নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী'র গল্প : মেঘ কালো


১ 

জাতীয় সড়ক। নাম যশোর রোড। এয়ারপোর্ট থেকে উত্তরদিকে বেঁকে সোজা চলে গেছে বনগাঁ। বনগাঁ বর্ডার পেরিয়ে এই পথ এসে পড়েছে বাংলাদেশের যশোরে। ঝকঝকে এয়ারপোর্ট থেকে পাঁচ সাত কিলোমিটার পথ পেরোলেই চারিদিকের পরিবেশটা ক্রমশ বদলে যেতে থাকে। শহরের চকচকে প্রলেপ হারিয়ে রাস্তায় তখন আধা মফস্বল শহরের ছাপ ফুটে উঠতে থাকে। 

নিউব্যারাকপুর স্টেশানের গায়ে সুবিশাল একটা মজা খাল, তার নাম দোয়ানিয়া খাল। তার দুধারে বিস্তৃত জায়গা জুড়ে বাংলাদেশের উদ্বাস্তু কলোনি। একাত্তরের আগে থেকে এরা এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। খালের খানিকটা দূরের শীতলা মন্দির বাঁয়ে ফেলে এগিয়ে আসতে হবে আরও খান কয়েক গলিপথ। এখানেই থাকে বাসনা, মালতী আর কমলারা। উঁচু পাঁচিল ঘেরা সুবিশাল এক আমবাগানের মধ্যে। না না, এটা বাসনাদের নিজেদের বাগানবাড়ি নয়। সেখানে বাসনা ও মালতীকে নিয়ে থাকে ওদের মা, কমলা। ওরা এই বাগানের আশ্রিত। কেয়ারটেকার পরিচয়ে এখানে বাস করছে প্রায় দশ বছর। 

নিউব্যারাকপুর, বাদু ও মধ্যমগ্রামে এমন ফল বাগানের ছড়াছড়ি ছিল আরও আটদশটা বছর আগে, কিন্তু এখন দিনকাল পাল্টেছে। এখানেও শুরু হয়েছে ফ্ল্যাট ব্যবসা। হু হু করে এখানে জমির দাম বাড়ছে। বাগানবাড়িগুলো দ্রুত বদলে গিয়ে তৈরি হচ্ছে হাইরাইজ। বাসনাদের বাগানের কাছাকাছি আরও দুটো ছোটো ও বড়ো বাগান বিক্রি হয়ে গেছে। এই বাগানবাড়িটা শরিকি বিবাদে এখনও টিকে আছে, বিক্রি হয়নি। বিক্রি হয়ে গেলে বাসনাদের রাতারাতি অন্য জায়গা দেখে নিতে হবে। 

বাগানের জং ধরা লোহার বিরাট গেটটা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো ভুতো। হাতের বিড়িটায় একটা জোরে টান দিল তারপর থুপ করে একদলা থুতু ফেলল সামনের ভ্যারেন্ডা ঝোপের উপর। বর্ষার জল পেয়ে ঝোপের গাছগুলোতে তারার মতো অসংখ্য ফুল এসেছে, খুব ছোটো ছোটো লাল রংয়ের এই ফুল। গাঢ় সবুজ পাতার ফাঁকে লাল ফুলে ভরা গাছগুলো এখন অসামান্য রূপসী। ভুতো সেদিকে তাকিয়ে অনাবশ্যক গাছের একটা ডাল ভেঙে নিল। তারপর সেটাকে হাতে নিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে ওদের আড্ডার ঠেকে গিয়ে বসলো। একতলা বাড়িটা এখন বহুদিন বন্ধ। সামনের অপরিসর বারান্দায় শুকনো নারকেল পাতা ও কিছু জ্বালানির কাঠ স্তুপ করে রাখা। বাড়িটার সামনে একটা দেশি আমড়া গাছে অজস্র আমড়া ফলেছে। একদিন কিছু আমড়া নিয়ে যেতে হবে, ভাবলো ভুতো। আমড়া দিয়ে টক ডাল, তাতে একটু কাঁচা লঙ্কা ডলে নিয়ে! আহ্! 

বাগানটা এখন বেওয়ারিশ অবস্থায় আছে, তা ভালো করেই জানে ভুতো। সে নারকেল পাতার স্তুপের তলায় হাত গলিয়ে সন্তর্পণে একটা বাংলার বোতল বের করে আনলো। পরক্ষণেই কার একটা পায়ের শব্দ পেয়ে সতর্ক চোখে চারদিক দেখে নিল। রঙ্গন এসে দাঁড়িয়েছে। রঙ্গন মুখে একটা অশ্লীল ভঙ্গি করে বলল, 
'এখনই শুরু করবে?' 

ভুতো বিরক্ত স্বরে বলল, 
'বাবাইয়ের জন্য বসে আছি। শালা! মেয়েছেলের মত হাঁটে! আধঘন্টা আগে ডেকে এসেছি, এখনও এদিকে আসার নাম নেই। 


২ 

বছর দশেক আগে বাগানের মালিকদের সঙ্গে পরিচিতির সুবাদে, সুবল মাইতি বাগানের পেছন দিকে একটা ঝুপড়ি বেঁধে থাকতে শুরু করে। দরমার বেড়া, মাটির গাঁথনির ছোট্ট পাকাপোক্ত বাড়ি। মাঝে কাঠের খুঁটির সাহায্যে তিনটে ছোটো খুপড়ি, অর্থাৎ তিনটে কামরা। সুবল প্রতিভাবান মানুষ। তাছাড়া সব বয়সের সব ধরণের মানুষের সঙ্গে সে খুব সহজেই মিশতে পারে। নানা রকম হাতের কাজও এই বিভিন্ন মানুষ ঘেঁটেই শিখে নেওয়া তার। 

অনাথ মিশুকে সুবলের সঙ্গে কমলার মা, প্রতিমার আলাপ জমে উঠেছিল হঠাৎই। একবার এক বিয়েবাড়ির রান্নার দায়িত্ব পড়েছিল কমলার মায়ের উপর। সুবল সেখানে ছিল জোগাড়ের দায়িত্বে। সেখানে সুবলের ব্যবহারে একেবারে মুগ্ধ হয়ে যায় প্রতিমা, তাই তার বাপ মরা মেয়েটাকে সুবলের হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছিল সে। মেয়ের বিয়ে দিয়ে সে নিশ্চিন্তে বর্ডার পেরিয়ে নিজের দেশ যশোরে ফিরে যায়। 

বিরাট বড় বাগানে নিজের ঘর সংসার দেখে বিয়ের পর এসেই কমলা একেবারে মুগ্ধ হয়ে যায়। সে যেন তার বাংলাদেশের গ্রামের সেই চেনা পরিবেশ ফিরে পেল। ঘরের পাশেই একটা টলটলে জলে ভরা পুকুর। বাগানটা আসলে ফলেরই বাগান, কাঠ হিসেবে দাম পাবার জন্যও অবশ্য গাছ আছে দু চারটে, তবে ফলের গাছই বাগানে বেশি। এটাই এই অঞ্চলের দস্তুর। বাদু রোডের ধার বরাবর ডাইনে বায়ে এখনও এমন ফলবাগান চোখে পড়ে। 

বাগানে ফলের মধ্যে আমগাছই বেশি। আর আছে তাল, নারকেল, বেল, চালতা, ফলসা, কতবেল, আমড়া, আতা, পেয়ারা, জামরুল, লিচু, জাম, সবেদা--- বাদ নেই কিছু। বড় বড় গাছের ছায়ায় বাগানের মাটি নরম আর ভেজা ভেজা। 

কমলা আগ্রহ করে বাগানে ঘুরে ঘুরে কালো কচুর কচি পাতা, ঘ্যাঁটকোলের কচি পাতা তুলে এনে নারকোল কুড়িয়ে কাঁচা লঙ্কা দিয়ে বেটে রাখত। দিনে বাগান থেকে কিছু না কিছু খাবার উপাদান সংগ্রহ করত কমলা। কমলা আর সুবল দুজনেই করিতকর্মা। ফল পাকলে মালিকের বাড়িতে পাঠিয়ে দিত সে। বাকিটা বিক্রি করে দিত সাবধানে। বাগানের পাঁচিল থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে একটা বখাটে ছেলেদের ক্লাব। ওরা মাঝে মাঝে বাগানে এসে ঝামেলা পাকালে সুবল একাই হাসিমুখে সব সামলে নিত। এমন করে বিয়ের পর কমলার দিন বেশ শান্তিতেই কাটছিল। বিয়ের পর পরই বড় মেয়ে বাসনা হল। সুবল এই সময় ভ্যান চালাতে শুরু করল, তাই সংসার চালাতেও কষ্ট হচ্ছিল না। 

স্বভাব বাউণ্ডুলে সুবল যে সংসারে থাকতে থাকতে মন থেকে হাঁপিয়ে উঠেছিল, তা কমলা কখনও বুঝতে পারেনি। সুবলের নেশা বিভিন্ন গাছপালা ঘেঁটে মলম, ওষুধ এইসব বানানো। ছোটবেলায় এমনটা সে শিখেছিল তার বাবার কাছ থেকে। জাদু মলম, বাত ও অম্বলের পাঁচন, হজমের গুলি এইসব নিয়ে তার বাবা দূরপাল্লার ট্রেনে ট্রেনে বিক্রি করত। তার একটা বড় দোকান করারও ইচ্ছে ছিল স্টেশানে। যেখানে নানা রকম ভেষজ ওষুধ পাওয়া যাবে। সে সব আর হয়ে ওঠেনি কখনও। সুবলের নেশা বিচিত্র মানুষে ভরা পৃথিবীর গাঁ গঞ্জে ঘুরে বেড়ানো। ঘুরে ঘুরে গাছপালা দিয়ে তৈরি ওষুধ বিক্রি করতে চায় সে। সুবলের মধ্যে বাস করে এক বিচিত্র অভিযাত্রী মন। 

বাসনার তখন ছ' বছর বয়স। সুবল তাকে তখন থেকেই নিয়ে বাগানের গাছপালার সঙ্গে পরিচয় করাতে লাগল, যেন পারিবারিক উত্তরসূরি তৈরি করে দিতে চায় সে। বাসনারও এইসবে খুব আগ্রহ। সারাদিন বাগানে টইটই করতেই তো সে চায়। 

বছরের শুরুতে বাসনাকে স্কুলে ভর্তি করে দেবে বলেছিল সুবল। কিন্তু বাসনার আর স্কুলে যাওয়া হল না। হঠাৎ ওষুধ তৈরির সব সাজসরঞ্জাম নিয়ে সুবল নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। ছোটো মেয়ে মালতী তখন সবে জন্মেছে আর বাসনার বয়স সাড়ে ছ' বছর। 

বাবাকে খুব মনে পড়ে বাসনার। কত গাছ, কত পাখি তাকে চিনিয়েছিল বাবা। একদিন ঝোপের ভেতর কুবো পাখির বাসা দেখে বাসনা উত্তেজিত হয়ে সুবলকে ডেকে আনে--- ''বাবা ওই পাখিটা ধরে দাও না!' 

সুবল হেসে বলেছিল, 'কী করবে?' 

-আমি পুষবো বাবা। 

-কেন? এই তো কী সুন্দর খোলা ঝোপে খেলে বেড়াচ্ছে। ওকে তুমি ধরো না। তোমার মা দেখতে পেলেই এটাকে কেটে রান্না করবে। জানো, এই পাখি খুব বোকা। বেশি জোরে উড়তেও পারে না। দেখো কী সুন্দর বাদামী রংয়ের পালক! আর লাল চোখ। কুব কুব করে ডাকে বলে ওকে বলে কুবো পাখি। এই যে এত ফল গাছ, ওরা কত বিষাক্ত পোকা খেয়ে গাছগুলো ভালো রাখে। আর ফল হলে আমরা খাই, তাই না? তাহলে তো ওরা আমাদের বন্ধু হল! 

এভাবে হলুদ শালিক অর্থাৎ বেনেবউ পাখিও চেনা হয়েছিল বাসনার। বাবা জাদু মলম তৈরি করাও তাকে শিখিয়ে দিয়ে গেছে। বলে গেছে, 'এই মলম তৈরি কিন্তু কাউকে শেখাবে না। নাহলে আর কেউ একে জাদু মলম বলবে না। আর আমাদের কাছেও কিনতে আসবে না।' 

দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে বাসনার মুখস্থ হয়ে গেছে। লোহার কড়াইতে সর্ষের তেল আর মৌমাছির মোম গরম করতে হবে। তাতে দিতে হবে চার ভাগ ইউক্যালিপটাসের পাতা, দু-ভাগ রসুন, দু-ভাগ ধুতরো পাতা আর দু-ভাগ নিশিন্দা পাতার রস। তারপর অনেকক্ষণ জ্বাল দিয়ে ঘন হয়ে এলে ছেঁকে ঠাণ্ডা করলেই তৈরি হবে জাদু মলম। ওতে মাথা-ব্যথা, গা-ব্যথা, দাঁদ, হাজা, চুলকানি, পা-ফাটা সব সেরে যায়। যজ্ঞডুমুরের পাতা আর সোহাগা থেকে দাঁতের মাজন আর নিশিন্দা আর ধুতরো পাতা দিয়ে বাতের তেল বানানোও মনে আছে বাসনার। বাবা না থাকায় বাগানের চারদিক আগাছায় ভরে গেছে। বাগান মালিকদের দালানবাড়ির বন্ধ দরজার বাইরের বারান্দায় এখন ভুতো কাকুরা রোজ নেশা করতে আসে। ফল পাকলে ঝগড়া করে এসে কেড়ে নিয়ে যায়। মা বললেও শোনে না। মালিকেরাও অনেকদিন এখানে কেউ আসে না। মা বলছিল, ওদের বাড়ির বড় কর্তা নাকি হঠাৎ মারা গেছেন। 

তিনদিন ধরে টানা বৃষ্টি পড়ছে। বাড়ির পাশের পুকুরটা এই তিন বছরে সংস্কারের অভাবে মজে এসেছে। অজস্র পানায় ভরে জল দেখা যায় না। তাতে বৃষ্টির ফোটা পড়লেও বোঝা যায় না। বাসনার বয়স এখন ন' বছর। তবে ওকে দেখলে আরও ছোটো মনে হয়। বোন হওয়ার পর থেকেই মায়ের শরীর খুব খারাপ, ভালো করে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারে না। সংসার চালানোর দায়িত্ব এখন একলা বাসনার উপর। পরিস্থিতির চাপে বাসনার শৈশবটাও যেন কেমন দরকচা হয়ে গেছে। ওর রোগা ছোট্ট শরীর আর শুকনো মুখে সবসময় একটা নির্লিপ্ত ভাব। 

এই তিনদিন বাসনাদের ভাত রান্না হয়নি। বোনটা সকাল থেকে একঘেয়ে সুরে কেঁদে চলেছে। ঘরের চাল থেকে জল পড়ছে বলে কমলা কাঁথা গায়ে দিয়ে বিছানার একদিকে একটু সরে শুয়েছিল। গতকাল বাসনা একটা কাঁঠাল পেয়েছিল, তাতে হালকা পাক ধরেছে। বাসনা বস্তা ঢাকা দিয়ে রেখেছিল পাকার জন্য। ঘরের বাতাসে এখন সেই পাকা কাঁঠালের গন্ধ। বাসনার বোন মালতী সেই কাঁঠালটা খাওয়ার বায়না ধরেছে। বাসনা একটু মুড়ি জোগাড় করার কথা ভাবছিল। বাগান থেকে কিছু একটা জোটাতে পারলে ক'টা দিন তাও চলে যাবে। যদি একটা পাকা তালও পাওয়া যায়, তাহলে বেশ ভালো দাম পাওয়া যাবে। এই বাগানের একটা তালগাছের তালগুলো দারুণ মিষ্টি। কুচকুচে কালো এই তালগুলোর নীচের দিকটায় কমলা ছাপ। এই তাল বাজারে সবাই ভালো দামে কেনে। যদি নগদ পয়সা পাওয়া যায়, তাহলে বাসনা চাল নাহলে মুড়ি কিনে নিয়ে ঢুকবে। এই তিনদিন পেয়ারা, জামরুল, কচু সেদ্ধ আর খেসারির ডাল ভেজানো খেয়ে চলছে তাদের। এভাবে চললে বোন আর মা বোধহয় মরেই যাবে। বাসনা আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল, এই বৃষ্টি আজ মনে হয় থামবে না! তারপর মুষল ধারাপাতের মধ্যেই বাগানের দিকে ছুট লাগালো। 
ভুতো আর রঙ্গন অনেকক্ষণ ধরে বাবাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছে। ওরা সবাই একসঙ্গে বসে মোবাইল ঘাঁটে। বাবাইয়ের একটা অ্যান্ড্রয়েড সেট আছে। ওটাতে ফোর-জি ডেটা ব্যালেন্স ভরে মেয়েদের নানা রকম ছবি দেখে ওরা। 

সকাল থেকে বৃষ্টি। মন মেজাজ একদম খিঁচড়ে আছে ভুতোর। বাড়িতে নিত্য অশান্তি। এক চিলতে বারান্দা আর দুটো স্যাঁতস্যাঁতে ঘরের ভাড়ার বাড়ি। বাবা মারা যাওয়ার পর দাদা বাড়ির সামনে একটা পান বিড়ির দোকান দিয়েছে। দোকানটা দাদা শ্বশুরের পয়সায় করেছে, ওরা দু' ভাই দোকানে পালা করে বসে। সকালে ভুতোর পালা। আজ সারাদিন বিক্রিবাটা একেবারেই নেই। বারোটায় দোকান বন্ধ করে দিয়ে বাগানের বারান্দায় ওদের নিজস্ব আড্ডার ঠেকে এসে বসেছে ভুতো। আসার সময় বাবাই আর রঙ্গনকে ডাক দিয়ে এসেছে। অলিখিত নিয়ম হল, বাবাই এবার আড্ডার ঠেকে ওর দামি ফোনটা নিয়ে চলে আসবে। ডাক শুনে রঙ্গন আগেই চলে এসেছে, কিন্তু বাবাইয়ের দেখা নেই। 

বাড়িতে টাকা পয়সা নিয়ে দাদা-মা-বউদির অশান্তি চলে সারাদিন ধরে। বাড়িতে দুটো ঘর। একটাতে দাদা বউদি আর তিন মাসের ভাইপো। অন্য ঘরটায় ভুতো মায়ের সঙ্গে থাকে। রাত বিরেতে মনের সুখে একটা বিড়িতেও সুখটান দিতে পারে না সে। তার বছর পঁয়ত্রিশের জীবনে একটাই আনন্দ, মোবাইলে বাছাই করা মেয়েদের ছবি দেখা। বিয়ের কথা কেবল ভাবাই সার! দোকানে বসে মাসের শেষে সামান্য হাতখরচ পায় সে। তার সঙ্গে উপরি হিসেবে জোটে বউদির ঠেস মারা কথা। ক্লাস এইটের পরে এ পাড়ার অনেকে মত তারও সর্বনাশের মূল, গাঁজার নেশা। পড়াশুনো আর এগোয়নি। এখন সারাদিনই অখণ্ড অবসর। সকালে দু-তিন ঘন্টা দোকানে বসা ছাড়া সারাদিনে আর কোনো কাজ নেই। রঙ্গনটার বাপের টাকা আছে, কিন্তু ব্যাটা হাড়কিপটে। বাবাইয়ের পেটে আবার বিদ্যে আছে। সায়ন্স নিয়ে টুয়েলভ পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছে। তবে কলেজের খাতায় নাম লেখানোই সার, বাবাই কলেজে যায় কচ্চিৎ কদাচিৎ। বাগানে গিয়ে মাঝে মাঝে ফলের ভাগ নিয়ে হুজ্জুতি করতে ভুতোর বেশ ভালোই লাগে। নিজের রংহীন জীবনটা বেশ টান টান হয়ে ওঠে তখন। 

বাবাই হঠাৎ এসে পড়তেই, আনন্দে রঙ্গন শিস্ দিয়ে উঠল। ভুতো নারকোল পাতার তলা থেকে বোতলটা বের করে দেখাল। বাবাই হাতের একটা কদর্য ইঙ্গিত করল, 

'আরে বাঁড়া! সক্কাল সক্কাল শুরু করবি?' 

রঙ্গন বলল, 

'তবে কী? বৃষ্টিতে গা গতর ব্যথা না! 

তিনজনেই খ্যা খ্যা করে বেশ কিছুক্ষণ হাসল। ইউটিউব থেকে একটা বাছাই ভিডিও বের করে, তিনজনে গা ঘেঁষাঘেষি করে বসল। স্বল্পবসনা এক সুন্দরী গানের তালে তালে তার পোশাক উন্মোচিত করছে, আর ওরা তিনজন মুগ্ধ চোখে তা দেখছে। ওদের আশা পূর্ণ হওয়ার আগেই, অর্থাৎ সুন্দরী সম্পূর্ণ উন্মোচিত হবার আগেই শ্লো নেট একেবারে জবাব দিয়ে দিল। ভিডিও বন্ধ হয়ে গেল, বৃষ্টির জন্য সার্ভারের সমস্যায়। 


৩ 

কমলার যখন বিয়ে হয়, ওর বয়স ছিল উনিশ। ফর্সা রং, মুখ চোখও বেশ সুন্দর। আঁটোসাটো শরীরের গড়ন। এখন বিয়ের দশ বছর পর কমলার বয়স যেন তিনগুন বেড়ে গেছে। বাসনা হওয়ার পর থেকেই শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না কমলার। অম্বলের রোগে রোগে গায়ের রংটাও যেন কেমন কালচে পড়ে গেছিল। ছোটো মেয়ে মালতী যখন হল, তখন থেকেই সুবল বারমুখো। মাঝে মাঝে ট্রেনে করে ইদিকে ওদিকে, গ্রামের ভেতরে ভেষজ ওষুধ বেচতে চলে যেত। ফিরত দু' তিনদিন পর পর। কমলা বুঝেছিল, সুবলের মন আর সংসারে নেই। কমলাকে নানা রকম মেয়েলি অসুখে ধরল তখন থেকেই। চিকিৎসার অভাবে ও উপর্যুপরি টোটকা খেয়ে রোগ বেড়ে চলল ক্রমাগত। 

এখন সে যেন এক জীবন্ত লাশ। নিরানন্দ নিষ্প্রাণ মুখ। ফ্যাকাশে হলদে গায়ের রং। হাত পা ফোলা ফোলা। চোখ কোটরে ঢোকা, হনুর হাড় দুটো উঁচু হয়ে মুখের শ্রী নষ্ট হয়ে গেছে। মানসিকভাবে একদম ভালো নেই কমলা। তার স্থির বিশ্বাস অসুস্থ নির্জীব কমলাকে ফেলে সুবল নতুন সংসার পেতেছে। তবুও মন তার দোলাচল ছাড়তে পারে না। বারবার মনে হয়, একদিন সুবল ঠিক ফিরে আসবে। মানুষটা এমন অবিবেচক হতেই পারে না। সুবল এসে ঘরের চালটা সারাবে। পুকুরটা পরিষ্কার করে আবার মাছের চারা ফেলবে। তখন কমলার অসুখও কোন এক জাদুমন্ত্রে সেরে যাবে। নতুন শাড়ি পরে সে কাঠকুটো জ্বেলে মাছ রান্না করবে। গরম ভাত আর মাছের ঝোলের গন্ধে চারদিক ম-ম করবে। প্রতিদিন সকালেই সে এক নতুন আশায় দিনটা শুরু করে। ধীরে ধীরে দিন শেষে তার মনে আসে হতাশা আর ক্লান্তি। সে একটু বেলা হলেই বিছানায় এসে শুয়ে থাকে। তার উঠে বসতেও ইচ্ছে করে না। এর জন্য তার শরীর যতটা না দায়ী, মন তার থেকে অনেক বেশি দায়ী। 

বিয়ের পরের দিনগুলো কমলার খুব মনে পড়ে। মানুষটা বড় ভালোমানুষ ছিল। কোনো সময় উঁচু গলায় কথা বলেনি কমলার সঙ্গে, রাগ বলে বস্তুটা যেন ছিল না মানুষটার, আর কী কাজটা সে জানত না, তাই ভাবতে বসতে হয়। খেঁজুর পাতা দিয়ে চাটাই বোনা থেকে শুরু করে বাঁশের কঞ্চি কাঠি দিয়ে ঘুনি বোনা, ঝাড়ু বাঁধা, ঘর বানানো, কত রকম গাছপালাও চিনতো লোকটা! 

একবার তেতো কালমেঘ পাতার রস মাথায় লাগিয়ে দিয়ে তার মাথার অবাধ্য উকুন শেষ পর্যন্ত সারিয়ে ছেড়েছিল। আর জানতো সে রান্না! একেবারে মেয়েমানুষও লজ্জা পাবে ওর কাছে। কত কথা! এখনও যেন মনে হয় কালকের ঘটনা! 

বাসনা তখন পেটে, ভরা মাস। হঠাৎ একদিন সুবলের খেয়াল চাপলো কমলাকে কোনো কাজ করতে দেবে না। চৌকির ওপর ওকে বসিয়ে রেখে, চা বানিয়ে আনলো সকাল সকাল। বলল, 

'আজ তোমার ছুটি। কোনও কাজে হাত দেবে না।' 

কমলা তো হেসে মরে। সুবল শান্ত স্বরে বলেছিল, 

'হাসছো কেন? সারাবছর তো তুমিই আমাকে রেঁধে বেড়ে খাওয়াও। একদিনও কি তুমি ছুটি পেতে পারো না? 

বেলা হতেই এল গরম দুধ আর মোড়ের দোকানের জিলিপি। খাওয়া শেষ হতেই কমলার আর একবার অবাক হওয়ার পালা। একটা লোহার জল তোলার বালতি ছিল। তার মধ্যে গরম জলে নিশিন্দা পাতা ভিজিয়ে নিয়ে সুবল হাজির হয়েছে চৌকির কাছে। নিজে মাটিতে বসে কমলার পা দুটো বালতির জলে ভেজাতে বলল। কমলা ছদ্ম রাগের ভঙ্গীতে বলল, 

'এবার কিন্তু বড্ড বাড়াবাড়ি হচ্ছে। এমন করলে আমি রান্নাঘরে চললাম।' 

সুবল বলেছিল, 'দেখবে এতে তোমার পায়ের ফোলা কেমন সেরে যাবে! শান্ত হয়ে একটু বসো দেখি চুপটি করে!' 

সত্যিই ওই পাতা ভেজানো গরম জলে পা ভিজিয়ে রাখতে, পায়ের ফোলা অনেকটাই কমে গেছিল কমলার। কত যে সেবা জানতো মানুষটা! সারা গায়ে, হাতে-পায়ে সরষের তেল মাখিয়ে বলেছিল এবার সরষের খোল ভেজানো দিয়ে মাথা ঘষে, চুল ধুয়ে, পুকুরে স্নান সেরে এসো। তোমায় আজ সাধ খাওয়াব আমি। 

'ওমা! সে কি কথা! বলে কমলা হাসল। 

সুবল বলেছিল, 

'তোমার মা-বাপ নেই কেউ, তোমায় আমি ছাড়া তবে কে খাওয়াবে? আজকে মনে করো আমি তোমার মা!' 

'আহা! ঢঙে মরে যাই'--- মুখে এ কথা বললেও খুশি আর ভালো লাগার অনুভূতিতে কমলার চোখের কোণ ভিজে উঠেছিল। তারপর ভিজে চুল পিঠের উপর ফেলে কপালে সিঁদূরের টিপ আর সুবলের দেওয়া নতুন লাল-হলুদ রংয়ের ছাপা শাড়ি পরে কমলা দুপুরের ভাত খেতে বসেছিল। 

মোচার তরকারি, মুসুর ডাল, আলু আর কুমড়ো-ফুল ভাজা, মাছের ঝোল, চালতার চাটনি, দই-মিষ্টি। কমলার মনে আছে, সেদিন এমনকী তাকে এঁটো বাসন ধুতেও হাত দিতে দেয়নি সুবল, কিন্তু ভগবান সব কিছু দিয়েও তো কেড়ে নিলেন! তিন বছর হল, মানুষটার কোনো খোঁজ খবর নেই। 

প্রচণ্ড জোরে বৃষ্টি পড়ছে, সঙ্গে হাওয়ার তাণ্ডব। হাওয়ায় ঘরের খুঁটিগুলো পর্যন্ত নড়ছে। চালের ফুটো থেকে যেখানে জল পড়ে, সেখানে একটা বালতি বসানো আছে। দরমার দরজার গা চুঁইয়ে ঘরে জল আসছে। চৌকির একপাশে তিন বছরের মেয়ে মালতীকে নিয়ে গুটিয়ে পাকিয়ে শুয়েছিল কমলা। হঠাৎ ঠাণ্ডা বাতাসের ঝটকায় তার ঘুম ভেঙে গেল। 

এ কী দেখছে সে! তার সামনে সুবল দাঁড়িয়ে! বৃষ্টিতে ভিজে একদম একশা। কপালের চুলগুলো চোখেমুখে লেপে রয়েছে। হাতে একটা টিনের তোরঙ্গ। দুর্বল শরীরে কাঁপতে কাঁপতে উঠে বসল কমলা। 

'এ কী! তুমি? এতদিন তুমি কোথায় ছিলে? আমরা মরেছি নাকি দেখতে এসেছো বুঝি? না এখনও মরিনি। তোমার মত অমানুষকে একবার দেখার জন্য এখনও বেঁচে আছি!' কথাগুলো বলে উত্তেজনায় হাঁপাতে লাগল কমলা। 

শান্ত গলায় এতটুকু না রেগে সুবল বলল, 

'ওগো অনেক কথা আছে! সব বলব। আর রাগ করে থেকো না। কিন্তু তোমার এ কী চেহারা করেছো কমলা! ও মা! মালতীর গায়ে তো দেখছি জ্বর! কতদিন হয়েছে! এসে গেছি যখন, আজই তোমাদের বড় ডাক্তার দেখাব। দেখবে তুমি একেবারে ভালো হয়ে যাবে। আমাদের বাসু কই, আমার বাসনা?' 

কমলা এবার ভাঙা গলায় কেঁদে উঠল, 

'মেয়েটার আমার লেখাপড়া হল না। কী কষ্ট করে বাগান থেকে ফল পাকুড় কুড়িয়ে সংসারটা একাই টানছে। এই ঝড় বৃষ্টিতে বাগানে ঘুরছে। মেয়েটাকে তুমি বাঁচাও। 

সুবল দড়ি থেকে গামছাটা নিয়ে মাথা মুছতে থাকে। বলে, 

'এই কয়েক বছরে অনেক টাকা সঞ্চয় করেছি। এই বাক্সে তোমার জন্য সোনার কানের ফুল, বাসনার জন্য জামা আর নাকের ফুল আছে। সেখানে আমার ব্যবসার খুব পসার ছিল। বাক্সটা খোলো কমলা, সব বার করো। 

কমলা বলে, 

'বাসনার জামা এনেছো, খুব ভালোই হল। মেয়েটার আমার গায়ে দেওয়ার একটাই ভালো জামা। ভেজা থাকায় পরতে পারছে না। বাড়ির যেটা আছে, ছিঁড়ে পিঁজে গেছে। পিঠটা হাঁ করে খোলা। মেয়ে তো বড় হচ্ছে---!' 

কমলা বাক্সটা তাড়াতাড়ি খোলার চেষ্টা করতে লাগল, কিন্তু বাক্সের ডালাটা কিছুতেই খুলছে না। চাবি ঘুরিয়ে বার বার চাপ দিচ্ছে কমলা। জোর করে চাপ দিতে গিয়ে কমলার হাতটা দেওয়ালের গায়ে ধাক্কা খেয়ে খুব জোরে ঠুকে গেল। ব্যথা পেয়ে চমকে উঠল কমলা। কোথায় সুবল? ঘরে কেউ নেই। খাটের উপর জ্বরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে আছে ছোট্ট মালতী। প্রচণ্ড বৃষ্টির দাপটে ঘরের দরজা খুলে গেছে। সেখান থেকে হু হু করে বৃষ্টির জল এসে ঢুকছে ঘরের ভেতর। দুপুরবেলাতেই মনে হচ্ছে সন্ধ্যে হতে যাচ্ছে। এক ম্লান বিষণ্ণতার আলোয় ঘর বাড়ি প্রকৃতিও আচ্ছন্ন হয়ে আছে। জোরে জোরে শব্দ করে ব্যাঙ ডাকছে। এই বৃষ্টি কি থামবে না? 

কমলার যেন বিশ্বাসই হতে চায় না যে, সে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল। হঠাৎ তার বুক ভাঙার কষ্ট চোখের জল হয়ে নেমে আসতে লাগল। 

৪ 

বাসনা উদভ্রান্তের মত বাগানে ছুটে এসেছে। বড় গাছের তলায় বৃষ্টির ছাঁট প্রায় লাগে না। ওর হাতে একটা পুরনো বাজারের ব্যাগ। একটা ঝুনো নারকেল গাছতলায় পড়ে আছে দেখতে পেয়ে প্রায় ছুটে এল বাসনা। তখনই ঝোপের ভেতরে একটা ভাঙা কাচের বোতলের টুকরো আমূল গেঁথে গেল ওর পায়ে। আহ্ মা গো! উফ বাবা, বলতে বলতে একটানে কাচটা বের করে ফেলে বাসনা। এটা ভুতো কাকুদের কাজ। রোজ রোজ এখানে নেশা করতে আসে, আর মদ খেয়ে এদিকে ওদিকে বোতল ফেলে রাখে। একদিন ওদের মাথা ভেঙে দেব এই কাচ দিয়ে --- বাসনা মনে মনে বলল। 

গাছের গোড়া থেকে ভিটেছাড়া লতার পাতার রস টিপে টিপে কাটা জায়গায় লাগালো সে। ব্যথা আর রক্ত পড়া কমলো। ঘুরে ঘুরে বড় গাছের তলাগুলো দেখে নিচ্ছে বাসনা। চালতা গাছের তলা থেকে কয়েকটা চালতা কুড়িয়ে পেল সে। আজকে ভাগ্য খুব সুপ্রসন্ন মনে হচ্ছে। যদি তাল তলায় দু একটা তাল পাওয়া যায়, ব্যাস! আজকে আর কালকের চিন্তা বন্ধ। চালতা নিয়ে আসার পথে ডেলো মাদারের গাছটা চোখে পড়ে গেল বাসনার। এর টক মিষ্টি ফল দিয়ে বাবা চাটনি বানিয়ে দিত। মায়ের শরীর খারাপ থাকলে, বাবা মাঝে মাঝেই রান্না করত। কী ভালো রান্না করত বাবা! 

বাবার জন্য খুব মন কেমন করে বাসনার। বাবা কেন তাকে না বলে চলে গেল? বুঝতে পারে না বাসনা। বাবা থাকলে একটা ভালো জামা চেয়ে নিত সে বাবার কাছে। 

তালতলায় যাবার পথে আরও জোরে বৃষ্টি নামল। চারদিক একদম অন্ধকার করে এসেছে। বৃষ্টি আর হাওয়ার দাপটে বাসনা ঠকঠক করে কাঁপছে। আকাশের দিকে মুখ তুলে চেয়ে বাসনা বলে, 

'ঠাকুর! আমার বাবাকে এনে দাও! তোমার কাছে আর কিছু চাই না। ঠাকুরগো, দয়া করো!' 

ওর চোখের জল আর বৃষ্টির জল একসঙ্গে ওর গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে। 

নেট বন্ধ হয়ে যেতে তিনজনেই বসে বসে এখন বাছা বাছা খিস্তি দিচ্ছে। যেন কদর্য কথা বলার প্রতিযোগিতা হচ্ছে। এতেও একধরণের মানসিক তৃপ্তি পাচ্ছে ওরা। বৃষ্টির দিনে আজ ওদের হাতে এ ছাড়া আর কোনো বিনোদনের উপকরণ নেই। এমন সময় ব্যাগ হাতে বাসনাকে ওই পথে যাচ্ছে দেখতে পেল ভুতো। নিমেষের মধ্যে ভুতো বাসনার দিকে ছুটে গেল। বাসনার শীর্ণ হাতটা চেপে ধরল ভুতো। 

'এই! আবার কী নিয়ে যাচ্ছিস তুই? এই বাগানের সব ফল তোরা একাই খাবি নাকি?' 

পায়ে কাচ ফুটে যাওয়াতে বাসনার মাথা গরম ছিল। নাহলে সে হয়তো কথাই বলত না। বাসনা বিরক্ত স্বরে বলল, 

'ছাড়ুন কাকু, আমার লাগছে।' 

'লাগুক।' গর্জে উঠল ভুতো। এখানে ফলের প্যাকেটটা রেখে, তারপর যাবি। 

'বা রে, কেন? এত কষ্ট করে ঝড়ে জলে ফল কুড়ালাম, আমি নেবো না কেন?' বাসনা মরিয়া হয়ে বলে উঠল। 

বাবাই আর রঙ্গনও বলে উঠল, 

'যেতে দাও ভুতোদা, বাচ্চা মানুষ!' 

ভুতো হার না মানা গলায় বলল, 

'বাচ্চা না চৌবাচ্চা! আচ্ছা যা। 

বাসনা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। যাওয়ার জন্য পেছন ফিরতেই, ভুতোর দৃষ্টি বাসনার পিঠের উপর পড়ল। আরে! একদম নীচ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে! ভুতোর ক্ষুধার্ত চোখদুটো ধকধক করে উঠল। সে দু' পা এগিয়ে এসে আবার বাসনার হাতটা চেপে ধরল। 

'তুই জামা খোল্! এক্ষুণি খোল্ বলছি।' 

দূর থেকে বাবাই আর রঙ্গন এবার উঠে এসে দাঁড়িয়ে গেছে। তাদের চোখে মুখে নতুন অ্যাডভেঞ্চার দেখার আগ্রহ। বাসনা নিরুপায় হয়ে কোনঠাসা পশুর মত চারদিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকাতে লাগল। 

'এই শোন, নাহলে তুই এই ফলের ব্যাগ পাবি না। আগে জামা খুলে দাঁড়া, তারপর ব্যাগ দেব। 

ঠিক এইসময় কোথা থেকে যেন উদভ্রান্তের মত ছুটে এল সুবল। রাগে আর উত্তেজনায় সুবলের ফর্সা মুখটা একেবারে লাল হয়ে গেছে। এসেই সে প্রচণ্ড জোরে একটা চড় মারল ভুতোর গালে। তারপর বাসনাকে কাছে টেনে নিয়ে বলল, 

'তুমি কি ওকে অনাথ ভেবেছো নাকি? ও আমার বড় মেয়ে! তোমাদের এতবড় সাহস কোথা থেকে হয়! এই বাগান আমি এখন কিনে নিয়েছি। ক'দিন পরে এখানেই আমাদের নতুন বাড়ি তৈরি হবে। এই বাগানে তোমাদের ঢোকা আজ থেকে আমি চিরদিনের জন্য বন্ধ করে দিলাম। আমি বাগানের বাইরে এবার থেকে দারোয়ান বসাব। কী ভেবেছোটা কী তোমরা? যাও, এক্ষুণি বেরিয়ে যাও। এতদিন আমি এমনি এমনি বাইরে থাকিনি। এখন আমার হাতে অ-নে-ক টাকা। 

যেন জাদু মন্ত্রে সব কিছু বদলে গেল। বাবাই, রঙ্গন আর ভুতো মাথা নীচু করে বাগান থেকে বেরিয়ে গেল। সুবল বাসনাকে বলল, 

'যা শিগগীর ঘরে যা! তোর জন্য নতুন জামা এনেছি, এই ছেড়াটা ছেড়ে নতুন জামাটা পরে ফেল তো দেখি!' 

বাসনা ভুতোর গর্জনে চমকে উঠল। 

'কী হলটা কী? জামা খোল বলছি!' 

বাসনা দেখল তাকে বাঁচাতে বাবা ফিরে আসেনি। কোথায় বাবা? আধো অন্ধকারে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা বন্য জন্তু। তাদের চোখগুলো শ্বাপদের মত অন্ধকারেও জ্বল জ্বল করছে। বাসনা করুণ স্বরে ব্যাগটা পাবার জন্য আবার মিনতি জানালো। ওদের খিক খিক হাসিতে বাসনার গলা যেন কোথায় হারিয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত অসুস্থ মা আর বোনের কথা ভেবে বাসনা জামাটা খুলে দাঁড়ালো। পাশব তিনজোড়া চোখ ওর শরীরে সার্চলাইটের মত ঘোরাফেরা করতে লাগল। 

একটু দূরে এর প্রতিবাদেই যেন খুব জোরে বাজ পড়ল। সেই শব্দে সবাই একসঙ্গে চমকে উঠল। আর কোথাও কোনও শব্দ নেই। কেবল বৃষ্টির জল অবিরল ধারায় পাতার গা বেয়ে ফোটা ফোটা হয়ে ঝরে পড়তে লাগল। বাসনা নিঃশব্দে মাটি থেকে ফলের প্যাকেট আর জামাটা কুড়িয়ে নিল। দুটোই তার ভীষণ দরকার। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. খুব সুন্দর। কতরকমের ওষুধ বানালে গল্পে। তুমি তো দেখছি কবিরাজীটাও বেশ জানো।

    উত্তরমুছুন