ললিতা চট্টোপাধ্যায়'এর স্মৃতি কথা : ঈশ্বরীতলার রূপোকথা ও টাইম মেশিন


বাড়িতে বাজার আসার মিনিট কুড়ির মধ্যেই আমার মায়ের প্রথম পদ রাঁধা হয়ে যেত। সেটা কালো লোহার কড়াইতে রাঁধা মাছের ঝোল বা লাউশাকের ঝোল ঝোল তরকারি,যাই হোক। থালায় গরম ভাতের ওপর ধোঁয়া ওঠা গরম একটা পদ মা বেড়ে দিতেন। 

পঁয়ষট্টি থেকে বাহাত্তর সাল। একটা জীবন থেকে অন্য একটা জীবনে ঢুকে যাওয়া ক্রমশ। দুটো জীবন একদম আলাদা। পেছনে সব পড়ে থাকে। সব। বাবা মা ভাই বোন। ঘড়িঘরের বাড়িতে ঠাকুমার গোটা সংসার। সেখানেই গরম একটা বারান্দায় লেখা,লেখার চেষ্টা। নিজের ফ্যামিলি তখন আনকোরা। সুন্দরী স্ত্রী। কিন্ত বায়না বা দাবী নেই। চুপচাপ। চার বছর আর আড়াই মাসের দুই মেয়ে। যৌথজীবন থেকে একটু একটু সরে যাওয়ার চেষ্টা। বেশিদূর নয়। কলকাতা থেকে ট্রেনে করে মিনিট চল্লিশ। ক্যানিং লাইন। 

শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় ও স্ত্রী ইতি গঙ্গোপাধ্যায়
১৯৮০। সদ্য নাতি হয়েছে। শ্যামল গোঁফ রেখেছেন।

জমি কিনেছিলেন। সেই গল্পে পরে আসছি। প্রথম এসে উঠলেন এক বাঙালি খ্রীষ্টান ভদ্রলোকের বাড়ি। সংসার পাতা হল। তারপর একজন খুন হওয়া মানুষের বাড়ি। এদিকে আমাদের বাড়ি তৈরি হচ্ছিল। বাবাও ট্রেনে করে কলকাতায় এসে শিফট ডিউটি করে ফেরত যেতেন আমাদের কাছে। খালপাড় ধরে জমির পর জমি কেনা তখন বাবার নেশা। জমি কেনা বেচা, বিষয়, টাকা, নতুন বাড়ি- নিরাপদ নিশ্চিন্ত জীবন কোথায়? এত রাজসূয় যজ্ঞ। সেই সময়ে লেখা বাবার একটা গল্প “খরার পরে"। 

তখন থেকেই ধোঁয়া ওঠা রান্নার নতুন উপকরণ জমে উঠছিল। 

একটা খোঁজ পেলেই জমি দেখা। জমির সঙ্গে নতুন নতুন মানুষের খোঁজ পাওয়া। দাগ,খতিয়ান,পর্চা, নাবাল,খাস-নতুন নতুন শব্দ। সেইসব নতুন মানুষের মধ্যে গিয়ে পড়লেন যাদের জগতটুকু তাদের চোখে দেখা সীমানার মধ্যেই। তার বাইরে মানে অনেক দূর। আমাদের জমিটা ছিল - রেল লাইনের লেভেল ক্রসিং পার হয়ে বাজার এলাকা ছাড়িয়ে,পঞ্চাননতলা থেকে আরও একটু গেলে খাল, সেই একদিকে যেটা পিয়ালি খালে মিশেছে। খালপাড়ের বাঁধেই কাঁচা রাস্তা। বড্ড ন্যাড়া। তার বাঁদিকেই নীচু জমি। একঢাল অনেকটা জমি। ইলেকট্রিক নেই কিন্ত। কালভার্ট পার হয়ে ডানদিকে ফিরলে খালের বাঁধে ওঠা। ডান হাতে খাল। বাঁহাতে উঁচু জমিতে প্রথমেই ব্রাহ্মণ এম এল এর বাড়ি। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা লাল মেঝের তিনতলা বাড়ি। রাজনীতিটুকু বাদ দিলে বাড়ির সবাই ভালোমানুষ। 


কেনা জমির প্লটিং শুরু হল।বাবার মনে হল লেখক আর শিল্পী বন্ধুদের নিয়ে একটা গ্রাম হোক । নিদেনপক্ষে একটা পাড়া।অনেকটা এখনকার এল.আই.সি বা ব্যাঙ্ক কর্মীদের সমবায় আবাসনের মতো।সন্তোষকুমার ঘোষ,নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী,মতি নন্দী, প্রকাশ কর্মকার – এই নামগুলো মনে আছে।আরও কেউ কেউ থাকতেও পারেন।দু একটা করে


<ছবি. দুই মেয়ে, স্ত্রীসহ শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। ১৯৭৪ কলকাতায়, ৫০/১প্রতাপাদিত্য রোড। তখনও ঈশ্বরীতলার রূপোকথা লেখা শুরু হয়নি।

ভিত মাঠের মধ্যে কিছুটা করে তৈরি হয়ে পড়ে থাকত। সন্তোষজেঠুর ভিতটাও তাই। শুধু সঙ্গে একটা বিশাল উঁচু গেটের খাঁচা। বেয়াই নির্বাচন হয়ে গিয়েছিল যে। সেইজন্য। শেষ বাড়িটা বাবার। দোতলার লিন্টন অবধি ,সঙ্গে তেতলার চিলেকোঠা। সাদা রঙের। ধানক্ষেতের মধ্যে জাহাজ মনে হত।বাড়ির ইঁটে ছাঁচ ছিল দুরকম। LOLLY আর MOLLY। নিজেদের ইঁটখোলার ইঁট। বড় বড় ঘর। লাগোয়া বাথরুম। তাতে চৌবাচ্চা। লাগোয়া কোলাপ্সিবল গেট দেওয়া বারান্দা। মাঝে বড় হল। আমরা বলতাম লবি। বারান্দায় পড়তে বসতাম হারিকেনের আলোয়। এই বাড়ির পিছনদিকে পুরো প্রস্থ জুড়ে চওড়া কালো বারান্দা, ঠাকুমার তরকারি কাটার জন্য। ঠাকুমা গৃহপ্রবেশের আগেই মারা যান। স্ট্রোকে। বাবার প্রথম স্বপ্নভঙ্গ। বাবারা পাঁচ ভাই। বাড়ির ভিত চারতলার। যাতে অনায়াসে পাঁচতলা হয়। কালো বারান্দা থেকে থাক থাক সিঁড়ি নেমে গেছে, যেদিকে পুকুর। ওটা কি গ্রুপ ফটো তোলার সিঁড়ি ছিল? ছিলও কয়েকটা ফটো। 

এই বাড়িতে শুধু আমার বড়জেঠু কিছুদিন ছিলেন। বড়মা দাদা বৌদিকে নিয়ে। অন্য ভাইরা আসতেন। সারাদিন থেকে কলকাতায় ফিরে যেতেন। 

বাড়ির কথা বললাম কেন? বাবার বাড়িবদল তো অভ্যাস ছিল। এই বাড়ির ইঁটে আছে ললি মলি। ইতি শ্যামলের সংসার শুরু এই বাড়িতে। সঙ্গে একটা স্বপ্ন নিয়ে। যৌথপরিবারের স্বপ্ন। বাবার ইচ্ছে ছিল-সব ভাইয়ের এক এক তলায় সংসার। দুটো গাড়ি থাকবে। একটা সব মেয়েদের নিয়ে স্কুলে যাবে। অন্যটা ভাইদের অফিসের জন্য। স্বপ্ন মিলল না। তাতে কি? এই বাড়িটাই হয়ে উঠল ভূমিহীন চাষিদের দাঠাকুরের বাড়ি। বাড়ির চারদিকে এবড়ো খেবড়ো মাঠ হয়ে গেল ঢেউ খেলানো ধানের ক্ষেত। দূরের ঝাপসা করা বৃষ্টি বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে আসে। খালি চোখে পরিষ্কার দেখা যায়। এটা ঈশ্বরীতলার অনাথ শান্তার সেই বাড়ি, যেখানে বলাই, বাঘা, টুকু, লিলির সব খেলাধুলো। লম্বা রান্নাঘরের মেঝেতে ইতি বা শান্তা সবাইকে খেতে দিত। ইলেকট্রিক এলে তৈরি হল ছয় ফুট বাই ছয় ফুট একটা খাওয়ার টেবিল। তখন লবিতে টেবিলে বসে খাওয়া। এটাতে বাবার লেখার কাজও চলত। আমাদের শোওয়ার ঘরেও ঢুকে গেল টেবিলটা। এটায় বাবা ললিবাবুকে বসিয়ে প্রথম ক্লাস সেভেনের নৃপেন আসফাকুলদের গল্প বলেছিলেন। তখন আমি বড়ই ছোট। 

ছবি. বাবা শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে ছোটো মেয়ে ললিতা চট্টোপাধ্যায়

কলকাতার সবাই আমাদের বাড়িতে এসে আনন্দ করে ফিরে যেত। সন্ধ্যার পর কলকাতা তাদের ডেকে নিত। মন টিকত না। রাত হলে অনাথ ওই সাদা বাড়িতে তার দুই মেয়ে বউ বাঘা বলাই সবাইকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। বাইরে গোয়ালে উমা। হাঁসমুরগীর ঘরের জালের দরজা তালাবন্ধ। পুকুরে চাঁদের আলো ফ্রেমে আঁটা। ফ্রেমের বাইরে ক্ষেতের ওপর বাকি জ্যোৎস্না পড়ে আছে। এই বাড়িটাই পরে আবার “নৃপেনদের বাড়ি”। 

আস্তে আস্তে এই বাড়ির সামনের রোয়াক বাঁধানো বারান্দায় জড়ো হোতো স্থানীয় ভূমিহীন ফুরণে খাটা কিছু মানুষ। এরা জানে শুধু চাষ করতে। কিন্ত পেশা অনেক। কী নেই তার মধ্যে – মাছ চুরি ,ধান কাটা, ভাগে চাষ করা, গোয়াল খাটা, মাছ পাহারায় রাত জাগা, ভাড়ায় গাদা বন্দুক ধরে ডাকাতি করা, সার্কাসে ভাড়া খাটা, আরশোলা দিয়ে ব্যাঙ ধরে বিক্রি করা – এমনকি ধানকাটার পর ইঁদুরের গর্ত থেকে ধান যোগাড়। সব কি বলা যায়? অনেক কিছুই রয়ে যায়। 

এইভাবেই আবার একটা যৌথ পরিবার তৈরি হচ্ছিল। অন্য পরিসরে। অভাবের সঙ্গেই এর মেম্বারদের বসবাস, দিনরাত। তাতে তারা অবাক হয় না। অভাবের গল্পও করে না। রোজকার নিরুপায়তা থেকে একটা রাস্তা খুঁজে নেয় সারভাইভালের। সেই রাস্তা খোঁজার জার্নিটাই আমাদের অবাক করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। এরাই সাত বছর ধরে আমাদের আপনজন ছিল। বাবা মা দিদি আমি আমাদের। কালো খোদাইকরা লক্ষ্মণ মিস্ত্রি, তার বাবা শরৎ মিস্ত্রি। দুই ভাই পঞ্চানন আর ভগীরথ মিস্ত্রি, হাজরা নস্কর, গণেশ। এদের সমস্যা, তার সমাধান বড় সরল। অভিমান রাগ ঝগড়া- ফলিডল বা রানিং ট্রেন এক্কেবারে সব সমাধান করে দিত। প্রথম বউ ফলিডল খেলে কদিনের মধ্যেই রোলেক্সের বেনারসী দাঁতে কেটে দ্বিতীয় বউ আসরে। বাবাকে দেখেছি, জোয়ান ছেলের ফুলে যাওয়া বডি ছাড়াতে ঘড়ি বন্ধক দিয়ে তার বাবাকে টাকা দিতে। ততদিনে বাবার চাষের নেশা ভরপুর। 

চাষের সময় কেউ তো জমি দেবে না। তাহলে একলপ্তে অনেকটা জমি কোথায় পাওয়া যাবে ? তাহলে অসময়ে চাষের চেষ্টা করা যাক। তখন কয়েকমাস জমি খালি পড়ে থাকে। তাই পাওয়া গেল। কয়েকশ বিঘা জমি। হিসেব নিকেশ হল। বীজধান, মজুরি, জলের ব্যবস্থা-এলাহি আয়োজন। বাড়ির দলিল রেখে ব্যাঙ্কের ঋণ। বাবা তাঁর সমস্ত জেদ নিয়ে আর নতুন অভিজ্ঞতার খোঁজ পেতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। জড়িয়ে গেলেন। আরও আরও জড়ালেন। আমরা পৃথিবীর বাইরে একটা অন্য পৃথিবীতে বড় হচ্ছিলাম। কাদা জল মাটি ধান গরু কুকুর হাঁসমুরগী, বাউন্ডারিহীন আকাশের নীচে অনন্ত দৌড় – এইসব নিয়ে। বাতাসে তখন আনন্দ ভাসত। কিন্ত ‘অসময়’ শব্দটা অদ্ভুত। যতই পরিকল্পনা হোক, মাটি থেকে জল ওঠে না। টিউবওয়েলে বালি ওঠে। আরও ঋণ নেওয়া হল। জলের ব্যবস্থাও হল। এবার মাজরা পোকা। দুধ জমা ধান চোখের সামনেই চিটে। ওষুধ স্প্রে করে কিছু ধান বাঁচল। সবাই দেখে মাঠ ভর্তি ধান। ধান চাষ ফেলে যাওয়ার উপায় নেই। ধান কাটার আগে তুমুল বৃষ্টি। মাঠে জল।“অসময়” টের পাইয়ে দিল। 

একবার কলেজের দুই বন্ধুর জোরাজুরিতে ওদের নিয়ে গিয়েছিলাম। স্টেশনে নেমে রিকশাওয়ালাকে বোঝাতে গেলাম ঠিক কোথায় যাবো। প্রশ্ন উড়ে এলো,শ্যামল বাঙালের বাড়ি থেকে কতদূর যাব। এক বন্ধু জানালেন, আমি শ্যামলের মেয়ে। এবার শুনতে হল – তাই হয় নাকি! ছোড়দা বড়দা দুজনই ছোট ছিল যে। 

দুপুরের পর খাল ধরে আমরা তিন বন্ধু হাঁটতে থাকলে একসময় একটা তেমাথা জলের ধারে পৌঁছে গেলাম যেখানে সামনে কমলা সূর্য, ডানদিকে বাবলা গাছের ঝাড় নিয়ে চেনা খাল। বাঁদিকে একটা নড়েবড়ে পাতা ছাওয়া ঘর।ঘর থেকে বেরিয়ে এল সন্তোষ টাকি।ততদিনে ‘দখল’ আমার পড়া।এই সেই ঘরটা যার মধ্যে দাক্ষী থাকলেও থাকতে পারে। এই মহামানব আমরা চলে আসার পর ছাদের দরজা ভেঙ্গে অনেক কিছুই না বলে গ্রহণ করেছেন। তিনি জানতেই পারেননি আমার বাবা কোথায় তাঁকে বিভিন্ন গল্প উপন্যাসে ঢুকিয়ে দিয়েছেন তার কীর্তিকলাপসহ,তাও আবার চিরদিনের জন্য। 

কেউ যদি ভেবে বসেন এটা ওই সাত বছরের দিনলিপি,তাঁর কিন্ত ভুল হবে। চম্পাহাটির ওই সাতবছর একটা জমি বা বেস যেখানে একই সময় আমরা কাটিয়েছি।জীবনকে বাবা তখন একটা পরীক্ষার দলাইমলাইতে ফেলে দিয়েছেন। ইচ্ছেমত জড়াতে দিয়েছেন। তার রস নিয়েছেন। নতুন লেখা উঠে এসেছে তার মধ্যে দিয়ে।আর আমাদের পাওনা হয়েছে একটা নিরাভরণ শৈশব। আমাদের প্রতিটা দিন কাটত প্রকৃতির অ্যামিউসমেন্ট পার্কে। যে নিম্নবর্গের কথা গণসঙ্গীতে অনেক পরে পেয়েছি,তাদের মাঝে বেড়ে উঠেছি আমি,দিদি। আমরা ওদের ছোড়দা আর বড়দা। বাবা----দাঠাউর, মা – মাঠাইরেন। 

কোন ক্লাস হবে তখন – কেজি টু। পুকুর কাটা দেখে ফেলেছি। চুণ দিয়ে তার জলশোধন দেখলাম। কতটুকু কচুরিপানা মাছকে ছায়া দিতে যথেষ্ঠ, জানি।পুকুর ছেঁচায় কোন কোন মাছ সবার শেষে কাদা ছেনে ওঠে – শিখলাম।গরুর রচনা সারাজীবনের মত শিখলাম। তার খাওয়া, তার আদর খাওয়া ,পাল খাওয়ানো,দুধ দেওয়া।কখন দুধ বাড়ে কমে,কিসে বাড়ে।কোন বাছুর কাজে লাগে। আদরের উমা আমাদের কত কি জানতে দিয়েছে শুধু আমাদের কাছে থেকে।এমনকি গরুর বাচ্চা হওয়াও দেখলাম। শেষ রাতে। শীতকালে। বাড়ির সামনের ক্ষেতে ধান কাটার পর। সবাই যেখানে ঘাসের লন বোনে,বাবা ধান রুইলেন।সেইখানে।শরৎ মিস্ত্রি,পঞ্চানন মিস্ত্রি,হাজরা নস্কর রাত জাগছে।কাঠের আগুন জ্বলছে উমাকে আরাম দিতে।বাবাও জেগে।মাও।আমাদের দুই বোনকে কেউ বলেনি ঘুমিয়ে পড়তে – তাই আমরাও জেগে।উমার জন্য জ্বালা আগুনে সবাই আরাম পাচ্ছে।একটা লম্বা কেউটে বাড়ির পেছন থেকে সরসর করে সামনে চলে এল।একজন চাষি তার ল্যাজ ধরে বনবন করে মাথার ওপর ঘুরিয়ে এক আছাড়।কী উল্লাস।কী আবদার – বাবু এটা আমরা নেব কিন্ত। খেয়ে সুখ।জানলাম, এও খাদ্য। কেউ আমাকে বলত না - পড়তে বস।দিদিকে বলত।পড়ার বই, গল্পের বই নাগালেই থাকত।হাতে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিজের। আমাদের সব আনন্দের সঙ্গী ছিল বাঘা।সব লুটোপুটি সব দৌড়। 

এবার একটু অন্য কথা বলি।বলা ভাল অন্য দিক থেকে কথা বলি। হঠাৎ কেন ঈশ্বরীতলা ? বিষয় আশয়? চাষ ?অনেক টাকা আয় করা ?কেন ?কিভাবে?সেই সময়টাও বাবার লেখা একটা গদ্য থেকে নিলাম। বাবার এক একটা লেখা আমার কাছে টাইম মেশিন। আমি তার মধ্যে দিয়ে একেকটা সময়ে আমার বাবার কাছে পৌঁছে যাই।তাঁকে চলাফেরা করতে দেখি।কথা বলতে দেখি। 

ছবি. ঈশ্বরীতলায়
দুই মেয়েসহ শ্যামল

বাবা মা’র বিয়ে ১৯৬০সালে।৬১সালে দিদির জন্ম। ওই সময়ে প্রথম বই প্রকাশিত হয় ‘বৃহন্নলা'।এখন এটি নাম পাল্টে ‘অর্জুনের অজ্ঞাতবাস‘।টালিগঞ্জে ঘড়িঘরের ভাড়াবাড়িতে ঠাকুমার সংসার। তিন ছেলে বিবাহিত। তাদের সন্তান হয়েছে।প্রবল স্থানাভাব।রাস্তার দিকে বারান্দায় গরমে বসে লেখা।লেখার চেষ্টা।প্রথম সন্তান হওয়ার পর থেকেই ছুটির দিন বাবা মাকে নিয়ে জমি দেখতে বেরোতেন।একটু হাত পা ছড়িয়ে থাকা।লেখার সুযোগ।এইভাবেই কলকাতার বালিগঞ্জ স্টেশন থেকে ট্রেনে চেপে আধঘন্টা দূরত্বে যাওয়া। 

বাবার কথায় -দাদুর ছিল জমি জায়গা -বরিশালে বঙ্গোপসাগরের তীরে।পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া।চাষবাসের অভিজ্ঞতা ছিল না পরিবারের কারোরই। বাবার বাবা মানে দাদু বছরে একবার আদায়ে যেতেন। ফিরতেন সম্বৎসরের চাল ডাল আনাজ, অনেক জিয়োনো মাছ,কচ্ছপ,ডিম এইসব নিয়ে। 

এই লেখাতেই নিজের এক বন্ধুর কথা বলছেন যিনি তাঁর বাবার মৃত্যুর পর হাতে পান কোম্পানির কাগজ। হালদারপাড়ার বাড়ি। জানবাজারে মৃত বাবার রক্ষিতা,চামেলি বিবি।তিনি তাদের ‘মাগীমা’। বাড়ির সব অনুষ্ঠানে সসম্মানে নিমন্ত্রিত হতেন।নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে আসতেন।বটুয়া থেকে একটা করে সোনার আঙটি উপহার দিতেন। বন্ধুর বাবা নিজের এবং নিজের বিষয় আশয়ের মরণোত্তর সম্মান রক্ষার জন্য মোট কটি আঙটি চামেলি বিবিকে দিয়ে গিয়েছিলেন? 

বাবাকে জমি দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন ব্রজফকিরের তৃতীয় এবং তৎকালীন স্ত্রী বা সঙ্গিনী । বিখ্যাত বাঙালি অভিনেতার ভাগ্নি তিনি।তাঁর চারটে বৈশিষ্ট্য তাঁকে রহস্যময় করে তোলে – পায়ে খড়ম,গলায় পাথরের মালা,একটা চোখে ব্যাথা পেয়ে ফুলে ওঠা নীল শিরা,চোখে সুরমা।তিনি যখন খালের বাঁধের ওপর থেকে হাত তুলে দূরে তাকিয়ে জমি দেখাচ্ছেন, বাবার কথায় – জমি কিনলে কি এই রহস্যময় নারীকে চিরকালের মত ফাউ পাওয়া যাবে ? এই চিরকাল কতটুকু? পাশে দাঁড়ানো নিজের স্ত্রীও কম রহস্যময়ী নন তাঁর হাসির ভঙ্গি,শাড়ির পাড় সমেত। 

জমির দাগ খতিয়ান দেখতে পাচ্ছেন দুরকম। সাবেক আর হাল।সাবেক দাগ নং২৪৭২।সাবেক খতিয়ান ৩৯।হালের দাগ নং২৯৭১।খতিয়ান ৮১।এই সাবেক – কবেকার?১৯৩০সালের।তবে কি “গণদেবতা”য় উল্লিখিত সেটলমেন্ট ? 

জমি দেখা স্থির।টাকা নেই।তৎকালীন অফিসের চিফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট ।বয়স্ক।নিঃসন্তান। জমির জন্য একুশশ টাকা চাইতে গেলেন।তিনি যে ঘরে টেবিল চেয়ারে বসে,সেই ঘরের মেঝেতে একফুট করে টাকার বান্ডিল রাখা।কত চাই ? 

একুশ। 

ওই পঁচিশ হাজার- এর বান্ডিল থেকে চার হাজার রেখে বাকিটা নিয়ে যাও।মাইনে থেকে কাটা যাবে। 

চেয়েছিলেন একুশ শ । পেলেন একুশ হাজার। 


শুরু হল ঢাকুরিয়ায় ক্যাম্প অফিস, কোর্ট দৌড়ঝাঁপ।খতিয়ান আর ম্যাপ কেনা,সার্চিং।রেজেস্ট্রি অফিস। জমি কেনা শুরু হল।হতেই থাকল।নেশা হয়ে গেল।জমি কেনা আর প্লট করে বেচে দেওয়া।খালের পাশে ১৭০০ ফুট ফ্রন্টেজ।পিছনের জমিও হাতে আসতে লাগল।যে সময় মানুষ নিশ্চিন্ত নীড়,চাকরি,সংসার করে তখন বাবার কথায় – মাথার বালিশের ওয়াড়কে ঈশ্বরীতলার ম্যাপ ভেবে ঘুমোতাম। 

জমির দলিলে দেখেন,চটিরাম সর্দারের জমি,পরগণে মেদনমল্ল। মৌজা ঈশ্বরীতলা।জানতে পারেন দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার আগের নাম মেদনমল্ল। বাঙালি সেনাপতির নামে। “কুবেরের বিষয় আশয়”- এ মেদনমল্লর উল্লেখ পাই। 

ছবি. 1979 এটা অ্যামেরিকায়।সঙ্গে এরিক হফার।





নতুন পর্ব শুরু হল।জমির নেশা।পঁয়ষট্টি সালের অক্টোবর মাসে মা, চার বছরের দিদি আর আড়াই মাসের আমি--- আমাদের নিয়ে এসে উঠলেন জীবন হালদারের বাড়ি। মানুষটি বাঙালি খ্রীষ্টান। তাঁর প্রচুর সম্পত্তি। 

কিভাবে করলেন এসব? 

শ্যামলবাবু, খুন করে ধরা দিতে নেই। জায়গা থেকে পালিয়ে যেতে হয়।সিংহীবাবুদের লেঠেল হয়ে সব জমি দখল করেছি।জমি দখল করতে গিয়ে একটা মুন্ডু পড়ে যায়।বডি টুকরো টুকরো করে ধান ক্ষেতে ছড়িয়ে দিই।ভাগ্য খারাপ। শকুনে দুটো টুকরো প্ল্যাটফর্মে ফেলে।পালিয়ে গেলাম নর্থ ওয়েস্টে খান সাহেবের বাড়ি।অনেক ভলান্টিয়ারের মধ্যে মিশে গিয়ে ছ মাস ছিলাম। সিংহীবাবুরা উকিল ঠিক করলেন।তারপর ফিরে এলাম। 

জানা গেল খান সাহেব হলেন আবদুল গফফুর খান,সীমান্ত গান্ধী। 

এই জীবন হালদার একদিন ভোর রাতে ঘুম ভাঙ্গিয়ে বাবাকে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুসংবাদ দিয়েছিলেন। তার মানে ৬৬ সালের জানুয়ারি মাসে বাবা আমাদের নিয়ে ওই বাড়িতে। 

এরপর সুধীরবাবুর বাংলো। সামনে বাগান।পেছনে পুকুর। ছটা ঘরের দোতলা বাড়ি। সুধীরবাবু খুন হন।তার বোন বাংলো ভাড়া দেন।সত্তর টাকা ভাড়া মাসে।ভদ্রলোকের প্রথম স্ত্রী অনেকদিন গত।ছেলেরা বাইরে চাকরি করে।দ্বিতীয়পক্ষের প্রেমে পড়ে গৃহশিক্ষকমশাই খুনটি করে জেলে।বিশ বছরের জন্য। দ্বিতীয়পক্ষ ছাড়া পেয়ে এসে, মোড়ায় বসে, বাবাকে বাড়ি ছেড়ে দিতে বলেন।প্রেমিক ফিরে এলে তিনি বাড়ির সামনের বাগানে বাছাই কলমের ল্যাংড়া আমগাছ লাগাবেন। 

ছবি. ঈশ্বরীতলার বাড়ি তৈরি হচ্ছে,
সামনে ইটভাটা।
 
ততদিনে আমাদের বাড়ি তৈরি প্রায় শেষ।৬৭সাল।বাবা নতুন বাড়িতে উঠে এলেন।জমি বাড়ছে।টাকা আসছে।মিলের ধুতি ,ফিনফিনে আদ্দির পাঞ্জাবি, পকেটে নোটের জলছবি,সিঁথি করে আঁচড়ানো ঢেউ খেলানো চুল।বাবু চেহারাটা ফুটে উঠছে।কেউ ধার নিচ্ছে।কেউ তোষামোদ করছে।অল্পবয়সী অভাবী মেয়ে হাত ধরে ‘রাখিতো’ হতে চাইছে।বাড়ির পেছনে একটা পুকুর কাটতে গিয়ে সাতফুট নীচে হারিকেন হাতে নিয়ে মাটি কাটার হিসেব নিচ্ছেন। দিনের শেষ।বন্ধু প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত সস্ত্রীক (ম্যারিঅ্যান দাশগুপ্ত)এসে হাজির।যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের প্রথম ব্যাচে তাঁর সহপাঠী ।বাবা তখন তুমুল বিষয়ী।আর মাত্র একফুট নীচে সে খুঁজে পাবে একটা নৌকার গলুই।তবে কি মরে যাওয়া বিদ্যাধরী নদীর বুকে আমাদের বাড়ি ছিল? ‘রাখাল কড়াই' গল্প পড়ে তখন একথা মনে হয়নি।এতদিন পর এই গদ্যটি পড়ে চুপ করে বসেছিলাম। মৃত নদীর ওপর আমাদের ছোটবেলা,ওই সাতটা বছর কেটেছে? 

খালের বাঁধটা ছিল মাটির। গর্তবোঝাই।এবড়ো খেবড়ো।বাবার কথায় – শের শাহ জিটি রোড বানানোর পর আর কেউ রাস্তার দিকে মন দেয়নি।পঞ্চানন মিস্ত্রি, হাজরা নস্কর -এদের বুদ্ধিতে এদের দিয়েই খালের মাটি কাটা হল।তাই দিয়ে লাথিয়ে লাথিয়ে লাথগঞ্জের ইঁট তৈরি হল ।হল ইঁটখোলা।আগুন দেওয়া হল।একমাস পর পাঁজা ভেঙ্গে ইঁট বের হল।খালের মাটির বাঁধের ওপর তাই পাতা হল।তারই সুরকি ঢালা হল।সরকারের রাস্তা বানানোর রোডরোলার ডেকে এনে চারবার ঘুরিয়ে দেওয়া হল।তৈরি হয়ে গেল শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের আধমাইল লম্বা নিজস্ব জিটি রোড। পরে লোকমুখে বলত, শ্যামল বাঙালের রাস্তা। 

রাস্তার ধারে লাগানো হল শিরীষ বকুল গুলমোহর শিমুল রেনট্রি। তারা বড়ো হয়ে ছায়া দিতে লাগল। পরে এটাই হয়ে উঠল, “ গতজন্মের রাস্তা “ । 

সারাজীবন কোনও পারিবারিক পেডিগ্রিতে বিশ্বাস করেননি।মিশতেন ডি-ক্লাসড হয়ে।নিজেকে মন্থন করে পাওয়া অভিজ্ঞতার পাশে নিরুপায় মানুষের সারভাইভালের রাস্তা খোঁজা নিয়েই লিখেছেন। এদের সঙ্গে দেখা হওয়াকেই বলেছেন, “ভারতবর্ষের সঙ্গে দেখা হল"। 

এবার একটু এগিয়ে যাই। বাহাত্তর সালে বাড়ি, বিশয়আশয় সব ছেড়ে কলকাতায় ফিরে আসা। নতুন জীবন। আবার লোভ। দৌড়ের লোভ। ‘কালীঘাট ফলতা লাইট রেলওয়েজ'-এর সার্ভিস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। রেলইঞ্জিন কিনতে গেলেন। নিলামে এক কালোয়ার কিনে নিল। কী করে হত – ‘নিজেদের রেললাইন’ নেই যে। 

দ্বিতীয়বার ওড়ার লোভ। টু-সিটার এরোপ্লেন। আকাশে লাইন লাগে না। নিলাম ডেকেও পিছিয়ে এলেন। কিছু গচ্চা গেল। ততদিনে ভীতু হয়ে যাচ্ছেন। 


ছবি. ওই বাড়ি ছেড়ে আসার কয়েকবছর পর আমার কাকার তোলা
১৯৭৫ সালে আমতলা, চম্পাহাটি দুই জায়গায় ধান রোয়া চলছে। চলছে অফিস। সঙ্গে নতুন পর্বের মাসিক কৃত্তিবাসের দায়িত্ব।কিছুদিনের জন্য।সেই সূত্র ধরে নতুন বন্ধুরা এল জীবনে।অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়,কেয়া চক্রবর্তী,অসীম চক্রবর্তী ,কেতকী দত্ত। নাটকের মানুষজন। “অদ্য শেষ রজনী" অর্ধেক লেখা হয়ে ছিল। “বেতার জগতে”র সম্পাদক সুভাষ বসু ফর্ম সই করিয়ে পান্ডুলিপি নিয়ে গেলেন।সরকারি ফাইল কাটার মত লাল কালি দিয়ে কেটে লেখার অনেকটা নষ্ট করে ফেরত দেন। অভিযোগ উপন্যাসে একজন বিতর্কিত অভিনেতার ছায়া আছে। সেই লেখা পরের বছর ‘ অমৃত' পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক কবি মণীন্দ্র রায় সস্নেহে চেয়ে নিয়ে ছাপেন । বই হিসেবে প্রকাশ করেন বিশ্ববাণী প্রকাশনীর ব্রজকিশোর মণ্ডল। বহু অংশ উদ্ধার করা যায়নি। ফিরে লিখতে হয় বাবাকে। যদিও লেখার তাপ থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। 

১৯৭৬ সালে আবার সেই সুভাষ বসু লেখা চান। শারদীয় বেতার জগতের জন্য। এবার ফর্ম ফিল আপ হয় না। বাবা পান্ডুলিপির ওপর শর্ত লিখে দেন, কাটাকুটি চলবে না, প্রয়োজনে ফেরত দিতে পারেন। ফোন আসে গ্রামীণ শব্দ---' পাল খাওয়ানো ‘অশ্লীল, বাদ দিতে হবে। বাবা লেখা ফেরত নেন। লেখক সমরেশ বসু—বাবার ‘বুড়োদা’ সেবছর অসুস্থ। লিখতে পারেন নি। সমরেশ বসুরই অনুরোধে ওঁর লেখার জায়গায় নবকল্লোলের সম্পাদক আরেক হৃদয়বান মানুষ মধুসূদন মজুমদার বাবার লেখাটি শারদীয় নবকল্লোলে প্রকাশ করেন---” ঈশ্বরীতলার রূপোকথা “।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. প্রথম বাড়ী ছেড়ে পালিয়ে আসা কিন্তু অনেকদিন আগে। বরিশালে বাবার বকুনি খেয়ে দত্তপুকুর নাকি মালিকবেরিয়া আশা। এ গল্পটা গদা কাকার মুখেই শোনা ১৯৭৮ সালে দত্তপুকুরে , তখনই আমাদের নিয়ে একটা ছোট গল্প লিখেছিলেন , যতদূর মনে পড়ে তখন ‘ক্লাস সেভেনের মিস্টার ব্লেক ’ প্রকাশিত হয়েছিল।

    উত্তরমুছুন