গল্পের কাছে কী চাই : স্মৃতি ভদ্র


গল্পের কাছে কী চাই? প্রশ্নটি কিন্তু খুব সরল নয়। বিশ্লেষণী পাঠকের কাছে গল্পের স্বরূপ একরকম, আবার সাধারণ পাঠকের কাছে গল্পের অর্থ অন্যরকম। তাই পাঠকের উত্তোরণের সাথে সাথে গল্পের কাছে প্রত্যাশার রূপও বদল হয়। 

গল্পের কাছে খুব সরল একটি আবেদন, গল্পে যেন গল্প গুঁজে দেওয়া থাকে। আমি যেন পরতের পর পরত সরিয়ে আবিষ্কার করতে পারি সে গল্প। প্রতিটি পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। এজন্য গল্পটিকে হতে হবে বহুমাত্রিক। পাঠক নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করবেন গল্পকে, আবিষ্কার করবেন তার তত্ত্বকে, আস্বাদন করবেন তার শিল্পরসকে। আর ঠিক একারণেই গল্পকে হতে হবে নির্মোহ।


গল্প লেখার সময় লেখক সচেতনভাবে পরিহার করবেন পক্ষপাতিত্ব। কোনো ঘটনা বা চরিত্রের প্রতি লেখকের পক্ষপাতিত্ব গল্পকে দূর্বল করে দেয়। 

এখন প্রশ্ন হলো গল্প কী আখ্যান নির্ভর হবে, না শৈলি নির্ভর? একজন পাঠক হিসেবে আমি অবশ্যই আখ্যান নির্ভর গল্পকে প্রাধান্য দিলেও গল্পের শৈলীকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করতে পারিনা। এক্ষেত্রে বলা যায়, আখ্যান যদি গল্পের প্রাণ হয় তবে শৈলী হলো গল্পে প্রাণ প্রতিষ্ঠার উপায়। একজন পাঠককে গল্পের অতলে নিয়ে যাবার বাহন হলো গল্পের শৈলী। 

গল্পের দ্বন্দ্ব,সংঘাত, বাঁক , মোচড় তো আসলে পাঠককে একনিষ্ঠ করে দেয় আখ্যানের সাথে। গল্পের উত্থান পতনের এক অনিশ্চিত যাত্রা শেষ করে প্রতিটি পাঠক আবিষ্কার করে নেয় তার নিজের আখ্যানটিকে। আর ঠিক এভাবেই একটি গল্প হয়ে ওঠে সামষ্টিক। 

হারুকি মুরাকামির ‘রাতের ট্রেনের হুইসেল বা গল্পের ক্ষমতা’ অথবা রবি শংকর বলের ‘ ঘুম বা অশ্রুর গল্প’ কিংবা বনফুলের ‘নিমফুল’ গল্পগুলো পড়া শেষেও আমাদের আচ্ছন্ন করে রাখে। খোরাক যোগায় ভাবনায়। তাই পাঠক হিসেবে গল্পে আমি অবশ্যই বলিষ্ঠ দর্শন চাই। লেখকের বোধের স্বচ্ছ প্রতিচ্ছবি হবে গল্প। এমনকি গল্প থেকে আমি তত্ত্বও আবিষ্কার করতে চাই। গল্পে এজন্যই লেখকের বয়ান হতে হবে অত্যন্ত সুস্পষ্ট। তবে তা যেন কোনোভাবেই প্রতিবেদন না হয়ে ওঠে। 

কাফকা’র মেটামরফোসিস গল্পটির কথা এক্ষেত্রে বলা যায়। একজন মানুষের পোকা হয়ে যাবার মধ্যেই আমরা আবিষ্কার করি সমাজের এক কদর্য রূপকে, স্বার্থপর সমাজের খসে পড়া মুখোশকে, দূর্বলের শোষিত হবার নিদারুণ যন্ত্রণাকে। অথচ কাফকা’র গল্পটিতে কখনই মোটাদাগে কথাগুলি বলা হয়নি। দর্শন বা বোধগুলো খুবই সচেতনভাবে কাফকা ছড়িয়ে দিয়েছেন গল্পের প্রতিটি স্তরে। 

আর একদম শেষে আসি গল্পের শিল্পবোধ নিয়ে। সাহিত্য শিল্পের একটি অন্যতম রূপ। তাই গল্পকে, গল্পের ভাষাকে শৈল্পিক হবার দায়বোধ তো থাকবেই। 

গল্পের ভাষা হবে সরল কিন্তু তাতে লেখকের শৈল্পিক বোধের আঁচড় অবশ্যই থাকতে হবে। শব্দ দিয়ে লেখক আঁকবেন বিমূর্ত নয়, মূর্ত একটি গল্প। আর একারণেই নান্দনিক ভাষা নির্মাণও একটি সার্থক গল্পের অন্যতম নির্ণায়ক। 

অবশেষে এটুকুই বলতে চাই, গল্পের কাছে আখ্যান চাই, উত্থান পতন বাঁক চাই আর চাই স্তব্ধ হয়ে যেতে। গল্পটি শেষ হবার পরেও তার রেশটুকু আমার ভাবনার জগতে আঘাত করুক, তার অভিঘাতে আবিষ্কার হোক না বলা অনেক গল্প। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

5 মন্তব্যসমূহ

  1. খুব অল্প কথায় চমৎকার বলেছ। ওই যে আখ্যানকে শৈলী দিয়ে বুনন এর কথা বলেছ সেটির পেছনে যত মুন্সিয়ানা ততই ভাল ক্র্যাফটিং, ভাল বুনোন। আবার কেবল বুনোন ভাল কিন্তু আখ্যান মলিন, তাতে গল্প নেই, তাতেও হবে না। এমন গল্প এমন উপন্যাস লেখা হোক যা পড়ে ক'দিন ঘোরের ভেতর থাকি।

    উত্তরমুছুন