১ম পর্ব
১৯৯০ সালের অপরাহ্ন। চঙ্গী এয়ারপোর্টে ট্যাক্সিতে চড়ে বসে অভ্র ও নাস্তিয়া। প্রায় ৪০ মিনিটের রাইড শেষে এসে উপস্থিত হয় ভিক্টোরিয়া হোটেলে। দিন শেষ হয়ে গেছে। দীর্ঘ জার্নির পরে দুজনেই ক্লান্ত। হোটেলের রিসেপশনে দাঁড়িয়ে অভ্র সময় নিয়ে কথা বলে। তাদের কথাবার্তা নাস্তিয়া বুঝতে পারেনা। সে ইংরেজি জানেনা, স্কুলে সে যদিও জার্মান শিখেছিল, তাও তার মনে নেই। মনে থাকলেও সিঙ্গাপুরে তার কোন কাজে আসতোনা। অভ্র ফিরে তাকায় ওর দিকে, মাথা চুলকিয়ে বলে, "একটু অসুবিধা হয়ে গেল, একটি মাত্র রুম আছে, তাও একটি কিং বেড। পৃথক কোন রুম নেই, এমনকি দুই বেডের কোন রুম ও নেই। কি করি বলো তো ?"
"অন্য কোন হোটেলে যাওয়া যায় না?"
“হ্যাঁ, চল যাই।”
পাশের হোটেলটি বেশি দূরে নয়। হাঁটার পথ। ওদের লাগেজও কাঁধে ব্যাগমাত্র।
গরমে গা পোড়ায়। এতটা গরম নাস্তিয়া আগে কখনও অনুভব করে নি।
তবে পাঁচ মিনিটের বেশি লাগে না। রিসিপশনে আবারও সময় নিয়ে কথা বলে অভ্র।আবারও চিন্তিত মাথা চুলকায়। শুক্রবার সন্ধ্যা, হোটেলের সব রুম বুকড, একটা মাত্র রুম দিতে পারবে, একটি মাত্র কুইন বেড। নাস্তিয়া কুইন, কিং বেডের বিষয়টি বোঝেনা, তবে অভ্রের সাথে একই বিছানায় ঘুমাতে সে অস্বস্থি বোধ করে।
সোভিয়েত ইউনিয়নে তখন গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রইকা চলছে। গ্লাসনস্ত - কথা বলা বা স্বাধীন মতামত প্রকাশ করার অধিকার। ওই অধিকার আগে ছিলনা, এখন ঘোষণা করে সেই অধিকার দেয়া হয়েছে।
পেরেস্ত্রইকা- রি-স্ট্রাকচার বা সামাজিক পুনর্গঠন। যে সমাজ এতদিন ধরে গঠন করা হয়েছে, তা নিয়ে আর এগুনো যাচ্ছেনা, সমাজকে নতুন করে গড়ার শ্লোগান দেয়া শুরু হয়েছে।
ওই দেশের মানুষের কাছে বাইরের পৃথিবীর বাস্তব চিত্র ছিল সম্পূর্ণ অজানা। কারণ পরিখা পার হয়ে বাইরে আসা নিষিদ্ধ ছিল।বাইরের দুনিয়ার যে খণ্ডচিত্র তাদের মিডিয়ায় পরিবেশন করা হতো তাতে বিভ্রান্তির পরিমাণ ছিল খুব বেশি। সঠিক খবর দেয়া হতোনা। বেশিরভাগ মানুষ রুশ ভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষাও জানতোনা। স্কুলে যদিও ২য় ভাষা হিসেবে জার্মান, ফ্রেঞ্চ, ইংরেজী, স্প্যানিশ পড়ানো হতো, তার কোন বাস্তব প্রয়োগ না থাকার কারণে স্কুল শেষ করে আসার আগেই ভুলে যেত।
ইংরেজী যে পৃথিবীব্যাপী সবচেয়ে প্রচলিত ভাষা, অনেকে ২য় ভাষা নির্বাচন করার সময়ে তাও জানতোনা। দেখা যেত হয়তো জার্মান শিখেছে কারো পরামর্শে এই কারণে যে কোনদিন হয়তো
ভাতৃপ্রতীম পূর্ব জার্মানীতে যাবার সুযোগ হবে এবং তখন কাজে লাগবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সে স্বপ্নও স্বপ্নই রয়ে যেত ।
সোভিয়েত ইউনিয়নে পেরেস্ত্রোইকার মধ্য ও শেষ পর্যায়ে অনেক রাশিয়ানই শিশুদের মত সরল ছিল। পুঁজিবাদী দুনিয়ার জটিলতা, দ্বৈতমুখ, প্রতারণা ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা ছিলনা। তবে তাদের এই শৈশবকালটা ছিল খুব সংক্ষিপ্ত। জীবন তাদের খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বাস্তবতাকে মেনে নিতে বাধ্য করেছে এবং বুঝিয়ে দিয়েছে যে, পৃথিবীতে শিশুর মত বাঁচা যায়না। শিশু হয়ে বাঁচতে গেলে বড়দের রক্তচক্ষু মেনে নিতে হয় ।
যাই হোক, অভ্র নাস্তিয়ার অস্বস্থিকে বিবেচনার মধ্যে এনে, একটি ট্যাক্সি নিয়ে তৃতীয় একটি হোটেলে পৌঁছে। রিসিপশনে কথা বলে। এখানেও সেই একই কথা, পৃথক রুম বা পৃথক বেড নেই।
অভ্র ভালো, ভদ্র ও স্মার্ট। তিন তিনটি হোটেলের একটিতেও পৃথক রুম বা পৃথক বিছানা না থাকার কাকতালীয় ব্যাপারটি নাস্তিয়া বুঝে উঠতে পারেনা। জীবনে প্রথম বিদেশে এসেছে।
অভ্র তার পরিচিত, প্রেমিক নয়। ভাষা জানেনা এবং সে ক্লান্ত। অভ্রের সাথে বিছানা শেয়ার করাটা যে তার ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর নির্ভর করছেনা সে তা বুঝতে পারে। তবু তিন তিনটি হোটেলে চেষ্টা করার জন্য অভ্রের প্রতি সে খুবই কৃতজ্ঞতা বোধ করে।
নাস্তিয়ার দেশে পার্টি ৭০ বছর ধরে অতি যত্ন ও নিষ্ঠার সাথে নাগরিকদের শিখিয়েছে : "আমাদের এখানে মানুষ মানুষের বন্ধু,কমরেড ও ভাই, আর ওখানে মানুষ মানুষের জন্য নেকড়ে।" এই বাক্যের দ্বিতীয় অংশটা অতি সত্য হলেও প্রথম অংশ নিয়ে একটু অস্পষ্টতা ছিল। এবং ছিল বলেই এই গল্প।
ওরা রুমে যায়।নাস্তিয়া গোছল করে রিফ্রেশ হয়। তারপরে অভ্রও।
ক্লান্তিটা কমে আসে।
চলো ডিনার করে আসি।
নাস্তিয়া হাল্কা ড্রেস পরেছে। সিংগাপুরের আলো ঝলমলে উষ্ণ রাত।আগের মত অত গরম নয়। চমৎকার বাতাস তার আঠারো বছরের ফকফকে চামড়ায় সুড়সুড়ি দিয়ে যায়। একটা অদ্ভুত অনুভূতি। না-গরম, না -ঠাণ্ডা, জাস্ট রাইট ।
সে রিজানের মেয়ে, ওদের গ্রীষ্মগুলোও মনোহরণ করে। কিন্তু এখানে কি একটা অন্যরকম গন্ধ, অন্য অনুভব। এক বছর আগে সে মস্কোর মেই ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়ে এসেছে। প্রথম বছর শেষ হয়ে গ্রীষ্মের ছুটি শুরু হয়েছে। গ্রামে চলে যাবার কথা ছিল কিন্তু হঠাৎ করে ইনস্টিটিউটের বন্ধু অভ্রের কাছ থেকে প্রস্তাব আসে তার সাথে সিঙ্গাপুর ভ্রমণে যাবার। সে ব্যবসার কাজে সেখানে যাচ্ছে, দুদিন যাওয়া আসা, তিনদিন সিঙ্গাপুরে থাকা। যাওয়া আসা থাকা খাওয়া ফ্রি, শুধু আসার সময় একটা কম্পিউটার ও একটা ফ্যাক্স নিয়ে আসতে হবে। এয়ারপোর্টে কাস্টম একটি কম্পিউটার ও একটি ফ্যাক্স ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য আনতে দেয়, কোন ট্যাক্স পে করতে হয়না ।
‘আভির’-এ ভিসার ব্যাপারটা সে দেখবে।
অভ্র ইনস্টিউট শেষ করে পিএইচডি শুরু করেছে। সে খুবই মিশুক ও আড্ডাবাজ।
প্রায়ই ওর রুমে পার্টি জমে। হাত বড় উদার এবং খরচ করে বেহিসাবি। খাদ্য, পানীয়, মিউজিক কোনকিছুর ব্যাপারেই কোন অপ্রতুলতা নেই, যদিও সারাদেশে মানুষ না খেয়ে আছে এবং অতিবৃদ্ধদের কেউ কেউ মারা যেতে শুরু করেছে। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পরে খাদ্যাভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নে কেউ মারা যায়নি।
নাস্তিয়ার রুমমেটরা অভ্রের বন্ধু, সেই সুত্রেই অভ্রের সাথে পরিচয় কোন এক পার্টিতে। ১৮ বছর বয়েসের মস্কোর হোস্টেলবাসী কোন মেয়ের জন্যে নিষিদ্ধ কোন ফল নেই, নিষিদ্ধ কোন ব্যবহার তো নয়ই। তারপরেও কোন কারণ ছাড়াই সে মস্কোতে একটি বছর কাটিয়েছে কোন প্রেমিক না জুটিয়ে। টেম্পটেশন যে ছিলনা তা নয়।হয়তো রিজানের আলো-হাওয়ার কোন প্রভাবে সে “না” বলতে পেরেছে।দেখতে সে সুন্দর। ছাত্রী হিসেবেও এক্সট্রা অর্ডিনারি, মেই ইন্সটিটিউটে ভর্তি হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়।
অভ্রের প্রস্তাবটি চাঁদ হাতে পাবার মত ।
এই বয়েসে বাইরের দুনিয়া দেখার সাধ সব মানুষেরই থাকে। সোভিয়েত ব্যবস্থা নতুন মানুষ তৈরী করার দায়িত্ব নিয়েছিল। সেই নতুন মানুষের অন্য দেশ দেখা, অন্য জাতি সম্পর্কে জানার কোন ইচ্ছা থাকবে না এটাই আশা করা হয়েছিল। “অন্য জাতিগুলো সোভিয়েত নতুন মানুষের জন্য ক্ষতিকর” নেতৃত্বের কোন এক স্থুল মগজে হয়তো এমনটাই ধারণা করা হয়েছিল। তাই নাগরিকদের দেশের বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তবে ব্যতিক্রম যে ছিল না,তা নয়। সব কিছুতেই থাকে। পার্টি ও রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে যারা ছিল তারা বাইরে যেতে পারতো। এদের বলা হতো, “আপারাতচিকি” বা “নমেনক্লাতুরা”। শ্রেণিহীন সমাজের এরা ছিল সুবিধাভোগী একটি বিশেষ শ্রেণি। তবে ঐ দেশীয় বা ঐ দেশের বাইরের মার্কসীয় পণ্ডিতগণ দাবী করতেন যে, এটা কোন শ্রেণি নয়, শুধু সমাজের একটি বিশেষ স্তর। শ্রেনি বা স্তর, নামের পরিবর্তনে কামের কী পরিবর্তন হয় তা বোঝা মুশকিল, কিন্তু এরা দেশের বাইরে যেতে পারতো।
তবে এরা এমন ধাতুতে তৈরী ছিল যে, পশ্চিমের বদ আলো হাওয়া তাদের স্পর্শ করতো না।
তাদের রাষ্ট্র চালাতে হয়, কূটনীতি, রাষ্ট্রের ব্যবসা-বানিজ্য, শান্তি- আলোচনা, ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান, আন্তর্জাতিক বিষয়-আশয় নিয়ে কত কাজ করতে হয়, সুতরাং তাদের পথ রোধ করা যে মূলতই রাষ্ট্রের পথ রোধ করা, এটা যে কোন বোধসম্পন্ন মানুষই বুঝতে পারে । তাই জনগণ এ নিয়ে অযথা প্রশ্ন তোলে না। জনগণ অবশ্য এমনিতেও প্রশ্ন করার স্বভাবটা ভুলে গেছে এবং পেটে বোমা ফেলেও তাদের কাছ থেকে প্রশ্ন আদায় করা যায় না, উত্তর তো নয়ই।
পেরেস্ত্রোইকা শুরু হবার পরে সোভিয়েত নাগরিকদের বিদেশে যাবার অনুমতি দেয়া। বিদেশে যেতে হলে যে দেশে যেতে ইচ্ছুক সে দেশের কোন সংস্থা থেকে লিখিত নিমন্ত্রণ দেখাতে হতো। সে নিমন্ত্রণ নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের বর্ডার ক্রস করার “এক্সিট ও রি-এন্ট্রি” ভিসার জন্য দরখাস্ত করতে হতো।দরখাস্তকারী যদি কোন রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য নিয়ে কাজ করে এমন কোন সংস্থার বর্তমান বা প্রাক্তন কর্মচারি না হয় তবে সে ভিসা পেত। যে সংগঠনটি ভিসা দেয় তার নাম আভির। আভির মাতা-পিতার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ একটি সংস্থা।
অভ্র এই ব্যবসার সাথে জড়িত প্রায় বছর দুই ধরে। যদিও সে ব্যবসায় পাইওনিয়ার নয়, ব্যবসা শুরু হবার পরেও সে প্রায় দুটি বছর নষ্ট করেছে তাভারিশদের সাথে থাকার কারণে।তাভারিশ মানে কমরেড। যারা দেশ থেকে সিপিবি, ছাত্রইউনিয়ন বা এই বলয়ের কোন সংগঠনের মাধ্যমে বৃত্তি নিয়ে এসে সিপিবি আরোপিত বিশুদ্ধতার অর্থডক্স নিয়মকানুন মেনে চলার গুরু দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে, তাদের এখানে তাভারিশ বলা হয়। দু'বছর আগে খুব বেশি পটর পটর করায়, মানে পার্টির নিয়মকানুন শিথিল করার দাবী পেশ করার কারণে তাকে পার্টির গ্রুপ থেকে বের করে দেয়া হয় । তার পরিবারের ত্যাগ এবং ব্যক্তিগতভাবে তার এত বছরের কৃচ্ছ সাধনাকে তারই প্রিয় তাভারিশরা এভাবে মূল্যায়ন করবে, তা সে কখনও ভাবতে পারেনি। সে “ডেমোক্রাটিক সেন্ট্রলিজম” যে সত্যিকারভাবে কী, তা বাস্তবে না জেনেও খুব দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতো। মানুষ ভূত, প্রেত, স্বর্গ-নরক ইত্যাদিতে বিশ্বাস করতে পারলে, “ডেমোক্রাটিক সেন্ট্রলিজমে” কেন বিশ্বাস করতে পারবে না, তা সে কোনভাবেই বুঝে উঠতে পারেনি। বহিষ্কারের পরে প্রথম ২ সপ্তাহ সে শুধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে।
বামপন্থী লোকজন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রয়োজনের বেশি ইমোশনাল হয় এবং যেখানে ব্যথা পাবার কিছু নেই, সেখানেও ব্যথা পায়।
তারপরে ইন্ডিয়া, নেপাল ও শ্রীলংকার বন্ধুরা বলা চলে জোড় করেই তাকে বাস্তবতার জগতে ফিরিয়ে আনে। এরা সবাই স্ব স্ব দেশের কমিউনিষ্ট পার্টি থেকে আসা।কিন্তু ওদের পার্টিগুলোতে কোন কমরেড ফরহাদ না থাকায়, অভ্রদের পার্টির মত বেত হাতে হেডমাস্টারি করার কোন সিস্টেম গড়ে ওঠেনি। ওরা বাইরেও যেতে পারতো, ব্যবসাও করতে পারতো এবং ওদের ছাত্র সংগঠনগুলোতে ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের কারণ ছাড়া আদর্শগত কোন বিভাজন ছিলনা। কিন্তু অভ্রদের পার্টির ব্যাপারটা ছিল একে বারে সাদা কালো বলশেভিক শ্লোগানের মত : "যারা আমাদের সাথে নয়, তারা আমাদের বিরুদ্ধে ( মানে আমাদের শত্রু) ।"
সুতরাং যারাই পার্টির কড়া নিয়ম-কানুন মানতে চাইতোনা, তারাই চলে যেত শত্রু শিবিরে। তাদের সাথে যোগাযোগ রাখাটাও সন্দেহের চোখে দেখা হতো। একটি অদৃশ্য লাল সাদা লাইন টানা হয়ে যেত এবং ইন্টারগ্রুপের বন্ধুত্ব হতো বিরল। এই কারণে অভ্রেরও বাংলাদেশ থেকে আসা সবচেয়ে কাছের বন্ধুরা ছিল তাভারিশ গ্রুপের, অন্যদের সাথে তার তেমন বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেনি।
ভিনদেশি বন্ধুরা ওকে বুঝাতে সক্ষম হয় যে এভাবে পেটা শুকা দিয়ে বসে থাকার কোন অর্থ হয়না। ব্যবসা করা কোন দেশেই অন্যায় নয়, সোভিয়েত ইউনিয়নে তা “অন্যায়” বললেও শুধু বাস্তবতা বিবর্জিত মাথা মোটারাই তা মেনে নেবে। চুরি করা হল অন্যায়। এই ব্যবস্থা ব্যবসাকে অবৈধ ও
‘স্পেকুলেশন’ বলে চুরি করাকে অলিখিতভাবে জায়েজ করে দিয়েছে। তবে চুরি করাকে
এদের আন্ডারগ্রাউন্ড মাস্টারেরা একটি সূক্ষ্ম আর্টে উন্নীত করে এর নিজস্ব কিছু বিধি-নিষেধ তৈরি করেছে। তা না মেনে চুরি করতে গেলে সর্বনাশ হবার সম্ভাবনা খুব বেশি। মস্কোর ইলিসিয়েভ সুপার স্টোরের ডাইরেক্টর, পার্টি নেতা ইউরি সকোলভ চুরির আন্তর্ভৌম পবিত্র আইন খেলাপ করে ফায়ারিং স্কোয়াডে গিয়েছিল। চুরি করে ধরা পড়তে নেই, আর ধরা পড়ে গেলে মুখ খুলতে নেই। কারণ পরিস্কার, একজন চোর কখনই তার অন্য কমরেডকে ধরিয়ে দিতে পারে না।
এবং সবচেয়ে বড় কথা, সারারাত্র নীতিকথার রামায়ন পড়ে, গর্বাচভ ব্যবসাকে বৈধ করে দিয়েছে।
পেরেস্ত্রইকা, মস্কো ও মধু শাহাব আহমেদ
২য় পর্ব
বন্ধুরা অভ্রকে ব্যবসায়ের পথ-ঘাট শিখিয়ে দেয়। অবৈধ কিছু করার প্রয়োজন নেই। বৈধ কাজই একজন উদ্যমী ব্যবসায়ী অন্য দশজনের তুলনায় স্মার্টভাবে করতে পারে। বোর্ডে ডাবল স্ট্যান্ড করা অভ্রর স্মার্টনেস ধার করার প্রয়োজন নেই। কিছু মানুষ আছে সাফল্য তাদের ছায়ার মতই, শুধু অর্জনের ইচ্ছটুকু থাকলেই হল।
বাংলাদেশের বৃটিশ -পাকিস্থানের আমলা তৈরির শিক্ষা ব্যবস্থায় যে সাফল্য দেখাতে পারে, তার পক্ষে সিস্টেমের অন্যসব দুর্বলতা ও গোঁজামিল থাকা সত্ত্বেও নতুন মানুষ তৈরি করার যে সোভিয়েত অনবদ্য শিক্ষাব্যবস্থা ছিল, সেখানে সফল হওয়া ছিল আরও সহজ। তাই দেখতে আপাত ছোট মনে হলেও অভ্রকে ওর শিক্ষকেরা শুধু স্নেহই করতোনা বরং অনেক বড় মনে করতো। আর অভ্রও যখনই সিঙ্গাপুর যেত তার প্রতিটি শিক্ষকের জন্য কিছু না কিছু উপহার নিয়ে আসতে ভুলতোনা।
ইতিমধ্যেই সে সিঙ্গাপুরে একটি কোম্পানি রেজিস্ট্রি করিয়েছে যার কোন বাস্তব কর্মকাণ্ড না থাকলেও কোম্পানির নামে সিল এবং প্যাড তৈরী করে এনেছে। এখন সে ঘরে বসেই যে কোন রাশিয়ানের জন্য প্রয়োজনীয় ইনভাইটেশন তৈরি করে দিতে পারে অরিজিনাল সিল ছাপ্পর সহ। কাজটি অবৈধ, কিন্তু একটু আধটু তো করতে হবেই ব্যবসার স্বার্থে।
ইনস্টিউটের আভিরে কাজ করে যে মেয়েটি, প্রতিবারই সিঙ্গাপুর থেকে সে তার জন্য ভালো উপহার নিয়ে আসে। অভ্রের ঘনিষ্ট বান্ধবীদের সে একজন। ‘আভির’ হল বিদেশীদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান, ওখানকার মেয়েগুলোর ক্ষমতা গ্রীক দেবীদের চেয়েও বেশি। ওরা ভিসা না দিলে একজন বিদেশি নিজ শহরের বাইরে এক পা ও যেতে পারবেনা, বিদেশে যাওয়া তো দূরের কথা।
এরোফ্লতে সচরাচর টিকিট পাওয়া যায়না। কিন্তু এর আগে এরোফ্লত কাউন্টারের সবচেয়ে সুন্দর যে মেয়েটি, লেনা, তাকে নিয়ে সে সিঙ্গাপুর ঘুরে এসেছে। একই রুমে একইভাবে তিনরাত সিঙ্গাপুরে কাটানোর পর লেনা এখন তার জন্য অসাধ্য সাধনে প্রস্তুত। ফিরে আসার সময় সেও অভ্রের জন্য একটি কম্পিউটার ও ফ্যাক্স কাস্টম পার করে দিয়েছে। প্রকৃত পক্ষে এই দুটো জিনিস বিক্রি করে যে লাভ হয় তাতে ও রকম একটি মেয়েকে কয়েকবার সিঙ্গাপুর ঘুরিয়ে আনা যায় বহুগুন বেনিফিট সহ। কিছুদিন আগে লেনা আবদার করেছে স্বামী সহ তাকে আবার সিঙ্গাপুর পাঠাতে।
তার খুবই ইচ্ছে সেন্টোসা দ্বীপে প্রিয়তম স্বামীকে নিয়ে সমুদ্রস্নান করার। অভ্র ঠাট্টা করে বলেছিল, "কেন, আমার সাথে সমুদ্র-স্নান বুঝি পছন্দ হয়নি?"
লেনা হেসে বলেছিল, "ভালো জিনিস বেশি খেতে নেই, তাতে বদহজম হয়।"
অভ্র বলেছিল, "আচ্ছা আচ্ছা, কবে যাবি বলিস। কাল হোস্টেলে আসিস, তোর জন্য ফ্রান্সের দামি শ্যাম্পেন কিনে রেখেছি। সেই সাথে আভিরের জন্য ইনভাইটেশন নিয়ে যাস।"
লেনা অভ্রের ইনস্টিউটের আভিরের অধীনে নয়, তাই ভিসাটা ওর নিজেরই নিতে হয়। অভ্র নিমন্ত্রণ দেয়া ছাড়া আর কোন সাহায্য করতে পারেনা। শ্যাম্পেনের দাওয়াতের অন্তর্নিহিত অর্থটা লেনা বোঝে।
"তোর খালি খাই খাই। আচ্ছা আসবো, তবে রেজিনকা* যেন থাকে, আমি কিন্তু ওসব সাথে রেখে স্বামীর সন্দেহের কারণ হতে রাজি নই।"
"চিন্তা করার কারণ নেই, তোর সাথে সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে দামী যে বাক্সটা কিনেছিলাম, সবটাই তো পড়ে আছে ।"
যেতে যেতে মৃদু হাসে অভ্র।
হাসে লেনাও ।
অভ্রকে সে পছন্দ করে, ওর মধ্যে এমন একটা কিছু আছে যা চুম্বকের মত।
সে তার স্বামীকে ভালোবাসে, কিন্তু বিদেশি এই ছেলেটা মাঝে মাঝে ঝড়ের দমকার মত মনটা কেমন আলু থালু করে দিয়ে যায়। সে কথা বলে ধীরে ধীরে, কথা বলে কম, কিন্তু প্রতিটা শব্দ বলে ওজন মেপে। খুব যে হাসি ঠাট্টা করে তা নয়, আবার রস কস হীনও নয়। ওর চোখে কি একটা আলো চিক চিক করে। মুখটা কেমন মায়া-ভরা। খুবই যত্নবান ও মনোযোগী। ও যখন পাশে থাকে অভ্র অন্য কোন কিছুতে মন দেয়না । ১০০% তাকেই সময় দেয়। মনে হয় ও ছাড়া অভ্রের আর কোন কাজ, আর কোন চিন্তা নেই। সবটুকু যত্ন শুধু ওকে ঘিরেই। একটা অদ্ভুত পুরুষ। ওর পাশে লেনার আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে যায়। মনে হয় সে সামান্য নয়, সেও অতি সুন্দর ও কাম্য । এই স্থানটিতে অভ্র ওর পরিচিত সব পুরুষ থেকে ভিন্ন।
অভ্র ব্যবসায়ি কিন্তু ব্যবসাটা যেন কেমন গা-ছাড়া গোছের, হলে হল, না হলে নাই। পিএইচডি , পড়াশুনো, সামাজিকতা, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে হৈ হুল্লোড়ই আসল। খুব একটা মদও খায়না, কখনও মাতাল হতে দেখেনি। অথচ ওর পার্টিতে গেলেও দেখা যেত দু একজন মদ খেয়ে টাল হয়ে গল গল করে বমি করে দিয়েছে। অথবা অশালীন সব কথাবার্তা বলছে। একবার তো মাতালে মাতালে মারামারি, তাও মেয়ে নিয়ে। অবশ্য এখন ও আর এই সব ঝামেলার পাবলিক দাওয়াত দেয়না, দু চারজন বন্ধু-বান্ধব যাদের এখন ডাকে, ওরা ভালো। ওরা নিজেদের স্থান বোঝে, খুব মার্জিত ও ভদ্র। বোঝা যায় ওরা সম্পূর্ণ অন্য প্রজাতির।
টাকা পয়সার ব্যবহারেও অভ্র লোভি নয় । সে যখন অভ্রের সাথে সিঙ্গাপুরে যায়, বেশ দামি হোটেলেই থেকেছে। অথচ ওর দু একজন বান্ধবি গিয়েছিল অন্য কাদের সাথে। তারা এসে বলেছে সস্তা, নোংরা, তেলাপোকা আর মশায় গিজ গিজ করা গা ঘিন ঘিনে হোটেলে থেকেছে। কোন কিছু কেনা কাটা করার জন্য দোকান পাটেও যাওয়ার সুযোগ পায়নি, মোস্তফা-শামসুদ্দিনের ঘিঞ্জি দু’ চারটা দোকানে ঘুরেই শেষ। যেদিন গিয়েছে তার পরের দিনই চলে এসেছে।
অথচ অভ্র সিঙ্গাপুর ঘুরে দেখিয়েছে, বীচে কাটিয়েছে সময়, অরচার্ড রোডের চোখ ধাঁধানো দামি দামি দোকানগুলো ঘুরে অনেক কিছুই কিনে দিয়েছে না চাইতেই। আসলেই একজন মানুষের সাথে আর একজন মানুষের কত তফাত। কেউ কমদামী হোটেলে থাকে এবং হোটেলের বা খাবার খরচ বাঁচানোর জন্য ট্রিপ যত সংক্ষিপ্ত করা যায় সেই চেষ্টায়ই থাকে। আর অন্যমানুষ সবকিছু দেখে অন্য দৃষ্টি দিয়ে।
সে তো প্রতি দিনই সিঙ্গাপুরের টিকিট বেচে, কেউ কেউ পারলে যেদিন গিয়ে নামে, সেদিনই ফিরতি প্লেন ধরতে চায়। এটা তো শরীরের উপরও অত্যাচার ।
অথচ অভ্র বলে,”অত তাড়াহুড়ো কি? জীবন তো একটাই, একটু ধীরে সুস্থে যাওয়াই ভালো। সারা বছর শীতের দেশে থাকি, দুটা দিন সেন্টোসা দ্বীপে রৌদ্রস্নান করে আর সাঁতরিয়ে কাটাবো। দূরের সমুদ্রে সারা পৃথিবীর বড় বড় জাহাজগুলো নোঙ্গর করে থাকে, সমুদ্র-সৈকতে সারি সারি নারিকেল গাছের পাতায় বাতাস ঝাপটা মেরে যায়, এই দৃশ্য তুই কোথায় দেখবি মস্কোতে বসে?”
* রেজিনকা- কন্ডম
পেরেস্ত্রইকা, মস্কো ও মধু শাহাব আহমেদ
৩য় পর্ব
দুসপ্তাহ পরেই লেনা তার স্বামীকে নিয়ে আসবে সিঙ্গাপুরে। অভ্র টিকেটের দাম ইতিমধ্যেই পরিশোধ করে দিয়েছে, আসার সময় থাকা খাওয়ার অর্থকড়ি দিয়ে সিমলিম স্কোয়ারের ফিউচার শপের ঠিকানা দিয়ে পাঠাবে। তাদের জন্য ২ টি কম্পিউটার ও ২ টি ফ্যাক্স এবারই কিনে রেখে যাবে। ওরা আসার পর ফিউচার শপের লোকজন এয়ারপোর্টেই ডেলিভারি দেবে কম্পিউটারগুলো। ওরা যার যার নামে লাগেজ জমা দেবে চেক-ইন কাউন্টারে ।
মস্কো এয়ারপোর্টে কিভাবে কাস্টমস পার হতে হবে তার বিস্তারিত নির্দেশনা দেয়া আছে। কম্পিউটার বা ফ্যাক্স নিজের ব্যবহারের জন্য আনা হয়েছে তাই বলতে হবে। বিক্রির কথা কোন মতেই বলা যাবেনা। মাঝে মধ্যে কাস্টমসে কোন খারাপ অফিসার পড়লে পরীক্ষা করা শুরু করে আদতেই যে ব্যক্তি কম্পিউটারটা আনছে তার ব্যবহার জানে কিনা।
কোন বাক্সে কী আছে ( মনিটর, প্রিন্টার, প্রসেসর ) তা জিজ্ঞেস করে। লেনা কম্পিউটার নিয়ে কাজ করে, তার অসুবিধা হবেনা, কিন্তু ওর স্বামীর হতে পারে। কোনটা কি কাজ করে তাও জানতে হয়, যেমন প্রসেসর হল কম্পিউটারের ব্রেইন, সব কাজ সেখানেই হয়, কি-বোর্ড দিয়ে ডেটা ও কমান্ড ইনপুট হয়, মনিটর হল টিভির মত একটা স্ক্রিন যেখানে প্রসেসরের ভেতরে যে কাজগুলো সম্পন্ন হচ্ছে তা দেখা যায়, আর প্রিন্টারের মাধ্যমে তাই কাগজে প্রিন্ট হয়ে আসে। খুব বেশি জানার দরকার নেই। অন্তত এ টুকু না জানলে ওরা বুঝে ফেলবে, এ ব্যক্তি অন্য কারো জন্য কম্পিউটার নিচ্ছে এবং সে ক্ষেত্রে ট্যাক্স পে করতে হবে। অবশ্য অভ্র থাকলে এটা কোন ব্যাপারই নয়, কাস্টমসের লোকজন খুব অল্পতেই কেনা বেচা হয়।
কম্পিউটার নিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে বেরুবার পর অভ্র বা অভ্রের লোক ওদের গাড়িতে তুলে নেবে। ডাকাতি জিনিসটা সোভিয়েত আমলে ছিলনা। পেরেস্ত্রইকা ও ব্যবসা শুরু হবার পর ডাকাতি, রেকেট, মাফিয়ার প্রবলেম শুরু হয়েছে। এরা এখন গিজ গিজ করে। কম্পিউটারের বাক্সগুলো দেখলেই চেনা যায়, সুতরাং এয়ারপোর্ট থেকে অজানা ট্যাক্সিতে উঠলে প্রায়ই মাঝপথে কোথাও ট্যাক্সি থামিয়ে পিস্তল ধরে আরোহিকে নামিয়ে দিয়ে মালামাল ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা ইদানিং অনেক হচ্ছে। অথবা মালপত্র ট্রান্কে পুরে জায়গা মত পৌঁছে, টাকা পরিশোধ করে বের হয়ে
ট্রান্ক পর্যন্ত যেতে যেতেই ট্যাক্সি চলে যাবার ঘটনাও প্রচুর।
সমস্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় ও কুখ্যাত যে ৫টি মাফিয়া গ্রুপ আছে মস্কোর সোন্তসেভস্কায়া মাফিয়া তাদের মধ্যে অন্যতম। অন্যান্য বড় বড় কোম্পানি, ব্যাংক, হোটেল , মার্কেট ও রেস্টুরেন্ট কন্ট্রোল করা ছাড়াও ট্যাক্সির ব্যবসাও ছিল ওদের হাতে। অন্যান্য গ্রুপের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতো ওরা এবং ইয়ত্তাহীন-সংখ্যক লাশ ওদের তালিকায়।তবে শুধু ওদেরই নয়।
মিলিশিয়া, কেজিবি এদের কাছে আপাত অসহায়।
মস্কো শহর থেকে এয়ারপোর্ট অনেকটা দূরে, লোকালয়ের বাইরে এবং নিরিবিলি পথও দীর্ঘ। এমনও দেখা গেছে যে নিজস্ব গাড়ি বা পরিচিত গাড়ি নিয়ে গেলেও এয়ারপোর্ট থেকে ফেরার পথে কোন নিরিবিলি জায়গায় দু'তিনটা বিদেশী গাড়ন হঠাৎ সামনে পিছনে এবং পাশ থেকে ঘিরে ফেলে গাড়ি থামাতে বাধ্য করেছে, তারপর অস্ত্রের মুখে মালামাল কেড়ে নিয়ে মুহূর্তের মধ্যে উধাও হয়ে গেছে।
সোভিয়েত সময়টা এই সেন্সে সোনার সময় ছিল। মানুষের নিরাপত্তার অভাব ছিলনা। এটাও ঠিক যে, তখন ডাকাতি করার মত মানুষের হাতে কিছু ছিলও না। যাদের ছিল, ক্ষমতাই ছিল তাদের নিরাপত্তা।
ক্যাপিটালিজমের এ-ই দোষ, কিছু মানুষের আছে প্রয়োজনের চেয়েও বেশি, বেশিরভাগ মানুষের কিছুই নেই। তাই নিরাপত্তার বিষয়টা খুব আপেক্ষিক সেখানে। রাশিয়া এখন যে দিকে যাচ্ছে তাকে ক্যাপিটালিজম হয়তো বলা যাবেনা কারণ এখনও সব কিছুই রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত। তবে এটা যে সোস্যালিজম নয় তা জোর দিয়েই বলা যায়। আগের দিনের পৃথিবীতে যেমন বোম্বেটে, ভাইকিং, হার্মাদ, বর্গী জলদস্যুতে গিজগিজ করতো এই দেশে এখন তেমনই। এরা এতকাল ছিল কই এবং এলই বা কোথা থেকে? রাষ্ট্র আছে, পুলিশ আছে, সর্বদৃশ্য চেকিস্টরা* আছে অথচ এই দঙ্গল বাড়ছে তো বাড়ছেই, মশা-মাছির মত।
ওরা হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে এক ইন্ডিয়ান খাবার দোকানের সামনে। বাইরে একটি লোক রুটি বানাচ্ছে। হাতের কসরতে ঘুরে ঘুরে ময়দার এলাস্টিসিটির কারণে রুটিটি বিশাল গোলাকার হয়ে পড়ে, তারপরে যখন বিশাল এক তাওয়ায় তা ভাজতে দেয়া হয় তা আবার সংকুচিত হয়ে আসে। নাস্তিয়া রাস্তায় দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখে।
অভ্র বলে, দোকানটা তত পরিস্কার নয় কিন্তু ওদের খাদ্য অসম্ভব সুস্বাদু। আমি সিঙ্গাপুরে এলে এক বেলা অন্তত এখানে খাই। তুমি খাবে এখানে? না কি সামনে ভালো জায়গা আছে সেখানে যাবো?
নতুন অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতা। নাস্তিয়া এত চমৎকার হাতের কসরত দিয়ে বানানো পরোটা ট্রাই করতে চায়। অভ্র গরুর মাংস, মুরগি আর চানা-মশলা দিতে বলে। যদিও মাইল্ড স্পাইসি অর্ডার ছিল এবং একটু মুখে দিতেই ঝালে নাস্তিয়ার ফর্সা গাল ও মুখ লাল হয়ে যায় ডালিম-খোসার মত।
সামান্যই খেতে পারে সে। রসমালাই দিয়ে মুখের ঝাল কমানো হয়। সেই সাথে নাস্তিয়া পরিচিত হয় অভ্রের প্রিয় একটি সুইটের সাথে। সারাজীবনে এই প্রথম নাস্তিয়ার ইন্ডিয়া উপমহাদেশের খাদ্য ট্রাই করা। সম্পূর্ণ অন্য ধরনের খাদ্য, অবাস্তব অভিজ্ঞতা, তবে ঝালটা একটু কম হলে ভালো হতো।
খাওয়া শেষ করে ওরা হাঁটতে শুরু করে, প্রায় দশটার মত রাত। হোটেল বেশি দূরে নয়। ফুটপাত নির্জন, যদিও রাস্তায় ট্যাক্সিগুলো হুস-হাস করে ছুটে যায় রাগত ষাড়ের মত দুই চোখে তীব্র আগুন জ্বেলে। আকাশটা বড় স্বচ্ছ ও নীল। অসংখ্য তারা, খুব স্পষ্ট আকাশ-গঙা।
প্রথম দেখা প্রাচ্যের আকাশ।
বাতাস বইছে। নাস্তিয়ার হাল্কা গাউন উড়ছে।
খুব ভালো লাগছে সিঙ্গাপুরের মোহনীয় রাত।
নাস্তিয়া হাত মুখ ধুয়ে দাঁত ব্রাশ করে জিন্সের প্যান্ট ও টি-শার্ট পরেই বিছানায় শুয়ে পড়ে । ওয়াশরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে রাতের পাজামা পড়ে রুমে এসে নাস্তিয়াকে ও-ভাবে শোয়া দেখে অভ্র প্রশ্ন করে :
"তুমি কি প্যান্ট শার্ট পরেই ঘুমাও সচরাচর?"
"না"
"রাতের গাউন নিয়ে আসতে ভুলে গেছ?"
"না।"
"তাহলে?"
"আমি এমনিই ঘুমাবো।"
"আরে বোকা মেয়ে সিঙ্গাপুর রাশিয়ার মত শীতের দেশ নয়, এখানে এসির অবস্থা দেখতেই পাচ্ছো তত ঠাণ্ডা নয়। ঘুম হবে না। তুমি কি আমাকে ভয় পাচ্ছো ? "
নাস্তিয়া চুপ করে থাকে।
"বুঝছি ভয় পাচ্ছো। শোন ভয় পাবার কোন কারণ নেই, আমি বাঘ ভাল্লুক নই, তোমাকে স্পর্শ করবোনা। তাছাড়া আমি বিছানার চাদড় ও ব্লান্কেট দুটো দিতে বলেছি, তুমি আলাদাই ঘুমোতে পারবে "
নাস্তিয়া কিছুটা স্বস্তি বোধ করে ।
"কথা দিচ্ছ?"
"অবশ্যই।"
ও এবার উঠে স্যুটকেস খুলে নাইট গাউন বের করে। তারপর একটি বিছানার চাদর নিয়ে চলে যায় ওয়াশরুমে। সেখানে সে প্যান্ট, টি-শার্ট খুলে নাইটি পরে সারা শরীর চাদড়ে জড়িয়ে বিছানায় গিয়ে শোয় আলাদা ব্লাংকেটের নিচে। অভ্র ততক্ষণে টিভি অন করেছে, একটা ইংলিশ ছবি চলছে ।
অভ্র বলে,"টিভি বন্ধ করে দেব? ঘুমাবে ?"
তারপরে উত্তরের অপেক্ষা না করে টিভি ও লাইট বন্ধ করে বলে, "ঘুমানোই ভালো, খুব ব্যস্ত দিন গিয়েছে, শুভ রাত্রি।"
নাস্তিয়া বলে, "শুভ রাত্রি।"
*চেকিস্ট- কেজিবির পূর্বসুরি সংস্থার নাম চেকা এবং সেখানে যারা কাজ করতো তারা চেকিস্ট।
পেরেস্ত্রইকা, মস্কো ও মধু শাহাব আহমেদ
৪র্থ পর্ব
প্রায় ১ ঘন্টা চলে গেছে। পাশাপাশি শুয়ে দুজন টগবগে, জীবিত মানুষ। দুইজন মানুষের মধ্যেই উপচে পড়া যৌবন। চুপচাপ ঘুমোতে গিয়েও আসলে দুজনেই জেগে।
লেনিনগ্রাদের পাশাপাশি বয়ে যাওয়া মালায়া ও বালশায়া নেভকার দুই ধারার মতন। প্রত্যেকের নিজস্ব স্রোত, নিজস্ব উন্মনতা। তবুও তাদের মাঝখানে আছে কামেন্নি দ্বীপ আর অমরাবতির ধার করা উদ্যান। ওদের মাঝে কোন দ্বীপ নেই, নেই কোন ক্যকটাসের ঝোপ ঝাড়। একজনের নি:শ্বাসিত হাওয়ার তরঙ্গ অন্যের গায়ে এসে লাগে।
অভ্র জানে নাস্তিয়া জেগে, নাস্তিয়াও জানে অভ্র ঘুমায়নি ।
ওর মধ্যে কেমন একটা আলোড়ন যা সে কোন মতেই অবদমন করতে পারছেনা। জীবনের এই প্রথম সে কোন পুরুষের সাথে এক বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে আছে। প্রায় অপরিচিত একজন পুরুষ। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এক বিছানায়। নিজস্ব রুমে একা বিছানায় হলে সে এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়তো নিশ্চিত। কিন্তু এখানে কোন মতেই ঘুম আসছেনা। অভ্র কি যেন একটা পারফিউম ব্যবহার করেছে এবং তার কেমন একটা মাতাল করা গন্ধ নাকের শ্লেষ্মা ঝিল্লি দিয়ে ঢুকে যেন মগজের কোথাও একটা অজানা অনুভূতির সৃষ্টি করেছে। পুরুষের গায়ে যে মাদকতার গন্ধ থাকে তা এত কাছ থেকে সে কখনও পায়নি। কেমন যেন একটা অস্বস্থি, আরো সঠিক ভাবে বলতে গেলে অস্বস্থিও নয়, যেন একটা অচেনা দ্বীপের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা। অভ্রই প্রশ্ন তোলে, "নাস্তিয়া ঘুম আসছেনা বুঝি?"
"ক্লান্তি লাগছিল, ভেবেছিলাম ঘুম হবে কিন্তু হচ্ছেনা।"
"এটা জেট ল্যাগের কারণে। তোমার সিঙ্গাপুর কেমন লাগছে?"
বলে সে শোয়া থেকে উঠে হেড বোর্ডে বালিশে হেলান দিয়ে বসে, নাস্তিয়াও তাই করে ব্লান্কেট এবং চাদড় সড়িয়ে । সে এখন হেলান দিয়ে বসা।
অভ্রর চোখ এড়ায়নি, নাস্তিয়ার কাঁধ থেকে শুরু করে দুই হাত পর্যন্ত নগ্ন, তার কণ্ঠদেশ ও বুকের উপরাংশও তাই। তার বুকে কাচুলি নেই, যদিও বুক দেখা যায়না কিন্ত তার মসৃন বন্ধুরতার মাঝখানে নাইটির মিহিনতা ভেদ করে উন্মিষিত উষোসী অহংকার। তার বাদামি চুল সামনে এসে বুক ঢেকেছে।
অভ্র রিজানের আকাশ দেখেনি, তবে নাস্তিয়ার চোখে যেই রং তা দেখে মনে হয় রিজানের আকাশ বড়ই সুন্দর। রিজানে যে নদী বয়,’অকা’, নিশ্চয়ই সেই নদী অদ্ভুত নদী, তা নইলে এত সৌন্দর্য সে পেল কোত্থেকে? আসলে রাশিয়ান মেয়েরা এমনিতেই সুন্দর। ১৮ বছরের টান টান ভরাট যৌবনের স্বল্প বসনের একজন কুমারীর রূপ সৃষ্টির যে সম্মোহিত শিল্পী, সে কি ভাষায় সেই রূপ বর্ণনা দিতে পারে ? ভ্যান গগ্ কি পারে তারই কোন সৃষ্টিকে রং-তুলি নয়, শব্দ দিয়ে আঁকতে?
অথবা ভর্তৃহরির সেই কবিতাটিঃ
বুঝিনা- এ হেন রূপটি স্রষ্টা নয়ন মেলিয়া কেমনে গড়ে;
নয়নে পড়িলে, মুগ্ধ বিধাতা ছাড়িত কি তারে ক্ষণেক তরে?
নিমীলিত চোখে এ রূপ-সৃষ্টি সম্ভব নহে; বুঝেছি তাই-
বুদ্ধের এই কথাটি সত্য-জগতের কোন স্রষ্টা নাই।*
নাস্তিয়া উত্তর দেয় ,"এয়ারপোর্টটা খুবই সুন্দর, আর সেখান থেকে আসতে ট্যাক্সি রাইডটা ছিল অদ্ভুত মসৃন, রাস্তার কোথাও একটা ঝাঁকুনিও লাগেনি, মনেই হয়নি গাড়িতে বসে আছি। এখানে সবকিছু এত পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন। আর দু' পাশে পাল্ম-ট্রিগুলো এত সুন্দর যে চোখ জুড়িয়ে যায়। পাম-ট্রি আমাদের নেই, তাই আমরা এমনিতেই এই গাছগুলোর প্রতি দুর্বল। আর ওই গাঢ় লাল ফুলের ঝোপগুলো, কি যেন নাম ? বোগেনভিলিয়া, অদ্ভুত!"
"আসলেই এটা খুব সুন্দর দেশ, রাশিয়ার সাথে বিরাট কনট্রাস্ট, এমনকি আমাদের দেশের সাথেও।"
"তোমার দেশ তো বাংলাদেশ, এখান থেকে বেশি দূরে নয়, তোমাদের দেশও কি এমন সুন্দর?"
"হ্যাঁ, ভিষণ সুন্দর, তবে ঠিক এমনটা নয়, সম্পূর্ণ অন্যরকম। আমাদের সৌন্দর্য গ্রামে, যেখানে কত কত নদী, জল, বিল, হাওর, সবুজ আর সবুজ। আমাদের দেশে মাঠ আর মাঠ, ধান-ক্ষেত আদি অন্তহীন , আকাশ নেমে আসে মাঠে। নদীগুলো একে বেঁকে যায়। আর তাতে বড় বড় পাল তোলা নাও। শুধু রং আর রং, রংয়ের খেলা। বাতাসে পালগুলো ফুলে ফুলে ঢাউস হয়ে থাকে। সামনে পিছনে নদী, কোথায় শুরু কোথায় শেষ, কেউ জানেনা, যেন মাঝখানে যাত্রা শুরু হয়, মাঝখানেই শেষ। মানুষ কখনও যাত্রী, কখনও দর্শক।"
"বাহ্, আমাদের রিজানেও তো তাই, আদি অন্তহীন মাঠ, বাতাস হুহু করে। সেই মাঠের মাঝখানে বয়ে যায় ‘অকা’ নদী, পালের নাও নেই কিন্তু সৌন্দর্যের কমতি নেই। মাঠের উদারতার সাথে জড়াজড়ি করে থাকে সেই নদীর হৃদয়, মন কেমন কেমন করে সেখানে। আমি সব সময় ওখানে ফিরে যেতে চাই। আমাদের ওখানে কনস্তান্তিনোভা গ্রামে জন্মেছেন সের্গেই ইয়েসিনিন। ওই মাঠ থেকেই তিনি পেয়েছেন মানুষকে ভালোবাসার হৃদয় আর চোখ। "
"তুমি বুঝি সের্গেই ইয়েসিননকে খুব পছন্দ করো?"
"হ্যাঁ, করি। তুমি তার সম্পর্কে জানো?
“যদি দেবদূত এসে বলে, যা যারে যা তুই স্বর্গে থাক গিয়ে
আমি বলবো, প্রয়োজন নেই, দাও মাতৃভূমি ফিরিয়ে।”
এই কবি তো?
"আশ্চর্য, তুমি একজন ইঞ্জিনিয়ার হতে এসেছো অথচ একেবারে কবির মন”
“আমি ইয়েসিনিনের সামান্য কিছু কবিতা পড়েছি। আমি যদিও কবিতা বুঝিনা কিন্তু আমার মনে হয়েছে অদ্ভুত সুন্দর দেশ-প্রেমে ভরা তার কবিতা। আমাদেরও একজন কবি ছিলেন ইয়েসিনিনের মতই, জীবনানন্দ দাশ, আমাদের দেশ ও প্রকৃতির প্রতি ছিল শর্তহীন নীরব ও নিবিড় ভালোবাসা তার। ইয়েসিনিন ছিলেন হৈ-হুল্লোড়, জীবন, ফুর্তি, মারামারি, নারী আর স্ক্যান্ডালে পরিপূর্ণ এক অদ্ভুত মানুষ। তোমাদের মাটির, মাঠের, লতা-গুল্মের, বৃক্ষের এবং মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস যেন শুনতে পেতেন তিনি। সুক্ষ্ণ তার বোধ ও ভাষার কারুকাজ।”
নাস্তিয়া কণ্ঠ মিলায়ঃ
“তার চোখে অশ্রু-বিন্দুর মত টল টল করেছিল যন্ত্রনা ও স্বপ্নের দ্রুতির ট্রেনে চড়ে-বসা বিগত শতাব্দীর রুশ।সেটা যে ছিল নিষ্ক্রান্তির ট্রেন তিনি তা বুঝতে পেরেছিলেন খুব তীব্রভাবে। বুঝতে পেরেছিলেন যে নতুন রাশিয়ায় তার স্থান নেই। তাই সম্ভবত তিনি স্বাচ্ছায় চলে গিয়েছিলেন সব স্বপ্ন ভঙ্গ হবার আগেই।
“আমাদের জীবনানন্দ দাশ ছিলেন ভীষন চুপ চাপ বৌদ্ধ সন্তের মত, খুব সাবধানে, পা টিপে টিপে মাটিতে হেঁটেছেন,এমনভাবে যেন মাটি ব্যথা না পায়, টের না পায় যে একজন মানুষ হাঁটছে তার বুকের উপর দিয়ে। এই নীরব হাঁটতে হাঁটতেই একদিন তিনি ট্রামের নীচে পড়ে মারা যান। কেউ কেউ বলে খুব বেশি নীরবতার দু:খ এত দু: সহ হয়ে পড়েছিল তার, যে তিনি স্বচ্ছায় ট্রামের নীচে মাথা দিয়ে নির্বান খুঁজেছেন।”
নাস্তিয়া বিস্মিত হয় অভ্রের ইয়েসিনিন-পরিচিতিতে। অনেক গভীরভাবে না পড়লে ইয়েসিনিনকে এত অল্প কথায় এমন ভাবে প্রকাশ করা অসম্ভব। সে বুঝতে পারে অভ্রের বোধশক্তি তীক্ষ্ণ।
এবং রিজান থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে, রাতে না ঘুমিয়ে এই স্বল্প পরিচিত মানুষটির সাথে ইয়েসিনিনকে নিয়ে কথা বলতে বলতে ওর মনে হয়, অভ্র খুব কাছের একজন মানুষ, ইয়েসিনিনের মতই।
সে বেশ স্বাভাবিক বোধ করে, ওর ভেতরে সন্দেহ ও অস্বস্থির ভাবটা কমে যায়। অভ্র তার কথা শুধু রাখেইনি বরং এই মুহূর্তে সে এমন কিছু প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছে যে তাকে বিশ্বাস করা যায় ।
এবার সে নিদ্রাবোধ করে। বলে,"ঘুম পেয়েছে কাল কথা বলবো।"
শুভ রাত্রি বলে ঘুমিয়ে পড়ে ।
*হাজার বছরের প্রেমের কবিতা
পেরেস্ত্রইকা, মস্কো ও মধু শাহাব আহমেদ
৫ম পর্ব
অভ্রও শুয়ে পড়ে। ঘুম আসেনা। বাবার কথা মনে পড়ে। সে জানে সে বাবার কথা রাখেনি । বরং পরিণত হয়েছে এক বিবেকহীন প্রাণিতে। বাবা তাকে সে শিক্ষা দেয়নি। সাড়া জীবন একজন সত্যিকারের মানুষের দৃষ্টান্ত হয়ে বেঁচেছে নিজে। জীবন মোহের পরীক্ষায় পাশ করে গেছে খুব উঁচু-মার্ক নিয়ে। কিন্তু তারই ছেলে করেছে রদ্দি মার্কা ফেল। এবং এমন নয় যে, তার সেই ফেল করাটা ছিল অচৈতন্য-প্রসুত। সবটাই সে করেছে সচেতনভাবে। কেন ? উত্তরটি সে আজও জানেনা।
বাবা একমাস ছিল মস্কোর বড় এক পার্টির হোটেলে। যেখানে বিভিন্ন দেশের কম্যুনিস্ট ও বামপন্থী নেতারা রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় থাকে। বলা চলে, দেশ থেকে পার্টিই তাকে জোর করে পাঠিয়েছিল।
কারণ বেশ কিছুদিন ধরেই তার ভীষণ দুর্বল লাগছিল। কুচকির দুই দিকে গ্ল্যান্ডগুলো বড় বড় গোল আলুর মত ফুলে উঠেছিল। দুই বগলে, ঘাড়ের দুই পাশে ছিল সেই একই অবস্থা। ডাক্তারেরা বলেছিল নন-হজকিন্স লিম্ফোমা, এডভান্সড স্টেজ। কোন চিকিৎসা করার সময় আর নেই, কাজ-কর্ম গুছিয়ে ফেলা ভালো। বাবা কাঁদেনি কিন্তু অভ্র কেঁদেছে। খুব ভালোবাসতো সে বাবাকে।
দেশে ফিরে যাবার ক'দিনের মধ্যেই বাবা চলে যায় না ফেরার দেশে। বাবা সারাজীবন মস্কোপন্থী ন্যাপের রাজনীতি করে গেছে। ছিল কমিউনিষ্ট পার্টিরও গোপন সদস্য। আইন ব্যবসায় ভালো পশার ছিল, গরীব মানুষের সেবা করেছে নি:স্বার্থভাবে। ডাকসাইটে ছাত্র নেতা ছিল ভাষা আন্দোলনের সময়ে ।
বাড়ি গমগম করতো, কত লোক আসতো, কতলোক যেতো। জেল খেটেছে কয়েকবার, তবে দীর্ঘ মেয়াদি নয়, আত্মগোপনেও থাকতে হয়েছে দীর্ঘদিন। সারাটা জীবনই মানুষের জন্য ব্যয় করেছে। যেদিন রোগ ধরা পড়ে, সেদিনও সমাজতন্ত্র ও পেরেস্ত্রইকা নিয়ে ব্যস্ত ছিল।
বলেছে, “বাবা অভ্র পৃথিবীতে কেউ চিরদিন থাকেনা। কথা হল কে কিভাবে বাঁচে। যতদিন প্রাণ আছে বাঁচা উচিত মানুষের জন্য, মানুষকে কষ্ট না দিয়ে। আমি খুব ভাগ্যবান, একটা ভালোজীবন কাটিয়েছি। তোমার দাদু দীর্ঘদিন বেঁচেছে, তোমার মনে আছে। দৃষ্টি হারিয়ে ফেলেছিল, চলতে গেলে পড়ে যেত। সারাদিন উঠোনে গাছের ছায়ায় বসে থাকতো, আর অপেক্ষা করতো আমি কখন বাড়ি ফিরবো অফিসের কাজ, পার্টির কাজ শেষ করে। কোন কোনদিন তার অপেক্ষার শেষ হতোনা, ঘুমিয়ে যেত।
পিতা মাতার প্রাণ সব সময়ই সন্তানের জন্য আই ঢাই করে, তা সন্তান যত বড়ই হোক। তোমাদের জন্য আমাদেরও ঠিক তাই। আমি তোমার দাদুর মত বৃদ্ধ হবার আগেই চলে যাবো, তোমার জন্য কোন বোঝা হবোনা । এটা একদিকে ভালোই। তবে তোমার মা’র তোমাকে খুব প্রয়োজন হবে এটা মনে রেখো। আর মানুষকে কষ্ট দিওনা।”
হাসপাতাল থেকে বের হবার দিন বাবা বলেছিল, “আমাকে একটু লেনিনের ম্যুসোলিয়মে নিয়ে যেও, শেষ বারের মত তাকে দেখে যাই।” অভ্র বলেছিল, “বাবা খুব বড় লাইন, তুমি বরং পার্টির মাধ্যমে বিনা লাইনে যাও।”
সে বলেছিল,”না রে বাবা, আমি তো সব সময়ে পার্টির ডেলিগেটদের সাথে লাইন ছাড়াই গিয়েছি। এবার আমি সোভিয়েত জনগনের সাথে লাইনে দাঁড়িয়ে যাবো। এই দেশটা যে কোনদিকে যাচ্ছে কেউ জানেনা। এই যে মানুষগুলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে তাঁকে দেখতে যায়, আমি নিজের চোখে দেখতে চাই তাদের চোখে মুখে কি অভিব্যক্তি থাকে। তারা কি সত্যই তাঁকে ভালোবেসে দেখতে যায়? না যায়, মানুষ যেমন যায় চিড়িয়াখানায় ? তুমি আমার সাথে থেকে তাদের কথা শুনে আমাকে অনুবাদ করে শোনাবে। আমি সত্যিই বুঝতে চাই এই দেশের মানুষের হৃৎস্পন্দনটা কি? তারা কি আসলেই এই সমাজটাকে ধরে রাখবে না ছুঁড়ে ফেলে দেবে?”
অভ্র বলেছিল, “বাবা তুমি এত দুর্বল, তুমি কি করে এত দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকবে?”
বাবা বলেছিল, “ভাষা আন্দোলনের সময় আমি সেই একই মিছিলে ছিলাম যেখানে সালাম বরকত মারা গােছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় কত সহযোদ্ধা মারা গেছে, আমি তো ওদের তুলনায় অনেক দীর্ঘ জীবন পেয়েছি রে বাবা। আমি এও পার হতে পারবো।”
সেদিন তারা ২ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে লেনিনকে দেখেছে। অভ্র আশেপাশের লোকজনের কথা বাবাকে অনুবাদ করে শুনিয়েছে। বাবা শুনেছে মনোযোগ দিয়ে, শুনে বিস্মিত হয়েছে। তারপরে লেনিনকে দেখে রুমাল দিয়ে চোখ মুছে আপন মনে বিড় বিড় করেছে : “থাকবেনা, না থাকবেনা"
অভ্রের ছোট কালের কথা মনে পড়ে। কতই বা বয়েস, ১০ বা ১১। ওদের পাড়ায় কিছু মাস্তান ছিল। ওদের সাহস ও ড্যাম-কেয়ার ভাব দেখে অভ্রের খুব ভালো লাগতো। ওরা বিভিণ্ণজনের বাড়িতে গিয়ে আম- পেয়ারা- ডাব চুরি করতো। সে ওই দলে মিশে পাহারাদারের কাজ করতো। বাবার কানে কথাটা পৌঁছায় ।
একদিন বিকেলে বাবা ওকে নিয়ে হাঁটতে বের হয়।
ওদের বাড়ির অদূরে যে ছোট্ট নদীটি বয়, সেই নদীর তীরে হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছিল একটি বস্তির কাছে। একজন মা কিছু রান্না করছিল মাটিতে দুই পায়ের উপরে বসে। তার কোলে ছোট একটি বাচ্চা। চুলার চারদিকে আরও তিনটি ছোট ছোট বাচ্চা অপলক নয়নে তাকিয়ে আছে হাড়ির দিকে। ওদের চোখে মুখে ক্ষুধা আর অপেক্ষার অধীরতাঃ কতক্ষণে রান্না শেষ হবে, যেন অনন্তকাল ধরে চলেছে এই প্রতীক্ষা। দুজন সম্পূর্ন ন্যাংটা, একজনের গায়ে ছেড়া হাফ প্যান্ট, যা তার চেয়েও বড়। মা যে কালো টায়ারটি পুড়ে পুড়ে রান্না করছে ওদের সেই টায়ারের মতই রৌদ্র পোড়া দেহ।
বাবা বলেছিল, “তুমিও ওদের মত একজন হতে পারতে। তুমি যদি মাস্তান হতে চাও তাহলে সেরা মাস্তান হও, তবে আমার বাড়িতে থাকতে পারবেনা। মুচি হলে ভালো মুচি হও এবং কাজটা সিনসিয়ার ভাবে করো। কৃষক হলে ভালো কৃষক । লেখাপড়া করতে চাইলে তোমাকে লেখাপড়ায় সেরা হতে হবে। আধা-খেচরা কিছু হয়ে লাভ নেই। এই পৃথিবীতে আধা- খেচরা মানুষ অনেক, আর দরকার নেই। এই বাচ্চাগুলোর কোন অপরাধ নেই। ওরা ওই মায়ের পেটে না জন্মে যদি তোমার মায়ের পেটে জন্মাতো তাহলে ওরা ক্ষুধার্ত থাকতোনা। এটা সম্পূর্ন তোমার উপরেই নির্ভর করবে তুমি এই পৃথিবীতে কিভাবে বাঁচবে। মনে রেখো অমানুষ হয়েও বাঁচা যায়, কিন্তু সে জীবন বড় নীচ জীবন।”
বাবার কথাগুলো মনে পড়ে, চোখ ভিজে আসে নিজের অজান্তেই। ও যেন স্পষ্ট শুনতে পায় মাথার কাছে দেয়ালটি ফিস ফিস করছে অবিকল বাবার কণ্ঠে, যে কথাগুলো সে শুনেছে আরো ছোট বয়সে :
"তোমার দাদু তেজপাতা গাছের নিচে চেয়ারে বসে থাকে, আর তুমি কি কর ? দৌড়ে পেয়ারা বা আম গাছে চড়ে বসো। আমি, তোমার মামা,তোমার কাকা, সবাই কাজে দৌড়াই। তুমিও একদিন তোমার দাদুর সেই চেয়ারে বসবে । তোমার নাতি নাতনিরা দৌড়াদৌড়ি করবে আর তুমি বসে বসে তোমার সারা জীবনের কথা মনে করবে।
জীবনে যত বেশি ভাল কাজ করবে তত ভালো বোধ করবে, যত বেশি খারাপ কাজ করবে তত বেশি খারাপ লাগবে। তুমি জানোনা স্বর্গ নরক আছে কিনা। হয়তো স্বর্গ নরক এই। ভালো কাজ করে থাকলে মৃত্যুকে সহজে আলিঙ্গন করতে পারবে, কষ্ট পাবে কম।”
চলবে
0 মন্তব্যসমূহ