ওয়াসি আহমেদ : গল্পের কাছে কী চাই


আপতদৃষ্টিতে প্রশ্নটা সাবজেকটিভ, যে-কারণে এর জবাবও তা-ই হতে পারে। গল্পের কাছে আমি যা চাই তা অন্যের চাওয়া থেকে ভিন্ন হতেই পারে। তারপরও সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা বলে একটা কথা রয়েছে, যা এই চাওয়াকে নানাভাবে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে, আর স্থান-কালের ভেদাভেদ সত্ত্বেও একটা উদ্দেশ্যকে, লক্ষ্যকে পাঠকের সামনে দাঁড় করায়-- যুক্তিযুক্তভাবেই। 


দৈনন্দিন জীবনযাপনে আমাদের গোচরে-অগোচরে প্রায় প্রতি নিয়ত কত ঘটনাই না ঘটছে! সেসবের অনেক কিছুই হয়তো গুরুত্বহীন, নজর করে দেখার বিষয় নয়। আবার এমনও হতে পারে, খোলা চোখে দেখা অতি সাদামাটা একটা দৃশ্য শুধু দৃশ্য হিসেবে থাকতে চাইছে না-- অন্য দৃশ্যের, দৃশ্যান্তরের খোঁজ দিচ্ছে, দিশা দিচ্ছে, উপলব্ধির চোরাকুঠুরিতে গোপনে টোকা দিচ্ছে। টোকা দিয়েই থেমে থাকছে না, খোঁচাও দিচ্ছে। খোঁচাবিদ্ধ লেখককের তখন উপসম তালাশ করা ছাড়া উপায় থাকে না। কখনো হয়তো উপসম মেলে, কখনো না। তবে তালাশ তাকে করে যেতেই হয়। এই তালাশই যদি হয় একজন গল্পকারের গল্প বলার প্রেরণা, তাহলে এ থেকে কী করে তার নিষ্কৃতি মেলে? অন্যভাবে বললে, পাঠককে সঙ্গে নিয়েই যেহেতু গল্প বলার চেষ্টা, সে-কারণে পাঠককেও এই তালাশে সহগামী হতে হয়। পৃথিবীতে যেদিন থেকে গল্প বলার শুরু, গল্পবলিয়েকে এমন তাড়নাই উদ্বুদ্ধ করেছে। 

কত ঘটনাই না গল্পে ইন্ধন জোগায়! দূর থেকে, কাছ থেকে দেখা বাস্তব ঘটনা। তবে বাস্তবেরও বাস্তব থাকে, লুপ্ত থাকে। আর আমরা যে পৃথিবীতে বাস করছি সেখানে ইদানীং ওপরতলের বাস্তব অনেক ক্ষেত্রেই মেকি, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে ভাঁওতাও। পোস্ট ট্রুথ বলে একটা ব্যাপার তো হরহামেশাই আমাদের তাড়া করছে, বিভ্রান্ত করছে। সেই সঙ্গে রয়েছে অপার ইচ্ছাপূরণ আর জনতুষ্টির (পপুলিজম) বিশ্বময় আগ্রাসী আয়োজন। 

তাহলে কী করা? খুঁড়ে খুঁড়ে যত দূর যাওয়া যায়। গল্পকারের জন্য এ এক অনির্দেশ্য যাত্রা, কখনো পরিণামহীন ঘোর ঘোর পথে। সঙ্গীহীন এই নিরালোক যাত্রায় গল্পকারের কাল্পনিক সঙ্গী একজন রয়েছেন, তিনি পাঠক। 

গল্প যেহেতু একটা শিল্প, অন্য সব শিল্পের মতো বানানো, একজন মনষ্ক পাঠক জেনেবুঝেই সেই বানানো চালচিত্রে ঢুকে পড়েন। তার কাছের-দূরের ঘটমান অথবা ঘটে যাওয়া নানা বিষয়আশয় একজন গল্পকার কী চোখে দেখছেন, ব্যাখ্যা করছেন সে-বয়ান তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এখানে পাঠক তার নিজস্ব রুচির নিরিখে লেখকের ব্যাখ্যা ও বয়ানকে যাচাই করবেন, এ-ই স্বাভাবিক। আর গল্পকারও চাইবেন তার নিজস্ব রুচি ও কৃৎকৌশল দিয়ে সেই বয়ানকে নিজের মতো করে বলার। সময়ের প্রবাহে এই কৃৎকৌশল বদলায়, পাঠকেরও পাঠ-অভিজ্ঞতা বদলায়। তবে মূল বিষয় একই রয়ে যায়-- পাঠক একটা গল্পে সমাজ ও জীবনের প্রতিফলনই দেখতে চান। এ প্রতিফলন কেবল মাঝ দুপুরে নিজের গুটিসুটি ছায়া নয়, ছায়ার ভিতরে লুপ্ত অন্য ছায়া, হতে পারে দীর্ঘ, জটিল, প্রশ্নসংকুল, কুহকী ছায়া। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমরা যা দেখি তা আয়না আমাদের যেটুকু দেখায়। একটা গল্প আয়নার অতিরিক্ত অনেক কিছু দেখায়। সরাসরি দেখায়, আবার সংকেতে-ইশারায়, এমনকি রুদ্ধবাক হয়েও দেখায়। গল্পের কাছে সেই বাড়তিটুকুই চাওয়ার। 


লেখক পরিচিতি
ওয়াসি আহমেদ
কথাসাহিত্যিক। 

    একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

    0 মন্তব্যসমূহ