লোকনাথ আর মোহাম্মদী দুটো পঞ্জিকাই রাখে আফতাব খলিফা। মোহাম্মদীটার মলাট লাল রঙের আর লোকনাথটার মলাট গোলাপী রঙের। তবে দুটোই সমান মাপের আর ওজনে তো মনে হয় লোকনাথ মোহাম্মদীর দ্বিগুণ। তবে কখনও ওজন দিয়ে দেখা হয় নি। একবার মাপার জন্যে বাটখারা আনার পরও হাটের কোণে মসজিদ বসানোর জায়গা নিয়ে মারামারি লেগেছে শুনে দৌড় দিতে হলো। আরেকবার মাপতে যাবে, ঠিক তখনই একটা লাল বড় মাজুল পাঁজর ঘেঁসে এত জোরে কামড় দিলো যে সব ভুলে সে লাফ দিয়ে উঠেছিল। তারপর পাঁজর জুড়ে লাল হয়ে ফুলে উঠল এবং সে চুন, নুন ও কাঁচা হলুদ গোলানো পানি লাগিয়ে ব্যথা তাড়াতে ব্যস্ত হয়ে গেল। আরেকবার ঠিক ওই সময়েই গফুর একটা গামলায় কাঁচা আম কেটে নিয়ে এলো। তাও আবার পোড়া মরিচ দিয়ে মেশানো। চোখের সামনে ওইরকম খাওয়ার জিনিস থাকলে কেউ পঞ্জিকা মাপে না আফতাবও মাপে নাই। খুঁজলে আরও বহুদিন মিলবে, আরও বহু ঘটনাও মিলবে, জানে আফতাব। মোট কথা পঞ্জিকা দুটোর ওজন এখনও মাপা হয় নাই।
পঞ্জিকা দুটো ওজন করার এই আজগুবি বুদ্ধি বেরিয়েছিল মলমওয়ালা হারিছের মাথা থেকে। অবশ্য তাকে মলমওয়ালা বললে ভুলই হবে। সুবিধামতো সব কিছুই বেঁচে সে। খুব ভোরের ট্রেনে গঞ্জে চলে যায়। ফেরে কখন কেউ জানে না। খুব সকালে তাকে আবারও দেখা যায়, রেলস্টেশনের দিকে ছুটছে বাজারঘেঁষা রাস্তা দিয়ে। হারিছ গুণগুণ করে গাইতে পারে, ‘তু জাহা জাহা চলে গা, মেরা ছায়া সাথ হো গা, মেরা ছায়া, মেরা ছায়া...’। তবে কোনওদিন হারিছের ছায়া দেখার ভাগ্য হয় নাই আফতাব খলিফার। সে যখন তার দোকানে আসে, তখন কোনও রোদ থাকে না; তার সঙ্গে দেখা হয় কালেভদ্রে, তাও এমন কালেভদ্রে যখন ছায়া পড়ার কোনও উপায় থাকে না। সেই হারিছ একদিন তার দোকানে এলো, তবে ওইদিন সে ‘তু জাহা জাহা চলে গা’ গাইছিল না; ওইদিন সে গাইছিল, ‘আজ কাহেঙ্গি দিল কা ফাসানা, জান ভি লে লে চাহে জামানা...’। গাইতে গাইতেই পঞ্জিকা দুটোর দিকে তাকালো সে তেরছা চোখে। তারপর বলল, ‘জিনিসের কাম এক, কিন্তুক ওজন তো আকাশপাতাল! মাইপা দেইখছেন?’
হারিছের কথায় কান দেয়ার সময় ছিল না তার, ভুল করে ছবির মেম্বারের পাঞ্জাবিতে বুকপকেটটা লাগানো হয় নাই। পাঞ্জাবী নেয়ার সময় বুঝেসুঝে নেয় নাই, তারপর তাড়াহুড়ো করে ওই পাঞ্জাবি পরে বিয়াইবাড়ি গিয়ে তার মানসম্মান সব পাংচার হয়ে গেছে। বিয়াই ইয়ার্কি মেরেছে, বিয়ানও বাদ রাখেনি। এই বয়সে বেশি কিছু করার সামর্থ্য তাদের কারই বা আছে! এই ইয়ার্কি-ফাজলামো করতে করতে যতটা উস্কানি জাগানো যায় আর শান্তি পাওয়া যায়, ততটাই লাভ কিন্তু তারপরও বিয়ানের ইয়ার্কির সামনে ছবির মেম্বার টিকতে পারে নাই। বিয়াইবাড়ি থেকে বাড়ির পথে হাঁটতে ধরেছে সে, কিন্তু বাড়িতে না গিয়ে সরাসরি চলে এসেছে বাজারের ওপরে, তারপর ইচ্ছামতো গালিগালাজ করেছে আফতাব খলিফাকে। দোকানের লোকজন অবশ্য গালিগালাজ না শোনার ভান করেছে, আফতাব নিজেও ঠোঁটের ওপর একটুকরো হাসি ঝুলিয়ে রেখেছিল, এমন ভাব যে এইসব কথাবার্তা শুনতে তার আরামই লাগে। আর আরাম না লাগার উপায় আছে নাকি মেম্বার মানুষ, তার ওপর আবার চরডোবা মানুষ, ১৪/১৫ বছর হয় এই গাঁয়ে এসে জেঁকে বসেছে, চরের স্বভাব এখনও পাল্টায় নাই, কোনওদিন পাল্টাবে বলেও আর মনে হয় না। ছবির মেম্বার চলে গেল, তারপরই মলমওয়ালা এলো, তাদের কথাবার্তার আভাস ধরে একসময় বলে উঠল, ‘কোনকার কোন ছবির মেম্বারে কী না কী কইছে, আরে আপনে মন খারাপ কইরেন না তো’ বলে গলা উঁচিয়ে ফের গাইতে লাগল, ‘ইশক মে জিনা, ইশক মে মারনা...’। গাইতে গাইতে পঞ্জিকা নিয়ে লোফালুফি করতে লাগল, লোফালুফি করতে করতে একসময় ওই কথা বলল, ‘জিনিসের কাম এক, কিন্তুক ওজন তো আকাশপাতাল! মাইপা দেইখছেন?’
ওজন আর করা হয় নাই। আর ওজন করার দরকারই বা কী! তাতে কি বোঝা যাবে, জিনিসের কাজ এক হলেও আকার আর ওজনে কেন এত আকাশপাতাল তফাৎ? তবে ওজন করার বুদ্ধি দিলেও মলমওয়ালা কখনও জানতে চায় নাই, এইভাবে দু’টো পঞ্জিকা রাখার কারণ কি। আফতাব নিজেও এর কোনও কারণ খুঁজে পায় না। তার বরং ঝামেলাই হয় মাঝেমধ্যে। লোকনাথটার দরকার হলে মোহাম্মদীটা হাতে উঠে আসে, মোহাম্মদীটা খুঁজতে গেলে লোকনাথটা চোখের সামনে ঘোরাফেরা করে। অবশ্য যেটা যখন হাতের কাছে মেলে, সেটাতেই তখন কাজ সারার চেষ্টা করে সে, তারিখের পাশেই দরকারি লেখাজোখা করে, দুধওয়ালাকে সর্বশেষ কী বারে কত টাকা দেয়া হয়েছে লিখে রাখে, অর্শের মলম লাগানোর তারিখে টিকচিহ্ন দিয়ে রাখে, যাত্রা শুভ না অশুভ তা জানার চেষ্টা করে। কিন্তু ওই পর্যন্তই পরে আর ঠেকার সময় সেই পঞ্জিকা খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার দরকার ফুরিয়ে গেলে অদরকারি হওয়া পঞ্জিকাটা উঁকি দিয়ে হাসতে থাকে থান কাপড়ের গাঁটের আড়াল থেকে। অথবা দেখা যায়, দোকানে আসা লতিফুরের বাপ দুই হাতের চিপায় পঞ্জিকাটা রেখে চোখ গুঁজে দেখছে সামনে কবে অমাবস্যা আছে। হিন্দু না জ্যোতিষও মানে না তারপরও লতিফুরের বাপ কোনও জরুরি কাজের তারিখ করার আগে বার বার দেখে নেয় সোম, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র এই চারটি বার হলো সকল কর্মে শুভ। কালবেলায় কোথাও রওনা হলে মৃত্যু আসতে পারে, মেয়ের বিয়ে দিলে সংসার খান-খান হতে পারে, অতএব কালবেলাও এড়িয়ে চলে লতিফুরের বাপ। এইভাবে বেশির ভাগ দিনই সে ভিড়ের সময় দোকানে এসে জোরে জোরে পঞ্জিকা পড়তে পড়তে মনযোগ নষ্ট করে, সময়ও নষ্ট করে।
ক’ বছর হয় যে এইসব ঘটছে, কিছুই তা আফতাব জানে না। দিনের পর দিন এরকম সব ঘটনা ঘটছে এরপরও সে কী না দুটো পঞ্জিকা রেখে চলেছে। তবে বাপে তো দুখানাই রাখতো, আফতাবও তাই রাখে। প্রতি বছর চৈত্রসংক্রান্তি আসার দিনকয়েক আগে নূরালী চাচা এসে পঞ্জিকা দুটো পৌঁছে দিয়ে যায় দোকানে। কত বছর হয় এইভাবে নূরালী চাচা পঞ্জিকা দুটো দিয়ে যাচ্ছে, বাপ কেন দুটো পঞ্জিকাই কিনতো তার কাছ থেকে, সেসব জানার চেষ্টা সে কোনওদিনও করে নাই। তবে নিশ্চয়ই কোনও কারণ আছে। কারণ ছাড়া দুটো পঞ্জিকা রাখার মতো মানুষ না তার বাপ। পুরোপুরি কিপ্টা না হলেও কারণ ছাড়া বাড়তি খরচ করতে যায় না সে। অতএব সে বাপের ওপর ভরসা রাখে, দুটো পঞ্জিকাই কেনে প্রতি বছর।
তবে পঞ্জিকার চেয়েও এখন আফতাবের বড় ভাবনা বোরিক পাউডার নিয়ে। চারদিন হয় আলমগীরের ডিসপেনশারিতে যাচ্ছে, কিন্তু পাচ্ছেই না। যেন সব বোরিক পাউডার হঠাৎ করে দোকানঘরে মজুদ করে ফেলা হয়েছে। কিন্তু বউয়ের অবস্থা ভয়াবহ। পায়ের কুঁচকিতে কী এক ঘা হয়েছে, নারকেল তেলের সঙ্গে এই বরিক পাউডার মিশিয়ে সেখানে ঘষলে না কি ওর ভালো লাগে। তখন নাকি মনে হয়, ঘায়ের উপর সুশীতল বাতাস এসে এমনভাবে ঘোরাফেরা করছে যেন তার ঘুম না ভাঙে। অতএব বরিক পাউডার জোগাড় করতে হবে, না হলে বউয়ের ঘুম ভালো হবে না, না হলে বউয়ের মৃদু গালমন্দ অথবা আশাভঙ্গের ঘ্যানঘ্যানানি শুনতে হবে। তা ছাড়া তার নিজেরও তো স্বার্থ আছে। কুঁচকির ওই ঘা যন্ত্রণা দিলে বউ নিজেকে মেলে ধরে না, গায়ে একটু হাত দিলেই ঝামটা দিয়ে ওঠে। অতএব আফতাব খলিফা আজও বাজার ছাড়ার আগে বোরিক পাউডারের খোঁজে আলমগীরের ডিসপেনশারির দিকে এগোয়। হাতের ডানে একঝাঁকা সজনে নিয়ে ডোবাগাঁওয়ের হামিদ বসে আছে, তারপর একটু এগিয়ে জলিলের তামাকের ছাপড়া, ছাপড়া যত বড় তামাক ডলার বারকোশ তার চেয়েও বড়, আর হাতের বামে একসার দোকানের ছাউনি, মানুষজন ঠিকমতো দেখা যায় না, দোকানদার তো আরামেই বসে থাকে, কিন্তু উবু হয়ে বসতে হয় বাজারিদের। আফতাব মতিহার পাতার ঘ্রাণ পায়, কয়েকটা নীল মাছি মাছের বাজার খুঁজে বেড়ায়, চোখ-নাক আর মাথার ওপর ভোঁ ভোঁ করে উড়ে-উড়ে নিশ্চিত হয়, এইখানে কোনও মাছ নাই, অতএব দূরে সরে যায়। ভাটিগঞ্জের কুরমান তাকে হাত-ইশারায় ডাকতে থাকে আর দূর থেকেই আফতাব দেখে, তার বাঁশের ঝাঁকার মধ্যে থেকে উপচে উঠছে তরতাজা উচ্ছের সবুজ আলো। কুরমান নির্ঘাৎ ফেঁসে গেছে, নতুন উচ্ছে বলে দাম নিশ্চয়ই খানিকটা বেশি চেয়েছিল, নইলে তো এতক্ষণ ওই উচ্ছে ওইভাবে পড়ে থাকার কথা না। আর এখন তাকে ডাকছে, কেননা জানে, উচ্ছে তার খুবই ভালো লাগে। কিন্তু এখন এইসব দেখার সময় নাই। বোরিক পাউডার অনেক বেশি জরুরি। তাই সে আলমগীরের ডিসপেনসারির দিকে তাকায়, আর দেখে, তাকে দেখেই আলমগীর মৃদু হাসছে, ডান হাত তুলে নাই-নাই করছে।
মেজাজটা আফতাব খলিফার খারাপ হয়ে গেল।
এখন বাড়িতে ফিরতেও আর ইচ্ছে করছে না। আফতাবের পা ঢিলে হয়ে যায়। বাজারের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত যেসব কুকুরগুলো দিনরাত দৌড়াদৌড়ি করে, তাদের একটি পায়ের নাগালে পড়ায় লাথি মারে। আর গেল বছর টিকা নেয়ার ভয়ে মুতে ফেলা ডোবাগাঁওয়ের কুদ্দুসকে কটকটি খেতে দেখে বলে, ‘অত কটকটি খাইও না, পাতলা হাগা হইলে কইল খবর আছে!’
কুদ্দুসের ঠোঁটের দু’পাশ দিয়ে মুখের মধ্যেকার কটকটির গুড় গলে লোভাতুর লালচে লালা ঝরছে। সে সেই লালা ঝরা সামাল দেয়ার চেষ্টা করে। তারপর একটা বড়সড় ঢোক গিলে বলে, ‘আপনার হইছিল নাকি?’
আফতাব ভেতরে ভেতরে একটু খেপে। পাশের গাঁয়ের ছেলে, তার ওপর কাজী বংশের পোলা, তাই এই পরামর্শ মুখ ফসকে বেরিয়ে গিয়েছিল। নইলে উপদেশ দেয়ার মতো মানুষ তো সে না। আর দর্জি মানুষের উপদেশ শোনেই বা কে! তারচেয়ে নিজের দোকান নিয়ে ব্যস্ত থাকা ভালো। আগবাড়িয়ে এরকম ঝামেলা পাকানোর বিরক্তিতে আফতাব আরও খ্যাপাটে হয়ে ওঠে, কাটা-কাটা গলায় থেমে থেমে বলে, ‘এইসব রোগবালাই সব মানুষেরই হয়। কার হয় নাই?’
‘সব মানুষের হইবে ক্যান আমার তো হয় নাই।’
‘এই জন্যিই তো সাবধানে থাইকবার কইলাম। হয় নাই, হইতে তো পারে।’
‘তা ঠিক, হইতে পারে।’মিচকে শয়তানটা ভালো মানুষের মতো কটকটি চিবুতেই থাকে। এতই অভদ্র যে তাকে দু’ একটা নিতেও বলে না। বরং খানিকটা চিবুনোর পর আবার জিজ্ঞেস করে, ‘তে আপনের হইছিল?’
‘কইলাম তো ব্যবাকেরই হইতে পারে।’
‘তা পারে। কিন্তু আপনের কি হইছিল, না কি হইতে পারে?’
কী ঝামেলা! আফতাবের এখন খুব বিরক্ত লাগে। একটা-দু’টো কটকটির ভাঙা টুকরো মুখের মধ্যে দিলে মুখটা হয়তো ব্যস্ত হয়ে পড়ত, নিশ্চয়ই বিরক্তিটাও কেটে যেত। কিন্তু নিজে থেকে তো আর চেয়ে নেয়া যায় না। আর ফাচুক পোলাটার কোনও থামাথামির লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। সে যে একটা লোক, একই রাস্তায় যাচ্ছে, ডোবাগাঁওয়ে কুদ্দুস পৌঁছে গেলেও তাকে আরও খানিকটা যেতে হবে, এইটা মনে হয় গ্রাহ্যেই নিচ্ছে না। আর ও কথা বাদ দিলেও, পাঁচ/সাত গাঁয়ের মানুষের জন্যে সাকুল্যে একটা দর্জিদোকান এই বাজারে আফতাব তার মালিক এই জন্যে তার সঙ্গে হিশাব করে কথা বলা উচিত না গাঁয়ের মানুষজনের? কবে তার কোন পূর্বপুরুষ হিন্দু থেকে মুসলমান হয়েছিল, এখনও সেই হিসাব করার মানে আছে? আর হিন্দু থেকেই তো এখানে সবাই মুসলমান হয়েছে, আবার সেই সব হিন্দু তো ব্রাহ্মণও ছিল না। শালা কাজীর ব্যাটা কাজী, কলুর বংশ থেকে মুসলমান হয়েছে, এখন ভাব ধরেছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় হঠাৎ লাপাত্তা হয়ে গেল সাধুনাথ কলু ওরফে কাশেম কলুর ব্যাটা খয়ের কলু, লোকজন বলাবলি করল, সে না কি টাউনের কোন গোডাউনে কাজ করে। যুদ্ধ থামল, খয়ের কলু সিল্কের পাঞ্জাবি পরে বাড়ি ফিরল, ছেলের আকিকার সময় দেখা গেল মৌলভী সাহেব খুৎবার সময় বলছে, কাজী খয়েরের পুত্রধন কাজী ইকবাল...। আরে, বাপ রে, নামের বাহার দেখ। এখন সেই কাজীর ব্যাটা কাজী এমন ভাব দেখায়, এইসব হিস্ট্রি লোকজন মনে হয় কেউ জানে না। আফতাব খুব রেগে বলে, ‘আমার কী হইছিল আর কী হয় নাই, সেইটা তোমাক কমু নাকি?’
‘কইতে পারেন, অসুবিধা কি? আপনের হিস্ট্রি খানিকটুক জানা থাইকলো, এই আরকি! হিস্ট্রি জানা তো খুবই ভালো চাচা। স্যারে কইছে, তা ছাড়া এইগুলা শুনতে ভালোই মজা লাগে’
ঠাস করে দু’চারটা চড় বসাতে পারলে শরীরটা পাতলা হতো। কিন্তু আফতাব মুখ গুঁজে কুদ্দুসকে পিছে ফেলে সামনে এগিয়ে যায়। ফাল্গুন মাসের দুপুর, রাস্তা একেবারে খটখটে, মানুষজনও কম। অনেকদিন হয় সে চিন্তা করছে, কীভাবে একটা সাইকেল কেনা যায়। রাস্তাঘাটে কত ফালতু মানুষজন, সাইকেলে চলাফেরা করলে তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার হাত থেকে রেহাই পাওয়া যেত। তা ছাড়া অত হাঁটতেও এখন আর ভালো লাগে না। সময় অবশ্য বেশি লাগে না, মাইলখানেক রাস্তা কোনও ব্যাপারই না। কিন্তু সকালে একবার, বিকালে আরেকবার সব মিলিয়ে সেই একমাইল রাস্তা দিনে চার মাইলে দাঁড়ায়। আবার সেই চলাফেরার সময় ডোবাগাঁওয়ের কুদ্দুসের মতো পোলাপান তার সঙ্গে ফাজলামিও করে! দর্জি মানুষ সে, তার মনে হয় কোনও সম্মান নাই! কুদ্দুস তাও ভালো, ছবির মেম্বারের পোলা তো তাকে আরও কুকথা বলেছিল। এইরকম ঠোঁটপাতলা বেয়াদপ তার চোখে আর একটাও পড়ে নাই যে না কি হাসতে হাসতে বলতে পারে, ‘চাচা, আপনে তো বেলাউজ-ছায়া বানান। কেলাস নাইনে পড়ে, ছনতলার সুমাইয়ার দুধ আর পাছার মাপ কত কইতে পারেন?’ আফতাব ক্ষ্যাপাটে চোখে তাকিয়েছিল, আর মেম্বারের পোলা ফ্যা-ফ্যা করে হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘বিয়ার প্রস্তাব পাঠামু চাচা। মুখখান তো বালোই দেহা যায়, আর কিছুর কতা তো জিগান যায় না, তাই আপনের কাছ থাইকা জানার চেষ্টা করতেছি।’ শুনে আফতাব মাথা নিচু করে ছিল, বুঝতে পারছিল কিছু বলা ঠিক হবে না, কিন্তু কিছু না বলেও সে শান্তি পাচ্ছিল না। অনেক কষ্টে শেষমেষ মুখ খুলেছিল, ‘বাচ্চা পোলা তুমি, তোমাক আর কী কমু? তোমার বাপেক আইসতে কইও, আমারও মুরুব্বী উনি, এক্সপার্ট মানুষ, উনি এইসব মাপজোঁক ভালো বুইঝবো। দরকার হইলে সুমাইয়াক ডাইকা পাঠামুনে। তোমার বাপ নিজের হাতে ওইসব মাইপামুইপা দেখবোনে।’
বাপকে টেনে আনায় মেম্বারের পোলার মুখ শুকনা নারকেল হয়ে গিয়েছিল। চোখে এক চিলতে ক্রোধ জ্বলে উঠেছিল বোধহয়, মেম্বারের চোখে জ্বলা যে-রকম ক্রোধে কয়েক বছর আগে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল একাব্বর আলীর শুকনো খড়ের গাদাগুলো আর শরৎ আসার আগেই গরুগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে পাগল হয়ে গিয়েছিল সে। আফতাবের পাশের বাড়ির মানুষ একাব্বর, ঘর থেকেই দেখা যেত টিপ টিপ বৃষ্টির মধ্যেই একাব্বর কোত্থেকে যেন ফিরছে বাঁশপাতা নিয়ে। কখনও সে ঘাস তুলে আনত টুকরি ভরে। কিন্তু এত করেও কাজ হলো না, ধানের খন্দ ওঠার আগেই গরু বেঁচে দিতে হলো একাব্বরকে, আর তাও পানির দামে। তবে আফতাবকে অত বেশি খেসারত দিতে হয়নি। পরের দিন সকালে দোকান খুলতে এসে তার ছোট ভাই মোসলেম দেখেছিল, কে যেন দোকানের সামনে পায়খানা করে রেখেছে।
আফতাব লক্ষ্য করে, তার শরীর থেকে ঘাম ঝরছে। ফাল্গুন মাসের দুপুরবেলা ঘাম ঝরা অস্বাভাবিক নয়, যদিও তার ঘাম হয় কম আর এখন একটু বাতাসও আছে। দক্ষিণ দিক থেকে হাওয়া আসছে। রোদ একেবারে স্থির, উত্তাপহীন বাতাসের তোড়ে। ইউনিয়ন বোর্ডের কাঁচা রাস্তায় ধূলো উড়ছে। দূরে মাঠের মধ্যে ক্ষেতে নিড়ানি দেয়া বন্ধ করে আলের ধারে বসে শরীর জিড়াচ্ছে ফতেহ মিয়া। কলকিতে তামাক সাজাচ্ছে সাদেক মিয়া, বাপে-পুতে মিলে প্রস্তুতি নিচ্ছে হুকা টানবার। সে দেখে, জুরান আলী সড়ক দিয়ে আসতে নিয়েও আলপথ ধরে রওনা হলো ওই তামাক টানার আশায়। কিন্তু আফতাবের এইসব নেশা নাই। ঠিক নেশা না, তবে শখ আহ্লাদ একটু ছিল, যদিও সমস্যা হচ্ছে বোরিক পাউডারের। চারদিন হয়ে গেল, বোরিক পাউডার মিলছে না কিছুতেই। এইভাবে ঠিক থাকা যায়? তা ছাড়া সকালে দোকানে আসার আগে আছিয়াকেও দেখল চুলার পাড়ে ভীষণ আড়ষ্ট। কুঁচকিতে চুলকানি নিয়ে চুলার পাড়ে আর কতক্ষণ থাকা যায়! সোমবারে টাকা দিতে আর নতুন কাপড় আনতে মোকামে যায় সে। কিন্তু সেই সোমবার আসতেও আরও দুইদিন। অবশ্য কালকেও যাওয়া যায় মোকামে। বছরের এই সময় মানুষজনের হাতে ধানবেচা নগদ টাকা থাকে, মানুষজন জামাকাপড়ও বানায়, তাই মোকামে দুইবারও যাওয়া যায়। মহাজনও কাপড় বাকিতে বেচতে তত গাইগুঁই করে না। জানে টাকা তাড়াতাড়িই ফেরৎ পাওয়া যাবে।
দুপুরের রোদ সড়কের ধারের কড়িগাছটার সব ছায়া গিলে ফেলেছে, পাতাগুলোকেও গোগ্রাসে গিলছে এই সময় বাড়ি ফেরার কোনও মানে হয় না। নতুন ধান তুলে মানুষজনের পাছাভারি হয়েছে, গাঁয়ে গানগাওয়া ফকির এসেছিল গেল সপ্তাহে, যাত্রার দল আসবে আগামী সপ্তাহে। আর জামাকাপড় বানানোর ধূম পড়েছে ঈদের মতো। খেয়েদেয়ে উঠেই দোকানে ফিরতে হবে তাকে। অর্ডার নেয়ার লোভ সামলানো যায় না, আবার অর্ডার নেয়ার মানেই হাতের কাজ বেড়ে যাওয়া। তা আরও ভয়ানক ঝামেলার। গজফিতা গলায় ঝুলিয়ে, হাতের পাশেই একটা কাঁচি রেখে মাথাটা নিচের দিকে নামিয়ে খালি কাপড় মাপো আর কাপড় কাটো। ছোট দোকান, কর্মচারীও কম, হিমশিম খায় আফতাব। তবে এই ঝামেলা আর কয় মাস থাকে? আবারও তো তাকে ঝিমাতেই হয় বর্ষা থেকে শুরু করে বছরের বাদবাকি মাসগুলো। বর্ষা আসে, মানুষজন তখন পারলে লুঙ্গি খুলে মাথায় বাঁধে। গামছার বিক্রি অবশ্য একটু বাড়ে। কিন্তু আফতাব তো আর গামছা বেচে না! বর্ষা যায়, মঙ্গা আসে, লোকজন জামাকাপড় বানানোর কথা একেবারে ভুলে যায়। এইভাবে হিশেব করলে, দর্জির দোকান করে কোনও লাভ নাই। তার চেয়ে একটা গুড়-চিনি-আলুর দোকান দেয়াও ভালো। ছোটবেলা থেকেই বাপকে সে এই কথা শুনিয়ে আসছে। কিন্তু বাপ খালি মিটমিটিয়ে হাসে, খুব বেশি হলে বলে, ‘তে এক কাম কর দোকান খালি কইরা, মালপত্র সব নামায়া নতুন কইরা তর যা পছন্দ তাই শুরু কর।’
কিন্তু সেইটা কি সম্ভব? লাভ লোকসান যাই হোক, কাজ আফতাব সারা জীবনে এই একটাই শিখেছে খায়রুলের মতো টুঙ্গি দোকানে বসে সে দাড়িপাল্লায় আলু মাপছে আর কানকো দিয়ে কেরোসিন মেপে দিচ্ছে, চিন্তা করতে গেলেই আফতাব বুঝতে পারে, সে আসলে স্বর্গসুখে আছে। ওই গুড়-আলু-চিনি-কেরোসিনের ব্যবসা করতে গেলে সে একদিনেই পথে বসবে। বাপই পারল না, আফতাব পারবে কোথা থেকে! ক্ষেত-রাখালির কাজে যেতে হয় বলে ১২ বছর বয়সে একদিন লাপাত্তা হয়ে গিয়েছিল তার দাদা আলতাফ। তারপর ফিরেছিল আরও এক যুগ পরে, ২৩ বছরে দর্জি হয়ে। ‘তুই ব্যাটা চাষার ব্যাটা, শিখলি দর্জির কাম, আক্কেল আছে তোর?’ লোকজন হাসাহাসি করত, কিন্তু আলতাফ সে কথা গায়ে মাখে নাই। প্রথমে সে বসতো বাজারের বড় জামগাছটার নিচে, মেশিনখানা নিয়ে। লুঙ্গি সেলাই দিতো, ছেঁড়াফাটা জামাকাপড়ও সেরে দিতো, পাখিরাও নাকি পছন্দ করত না তার দাদাকে, কখনও কাঁধে, কখনও মাথার ওপরে, কখনও আবার পিঠে হেগে দিতো। কিন্তু এইসব সহ্য করা ছাড়া আর কি-ইবা করার ছিল তার! অবশ্য উপায় আরেকটা ছিল, আবারও তা হলে ফিরে যেতে হতো শহরে! কিন্তু বয়স হয়েছে বলে বাড়ি ফেরার এক সপ্তাহের মধ্যেই দাদাকে বিয়ে পড়িয়ে দিয়েছিল তাঐ মশাই তার ভায়ের ছোট মেয়ের সঙ্গে ষোল বছর বয়সে ব্যাটা ছেলেদের বিয়ে হয়ে যায় অথচ তার ছেলের বয়স তেইশ পেরিয়ে গেছে, এই লজ্জা তাঐ মশাই সপ্তাহখানেকের বেশি টানতে পারে নাই। জামগাছের নিচ থেকে দাদা তার ছাপড়া দোকানে বসতে শুরু করেছিল, বাপ তার সেই ছনের ছাপড়া ভেঙে আস্ত টিনের ঘর তুলল, বাড়িতেও নতুন আরেকটা টিনের ঘর উঠল। তা হলে দর্জির দোকানে লাভ নাই, এ কথাই বা আফতাব বলে কী করে! বরং বলা যায়, সে-ই কিছু করতে পারে নাইÑযদি সে পারত, অন্তত একটা টিনের ঘরে ইটের মেঝে করে দিতে পারত তা হলে না হয় একটা কিছু হতো। একটাই দর্জি দোকান এই ৫/৬ গাঁয়ের মধ্যে, কিন্তু তারপরও সে কোনও টাকা জমাতে পারছে না!
টাকা জমাতে না পারার দুঃখ ভোলার জন্যে আফতাব আবারও ভাবে, একটা ব্যাপার বাপের কাছ থেকে এখনই জেনে নেয়া দরকার, এক দোকানে দুই রকম দুইটা পঞ্জিকা রাখার কারণ কি? এতদিন গেল, তবুও তো সে এখনও ঠিক বুঝতে পারছে না। বাপ কি তাকে খোলাশা করে বলবে না কখনো? প্রায়দিনই ভাবে সে, বাড়ি ফিরে বাপের কাছে থেকে জেনে নেবে, দুই-দুইটা পঞ্জিকা রাখার কারণ। দুই পঞ্জিকাতেই যদি লেখা থাকে যাত্রা শুভ, তা হলেই কি তার উচিত টাউনের মোকামে কাপড় কিনতে যাওয়া? অথবা দুই পঞ্জিকাতেই যদি যাত্রা নাস্তি থাকে, তা হলে সে কি পাওনা টাকা তোলার জন্যে তাগাদায় পাঠাবে না আর আশরাফকে? কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর বাবাকে কোনও প্রশ্ন করা হয় না, বাড়ি ফিরে আরও কত কাজ আফতাবের আর কিছু মনে থাকে না। দোকানেও এই নিয়ে টানা চিন্তা করতে পারে না সে, কী দ্রুত সে সরে যায় অন্য চিন্তাতে। এমনকি, খেয়াল করেছে সে, সঙ্গমের সময়েও মাঝে মাঝে সে শ্লথ হয়ে পড়ে হঠাৎ করে, হিসাবনিকেশের কথা মনে করতে গিয়ে, মনে মনে থান কাপড় মাপতে গিয়ে। দোকানটা বোধহয় দিন-দিন তাকে গ্রাস করছে, দোকান ছাড়া অন্য কিছু থাকতেই চায় না তার মাথার ভেতর।
মাঝারি একটি কাঠালগাছ ছায়া ফেলেছে আফতাব খলিফার দোকানের চালের উপর, ঢালু টিনের চালে কোনও পাতা জমে না, সব পাতা গড়িয়ে পড়ে দোকানঘরের এপাশওপাশ। সে তাই মাঝেমধ্যে বাড়ি থেকে ছাগলটাকে নিয়ে যায় দোকানে। দোকানের ঝাঁপির খুঁটিটার সঙ্গে গলার দড়িটা লম্বা করে বেঁধে রাখে ছাগলটাকে। এইভাবে কাঠালপাতাকে ছাগলের খাদ্য হিসেবে কাজে লাগাতে পারলে আফতাব খলিফার মন শান্তি খুঁজে পায়। সেদিন আর মুসাকে সে গালাগালি করে না। যদিও মুসাকে গালিগালাজই করা উচিত প্রতি মুহূর্তে, বোধহয় এমন কোনও মুহূর্ত নেই যখন সে গালিগালাজ খাওয়ার উপযোগী কাজ করে না। কখনও সে কলারের মাপ ডান বামে দু’রকম করে, কখনও আবার কাপড় খানিকটা বেশি আছে দেখে একটার বদলে দুই-দুইটা ঢাকনাওয়ালা পকেট লাগায়, কখনও বোতামের গাঁত উল্টাপাল্টা করে। এইভাবে মুসা প্রতিদিন ক্লান্তিহীন ভুল করে চলে। অথচ দর্জি-কাজের ডিগ্রি দেখিয়েই মুসা তার দোকানে বছরখানেক আগে চাকরি নিয়েছিল। ঢাকার দর্জিবিজ্ঞান কলেজ থেকে নাকি হাতেনাতে লেখাপড়া শিখেছে, সিমেন্টের বস্তার নাকি খাকিরঙা কাগজ কেটে, সেলাইকলে সেলাই করে জামাকাপড় প্যান্ট বানানোর দীক্ষা নিয়েছে তারা মাস্টারদের কাছে থেকে। কাগজ কেটে কেটে সেলাই করে বানানো অনেকগুলি ওরকম জামাকাপড় প্যান্ট দেখে আফতাব খলিফা সেইদিন মুসার ওপর মুগ্ধ হয়েছিল। ক্লাস করার সময় আর পরীক্ষা দিতে গিয়ে মুসাকে না কি ওইগুলি বানাতে হয়েছিল। ভুলভাল ছিল অবশ্য, কিন্তু তারপরও আফতাব খলিফা সেগুলি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতেই দেখেছিল। ছাত্ররাই তো ভুল করবে, তা ছাড়া কাগজ আর কাপড় তো এক জিনিস না। আর মুসাও তার কাছে ব্যাখ্যা করেছিল, ‘কাগজের উপর সেলাই করা কি এতই সহজ? তাও এইরকম এবড়োথেবড়ো সিমেন্টের কাগজের উপরে? আহ্ চাচা, আপনাকে যদি একবার খালি দেখাতে পারতাম, কাপড় কাইটা কী সুন্দর একটা ব্লাউজ আর ছায়া বানাইছিলাম পরীক্ষার সময়ে!’ ব্লাউজ বানানো তো মুখের কথা নয়, তার ওপর গাঁওগেরামের ব্যাপার, মাপজোঁক করা যায় না কবে কীভাবে একজন একটা ব্লাউজ বানিয়েছিল, সেটি থেকেই যুগের পর যুগ ব্লাউজ বানাচ্ছে আর সব মেয়েরা। নিজেরা তারা কখনোই আসে না এইসব বানাতে। প্যাকেটে ভরে ব্লাউজ-সায়া নিয়ে আসে তাদের বাপ-স্বামীরা। বলে, ঠিক ওইরকমই আরেকটা বানিয়ে দিতে; অথবা, এইটার চেয়ে আধাইঞ্চি কম একখানা, আধাইঞ্চি বেশি একখানা... এরকম আরকি। সায়া তাও বানানো যায়, ভুল হলে ঠিকও করা যায়; কিন্তু আন্দাজ করা সেই মাপজোঁক থেকে ব্লাউজ বানানো কী যে কঠিন! মুসা সেই ব্লাউজ আর ছায়া বানানো জানে শুনে আফতাবের আর হুশ ছিল না, সঙ্গে সঙ্গে তাকে লাগিয়ে দিয়েছিল দোকানের কাজে। এই মুসা, দু’ দিনের মধ্যেই আফতাব বুঝে গিয়েছিল, একটা জিন্দা লাশ কাগজ কেটে বানানো জামাকাপড়ের মতোই ভুলেভালে ভরা তার কাজ, সেলাইয়েও নানা খুঁত, কাপড় কাটতে গেলে তার মাথা কোনদিকে যে যায়, কিছুই তার বোঝা যায় না, শুধু দেখা যায়, কাপড় কাটা ঠিক হয় নাই, গড়বড় হয়ে গেছে, এ জোড়া দিয়ে আর কোনও পোশাক বানানো সম্ভব নয়।
অতএব কাজের চাপ আর কমে নাই আফতাব খলিফার। বরং, এক হিসেবে আরও বেড়েছে। কাপড় সে নিজেই কাটে, আগে যেমন কাটত; কিন্তু এখন কাপড় কাটার পরও টেনশনে থাকে সে। এক চোখে কাপড় কাটে, আরেক চোখে তাকিয়ে থাকে মুসার দিকে কী জানি, সেলাইটাও ভুল করে কি না। ভাগ্য ভালো, সেলাইয়ে এখনও বড়সড় কোনও ভুলভাল করে নাই মুসা। যদিও সম্ভাবনা আছে। হাইস্কুলের মেয়েরা দোকানঘরের ঠিক পেছন দিয়েই আসাযাওয়া করে। সকালেও সে বড়সড় একটা ক্ষতি করেছে কামিজ কাটতে গিয়ে। পারতপক্ষে আশরাফই দোকান খোলে, কিন্তু আজ সে সকাল-সকাল সাতলাঠি গিয়েছিল ফুপুর বাড়ি, এক কাদি শবরি কলা নিয়ে। বাপ নাকি তার বোনকে স্বপ্নে দেখছে কয়দিন ধরে। এ রকম অসংখ্য স্বপ্ন আজকাল তার হালকা ঘুমের মধ্যে দিয়ে চলাফেরা করে, হাসাহাসি করে; যেন ঘাসের চিকন ডগা তার নাকে ঢুকিয়ে দিয়েছে অতীন, তারপর লম্বা দৌড়ে পৌঁছে গেছে বাড়ির পেছন দিকে। অথবা দুঃস্বপ্নের এক দীর্ঘ জগতে সে আর অতীন প্রেত হয়ে গেছে, ভয়ার্ত অমাবস্যার রাতে দোল খাচ্ছে জয়শঙ্করের শূন্য ভিটার তেতুল গাছে। একদিন অতীনের বোন দু বেণী বেঁধে বাঁশবাগানে তার জন্যে অপেক্ষা করেছিল আর তারপরদিন ওদের কাউকেই খুঁজে পায়নি গ্রামের মানুষজন। বাড়িঘর হা হা করছে, খাট-বিছানা আছে, হাড়িপাতিল আছে, কেবল মানুষগুলোই নেই। অতীনের বোনের শাদাধূসর বিড়ালটা সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে আর কখনও তারস্বরে, কখনও মৃদুকণ্ঠে ম্যাঁও ম্যাঁও করছে। ঘরের দুয়ারের কাছে পড়ে আছে একটি লোকনাথ পঞ্জিকা, শেষ মুহূর্তে হয়তো সিদ্ধান্ত পাল্টেছে অতীন, ফেলে গেছে তার পঞ্জিকাটা।
স্বপ্নের ঘোর থেকে বেরিয়ে লোকটা বোনকে খোঁজে, মনে হয় বোনকেই কেবল বলা যায় এইসব স্বপ্নের কথা, ঘোরতর এক শৈশবকাল ফিরে আসার কথা। কিন্তু সে বিছানায় পড়ে গেছে, ঘরে পড়ে গেছে; তার চোখ দিয়ে দর দর করে জল গড়িয়ে পড়ে, সে কেবল কাঁদতে পারে, সে কেবল স্বপ্নের মধ্যে তার বোনকে দেখার কথাই বলতে পারে, অতীন কিংবা অতীনের বোনকে দেখার কথা ঘুণাক্ষরেও বলা হয় না, বললেও তো চিনতে পারবে না কেউ, অতএব আর বলা হয় না। একটু একটু করে স্মৃতি জমাতে শুরু করলে নাতি-নাতনিদের নাকি ব্যাটার বউয়েরই মায়া জন্মায় আশরাফ কাজ ফেলে সাতলাঠিতে যায়, খালি হাতে তো যাওয়া যায় না, কলার ঝাড় থেকে এক মুহূর্তের মধ্যে কেটে নেয় এক কাঁদি কলা নিয়ে। সেই সুবাদে সকালে দোকান খুলেছে মুসা, তারপর নিজের বিদ্যা জাহির করার জন্যে কাচি নিয়ে কাটতে বসেছে উত্তর পাড়ার লতিফের মেয়ের অর্ডার দেয়া ছিট কাপড়ের কামিজ। অনেক ভেবে দেখেছে মুসা, এইভাবে নিজে থেকে ফাঁকতালে দু’একটা কাজ না করলে কোনওদিনই তার আর জামাকাপড় বানানো শেখা হবে না। কিন্তু আড়াই গজের জায়গায় তিন গজ কাপড় নষ্ট করেও মুসা কামিজটাকে আর বাগে আনতে পারে নাই। কাটাকুটি করা তিন গজ কাপড় ঢুকিয়ে দিয়েছে ইঁদুরের গর্তের মধ্যে। রাতে একগাদা কাপড় মাপমতো কেটে রেখে গেছে আফতাব, কিন্তু নয়টা নাগাদ দোকানে এসে দেখে তখনও কোনও কাপড়ে সেলাই চড়ে নাই। দোকানের ছোট বেঞ্চটায় মূর্তির মতো বসে আছে বৃদ্ধ হারান, সঙ্গে সাত বছরের নাতি, তিন দিন হয় জামার জন্যে ঘুরঘুর করছে। এত বেলা হয়ে গেছে, এখনও সব কাজ পড়ে আছে, ঘটনাটা কি? সকাল থেকে মুসা তা হলে কী ঘোড়ার ডিম ভেজেছে? দোকান অবশ্য একেবারে ফিটফাট, এখানেওখানে একটুকরা ফালতু কাপড়ও পড়ে নাই, খালি সামান্য একফালি ছিট কাপড় আটকে আছে সেলাই কলের হ্যান্ডেলের ধারঘেঁসা বক্সটার মধ্যে। যতই পরিষ্কার করুক, দোকান ঝাড়– দিতে এত সময় লাগবে? তখনই সাত বছরের অবুঝ শিশুটা অবরুদ্ধ রাগে রুষে উঠে সমস্যার সমাধান করে দেয়, ‘কাপড় কাইটা কুচি কুচি কইরা এন্দুরের ড্যারার মুখ বুজাইছে!’
এইভাবে আজ আফতাব খলিফার দিন শুরু হয়েছে : প্রথমে চুলার পাড়ে বসা আছিয়ার ক্লান্ত মুখ দেখে বোরিক পাউডারের অভাব অনুভব করে, তারপর তিন গজ কাপড় ইঁদুরের গর্তে ঢুকেছে জেনে। এই মুসাকে বিদায় করে দেয়াই ভালো এবং আজকেই বিদায় করে দেয়া যেত। কিন্তু কেন যেন সে বিদায় করতে পারে না। তা হলে কি মুসা আসায় আসলে সে একটু ভালোই আছে? বন্ধুরা দোকানে এলে সে এখন তাদের সঙ্গে ৫/১০ মিনিট গল্প করতে পারে; কিন্তু তার মানে কি এই যে সে আগের চেয়ে ভালো আছে? ছোট দোকান হলেও কাপড়ের আলমারির পেছনে খানিকটা জায়গা সব সময় ফাঁকা পড়ে থাকে। দোকান আরও বড় করার, আরও কয়েকটা মেশিন বসানোর আর কর্মচারী রাখার সামর্থ্য তার এখনও হয় নাই। ফাঁকা জায়গাটায় তার চেনাজানা বন্ধুরা এসে মাদুরের ওপর আড্ডা জমায়, তাস পেটায় অথবা দাবা খেলে আর আফতাবেরও তা ভালোই লাগে। দাদার মতো ২৩ বছরে নয়, তার বিয়ে হয়েছে বাপের মতোই ১৭/১৮-তে। তারপর এক বছরের মাথায় বাপ হয়ে যাওয়ায় এই জীবনে তার মারা যাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নাই। বয়স না হলেও দাঁড়ি রেখেছে সে, ৩/৪ পোলার বাপ হওয়ার পর দাড়ি না রাখা খুবই খারাপ ব্যাপার, এমনিতেই তারা দর্জি মানুষ, জোলা-দর্জি-কলু হওয়ার মতোই খারাপ ঘটনা দাঁড়ি না রাখা। অতএব দাড়ি রাখে সে, পারতপক্ষে নামাজও পড়ে, তবে বন্ধুরা তার আলমারির পেছনে আড্ডা দিতে এলে ভালো লাগে। এইরকম ছোটখাটো দু’চারটে ভালো লাগা তাকে বাঁচিয়ে রাখে। ছোট ভাই আশরাফের কান বাঁচিয়ে না-বাঁচিয়ে বন্ধুরা তার সঙ্গে তামাশা করে, ‘আহ্ দোস্ত, কতজনের কতরকম মাপের দুধের কাপড় যে হাতাইলা তুমি! হাতাও, হাতাও... যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ... আশ মিটায়া হাতাও...’। শুনে আফতাব খলিফা কিছু বলে না। একটু হাসে। হা হা করে হাসতে গিয়েও নিজেকে গুটিয়ে নেয়। খানিকটা পাপবোধ জাগে, খানিকটা লোভ চাড়া দেয় বন্ধুদের মধ্যে নিজের ভালমানুষী ভাবমূর্তি ধরে রাখার লোভ। অতএব রামগড়–রের ছানা হয়ে সে গজফিতা নিয়ে মনযোগ দিয়ে মাপজোঁক করে, কাপড় কাটে এবং খুব সহজেই ভুলে থাকে, হাইস্কুলের মেয়েগুলো যে-কোনওদিন স্কুল শুরুর আগে অথবা পরে হানা দিতে পারে। দল বেঁধে প্রায় নিঃশব্দে তারা দোকানে ঢোকে, কিন্তু একমুহূর্তেই সারা দোকান তাদের কলকলানিতে ভরে ওঠে। পোশাক বানানোর সামর্থ্য তাদের নেই বললেই চলে, কিন্তু প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার তারা দেখে নেয় নতুন আসা কাপড়ের থানগুলো। একরঙা নয়, ছিট কাপড়ই ভালোবাসে তারা আর তার সঙ্গে সালোয়ার হিসেবে একরঙা কোন কাপড়টা ভালো মানাবে, তাই নিয়ে ফিসফিসিয়ে কথা বলে চলে।
আফতাব খলিফা সড়ক থেকে আলপথে নেমে পড়ে। রোদ আজ আর নামবে না মনে হয়। পিঠটার সঙ্গে ফতুয়া লেপটে গেছে আর শিড়দাঁড়া বরাবর চুলবুল করছে। সকালে মুসাকে গালি দেয়ার জন্যে খারাপ লাগছে এখন। বিকেলে মুসাকে ভালো করে বুঝিয়ে বলতে হবে। আর, আর পঞ্জিকার কথাটা বাপকে আজই জিজ্ঞেস করতে হবে। সামনে নতুন বছর এলো বলে, এবার সে একটু সঞ্চয়ী হবে, দোকানটার মেঝে না হোক, বাড়ির মেঝে পাকা করা দরকার। নাকি দোকানের মেঝেই আগে পাকা করবে? যাই হোক, তেমন কোনও কারণ না থাকলে দু’টার বদলে সে এ বছর না হয় পঞ্জিকা একটাই কিনবে।
খেতে বসে আফতাব খলিফা প্রতিদিনের মতোই গৎবাঁধা প্রশ্ন করে, ‘আর সবে খাইছে?’
আর আছিয়াও গৎবাঁধা উত্তর দেয়, ‘খাইছে।’
মা মারা যাওয়ার ক’দিন পর দুপুরের খাওয়ার সময় থেকে এই প্রশ্ন করতে শুরু করে আফতাব। তারপর সাত বছর চলে গেছে, একদিনের জন্যেও এই প্রশ্ন আর বাদ যায় নাই। বিড়ালের ভারি উৎপাত, আছিয়া তাই রান্নার পাতিল সব শিকায় তুলে রাখে, খাওয়ার সময় আবার নামায়, যেমন এখন নামিয়েছে। তার চোখে কোনও প্রশ্ন নাই, কোনও উত্তাপও নাই। পায়েরগুলি কাটতে হলেও হাতের নখ তার কোনওদিনই কাটবার দরকার পড়ে না, কাটার উপযোগী হওয়ার আগেই পাতিল-থালাবাসন মাজতে গিয়ে অ্যালুমিনিয়ামের ঘসায় ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়। আফতাব খেতে খেতে একবার সেইসব নখ দেখে। আছিয়া বোধহয় টের পায়, তাই তাড়াতাড়ি হাতগুলো আঁচলের আড়াল করে। বিড়ালটা কোত্থেকে এসে ঘুরঘুর করতে থাকে, কখনও মোলায়েম করুণ স্বরে ম্যাঁ ম্যাঁ করে, কখনো আক্রোশ ভরে ম্যাঁ ম্যাঁ করে, কিন্তু আফতাব কিছুই দেয় না তাকে, বরং মাছের কাটাগুলো সযত্নে পাতের কোণে রেখে দেয় খাওয়া শেষে ঘরের বাইরে বসে থাকা কুকুরটার সামনে দেবে বলে। বিড়ালকে খেতে দিয়ে কী লাভ হবে? ভরা পেটে বিড়াল কখনও ইঁদুর খোঁজে না। তারচেয়ে থাকুক খালি পেটে। বাড়িতে এত ইঁদুর, এত চিকা দরকার হলে শিকার করুক। তারচেয়ে কুকুরকে খেতে দেয়া অনেক ভালো। কুকুর আর বেড়ালসংক্রান্ত এই খাদ্যতত্ত্ব অনেক আগে থেকেই মেনে চলে সে। খেতে খেতে সারা শরীরে তার রাজ্যের ক্লান্তি নামে। খাওয়ার পর একটু না শুয়ে থাকতে পারে না সে। বাইরের ঘরে বাপের চকির উল্টো দিকে দিনের বেলা এখানেই শোয় সে । আশরাফের চকির ওপর সে শুয়ে থাকে টান হয়ে। চিন্তা করে, মুসাকে নিয়ে কী করা যায়। দর্জি কলেজে লেখাপড়া করেছে শুনে চোখকান বুজে তিনশ’ টাকা বেতনে কাজ দেয়া ঠিক হয় নাই, কয়েকদিন আসাযাওয়া করতে বলা উচিত ছিল। এখন হুট করে বিদায় করে দেয়াটা খারাপ দেখায়, আবার কাজকর্ম না জানা মানুষ রেখে মাসে মাসে তিনশ’ টাকা নষ্ট করার কোনও মানে নাই। আশরাফকেই তো সে তিনশ’ টাকা দিতে পারে না। একান্নবর্তী সংসার, আশরাফকে কোনও টাকা দিতে হয় না, আশরাফ দোকানেই কাজ করে আর খাওয়াদাওয়া করে, যতদিন বিয়ে না হয় ততদিন এভাবেই চলবে। বিয়ে হলো সর্বনাশা ঘটনা, বিয়ের পর দোকানপাটের হিশেব অন্যরকম হয়ে যাবে। এই দোকান কি এক থাকবে? না কি দুই ভাগ হয়ে যাবে? সে ভেবে পায় না।
আফতাব চকির ওপর গড়াগড়ি খায় আর বাবাকে দেখে। বাবাও বোধহয় তার দিকে তাকিয়ে আছে। আবারও জিজ্ঞেস করে বসবে নাকি, টাকাপয়সা কিছু জমেছে কি না? আফতাব প্রমাদ গোণে। কয়মাস হলো এই এক ঝামেলায় আছে সে, বাপ এখন দেখতে চায়, দোকানের আয়ে একটা কিছু করতে পেরেছে সে। দোকানে যাওয়া দূরে থাক, কত বছর হয়ে গেল, বাপে আর বাড়ির বাইরেই যেতে পারে না। কিন্তু না গেলেও তার কত কথা। আয় তো এখন আরও বাড়ার কথা মানুষ বেড়েছে, রেডিওতে দৈনিক জনসংখ্যার স্রোত থামানোর জন্যে কতরকম পরামর্শ দেয়া হচ্ছে এত মানুষজন। এরা কি জামাকাপড় কিছুই পরে না? নিশ্চয়ই পরে; জামাকাপড় বানায়, জামাকাপড় পরে। তা হলে আয় কেন বাড়বে না? মানুষও তো বাড়ে নাই এই সংসারে নতুন করে! বুড়ো মানুষজনের এই এক দোষ, তালগোল পাকিয়ে ফেলে; সংসারে মানুষ বাড়ে নাই হয়তো, কিন্তু মানুষজন তো বেড়েছে, আর জিনিসপত্রের দরদামও তো আকাশ ছুঁই-ছুঁই করছে। ওদিকে খানিকটা জমি যে আছে, তারও আবাদ তো মার গেল পরপর কয়েক বছর ধরে। তা হলে টাকাপয়সা আর জমে কেমন করে। দৈনিক যে বাজার থেকে খানিকটা মাছ কিনে বাড়িতে পাঠানো যায়, এটাই তো খোদার কাছে হাজার শোকর! অতএব আফতাব খলিফা বাপের দিক থেকে চোখটা ফিরিয়ে নেয়। আবার আড়চোখে তাকিয়ে দেখে, বাপ সত্যিই কিছু জানতে চাইবে কি না। কিন্তু সেরকম আর মনে হয় না। মানে বাপ শুয়ে থাকে এবং খোলা চোখে দুনিয়াটা দেখে, কিন্তু কিছু বোধহয় তার আর জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে জাগে না।
অতএব বাড়িতে দুপুরের ঘন্টাখানেক সময় আফতাব খলিফার নিশ্চিন্তেই কাটে। তবে একসময় ধড়মড় করে উঠে বসে বিছানাতে। যদিও কোনও খারাপ স্বপ্ন দেখে নাই। আসলে তাড়াতাড়ি দোকানে যেতে হবে, দোকানে গিয়ে আসরের নামাজটা পড়ে নেবে, অতএব সে তাড়াতাড়ি উঠে অজু করে নেয়। তারপর নইমটকা কেনার জন্যে একটা টাকা চাইতে আসা বাচ্চা মেয়েটাকে হাত দিয়ে ঠেলে সে আছিয়ার উদ্দেশে ‘গেলাম’ বলে বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়ে। এইভাবে ঠেলা খাওয়ার বেদনায় মেয়েটি তারস্বরে কাঁদতে থাকে আর তার দাদা বিছানায় শুয়ে ভাবে, আবারও বোধহয় অতীন তার ছোটবোনকে মারধর করেছে। কিন্তু অতীন তো চলে গেছে। আফতাবের বাপে ধড়মড় করে উঠে বসতে চায় এবং মনে পড়ে এখন আর আগের মতো সে একা-একা ওঠানামাও করতে পারে না। এখন ঘর জুড়ে মৃদু অ্যামোনিয়ার গন্ধ অথবা মৃত্যুর জলস্রোত। পঞ্জিকা খুলে তার দেখে নিতে ইচ্ছে করে আজকের দিনটিকে। ভালো থাকার সময় তো প্রতিদিনই দেখে নিতে পারত। অতীনদের বাড়িতে পড়ে ছিল পঞ্জিকাটা সে সেটা কুড়িয়ে এনেছিল, বাপকে দেখিয়েছিল আর বাপ তাকে শিখিয়েছিল অমাবস্যা, শিখিয়েছিল পূর্ণিমা রাত, শিখিয়েছিল তিথি, নক্ষত্রামৃতযোগ এইসব। সেই থেকে প্রতি বছর একটা করে লোকনাথ পঞ্জিকাও কেনা হতো। কাজের ফাঁকে সেটা দেখতে দেখতে সে জানতে পারত, আজ অতীনরা পূজা করছে, আজ অতীনের বোন নিশ্চয়ই উপবাস করবে, আজ তো দেখি ভাইফোঁটার দিন... আচ্ছা, আফতাব কি পঞ্জিকা দুটোই রাখে? না কি একটা কেনা বাদ দিয়েছে? হয়তো কেনে, এই ক্ষীণ আশা নিয়ে বাপে আফতাবকে ডাক দেয়ার চেষ্টা করে, বলতে চায় পঞ্জিকাটা বাড়িতে নিয়ে আসতে, যাতে সে দেখে নিতে পারে অতীনরা এখন ওই পারে, নির্বান্ধব ওই পারে কী করছে, তারপর একটি শীর্ণ শ্বাস খুব ভেতর থেকে উঠে আসতে গিয়েও গলায় আটকে গেলে বুঝতে পারে এইসবের আর দরকার হবে না। সে এখন মারা যাচ্ছে। হয়তো অতীন অথবা অতীনের বোনও মারা গেছে। হয়তো এবার তাদের সঙ্গে তার অনেক-অনেক দিন বাদে দেখা হবে।
আফতাব খলিফা ততক্ষণে অর্ধেক রাস্তা পাড়ি দিয়েছে। রাস্তার ধারে কড়িগাছের নিচে ফের ছায়া জমেছে, সেখানে গিয়ে তার মনে পড়ে, এহ্, আজকেও বাপকে জিজ্ঞেস করা হলো না, দুইটা পঞ্জিকা রাখার দরকার আছে নাকি!
রাতে না হয় কাল সকালে অবশ্যই জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে হবে।
0 মন্তব্যসমূহ