পাঠ-প্রতিক্রিয়া : মৌসুমী কাদের'এর ''বাদামী জুতো এবং অন্যান্য গল্প ''

 

সুমী সিকানদার

প্রচ্ছদটা ছোটবেলার রাশান বইগুলোকে মনে করায় । এটি গল্পকার এবং 'গল্পপাঠ' ওয়েবজিনের অন্যতম সম্পাদক মৌসুমী কাদেরের প্রথম গল্পগন্থ , ২০২০ সালে জাতীয় গ্রন্থ মেলায় প্রকাশিত । প্রকাশ করেছে অংকুর প্রকাশনী এবং প্রচ্ছদ করেছেন চারু পিন্টু।

বইটিতে ১৬টি গল্প সন্নিবেশিত এবং বেশীর ভাগ বড় গল্প।

লেখক মৌসুমী কাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া সমাপ্ত করছেন। পরবর্তীতে দীর্ঘ সময় ধরে প্রবাস জীবন যাপন করছেন। তার লেখায় রয়েছে বাংলা , বাঙ্গালিয়ানা , শৈশব , মধ্যবর্তী বয়সে নারীর সংকট, মানুষের মনস্তত্ব ইত্যাদি। আমার মনে হয় যারা পরবাসে থাকেন তারা একই সাথে দেশ এবং প্রবাস দুইটি অবস্থান বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা রাখতে পারেন এবং লিখতে পারেন। তাদের বর্ণনাগুলো কিছুটা আলাদা অবস্থানগত বৈচিত্রের কারণে। সেটা গল্প কবিতা উভয় ক্ষেত্রেই।

নানা বৈচিত্র এবং অভিনবত্ব আছে মৌসুমী কাদেরের গল্পের বিষয় নির্বাচনে ।প্রবাসের মাল্টি কালচার এবং ভিন্ন রঙের গাত্রবর্ণের আলাদা আলাদা আচরণ । তবু তারা সবাই প্রবাসী তাই কোথাও গিয়ে তারা এক আকাশের নিচে একাত্ব বন্ধু।

গল্পের নামগুলোতে বিভিন্ন চরিত্রের তথা মানুষের আনাগোনা । আছে বিড়ালও ।যেমন আইরিশ পাব , ইতিবৃত্ত, সুটকেস , বাদামী জুতো ও অন্যান্য গল্প , ৎ ,সৎকার , তেলাপোকা , মমতাজ, একপায়া কবুতর ইত্যাদি ।

''আইরিশ পাব'' একেবারেই ভিন্ন ধারার একটা গল্প । চমৎকার ভাবে এই গল্পের সাথে অন্তরঙ্গ হয়ে গেছি। সুরে সুরে কথা বলে গেছে গোটা গল্প। কাঁটাচামচ, প্লেট, গ্লাস এরা সবাই সুরের মূর্ছনা তৈরী করে। লেখকের সাথে আলেহান্দ্রো এর পরিচয় হয়েছে ''ডিপার্ট্মেন্ট অব ল্যাঙ্গুয়েজ স্টাডিজে।'' তাদের নিজেদের মধ্যে তেমন মিল নেই , সম্পর্কেও আগ্রহ নেই। তবে তারা পরিচিত।

আলেহান্দ্রোই একদিন একটা আইরিশ পাবে নিয়ে গেলো লেখককে।এখানেই দেখা হলো পুরোনো অতীতের সাথে। স্কার্ফ মাথায় জড়ানো, লং ড্রেস পরা প্রায় ষাটোর্ধ এক বৃদ্ধা লেখককে হাত ইশারায় ডাকছেন। কিছুক্ষণ পর আবার ইশারা। লেখক অগত্যা উঠে গেলো। লেখকের নাম ধরে বৃদ্ধা ডাকলেন। গল্পের এ পর্যায়ে এসে লেখকের নাম জানা গেল অন্তি।

অন্তি মূহুর্তে ফেরত গেল চল্লিশ বছর আগের সময়ে । যখন এই বৃদ্ধা কবরী'দি এবং অন্তি প্রতিবেশী ছিলেন। কবরী'দি তাদের বাসায় একের পর এক গাইতেই থাকতেন। ''শিউলি ফুলের মালা দোলে, শারদ রাতের বুকে ঐ'' ''এখনো কানে বাজে ।ওস্তাদজি শিখাতেন গানে বেশী কারুকাজ না করতে, তাতে গানের মাধুর্য নষ্ট হয়। কবরী'দি আর অন্তির পরিবারের মিল এত বেশী ছিলো যে ভালমন্দ যা কিছুই রান্না হতো তা বাটি চালান হয়ে যেত। কবরী'দির বাবা পেশায় চিকিৎসক হলেও গানভক্ত মানুষ ছিলেন , তার প্রভাবেই কবরী'দি এবং ধীরে ধীরে অন্তি এবং তার বোনেরা গানের নেশায় পড়ে যায়। সঙ্গিত মুখর জীবন কাটানোর ভাগ্য সবার হয় না , তাদের হয়েছিলো। দুই পরিবার দুই ধর্মের হলেও সেটা কোনও ভাবেই সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।

এরই মধ্যে শহরের অবস্থা খারাপ হতে লাগলো পাকিস্তানীরা দেশের যত্রতত্র আগুন দিতে লাগলো এবং শুরু হয়েগেল মুক্তিযুক্ত। ১৯৭১সাল।

এই যুদ্ধ কালীন অব্যবস্থা এবং তান্ডব কে লেখক বায়োস্কোপের মতোই দেখিয়েছেন। পাড়ার হিন্দুরা ভারতে চলে যাচ্ছিলেন অনেকেই। রেল কর্মচারী নন্দকাকুকে বাবা বলছিলেন ''নিজের জন্মভূমি ছেড়ে চলে যাবেন মশাই? এটা তো হিন্দু মুসলিম সকলেরই দেশ। '' এক পর্যায়ে কবরী'দির বাবাকে টেনে হিঁচড়ে ধরে নিয়ে গেলে কবরী'দি রাও দেশ ছেড়ে চলে গেল ।আর দেখা হয়নি। এই চল্লিশ বছর বাদে অন্তির সাথে কবরী'দির দেখা হলো তখন তিনি আর সেই কবরী'দি নেই। বয়স সবারই হয়েছে, সময় গেছে, কবরী'দির গেছে পরিচয়। তিন যুগ পর আইরিশ পাবের আলো আঁধারীতে অন্তিই উদ্ধার করলো কবরী'দি এখন তাসনীভা আফজাল। গল্পটা শেষ করে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠেছিলো । স্মৃতি এক ন্যপথেলিন যা কাপড়ের ভাঁজে লুকানো থাকে। মেদু ঘ্রাণ ছড়াতে ছড়াতে একসময় উবে যায়।

''নিমপাতা'' গল্পটা সমসাময়িক কালের স্বামী- স্ত্রীর পোড় খাওয়া সম্পর্কের গল্প। যেখানে বান্ধবী নিজেই বন্ধুত্বের আড়ালে বন্ধুর স্বামীর সাথে সম্পর্কে গড়ায় এবং নির্লজ্জের মতো ওপেন সেক্সলাইফ কাটায়। আমি কিছুটা চমকে গেছি লেখকের বিবরণে। লিনার বাসাতেই ড্রইং রুমের ফ্লোরে উদ্দাম লেপ্টালেপ্টি করে শুয়ে আছে বান্ধবী নুমা এবং লিনার স্বামী তারেক, যার চাওয়া লিনা পূরণ করতে পারেনি। বা কেউই তার চাওয়া পূরণ করতে পারবে না। এরা বহুগামী। লিনা নিজের চোখে অসহনীয় দৃশ্যটা দেখে এবং সবই জানে । কিন্তু কিছু বলেনা। কেননা বাঁধা দেয়ার সময় তখনো আসে নাই। তার বুকে ব্যথা শুরু হয়, মাঝরাতে সে একাই হাসপাতালে রওনা দেয় । তার নিজের যত্ন তাকে একাই করতে হবে, এই রাতে সে মায়ের বাড়ির কাউকেও জানায় না।

মেয়েদের জীবন বড় বিচিত্র। এক জনের চেয়ে অন্যজনেরটা আরো যেন বেশী ভুলভুলাইয়া , অনেক বেশী জটিল এবং সমাধানহীন। তবে নিমপাতা গল্পে লিনা একটা বড় সিদ্ধান্ত নেবার জন্যই ধৈর্য্য ধরে। পাঠকের ভাললাগবে গল্পটা। বাংলাদেশের মেয়েরা অনেক সময় প্রতিশোধ নিতে পারেনা চেষ্টা করলেও। নিমপাতা গল্পে লিনা স্বামীর ব্যাভিচারের প্রতিশোধ নিয়েছিলো কি না তা মৌসুমী কাদেরের বইটা পড়লেই পাঠক জানতে পারবেন।
''ইতিবৃত্ত'' গল্পটার কাহিনী বেশ প্রচলিত। তবে মৌসুমী কাদেরের বলার ভঙ্গিমা ভিন্ন। হেনাবুয়ার জরুরী ফোন পেয়ে নীলা বিরক্ত হয় কেন না সে মাত্রই অফিসে এলো। কিন্তু বুয়ার কন্ঠে এমন কিছু ছিলো যা তাকে বাসায় ফেরৎ নিয়ে আসে। উন্মোচিত হয় একের পর এক সত্য। লেখকের ভাষায় , ''হেনা কাঁদতে কাঁদতেই বলে , মামী , একথা কতি পারতিসি না। কাল রাত্তিরে মামা আমার গায়ে হাত দিয়সিলো।''নীলা চুপ হয়ে যায়, অসহায় বোধ করে।ঘুষ খাবার জন্য তার স্বামী মামুনের চাকরী কিছু দিন হলো গেছে। তার পর থেকেই নানা টেনশন থাকে মামুন। কিন্তু এসব গৃহকর্মীর গায়ে হাত দেয়ার অজুহাত হতে পারে না। নীলা কিছু মানতে পারছে না। আসলে বিশ্বাস হচ্ছে না। নিজেকে ঘৃনা হতে থাকে। তার মনে হতে থাকে যে লোক ঘরের কর্মীর গায়ে হাত দেয় সে অনেকের সাথেই এ কাজ করতে পারে।

অথচ তারা প্রেম করেই বিয়ে করেছিলো। বিয়ের আগেই সম্পর্ক করার জন্য ক্রেজি ছিলো মামুন। তখন নীলা এভাবে বোঝেনি।

বয়স কম ছিলো । ভয় পেলেও প্রেমে ভেসে গেছিল। একমাত্র বন্ধু মিলিই জানতো সব কিছু। নীলা মিলিকেই একমাত্র কাছের মনে করে। আজ এই বিপদে মিলির কাছে ছুটে গেল নীলা। তার মামুনের উপর থেকে সমস্ত বিশ্বাস ভেঙ্গে গেছে। নীলার একটাই প্রশ্ন, ''মামুন কি তোর কাছে গিয়েছিলো? '' মিলি কতক্ষণ চুপ থাকে। একটা সময় মামুন আর মিলি ব্যবসা করেছিলো। কিছু পরে মিলি জবাব দেয় ''আমি অ্যবরেশন করিয়েছিলাম।কোন কিছুই আমার ইচ্ছেতে হয়নি। '' দুই নারীর কথা থেমে যায়। নীলার মনে আর কোনও বিষন্নতা কাজ করছে না।সব গুলো কৌতুহল তার মিটে গেছে।

পাঠকের ভাবনাও থমকে যাবে। নারীদের উপেক্ষার শেষ নেই, অপেক্ষার শেষ নেই, অপমানের শেষ নেই। কেউ কেউ পাশ কাটায় ,কেউ কেউ অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।

ভালোলাগা গল্পগুলোর মধ্যে আছে সৎকার, আমায় লাবণ্য দাও। লেখকের ভাষায় ''সত্যেরা আটকে পড়েছে দেয়ালে , খুঁজে পাচ্ছে না পথ... আমি আমার অনুভূতির জায়গায় প্রবল সৎ হতে চাই ,আর বলতে চাই যে বন্ধুত্ব, বিশ্বাস আর আস্থার যে ছায়া গায়ে মেখেছি, তার কোনোটা মিথ্যা ভান নয়।তুমি বিশ্বাস করো অনুভূতিগুলোকে, ধুলোয় মিশে যেতে দিও না।''

আমাকে অবাক করেছিল 'ৎ' গল্পটি । ''বাড়ির কলাপসিবল গেইটের সামনে সব চেয়ে বড় বিড়ালটি ৎ ভঙ্গিতে মরে পড়ে আছে। শরীরের কোথাও রক্তের ছিটেফোঁটা নেই , মাথাটা মাটির দিকে একটু থেঁতলে গেছে।'' এই বিড়ালটা মা বিড়াল , তার চারটা ছোট ছোট ছানা ছিলো। কে বা কারা প্রতিশোধ নিতে তাকে মেরে ফেলেছে নাকি বিড়ালটা আত্মহত্যা করেছে তাই নিয়ে হাজারীবাগ বাসিদের মধ্যে তর্ক বিতর্ক চলছে। এই বিড়ালগুলো ছিলো প্রফেসর সাহেবের বিড়াল। অতি আদরের , অতি আত্মার। প্রফেরসর সাহেবের সাথে এলাকার জমির মৃধার সম্পর্ক সুবিধার ছিলোনা বিধায় সবাই ধারণা করে জমিরই ইচ্ছে করেই প্রফেসরকে শিক্ষা দেবার জন্য বিড়ালটাকে মারিয়েছে। মৃত বিড়াল কোলে নিয়ে যখন শোকে পাথর প্রফেসর রাস্তার ওপরেই বসে আছেন ,তখন জমিরের কথাগুলো ছিলো এই রকম, ''আরে বিলাই মরছে তো কী হইছে। মহল্ল্যার মাইনসের কত্ত রকম ছমছ্যা ।কারো বিমার লাগছে , বিয়া লাগছে,পুলাপান হইছে, কয়ডা ছমছ্যা সামাল দিবেন মিয়া ?এল্যা বিলাই বুলাই ছাইড়া দেন ,ভাইসাব।''।

পুরান ঢাকার অতি জনপ্রিয় ভাষায় লেখা এই গল্পটা লেখক মৌসুমী কাদেরের ''বাদামী জুতো ও অন্যান্য গল্প '' বই হাতে নিয়ে পড়তেই পাঠক অনেক মজা পাবেন। প্রথম বইয়ের লেখক হিসেবেব অনেক ভিন্নতর ভাবনা এবং দক্ষ হাতের পরিচয় তিনি দিয়েছেন। অসাধারণ অনুভূতিময় সব গল্প নিয়ে পাঠকের সময় ভালো কাটবে । পাঠকের হাতে হাতে বইটি ফিরুক । লেখক সম্পাদক মৌসুমী কাদের এর জন্য বরাবরের শুভকামনা ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ