নামিয়ে জল-ভরে-ফিরে-আসা জলভরনিদের কাছে বিরজুর মার বেচাল কথাবার্তার ন্যায়-বিচার করছিল, 'দেখলে তো বিরজুর মাকে! যেই চারমণ পাটের পয়সা হয়েছে ওমনি মাটিতে পা পড়ে না। বিচার কর তোমরা! নিজের মুখে আট দিন আগে থেকে গাঁয়ে অলিগলিতে বলে বেড়িয়েছে, হ্যাঁ, এবার বিরজুর বাপ বলেছে, গরুর গাড়িতে চাপিয়ে বলরামপুরের নাচ দেখিয়ে আনবে। বলদ এখন নিজের বাড়িতে রয়েছে, হাজারটা গাড়ি তো চাইলেই পাওয়া যাবে। তা, এখন আমি বলছি, নাচ দেখার জন্য সবাই তড়িঘড়ি তৈরি হয়েছে, রান্না-বান্না করেছে। আমার মুখে আগুন, কেন যে বলতে গেলাম। শুনছ, কী জবাব দিল বিরজুর মা!’
মাখনি পিসি তাঁর ফোকলা মুখের ঠোঁট জোড়া এক দিকে বেঁকিয়ে শব্দ বার করে,‘আ-রে-রে ! বির-র-র-জু-উর মার... সামনে-বাধিন পে-এ-এ-ছনে-টান যদি না থাকে, তবে-এ-এ-ই তো?’
জঙ্গির ছেলের বৌ বিরজুর মাকে ভয় করে না। সে একটু গলা খুলেই বলে, ‘পিসি-ই! সরবে সিটলমিন্টের (সার্ভে সেটেলমেন্টের) হাকিমের বাসায় ফুল-ছাপ পাড়ের শাড়ি পরে যদি তুইও বেগুন ভেট দিতি, তাহলে তোর নামেও দু-তিন বিঘে ধানী জমির পর্চা কাটা হত! তাহলে, আজ তোর ঘরেও দশমণ ‘সোনাবঙ্গ’ পাট হত, জোড়া বলদ কেনা যেত! তাহলে সামনের বাঁধন পেছনে হাজারটা টান থাকত।’
জঙ্গির ছেলের বৌ মুখফোঁড় মেয়ে৷ রেলওয়ে স্টেশনের পাশের মেয়ে। সবে তিন মাস হল গাওনায় নতুন বৌ হয়ে এসেছে, এরি মধ্যে কুর্মাটোলার সব কটা ঝগড়াটে শাশুড়ির সঙ্গে এক-আধবার ঝগড়া-বিবাদ হয়ে গেছে। ওর শ্বশুর জঙ্গি দাগী চোর, সি-কেলাসী। ওর মরদ রঙ্গি কুর্মাটোলার নামী লেঠেল। এই জন্য সবসময় শিং নাড়িয়ে বেড়ায় জঙ্গির ছেলের বৌ।
বিরজুর মার উঠোনে জঙ্গির ছেলের বৌয়ের গলা খুলে বলা কথাগুলো গুলতির গুলির মতো শাঁ শাঁ করে আসে। বিরজুর মা একটা চোখা জবাব খুঁজে বার করে, কিন্তু মুষড়ে গিয়ে চুপ করে যায়।... গোবরের পাহাড়ে পাথর ছুঁড়ে আর কী হবে!
জিভের ঝাল গলায় নামিয়ে, বিরজুর মা মেয়ে চম্পিয়াকে ডাকে, ‘ওরে চম্পিয়া-য়া-য়া, আজ ফিরে এলে তোর মাথা মুচড়ে চুলোয় সেঁধিয়ে দেব। দিন-দিন বেচাল হয়ে চলেছে!... গাঁয়ে এখন থিয়েটার বায়োস্কোপের গান গাওয়া ছিনাল বৌরা আসতে শুরু করেছে। হয়তো কোথাও বসে ‘বাজে না সুরলিয়া’ শিখছে ! ওরে চম্পিয়া-আ-আ- !’
জঙ্গির ছেলের বৌ বিরজুর মার কথার স্বাদ নিয়ে কোমরের ঘড়া সামলায়, তারপর দুলিয়ে বলে, ‘চল্ দিদিরা চল্! এই পাড়ায় হরতনের বিবি থাকে! জানো না বুঝি, দুপহর দিন আর চৌপহর রাত বিজলি বাতি ঝক্ ঝক্ করে জ্বলে!’ ঝক্ ঝক্ বিজলি বাতির কথা শুনে, কেন জানি, সকলে খিলখিল করে হেসে ওঠে।
পিসির ফোঁকলা দাঁতের ফাঁক দিয়ে একটা মিঠে গাল বেরোয়, ‘শয়তানের ঠাকুমা!’
বিরজুর মার চোখে যেন কেউ জোরালো টর্চের আলো ফেলে ধাঁধিয়ে দেয়।... ঝক্ঝকে বিজলি বাতি! তিন বছর আগে সার্ভে ক্যাম্পের পর গাঁয়ের জ্বালামুখী মেয়েরা একটা গল্প তৈরি করে ছড়িয়ে ছিল। চম্পিয়ার মা'র উঠোনে রাতভর ইলেক্ট্রিক আলো ঝকঝক্ করছিল। চম্পিয়ার মা'র উঠোনে নাল-অলা জুতোর ছাপ ঘোড়ার নালের ছাপের মতো!... জ্বল, জ্বল, আরও জ্বল। চম্পিয়ার মার আঙিনায় রূপোর মতো পাট শুখোতে দেখে জ্বলতে থাকা সব মেয়েরা এবার খামারে সোনালী ধানের বোঝা দেখে বেগুন পোড়া হয়ে যাবে।
মাটির হাঁড়ি থেকে চুঁইয়ে পড়া ছোয়া গুড় আঙুলে চাটতে চাটতে চম্পিয়া আসে, মার হাতে চড় খেয়ে চিৎকার করে ওঠে, ‘আমায় মারছ কেন-ও-ও-ও ? সাহুবৌ তাড়াতাড়ি জিনিস দেয়না, - এঁ-এঁ-এঁ এঁ!’
‘সাহু বৌ তাড়াতাড়ি জিনিস দেয়না। বলি ঐ এক সাহুবৌয়ের দোকানেই মুক্তো ঝরে যে, ওখানে শেকড় গেড়ে বসেছিলি! বল, গলায় পা চেপে ঘাড় মটকে দেব হতচ্ছাড়ি, আবার যদি ‘বাজে না মুরলিয়া’ গাইতে শুনি!... ন্যাকামি শিখতে যাস ইস্টিশানের ছুঁড়ির কাছে!’
বিরজুর মা চুপ করে নিজের গলার আওয়াজ আন্দাজ করে, তার কথাগুলো জঙ্গির ঝুপড়ি অবধি পষ্টাপষ্টি পৌঁছে গিয়ে থাকবে ।
ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা ভুলে বিরজু ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে হাঁড়ি থেকে চুঁইয়ে পড়া গুড় হ্যাংলা দৃষ্টিতে দেখছিল।... দিদির সঙ্গে সেও যদি ওখানে যেত তাহলে দিদি ওকেও গুড় চাটতে দিত নিশ্চয়। রাঙাআলুর লোভে সে এখানে পড়ে থাকে, আর চাইতে গিয়ে মা রাঙাআলুর বদলে...
‘ওমা, এক আঙুল গুড় দে!’ বিরজু হাতের চেটো ছড়িয়ে দেয়, ‘দে মা; এ-ই এক চিমটি!’
‘এক চিমটি কেন, হাঁড়ি শুদ্ধু তুলে ফেলে দিয়ে আসছি পেছনের উঠোনে; গিয়ে চাটিস! হবে না মিষ্টি রুটি! মিষ্টি রুটি খাওয়ার মুখ চাই!’ বিরজুর-মা রাঙাআলুর টুকরি ক্রন্দনরত চম্পিয়ার সামনে রেখে বলে, ‘বসে খোসা ছাড়া, নইলে …!’
দশ বছরের চম্পিয়া জানে, রাঙাআলুর খোসা ছাড়াবার সময় কম করেও বারো বার মা তার চুল ধরে টানবে, ছোট ছোট দোষ বার করে গাল দেবে।... পা ছড়িয়ে ওভাবে বসে আছিস যে, নির্লজ্জ! চাম্পিয়া মা’র রাগ ভাল করেই জানে। বিরজু এই সুযোগে সামান্য খোসামোদ করে, ‘মা, আমিও রাঙাআলুর খোসা
ছাড়াব?’ “না” মা ধাঁতানি দেয়, ‘একটা রাঙাআলু ছাড়াবে, আর তিনটে পেটে। সিধুর বৌকে গিয়ে বল, এক ঘণ্টার জন্য কড়াই চেয়ে নিয়ে গেছে তা ফেরত দেয়ার নাম নেই ! যা তাড়াতাড়ি!’
মুখ কালো করে উঠোন থেকে বেরোতে বেরোতে বিরজু রাঙাআলু আর গুড়ের দিকে তাকায়। চম্পিয়া তার আলুথালু চুলের ফাঁক দিয়ে মাকে দেখে, তারপর চোখ এড়িয়ে চুপচাপ বিরজুর দিকে একটা রাঙাআলু ছুঁড়ে দেয়... বিরজু নিয়ে পালায়।
‘সূয্যি ঠাকুর ডুবে গেছে। সাঁঝবাতির সময় হয়েছে। এখনও গাড়ি…’ চম্পিয়া মাঝ পথেই বলে ওঠে, ‘কোইরিটোলায় কেউ গাড়ি দেয়নি মা! বাবা বলেছে, মাকে বলিস সব ঠিকঠাক করে তৈরি হয়ে থাকতে।... মালদহিয়া টোলার মিঞাজানের গাড়ি আনতে যাচ্ছি?’
শোনার সঙ্গে সঙ্গে বিরজুর মার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। মনে হয় ছাতার শিক খুলে পড়েছে ডাণ্ডা থেকে, হঠাৎ। কোইরিটোলার কেউ আর গাড়ি দেয়নি ধারে! আর পেয়েছে গাড়ি তাহলে ! নিজের গাঁয়ের লোকেদের চোখেই যখন জল নেই, মালদহিয়া টোলার মিঞাজানের গাড়ির ওপর কিসের ভরসা! না তিনে না তেরোয় ! কী হবে রাঙাআলুর খোসা ছাড়িয়ে ! রেখে দে তুলে!... হু, ঐ মানুষটা নাচ দেখাবে ! গরুর গাড়িতে চাপিয়ে নাচ দেখাতে নিয়ে যাবে ! হু, খুব চেপেছি গরুর গাড়িতে, খুব দেখেছি নাচ মন ভরে !...
পায়ে হাঁটা লোকেরা এতক্ষণে পৌঁছে পুরনো হয়ে গেল।
বিরজু ছোট্ট কড়াই উপুড় করে মাথায় নিয়ে আসে, ‘দ্যাখ দিদি, মিলিটারী টুপি ! এর ওপর দশটা লাঠি মারলেও কিছু হবে না।’
চম্পিয়া চুপচাপ বসে থাকে, কিছু বলে না, একটুও হাসে না। বিরজু বুঝে ফেলে মার রাগ এখনও নামেনি পুরোপুরি ।
মরাইয়ের ভেতর থেকে ছাগলটাকে বাইরে তাড়িয়ে দিতে দিতে বিরজুর মা বিড় বিড় করে, ‘কালই পাঁচকড়ি কষাইয়ের হাতে তুলে দেব রাক্ষস কোথাকার ! সব জিনিসে মুখ দেবে। চম্পিয়া, বেঁধে রাখ ছাগলটাকে। খুলে ফেল ওর গলার ঘন্টি। সবসময় টুংটুং! আমার একদম ভাল লাগে না!’
টুংটুং শুনতেই বিরজুর রাস্তায় চলে যাওয়া গাড়ির কথা মনে পড়ে। বাবুটোলার গাড়ি এখন নাচ দেখতে যাচ্ছে, ‘ঝুনঝুন, গরুর মালা, তুমি শুন…’
‘বেশি বক্ বক্ করিস না !’ ছাগলের গলা থেকে মালাঘন্টি খুলতে খুলতে চম্পিয়া বলে।
‘চম্পিয়া উনুনে জল ঢেলে দে। বাপ এলে বলিস উড়োজাহাজ করে নিজে নাচ দেখে আসুক ! আমার নাচ দেখার শখ নেই! আমায় কেউ জাগাবি না ! আমার মাথা ধরেছে।'
মরাইয়ের উঠোনে বিরজু ফিস্ ফিস্ করে জিজ্ঞেস করে, ‘দিদি, নাচে উড়োজাহাজ উড়বে না কি?’ কাঁথা জড়িয়ে চম্পিয়া চাটাইয়ে বসতে বসতে বিরজুকে চুপচাপ পাশে বসতে ইশারা করে, মিছিমিছি মার খাবে বেচারা !
বিরজু দিদির কাঁথায় ভাগ নিয়ে গুটিসুটি মেরে বসে। শীতকালে এভাবে হাঁটুতে থুৎনি ঠেকিয়ে গুটিসুটি মেরে বসতে শিখেছে সে। চম্পিয়ার কাছে মুখ এনে বলে ‘আমরা নাচ দেখতে যাব না? গাঁয়ে একটাও পাখি নেই সবকটা চলে গেছে।’
চম্পিয়ার এখন কণা মাত্র ভরসা নেই। সাঁঝ তারা ডুবেছে। বাবা এখনও গাড়ি নিয়ে ফেরেনি !... একমাস আগে থেকেই মা বলছিল,’বলরামপুরে নাচের দিন মিষ্টি রুটি তৈরি হবে, চম্পিয়া ছাপা শাড়ি পরবে, বিরজু প্যান্ট পরবে, গরুর গাড়িতে চেপে…’
চম্পিয়ার চোখের ভেজা পলকে এক ফোঁটা জল এসে থামে ।
বিরজুর বুকও ভারী হয়ে যায়। সে মনে মনে তেঁতুল গাছের জিন বাবাকে একটা বেগুন দেয়ার মানত করে, গাছের প্রথম বেগুন, সে নিজে যে-গাছের চারা পুতেছে !...‘তাড়াতাড়ি গাড়ি নিয়ে বাবাকে পাঠিয়ে দাও, জিন বাবা!’
মরাইয়ের ভেতরে বিরজুর মা চাটাইয়ে শুয়ে পাশ ফিরছিল। উহুঁ, আগে থেকে কোনো কিছুর সাধ করা উচিত নয় ! ভগবান তার সাধ ঘুচিয়ে দিয়েছেন। সবচেয়ে আগে ভগবানকেই জিজ্ঞেস করতে হবে, কোন ভুলের জন্য এমন ফল দিচ্ছ ভোলাবাবা! নিজের জ্ঞানত সে কোনো ঠাকুর দেবতার মানত অপূর্ণ রাখেনি । সার্ভের সময় জমির জন্য যত মানত করেছিল... ওমা, সত্যিই তো ! মহাবীরজীর রুটি এখনও বাকি আছে। হায়, হায়, ঠাকুর .:. ভুলক্রুটি ক্ষমা কর মহাবীর বাবা ! মানত দ্বিগুণ করে দেবে বিরজুর মা!...’
বিরজুর মার মনে থেকে থেকে জঙ্গির ছেলের বৌয়ের কথা বিঁধতে থাকে, ঝক্ঝক্ বিজলি বাতি!..... চুরি-চামারি করা লোকেদের ঝি-বৌরা জ্বলবেই তো ! পাঁচ বিঘা জমি আদায় করেছে বিরজুর বাবা অমনি গাঁয়ের ভাই-খাদিদের চোখে যেন কুটো পড়েছে।
ক্ষেতে পাটের চাষ দেখে গাঁয়ের লোকেদের বুক ফাটতে শুরু করেছে; মাটি ফেটে পাট উপছে পড়েছে; বৈশাখী মেঘের মতো ফুলে ফেঁপে উঠেছে পাটের ফসল ! এত চোখের নজর কি আর ফসল সইতে পারে ! যেখানে পনের মণ পাট হওয়ার কথা, মাত্র দশ মণ পাট দাঁড়িপাল্লায় ওজনে উঠেছে রবি ভগতের গুদামে! ...
এতে জ্বলার কি আছে বাপু !... বিরজুর বাবা প্রথমেই কুর্মাটোলার সকলকে জনে-জনে বুঝিয়েছে, সারাজীবন কি জনমজুরি করেই কাটবে ! সার্ভের সময় এসেছে, লাঠি শক্ত করে ধরলে দু-চার বিঘে জমি আদায় হতে পারে। তা, গাঁয়ের কোনো পুতখাকির ভাতার সার্ভের সময় জমিদারবাবুর বিরুদ্ধে কাশল না পর্যন্ত। বিরজুর বাবাকে কী কম সইতে হয়েছে ! জমিদারবাবু রাগে ক্রোধে সার্কাসের বাঘের মতো লম্ফঝম্প করেছিল। ওর বড় ছেলে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেবে বলে শাসিয়ে গিয়েছিল।... শেষে জমিদারবাবু তার ছোট ছেলেকে পাঠায়। বিরজুর মাকে “মাসি” বলে ডাকে -- ‘এই জমিটা বাবা আমার
নামে কিনেছিল। আমার লেখাপড়ার খরচ এই জমির ফসলেই চলে।... আরও কত কথা ! কী মোহন যাদুই না জানে ঐটুকুন ছেলে। জমিদারের বেটা তো…’
‘চম্পিয়া, বিরজু ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি ? এখানে চলে আয় বিরজু ভেতরে । তুইও চলে আয়, চম্পিয়া।... ভালমানুষ আসুক আজ একবার!’
বিরজুর সঙ্গে চম্পিয়াও ভেতরে উঠে আসে। ‘কুপি নিভিয়ে দে।... বাবা ডাকলে জবাব দিবি না। ঝাঁপ ফেলে দে।’
‘ভালমানুষ রে, ভালমানুষ। মুখ দেখ একবার এই পুরুষ মানুষের ।... বিরজুর মা যদি রাত দিন মুখ না করত তাহলে আর পেয়েছিল এই জমি। রোজ ফিরে এসে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ত, ‘আমার জমি চাই না বিরজুর মা, মজদুরিই ভাল।’ খুব ভেবে চিন্তে জবাব দিত বিরজুর মা, ‘বাদ দাও তাহলে, তোমার মনই যখন স্থির হয় না, তাহলে আর কী হবে! বউ-জমি হল জোরের, নইলে আর কারোর!...
বিরজুর বাপের ওপর় বেজার রাগ জমতে থাকে। আরও জমে উঠছে।.. . বিরজুর মার ভাগ্যই খারাপ. এমন গোবরগণেশ মার্কা বর পেয়েছে। কিই বা সখ আহ্লাদ পূরণ করেছে ঐ পুরুষ মানুষ। কলুর বলদের মতো খেটে খেটে সারা জীবন কাটিয়ে দিল, কখনও এক পয়সার জিলিপিও কি এনে দিয়েছে তার মরদ !... পাটের দাম ভগতের কাছ থেকে নিয়ে বাইরে বাইরে বলদ হাট্টায় চলে গেছে। বিরজুর মাকে একবারও নম্বরী নোটখানি দেখতেও দেয়নি চোখের দেখা।... বলদ কিনে আনল। সেদিন থেকেই গাঁয়ে ঢ্যাঁড়া পেটাতে শুরু করেছে, বিরজুর মা এবার গরুর গাড়িতে চেপে যাবে নাচ দেখতে।... হু, অপরের গাড়ির ভরসায় নাচ দেখাবে!
শেষে নিজের ওপরেই তার রাগ ধরে। সে নিজেও কিছু কম নয়। তার মুখে আগুন লাগুক ! গরুর গাড়িতে চেপে নাচ দেখার ইচ্ছে কোন কুক্ষণে তার মুখ থেকে বেরিয়েছে, ভগবান জানেন! তারপর, আজ সকাল থেকে দুপুর অবধি, কোনো-না-কোনো অজুহাতে সে আঠারো বার গরুর গাড়িতে চেপে নাচ দেখতে যাবার কথা তুলেছে।.. ই, খুব নাচ দেখ! বাহ্রে নাচ! ছেঁড়া কাথার তলায় শুয়ে, শাল আলোয়ানের স্বপ্ন!... কাল সকালে জল ভরার জন্য যখন যাবে, শানানো জিভের ছুঁড়িরা সকলেই হাসাহাসি করতে করতে
যাবে, হাসাহাসি করতে করতে আসবে।... সকলেই হিংসে করে তাকে; হ্যাঁ, ভগবানও একচোখো।... দুই সন্তানের মা হয়েও যেমন-কার-তেমন আছে। তার বাড়ির পুরুষও তার কথা মতো চলে। সে চুলে নারকেল তেল মাখে। তার নিজের জমি আছে । আছে কারো কাছে, এক কাঠাও জমি এই গাঁয়ে ? হিংসা করবে না ! তিন বিঘে ধান ফলেছে, অঘ্রাণী। লোকেদের কুনজর থেকে যদি বাঁচে, তবে তো!
বাইরে বলদের ঘন্টি শোনা যায়। তিনজনই সর্তক হয়ে যায়। উৎকর্ণ হয়ে শুনতে থাকে।
‘আমাদের বলদের ঘন্টি, না রে চম্পিয়া?,
চম্পিয়া ও বিরজু প্রায় একযোগে বলে ওঠে, ‘হ্যাঁ-হ্যাঁ-হ্যাঁ!’
‘চুপ!’ বিরজুর মা ফিসফিস করে বলে, ‘সঙ্গে গাড়িও আছে । ঘর্ঘর করছে, তাই না ?'
‘হ্যাঁ-হ্যাঁ-হ্যাঁ!’ দুজনেই আবার সম্মতি জানায় ।
‘চুপ! গাড়ি নেই। তুই চুপচাপ বেড়া ফাঁক করে দেখে আয় তো চম্পি! পালিয়ে আয় চুপচাপ।’
চম্পিয়া বেড়ালের মতো পা টিপেটিপে বেড়ার ফাঁকে উঁকি মেরে দেখে আসে - ‘হ্যাঁ মা, গাড়িও রয়েছে!’
বিরজু ধড়ফড় করে উঠে বসে। ওর মা ওর হাত ধরে শুইয়ে দেয়, ‘কথা বলিস না।’
চম্পিয়া কাঁথার তলায় ঢুকে পড়ে।
বাইরে গরুর গাড়ি খোলার শব্দ আসে। বিরজুর বাবা বলদ দুটোকে শক্তগলায় ধমক দেয়, ‘হ্যাঁ! হ্যাঁ! বাড়ি এসে গেছে। বাড়ি ফেরার জন্য বুক ফেটে যাচ্ছে!’
বিরজুর মা চটে ওঠে, নিশ্চয়ই মালদহিয়া টোলায় গাঁজা টেনে এসেছে। গলার আওয়াজ খনখনে বেরোচ্ছে।’
‘চম্পিয়া-আ!’ বাইরে থেকে ডেকে বলে তার বাবা, ‘বলদ দুটোকে ঘাস দে, চম্পিয়া-আ!'
ভেতর থেকে কোনো জবাব আসে না। চম্পিয়ার বাবা উঠোনে এসে দেখে, না আলো, না পিদিম, না উনুনে আগুন!... ব্যাপার কী ? নাচ দেখতে উতলা হয়ে হেঁটেই রওনা দিয়েছে নাকি... ! বিরজুর গলা খুসখুস করে ওঠে, তা আটকাবার জন্য খুব চেষ্টাও করে । কিন্তু কাশি শুরু হতে নাগাড়ে পাঁচ মিনিট ধরে কাশতে থাকে।
‘বিরজু ! বাবা বিরজু মোহন !’ বিরজুর বাবা আদর করে ডাকে, ‘মা রাগ করে শুয়ে আছে বুঝি!... দেখে যা এখনও লোকেরা যাচ্ছে।' বিরজুর মার ইচ্ছে হয়, শক্ত জবাব দেয়, আর দেখতে হবে না নাচ !... ফিরিয়ে দাও গাড়ি।
‘চম্পিয়া-আ ! উঠছিস না কেন ? নে, ধানের পঞ্চশিষ রেখে দে।’ ধান ছড়ার ছোট একটা আঁটি ঝোপড়ির দাওয়ায় রেখে সে বলে, ‘বাতি ধরা !’
বিরজুর মা উঠে দাওয়ায় আসে, ‘দেড় পহর রাতে গাড়ি আনার কি দরকার ছিল ? নাচ প্রায় শেষ হয়ে এল।’
কুপির আলোয় ধান-ছড়ার রঙ দেখার সঙ্গে সঙ্গে বিরজ্জুর মা’র মনের সব ময়লা দূর হয়ে যায়।... ধানী রঙ তার চোখ বেয়ে শিরা-উপশিরায় মিশে যায়।
‘নাচ এখনও শুরু হয়নি । এইমাত্র বলরামপুর বাবুদের কোম্পানীর গাড়ি মোহনপুর হোটেল বাংলো থেকে হাকিম সাহেবকে আনতে গেছে। এবছরে এটাই শেষ নাচ।...পঞ্চশিষ বেড়ার বাতায় গুঁজে রাখ, আমাদের ক্ষেতের ধান।’
‘আমাদের ক্ষেতের?’ উৎসাহে বিরজুর মা জিজ্জেস করে, ‘ধান পেকে গেছে ?’ ‘না, দশদিনে অঘ্রাণ পেরোতে-না-পেরোতে লাল হয়ে ঝুঁকে পড়বে সারা ক্ষেতের ছড়া ! মালদহিয়া টোলায় যাচ্ছিলাম, আমাদের ক্ষেতের ধান দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। সত্যি বলছি, ধানের পঞ্চশিষ ছেঁড়ার সময় আঙুল কাঁপছিল আমার!’
বিরজু ধানছড়া থেকে একটা ধান বার করে মুখে ফেলে, তার মা হাল্কা বকুনি দেয়,‘কেমন হাঁদারে তুই !... এই সব
শত্তুরের জ্বালায় কোনো ধম্মপুণ্যি করার জো নেই।’
‘কী হল, বকছ কেন?’
‘নবান্নের আগেই নতুন ধান এঁটো করল, দেখছ না ?'
‘এদের বেলায় সব কিছু মাফ। এরা বলতে গেলে পাখ-পাখালি। শুধু আমাদের দুজনের মুখে নবান্নের আগে নতুন অন্ন যেন না পড়ে।'
এবার চম্পিয়াও ধান ছড়া থেকে দুটো ধান নিয়ে দাঁতে চিবোয়, ‘সত্যি মা। কি মিষ্টি চাল!’
‘কেমন সুন্দর গন্ধ, তাই না দিদি?’ বিরজু আবার মুখে ধান চিবোয়।
‘রুটি-টুটি করে রেখেছ নাকি ?’ বিরজুর বাবা হেসে জিজ্ঞেস করে।
‘
না।' অভিমানী স্বরে বলে বিরজুর মা, ‘যাবার ঠিক-ঠিকানা নেই... রুটি করতে বসিআর কি।'
না।' অভিমানী স্বরে বলে বিরজুর মা, ‘যাবার ঠিক-ঠিকানা নেই... রুটি করতে বসিআর কি।'
'বাহ ! তোমরাও আছ বেশ!... যার বলদ আছে, সে কি চাইলে গাড়ি পাবে না? গাড়িওয়ালাদেরও মাঝে মাঝে বলদের দরকার পড়ে |... যাও, তাড়াতাড়ি রুটি করে নাও।’
‘দেরি হয়ে যাবে না তো?’ ‘টুকরি ভর্তি রুটি তুমি তো চোখের নিমেষেই করে ফেল; পাঁচটা রুটি করতে কত আর দেরি হবে।’ এখন বিরজুর মা'র ঠোঁটে হাসি খেলতে থাকে। সে ছোটদের চোখ এড়িয়ে দেখে, বিরজুর বাবা তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে দেখছে।... চম্পিয়া আর বিরজু না থাকলে মনের কথা হেসে খুলে বলতে আটকাত না। চম্পিয়া আর বিরজু একে অপরকে দেখে, আনন্দে খুশিতে ওদের চেহারা ঝলমল করে ওঠে... মা মিছিমিছি রাগ করছিল !
‘চম্পী ! যা-তো ঢিবিতে দাঁড়িয়ে মাখনি পিসিকে একবার ডাক!’
‘ও, পিসি-ই-ই। শুনছো পিসি-ই ! মা ডাকছে!’
পিসি কোনো জবাব সরাসরি দেয় না, কিন্তু তার বিড়বিড়ানি স্পষ্ট শোনা যায়, ‘হ্যাঁ! এখন পিসিকে অত সাধা কেন ? গোটা পাড়ায় শুধু এক পিসিই তো রয়েছে যার কোনো টান-বাঁধন নেই।'
‘ওগো পিসি।’ বিরজুর মা হেসে জবাব দেয়, ‘তখন খুব রাগ করেছিলে, তাই না ? বাঁধন-টান অলাকে দেখে যাও, দু-পহর রাতে গাড়ি নিয়ে এসেছে। এসে পড় পিসি আমি যে মিষ্টি রুটি করতে পারি না।’ পিসি কাশতে কাশতে আসে, ‘এইজন্যই তো দিন থাকতে থাকতেই জিজ্ঞেস করেছিলাম, নাচ দেখতে যাবে নাকি ? তখন বললে আমি আগে থাকতেই আমার মালসা এখানে ধরিয়ে যেতাম।’
বিরজুর মা পিসিকে মালসা দেয়, ‘ঘরে ধান চাল কিছুই নেই। শুধু এক ছাগল আর কিছু বাসন কোসন। তা, সারারাতের জন্য এখানে তামাক রেখে যাচ্ছি। তোমার হুঁকো এনেছ তো পিসি?’
পিসি যদি তামাক পায়, সারা রাত কেন, পাঁচ রাত বসে জাগতে পারে। ও-হো! এ যে দরাজ হাতে তামাক রেখেছে বিরজুর মা। আর ঐ এক সাহুবৌ ! রাম বল ! সেবারে আফিমের গুলির মতো মটর ওজনে তামাক রেখে চলে গেছিল গোলাপ বাগ মেলায়, বলে গেল টিনভর্তি তামাক আছে।
বিরজুর মা উনুন ধরায়। চম্পিয়া রাঙাআলু মেখে মেখে দলা পাকায়, আর বিরজু মাথায় কড়াই উল্টে রেখে বাবাকে দেখায়, ‘মিলিটারী টুপি ! এর ওপর দশ লাঠি মারলেও কিছু হবেনা।’
সকলেই সশব্দে হেসে ওঠে। বিরজুর মা হেসে বলে, ‘তাকের ওপর তিন চারটে মোটা রাঙাআলু আছে, চম্পিয়া দিয়ে দে বিরজুকে, বেচারা সন্ধে থেকে...
‘বেচারা আর বোল না মা, খুব চালু ছেলে।’ চম্পিয়া এবার কিচিরমিচির করে ওঠে, তুমি তো জানো না, কাঁথার তলায় মুখ চলছিল কেন বাবুসাহেবের !'
‘হি-হি-হি-!’
বিরজুর ভাঙা দুধ-দাঁতের ফাঁক দিয়ে কথা বেরোয়, 'বেলাক মারটিনে পাঁচটা রাঙাআলু খেয়ে ফেলেছি! হা-হা-হা!’
সকলেই আবার সশব্দে হেসে ওঠে । বিরজুর মা পিসির মন রাখার জন্য জিজ্ঞেস করে, ‘এক ছটাক গুড় আছে। আদ্দেক দেব নাকি পিসি?’ পিসি গদগদ হয়ে বলে, ‘রাঙাআলু তো এমনি মিঠে, অত দেবে কেন ?’
যতক্ষণ ধরে বলদ জোড়া ঘাস-দানা খেয়ে একে অপরের দেহ জিভ দিয়ে চাটে, ততক্ষণে বিরজুর মা তৈরি হয়ে নেয়। চম্পিয়া ছাপা শাড়ি পরে আর বিরজু বোতামের অভাবে প্যান্টে পাটের দড়ি বাঁধে। বিরজুর মা উঠোন থেকে বেরিয়ে গাঁয়ের দিকে উৎকর্ণ হয়ে শোনার চেষ্টা করে, ‘উহ, হেঁটে যাওয়ার লোকেরা কি আর এতক্ষণ বসে থাকে!’
পূর্ণিমার চাঁদ উপরে এসে পড়েছে।... বিরজুর মা আসলি রুপোর টিকলি পরেছে আজ, প্রথমবার। বিরজুর বাবার কী হল, গাড়ি জুতছে না কেন, মুখের দিকে হাঁ করে এক দৃষ্টে চেয়ে দেখছে,যেন নাচের হরতনের...
গাড়িতে বসতেই বিরজুর মার দেহে এক বিচিত্র শিহরণ হতে থাকে। সে বাঁশের বল্লী ধরে বলে, ‘গাড়িতে এখনও অনেক জায়গা আছে ।... একটু ডান রাস্তা ধরে হেঁকো।’
বলদ জোড়া দৌড়তে শুরু করলে, চাকা চিঁই-চিঁই করে ঘরঘরানি শুরু করলে, বিরজুর পক্ষে চুপ করে থাকা সম্ভব হয় না, ‘উড়োজাহাজের মতো ওড়াও বাবা !’ গাড়ি জঙ্গির বাসার পেছন দিকে পৌঁছয়। বিরজুর মা বলে, ‘জঙ্গিকে একটু জিজ্ঞেস কর তো, ওর ছেলের বৌ নাচ দেখতে চলে গেছে নাকি?’
গাড়ি থামাতেই জঙ্গির ঝুপড়ি থেকে ভেসে আসা কান্নার শব্দ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিরজুর বাবা জিজ্ঞেস করে, ‘ও জঙ্গি ভাই, কান্নাকাটি হচ্ছে কেন ভেতরে?’ জঙ্গি মালসায় আগুন পোহাচ্ছিল, বলে, ‘আর বল কেন, রঙ্গি বলরামপূর থেকে ফিরে আসেনি, বৌমা নাচ দেখতে যাবে কী করে ? পথ চেয়ে থাকতে থাকতে ওদিকে গাঁয়ের সব বৌ-ঝিরা চলে গেছে।’
‘ওগো টিশনওয়ালী, কাঁদছ কেন ?’ বিরজুর-মা ডেকে বলে, ‘তাড়াতাড়ি চলে আয় শাড়ি পালটে । গোটা গাড়ি ফাঁকা পড়ে আছে। বেচারী !... আয় তাড়াতাড়ি !’
পাশের ঝুপড়ি থেকে রাধার মেয়ে সুনরী বলে, ‘কাকা গাড়িতে জায়গা আছে ? আমিও যাব।’
বাঁশ ঝাড়ের ওপারে নারান খাবাসের ঘর। তার বৌ-ও যায়নি। গিলটি করা ঝুমকো-হার পরে ঝমঝম শব্দ তুলে আসে। ‘চলে আয়। যারা রয়ে গেছে, সকলেই তাড়াতাড়ি চলে আসুক।’
জঙ্গির ছেলের বৌ, নারানের বৌ আর রাধার মেয়ে সুনরী, তিনজনেই গাড়ির কাছে এগিয়ে আসে | বলদটা পেছনদিকের পা চালায়। বিরজুর বাবা একটা বাজে গাল দেয়, ‘শালা ! লাথি ছুঁড়ে খোঁড়া করবি নাকি বৌদের !’
সকলেই সশব্দে হেসে ওঠে। বিরজুর বাবা ঘোমটায় ঢাকা আনত দুই বৌকে দেখে। তার নিজের মাঠের আনত ধানছড়ার কথা মনে পড়ে যায়।
জঙ্গির ছেলের বৌ'র গাওনা তিনমাস আগে হয়েছে । গাওনার রঙিন শাড়ি থেকে সরষের তেল আর মেটে সিঁদুরের গন্ধ আসছে । বিরজুর মার নিজের গাওনার কথা মনে পড়ে। সে কাপড়ের পুটলি থেকে তিনটে মিষ্টি রুটি বার করে বলে, ‘খেয়ে ফেল একটা একটা করে। সিমরাহায় সরকারী কুয়ো থেকে জল খেয়ে নিস।'
গাড়ি গাঁয়ের বাইরে এসে ধান ক্ষেতের পাশ দিয়ে যেতে থাকে। জ্যোৎস্না -- কার্তিক মাসের !... ক্ষেত থেকে ধানের ঝরা ফুলের গন্ধ আসে। বাঁশ ঝাড়ের কোথাও বুনো লতায় দুধসাদা ফুল ফুটেছে। জঙ্গির ছেলের বৌ একটা বিড়ি ধরিয়ে বিরজুর মার দিকে এগিয়ে দেয়! বিরজুর মার সহসা মনে পড়ে, চম্পিয়া, সুনরী, নারানের বৌ আর জঙ্গির ছেলের বৌ, এরা চার জনেই গায়ে বায়োস্কোপের গান গাইতে জানে।... বাঃ।
গাড়ির চাকা ধান ক্ষেতের মাঝ দিয়ে গেছে। চারদিকে গাওনার শাড়ির খসখসানির শব্দ হয়... বিরজুর মার কপালের টিপে চলকে পড়েছে জ্যোৎস্না। ‘আচ্ছা, এখন একটা বায়োস্কোপের গান গা তো চম্পিয়া !... ভয় কিসের ? যেখানে ভুলে যাবি, পাশেই মাস্টারনি বসেই আছে।’
বৌ দুজন নয়, চম্পিয়া আর সুনরী কেশে গলা পরিষ্কার করে।
বিরজুর বাবা বলদ দুটোকে তাড়া দেয়, ‘চল ভাই! আরও জোরে জোরে গা-না চম্পিয়া, নইলে আমি বলদ দুটোকে আস্তে আস্তে যেতে বলব।’
জঙ্গির ছেলের বৌ চম্পিয়ার কানের কাছে ঘোমটা নিয়ে গিয়ে কিছু বলে। তারপর চম্পিয়া চাপা সুরে শুরু করে, ‘চাঁদের জোছনা...
বিরজুকে কোলে নিয়ে বসা মায়ের ইচ্ছে হয় সেও সঙ্গে সঙ্গে গান গায়। বিরজুর মা জঙ্গির ছেলের বৌ-এর দিকে চায়, ধীরে ধীরে গুনগুন করছে সেও । কী ভাল বৌ! গাওনার শাড়ি থেকে এক বিশেষ ধরনের গন্ধ বেরোয়। ঠিকই বলেছে সে! বিরজুর মা বিবি বটে, হরতনের বিবি ! এ তো কোনো খারাপ কথা নয়। হ্যাঁ, সে সত্যি হরতনের বিবি!
0 মন্তব্যসমূহ