উপল মুখোপাধ্যায়ের গল্প : টেরেসে পেচ্ছাব ও চাঁদ



বালিশ খুব ভারী হয়। বিশেষ করে সে যদি পাশ বালিশ হয়। এত ভারী পাশ বালিশ নিয়ে কী করবে কী কয়বে করতে করতে সুদীপ্ত বলল,“ আমি সহ্য করতে পারি না।” গোটা তিনেক পাশ বালিশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে মাঝে ট্রেতে ভদকার বোতলের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ও কথা বলছিল। আরো কয়েকে ছিল - শুভঙ্কর বা রাজু বা টুবলু এরা সব ভারী ভারী বালিশের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে এলিয়ে কেলিয়ে মেলিয়ে পড়ে আছে।

ভারী বালিশটা কনুই দিয়ে ঠেসে হাতের তালু দিয়ে দাড়িওলা মাথাটা স্থির করতে করতে ডেফিনিটিভ তর্জনী উঁচিয়ে সুদীপ্ত বলছে তো বলছেই, বলছে তো বলছেই,“ ওই স্কুল আমাদের শেষ করেছে। করেই চলেছে।“ রাজু বলল,“ কেন? করেই চলেছে - কেন।“সুদীপ্ত বলল,“বলছি। হ্যাঁ বলেই চলেছি তো,শুনছিস না। ওই স্কুল আমাদের কী শেখালো? ভালো ছেলে হও, ওখানে সবাই পড়ত, পয়সা লাগতো না বলে সবাই পড়ত। মাস্টার প্রফেসর সবার ছেলে পড়ত। যাদের বাবারা মায়েরা প্রিভিলেজড তারা, আবার আমার মতো ছেলেরাও পড়ত যারা তা নয়।” শুভঙ্কর বলল,“ ঠিক ঠিক। একদম ঠিকঠাক।”টুবলু প্রতিবাদ করল,“মোটেই ঠিকঠাক নয়। সুদীপ্ত প্রিভিলেজড। ওর বাবা মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান ছিল। চেয়ারপারসন। সিপিএম ছিল। যথেষ্টই প্রিভিলেজড ছিল।”

সুদীপ্ত বালিশ ছেড়ে সোজা হয়েছে, বালিশ ছেড়ে দেওয়ায় তার বড় শরীর খাড়া। বুকে মাংস, পেটে মাংসেরা অতীত হয়েছে কারণ ও পেটটি ভেতর থেকে বেঁধে এসেছে যাকে অপারেশন বলে।ইএমআইতে বেরিয়াটিক সার্জারি করায় ওর ফ্যাটেরা দ্রবীভূত কিন্তু চামড়া বেড়ে টেড়ে পেট ড্যাবোর হয়ে, ভুঁড়ি হয়ে অনেক আগে থেকে একটু একটু করে বেড়ে উঠেছিল ফলত চামড়াটা শুধু ঝুল ঝুল করে। খাড়া হয়ে বসায় তার পেটের বেকার হওয়া চামড়ার স্তর আবার থল থল করে ভুঁড়ির মতো পরতে পরতে সাজিয়ে বসে গেল যা দেখতে কেমন লাগবে আগে থেকে ডাক্তার আন্দাজ করতে পারেনি পারলে চামড়া ছাড়িয়ে নিত।

সে বলল,“চেয়ারম্যান ছিল। চেয়ারপারসন ছিল। কোন দিন এক পয়সা — ” রাজু কোন এক বালিশের কোনা দিয়ে তাকিয়ে ছিল। ডাঁই বালিশগুলো এদিক ওদিক হয়ে কখনও গ্রান্ড ক্যানিয়ন কখনও চম্বলের বেহড়ের আকার নিতে নিতে আবার বিছানা বালিশ হয়ে পড়ছে। সে কোঁত পেড়ে পেড়ে বলে,“সেটা কোন কথা নয় — তোর বাবা সিপিএম ছিল, কমিউনিস্ট পার্টি করবে আবার সততার বড়াই করবে এ চলবে না, এ চলবে না।” সুদীপ্ত বলে,“ যা যা সিপিএম হতে যাবে কেন, সিপিএম সাপোর্টেড নির্দল — সমর্থিত। বাবা জীবনে কোন পার্টি করেনি। একদম সোস্যাল। ক্লাব করত। সিউড়ির সবচেয়ে বড় পুজোটা বাবার ক্লাব করত। পুরো সোস্যাল।

___ পুরো সোস্যাল?

___ হ্যাঁ - এ্যা বিট পলিটিক্যাল তো বটে।

___ মানে সিপিএম।

___ সরলীকরণ করিস না। সমর্থিত । নির্দল।

___ ওই হল।

___ কী হল?

___ ওই-

___ কী ?

___ একরকম সিপিএমই।

___ না।

___ আচ্ছা নট লেস্ দ্যান সিপিএম— একটু কম কম।

___ আর বেশি বেশি?

___ বেশি বেশি না। বাবা বেশি ছিল না। সোস্যাল।

টুকলু বালিশে মুখ রেখে রেখে ওম নিচ্ছিল। হালকা এসি চলছে তবু বালিশের গরম কী বোঝা যায়। কোথায় কোন বাংকারে গোলাগুলির শব্দে যেন ওর ঘুম ভাঙল,“অবশ্যই তোর বাবা প্রিভিলেজড। প্রিভিলেজড ধরে নিয়েই বল।”সুদীপ্ত বলে,“ স্কুল নিয়ে আমার অনেক রাগ। ওই সরকারী বিনে পয়সার গরীবির এ্যারিস্টোক্রেসি। আমাদের লাইফ শেষ করেছে। অনেক সময় চলে গেছে মিছিমিছি। আরো আগে হতে পারত। আরো আগে হতে পারত।”

___ কী হতে পারত?

___ অনেক কিছু হতে পারত। হতে দিত না ওই প্রিভিলেজড দলবল। মাস্টার প্রফেসর সরকারী আমলা ডাক্তার তাদের ছেলেপুলেরা। সবাই এক জায়গায় পড়বে।

___ কেন পড়বে ?

___ কেন পড়বে না। সবার অধিকার থাকবে— সে রকমই তো কথা ছিল। সবার রাইট।

___ আমার চাওয়ার কী হবে?

___ মানে।

___ চয়েস। আমার চয়েস। আমার চয়েস থাকবে না।

___ চয়েস না ডিজায়ার?

___ ডিজায়ার হলে আপত্তি আছে। কোন শালা বলবে আপত্তি আছে।

___ আমি। তবে আমি বলব না।

___ কারণ? কেন বলবি না?

___ কারণ এটা তোর।

___ মানে?

___ ফ্ল্যাটটা। এখানে আমরা—

___ তোরা? তোরা কী ?

___ এ্যা বিট অফ — উমেদার তো বটে।

___ ধূস্ ফালতু কথা বলবি না। সবার সমান। সমানাধিকার। এই ঘরে।

___ কিছুটা—

___ হ্যাঁ কিছুটা হতে পারত। এর কাছ থেকে নিয়ে ওকে দিতে পারত। তানা সব সরকারী । বিনি পয়সার। মাগনার

___ কী মাগনা?

___ মাগনা স্কুল মাগনা হাসপাতাল মাগনা রেশন মাগনা কন্ডোম মাগনা জন্ম মাগনা মৃত্যু —

এই ভাবে মাগনা মাগনা করতে করতে সুদীপ্ত বিছানা ছেড়ে মদের বোতল বালিশ হয়ে উঁচু নিচু প্রাকৃতিক নানা আকার নেওয়া বিছানার বেশ এক অঞ্চল ছেড়ে ধপ ধপ করে বাথরুমের দিকে যায়। সে আরো এগোতে থাকে, এগোতে এগোতে যেতে যেতে কোথায় চলে যায়। তখন আবার ঘরের সন্ধান পেতে হাঁটতে আরম্ভ করতে হয়। রাতের মতো করে দেখতে শিখতে জানতে হয় যখন দূরত্ব বেড়ে হাতের বাইরে চলে যেতে যেতে হয়ত কারো চোখের দিকে তাকাল। সেই চোখ সে সারা শরীরময় বুঝতে পারে, সহস্র নেত্র হয়ে তাকানোর জন্য এই ফ্ল্যাট নয়। এখানে ওখানে পাঁচিল তুলে তুলে তার মধ্যে জায়গা বার করা এই আবাসনের একটা ঘরে সুদীপ্ত তার বন্ধুদের ট্রিট দিচ্ছে। তার ফ্ল্যাট এটা নয় । এই ফ্ল্যাট সে ভাড়া নিয়েছে দিনের হিসেবে। তার নিজের ফ্ল্যাটে সব ঠিকঠাক আছে — তার বউ বাচ্চা বাবা মা। এখানে কি তার বউ আসবে? কেমন হবে তর বউ? কেমন দেখতে হবে?

এ সবের সঙ্গেএই ফ্ল্যাটটির কোন সংযোগ নেই - সে দেখতে ভালোই। আর ভালো তাকে হতেই হয় কারণ তাকে প্রমাণ করতে হয় সে পুরোপুরি সাজানো গোছানো। তার দুটি বা তিনটি ঘর আছে,ঝকঝকে তকতকে ঘর। বাথরুম আছে দুই, বাসনপত্র আছে জল আছে। বাথরুমে যেতে যেতে সুদীপ্ত ভাবছিল ওরা ভাবছে এই ফ্ল্যাট তার নিজের। এদের ভুল ভাঙানোর জন্য তাড়া নেই। বেশ কয়েকটা মাল আছে যাদের একটু দূরে রেখে গা ঘিন ঘিন সংস্পর্শ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে হয়। আরে বাবা চাইলেও কাছে টানা যাবে কি ? সম্ভব নয়। খেতে খেতে বাওয়াল করার জন্য ঠিক আছে। বাথরুমে পেচ্ছাপ করতে করতে এ সব ভাবতে ভাবতে সুদীপ্তর দারুণ হাল্কা হাল্কা লাগল। জল ছেড়ে নুনু নাচাতে নাচাতে সে হাসে আর তার সারা শরীর দোলে। দে দোল দোল, দে দোল দোল করতে করতে সুদীপ্ত বুঝতে পারে ফার্নিসড ফ্ল্যাটটা দুলব দুলব করেও দুলল না। আজকাল বেশি মদ খেতে পারে না সুদীপ্ত ,খাবারও না। বেরিয়াটিক সার্জারি করে তার পেট ছোট করে বেঁধে দিয়েছে। খাবার কমে গেছে,মদ কমে গেছে,বেশি চাট খেতে পারে না। খেয়ে ফেললে কষ্ট হয় এমন যে আর ইচ্ছে করে না। আর কী কী কমে গেছে বুঝতে বুঝতে সে বিছানায় শুয়ে পড়ার আগে দেখে সবাই প্রায় দলামলা হয়ে খাটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। না, এখানে জায়গা হবে না।

অন্য ঘরটায় যেতে আরম্ভ করতে সুদীপ্ত পা বাড়াতে গিয়ে হোঁচট খেল বটে। রাজু হামাগুড়ি দিচ্ছে। তার ওপর পড়তে গিয়ে সামলে নিতে নিতে রাজুকে তুলে ধরল ও। টলছে আর বিড় বিড় করছে। ওকে ধরে ঝাঁকাতে থাকল সুদীপ্ত আর বলে,“ চল ও ঘরে চল। আমার এই ফ্ল্যাটটা আরো বড় । কত বড় বড় ঘরগুলো দেখ। ফুললি ফার্নিসড — তার ওপর লাগোয়া টেরেস আছে। কত ফুল গাছ হয়। কত পাখি আসবে। কত গন্ধ ছড়াবে।” রাজু বলল,“গন্ধ ছড়াবে কেমন করে?”সুদীপ্ত বলল,“ছড়াবে ছড়াবে— ছোটবেলার ছড়াতো না। ” রাজু বলল,“তুই আড়াই লাখ টাকা মাইনে পাস?” সুদীপ্ত বলল,“আরো বাড়বে জানুয়ারি থেকে। ”

রাজু বলল,“আমি কিন্তু টাকা চাইব না। চাইব না টাকা আমরা।”সুদীপ্তর খানিকটা সন্দেহ হওয়ার মতো হল। সে রাজুকে টেরেস দেখাতে নিয়ে গেল। টেরেসটির তলায় মাঠে এখানে ওখানে নানা ল্যান্ডস্কেপ ধরে ধরে আলো দিয়ে দিয়ে সাজানো আছে। সেখানে এখানে ওখানে সিকিউরিটিরা , তারা খুব নিশ্চিত যে এখানে ওখানের থেকেও আরো বেশি বেশি করে নজরদারি আছে,সিসি টিভি ফুটেছে তুলে রাখা হচ্ছে, কন্ট্রোল রুমে তাদের সুপারভাইজাররা সেই সব ছবিগুলো বিশ্লেষণ করছে আর দরকার হলে মাঝেমধ্যে ওয়ারলেসে মোবাইলে ফোন করে করে খোঁজ হওয়া ছবিগুলোর কাছাকাছি চলে গিয়ে সেই ছবি সম্বন্ধে নানান তথ্য জানান দিতে হয়। সে জন্য আজকাল সিকিউরিটিরা খুব নির্লিপ্ত থাকে — তাদের কাজ দেখা নয়, দেখা জিনিসের খোঁজ করা। টেরেসের মধ্যিখানে গিয়ে রাজুকে ফুল দেখাতে দেখাতে সুদীপ্তর মনে হল চাঁদ সম্বন্ধে কিছু খোঁজ নেওয়া যাক। সেটা করতে হলে আবার আকাশের দিকে দেখতে হয় কারণ চাঁদ নেমে আসার মতো ঘটনা ঘটবে কিনা সে এক রহস্যময়। এই চাঁদ সম্পর্কে যাঁরা বলেচেন তাঁদের মধ্যে সৌগত বালীর কথা ইচ্ছে করেই বলি আরকি। ও বলেচে—যাঁদের যাঁদের চাঁদ দেখার মতো সঞ্চয় এখনো রয়ে গেছে তাঁদের জন্য শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা।

এটা কি বুদ্ধ পূর্ণিমা নাকি অন্য পূর্ণিমা সেটা নিয়ে ভাবছিল সুদীপ্ত। রাজু তখন পেচ্ছাপ করছিল। সুদীপ্ত দেখে রাজু টেরেসের ওপর থেকে নিচের দিকে ওপরের দিকে ছর ছর করে মুতে ভাসিয়ে দিচ্ছে। সুদীপ্ত রাজুকে পেছন থেকে দেখতে চাইছে— পেচ্ছাপের সামনাসামনি আসার কোন ইচ্ছে তার নেই।

কোন ইচ্ছে তার নেই রেললাইনের ওপর শুয়ে শুয়ে অকাতরে ঘুম দিতে দিতে নিশ্চিন্তে কাটা কাটা ছেঁড়া ছেঁড়া হয়ে মালগাড়ির ভারী ভারী লোহার চাকার তলায় কাটা অথবা কাটার নাম করে থেঁতলে হিঁচড়ে মরার মতো কোন একটা কিছু প্রায় বুঝতে না পেরেই করার। তাই সে রাজুর মুখোমুখি হতে না পেরে,তার পেচ্ছাপ টেচ্ছাপ আটকাতে না পেরে তাকে টানতে থাকে আর রাজু বলে,“দাঁড়া দাঁড়া টানিস না টানিস না,একটু একটু।” টেরেস থেকে কয়েকটা টব ও গাছের বাহার পেচ্ছাপের সঙ্গে আছড়ে আছড়ে পড়ল তবু সিকিউরিটিরা কোন শব্দ পায় না। তারা শুধু অপেক্ষা করে কখন কন্ট্রোলরুম থেকে ছবি দেখে দেখে তাদের ছবির কাছাকাছি ঘটনার অনুসন্ধানে পাঠানো হবে আর সুদীপ্ত ভাবছিল,“পেচ্ছাপ করেছে ঠিক আছে,ছবি ওঠেনি তো —”


-------------------













লেখক পরিচিতি
উপল মুখোপাধ্যায়
গল্পকার।
পশ্চিমবঙ্গে থাকেন।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

7 মন্তব্যসমূহ

  1. জয়দেব চক্রবর্তী ৬ই সেপ্টেম্বর ২০২০ সকাল ৮.৩০ বেশ ভালো

    উত্তরমুছুন
  2. বাংলায় এ গল্পের পাঠক এখনও ঠিক তৈরি হয়নি। ভবিষ্যৎ পাঠকের জন্য লেখা এই গল্প, মনে হয়, বাংলা গল্পের ভবিষ্যৎ।

    উত্তরমুছুন
  3. বাংলায় এ গল্পের পাঠক এখনও ঠিক তৈরি হয়নি। ভবিষ্যৎ পাঠকের জন্য লেখা এই গল্প, মনে হয়, বাংলা গল্পের ভবিষ্যৎ।

    উত্তরমুছুন
  4. বাংলায় এ গল্পের পাঠক এখনও ঠিক তৈরি হয়নি। ভবিষ্যৎ পাঠকের জন্য লেখা এই গল্প, মনে হয়, বাংলা গল্পের ভবিষ্যৎ।

    উত্তরমুছুন