জাদুকর পরেশ চন্দ্র সরকারের খুব নাম ডাক তখন। হঠাৎই পত্রিকায় খবর এলো ঢাকায় তিনি জাদু প্রদশর্ন করবেন। অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিকে দাওয়াত দেয়া হলো। দেদারসে টিকিটও বিক্রি হয়ে গেল। শহরের দেয়ালে দেয়ালে পোস্টারও সাঁটানো শেষ।
তনুভাই জিজ্ঞেস করল, ‘পুতুল, জাদু দেখতে যাবি?’’
আমি বললাম, ‘কিসের যাদু?’
তখন আমার ছন্নছাড়া অবস্থা। বাবা বেঁচে নেই। বোন হারিয়ে গেছে। টেনেটুনে সংসার চলছে। স্বাধীনতার বিজয় আনন্দ কাউকেই ছুঁয়ে যাচ্ছে না। বাড়ি ভরা শোক। কোথাও যাবার মত আর্থিক সঙ্গতিই নেই, তো আবার জাদু দেখা! কোনরকমে টেনেটুনে পড়াশুনাটা চালিয়ে যাচ্ছি।
গভীর শোক কাটাতে তনু ভাইয়ের প্রস্তাবে রাজিই হয়ে গেলাম।
কিন্তু কথায় কথায় তনুভাই যে আমায় ‘পুতুল’ বলে ডাকত সেটা ছিল বড্ড বিরক্তিকর। কেবল মা এই নামে ডাকলে ঠিক ছিল। দিদিভাই, মানে ‘মিতুল’ আর আমি জমজ হওয়াতে ছেলেবেলায় আমাদের দুজনকে একই রকম পোশাক পরানো হতো। মা নিজের হাতে সেগুলো সেলাই করতেন। হাতায় কুচি, বুকে পরপর ছ’টা ঝিনুকের বোতাম। জামাগুলো পরিয়েই মা আমাদের কাছে ডাকতেন, ‘ওরে আমার পুতু-মিতু্... সোনা পাখিরা, আয় আয় মার কাছে আয়...।’ আমরা লাল ফ্রক পরে মায়ের কোলে ঝাপিয়ে পড়তাম। একটা বয়স পর্যন্ত মায়ের এই অত্যাচার সহ্য করেছি। কিন্তু এখন কি আর ওসব সহ্য করা যায়? বোনের নাম ‘পুতুল’ হলে তাও মানাতো। কিন্তু ছেলেদের নাম ‘পুতুল’ শুনলেই লোকে হাসে। আমারও বেশ লজ্জা লজ্জা লাগে।
যাই হোক, শেষ পর্যন্ত আমরা জাদু দেখতে গেলাম।
মিলনায়তন কানায় কানায় পূর্ণ। বাতিগুলো নেভানো। সারা গায়ে ঝলমল পোশাকে আলো জ্বালিয়ে মঞ্চে প্রবেশ করলেন জাদুকর পরেশ চন্দ্র সরকার। চকচকে জোব্বা, হাতের আঙুলে দামী পাথরের আংটি, গলায় মুক্তোর মালা, মাথায় চুমকি বসানো ঝলমলে সিল্কের পাগড়ী। তিনি মাথা নেড়ে দর্শকদের সম্ভাষণ জানালেন। দর্শকরাও তুমুল করতালি দিয়ে তাকে স্বাগত জানাল।
আমি আর তনুভাই পাশাপাশি সিটে বসা।
দূর থেকেও আমরা জাদুকরকে দেখতে পাচ্ছিলাম। বিশাল বাঁকানো তার মোচ। চোখে সুরমা। সারা মুখে হালকা গোলাপী পাউডারের প্রলেপ। ঠোঁটেও হালকা রঙ।
এক সময় তিনি শুরু করলেন সম্মোহনের জাদু।
একজন তরুণীকে ঐন্দ্রজালের মাধ্যমে ঘুম পাড়িয়ে তারপর তাকে বৈদ্যুতিক করাত দিয়ে দু খন্ড করা হবে। চরম উত্তেজনা চারদিক, সাথে মৃদুগুঞ্জন। সময় নিয়ে যেন কোন ভুল না হয় সেজন্য জাদুকর খুব সাবধানে যন্ত্রপাতিগুলো দেখে নিচ্ছেন। তরুণীটিকে কেটে জোড়া লাগাতে এক সেকেন্ডও এদিক-ওদিক করা যাবে না। গভীর মনোযোগ প্রয়োজন। উনি দর্শকদের অনুরোধ করলেন যেন কেউ টু শব্দটি না করে।
ঢেউয়ের মতন হাত দুলাতে দুলাতে মুহূর্তেই সংবেশিত করে ফেললেন তিনি মেয়েটিকে। ঘুমিয়ে পড়ল সে। সবাই যখন গভীর মনোযোগ দিয়ে দৃশ্যটা দেখছে, ঠিক তখুনি হলঘরের বাতিগুলো জ্বলে উঠল। জাদুকর দর্শকদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, “আপনাদের মধ্যে কেউ কি আছেন, যিনি এই জাদুতে অংশ নিতে চান?” আবার চারদিকে গুঞ্জন। কিন্তু কেউ উঠে দাঁড়িয়ে আগ্রহ প্রকাশ করছে না। জাদুকর মাইকে ইশারা করে আমাকে ডাকলেন। বললেন, ‘এই ছেলে এদিকে এসো।‘ সবার নজর কাড়ার জন্য ঝকঝকে আলোটা আমার উপর ফেলা হলো। একেতো জামা কাপড়ের ম্যারম্যারা অবস্থা, তার উপর চেহারাতেও নেই কোন চাকচিক্য। খুবই ভয়ে ভয়ে উঠে দাঁড়ালাম। বুকের ভেতরে সমানে দ্রিম দ্রিম বাজছে।
তনু ভাই হাতে একটা চিমটি কেটে বলল, ‘স্টেজে ডাকছে; যা,……হাবার মত দাঁড়িয়ে আছিস ক্যা্নো?’
ভয়ে ভয়ে মঞ্চে উঠে গেলাম।
কসাইখানায় যেমন চাপাতি দিয়ে মাংস কাটা হয়, এ যেন তেমনি একটা বিভৎস দৃশ্য! এক তরুণীর পেট কেটে দুই খন্ড করা হবে। গোল বৈদ্যুতিক করাতের ঘস ঘস শব্দে দর্শকরা তখন উত্তেজিত। পরিবেশ থমথমে। মেয়েটির নিথর দেহ পড়ে আছে টেবিলে। করাতের শব্দ ভু...উম করে বাজতে লাগল। ভেতরটা মনে হচ্ছিল ফেটে যাবে আমার। তরুণীর মুখ, মাথা এবং লম্বাটে লাল গাউনটা কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে। আমি এক ঝলক ওর দিকে তাকিয়ে দেখলাম। কপালের টিকলীটা বামদিকে একটু হেলে পড়েছে। নাকে সাদা পাথরের ফুলটা চিকচিক করছে। আহা, প্রতিমার মতন মুখ! কেন যেন খুব চেনা চেনা লাগছে! বুকের ভেতর হাহাকার লাগছিল। মনে মনে ভাবছি, মেয়েটাকে কাটতে গিয়ে যদি ধাঁরালো করাতটা গায়ে লাগিয়ে দেয়? সত্যিই যদি পরেশের জাদুর হিসেবটা ঠিকঠাক মত না মেলে?
মিতুল হারিয়ে গিয়েছিল। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া যায় নি। বাড়িতে আমাদের শোকটা একরকম চিরস্থায়ীই হয়ে ছিল। আহা, জাদুকরের এই মেয়েটিকে যদি মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়া যেত?
২
করাত তখনও ঘস্ ঘস্ শব্দ করে ঘুরছে। হঠাৎই দেখলাম কালো কাপড়টা গা থেকে সরিয়ে মেয়েটা টেবিল ছেড়ে ধুম করে উঠে বসল। ধীরে ধীরে পাটাতনে পা ছুঁয়ে সে কয়েক সেকেন্ডের জন্য দর্শকের দিকে তাকাল। দর্শকরাও স্তব্ধ হয়ে ঘটনাটা দেখছে! মেয়েটার এই আকস্মিক জেগে ওঠায় জাদুকর ছিট্কে দূরে সরে গেল। হয়ত উনি বুঝতে পারছিলেন যে বিরাট কোনো দূর্ঘটনা ঘটে গেছে। হিসেবটা যেন ঠিকঠাক মত মেলে নি। মেয়েটার মাথার উপর উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বাতিগুলো থেকে আলো পড়াতে সকলের দৃষ্টি সেখানেই আটকানো।
টেবিল থেকে নেমে মেয়েটা খালি পায়ে হন হন করে হাঁটতে লাগল। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে। কাউকে তোয়াক্কা না করেই নিশব্দে সে মঞ্চের বামদিকের সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। তারপর দর্শকসারির মাঝখান দিয়ে যে লম্বা পথটা চলে গেছে সেটি বরাবর হাঁটতে লাগল। দর্শকরা হা করে দৃশ্যটা গিলছে। ঘটনাটা আসলে কী ঘটছে, কেউ কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। তাহলে কি আজ আর জাদুটা দেখা যাবে না? আমি তখনও বোকার মতন মঞ্চে দাঁড়িয়ে। পা দুটো সিরসির করছিল। হাতের তালু শীতল। হঠাৎই কোন কিছু না ভেবে মঞ্চ থেকে নেমে মেয়েটিকে অনুসরণ করে হাঁটতে শুরু করলাম আমি।
৩
মেয়েটি মিলনায়তনের বড় কাঠের দরজাটা পেরিয়ে বাইরে চলে গেল। আমিও ওর পেছন পেছন রাস্তায় নেমে এলাম। কিছুক্ষণ পর পেছন ফিরে তাকাতেই দেখি শহরটাকে আর দেখা যাচ্ছে না। যে শহরের একটা মিলনায়তনে হাজার খানেক মানুষ বসে জাদু দেখছিল, তারা কেউই নেই।
তিরতির করে সন্ধ্যা নামছে, চারদিকে মিষ্টি বাতাস উড়ছে। আকাশে সিঁদুর রঙ ছড়িয়ে আছে। পেছনের দালান গুলো গাছ আর ঝোপঝাড়ের ভেতরে লুকিয়ে পড়েছে। কিন্তু নিমেষেই শহরটা হাওয়া হয়ে গেল? এত কিছু ভাববার সময় ছিল না আমার। কেমন যেন তোলপাড় লাগছিল। মেয়েটিকে অনুসরণ করে হাঁটতেই থাকলাম।
সে একমনে হাঁটছে। আমিও ওর লাল গাউনটা অনুসরণ করে পেছন পেছন হাঁটছি। মেয়েটা পেছনে তাকাচ্ছে না। আমি চারদিকে তাকিয়ে দেখি, পথটা খুব চেনা চেনা লাগছে। কোথাও ৭.৩ মিটার আবার কোথাওবা ৯.১ মিটার প্রশস্ত রাস্তা। রাস্তার দুধারে বিশাল বিশাল রেইনট্রি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। গাছের পাতাগুলো ঘন ছাদ হয়ে ঢেকে গেছে। পাতার ফাঁকে লাল আকাশ ফুঁটেছে।
হঠাৎ খেয়াল করলাম, মেয়েটা একা না। আশপাশের গ্রামগুলো থেকে এক এক করে অনেক মানুষ এসে এই পথে জুটে গেছে। যতই এগুচ্ছি ততই মানুষ বাড়ছে। সবাই পোটলা-পাটলি নিয়ে হাঁটছে। কেউ শিশুদের নিয়ে দৌড়াচ্ছে। কারো কাঁধে ফেরী, কারো ছেঁড়া খোঁড়া নিঃসম্বল চেহারা। কেউ কেউ মাঝে মাঝে গাছতলায় জিরিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু কারো মুখেই কোন হাসি নেই; কেমন যেন একেকটা শূন্য চেহারা।
এক বুড়োকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথায় যাচ্ছেন আপনারা?’
লোকটা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘ইন্ডিয়া।’
মনে মনে ভাবলাম, এটা কি ইন্ডিয়া যাবার পথ? কিন্তু সেটাই বা কেমন করে সম্ভব? মেয়েটিই বা কীভাবে আমাকে এখানে নিয়ে এলো?
লোকগুলো আবার মেয়েটিকে অনুসরণ করে হাঁটছে। কেউ কেউ একটু বিরক্তও হচ্ছে। কেবল আমিই একটানা তাকিয়ে আছি। চোখের পাতা ফেললে যদি মেয়েটা হারিয়ে যায়? তাই, কিছুতেই নামাতে পারছিলাম না চোখ। হঠাৎ মানুষগুলো ছুটে ছুটে দৌড়ে পালাতে শুরু করল। কাদামাটিতে ডুবে যাচ্ছে ওদের পা, তাও ছুটছে ওরা। কেউ থামছে না। যতই মেয়েটার কাছে যাবার চেষ্টা করছি ততই ও দূরে দূরে সরে যাচ্ছে। দূরত্ব বাড়ছে তো বাড়ছেই।
হঠাৎ দূরে লাল গাউনটার দিকে তাকিয়ে দেখি ওটা আসলে গাউন নয়, ঠিক যেন দি’ভাইয়ের সেই লাল ফ্রক। পেছনের লাল ঝুলটা বাতাসে দুলতে দুলতে একসময় সেটা আকাশের সীমানায় হারিয়ে গেল। ফ্রকটা ছুঁতে না পারায় আমি চিৎকার করে ডাকতে শুরু করি, মিতু......মিতু...
এমন করে ডাকটা ঠিক সেদিনই একবার ডেকেছিলাম।
যেদিন খুব ভোরে বিকট শব্দে দরজা ভাঙার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। মিতু তখন সবে তরুণী। গান গাইত, নাচত। পাড়ার সবাই ওকে চিনত।
ছেলেগুলোকে ডেকে মা বলেছিল, ‘বাবারা, আমার মেয়েটা খুব ছোট; ‘তোমরা এক এক করে ভেতরে যাও, নইলে ওঁ বাঁচবে না।’ পাশের ঘরে বড়’দা আর আমার হাত, পা, মুখ বাঁধা। গোঙাতে গোঙাতে আমরা চিৎকার করে মিতুকে ডাকার চেষ্টা করছিলাম........ঠিক যেভাবে আজ ডাকছি...
পরদিন ভোরে সত্যি সত্যিই মিতু চলে গেল। কোথাও ওঁকে আর খুঁজে পাওয়া যায় নি।
একটা মামলা করা হয়েছিল।
বাদী পক্ষের ধর্ষিতা মেয়েটির নাম ছিল ‘মধুমিতা রায়।’
কথাসাহিত্যিক / অনুবাদক
কানাডায় থাকেন।
কানাডায় থাকেন।
0 মন্তব্যসমূহ