অনুবাদ : বিপ্লব বিশ্বাস
আমার লেখক জীবনের সামগ্রিক রূপান্তর শুরু হয়েছিল, অনিবার্যভাবেই মনে হয়, শুধু একটি ধারণা দিয়ে। একটি নতুন উপন্যাস লেখা শুরু করতে যাচ্ছিলাম, ঘোড়দৌড় নিয়ে, এক হাস্যরসের উপন্যাস, এবং আমাকে বলতেই হয়, আমি বাধাহীনভাবে এই লেখা নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলাম।
আগেও ' মূ '(Moo) নামে এক মজার উপন্যাস লিখেছি, আমার অফিসে বসে, আমি নিশ্চিত ছিলাম যে আমার শ্রেষ্ঠ শ্রোতা - পাঠক ছিল ; হাসির সব লাইন লিখছি, পাতার পর পাতা, অধ্যায়ের পর অধ্যায়, আর সব সময় হেসেই চলেছি। ' মূ ' লেখার সময় মধ্যেমাঝে কয়েকটি পাতা হাতে নিয়ে ঘাড় উঁচিয়ে রাস্তায় বেরুতাম আর সেখান থেকে জোরে জোরে পড়তাম ; লক্ষ করতাম, কিছু অর্থপূর্ণ অথচ ফাঁকা দৃষ্টি আমার ওপর পড়ছে। এ জগতে কী আছে, কে আছে যার সম্পর্কে আমি বলছি?
শেষ অব্দি ' মূ ' এক শ্রোতা খুঁজে পেল আর বছরকয় পর আমি নিজেই খুব উপভোগ করলাম কেননা আমি তখন অন্য যারা এটি পড়ে মজা পাচ্ছিল তাদের কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া, চিঠিপত্র পেতে শুরু করেছি। কিন্তু অনেক দেরিতে। সেই সময় আমি ' The All True Travels and Adventures of Lidie Newton ' লিখছি এবং আগের সেই মন - মেজাজ আমার ছিল না।
সুতরাং আমার এক নতুন বন্ধু আর এক নতুন উপন্যাস জুটল। এই দুটিকে এক জায়গায় আনার চেয়ে সহজ কাজ কী হতে পারত অর্থাৎ সেই শ্রোতার সামনে অধ্যায় ধরে ধরে জোর উচ্চারণে উপন্যাসটি পড়ে যাওয়া?
জ্যাক নামে আমার সেই বন্ধু খানিক দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ল। সে ঠিক পাঠক ছিল না আর আমার লেখা কোনও বইও সে পড়েনি। তার ভূমিকা যে কী, সে জানত না। তার কি কোনও পরামর্শ দেবার ছিল? সঠিক জায়গায় সে কি হেসে কুটিকুটি যেত?সে কি বিরক্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ত যেহেতু ঘোড়দৌড় বিষয়ে সে যখন কিছুই জানত না?
আমি যেটা তাকে বলিনি তা হল আমার ব্যক্তিগত আনন্দলাভই এ ক্ষেত্রে মূল বিষয়। তার উপস্থিতি শুধু এই কারণেই যে আমার নিজস্ব ঠাট্টা - মস্করার কথা শুনে সে উপহাসে ফেটে পড়বে। বাস্তবিকই সে তার ভূমিকা যথাযথই পালন করেছিল। যা কিছু সে করেছিল তা হল হেসে ওঠা, মাথা ঝাঁকানো, ' হুম ' বলে ওঠা, ' হ্যাঁ ' বলা বা ধন্যবাদ জানানো। কোনও পরামর্শ নয়, নয় কোনও সমালোচনাও। আমি যখন পড়তে পড়তে সেই উপন্যাসের অধ্যায়গুলির মাঝামাঝি পৌঁছে যেতাম, সে জানতে চাইত, পরবর্তী পাঠ কবে হবে। এতে আমি নিজেকে ঠেলা লাগাতাম যাতে করে আরও কিছু পাতা লিখে তাকে শোনার জন্য ডাকতে পারি ।
এই রূপান্তর প্রক্রিয়া শুরু হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। মধ্যেমাঝে কিছু লিখতাম এবং এটা ভাবতাম না যে ' আমার এটা পছন্দ হচ্ছে ', বরং ভাবতাম ' ওহ্, জ্যাক এটা পছন্দ করবে '। আমি আরও জোর হেসে উঠতাম, ওর জন্য হাসতাম, হাসতাম নিজের জন্য আর ওর সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নেবার কথা ভেবে।
তার পক্ষে আমার নান্দনিকতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতেও খুব একটা সময় লাগেনি। উপন্যাসটির প্রথম দু তিনটি অধ্যায় সে ঠিক বুঝতে পারেনি কিংবা সঠিকভাবে বোধগম্য করতে পারেনি কিন্তু তারপর থেকে লক্ষ করতে শুরু করলাম, ঠিক যে জায়গাটিতে বিশেষ কোনও ব্যঙ্গ বা কোনও নির্দিষ্ট মতামত আমার অভিপ্রেত ছিল ঠিক সেই জায়গাটিতে সে সব সময় প্রায় ঘোঁতঘোঁত করেছে, মুচকি হেসেছে নয়তো বিড়বিড় করে উঠেছে।
এ বিষয়ে ভাবনার দুটি পথ ছিল। একটি, আমার মুখনিঃসৃত কথাসব তার বোধগম্যতা ও আবেগ উভয় স্তরেই স্পষ্ট সংযোগ ঘটাতে পেরেছিল। অপরটি হল, আমাদের উভয়ের মধ্যে একটি সমন্বয় ছিল। আমি এই দুটিকেই পছন্দ করেছিলাম।
প্রায় মাসতিনেক ধরে দেড়শো পাতার মতো শোনার পর সে একটি পরামর্শ দিল। আমি বাধা দিতে চাইলেও তা গোপন করলাম। মোটের ওপর সে ছিল অত্যন্ত বিনয়ী ও শ্রদ্ধাশীল। তাই মন দিয়ে তার কথা শুনলাম। সে যা চাইছিল তা হল, কিছু ব্যাখ্যা, কিছু সংশোধন।
ঠিক সেই সময় আমি বুঝতে পারলাম যে সে এ ক্ষেত্রে এক আদর্শ শ্রোতা আর ঠিক সেই সব জায়গাগুলিতে সে সংশোধন চাইছিল যে সব জায়গায় আমি দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম বা যত্নবান ছিলাম না। সে যথেষ্ট মনোযোগ সহকারে শুনছিল এটা জানতে কখন সে বুঝতে পারছিল না এবং কখন সে যা বুঝতে পারছে তা থেকে যা বুঝতে পারছে না তাকে আলাদা করতে সক্ষম হবে।
ঘটনা হল, সে শুধুমাত্র কদাচিৎ সংশোধনের জন্য অনুরোধ করছিল যার অর্থ হল সে প্রায় সবটাই বুঝতে পারছিল। এতে কী যে স্বস্তি! একবার সে একটা রসিকতা করল। উপন্যাসজুড়ে আমি জানোয়ারদের নিয়ে অনেক মজার ঠাট্টা করেছি আর যখন এই রসিকতাটা সে করল, এত জোর হেসে উঠলাম যে হাত থেকে ফোনটা ঘরে আড়াআড়িভাবে ছিটকে পড়ল। সেটাকে যথাস্থানে রেখে যখন আবার পড়তে লাগলাম সে আমার শব্দ ব্যবহার তথা সময়ের ব্যবহার খানিক শুধরে দিল। এই প্রথম আমি সেখানেও লাগাম দিলাম।
সেই জায়গাটি ছিল লোভনীয় যার মধ্যে আমি তৎক্ষণাৎ ঢুকে গেলাম, আমাদের বিচিত্রবর্ণিত ঢঙে পুনঃসজ্জিত সম্পর্ককে প্রকাশ করার জন্য - অর্থাৎ সেই উপন্যাসের মধ্যে আর তারপর তার সামনে তা পড়তে লাগলাম। এই পঠিত অংশগুলিতে তার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ অনেক ' হুঁ- হাঁ ' থাকলেও কোনও খোলাখুলি আলোচনা বা ভিন্ন প্রতিক্রিয়া ছিল না। আমি বুঝেছিলাম যে আমার মতের বিষয়ে আমার অধিকারকে সে সম্মান দিচ্ছে আর সে বুঝেছে যে যা কিছু বিস্তারিত নিরীক্ষণের জন্য নির্ধারিত তাই তার সামনে তুলে ধরা হচ্ছিল - যা একজন লেখকের সঙ্গে সখ্য বিষয়ে পাঠকের পরীক্ষাসমূহের অন্যতম।
এই নিরীক্ষার স্বরূপ বিষয়ে আমাদের মধ্যে বারকয়েক আলোচনা হয়েছে : দর্শক এবং দৃষ্ট বস্তু উভয়ের ক্ষেত্রেই সততা, নির্লিপ্তি আর নির্দিষ্ট সাহসের প্রয়োজন। এইসব আলোচনা আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল যে আমাকেও নিরীক্ষণ করা হচ্ছে এবং প্রকৃত মনোগ্রাহী বিষয় কিন্তু আমাদের উভয়ের বিশেষ নিরীক্ষা নয় বরং নিরীক্ষার কাজটাই মূল।
ঘটনা হল, আমার অন্যান্য উপন্যাসের চাইতে অনেক বেশি এই উপন্যাসটি লেখার সময়, এটা যে জোরে জোরে পাঠ করতে হবে সে বিষয়ে সম্পর্কান্বিত ছিল না। কিন্তু প্রায়ই যখন নতুন একটি অধ্যায় লিখতে বসতাম এবং সে ক্ষেত্রে প্রাথমিক কোনও ধারণা ছিল না যে আমি কী লিখতে যাচ্ছি যার সম্মুখীন কখনও হইনি অথবা যে বিষয়ে আগে নিজে ভুগিনি। প্রায়ই ভাবতাম একটা বিশেষ চরিত্র বিষয়ে কী ঘটতে যাচ্ছে তা আমি ঠিকঠাক জানি কিংবা কীভাবে সেই পুরুষ বা নারী চরিত্র চরম অবস্থা বা পরিণতির সঙ্গে খাপ খেয়ে যাবে - এবং আমি প্রায়ই সেভাবে লিখতাম না। কিন্তু যদিও আমি আমার কল্পনার সঙ্গে আগের চেয়ে অনেক বেশি লড়াই করে গিয়েছি, তবুও সে লড়াই শেষে কম্পিউটার পর্দায় যা ফুটে উঠেছে তা আমাকে যুগপৎ বিস্মিত ও আনন্দিত করেছে যা আগে করেনি এবং আমি সব সময় অন্যকে তার অংশীদার করতে আগ্রহী।
সেখানে একজাতীয় উদ্ভাবনী উচ্ছ্বাস ছিল যা আমাদের উভয়কেই বিনোদিত করছিল যা কি না অতীত - দর্শনী হিসাবে প্রতিদিনের লেখার একটা লক্ষ্য হয়ে উঠল। আমার সন্দেহ, একজন প্রস্তুত ও অবিচার্য শ্রোতা আমি কী করছি সে বিষয়ে জানতে না দিয়ে আমাকে স্বাধীনতা ও আরাম দিয়েছিল, এটাই মেনে নিতে বুঝিয়েছিল যে লেখার শেষ অব্দি যাওয়ার পথটা যা আমি বুঝতে পারিনি তা অবশ্যই বোধগম্য হবে শেষটায় পৌঁছুলে।
আমার লেখা অন্যান্য উপন্যাসগুলি অত্যন্ত গোপন ছিল যা সম্ভবত উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে সহজাত। একদিন তুমি তোমার ঘরে ঢুকলে, আর বছরকয় পর তোমার গোপন ধ্যানের ফলাফল উপস্থাপিত করলে - পরিপূর্ণ ও পরিচ্ছন্নভাবে।
একজন গুপ্ত মানুষের পক্ষে এ জীবন ভালো কিন্তু আমার এতে অস্বস্তি হত, মনে হত দ্বিচারিতাঢঙে গুপ্তচরগিরি করছি যেখানে প্রতিদিনের ভালো অংশের অংশীদার হিসাবে আমি কে তার হদিশ পায় না আমার প্রিয়তম সঙ্গীরা আর হয়তো তাদের কাছে এমন মনে হয় এ যেন পণ্য উৎপাদনের ভিন্ন এক রূপ মাত্র। যে প্রক্রিয়া আমার ক্ষেত্রে একটা ভাবনার বিবর্তন, অনুভব, নান্দনিকতা এবং পরিচয় গড়ে তুলেছে তা তাদের কাছে একটা আস্ত বই আর উপার্জন মাত্র। আমার এই লিখন - প্রক্রিয়ায় জ্যাকও এই বিবর্তনের একটি পক্ষ, একজন অংশীদার। এমনকি আমাদের মধ্যে এই সদাশয় গোপনও নেই।
এর মাঝ দিয়ে আমি অবলোকন করলাম যে উপন্যাস লেখার বিষয়টা বাক্সের ভেতর জিনিসপত্র রাখার চাইতে অনেক বেশি হৌজ পাইপের মাঝ দিয়ে জল পাঠানোর মতো। কেননা যেমন মাথায় এসেছে আমি সেভাবেই আমার উপন্যাস লিখেছি, কীভাবে তা ভেতরে প্রবেশ করেছে সে বিষয়েও আমি সচেতন ছিলাম : মানুষজনকে যে সব প্রশ্ন করেছিলাম ও তাদের উত্তর, যা কিছু আমি দেখেছি এবং ব্যবহার করেছি, যা কিছু আমি আবডালে শুনেছি, পড়েছি তা সব এক সঙ্গে মিশিয়ে দিনের লেখা শেষ করেছি।
ডেভিড লজ তাঁর ' After Bakhtin ' বইতে উপন্যাসের বিভবকে আঁকড়ে ধরার ক্ষেত্রে সাহিত্যতত্ত্বের ব্যর্থতা বিষয়ে তাঁর ভাবনা ব্যক্ত করেছেন এবং তিনি উপন্যাসের বর্ণনাংশের মাঝে যে সব বিচিত্র কণ্ঠস্বর প্রবেশ করে তার মধ্যেই এই বিভব খুঁজে পেয়েছেন - এমনকি যখন লেখক বা লেখিকা তার জোরাল কণ্ঠস্বর খুঁজে পান তখনও। এটা ছিল আমার প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা, অসংখ্য কণ্ঠস্বর আমার মধ্যে ঢুকে আমাকে নাড়িয়ে দিচ্ছে - কখনও কখনও পুরো অধ্যায় জুড়ে আবার কখনও একটিমাত্র শব্দের ক্ষেত্রেও।
উপন্যাস - লিখনকে আমি সব সময় একটি সামাজিক কাজ বলে মেনেছি : তার অফিসে কোনও উচ্চকিত পার্টিতে লেখক একাই তার গুচ্ছের চরিত্রকে বিনোদিত করছেন যা অন্য কেউ দেখতে বা শুনতে পাচ্ছে না। কিন্তু এই ক্ষেত্রে আমি বহুস্বরকে অনেক ক্রিয়াশীলভাবে স্বাগত জানিয়েছি এবং তারা আমাকে বয়ে নিয়ে গেছে, ভাসিয়ে নিয়ে গেছে জ্যাকের কাছে ও সে সব তার মনোযোগ ও আগ্রহের মাঝ দিয়ে আমার কাছে ফিরে এসেছে।
অবশ্যই মনে হয়, একটি হাসির উপন্যাসে নিযুক্ত দুটি পক্ষ একে অপরকে ভালোবাসবে এবং আমরাও তা করেছিলাম ও আমাদের মধ্যে ভালোবাসার সম্ভাবনা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উপন্যাসটিও অনেক বেশি হাস্যরসাত্মক হয়ে উঠবে - এ ক্ষেত্রে যা হয়েছিল। গত বছর যা কিছু লিখেছি সে বিষয়ে দুজনের মধ্যে আলোচনা করেছি। আজ সকালে যখন তাকে বললাম যে ' লিখন - জীবন ' বিষয়ে আমি লিখতে যাচ্ছি সে তখন বলল, ' কী বিষয়ে লিখবে? ' আমি বললাম, ' জানি না। '
তারপর বললাম :"' লিখন -জীবন ''। আমি তোমাকে তিরিশ সেকেন্ড সময় দিলাম, তুমি একটা শব্দ বলো, যে কোনও শব্দ। তিরিশ সেকেন্ড পর সে বলল, " ভালোবাসা। "'
হ্যাঁ, আমার মনে হল, উপন্যাস হল একটি দাগ যেখানে ভাষা, চলাচল, অনুভূতি আর ভাবনা ক্ষণিকের জন্য আঠার মতো জুড়ে যায়, কোনও এক এজেন্সির মাধ্যমে, ধরা যাক, এক বিশেষ স্বেচ্ছাসেবক কিন্তু এটা কোনও বস্তু বা ভূতাবেশ নয় - এটি ভালোবাসারূপ আচরণ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন