ছুটির লেখা : যুবক ও একটি মাস্ক



মোবাইলে কথা বলছিল তরুণ ছেলেটি।বয়স বাইশ তেইশের বেশি হবে না।গায়ের রং ফর্সা,লম্বা,একহারা গড়ন।নিম্ন মধ্যবিত্তের অবয়বে জিন্সের প্যান্ট,ফুলহাতা প্রিন্টের শার্ট।মুখে কোনো মাস্ক নেই।

এক মুহূর্ত দ্বিধা করলাম।করোনা প্যানডেমিকের এই দুর্যোগময় কালে বাসে এর পাশের সিটে কি বসা ঠিক হবে ? পরক্ষণেই নিজেকে আবিস্কার করলাম ভদ্রতার সুরে জিজ্ঞেস করছি, এখানে কি বসা যাবে?সিট আছে খালি?ভেবেছিলাম জানালার সাইডে ফাঁকা আসনে সরে যাবে।কিন্ত্তু না, তার পরিবর্তে সে নিরবে উঠে গিয়ে আমাকে জানালার পাশের আসনে বসার ইঙ্গিত করল।আমি ভেতরে সেঁধিয়ে গেলাম।
বাসের যাত্রীদের অধিকাংশের মুখে মাস্ক নেই।থাকেও না।এ লোকাল রুটে আমি নিয়মিত যাত্রী।দেখতে দেখতে এখন গা সওয়া হয়ে গেছে।বাঙালি এক অদ্ভুত অকুতোভয় জাতি।হজম ক্ষমতা প্রবল। স্বয়ং ঈশ্বর আছেন প্রবলভাবে তাদের পাশে। ফলে কিছুতেই কিছু হয় না।অবলীলায় সবকিছু হজম করে ফেলে। ইউরোপ আমেরিকা জয় করা পরাক্রমশালী করোনা পরাভূত হয় এখানে এসে।বেচারা! শুধু আমার মতো ভীরুদের জন্য ব্যাপারটা খানিকটা অন্যরকম। 

ছেলেটা মোবাইলে কথা শেষ করেছে। এই-ই সুযোগ। 

আমি স্নেহাদ্রসুরে তাকে বললাম,বাবারে,তোমার মুখে মাস্ক কই? মাস্ক পরোনি কেন? মাস্ক পরো!
সে পকেট হাতড়ায়।বুক পকেট,প্যান্টের পকেট।না মাস্ক নেই।আদৌ ছিল না কোনোকালে।

বলে,মাস্ক দিয়ে কী হবে?বলতে বলতে আবারও পকেট হাতড়ায়।যেন খুঁজে পাচ্ছে না। কিন্ত পকেটে মাস্ক থাকলে তো?

ঠিক,কী হবে মাস্ক পরে?মাস্ক ছাড়াই তো দিব্যি চলছে সব!

মাস্ক না পরলে এ যুবকের কিছুই হয়তো হবে না।তার তরুণ বয়সের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কাছে দুর্বল করোনা ভাইরাস হেরে ভুত হয়ে যাবে। এ তরুণ নিজে কিছুই টের না। তার দরকারও নেই।বোধহয় অকারণেই কথা বাড়াচ্ছি আমি।

বিবিসি এক খবরে বলছে, এক জরিপে নাকি দেখা গেছে যে গড়ে ঢাকা শহরের দুই তৃতীয়াংশের বেশি মানুষ নির্বিবাদে করোনা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে কোনোরকম উপসর্গ,লক্ষণ ছাড়াই।বিশেষ করে যুবক শ্রেণির মাঝে এটা খুবই দেখা গেছে। আর তাদের সংখ্যা শতকরা আশি ভাগ।
অতএব চেপে যাও বাপু!

কথা না বাড়িয়ে অফিসের ব্যাগ থেকে এক্সট্রা একটা মাস্ক বের করে যুবকের হাতে ধরিয়ে দিই।বলি,মাস্ক দিয়ে কী আর হবে? পরতে হবে!বাবারে, তোমার এ বয়সে শরীরের যে জোর, যে শক্তি, তা তো সবার নেই!তাই নিজের জন্য না হোক, অন্তত অন্যদের জন্যও না হয় মাস্ক পরলে একটু! নাও ধরো।আশা করি এরপর মাস্ক পরতে তোমার আর কখনো ভুল হবে না!

সে খপ করে আমার হাত থেকে মাস্ক নিয়ে ঝপ করে মুখে পরে।

গল্পটা এখানে শেষ হতে পারত।ভালই হতো তাহলে অল্প কথার গল্প।কিন্তু না। হতাশ হয়ে বলতে বাধ্য হচ্ছি, হা কপাল!উল্টো মাস্ক পরেছে সে!

মাস্কের ভেতরে প্লাস্টিকের একটা নরম কাঠি থাকে।ওটা ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে নাকের উপরে সেঁটে থাকে।ছেলেটা যেভাবে মাস্ক পরেছে তাতে কাঠিটা নাকের উপরে নয়, অবস্থান করছে তার থুতনির নিচে।অর্থাৎ কিভাবে মাস্ক পরতে হয় আদৌ সে জানে না। 

আমি তাকে সাহায্য করি।মাস্ক খুলে ফের ঠিক করে পরাই।

বোধহয় একটু লজ্জাই পায়।হালকা করার জন্য মজা করে বলি,এই যে এত করোনাফরোনা চলছে, তুমি মনে হয় এ জিন্দেগিতে কোনোদিন মাস্কটাস্ক পরা দূরে থাক, ছুঁয়েও দ্যাখোনি!ঠিক কিনা?
সে উপরে-নিচে হ্যাঁ-সূচক হাল্কা মাথা নাড়ায়।

গত পঁচিশ বছর ধরে যুব দপ্তরে আমি কাজ করছি। যুবাদের সাথে কথা বলতে আমার ভাল লাগে।স্বচ্ছন্দও বোধ করি।তাই যুবা পেলে গায়ে পড়ে কথা বলার একটা বদাভ্যাস দাঁড়িয়ে গেছে।এ দপ্তরেই আমার ডাল-ভাত-রুটি-রুজি।তাই যে কোনো ফর্মেই হোক, যুবাদের সাথে ইন্টারআ্যকশন আমার কমফোর্ট জোন।বন্ধুসুলভ গলায় কিভাবে কথা বলতে হয় জানি।সুতরাং ছেলেটির সাথে যে কোনো ভুল বোঝাবুঝি হয় না সে কথা বলাইবাহুল্য। 

শেষ স্টপে আমি নামবো।আমার গন্তব্য এখনো বহুদূর। আচ্ছা, পাশের তরুণ বন্ধুটি কিছুটা কি অপ্রতিভ?শক্ত হয়ে বসে আছে যেন! লজ্জা পেয়েছে আমার কথায়?আমার কাছে তা মনে হয় না।
এ বয়সের সাথে সখ্যতার অভিজ্ঞতা আমার সিকি শতক।খুব জানি তরুণ বয়সের মনের অলিগলি।এও জানি, সততই তারা উদার।তাদের গ্রহণ ক্ষমতা প্রচন্ড।অতসত মাইন্ডের ধার ধারে না।

পরের স্টপেজে ছেলেটি নেমে যায়। চালু জায়গা।এখানে নদীর উপরে অনেকটা উঁচুতে ব্রিজ। ব্রিজের এপারওপার দু'দিকেই বড় জমজমাট বাজার। প্রচুর দোকানপাট।মানুষে গিজগিজ। নদীটাও বিখ্যাত।মাইকেল মধুসূদনের কপোতাক্ষ নদ। দক্ষিণে এদিকটায় নেমে এসে বেশ স্বাস্হ্যবান চেহারা।কুলকুল বয়ে চলেছে। নীল স্রোতধারা।বড়ই মায়াময়।ছেলেবেলার মতো ঝাপ দিতে ইচ্ছা করে।

বাসটা থেমে আছে।জানালা দিয়ে আমি বাইরে মুখ বাড়াই। উদ্দেশ্য, দেখতে চাই যে তরুণটি মাস্কটি পরে আছে নাকি বাস থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই খুলে ফেলেছে। 

কিন্তু তার আর দেখা পাই না। সে মিশে গেছে জনারণ্যে।
 
 
--------------
 
লেখক পরিচিতিঃ
চন্দন মণ্ডল
গল্পকার। গদ্য লেখক।
যশোরে জন্ম। এখন খুলনায় থাকেন।
 

 
 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ