সোনাবুড়ির শতছিন্ন শাড়িটার দিকে আর তাকানো যায় না অথচ বুড়ি ওই নরুন পেড়ে সাদা শাড়ি ছাড়া কিছু পরবেও না নইলে পুরোনো দুচারটে ছাপা শাড়ি কি আর যোগাড় হয় না চেয়ে চিন্তে? অনেকেই পুরোনো শাড়ি জামা দিয়ে দানধম্ম করে। কিন্তু এই নরুন পেড়ে শাড়ি কজনই বা পরে যে দেবে!
কী যে সব সংস্কার! সাদা পরল কি রঙিন তা দেখার কে আছে বুড়ির? কোনদিন খেল আর কোনদিন উপোস দিল সে দেখারও কি কেউ আছে? অথচ ছিল, এককালে তো ছিল নিশ্চই। সেই কত যুগ আগে বুঝি এখানে ঘর ভাড়া নিয়ে এসেছিল তারা। গরীবের পাড়া। সবই দিন আনা দিন খাওয়া সংসার। একটানা টালির ছাউনিতে একখানা ঘরে সংসার ছিল সোনাবউয়ের। তবে সে সময়ের প্রতিবেশীরা, যারা সোনাবউ ডাকত তারা বেশিরভাগই মরে হেজে গেছে বা উঠে গেছে আর কোথাও। সেদিনের সেই সোনাবউ এখন মুখেমুখে সোনাবুড়ি হয়ে আঁচল পেতে বসে থাকে বড়রাস্তায় মনিহারি দোকানের ছায়ায়। চায় না কিছু। কেউ নজর করে কোলে দুটো পয়সা ফেলে দিল তো খাবার কিনে খায়। অতএব দুবেলা পেট ভরলে কেমন তৃপ্তি হয় সেও ভুলতে বসেছে বুড়ি বহুকাল।
আজ আবার দেখো আঁচলের নিচে চকচকে কাঁসার বাটিখানা নিয়ে বেরিয়েছে। ওই একটিই সম্পদ। ওটিকেই যা যত্নআত্তি ওর। কখনও বাটি নিয়ে পড়শিদের ঘরে সামনে দাঁড়ায়। খুব চেষ্টায় বলে উঠতে পারে, “দুটো খেতে দিবি? বড্ড খিদে পেয়েছে। কিছু নাই ঘরে”
এতদিন বেঁচে থাকাই বা কেন? ঠাকুরকে জিজ্ঞেস করে। মরলে প্রাণের আগে পেটের জ্বালাটুকু চুকে যায় যে! নয় নয় করে যেটুক যা ছিল সবই বিক্রি করে তো এই পেটেই ঢুকেছে। শুধু এই বাটিখানারই বড় মায়া। একে বুক ছাড়া করেনা বুড়ি।
মাঝে মাঝে উল্টোদিকের বিরিয়ানি কাবাবের দোকানের সামনে গিয়ে ওই বাটি হাতেই দাঁড়ায়। হানিফের স্পেশাল কাবাব-সাইনবোর্ড টাঙ্গানো। দোকানের কর্মচারী রতন হাসে, “তুমি মাংস খাবে নাকি ঠাকমা? দাঁড়িয়ে আছ যে?”
বুড়ি জানে ওটা ঠাট্টা। রতনও জানে ঠাট্টা আর এও জানে বুড়ি কেন এসেছে। এসেছে দুটো ছাই নিতে। ওই ছাই দিয়ে বাটিখানা রাস্তার কলের পাশে বসে বসে মেজে চকচক করে তুলবে।
বাটি হাতে বুড়িকে দেখেই দোর বন্ধ করে দেয় পাশের ঘরের বউটি। টানাটানির মহল্লাতেই ঘর। কার সংসারই বা উপচে পড়ছে? অথচ বুড়ো মানুষ বাটি নিয়ে দাঁড়ালে ফেরানো যায়?বউটি এ বাসায় নতুন। ছেলেমানুষ বয়স। সংসার এখনও তাকে ছিবড়ে করেনি। না দিতে পারার লালচে কষ্টবোধটুকু এখনও পাকা ফোঁড়ার মত টসটস করে মনে। তাই ঠোঁট চিপে সরে যায়, বিছানার চাদরে হাত বোলায়। আগের রাতের কথা ভেবে মনটা অন্যদিকে ঠেলে দেয়।
সোনাবুড়ি সেসব জানতে পারে না। এগোয় আর একটু। বাটিটি আঁচলে লুকিয়ে রুমা, টুসি, পিঙ্কি, রানুদের দোরে একবার করে দাঁড়ায়। সবকটি দরজাই বন্ধ। বুড়ির হাত সরেনা ধাক্কা দিতে। শূণ্য চোখে তাকায়, ঠুকঠুকিয়ে এগোয়।
রাস্তার ওপর ফুটপাথ ঘেঁষে পরপর সবুজ রঙা দরজা। এইসব পথের কোলে ঘর তুলে দোর বসানো বাড়ি উত্তর কলকাতার মাঝবয়সে তৈরি। গায়ে গায়ে আটকে থাকা বাড়িগুলোর কোনো একটি দরজা ঢুকে যায় টানা পথে বাড়ির অভ্যন্তরে। সে দরজাটি আকারে একটু হলেও বড়সড়। খোলা থাকলে টুক করে ঢুকে ফেরিওয়ালা দুদন্ড বসে একটু জিরিয়ে নেয় যদি না ভেতর থেকে কেউ মুখনাড়া দিয়ে বার করে দেয়। সেই দরজাটি রাজদরজা আসলে। আর বাকি ছোট দরজাগুলো ফুটপাথ থেকে সটান উঠে দাঁড়িয়ে পাশাপাশি এক এক ঘরের ভাড়াটের সংসার দিয়ে পাড়া সাজিয়ে রাখে।
রুমা পিঙ্কি রানুরা নিজেদের ওই একফালি ভাড়া ঘরের দরজায় দিনের মধ্যে চোদ্দবার এসে দাঁড়ায়। সিনেমা সিরিয়ালের গল্প, চুলে তেল ঘষা, পথচলতি লোক দেখে হাসাহাসি টোনটিটকিরি, ফেরিওয়ালা দাঁড় করিয়ে দরাদরি সব ওদের ওই দরজায় দাঁড়িয়েই। অথচ এখন দেখ, বুড়ির মুখের সামনে সবকটি দোর বন্ধ।
সোনাবুড়ির ফোকলা মুখে জিভ এলিয়ে যায়। বড় খিদে। আগের রাতে শনি মন্দিরের সিন্নি পেসাদ খেয়েছে। একটা ছোট কলা চাইতে ইচ্ছে করছিল খুব বাউনঠাকুরের কাছে। পারে নি। দুচোখ ভরে পুজো দেখেছে বসে। তারপর ঠাকুরকে গড় করে মনে মনে বলেছে, একটা কলা দেবে ঠাকুর? তোমার থালায় কত ছড়া করে কলা। একটা কলা খেতে দেবে আমাকে?
ঠাকুর দেয়নি। কিই বা দিয়েছে আজ অব্ধি ঠাকুর বুড়িকে?
সামনের বন্ধ দুয়োরে মরচে পড়া শিকলটা দুলছে। এখুনি দরজা বন্ধ করে দিল ওকে দেখে টুসি। কত বড় হয়ে গেছে মেয়েটা। বুড়ি দাঁড়িয়ে ভাবে, তখন ক'মাসের যেন! ওর মা মায়ের দয়ায় বিছানা নিল। টুসির বাপ সোনাবুড়ির কাছেই মেয়েকে রেখে কারখানায় যেত। অল্প দুধে অনেকটা জল আর একটু চিনি মিশিয়ে ঝিনুকে করে খাওয়াত বুড়ি, কোলে থাবড়ে ঘুম পাড়াত। ক’টা দিন ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে ওর ঘরেই রেখেছিল বাচ্চাটাকে। তখনও সে এতটা বুড়ি হয়নি। তখনও টানা তিন চারদিন না খেয়ে কাটাতে হলে এমন প্রাণ বেরিয়ে যেত না। তখনও আর কে যেন ছিল ওর, অত আর মনেও পড়ে না।
বাটিটাও আঁচলের নিচ থেকে যেন চারিপাশ দেখে বড় আগ্রহে। কতকাল হল ও কানায় কানায় ভরে ওঠে নি। এই সোনার মত রূপ নিয়ে কি হবে ভেতর যদি ফাঁকা হয়! চকচকে কাঁসার বাটিখানা তাই যেন কিছুটা কুন্ঠিত। বাটির মধ্যে যদি প্রাণ থাকত তো এত রূপসী হতে সে আপত্তি করত নিশ্চই এতদিনে। বুড়ির ফাটা কোঁচকানো চামড়া ঢাকা হাত, ভোঁতা ময়লা আঙ্গুল, ফাটা ফাটা কালচে নখ, শতেকছিদ্র শাড়ির মধ্যে ও যে কী বেমানান তা যেন বাটিটা নিজেও বোঝে। তাইই বুঝি ছোট একটা হোঁচট খাওয়ার সুযোগে হাত থেকে গড়িয়ে যায় রাস্তায়, কলের নিচের পাথরে গিয়ে রিন্রিন্ শব্দে ধাক্কা খেয়ে থামে।
কলে বালতি পেতে বসে চান করছিল যে ছেলেটি সে এদিক ওদিক তাকিয়ে বাটিটা চট করে তুলে বালতিতে ডুবিয়ে দেয়।
সোনাবুড়ি খুনখুনিয়ে আপত্তি করে ওঠে "ও কী! আমার বাটি! আমার বাটিটা নিয়ে নিচ্ছ যে! ফেরত দাও বলচি”
ছেলেটা ভাব করে এমন যেন বুঝতেই পারছে না কী বাটি, কোন বাটি, কোথায় বাটি।
বুড়ি ককিয়ে ওঠে, “ও বাপ! আমার বাটিটা দিয়ে দাও বাপ...ও খোকন! ও সোনা বাপ আমার, বাটিটা দাও আমার…”
নিজেদের জানলায় দাঁড়িয়ে টুসি,পিঙ্কি, রানু, রুমা দেখে বুড়ির ছেঁড়া আঁচল গা থেকে খসে পড়ছে, বুড়ির ক্ষীণ গলায় হাহাকার যেন চড়া রোদে মিলিয়ে যাচ্ছে ফুটে উঠেই। বুড়ি পারছে না ঝগড়া করে নিজের বাটির অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। হেরে যাচ্ছে বুড়ি ওই উদ্ধত চোর যুবকটির কাছে। অথচ ওরা তো জানে বুড়ির চিৎকার করা উচিত, ওরা তো জানে বুড়ি বাটি নিয়েই বেরিয়েছিল ঘর থেকে, ওরা তো দেখেছে ছেলেটা বাটিটা চট করে তুলে নিল রাস্তা থেকে।
ছেলেটা বিরক্ত চোখে তাকিয়ে বলে, “কী বাটি বাটি করছ?”
সোনাবুড়ি চেঁচানোর চেষ্টা করে “ওই তো আমার বাটি যে তুলে নিলে তুমি! ওটা আমাকে দিয়ে দাও বলছি!”
ছেলেটা ইচ্ছে করেই জল ছিটিয়ে দেয় রাস্তার কুকুরগুলোর গায়ে। একটা পাত্তা দেয় না। অন্য দুটো ঘেউ ঘেউ করে পাড়া গরম করে। কুকুরের চিৎকারে বুড়ির কান্না চাপা পড়ে যায়। ছেলেটা কলতলায় গা ঘষে ঘষে চান করতে থাকে। কোমরে জড়ানো গামছাটা অশ্লীলতার সন্ধি অবধি সরিয়ে সরিয়ে এমনভাবে সাবান ডলতে ডলতে জানলাগুলোর দিকে তাকায় যেন দুর্যোধন উন্মুক্ত উরু দেখিয়ে উত্তেজিত করতে চাইছে দ্রৌপদীকে।
টুসি নিজের দরজাটা আধখোলা রেখে বাইরে এসে দাঁড়ায়। বলে, “বাটি নিয়ে নিশ্চই দুটো ভাত চাইতেই আসছিল। আমাদের ঘরে ভাত হলেই গন্ধ পায় তো। এলে মা এক হাতা দেয়”
পিঙ্কি বলল, “হতে পারে বাটি করে তেল চাইতে আসছিল, হয়ত বিশু ওর সবজির ভ্যান থেকে পচা কুমড়ো কি আলু কি ঝিঙ্গে দিয়ে দিয়েছে। বেলা হয়ে গেলে পোকাধরাগুলো তো দিয়ে দেয় অনেক সময়”
রুমা বলে, “কদিন আগে নলিনের মিষ্টির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল তো বাটি নিয়ে। দোকান থেকে কে একটু রস ঢেলে দিল। কী হাসি সেই রস খেয়ে! আমি তখন টিউশনি থেকে ফিরছিলাম”
বুড়ি কাঁদছিল খুনখুন করে। কুকুরগুলো বেওয়ারিশ ঘুরছিল এদিক ওদিক। মেয়েগুলো দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াচ্ছিল একে একে কারণ বাটিহীন বুড়িকে ধার না দিতে পাড়ার চিন্তাটা আর ভাবাচ্ছিল না ওদের সেই মুহূর্তে।
কলতলায় ছেলেটা চটুল গান ঠোঁটে নিয়ে মেয়েগুলোকে দেখে উত্তেজিত হয়ে সাবান ঘষতে ঘষতে জানু থেকে তলপেট, ছাতি, বগলতলা, ঘাড়, গলা, মাথা অব্ধি শরীরে সমস্ত নিভৃত অনিভৃত অংশ সস্তা ফেনায় এমনভাবে ঢেকে দিচ্ছিল যেন সে সমুদ্রসৈকতে হারিয়ে ফেলেছে নিজেকে।
রানু, রুমা, পিঙ্কি, টুসি পায়ে পায়ে নেমে আসছিল রাস্তায়। ওদের খর দৃষ্টির সামনে ছেলেটার স্নানলীলা যেন কুকুরগুলোকেও বিস্ময়ে চুপ করিয়ে রেখেছিল।
বুড়ি আর একবার চেষ্টা করল "আমার বাটিটা নিয়ে নিও না গো। ওই আমার একটা মাত্র বাটি"
ছেলেটা পাত্তা না দিয়ে ঝুপ ঝুপ জল ঢালছিল মাথায়। গানের বিরতি নেই তার।
এমন সময় রানু এগিয়ে এসে বালতিতে হাত ডুবিয়ে বাটিটা তুলে নিল আচমকাই তারপর শানানো গলায় চেঁচিয়ে বলল "বুড়ো মানুষের জিনিস চুরি করতে লজ্জা করে না? হারামীর হাতবাক্স সব! তখন থেকে দেখছি… বুক ফুলিয়ে চান করা হচ্ছে আবার! খুব সাহস, না?"
ছেলেটা যেন এক মুহুর্ত কুঁকড়ে গিয়েও ফুঁসে উঠল। আগুনচোখে সোনাবুড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, “বাটি তোমার নাকি? কার বাড়ি থেকে চুরি করেছ?”
বুড়ি কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই খান্ডারনী মেয়েগুলো আর বেকার কুকুর তিনটে একসাথে চিল্লিয়ে উঠল। ফালতু ঝগড়া করে লাভ নেই বুঝে রোদরাঙা দুপুরটাকে অপমানিত করে ছেলেটা ভিজে গায়ে উঠে গেল কলতলা থেকে। হুঁঃ ভারি তো একটা বাটি!
রানু বাটিটা সোনাবুড়ির হাতে দিতে গিয়ে দেখল বুড়ির মুখখানা ভেঙ্গে চুরে বেঁকে যাচ্ছে যেন। এইই বুঝি ওর কান্নার রকম। শরীরে একফোঁটা জলও নেই যে চোখ দিয়ে বেরিয়ে আসবে।
বুড়ি দু হাত তুলে আশীর্বাদ করল বুঝি বিড়বিড়িয়ে। কী বলল শোনা গেল না ঠিক।
তারপর ছেঁড়া ময়লা আঁচলটি দিয়ে পরম মমতায় বাটিটাকে মুছতে মুছতে ডুকরে উঠল, “চুরি করি নাই! চোর নই গো আমি…এ আমার খোকার দুধের বাটি ছিল গো!”
পিচের রাস্তাটা ঝগড়াটি মেয়েগুলোর উল্লম্ব ছায়া আর কুকুরের ছড়ানো এঁটোকাটা সমেত বুড়ির পাশে পাশেই যাচ্ছিল যখন বুকের কাছে বাটিটি আঁকড়ে পায়ে পায়ে বুড়ি ফিরছিল ঘরের দিকে। ভুলেই গেছে সে তখন কী চাইতে বেরিয়েছিল রাস্তায়। ভুলেই গেছে সে কাল ঠাকুর তারজন্য একটা কলা অবধি বরাদ্দ করে নি। ভুলেই গেছে পেট ভর্তি খিদে সইতে না পেরে দুটো ভাতের আশায় পথে বেরিয়েছিল সে। বাটিখানা ফিরে পেয়ে খিদে তেষ্টা বুঝি মিটেই গেল সোনাবুড়ির।
ধীর পায়ে রোদ মাড়িয়ে ঘরে ফেরা বুড়িকে দেখতে দেখতে টুসি পিঙ্কিকে বলল, “আবার কাল দেখবি বেরোবে ওই বাটি নিয়ে।মাকে জিজ্ঞেস করে একমুঠো ভাত দিয়ে দেব না হয়”
পিঙ্কি রুমাকে বলল, “ভাত থাকলে ভাল না হয় একটু মুড়ি দিয়ে দেব জল দিয়ে। অনেক্ষন ধরে পাকলে খেতে পারবে”
রুমা উদাস চোখে তাকিয়ে বলল, “দিস। নলিনের দোকান থেকে দু চামচ রস চেয়ে দেখব ‘খন। সব রসই কি কাজে লাগে নাকি? দেবে নিশ্চই।”
লেখক পরিচিতি
সঙ্গীতা দাসগুপ্তরায়
লেখক। কোলকাতায় থাকেন।
1 মন্তব্যসমূহ
Thakur emon lekhak diyechhe
উত্তরমুছুন