রুখসানা কাজলে'র গল্প : ছিন্ন মানবতার চূর্ণ কান্না- প্রাণ হে


বেডরুমের দুটি আলোই জ্বেলে দিয়েছে লায়লা । সাদা আলোয় চকচক করছে আয়নার কাঁচ। এবার সেই আয়নার সামনে নিজেকে মেলা দেয় ও। উন্মুক্ত এবং নগ্ন। গেল দেড়মাসের প্রতিটি দিন এভাবে খুঁটে খুঁটে শরীরের প্রতিটি অংশ খুঁজে দেখছে। কিছু কি বদলে গেলো ওর চেনা শরীরের কোথাও !


আয়নার লায়লাকে ঝকঝকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ডানে ঘুরে বামে ঘুরে কোথাও কোন পরিবর্তন হয়েছে কিনা ভাল করে দেখে লায়লা। হাত দিয়ে স্তনদুটো তুলে ধরে। সামান্য স্ফুটিত নিপল্‌। গোলাপ কুঁড়ির মত তাতে স্পষ্ট হচ্ছে মাতৃত্বের মায়া। নিপল্‌কে কেন্দ্র করে স্তন জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে হালকা কালো ছায়া। নীল নীল শিরাগুলোতে ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ তুলেছে মা নদীর শান্ত জলস্রোত। পেট ছুঁয়ে হাত দুটো নামিয়ে আনে তলপেটের উপর। একেবারে সমান পেট। দৃষ্টিকে আরও সুতীক্ষ্ণ করে অনেকক্ষণ নাভির নীচে তাকিয়ে থাকে। উঁহু সামান্যতম উঁচু লাগছে না ওর নাভিতল। আলমারীর রিং থেকে গজ ফিতে টেনে আনে। মাপ নেয় তলপেটের। যা ছিল, তাই-ই আছে। রোজকার মত কয়েক বার করে মাপ নেয়। বুক পেট। পেট বুক। লায়লার শরীর একটি মা বৃক্ষ হয়েছে। সদ্য অঙ্কুরিত একটি নব বৃক্ষের মা। দু মাসের সামান্য কম। কিন্তু অঙ্কুরোদগমের সামান্য ছায়া ছাড়া আর কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

এ কদিন গুগল সার্চ করে গর্ভধারণের ব্যাপারে ওরা অনেক কিছু জেনে ফেলেছে। তাতে লেখা আছে, মর্নিং সিকনেস ছাড়া দু আড়াই মাসের প্রেগন্যন্সি পিরিয়ডে শরীরের তেমন কিছু পরিবর্তন হয় না। আঙ্গুরের দানার মত একটি প্রাণ তখন আশ্রয় স্থির করে নেয় মায়ের জরায়ুতে।

লায়লার মন ভরে থাকে মা মা সুগন্ধে।

দু স্তনের উপর হাত রেখে অনেক অনেক ক্ষণ তাকিয়ে থাকে লায়লা। এক সময় কর্‌কর্‌ করে ওঠে ওর দুচোখ। এবার আয়নার বুকে মাথা ঠেকিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। সে কান্নায় বেজে ওঠে প্রকৃতির হাতে অপার হয়ে যাওয়া মানুষের ব্যুহহীন অসীম অপারগতা।

অথচ কয়েক সপ্তাহের একটি ভ্রুণ ওদের পৃথিবীটাকে বদলে দিয়েছিল কত আনন্দ হাসিতে।

মার্চের দু তারিখে প্রেগনেন্সি রিপোর্ট পজেটিভ জেনে ফাহিমের সে কি নাচ। দুই বন্ধুর সাবলেট বাসা আনন্দে ভরে গেছিল সেই সন্ধ্যায়। উইকএন্ড থাকায় সুখবরটি জানাতে ওরা চারজনই পর দিন ভোরে কেরানীগঞ্জ চলে গেছিল। লায়লার শ্বশুরবাড়ি। একই পাড়ায় মায়ের বাড়ি। মা আর শাশুড়িমা মহাখুশি। ফেরার আগে লায়লার ওড়নায় দুটো রসুন বেঁধে দিয়ে শাশুড়িমা বলেছিলেন, এখন কাউকে জানানোর দরকার নাই। মাস চারেক হোক তখন বলিস সবাইকে।

মাহিয়া তরিতরকারি বোঝাই ব্যাগ স্কুটির পেছনে রাখতে রাখতে তাল দিয়েছিল, হু হু ঠিক বলেছেন আন্টি। আকাশে চাঁদ উঠলে ----

ফেরার পথে ফাহিমের পিঠে মুখ গুঁজে লায়লা মনে মনে খুব হেসেছিল। ওর শাশুড়ি কোন দিন কোন সংস্কার মানেন না। ইশকুলে লায়লাদের ভূগোল পড়াতেন। এখনও চাকরী করছেন। কারো গলায় হাতে তাবিজ বা গিট্টু সূতা দেখলেই খেপে যেতেন। সেই মানুষটিও শেষে রসুনে্র উপর আস্থা দেখালেন ! হায় রে রক্তের টান !

অজানা এক মায়ায় লায়লাও সারাপথ রসুন বাঁধা ওড়নার কোণা ওর মুঠোয় ভরে রেখেছিল। ঘরে ফিরে অফিসের ব্যাগে রাখতে রাখতে ভেবেছিল, সত্যি মহাচীনসহ অন্যান্য দেশে যা হচ্ছে ! কখন বাংলাদেশে কভিড১৯ ঢুকে পড়ে কে জানে বাবা !

খুব আনন্দে ছিল ওরা। বিশ্বজোড়া করোনা মহামারী ওদের এই আনন্দে তেমন বাঁধা দিতে না পারলেও কিছুটা আতঙ্ক আর চিন্তা তো ছিলই। চারজন বন্ধুই চাকরি করে ব্যক্তিগত মালিকাধীন অফিসে। কয়েকবার বিসিএস দিয়েছিল ওরা। চান্স পায়নি কেউ। তাই আর সময় নষ্ট না করে চাকরিতে ঢুকে গেছিল। চাকরির বয়েস মাত্র দু বছর হতে চলেছে। প্রত্যেকের বেতন চল্লিশ হাজারের নীচে। লায়লা ফাহিম একই এজেন্সিতে একই সময়ে চাকরী পেয়ে গেছিল বলে সমান বেতন পায়। ওদের বন্ধু দম্পতি মাহিয়া নাঈম দুই অফিসে কাজ করত। দু বন্ধুই কিনে নিয়েছিল সেকেন্ড হ্যান্ড দুটি স্কুটি। বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি সার্ভিস চার্জ দিয়ে বত্রিশ হাজার টাকায় তিন রুমের ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে শুরু করেছিল সংসার জীবন।

৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারীদিবসের গিফট কিনে খেতে গিয়েছিল ফুড কর্ণার জয়তীতে। খাবার পরিবেশন করা চেনাজানা মেয়েটিই ওদের জানায়, দেশে কভিড রুগী ধরা পড়েছে । এবার আমরা শেষ ! কেন যে অই ইতালি গো দেশে ঢুকতে দিলো !

অন্য সময় হলে মাহিয়া বকে দিত, অই নূপুর দেশ কি তোর একার নাকি রে ! কিন্তু খাবার দিয়ে ভয়ার্ত নূপুরকে দেখে চুলবুলি মাহিয়াও চুপ করে যায়।

খাবে কি ওরা ! চারজনেরই মুখ শুকিয়ে গেছিল ততক্ষণে। তড়িঘড়ি খাবার শেষ করে কতগুলো মাস্ক কিনে ফিরে এসেছিল ঘরে। এরপরেই শুরু হয়ে যায় ভয় আর আতঙ্কের দিনরাত। করোনাভাইরাসের ঝুঁকি এড়াতে ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। দলে দলে গার্মেন্টস শ্রমিকরা কেবল মাস্ক পরে বাস, ট্রেন, লঞ্চ, ফেরি, নৌকা, স্পীডবোটে গায়ে গা লাগিয়ে ফিরে যায় গ্রামে। এদের প্রত্যকের মুখে অনিশ্চয়তার ছাপ। এ কোন অসুখ ! অভাবে ঘর ছাড়া মানুষদের আবার ঘরে ফিরিয়ে আনছে । এভাবেই কি মারবে তাদের ? যদি বাঁচে ছুটি শেষে কাজ থাকবে তো তাদের ? আচ্ছা কতদিন থাকবে এ অসুখ ? দুই, তিন চার যদি তার বেশি মাস চলে তবে খাবে কি ? খাওয়াবে কি ?

সবাই ধারণা করেছিল বাংলাদেশ উষ্ণ দেশ । সুতরাং কভিড১৯ তেমন সুবিধে করতে পারবে না এদেশে। কিন্তু দিন দিন দেশের পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। মৃত্যুর সংখ্যাও উর্ধ্বগামী। তাছাড়া বাংলাদেশের ব্যবসা বানিজ্যের সাথে জড়িত ভারত, চীন, সিঙ্গাপুর, ইতালী, আমেরিকা, ইংল্যান্ডসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে করোনার থাবা মানব মৃত্যুসহ ধ্বসিয়ে দিচ্ছিল প্রতিটি দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে। প্রতিটি দেশে সাধারণ ছুটি আর লকডাউন। বাজার ঘাট, অফিস আদালত, ইশকুল কলেজ বন্ধ। ঘর নয় মানুষ যেন খাঁচায় বন্দি প্রাণী হয়ে গেছে। বাইরের সংস্পর্শ থেকে সুরক্ষা পেতে ঠিকা কাজের বুয়াদেরও নিষেধ করে দিয়েছে বাসাবাড়ি ফ্ল্যাটের খালাম্মা আন্টিরা। ব্যবসা বাণিজ্য অফিস দোকান বাজার প্রায় বন্ধ। বেসরকারী চাকুরীজীবী, শ্রমিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, দোকানদার, রিকশাচালক, ড্রাইভাররা বেকার হয়ে যাচ্ছে ! কি করে চলবে এদের সংসার, সন্তানদের খাওয়াপরা, বাড়িভাড়া। আসন্ন যে কোন হঠাত বিপদ এলে কি করে এরা সামাল দিবে !

এ ভাইরাসের মৃত্যুবাণ এখনও অনির্ণেয়। ক্রমশঃ পরিবর্তনের মাধ্যমে কোভিড১৯ নিজেকে আরও শক্তিমান করে তুলছে। বিভিন্ন দেশের অণুজীব বিজ্ঞানীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে তবু এখনও কোন ওষুধ আবিস্কার হতে পারেনি। ফলে চিকিৎসাও নেই। একমাত্র জনবিচ্ছিন্ন থেকে পরিচ্ছন্ন থাকা এবং গরম পানিতে গার্গল, চা লেবু খেয়ে নিজেদের সুস্থ রাখুন বলা ছাড়া ডাক্তারদের হাতে আর কিছু বলার নেই। এ এমন এক রোগ যে ডাক্তার ছুঁলেও তার রক্ষা নাই।

এপ্রিলের ১ থেকে আবার সাধারণ ছুটির নির্দেশ আসে। কিন্তু ঘটে যায় অভূতপূর্ব এক ঘটনা। গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির যে শ্রমিকরা ফিরে গেছিল তারা আবার ফিরে আসতে থাকে। গার্মেন্টস বন্ধ নাকি খোলা, কে কেন তাদের ফিরতে বলেছে তাই নিয়ে চাপান উতর চলতে থাকে সুধীজন আর ফেসবুকের পাতায় পাতায়। কিন্তু শ্রমিকরা ফিরছে। তারা ফেরার নির্দেশ পেয়েই ঢাকামুখী যে কোন পথ অবলম্বন করে মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে ফিরে আসছে। সাধারণ যানবাহন বন্ধ থাকায় হেঁটে আসছে অসংখ্য শ্রমিক। ক্ষয়ে যাচ্ছে স্যান্ডেল। খালি পায়ে রক্ত ঝরছে। তবু চাকরি বাঁচাতে ফিরে আসতেই হচ্ছে।

সংবাদপত্র আর টিভির পর্দায় এসব ছবি দেখে বুক কেঁপে ওঠে ওদের। ক্ষুধার কাছে নিশ্চিত হেরে গেছে মৃত্যুভয়। পাটুরিয়াঘাটে দুই সন্তানের মা রাবেয়া মৃধা বোরকার ঝুল উপরে তুলে হাঁটা না থামিয়ে সাংবাদিককে বলে, ঘরে থাকলিও করোনাতে মরতি পারি গো ভাইধন। স্বামিডা বেকার হয়ি পড়িছে। দুডে বাচ্চা, মা শাশুড়ি। প্যাট আগি---

অবিশ্রান্ত পথচলা না থামিয়ে কিশোর শ্রমিক রাহেলউদ্দিন গাজীপুর চৌরাস্তার মোড়ে মাথায় পানি ঢেলে জানায়, আমরার আবার মরা আর বাঁচা।

অনেকগুলো শুকনো নারকেল, মোচাথোড়ের ভারে ন্যুব্জ জেসমিন নূরজাহানরা সদরঘাট থেকে হাঁটতে শুরু করেছে। আলোকচিত্রীরা প্রশ্ন করার আগেই বলে দেয়, কন দেহি মনুভাইজানেরা খিদে আগে না মিত্যু আগে। এহন যাতি দ্যান গো। দেরি করায়েন না তো দেহি।

এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে মাহিয়ার অফিস বন্ধ করে দেওয়া হল। প্রচুর দুঃখ প্রকাশ করে জানিয়ে দেওয়া হল আপাতত অফিস বন্ধ। দুঃসময় কাটলে দেখা যাবে। মাহিয়া কদিন ঘরে থেকে কি করবে ! বাপের বাড়ি চলে গেছে। এরকম চাকরী নেই হয়ে যাওয়ার অনেক খবর শোনা যাচ্ছে। ফাহিম লায়লা ভয় পায়। নাঈম যদি বাসা ছেড়ে দেয় তাহলে কি করে সামাল দিবে ওরা ? ওদের অফিসের অবস্থাও ভাল নয়। নাঈমও চিন্তিত। একেই করোনার আতঙ্ক তার উপর চেপে বসেছে চাকরি হারানোর অনিশ্চয়তা। তবু কথা দেয়, চাকরি থাকলে সে এ বাসাতেই থাকবে। নইলে গ্রামে ফিরে যাবে।

ফাহিম দুশ্চিন্তায় ঘুমুতে পারে না। ঘন ঘন পানি খায়। ঘুরে ফিরে বিছানায় এসে বসে। ঘুমিয়েও পড়ে। কিন্তু সে সামান্য ক্ষণ। আবার জেগে উঠে টিভি অন করে দেয়। সিনেমা নাটক, বিজ্ঞাপন সবই আগের মত আছে। কেবল নতুন করে যুক্ত হয়েছে হাত ধোয়া আর বার বার করোনায় মৃত্যুর হিসাব দেওয়ার সংবাদ। ধ্বসে যাচ্ছে চীন আমেরিকা, ধুঁকছে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, ইতালী, স্পেন ব্রাজিল। হজ্ব বন্ধ। সৌদি আরবে ছড়িয়ে পড়েছে মরণ। পাশের দেশ ভারতে কর্মহীন শ্রমিকদের কষ্ট দেখে কান্না পেয়ে যাচ্ছে।

ফেসবুক, টিভি আর ভাল লাগে না লায়লার। নেটফ্লিক্সেও বিরক্ত ধরে গেছে। আনন্দ মিইয়ে আতঙ্ক ধরেছে মনে। তাছাড়া যখন তখন পেট মুচড়ে বমি আসে। মাস্কের গন্ধে গা গুলোয়। হাঁসফাঁস লাগে। নিজের বানানো মাস্ক পরেও শান্তি পায়না। সামান্য কিছু খেয়ে ঘুমিয়ে যায়। ওদের অফিসের আনাচ কানাচ থেকে নানা খবর ভেসে আসে। ফাহিম নাঈম নিজেরাই সান্ত্বনা খোঁজে, ঘরে বসিয়ে কোন মালিক কবে বেতন দিয়েছে তার কর্মচারী কর্মকর্তাদের ?

এপ্রিলের মাঝামাঝি ফুল বেতন দিয়ে নাঈমকে জানিয়ে দেওয়া হলো অফিস ধুঁকছে। আর পারছে না। ওরা জানত এরকম কিছু হবে। কারও হাতেই কিছু করার নেই। কষ্ট ঝেড়ে নাঈম স্মার্টলি ঠাট্টা করে বুঝলি তোরা, করোনাক্রান্ত বৈশাখের উপহার পেলাম, বেকারত্ব। এবার বাড়িওয়ালার সাথে কথা বলা দরকার রে ফাহিম। দেখি উনি কি বলেন।

আজকাল অনেক বাড়িওয়ালাই ভাড়াটেদের সাথে ভাড়া না পেয়ে দুর্ব্যবহার করছে। বাসায় ঢুকতে দিচ্ছে না বা মালপত্র রাস্তায় ফেলে রাখছে। ওদের বাড়িওয়ালা ইংল্যান্ড প্রবাসী বলে সে রকম আশঙ্কা নেই। তবু কথা বলে রাখলে ভাল হয়। ওইদিনই ফ্ল্যাট মালিকের সাথে যোগাযোগ করে সার্বিক পরিস্থিতি জানায় ওরা । সত্যিকারের ভদ্রলোক ওদের বাড়িওয়ালা। ঠিক হয় সার্ভিস চার্জসহ, গ্যাস বিদ্যুৎ, পানির বিল ফাহিমরা নিয়মিত দিয়ে যাবে। ফ্ল্যাটভাড়া জমা থাকুক। দিতে পারলে পরে দিলেও চলবে। এ মহামারী সহজে থামবে বলে মনে হচ্ছে না। কবে ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয় কে জানে। আচ্ছা থাকো তোমরা। দোয়া করো আমার জন্যে। ভদ্রলোকের সহমর্মিতায় তিনটি তরুণের চোখে পানি চলে আসে।

নাঈম অনেক চেষ্টা করে আরেকটি কাজ পেতে। সবখানেই ছাঁটাই। আপাতত কাজ নেই কোথাও। ব্যাংক, বীমা, সংবাদপত্র অফিস, প্রাইভেট ইশকুল, অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারীদের ভয়াবহ করুণ অবস্থা। একটি ইশকুলের প্রধাণ শিক্ষক তার সহকর্মিদের নিয়ে তরিতরকারীর ব্যবসা শুরু করে দিয়েছে। বাঁচতে এবং বাঁচাতে হবে যে !

সপ্তাহ খানেক পর, বাড়ি যাওয়ার আগে নাঈম বলে যায়, কিছু তো করতেই হবে রে। ছোট দুটি ভাইবোন আছে। মা বাবা বউ। আব্বার ছোট্ট দোকান চলে না প্রায়। দায়িত্ব তো আমারই।

কি করা যায় ? ভেবেছিস কিছু ? ফাহিম জানতে চায়।

স্যুটকেসে তালা দিয়ে নাঈম রেডি, কিছু তো করব। কাজ না পেলে ইজিবাইক চালাব। এখন প্রতিদিনের জন্যে বেঁচে থাকার স্ট্রাগল করতে হবে। ঘরে বসে থাকলে চলবে না রে। আসি। তোরা ভাল থাকিস। সুস্থ থাকিস। নিজের যত্ন নিস লায়লা।

তিনজন জড়িয়ে ধরে তিনজনকে। কেউ কিছুতেই কান্না থামাতে পারে না ।

মাহিয়া ফোন করে। গ্রামের অবস্থাও খুব খারাপ । সারাক্ষণ উৎকন্ঠায় থাকে। নাঈম বসে থাকার লোক নয়। বাইক চালাচ্ছে। মাঝে মাঝে দুজনকেও তুলে নিতে হয়। দিন আনা দিন খাওয়া। তাতে দুঃখ নাই। কিন্তু সংক্রমণের ভয় লাগে। রোজ এক গামলা পানিতে সাবান গুলে বসে থাকে মাহিয়া। নাঈম এলে গরম পানিতে গোসল করিয়ে কাপাড় জামা ধুয়ে তবে শান্তি। ফ্লোর পাকা এটাচ ওয়াশরুমের একটি টিনের ঘর তুলেছিল ওরা । কেউ কাশি দিলেই তাকে সেঘরে কোয়ারেন্টাইন করে দিচ্ছে নাঈম। একেকটা কাশির শব্দ ইস্রাফিল ফেরেশতার শিঙার ফুঁয়ের মত লাগে ! যেন কেয়ামত এসে গেছে।

রাতে অনেকবার ঘুম ভেঙ্গে যায় লায়লার। খুব গরম লাগে আজকাল। গরমে ঘাম বসে যাচ্ছে গলায় বুকে। খুসখুস করে গলা। আর কত গার্গল করা যায়। বমি ঠেলে আসে নাড়িভুঁড়ি ছেঁকে। আগে এরকম হত না। লায়লার বড় খালার মেয়ে আসমা গাইনি এসিস্টেন্ট। ওকে জানিয়েছিল। আসমা বলেছে এরকম নাকি হয়। এ সময় হবু মায়েরা তাদের হবু বাচ্চার প্রটেক্টটর হয়ে ওঠে। ফলে টেনশন হয় আর তাতে গরম বেশি লাগে। তাছাড়া সময়টা ভাল নয়। তোর জন্যে আমারও টেনশন হচ্ছে রে লায়লা। এমন দুঃসময় প্রেগনেন্ট হলি তুই !

বোনের কথা শুনে লায়লা ভাবে, আরও একজন মানুষের ভার বাড়ছে বলেই এত গরম লাগছে। যে দুঃসময় চলছে তাতে টেনশন তো হবেই। পানি খেতে খেতে হঠাত থেমে যায় ওর হাত, শুধু কি ভার ? অনাগত মানুষটি বোঝা হয়ে উঠবে না তো তাদের কাছে ? কোথায় যেন পড়েছিল, শিশুপালনে পিতামাতার আর্থিক সক্ষমতা, মুক্ত ও আনন্দময় পরিবেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ মুহুর্তে তারা কি সক্ষম ? না হয় বেড়াতে গেল না কোথাও, যেটুকু দরকার তাই খেলো, অতিরিক্ত মেপে সংসার চালালো কিন্তু পারবে কি শিশুটিকে একটি সুস্থ সুন্দর মুক্ত পৃথিবী উপহার দিতে ?

মাথা ঘুরে ওঠে ওর। কেমন শীত শীত শিরশিরানি লাগে রোমকূপের গোঁড়ায়। ফ্যান অফ করে ড্রইংরুমে চলে আসে। ফাহিম ঘুমুচ্ছে । একটি হাত ফ্লোরে পাতা শতরঞ্জিতে ঠেকে গেছে। আর হাতের কাছে সেন্টার টেবিলের পায়ে বাঁধা পেয়ে একটি কাগজ ফ্যানের বাতাসে থরথর করে কাঁপছে। লায়লা তুলে নেয়। নিত্য দিনের হিসাব লিখে রাখা ওর আর ফাহিমের অভ্যাস। কিন্তু গেল দুদিন কোন বাজার হয়নি ! ফাহিম অবশ্য একবার বেরিয়েছিল স্ক্রুটিতে স্টার্ট দিতে। তবে কি তেল কিনেছে ? কিন্তু বেশ বড় হিসাব লেখা মনে হচ্ছে। ভাল করে দেখে লায়লা, ওদের দুজনের বর্তমান বেতনের সাথে নিত্যদিনের খরচগুলো লিখেছে ফাহিম। তাতে লায়লার মা আর ভাই বাদ যায় নি। আরেক পাশে একটি সম্ভাব্য হিসাব লেখা। যদি ওদের বেতন হাফ করে দেয় তো কিভাবে চলতে হবে তার খসড়া করেছে। সব শেষে কয়েকটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন। তার নীচে একটি স্টার। স্টারের সার্কল পয়েন্টে একটি শিশুর হাসিমুখ। শিশুটির ডানগালে আঁকা একটি কালো আদুরে হার্ট।

দ্বিগুণ দুলে ওঠে লায়লার মাথা। সেই সাথে কোথা থেকে কে জানে কেমন এক অসহায় গুমোট গন্ধ ভেসে এসে ঝাপটে ধরে। মুচড়ে ওঠে পেট। ছুটে যায় ওয়াশরুমে। যতটুকু পানি খেয়েছিল তার বেশি বেরিয়ে যায় শরীর থেকে। ঘুম ভাঙা ফাহিম ওয়াশরুমের দরোজায় এসে দাঁড়ায়, বাচ্চাটা তো খুব জ্বালাচ্ছে লায়লা। মহা দুষ্টু হবে বোঝা যাচ্ছে। নে মগটা ধর। গরম পানি দিচ্ছি । সাবধানে ধরিস।

গরম পানির মগ নিয়ে ফাহিমকে চলে যেতে বলে ও । এসব সিম্পটমে এখন ওরা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম ফাহিম ঠাট্টা করত, ডাক্তার ম্যাম বলেছিলেন মর্নিং সিকনেস। তোর দেখি যখন তখন মর্নিং দেখা দিচ্ছে রে লায়লা।

মাহিয়া মিথ্যে রাগ দেখিয়ে বলেছিল, প্রেগনেন্ট হলি বুঝতি ব্যাটা। আছিস তো আরামে। যত কষ্ট আমাগো। অথচ সবাই বলবে ফাহিমের ছেলে। নাঈমের মেয়ে।

নাঈম সাথে সাথে হইহই করে ওঠেছিল, মাহি তুই মাইয়ে পালি কই রে ? আমার তো ছেলেও হতি পারে।

নাঈমের পিঠে চটাস করে চড় মেরে মাহি ছুটে পালিয়েছিল, এখনই আমার আমার করছিস। যাহ্‌ আমি শালার বাচ্চাই নিমু না।

বিছানার উপর অবসন্ন হয়ে বসে থাকে লায়লা। সন্তান জন্মদানে পুরুষের আনন্দ দান ছাড়া প্রসবের পর্যায় পর্যন্ত নারীকে একাই অশেষ কষ্ট বহন করতে হয়। কিন্তু তারপর ? প্রতি পদে মায়ের পাশাপাশি থেকে একজন পুরুষকে দায়িত্ব পালন করতে হয়। চাকরি থাকলে এত ভাবনা ছিল না। যদি না থাকে ! কিম্বা হাফ বেতন করে দেয়, তাহলে ?

ওর বাবা নেই। মামারা মায়ের সম্পত্তিতে বাড়ি করে দিয়েছে। বছরের খাবার ওঠে আসে জমি থেকে। ফাহিমের আম্মু ওর মাকে কিছু টুইশ্যনি এনে দেয়। নীচু ক্লাশের ছাত্রছাত্রী। অভাবের গায়ে পিঠ রেখে ওদের দিন চলে যায়। এখন টুইশ্যনিও বন্ধ। ফাহিমদের যৌথ পরিবার। ভীষণ বুদ্ধিমতী বলে অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে নিপুণভাবে সংসার সামলে চলেছে ওর মা। ওদের দুজনের চাকরি ছিল দু পরিবারের শক্তি। কিছুতেই বিসিএস হল না ওদের। ফাহিমের দু ভাইবোন আর লায়লার ভাইকে ওরা শক্ত করে গাইড দিচ্ছে এখন থেকেই। বিসিএস পেতেই হবে ওদের সবাইকে বা কাউকে না কাউকে।

শুয়ে পড়ে লায়লা। উফফ্‌ আর নিতে পারছে না ও। এ কী অসুখ দিলে তুমি আল্লাহ ! তুমি না রাহমানের রহীম। মানুষকে ভালোবাস ! আমরা না তোমার প্রিয় নবীর উম্মত ! তবে এ কেমন দয়া তোমার ! আর কি মাফ করা যায় না আল্লাহ্‌ !

গলায়, মাথায় মুখে অনেকগুলো চুমু খেয়ে ফাহিম আদর করে ডাক দেয়, ওঠ লায়লা। আস্তে করে উঠ। যা মুখ ধুয়ে আয়। শুকনো মরিচ ভেজে নুডুলস করেছি। ঝাল ঝাল টেস্ট হয়েছে। খেয়ে দ্যাখ। তোর ভাল লাগবে।

ফাহিমের হাতের ভেতর মুখ গুঁজে দেয় লায়লা, এখনও কি রাত নাকি দিন ! সকাল হয়ে গেছে ?

ফাহিম হাসতে হাসতে পিঠ পেতে দেয়, ওরে কানিবুড়ি এখনও রাত্তির আছে। এবার ভোর হবে। নে ওঠ। শক্ত করে গলা ধরিস কিন্তু।

খেতে ভাল লাগছে লায়লার। একটুকরো লেবুও কেটে দিয়েছে ফাহিম, আজ তো মিটিং আছে তাই না। কি হতে পারে জানিস কিছু ?

চামচে নুডুলস তুলে ফাহিম জানায়, একটু আগে সাবেরভাই এসএমএস করেছে সবাইকে। পড়ে দেখিস। ডিসিশন হয়ে গেছে। চাকরি থাকবে তবে মে মাস থেকে হাফ বেতন নিতে হবে সবাইকে। যতদিন এজেন্সি কাজ পাবে ততদিন। এরপর বেকার।

দাঁতের নীচে এক টুকরো শুকনো মরিচ পেয়েছিল লায়লা। পিষে দিতে দিতে খুব আরাম পায়। সত্যি টেস্টটা ভাল লাগছে। ও আরও কিছু নুডুলস তুলে নেয়, তোর না কেরানীগঞ্জ যেতে হবে আজ ? যাবি ?

চামচবাটি সিংকে রেখে এসে ফাহিম জানায়, মিটিংয়ের পর যাব। একদিন থাকতে হবে বুঝলি। বড়চাচা করোনার ভয় পেয়েছে তাই বাড়ি ভাগ করে বুঝিয়ে দিতে চাইছে। সামান্যই পাব। হয়ত দুই আড়াই কাঠা। তুই একা থাকতে পারবি নাকি আসমাকে ডেকে নিবি ?

লায়লা ফাহিমের কোলের ভেতর ঢুকে পড়ে, ওতেই হয়ে যাবে আমাদের। নিজের বাড়ি বলে কথা। একটু মাথা টিপে দে না ফাহিম । খুব ভারি ভারি লাগছে।

ফাহিমের আঙুল যেন অক্ষর লিখে দিচ্ছে ওর মাথায়। আসমাকে রেডি হয়েই আসতে বলেছে লায়লা। এরকম অসহায়, অন্ধ বদ্ধ দুঃসময়ে ও কোন শিশু চায় না। যারা বেঁচে আছে তারা বাঁচুক।

--------------




লেখক পরিচিতি
রুখসানা কাজল
কথাসাহিত্যিক।
বাংলাদেশ, নর্থ ধানমন্ডিতে থাকেন।





                                                                                














একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ