হামিরউদ্দিন মিদ্যা'র গল্প : নিশিকাব্য

বাঁশের দরজার আগলটা ঠেলে উঠোনে নেমে এল মরিয়ম।কার্তিকের রাত।শীতের তীব্রতা ছুঁচ ফোটা না হলেও শিশির পড়ার খামতি নেই।গাছগাছালির পাতা,টিনের চাল,ঘাসের ডগা সব হিম- ঝকঝকে।চারপাশে হালকা কুয়াশার আস্তরণ—তবে আকাশের দিকে তাকালে পাকা ধান রঙা চাঁদটার চুঁইয়ে পড়া আলো রাতের অস্পষ্টতা খানিক দূর করে।তা আর কতদূর!বড়জোর ছলি মোল্লার বাগান বাড়ি,আর রায়হান সেখের ধানজমির আল টপকায়।দাওয়ার ওপর নামানো জল ভর্তি বদনাটা হাতে তুলে নিল মরিয়ম,তারপর চুলোশালের পেছনে ফজলু সেখের বাড়ির দেওয়াল ঘেঁষে যে নালার মতো অংশটা—সেখানে গিয়ে তল পেটের জ্বালা জ্বালা ভাবটা ফেলতে বসল। 

কলতলার জলটা পাইপ বেয়ে নেমে আসে নালাতে।সেই জন্য জায়গাটা জলা।কেমন একটা আঁশটে গন্ধ ছড়িয়ে থাকে।আওতা মাটির জন্য চুলোশালের পেছনের আঁজির গাছটা ঢ্যাঁঙা,কিন্তু গতর নেই।বাগান বাড়ির মাথার ওপর চাঁদটা হাঁটতে হাঁটতে আলামারা হয়ে রায়হানের টিনের চালের ওপর জিরচ্ছে।হিম ঝকঝকে টিন থেকে কিছুটা আলো পিছলে গিয়ে আঁজির পাতার ফাঁক গলে ফজলু সেখের বাড়ির পেছন দেওয়ালে পড়ে বড় আয়না হয়ে যায়।সেই আয়নায় মরিয়ম তার মুখ দেখতে পাই না ঠিক কথা,তবে আঁজির গাছের বাঁকা ডালটা নিজের ছবি আঁকে।একটা ছুঁচো না কাঠবিড়ালি ছায়াটাকে ডাল ভেবে লাফাতে গেলে ঠকে গিয়ে নালাতে ধাব্বিস করে পড়ে।'ও মা গো!'—বলে ভয়ে তিঁকুড়ে উঠে মরিয়ম।হাত থেকে বদনার কিছুটা জল ছলকে পড়ে। 

'আমি তো পেচ্ছাবে পানি নিইনি!না-পাক শরীরে নামাজ হবে কী করে!' উঠোনে দাঁড়িয়ে মরিয়ম ভাবে।আর না-পাক শরীরে নামাজ পড়লে কবরের ভেতর আযাবের কথা ভেবে কাঁপতে থাকে সে।'তাহলে কলতলায় গিয়ে পানিটা নিয়ে নেব?যদি শাড়িতে লেগে গেছে!' 

ওধারে ইলেক্ট্রিক খুঁটির তারটা বাগানবাড়ির পাশ দিয়ে টিনের চালের পেছন পানে।কালো না পাঁইশে রঙা পেঁচাটা তারে বসে নিদেন মানুষের মতো বার দুই গোঁঙিয়ে উঠলে,পা গুলো মাটিতে সেঁটে যায় মরিয়মের।বুকের ভেতরের ঢেঁকিটায় কে যেন পাড় দেয়।ভয় পাওয়া ডাউক পাখির মতো ভ্যাবলা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একসময় মালুম হয়,উঠোনে কালো পানা কী যেন একটা লাফাচ্ছে।হয়তো ব্যাঙ।হয়তো মাছ।হয়তো পাখির ছানা।পায়ে পায়ে খানিক এগিয়ে গেল মরিয়ম।কাছে গিয়ে দেখল,একটা চ্যাং মাছ। 

শিশিরে উজিয়ে এসেছে।কাছেই ধানজমি।ডাঙায় মাছ উঠে আসা নতুন কিছু নয়।একবছর রায়হান নামাজ পড়তে উঠে একটা ধরেছিল।অনেকটা বড় সাইজের।এটা মাঝারি,তবুও যাচা ধন কেউ পায়ে ঠেলে!হেঁট হয়ে মাছটা ধরার জন্য হাত বাড়াল মরিয়ম,কি ভেবে হাত গুটিয়ে নিল।রাতবিরেতে মাছ আর তাল থেকে খুব সাবধান!বলা যায় না খোদার দুনিয়ায় কীসের সুরত ধরে কী যে আসে!হয়তো তুমি দেখলে মাছ,ধরতে গেলে,হয়ে গেল কালো বিড়াল।ডর পেয়ে হুমড়ি খেয়ে তখন পড়ে যায় মানুষ।দাঁতে দাঁত চেপে অজ্ঞান হয়ে পড়ে।তারপর জ্বর শুরু হয়।নির্ধুমসে জ্বর।যতই তুমি ডাক্তার দেখাও,ওষুধ খাও— জ্বর তোমার ছাড়বে না,ছাড়বে না...শরীরটা দিনকে দিন শুকিয়ে পাটকাঠি হয়ে যাবে।ভালো মন্দ খেলেও তা কোথায় যাবে মালুম পাবে না।ছোটবেলায় মরিয়ম যখন ভোর ভোর উঠে তাল কুড়োতে যেত,তখন দাদো তাকে এই সাবধানবানি দিয়েছিল।চল্লিশের কোঠা পেরতে গেলেও,তা আর অগ্রাহ্য করতে পারে না।মরিয়মের বুকে কাঁপন ধরে।বিড়বিড় করে সুরা ইয়াসিন পড়ে,তাতে আর কোনো খারাপ জিনিস তার ধারে পাশে ঘেঁষতে পারবে না। 

রায়হান সেখের ঘুম পাতলা।তার ওপর কানখড়কা।এককালে ডুমুরজলার দিঘিটার রাখা ছিল।কেউ যেন মাছ চুরি করে না নেয়,তাই পাহারা দিত রাতে।জলের মধ্যে সামন্য কুবকাব শব্দ পেলেই চোখ মেলে সার্চার টর্চ ফেলত।রাখালী গেছে,স্বভাবটা যায় নি।মরিয়ম যখন তক্তাপোশ থেকে উঠেছে,তখনই চেতন হয়েছে মানুষটার।বলল, 'টর্চটা নিয়ে যা গো।' 

মরিয়ম জবাব দেয়, 'জ্যোসতার রেতে,টর্চ লাগবে নি।বার বসেই চলি আসব।' 

রায়হান বিছানায় শুয়ে শুয়েই হাই তোলে।এতক্ষণ কী করছে মরিয়ম!'বার' বসতে এত দেরি! তক্তাপোশ থেকেই হাত বাড়িয়ে বড় লাইটটা জ্বালাল সে।তারপর শিথান তলায় রাখা তিন ব্যাটারির টর্চটা নিয়ে ফাঁকে বেরল। 

মরিয়মকে দেখে চমকে গেল রায়হান।খোলা চুলে উঠোনে ঘাড় গেদে দাঁড়িয়ে আছে।বেয়াদপ মেয়েমানুষের মতো দাঁড়িয়ে কী করছে মরিয়ম?এদিক ওদিক তাকিয়েও আর কাউকে দেখতে পেল না রায়হান।একটু ভয় পাইয়ে দেবার জন্য পা টিপে টিপে কাছে গিয়ে আচমকা টর্চ মারল মুখে।মরিয়ম শিউরে উঠল। 

'ঢং দেখো বুড়োর!মশকরা করার আর জায়গা পাওনি।ভয়ে আমার জান নাই!আচ'কাই ভূতের মতন উদয় হলে যে?' 

রায়হান দক্তা-সুপরি খাওয়া গাব ধরা দাঁতগুলো বার করে ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ হাসল।বলল, 'তুই যে পেতনির মতন দাঁড়িই আছিস!' 

মরিয়ম জবাব দেয় না।মরদটা যত বুড়োতে গেল,তত ভীমরতি ধরেছে।নামাজ তো পড়েই না।আবার রমজান মাসে মরিয়ম যেখানে না খেয়ে খেয়ে আল্লার দরবারে শুকরিয়া আদায় করে,সেখানে রায়হান তিন বেলা গবগব করে ভাত মারবে।তখন হাট বাজার গেলে ইতিউতি জিনিস কিনে এনে দেখিয়ে দেখিয়ে খাবে।মরিয়ম তো আর ছোঁচা পেটা নয়।যে খাওয়ার লোভে রোজা ভেঙে দেবে।অনেক বলা কওয়াতে কিছুদিন রোজা রেখেছিল বটে,কিন্তু মরিয়ম হেঁশেলে ঢুকে টের পেয়েছিল পাকা ঘুঘুর কারবার।ব্যপারটা চাপা থাকেনি।গঞের দোকানেও তাকে খেতে দেখেছে অনেকে। 

'কী হল?জবাব দে?' রায়হান আবার জিজ্ঞেস করে। 

মরিয়ম আঙুল বাড়িয়ে উঠোনে পড়ে থাকা মাছটা দেখাল।রায়হান টর্চ জ্বেলে কাছে এগিয়ে গেল, 'আরে শিশিরে মাছ উঠেছে!তুই ধরিস নি?' বলে উত্তরের তোয়াক্কা না করেই হাত বাড়িয়ে মাছটা ধরতে গেল রায়হান।তিড়িং করে লাফ মেরে মাছটা এগিয়ে গেল কয়েক হাত। 

মরিয়ম মুখ ভেঙচিয়ে বলল, 'লি মুরোদে!' 

মরিয়মের কাছে রায়হান অকর্মা প্রতিপন্ন হতে চাই না।কিন্তু কী করবে!চ্যাংমাছের মতো চ্যাঁদর মাছ আর দুটি আছে!আবার হেট হয়ে ধরতে গেল,দ্বিতীয় বারেও বিফল।মাছটা এবার তিড়িং বিড়িং করে লাফ মেরে ধানজমির দিকে এগোতে লাগল। 

মরিয়ম ভয় পেয়ে গেল।তাহলে কী মাছ নয়?মাছের সুরত ধরে অন্য কিছু...ভুলিয়ে ভালিয়ে তার মরদটাকে নিয়ে যাচ্ছে।ধানজমির কাছে গিয়েই হয়তো আসল চেহারা দেখা দেবে।মরিয়ম বাধা দিল, 'আর যেও না গো!ছোট পারা মাছ,ছেড়ি দাও।' 

'ছেড়ি দিব কেনে?শালার মাছ!এর শ্যাষ দেখিই ছাড়ব।' রায়হানের এই জেদের কাছে হার স্বীকার করল মরিয়ম।আর দাঁড়িয়ে না থেকে সে-ও মরদটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। 

উঠোন থেকে নেমে এসেই আলপথ।পারাপারের রাস্তা বলে কেউ বলে পথআল।ডাইনে ধানজমি।বাঁয়ে ছলি মোল্লার ইউক্যালিপটাসের বাগান।গাছগুলো দুই-বছরেই মাথা চারা দিয়ে উঠেছে।তিন কাটুনি গাছ।এই আলপথ ধরে এগিয়ে গেলে মোল্লাপাড়ায় ঢোকা যায়।বাঁকা সিঁথির মতো ছোট ক্যানেলটা বেলে মাঠের দিকে চলে গেলেও রায়হানের এই একানে জমিটাকে ভিজিয়ে দিয়ে যায়।বলতে গেলে এই একটি জমিই দুটো পাড়াকে আলাদা করে রেখেছে। 

জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর।শেষ রাতে চাঁদটার আরও যেন তেজ বেড়েছে।আধ-পাঁকা ধান বলে এখনো কাটেনি রায়হান।জমির জলটা শুকিয়ে এলেও কাদা মরেনি।আর দিনকতক পরেই কাটবে।গোপালভোগ ধানের লম্বা গাছ।হলুদ আভা এসেছে।ধানখেত থেকে একটা তীব্র মিঠে গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে।মন মাতাল করা গন্ধ!আলের ধারে দাঁড়িয়ে জ্যোৎস্নায় ধানখেতের এমন রূপ দেখে দু-জনেই মাছের কথা ভুলে গেল।ধানখেতের ওধারে মোল্লাপাড়ার টালি,টিন আর এস্টব্যাস্টের ছাউনি দেওয়া ঘরগুলো যেন কানে কানে কথা বলছে। 

এবার রায়হান টর্চ মেরে দেখল মাছটাকে।কালো পুঁতির মতো দুটো চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে।কেমন রাগী রাগী চাউনি।রায়হান শেষ বারের মতো হেঁট হয়ে হাত বাড়াল,জমিতে ঝাঁপাল না মাছটা,এবার লাফিয়ে আলপথে পড়ল। 

'দেখো দেখো!' মরিয়ম আবেগে আপ্লুত হয়ে আঙুল বাড়াল।রায়হানেরও চোখে পড়েছে।দৃশ্যটা দেখে নির্বাক হয়ে গেল সে।আলপথে সারি সারি মাছ উঠে বসে আছে!চ্যাং,ল্যাঠা,কই।যেন একটা লম্বা মাছের শিকল।এমন দৃশ্য দু-জনের কাছেই অপ্রত্যাশিত।রাতের দুনিয়ার এসব অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্যের রহস্য উন্মোচন করতে পারল না তারা।শুধু বিস্ময়ে চেয়ে রইল।রায়হান ডাকাবুকো হলেও কখনো এমন দৃশ্য দেখেনি।সাপে-নেউলের লড়াই সে দেখেছে।কিভাবে খন্ড খন্ড করে দেয় সাপকে।বাঁশঝাড়ে একবার আজব এক পাখি দেখেছিল।যার চেহারা বর্ণনা করা দুঃসাধ্য।ঘোর বর্ষায় কইমাছের তালগাছে চড়া দেখেছে।ছুঁচোর মিলন দেখেছে।এ যে বিশ্বাস যোগ্য নয়।খোয়াব দেখছি না তো!' কথাটা মনে হতেই মরিয়মের কাঁধে হাত রাখল রায়হান।কেঁপে উঠল মরিয়ম। 

এই যে মরিয়মের কেঁপে ওঠা,এটা কী বাস্তব?নাকি খোয়াবের ভেতরেই মরিয়ম পাশে দাঁড়িয়ে আছে।যাদের নিয়ে বসবাস,যাকে নিয়ে তুমি জীবন যাপন করছ,যে তোমার সারাটাদিন আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে।খোয়াবে তো সে-ই আসে।মাথায় সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে রায়হানের।স্বপ্ন আর বাস্তবের ভেতরে সাঁতার কাটে সে। 

টর্চটা জ্বেলে আলপথে নেমে পড়ল রায়হান।'কুব' শব্দ করে ধানজমিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল মাছটা।কী মিষ্টি শব্দ!এই শব্দের ভেতরে কেমন একটা মাদকতা আছে।যার লোভ সামলানো রায়হানের দায় হয়ে ওঠে।নেশাচ্ছন্ন হয়ে আরও এগিয়ে গেল সে।মরিয়মও পিছু ধরল। 

'মরদটার হলটা কী!কীসের ডাকে ওমন চলে যাচ্ছে?' মরিয়ম ভাবে,আর নিজের অনুমানে নিশ্চিত হয়।যা ভেবেছে তাই ঠিক।মরদটাকে বাধা দিতেই হবে।কিন্তু আটকাবে কী করে?ও যে হেঁটে হেঁটে চলেই যাচ্ছে।যা ঘটছে সবই অলৌকিক।মরিয়মও আলপথ ধরল।হেঁকে বলল, 'দু-চারটে মাছ ধরো গো!ভাজা হবে।' 

রায়হান পেছন ঘুরে মুখে আঙুল দিয়ে ইশারা করল,চুপ! 

মরিয়ম ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল।মরদটার মতিগতি তার মালুম হয় না।এতক্ষণ একটা মাছের পেছনে ছুটছিল।এখন সারা আলপথ জুড়ে মাছ,তাও ধরছে না কেন,তার ভাবনায় আসে না। 

পায়ের শব্দে কুবকাব করে ঝাঁপ মারছে মাছগুলো।কেমন একটা নেশায় পেয়ে বসে রায়হানকে।এত মাছ জমিতে কোনখানে লুকিয়ে ছিল তা আগে টের পায়নি সে।মনে হল চেনাজানা জগত ছেড়ে অন্য কোনো জগতে এসে পড়েছে। 

পারাবারের আল বলে তেমন ঘাস জন্মাতে পারে নি।চকচকে পথ।শিশিরে ভিজে কাদামতো হয়ে গেছে।মরিয়ম একজায়গায় পিছল খেয়ে ধপাস করে পড়ল ধানজমিতে।রায়হান পিছন ঘুরে চেয়ে দেখল।ছুটে এসে হাত ধরে তুলল মরিয়মকে।কাপড়ে কাদা লেগে গেছে। 

রায়হান ধমকে উঠল, 'তুকে কে আসতে বলেছে পিছু পিছু!এবার হলি তো কাদাজল মেখে ভূত!' 

'হ,আমি ভূত হইছি।আর তুমারে ভূতে ধরেছে!' 

'চল,কলতলায় ধুয়ে নিবি।' 

'খামোকা এতদূর গেলে!একটা মাছও ধরলে না!' 

'ওগুলো মায়ার জিনিস মরিয়ম।ভাগ্যিস উঠেছিলাম।এমন দৃশ্য কেউ দেখেছে!' 

'আমার খুব ডর করছিল গো!তুমি যেভাবে চলে যাচ্ছিলে...' 

দু-জনেই চুপ।উঠোন থেকে নেমে আলপথ ধরে অনেকটাই হেঁটে চলে গেছিল।কিছুটা আসতেই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ল রায়হান।তারপর ঘোরের ভেতর থেকে বলল, 'এখন আর মাছ কুথায় মরিয়ম!আগে বেবাক মাছ হতো এই জমিতে।চ্যাং,ল্যাঠা,কই,পুঁটি,গুঁতে।ছেলেবেলায় দেখেছি আব্বা 'ঘুনি' আড়ত। এই যে জায়গাটা দেখছিস।' হাত বাড়িয়ে একটা জায়গা মরিয়মকে দেখায় রায়হান, 'এখানে একটা 'ঘাঁই' খোলা ছিল।আমাদের ঘরবাড়িগুলো আর কতদিনের।সব তো মাঠ ছিল।ক্যানেলে পানি ছাড়লে এক একটা জমি ভরতি হয়ে ঘাঁই দিয়ে পানি নীচের জমিতে নামত।ঘাঁই মুখে 'ঘুনি' আঁড়লে সকালে মাছে ভরতি হয়ে যেত।' 

মরিয়মের এখন এসব কথা শুনতে ভালো লাগছে না।কতবার মরদটার মুখে শুনেছে মাছের কথা।আগে যে মাঠে,খালে,ডোবায় প্রচুর মাছ হত,এটা তো তারও ছেলেবেলায় দেখা।মরদটার মন নরম দেখে মরিয়ম এবার আসল কথাটি পাড়ল, 'খোকা যে জমিটা বুজিয়ে বাগান করবে বলছে,তুমি কিছু ভাবলে গা?' 

বাপি বেশ কয়েকবার বলেছে রায়হানকে।রাজী হয় নি।তাই মা'কে ধরেছে এবার।যেন বাপটাকে রাজী করায়। 

'বাপ দাদার আমলের জমি মরিয়ম।বুজিয়ে কী হবেক বল তো!বাগান করে কিছু বেশি লাভ করা যাবেক মানছি,কিন্তু চোখের সামনে সব তো হারিয়ে গেল একে একে।শেষ প'ন্ত আমিও!না না,আমি বেঁচি থাকতে জমিটা বুজতে পারব নি।' 

'খোকাকে সেটা বুঝিয়ে বলবে।ছেলেটা খুব ঝোঁক নিয়েছে।বলছিল,তিন কাটুনি গাছ,ভালো টাকা হবেক।' 

'টাকায় সব লয় বুজলি।এককালে আমাদের পাড়াটা কী ছিল তুই দেখিস নি।আমাদের ঘরটার নীচে একটা ঢিবি ছিল।সেখানে একটা ঝাঁকর- ঝুমর বাবলা গাছ।মাঠে ধান কেটে মুনিষরা গাছতলায় বসে একটু জিরতো।এখনও বিছানায় শুলে আমার সারা গায়ে কাঁটা ফুটে।মনে হয় বাবলা গাছটার ওপর শুয়ে আছি।ঘুম ভেঙে যায় খালি।' 

এরকম আজব কথা মরিয়ম আজই শুনল।কোন আমলে একটা গাছ ছিল।সব কেটেকুটে, মাটি চাপা দিয়ে ঘর তুলেছে।আর বলে কি-না... 

'আগে ছিল তো ছিল।এখন তো কিছু নাই।এভাবে গো ধরি থাকলে হবেক?তুমার কী!ছেলে যদি নিজের ভালো বুঝতে পেরিছে, ওকে ওর মতো চলতি দাও।' 

'আমরা কী মরে গেছি নাকি!' 

এবার ঝাঁঝিয়ে উঠল মরিয়ম, 'তুমার ভীমরতি ধরেছে!জমিটা রেখেই কী হচ্ছে বলো তো?পাড়ার ভেতরে একানে জমি।সারা পাড়ার হাঁস এসে নামে।গোরু-ছাগলের দৌরাত্ম।ধান আর কতগুলো পাও?' 

'সে যাই পাই।মাঠে সব নীচু জমি।পাড়ের জমি আছে কুথায়!কয়েক টলি পলি মাটি ফেলে দিলে আলু হবে।সবজিবাড়ি হবে।শরীরে খাঁটলে সোনা ফলবে।শখ করে গোপালভোগ ধান লাগাচ্ছি,যাই হোক দু-চারটে তো মুখে তুলতে পারছিস।ক্ষীর পায়েশ পিঠে পোলাও খাওয়া হয় মাঝেমধ্যে।মেয়ে জামায় এলে দিতে পাস।শখের জমি,এমনিই কী রেখিছি!' 

মরিয়ম চূপ করল।মেয়ে জামাইয়ের কথা তাহলে মরদটাও ভাবে! 

হেঁটে হেঁটে কলতলায় এসে দাঁড়াল দু-জন।রায়হান টর্চ জ্বেলেই জিভ চুকচুক করে উঠল, 'এ হেঁ!কাদায় জবজবে হয়ি গেছে,ধুয়ে পড়বি কী করে?জাড়ে ভিজে কাপড় পরিস না।ঠান্ডা লেগে যাবেক।' 

মরিয়ম বলল, 'আমি আর কাদা গায়ে ঘরে ঢুকব নি।পিড়ের আলগুনিতে তোলা আছে,একটা শাড়ি আনো তো।' 

রায়হান পিড়েতে চুপিচুপি ঢুকে আলনা থেকে হলুদ রঙের শাড়িটা নিয়ে নিঃশব্দে ফাঁকে বেরিয়ে এল।আসার সময় একবার বাপির ঘরের দিকে চাইল।দরজাটা ঠেসানো আছে।তাহলে বউকে নিয়ে ঘুমচ্ছে। 

মরিয়ম শাড়ি পালটাতে পালটাতে বলল, 'তুমার কী লাজলজ্জা নাই!যাও,ঘরে গিয়ে শোও গা।' 

রায়হান বলল, 'এই শাড়িটায় তুকে দারুণ লাগছে মরিয়ম।হলুদ পাখির মতো।' 

মরিয়ম লজ্জায় জিভ কাটল, 'ধ্যাৎ!দিনকে দিন খোকা হচ্ছ তুমি?' 

পুবের আকাশ সামান্য ফরসা হয়েছে।মসজিদের মাইকে ফজরের আজান হাঁকল মোয়াজ্জিন।শাড়িটা পালটে কাদা লাগা শাড়িটা কেচে দুই হাত দিয়ে জল নিঙড়াচ্ছিল মরিয়ম,হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ!হাতের কাজ হাতেই রইয়ে গেল। 

বাপির বউ জুলেখা আজান দিলেই রোজ উঠে পড়ে।কলতলায় গিয়ে বদনায় পানি ভরে ওজু করে।নামাজ সে কোনো দিন পড়তে কসুর করে না।আজও সেই মতোই উঠেছে।পিড়ের বাঁশের দরজাটা খোলা দেখে প্রথমে খানিক থমকে দাঁড়াল জুলেখা।তারপর ভাবল,শাশুড়ি ওজু করতে উঠেছে।ফাঁকে বেরিয়ে গেল হুট করে।বেরিয়েই জিভ কাটল!ভোরের বেলা শাশুড়ি শাড়ি কাঁচছে!পাশে আবার শ্বশুরও দাঁড়িয়ে!লজ্জায় পোঁ করে ঘর ঢুকে গেল জুলেখা। 

রায়হান বলল, 'বাপির বউ ওমন করে চলে গেল কেনে বলত?' 

উঠোনে টাঙানো দড়িতে ভিজে শাড়িটা মেলতে মেলতে মরিয়ম বলল,'মরণ!' মুখ ঝামটা দিয়েই সুর সুর করে চলে গেল মরিয়ম। 

রায়হান কিছুক্ষণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে একলাই দাঁড়িয়ে রইল উঠোনে।আজ এই রাতটা তার কাছে বড়ই মায়াবী লাগছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. বেশ ভালো লাগল গল্পটি পড়ে। এতো সব, আমাদের ঘরের কথা। আপনার কথার আঁচড়ে এক পার্থিব ও অপার্থিব জগতের আলোকে, অসাধারণত্ব পেয়েছে, সাধারন এক ঘটনা। শেষটিও ছোটগল্পের নিয়ম মেনে পাঠক কে ভাবাবে। দু'এক জায়গায় ই হবে য় অথবা উল্টোটি।

    উত্তরমুছুন
  2. খুব ভালো লাগল। নিটোল ছোটো গল্প। লেখার মুন্সীয়ানা মুগ্ধ করে।

    উত্তরমুছুন