কার্তিক বুলার দিকে বড় বড় চোখ দুটো মেলে তাকিয়ে। বুলা কার্তিকের চাইতে দশ বছরের ছোটো হবে। কার্তিকের গেল বৈশাখের চোদ্দোতে বত্রিশে পড়ল। বুলা একজন পুরুষের গল্প করছে। বুলা এক বাড়ি আয়ার কাজ করে, সেই বাড়িতেই ভাড়া থাকে তার গল্পের পুরুষ। বুলাকে সে চায়। বুলা বলে, তাকে চায় না, তার শরীরটাকে চায়। কার্তিক সবুজ কলাপাতা রঙের কামিজটার ধারটা টেনে সোজা করল। এমনি এমনিই করল। মন চঞ্চল হলে কার্তিক কামিজটাকে বারবার টেনে সোজা করে। মুদ্রাদোষ।
পিছনে ঘাড়ের উপর এলিয়ে পড়া চুলটা গার্ডার দিয়ে বাঁধা। একবার চুলের গোছাটা সামনে এনে বুকের উপর রাখল। বুলার বুকের দিকে তাকালো। বুলা মেয়ে, সত্যিকারের মেয়ে। পাপিয়া একটা আমপাতা নিয়ে পাতার পিছন দিকটা দিয়ে মাটিতে দাগ টানছে। পাপিয়া বয়সে বুলার কাছাকাছি হবে। বিকালবেলা, সাড়ে চারটে-পাঁচটা হবে। বেশ গরম, আষাঢ় মাসের প্রথম বুধবার। লকডাউন চলছে, দূরপাল্লার ট্রেন কিছু কিছু চললেও তাদের এই শিয়ালদা মেন লাইনে লোকাল ট্রেন এখনও বন্ধ। নইলে এই সময় কার্তিক এই গ্রামে থাকে নাকি? কলকাতায় নার্সিং হোমে কাজ করে। রান্নার কাজ। রুগীদের পথ্য রান্না করা। বুলা আয়ার কাজ করে বারাকপুরে। পাপিয়া কলেজে পড়ে, নৈহাটিতে। তাদের কাছাকাছি রেলস্টেশান বলতেও এই নৈহাটিই।
বুলা হোয়াটস অ্যাপ খুলে ছেলেটার ছবি দেখাচ্ছে। একটা নীল টিশার্ট আর জিন্স পরে বাইকে বসে, সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে। বেশ ফর্সা। লম্বাও কার্তিকের মতন হবে, প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুটের কাছাকাছি। আরেকটা ছবি, খালি গায়ে ছাদের কার্ণিশে বসে সিগারেট খাচ্ছে, বেগুনী রঙের হাফপ্যান্ট। কার্তিকের দৃষ্টি ছেলেটার প্যান্টের উপর দিয়ে কিছু একটা খুঁজতে চাইছে। নিষিদ্ধ দৃষ্টি। নিষিদ্ধ তৃষ্ণা। তবু তৃষ্ণা তো। বুকের ভিতরটা খামচে ধরল যেন কেউ, তলপেটের পেশীগুলোতে মোচড় খেলে গেল। কার্তিক চোখ সরিয়ে নিল। আকাশের দিকে তাকালো। আকাশে পাপ জন্মায় না, পাপ জমে না। সেখানে নিষিদ্ধ কিছু নেই। যত পাপ, নিষিদ্ধ তৃষ্ণা এই মাটিতে। মেঘ করে এসেছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বৃষ্টি হবে। যা ভ্যাপসা গরম গেল ক'দিন! হোয়াটস অ্যাপে ছবি সরে গেছে, এখন অন্য ছবি। ছেলেটার নাম পাপ্পু। মোবাইল সারানোর দোকান। এই ছবিটা বন্ধুদের সাথে, হাতে মদের বোতল সবার। পাপিয়া বলল, মাল খায়? বুলা বলল, এক নম্বরের হারামি শালা, সারাদিন ছুঁক ছুঁক করবে। আর সব দৃষ্টি বুকের দিকে। বুলা বলতে বলতেই নিজের ওড়নাটা টেনে নিল বুকের উপর। ঠিকই তো ছিল। আসলে অভ্যাস হয়ে গেছে। কার্তিক আজ ওড়না আনেনি। কলকাতায় যায় যখন পরে যায়। শূন্যতা ঢাকার লজ্জায় পরে যায়। থাকলে ঢাকত কোনোদিন? কার্তিক মনে মনে বলে, কক্ষনো না। বুলা বলে, তোমার যদি সত্যি সত্যি থাকত বুঝতে, কি নোংরা দৃষ্টিতে তাকায়, যেন গিলে খাবে। পাপিয়া হাসে, বলে, ভালোই তো। তাকাবে না? তারপর চটুল কথা, হাসাহাসি। কার্তিকও হাসে। জোর করে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে পুড়ে যায়। বুকের পাঁজরগুলো বেঁধে। শূন্যতার কাঁটা।
বুলা পা দুটো সামনে ছড়িয়ে কি একটা ভাবছে। পাপিয়া গুনগুন করে কিছু একটা হিন্দি সিনেমার গান গাইছে। অরিজিৎ সিং-এর কোনো গান। মনে পড়ছে না কথাগুলো।
কার্তিক বলল, বুলা আমি যদি করোনায় মরে যাই বেশ হবে বল? এমনিতেও আমার সাতকুলে কেউ নেই। কথাটা সত্যিই। কার্তিকের মা-বাবা অনেকদিন আগেই মারা গেছে। ভাইবোন বলতে কেউ নেই। কিছু আত্মীয়স্বজন আছে, কিন্তু কার্তিককে নিয়ে তাদের অনেক সমস্যা। আর হবে নাই বা কেন, হিজড়াকে কে আর নিজের আত্মীয় বলে? অনেকেই বলেছে কার্তিককে কারোর একটা দলে নাম লিখিয়ে নিতে। এই নৈহাটিতেই দুটো দল আছে। ওরা কার্তিকের সাথে যোগাযোগও করেছিল। কার্তিকের ইচ্ছা করেনি। সে স্বপ্নে বাঁচে। তার স্বপ্ন তার একজন নিজের পুরুষ মানুষ হবে। তাকে ভালোবাসবে, সে-ও ভালোবাসবে পাগলের মত। এখনও ভালোবাসে। প্রচণ্ড ভালোবাসে। তাকে ভালোবেসে তার রাতে ঘুম হয় না। শরীরে জ্বালা করে। বুকটা তুষের মত পুড়তেই থাকে, পুড়তেই থাকে। যাকে ভালোবাসে তার ছবিটা স্পষ্ট নয়। কিন্তু অবয়বটা স্পষ্ট। কে বলল, দীক্ষা নিলে মন শুদ্ধ হয়। তাও নিল। কণ্ঠি নিল। কিন্তু মন আর মন্ত্রের পার্থক্য হয়ে থাকল কয়েক যোজন। তার মনের উপর ভালোবাসা কাকতাড়ুয়ার মত বসে আছে। ঈশ্বর, শান্তি --- কেউ বসতে পায় না। তার পাপের ভালোবাসা, গুরু বলল। শরীর নাকি পাপের দিকে নিয়ে যায়। কার্তিক পাপ আর ভালোবাসা আলাদা করতে পারে না এখন। তাই পাপই চায়। ভালোবাসার মত পাপ। কিন্তু সেরকম মানুষ কই? শুধু ঠুকরে যাওয়ার মানুষ। আগলে রাখার মানুষ বানায়নি তার জন্যে ভগবান? তার বুকের রক্তে জাগা সেই পুরুষ কবে তার চোখের সামনে এসে দাঁড়াবে?
বুলা বলল, কার্তিকদা বাড়ি যাবে না? ফোঁটা ফোঁটা শুরু হয়ে গেল তো? কার্তিক হাতের পাতার দিকে তাকালো। তাই তো! বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে, বিন্দু বিন্দু জল। কার্তিক বলল, তোরা যা, আমি একটু বসে আসছি। পাপিয়া ইতিমধ্যে দাঁড়িয়ে ওড়নাটা মাথায় দিয়ে দিয়েছে, সে বলল, ভিজো না কার্তিকদা, জ্বর চলে এলে করোনা বলে কোয়ারেন্টাইনে নিয়ে চলে যাবে।
কার্তিক হাসল। বলল, কাদের কোয়ারেন্টাইনে রে? ছেলেদের না মেয়েদের?
বুলা দাঁড়িয়ে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, শুধু বাজে কথা তোমার... এসো তুমি, আমরা এগোই... চ চ... পাপিয়া... এমনিতেই সকাল থেকে আমার চারবার হাঁচি হয়েছে...
মা-কে মনে পড়ে না কার্তিকের। বাবাকে অল্প মনে পড়ে। কার্তিককে দু'চক্ষে দেখতে পারত না তার বাবা। বাবা মিস্ত্রীর কাজ করত। একটা ফ্ল্যাট বানাতে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে মরে গেল। বাবার সাথে শেষ কথা হয়েছিল, “এবারের পুজোয় জামাকাপড় চাইলে নিজেরটা নিজেই গুছিয়ে নিও। সে যেভাবেই হোক।” কথাটার ঝাঁঝ, ইঙ্গিত এখনও মাঝে মাঝে অস্থির করে তোলে কার্তিককে। মেনে নিতে পারে না। অথচ কত ব্যঙ্গ, কত বিদ্রুপকে সে এখন ডালভাত করে ফেলেছে জীবনে। বাবা মদ খেয়েই থাকত। তখন ক্লাস সিক্সে পড়ে কার্তিক। সদ্য মেয়েদের কাপড় পরা শুরু করেছে। বাড়িতে আর পাড়াতে একটা ফ্রক নইলে একটা সালোয়ার-কামিজ পরে ঘুরে বেড়াত। বাবা বলত, বেশ্যা। চুলের মুঠি ধরে বাড়ির বাইরে বার করে দিত। পাশের বাড়ির শর্মিলা মাসি কার্তিককে খুব ভালোবাসত। সে-ই খেতে দিত। নইলে মরেই যেত কার্তিক। এখন শর্মিলা মাসির ছেলেরা বড়। কার্তিক তাদের বাড়ি যাক তারা পছন্দ করে না। সেও যায় না। শর্মিলা মাসি তাকে পুজোর সময় শাড়ি পাঠায়। বলে, তুই আমার মেয়ে।
হঠাৎ মনে পড়ল কার্তিকের যে আজ সে কাজল পরে আছে। বৃষ্টিতে ধুয়ে কি অবস্থা হবে? আঙুল দিয়ে গালের উপর বোলালো। কাজল ধুয়ে যায়নি। তার ভিজে সাদা আঙুলে শুধু একটা লাল পাথরের আঙটি। কাজল নেই।
ভীষ্ম ব্যাঙ্গালোর থেকে ফিরেছে। কি করে কি করে যেন ফিরেছে। এই নিয়ে গ্রামে খুব অশান্তিও হয়েছে। তবে চোদ্দোদিন হয়ে গেছে। এখন আর নাকি ভয় নেই। দূর থেকে ভীষ্মকে দেখেছে দু-একবার কার্তিক। রোগা হয়ে গেছে। বউটাও খুব রোগা ওর। ওখানেই বিয়ে করেছে শুনেছিল কার্তিক। বাঙালি মেয়েই। শান্তিপুরের না কোথাকার জানি। ওদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বাচ্চার কান্নার আওয়াজও পেয়েছে। বাচ্চাটা দেড়-দুই বছরের হবে।
৩
---
কার্তিক ভীষ্মকেই প্রথম চুমু খায়। তখন কার্তিক স্কুল ছেড়ে দিয়েছে অনেককাল হয়েছে, তার বয়েস বাইশ কি তেইশ। তার চেহারায় তখন একটা লাবণ্যও ছিল, তার ভিতরের মেয়েটাকে সে কিছুটা হলেও বাইরে দেখতে পেত। এখন কেমন কেঠো হয়ে গেছে সে। সে যা হোক। ভীষ্ম দু-তিন বছরের বড় তার থেকে। কার্তিক তখন হাইস্কুলে বাসন মাজার কাজ করে। ভীষ্মকে মনে মনে পছন্দ করত কার্তিক। কালো, ছিপছিপে গড়ন, চোখ দুটো খুব চঞ্চল, হাতের আঙুলগুলো সরু সরু, বুক ভর্তি লোম। প্যাণ্ডেল বাঁধার কাজ করত। ভীষ্ম তার চোখের দিকে তাকালে চোখ নামিয়ে নিত কার্তিক। কলপাড়ে, পুজোমণ্ডপে, ভোটের সময় লাইনে, ঘুড়ি ওড়াবার সময় তাদের বাড়ির সামনের মাঠে – যখন তখন তাকে খেয়াল করত ভীষ্ম। এই খেয়াল করার অনুভবটা নতুন ছিল কার্তিকের কাছে। তাকে কেউ কখনও খেয়াল করত কই? পরখ করার চোখ তো হরদম, ঘরের বাইরে বেরোলেই হল। কিন্তু খেয়াল করত না তো অন্য কেউ? ভীষ্মের চোখে একটা খেয়াল ছিল। আদর ছিল। প্রশ্রয় ছিল। সেগুলো ভালোবাসা কিনা বুঝত না কার্তিক।
একবার ধুম জ্বরে প্রায় বেহুঁশ কার্তিক। শর্মিলা মাসি এসে খাইয়ে যাচ্ছে দু’বেলা। সেই সময় একদিন ভীষ্ম এল তার সাথে দেখা করতে। প্রথমদিন দরজা থেকে তার খোঁজ নিয়ে চলে গেল। আবার পরেরদিন এল দুপুরবেলা। হাতে একটা হরলিক্সের শিশি। তার মাথার কাছে বসল। বলল, জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে যে রে। বাটি করে জল আনল। নিজের রুমাল বার করে জলপট্টি দিল। কার্তিকের গায়ে ধাক্কা লেগেছে অনেকের, কিন্তু মানুষের ছোঁয়া বলতে মানুষ যা বোঝায় এই তার প্রথম। সারা শরীর শিউরে শিউরে উঠতে লাগল। তার পুরুষের শরীরের কারাগারে বন্দী যে মেয়ে, সে ফোঁস ফোঁস করতে লাগল। জ্বরের তাপের উপর বাড়ল তার ক্ষুব্ধ হৃদয়ের তাপ। তার পুরুষ স্তনবিন্দুতে অসম্পূর্ণ মেয়েমানুষের ব্যথা। লজ্জা। আচমকা হুঁশ হারালো কার্তিক, ভীষ্মের মাথাটা নীচের দিকে টেনে, নিজের ঠোঁটটা দিয়ে কামড়ে ধরল ভীষ্মের ঠোঁট। ভীষ্ম বাধা দিল না। কার্তিকের মাথাটা টেনে নিল উঁচু করে।
জ্বর সেরে অন্য জ্বরে পড়ল কার্তিক। ভীষ্মকে দেখলে তার সারা শরীর পুড়ে যায়। ভীষ্ম ক'দিন না এলে তার খাবারে রুচি থাকে না। ঘুম আসে না। মাথা ব্যথা করে। গা পাক দেয়। ভীষ্ম তাকে মেয়েদের কাপড় পরতে বারণ করে। কার্তিক রেগে যায়। কেন পরবে না সে? ভীষ্ম তাকে উলঙ্গ করে। কার্তিক ভীষ্মকে উলঙ্গ করে। বিচিত্র নিয়মে প্রকৃতি যেন গুটি সাজিয়ে রেখেছে। দু’জনেরই যেন সব চালগুলো জানা, খেলার সুযোগ হয়নি এতদিন। কিন্তু কোথাও একটা বাধা থেকেই যায়। কিসের একটা অপূর্ণতা। কার্তিক শরীরে খোঁজে সে রহস্য। ভীষ্ম খোঁজে মনে। ক্রমশ রাগ বাড়ে। কথা কাটাকাটি বাড়ে। ওদিকে ভীষ্মের বাড়ির লোক সব জানাজানি হয়ে গেলে অশান্তি করে ভীষ্মের বিয়ে দিয়ে দেয়। কিন্তু এমনই কপাল যে সে বউ বিয়ের চারদিন যেতে না যেতেই তার আগের প্রেমিকের সাথে পালিয়ে যায়। ভীষ্ম বাউণ্ডুলের মত হয়ে যায়। কার্তিক এই গ্রাম ছেড়ে বেরোবার রাস্তা খোঁজে। অবশেষে কার্তিক কলকাতায় একটা নার্সিং হোমে কাজ পায়। ভীষ্ম ব্যাঙ্গালোরে চলে যায়। সেখানে সে আবার বিয়ে করে, কার্তিক খবর পায়। অসাড় মনে কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না।
৪
---
কার্তিক উঠল। বৃষ্টিটা বাড়ছে। অন্ধকার হয়ে গেছে। মাস্কটা হাতে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে মাঝে মাঝে। চারদিক নিঝুম অন্ধকার। চারদিকে সব কেমন বদলে গেছে। মানুষ মানুষকে দেখলে ভয় পায়। কি এক রোগ! আর কলকাতার কাজটা থাকবে কি না কে জানে। ট্রেন কবে চলবে কেউ জানে না। যা হোক এইগুলো নিয়ে আর ভাবে না কার্তিক। মাঝে মাঝে ক্লাব থেকে এসে সাহায্য দিয়ে যায়। তার এই গ্রামে এখন মোটামুটি একটা জায়গা হয়েছে। তার কারণ অবশ্যই টাকা হয়েছে তার কিছুটা। ভালো জামাকাপড় ছাড়া রাস্তায় বেরোয় না। কোনোরকম বেচাল এড়িয়ে যায়। লোকে কিছুটা সমীহই করে চলে তাকে। যদিও ঘরে ডাকে না কেউ। কিন্তু যদি তার করোনা হয়, কোন কোয়ারেন্টাইনে নিয়ে যাবে? পেপারে পড়েছে তাদের মত কয়েকজনকে নাকি খুব হেনস্থা করেছে কোয়ারেন্টাইনের কিছু লোক, থাকতে দেয়নি। মেয়েরাও থাকতে দিতে চায় না। তাদের সবার সমস্যা টয়লেট নিয়ে। কোন টয়লেটে যাবে সে? তাদের জন্য টয়লেট কোন কোয়ারেন্টাইনে বানানো হবে তবে? নাকি পুরুষদের সাথেই রেখে দেবে? ভাগ্যে শ্মশানে কোনো লিঙ্গভেদ নেই, নইলে হয়তো জঙ্গলেই ফেলে রেখে যেত শিয়াল-কুকুরের ভরসায়।
কিসের চীৎকার? ওটা ভীষ্মের বাড়ি না? অত জটলা কিসের? কিছু না ভেবেই হনহন করে এগিয়ে গেল কার্তিক। ঘটনা যা শুনল তা হল তার বাচ্চাটার জন্য খাটালে দুধ আনতে গিয়েছিল ভীষ্ম, দুধওয়ালা তাকে প্রায় মেরে বার করে দিয়েছে। ভীষ্মকে দুধ দিলে তার সাথে নাকি তার গরুগুলোরও করোনা হবে, সব শুদ্ধ মরবে তারা।
কার্তিক ধীরে ধীরে সরে ভীষ্মের পাশে এসে দাঁড়ালো। ভীষ্মের বউ কাঁদছে, তার কোলে বাচ্চাটা কাঁদছে। ভীষ্ম মাথায় হাত দিয়ে বাড়ির সামনে সিঁড়ির উপর বসে। কার্তিককে ভীষ্মের পাশে দেখে, অনেকের চোখের কৌতুক এড়িয়ে গেল না কার্তিকের চোখ, এই স্ট্রিট লাইটেও স্পষ্ট। মানুষ মানেই ভণ্ড। এ নতুন কথা কিছু না। সবাই নিজেকে ভয় পায়। নিজের আসল চেহারা না লুকালে সমাজে বাঁচা যায় না, লেখাপড়া না শিখেও এটা বুঝে গেছে কার্তিক। মানুষ যমের মুখোমুখি হতেও ভয় পায় না, যত ভয় নিজের মুখোমুখি হতে।
কার্তিক একবার বউটার দিকে তাকালো। কালো হলেও কি হবে, শ্রী আছে মেয়েটার মুখে। বাচ্চাটার মুখে ভীষ্মের মায়ের আদল। ছেলে না মেয়ে? জানে না। হঠাৎ কেন জানি তার মাথাটায় আগুন জ্বলে উঠল, চীৎকার করে বলে উঠল, “খালি হাতে এসেছ কেন গো? একটু বিষ বা একটা দড়ি আনলে পারতে, এ পুরো পরিবার নিয়ে মরত। তোমাদেরও হাড় জুড়াতো। হ্যাঁ গো, বিপদে মানুষ নিজের বাড়ি আসবে না তো কোথায় আসবে? রাস্তায় ঘাটে কিভাবে মানুষ মরে পড়ে থাকছে পড়ছ না কাগজে? এরা মরে থাকলে সুখ পেতে খুব? এদের উপর দিয়ে ট্রেন চলে গেলে প্রাণ জুড়াতো তোমাদের? এই বাচ্চাটা গলা শুকিয়ে মরলে ভগবান ক্ষমা করবে তোমাদের?” কার্তিকের গলা বুজে এলো। এত নিষ্ঠুরতা! কেন?
ভীষ্মের বউ কেঁদে তার পায়ের তলায় পড়ে বলল, আমার বাচ্চাটাকে বাঁচাও দিদি... আমার বাচ্চাটা মরে যাবে গো... সকাল থেকে কিচ্ছু খায়নি...
কার্তিকের বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। থতমত খেয়ে গেল, এভাবে কেউ ডাকে না তো তাকে! কাজের ডাক সারাটা জীবন পেয়েছে, কিন্তু এমন ডাক?... দিদি?... কার্তিক নীচু হয়ে হাত ধরে তাকে তুলে বলল, ভীষ্মদা তুমি ওকে নিয়ে ঘরে যাও, আমি দুধ নিয়ে আসছি। ভীষ্ম এতক্ষণে সোজাসুজি তাকালো কার্তিকের দিকে। সেই খেয়াল করা চোখ।
কার্তিক হাঁটতে শুরু করল। ভীষ্মের দিকে আর তাকাবে না। কেঁদে ফেলবে। আঙুল দিয়ে গালে হাত দিয়ে দেখল তার কাজল গলেছে। কেঁদেছে কার্তিক। কখন কাঁদল? কার্তিক হাঁটতে হাঁটতে নিজের বুকের দিকে তাকালো, যদি দুধ হত, সবটুকু দিত না হয় আজ ভীষ্মের বাচ্চাটাকে। আচ্ছা, বাচ্চাটা ছেলে না মেয়ে? কি আশ্চর্য! কেন সে বারবার ছেলে না মেয়ে ভাবছে? যদি তার মত হয়? ভাবতেই চমকে উঠল মনে মনে, ঈশ্বরকে বলল, না না, তা যেন না হয় ঠাকুর... বড় কষ্ট, বড় হেলাফেলা গো... থাক থাক থাক...
লেখক পরিচিতি :
সৌরভ ভট্টাচার্য
গল্পকার।
কলকাতায় থাকেন।
পিছনে ঘাড়ের উপর এলিয়ে পড়া চুলটা গার্ডার দিয়ে বাঁধা। একবার চুলের গোছাটা সামনে এনে বুকের উপর রাখল। বুলার বুকের দিকে তাকালো। বুলা মেয়ে, সত্যিকারের মেয়ে। পাপিয়া একটা আমপাতা নিয়ে পাতার পিছন দিকটা দিয়ে মাটিতে দাগ টানছে। পাপিয়া বয়সে বুলার কাছাকাছি হবে। বিকালবেলা, সাড়ে চারটে-পাঁচটা হবে। বেশ গরম, আষাঢ় মাসের প্রথম বুধবার। লকডাউন চলছে, দূরপাল্লার ট্রেন কিছু কিছু চললেও তাদের এই শিয়ালদা মেন লাইনে লোকাল ট্রেন এখনও বন্ধ। নইলে এই সময় কার্তিক এই গ্রামে থাকে নাকি? কলকাতায় নার্সিং হোমে কাজ করে। রান্নার কাজ। রুগীদের পথ্য রান্না করা। বুলা আয়ার কাজ করে বারাকপুরে। পাপিয়া কলেজে পড়ে, নৈহাটিতে। তাদের কাছাকাছি রেলস্টেশান বলতেও এই নৈহাটিই।
বুলা হোয়াটস অ্যাপ খুলে ছেলেটার ছবি দেখাচ্ছে। একটা নীল টিশার্ট আর জিন্স পরে বাইকে বসে, সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে। বেশ ফর্সা। লম্বাও কার্তিকের মতন হবে, প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুটের কাছাকাছি। আরেকটা ছবি, খালি গায়ে ছাদের কার্ণিশে বসে সিগারেট খাচ্ছে, বেগুনী রঙের হাফপ্যান্ট। কার্তিকের দৃষ্টি ছেলেটার প্যান্টের উপর দিয়ে কিছু একটা খুঁজতে চাইছে। নিষিদ্ধ দৃষ্টি। নিষিদ্ধ তৃষ্ণা। তবু তৃষ্ণা তো। বুকের ভিতরটা খামচে ধরল যেন কেউ, তলপেটের পেশীগুলোতে মোচড় খেলে গেল। কার্তিক চোখ সরিয়ে নিল। আকাশের দিকে তাকালো। আকাশে পাপ জন্মায় না, পাপ জমে না। সেখানে নিষিদ্ধ কিছু নেই। যত পাপ, নিষিদ্ধ তৃষ্ণা এই মাটিতে। মেঘ করে এসেছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বৃষ্টি হবে। যা ভ্যাপসা গরম গেল ক'দিন! হোয়াটস অ্যাপে ছবি সরে গেছে, এখন অন্য ছবি। ছেলেটার নাম পাপ্পু। মোবাইল সারানোর দোকান। এই ছবিটা বন্ধুদের সাথে, হাতে মদের বোতল সবার। পাপিয়া বলল, মাল খায়? বুলা বলল, এক নম্বরের হারামি শালা, সারাদিন ছুঁক ছুঁক করবে। আর সব দৃষ্টি বুকের দিকে। বুলা বলতে বলতেই নিজের ওড়নাটা টেনে নিল বুকের উপর। ঠিকই তো ছিল। আসলে অভ্যাস হয়ে গেছে। কার্তিক আজ ওড়না আনেনি। কলকাতায় যায় যখন পরে যায়। শূন্যতা ঢাকার লজ্জায় পরে যায়। থাকলে ঢাকত কোনোদিন? কার্তিক মনে মনে বলে, কক্ষনো না। বুলা বলে, তোমার যদি সত্যি সত্যি থাকত বুঝতে, কি নোংরা দৃষ্টিতে তাকায়, যেন গিলে খাবে। পাপিয়া হাসে, বলে, ভালোই তো। তাকাবে না? তারপর চটুল কথা, হাসাহাসি। কার্তিকও হাসে। জোর করে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে পুড়ে যায়। বুকের পাঁজরগুলো বেঁধে। শূন্যতার কাঁটা।
বুলা পা দুটো সামনে ছড়িয়ে কি একটা ভাবছে। পাপিয়া গুনগুন করে কিছু একটা হিন্দি সিনেমার গান গাইছে। অরিজিৎ সিং-এর কোনো গান। মনে পড়ছে না কথাগুলো।
কার্তিক বলল, বুলা আমি যদি করোনায় মরে যাই বেশ হবে বল? এমনিতেও আমার সাতকুলে কেউ নেই। কথাটা সত্যিই। কার্তিকের মা-বাবা অনেকদিন আগেই মারা গেছে। ভাইবোন বলতে কেউ নেই। কিছু আত্মীয়স্বজন আছে, কিন্তু কার্তিককে নিয়ে তাদের অনেক সমস্যা। আর হবে নাই বা কেন, হিজড়াকে কে আর নিজের আত্মীয় বলে? অনেকেই বলেছে কার্তিককে কারোর একটা দলে নাম লিখিয়ে নিতে। এই নৈহাটিতেই দুটো দল আছে। ওরা কার্তিকের সাথে যোগাযোগও করেছিল। কার্তিকের ইচ্ছা করেনি। সে স্বপ্নে বাঁচে। তার স্বপ্ন তার একজন নিজের পুরুষ মানুষ হবে। তাকে ভালোবাসবে, সে-ও ভালোবাসবে পাগলের মত। এখনও ভালোবাসে। প্রচণ্ড ভালোবাসে। তাকে ভালোবেসে তার রাতে ঘুম হয় না। শরীরে জ্বালা করে। বুকটা তুষের মত পুড়তেই থাকে, পুড়তেই থাকে। যাকে ভালোবাসে তার ছবিটা স্পষ্ট নয়। কিন্তু অবয়বটা স্পষ্ট। কে বলল, দীক্ষা নিলে মন শুদ্ধ হয়। তাও নিল। কণ্ঠি নিল। কিন্তু মন আর মন্ত্রের পার্থক্য হয়ে থাকল কয়েক যোজন। তার মনের উপর ভালোবাসা কাকতাড়ুয়ার মত বসে আছে। ঈশ্বর, শান্তি --- কেউ বসতে পায় না। তার পাপের ভালোবাসা, গুরু বলল। শরীর নাকি পাপের দিকে নিয়ে যায়। কার্তিক পাপ আর ভালোবাসা আলাদা করতে পারে না এখন। তাই পাপই চায়। ভালোবাসার মত পাপ। কিন্তু সেরকম মানুষ কই? শুধু ঠুকরে যাওয়ার মানুষ। আগলে রাখার মানুষ বানায়নি তার জন্যে ভগবান? তার বুকের রক্তে জাগা সেই পুরুষ কবে তার চোখের সামনে এসে দাঁড়াবে?
বুলা বলল, কার্তিকদা বাড়ি যাবে না? ফোঁটা ফোঁটা শুরু হয়ে গেল তো? কার্তিক হাতের পাতার দিকে তাকালো। তাই তো! বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে, বিন্দু বিন্দু জল। কার্তিক বলল, তোরা যা, আমি একটু বসে আসছি। পাপিয়া ইতিমধ্যে দাঁড়িয়ে ওড়নাটা মাথায় দিয়ে দিয়েছে, সে বলল, ভিজো না কার্তিকদা, জ্বর চলে এলে করোনা বলে কোয়ারেন্টাইনে নিয়ে চলে যাবে।
কার্তিক হাসল। বলল, কাদের কোয়ারেন্টাইনে রে? ছেলেদের না মেয়েদের?
বুলা দাঁড়িয়ে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, শুধু বাজে কথা তোমার... এসো তুমি, আমরা এগোই... চ চ... পাপিয়া... এমনিতেই সকাল থেকে আমার চারবার হাঁচি হয়েছে...
২
---
কার্তিক একা একা বসে। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে। পা দুটো ছড়িয়ে সামনে আকাশের দিকে মুখ করে, দুটো পাতায় ঢাকা মণি। দেখতে চাইছে না কিছু, অনুভব করতে চাইছে। চোখের পাতার উপর বৃষ্টির ছাঁট পড়লে এত ভালো লাগে। মনে হয় যেন মা। যেন আদর। ওপারের থেকে আসা মায়ের শীতল হাতের স্নেহ।
---
কার্তিক একা একা বসে। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে। পা দুটো ছড়িয়ে সামনে আকাশের দিকে মুখ করে, দুটো পাতায় ঢাকা মণি। দেখতে চাইছে না কিছু, অনুভব করতে চাইছে। চোখের পাতার উপর বৃষ্টির ছাঁট পড়লে এত ভালো লাগে। মনে হয় যেন মা। যেন আদর। ওপারের থেকে আসা মায়ের শীতল হাতের স্নেহ।
মা-কে মনে পড়ে না কার্তিকের। বাবাকে অল্প মনে পড়ে। কার্তিককে দু'চক্ষে দেখতে পারত না তার বাবা। বাবা মিস্ত্রীর কাজ করত। একটা ফ্ল্যাট বানাতে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে মরে গেল। বাবার সাথে শেষ কথা হয়েছিল, “এবারের পুজোয় জামাকাপড় চাইলে নিজেরটা নিজেই গুছিয়ে নিও। সে যেভাবেই হোক।” কথাটার ঝাঁঝ, ইঙ্গিত এখনও মাঝে মাঝে অস্থির করে তোলে কার্তিককে। মেনে নিতে পারে না। অথচ কত ব্যঙ্গ, কত বিদ্রুপকে সে এখন ডালভাত করে ফেলেছে জীবনে। বাবা মদ খেয়েই থাকত। তখন ক্লাস সিক্সে পড়ে কার্তিক। সদ্য মেয়েদের কাপড় পরা শুরু করেছে। বাড়িতে আর পাড়াতে একটা ফ্রক নইলে একটা সালোয়ার-কামিজ পরে ঘুরে বেড়াত। বাবা বলত, বেশ্যা। চুলের মুঠি ধরে বাড়ির বাইরে বার করে দিত। পাশের বাড়ির শর্মিলা মাসি কার্তিককে খুব ভালোবাসত। সে-ই খেতে দিত। নইলে মরেই যেত কার্তিক। এখন শর্মিলা মাসির ছেলেরা বড়। কার্তিক তাদের বাড়ি যাক তারা পছন্দ করে না। সেও যায় না। শর্মিলা মাসি তাকে পুজোর সময় শাড়ি পাঠায়। বলে, তুই আমার মেয়ে।
হঠাৎ মনে পড়ল কার্তিকের যে আজ সে কাজল পরে আছে। বৃষ্টিতে ধুয়ে কি অবস্থা হবে? আঙুল দিয়ে গালের উপর বোলালো। কাজল ধুয়ে যায়নি। তার ভিজে সাদা আঙুলে শুধু একটা লাল পাথরের আঙটি। কাজল নেই।
ভীষ্ম ব্যাঙ্গালোর থেকে ফিরেছে। কি করে কি করে যেন ফিরেছে। এই নিয়ে গ্রামে খুব অশান্তিও হয়েছে। তবে চোদ্দোদিন হয়ে গেছে। এখন আর নাকি ভয় নেই। দূর থেকে ভীষ্মকে দেখেছে দু-একবার কার্তিক। রোগা হয়ে গেছে। বউটাও খুব রোগা ওর। ওখানেই বিয়ে করেছে শুনেছিল কার্তিক। বাঙালি মেয়েই। শান্তিপুরের না কোথাকার জানি। ওদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বাচ্চার কান্নার আওয়াজও পেয়েছে। বাচ্চাটা দেড়-দুই বছরের হবে।
৩
---
কার্তিক ভীষ্মকেই প্রথম চুমু খায়। তখন কার্তিক স্কুল ছেড়ে দিয়েছে অনেককাল হয়েছে, তার বয়েস বাইশ কি তেইশ। তার চেহারায় তখন একটা লাবণ্যও ছিল, তার ভিতরের মেয়েটাকে সে কিছুটা হলেও বাইরে দেখতে পেত। এখন কেমন কেঠো হয়ে গেছে সে। সে যা হোক। ভীষ্ম দু-তিন বছরের বড় তার থেকে। কার্তিক তখন হাইস্কুলে বাসন মাজার কাজ করে। ভীষ্মকে মনে মনে পছন্দ করত কার্তিক। কালো, ছিপছিপে গড়ন, চোখ দুটো খুব চঞ্চল, হাতের আঙুলগুলো সরু সরু, বুক ভর্তি লোম। প্যাণ্ডেল বাঁধার কাজ করত। ভীষ্ম তার চোখের দিকে তাকালে চোখ নামিয়ে নিত কার্তিক। কলপাড়ে, পুজোমণ্ডপে, ভোটের সময় লাইনে, ঘুড়ি ওড়াবার সময় তাদের বাড়ির সামনের মাঠে – যখন তখন তাকে খেয়াল করত ভীষ্ম। এই খেয়াল করার অনুভবটা নতুন ছিল কার্তিকের কাছে। তাকে কেউ কখনও খেয়াল করত কই? পরখ করার চোখ তো হরদম, ঘরের বাইরে বেরোলেই হল। কিন্তু খেয়াল করত না তো অন্য কেউ? ভীষ্মের চোখে একটা খেয়াল ছিল। আদর ছিল। প্রশ্রয় ছিল। সেগুলো ভালোবাসা কিনা বুঝত না কার্তিক।
একবার ধুম জ্বরে প্রায় বেহুঁশ কার্তিক। শর্মিলা মাসি এসে খাইয়ে যাচ্ছে দু’বেলা। সেই সময় একদিন ভীষ্ম এল তার সাথে দেখা করতে। প্রথমদিন দরজা থেকে তার খোঁজ নিয়ে চলে গেল। আবার পরেরদিন এল দুপুরবেলা। হাতে একটা হরলিক্সের শিশি। তার মাথার কাছে বসল। বলল, জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে যে রে। বাটি করে জল আনল। নিজের রুমাল বার করে জলপট্টি দিল। কার্তিকের গায়ে ধাক্কা লেগেছে অনেকের, কিন্তু মানুষের ছোঁয়া বলতে মানুষ যা বোঝায় এই তার প্রথম। সারা শরীর শিউরে শিউরে উঠতে লাগল। তার পুরুষের শরীরের কারাগারে বন্দী যে মেয়ে, সে ফোঁস ফোঁস করতে লাগল। জ্বরের তাপের উপর বাড়ল তার ক্ষুব্ধ হৃদয়ের তাপ। তার পুরুষ স্তনবিন্দুতে অসম্পূর্ণ মেয়েমানুষের ব্যথা। লজ্জা। আচমকা হুঁশ হারালো কার্তিক, ভীষ্মের মাথাটা নীচের দিকে টেনে, নিজের ঠোঁটটা দিয়ে কামড়ে ধরল ভীষ্মের ঠোঁট। ভীষ্ম বাধা দিল না। কার্তিকের মাথাটা টেনে নিল উঁচু করে।
জ্বর সেরে অন্য জ্বরে পড়ল কার্তিক। ভীষ্মকে দেখলে তার সারা শরীর পুড়ে যায়। ভীষ্ম ক'দিন না এলে তার খাবারে রুচি থাকে না। ঘুম আসে না। মাথা ব্যথা করে। গা পাক দেয়। ভীষ্ম তাকে মেয়েদের কাপড় পরতে বারণ করে। কার্তিক রেগে যায়। কেন পরবে না সে? ভীষ্ম তাকে উলঙ্গ করে। কার্তিক ভীষ্মকে উলঙ্গ করে। বিচিত্র নিয়মে প্রকৃতি যেন গুটি সাজিয়ে রেখেছে। দু’জনেরই যেন সব চালগুলো জানা, খেলার সুযোগ হয়নি এতদিন। কিন্তু কোথাও একটা বাধা থেকেই যায়। কিসের একটা অপূর্ণতা। কার্তিক শরীরে খোঁজে সে রহস্য। ভীষ্ম খোঁজে মনে। ক্রমশ রাগ বাড়ে। কথা কাটাকাটি বাড়ে। ওদিকে ভীষ্মের বাড়ির লোক সব জানাজানি হয়ে গেলে অশান্তি করে ভীষ্মের বিয়ে দিয়ে দেয়। কিন্তু এমনই কপাল যে সে বউ বিয়ের চারদিন যেতে না যেতেই তার আগের প্রেমিকের সাথে পালিয়ে যায়। ভীষ্ম বাউণ্ডুলের মত হয়ে যায়। কার্তিক এই গ্রাম ছেড়ে বেরোবার রাস্তা খোঁজে। অবশেষে কার্তিক কলকাতায় একটা নার্সিং হোমে কাজ পায়। ভীষ্ম ব্যাঙ্গালোরে চলে যায়। সেখানে সে আবার বিয়ে করে, কার্তিক খবর পায়। অসাড় মনে কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না।
৪
---
কার্তিক উঠল। বৃষ্টিটা বাড়ছে। অন্ধকার হয়ে গেছে। মাস্কটা হাতে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে মাঝে মাঝে। চারদিক নিঝুম অন্ধকার। চারদিকে সব কেমন বদলে গেছে। মানুষ মানুষকে দেখলে ভয় পায়। কি এক রোগ! আর কলকাতার কাজটা থাকবে কি না কে জানে। ট্রেন কবে চলবে কেউ জানে না। যা হোক এইগুলো নিয়ে আর ভাবে না কার্তিক। মাঝে মাঝে ক্লাব থেকে এসে সাহায্য দিয়ে যায়। তার এই গ্রামে এখন মোটামুটি একটা জায়গা হয়েছে। তার কারণ অবশ্যই টাকা হয়েছে তার কিছুটা। ভালো জামাকাপড় ছাড়া রাস্তায় বেরোয় না। কোনোরকম বেচাল এড়িয়ে যায়। লোকে কিছুটা সমীহই করে চলে তাকে। যদিও ঘরে ডাকে না কেউ। কিন্তু যদি তার করোনা হয়, কোন কোয়ারেন্টাইনে নিয়ে যাবে? পেপারে পড়েছে তাদের মত কয়েকজনকে নাকি খুব হেনস্থা করেছে কোয়ারেন্টাইনের কিছু লোক, থাকতে দেয়নি। মেয়েরাও থাকতে দিতে চায় না। তাদের সবার সমস্যা টয়লেট নিয়ে। কোন টয়লেটে যাবে সে? তাদের জন্য টয়লেট কোন কোয়ারেন্টাইনে বানানো হবে তবে? নাকি পুরুষদের সাথেই রেখে দেবে? ভাগ্যে শ্মশানে কোনো লিঙ্গভেদ নেই, নইলে হয়তো জঙ্গলেই ফেলে রেখে যেত শিয়াল-কুকুরের ভরসায়।
কিসের চীৎকার? ওটা ভীষ্মের বাড়ি না? অত জটলা কিসের? কিছু না ভেবেই হনহন করে এগিয়ে গেল কার্তিক। ঘটনা যা শুনল তা হল তার বাচ্চাটার জন্য খাটালে দুধ আনতে গিয়েছিল ভীষ্ম, দুধওয়ালা তাকে প্রায় মেরে বার করে দিয়েছে। ভীষ্মকে দুধ দিলে তার সাথে নাকি তার গরুগুলোরও করোনা হবে, সব শুদ্ধ মরবে তারা।
কার্তিক ধীরে ধীরে সরে ভীষ্মের পাশে এসে দাঁড়ালো। ভীষ্মের বউ কাঁদছে, তার কোলে বাচ্চাটা কাঁদছে। ভীষ্ম মাথায় হাত দিয়ে বাড়ির সামনে সিঁড়ির উপর বসে। কার্তিককে ভীষ্মের পাশে দেখে, অনেকের চোখের কৌতুক এড়িয়ে গেল না কার্তিকের চোখ, এই স্ট্রিট লাইটেও স্পষ্ট। মানুষ মানেই ভণ্ড। এ নতুন কথা কিছু না। সবাই নিজেকে ভয় পায়। নিজের আসল চেহারা না লুকালে সমাজে বাঁচা যায় না, লেখাপড়া না শিখেও এটা বুঝে গেছে কার্তিক। মানুষ যমের মুখোমুখি হতেও ভয় পায় না, যত ভয় নিজের মুখোমুখি হতে।
কার্তিক একবার বউটার দিকে তাকালো। কালো হলেও কি হবে, শ্রী আছে মেয়েটার মুখে। বাচ্চাটার মুখে ভীষ্মের মায়ের আদল। ছেলে না মেয়ে? জানে না। হঠাৎ কেন জানি তার মাথাটায় আগুন জ্বলে উঠল, চীৎকার করে বলে উঠল, “খালি হাতে এসেছ কেন গো? একটু বিষ বা একটা দড়ি আনলে পারতে, এ পুরো পরিবার নিয়ে মরত। তোমাদেরও হাড় জুড়াতো। হ্যাঁ গো, বিপদে মানুষ নিজের বাড়ি আসবে না তো কোথায় আসবে? রাস্তায় ঘাটে কিভাবে মানুষ মরে পড়ে থাকছে পড়ছ না কাগজে? এরা মরে থাকলে সুখ পেতে খুব? এদের উপর দিয়ে ট্রেন চলে গেলে প্রাণ জুড়াতো তোমাদের? এই বাচ্চাটা গলা শুকিয়ে মরলে ভগবান ক্ষমা করবে তোমাদের?” কার্তিকের গলা বুজে এলো। এত নিষ্ঠুরতা! কেন?
ভীষ্মের বউ কেঁদে তার পায়ের তলায় পড়ে বলল, আমার বাচ্চাটাকে বাঁচাও দিদি... আমার বাচ্চাটা মরে যাবে গো... সকাল থেকে কিচ্ছু খায়নি...
কার্তিকের বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। থতমত খেয়ে গেল, এভাবে কেউ ডাকে না তো তাকে! কাজের ডাক সারাটা জীবন পেয়েছে, কিন্তু এমন ডাক?... দিদি?... কার্তিক নীচু হয়ে হাত ধরে তাকে তুলে বলল, ভীষ্মদা তুমি ওকে নিয়ে ঘরে যাও, আমি দুধ নিয়ে আসছি। ভীষ্ম এতক্ষণে সোজাসুজি তাকালো কার্তিকের দিকে। সেই খেয়াল করা চোখ।
কার্তিক হাঁটতে শুরু করল। ভীষ্মের দিকে আর তাকাবে না। কেঁদে ফেলবে। আঙুল দিয়ে গালে হাত দিয়ে দেখল তার কাজল গলেছে। কেঁদেছে কার্তিক। কখন কাঁদল? কার্তিক হাঁটতে হাঁটতে নিজের বুকের দিকে তাকালো, যদি দুধ হত, সবটুকু দিত না হয় আজ ভীষ্মের বাচ্চাটাকে। আচ্ছা, বাচ্চাটা ছেলে না মেয়ে? কি আশ্চর্য! কেন সে বারবার ছেলে না মেয়ে ভাবছে? যদি তার মত হয়? ভাবতেই চমকে উঠল মনে মনে, ঈশ্বরকে বলল, না না, তা যেন না হয় ঠাকুর... বড় কষ্ট, বড় হেলাফেলা গো... থাক থাক থাক...
লেখক পরিচিতি :
সৌরভ ভট্টাচার্য
গল্পকার।
কলকাতায় থাকেন।
5 মন্তব্যসমূহ
এক সংবেদনশীল নির্মোহ লেখার মুখোমুখি হলে মানুষের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিই পালটে যায়। এ তেমনই একটা লেখা। এক নির্মম নিষ্কলঙ্ক বাস্তব...
উত্তরমুছুনকিছু লেখা চোখ বয়ে নিয়ে যায়, সাথে চোখের জলটাকেও। লেখার বুনট,গল্প,চোখা তলোয়ার,টুপুর টাপুর সব মিলেমিশে মুগ্ধ করে দিল।
উত্তরমুছুনচমৎকার গল্প।
উত্তরমুছুনপাঠশেষে মন খারাপ করছে ভীষণ। কার্তিকের কাজল লেপটানো চেহারাটা দেখতে পাচ্ছি।
উত্তরমুছুন"আকাশে পাপ জন্মায় না, জমে না" চমৎকার বললেন !
উত্তরমুছুন