যন্ত্রণা, তোমার কাছে যা চেয়েছি
বিবিধ পাঠকের বিবিধ সত্তা। লেখক কোন পাঠকের কথা ভেবে লিখবেন? কোন পাঠকের কথা মনেরেখেই তিনি লিখবেন না এটাই স্বাভাবিক। বরং তিনি নিজের মতো করে লিখবেন। পাঠক নিজের সত্তা অনুসারে নিজের লেখককে খুঁজে নেবেন। এই খুঁজে নেওয়ার ওপর নির্ভর করে একজনের পাঠক সত্তা।
কোন পাঠক গল্পে কী চায়। সব পাঠকের মতো আমিও গল্পের কাছে বেশ কিছু বিষয় প্রত্যাশা করি। যেসব লেখকদের লেখায় তা পাই তারাই আমার প্রিয় লেখক হয়ে ওঠে। গল্প পড়া আমার কাছে এক আত্মযন্ত্রণা, এক ঘোর। শেষপর্যন্ত দেখে নিতে চাইছি লেখক কী বলতে চাইছেন। তার দর্শন কোথায় এসে পৃথক হয়ে যাচ্ছে বা স্বতন্ত্র হয়ে উঠছে।
প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো সাদামাঠা লেখা আমার পছন্দ নয়। একটু জটিল গল্প চাই। আখ্যান চাই। গল্পে যিনি কাহিনির উৎসব ঘটাতে চান তিনি না পছন্দ। বরং যিনি কাহিনির ভেতর দিয়ে অন্য স্রোত বহন করে আনছেন তিনিই প্রিয় লেখক হয়ে ওঠেন। অনেকটা নদীতীরে থাকা বালির মতো। যিনি শুধু বালির গপ্প লিখছেন তিনি বর্জিত। যিনি বালির নীচের তলার জলস্তরের খোঁজ করছেন তিনিই প্রিয় লেখক। বারবার মনে হয়েছে গল্পে কাহিনি বলার দিন শেষ হয়েছে। বিচ্ছিন্ন ঘটনা সমষ্টি নিয়েই লেখক গল্প গড়ে তুলবেন।
পুষ্পল মুখোপাধ্যায়ের একটি গল্পসংকলনের নাম ‘সব বানানো গল্প’। লেখক তো গল্প বানাবেনই। সেই বানানোটা যেন মিথ্যে না হয়, মেকি না হয়। পাঠকের চোখে যেন ধরা না পড়ে।অনেকটা যেন ঠাকুর মশাইয়ের সেই কথার মতো—সত্য বলিব কিন্তু সে সত্য বানাইয়া বলিব। কিছুদিন আগে একটা গল্প পড়লাম। এলিট ক্লাসে বিচারণ করা লেখক গল্পের প্রথম বাক্যেই লিখেছেন—বস্তিবাসী মানুষের প্রতি আমার আজন্ম সহানুভূতি। পড়তে গিয়েই মনে হল লেখক মেকিসর্বস্ব হয়ে গল্প শুরু করছেন। অতএব এহ বাহ্য।
লেখক কর্তৃক ব্যবহৃত ভাষা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি যেন মেদামারা ভাষা ব্যবহার না করেন। শব্দের যেন একটা আলাদা মাধুর্য থাকে, মিষ্টতা থাকে। একটা সুরেলা ভাব থাকে। পাঠকের ভাষার সঙ্গে লেখকের ভাষার যেন একটা প্রভেদ থাকে। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত শব্দগুলিই তিনি ব্যবহার করুন তবে যেন শব্দের মায়াজালে ভিন্ন ভুবন রচনা করে নেন।
বেশকিছু লেখকের উপস্থাপন রীতি ও কৌশল পরিচিত। যেমন ধরা যাক সাহিত্যিক অলোক গোস্বামী। অলোক গোস্বামীর রচনার কোনো পরিচ্ছেদ যদি অন্য লেখার মধ্যে মিশিয়ে দেওয়া যায় তবুও সে পরিচ্ছেদ পড়ে বলে দিতে পারব এটা অলোক গোস্বামীর লেখা। ভাষা ও উপস্থাপন রীতি যেন লেখকের নিজস্ব হয়।
লেখকের স্পষ্ট রাজনৈতিক জ্ঞান থাকা চাই, সময় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা চাই। যেকোন রাজনৈতিক চেতনাই হতে পারে। যেকোন রাজনৈতিক বিশ্বাস হতে পারে।
আখ্যানের ভিতর সময়ের রাজনীতি প্রবেশ করুক। প্রেমের গল্প চাই না। আমি নিজেই শত প্রেমের মালিক। অপরের মুখে প্রেমের গল্প শুনে আমি কি করব? বরং আখ্যান হয়ে উঠুক রাজনৈতিক। গল্পের বীণায় বাজিয়ে দেওয়া হোক রাজনৈতিক ভণ্ডামিকে। লেখক সরাসরি আঘাত করুক রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে। রাষ্ট্রের যাবতীয় কুৎসা, ভণ্ডামি, ছ্যাচরামি, দালালি লেখক গল্পের আখ্যানে নিয়ে আসুক। পাঠককে
দেখিয়ে দিক রাষ্ট্র কীভাবে আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। যেকারণে আজ আর ঐতিহাসিক উপন্যাস পড়তে চাইছি না। আমি আমার সময়টা ভালো করে বুঝে নিতে চাইছি। গল্পের কাছে তাই আমার প্রার্থিত। লেখক প্রবলভাবে আঘাত করুক শ্রেণিকে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে। মধ্যবিত্তের যাবতীয় ভণ্ডামি, মেকিসর্বস্বতা, চালাকি যেন রক্তমাংস সহ বেরিয়ে আসে। মধ্যবিত্তের বেঁচে থাকার আত্মদর্পণ হিসেবে গল্পকে দেখতে চাই। ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় নিম্নবিত্ত শ্রেণিকে আঘাত করার সময় এখনও আসেনি। যারা নিজেরাই খেতে পায় না তাদের আঘাত করে কী লাভ! বরং সে জীবনচিত্র উঠে আসুক।
পূর্বের লেখকদের সম্পর্কে লেখকের স্পষ্ট ধারণা থাকা চাই। আবহমান কালের বাংলা গল্প পড়ে তিনি যেন গল্প লিখতে আসেন। অনেক গল্প পড়েই মনে হয়েছে তিনি যদি অমুক লেখকের অমুক গল্পটা পড়ে থাকতেন তবে এই গল্পটা আর লিখতেন না। আমাদের ভাষায় এমন গল্প অনেক আগেই লেখা হয়েছে। এটা যেন না হয়। তবে লেখক সম্পর্কে একটা বিরূপ ধারণা মনের মধ্যে জেগে ওঠে। আবহমান কালের গল্প সম্পর্কে লেখক পরিচিত হয়েই গল্পে প্রবেশ করেছেন। বিষয়টা যেন এমন—প্রায় সব পড়েছি। এরপরও আমার কিছু বলার আছে। তাই লিখতে এসেছি।
আমি চাই লেখক গোল গল্পকে ভেঙে দিক। গল্পের মধ্যে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করুক। নানা রিপোর্টিং, বিচ্ছিন্ন ঘটনা, ছক এনে নিজেই একটা মডেল তৈরি করে নিক।
লেখক পরিচিতি
পুরুষোত্তম সিংহ
পেশা শিক্ষতা।
সাহিত্যের গবেষক। প্রন্ধকার। পশ্চিমবঙ্গে থাকেন।
পুরুষোত্তম সিংহ
পেশা শিক্ষতা।
সাহিত্যের গবেষক। প্রন্ধকার। পশ্চিমবঙ্গে থাকেন।
0 মন্তব্যসমূহ