অনিন্দিতা গোস্বামী
আমি জীবনে কারো কাছে কিছু চাইনি,তবু আযাচিত ভাবে যা পেয়েছি তা বড়ো কম নয়। আমার গল্প পড়ে কখনো কেউ আমাকে দিয়েছে পুঁতির পুতুল, তো কেউ ভিড় ট্রেনে জায়গা। তবে আমি কি বলব,গল্পের কাছে আমি চাই, বসবার জায়গা? এতো গেলো মজার ছলে কথা। সত্যি কথা বলতে গেলে একজন গল্প লেখক হিসেবে আমি গল্পের কাছে কিছু চাইতে পারি কি আদৌ? আমার মতে একজন গল্প লেখক হবেন নির্লিপ্ত, নিরপেক্ষ। আউটসাইডার। তিনি দূর থেকে দেখবেন গল্পের কুশিলবরা কী করছে, কোন দিকে যাচ্ছে তার গল্পের গতি। তার এখানে কিছুই করার নেই দেখে যাওয়া ছাড়া।
তাহলে গল্পের কাছে কে চাইতে পারেন কিছু, না পাঠক। তাই এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে আমাকে একজন পাঠকের জায়গায় দাঁড়িয়ে উত্তর দিতে হবে। আর সেই জায়গা থেকে আমার একটাই কথা--বিনোদন। এন্টারটেনমেন্ট, এন্টারটেনমেন্ট এন্ড এন্টারটেনমেন্ট। এখন এই বিনোদন অনেক রকমের হয়। কেউ আনন্দ পান টাঙ্গো নাচে, কেউ বা কত্থক। কেউ শোনেন হাল্কা আধুনিক গান কেউবা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, কারো ভালো লাগে কিম কি দুকের ছবি ,কারো সত্যজিৎ। আবার কেউ আছেন সর্বগ্রাসী। সব রকম গান শুনতেই ভাল বাসেন, সে রবীন্দ্রসঙ্গীতই হোক কি নজরুলগীতি, কিম্বা আধুনিক শুধু তা ভাল হলেই হল। আমিও ঠিক সেই দলে। গল্প হলেই হলো। তবে গল্প আগে গল্প হতে হবে। যা চিত্তের বিনোদন ঘটাবে। মস্তিষ্কের পুষ্টি যোগাবে। আর তার জন্য সর্বাগ্রে চাই পাঠ্য গদ্য। স্বাদু গদ্য। যা গল্পটিকে পড়িয়ে নেবে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত। নরেন্দ্রনাথ মিত্র, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, বিমল কর, সব দিকপাল গল্পকার। তাঁরা কিন্তু প্রত্যেকেই গল্প বলেছেন। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, অমর মিত্র এঁরা কী অপূর্ব সব গল্প বলেছেন।
এখন গল্প কীরকম ভাবে বলব? খুব সহজ ভাবে বললে বলা যায় গল্প তৈরিই হয় ইমপ্রেশ্যন থেকে। যে কোনো শিল্পবস্তুই ইমপ্রেশ্যন সঞ্জাত। যিনি তুলি ধরে নিপুণভাবে ছবি আঁকছেন তিনি তো যদ্দৃষ্টং তচ্চিত্রিতং করছেন না, শিল্পীর প্রতিটি প্রাকৃতিক উপকরণ আহরণে এবং বিন্যাসে যা কাজ করে যাচ্ছে তা হল তাঁর মানসিকতা অনুযায়ী গৃহীত ইমপ্রেশ্যন। এই ইম্প্রেশ্যনের ফলেই তাঁর পাহাড়ের স্বাতন্ত্র্য এসেছে, তাঁর সমুদ্র কিংবা আকাশের বর্ণলেপ একটা নিজস্ব চরিত্র বহন করছে। ছোটগল্প সেই রকম,বস্তু আর ভাবের কেন্দ্রস্থলে তার অবস্থিতি। তাই ভালো গল্পে সংকেতময়তা একটি আবশ্যিক শর্ত। আর এই জাগাতেই তৈরি হয় সমস্যা। বাক্যে ও ভাবে সংকেতময়তা আনতে গিয়ে অনেক গল্পে অযথা জটিলতা তৈরি হয়, ফলে গল্পটি গতি হারায় আবার অতিরিক্ত ঘটনার ঘনঘটা, বা বিবরণ নির্ভরতা এক ধরনের স্থুল লৌকিক রোমাঞ্চ ,আনন্দ বা বিষাদ পরিবেশণ করতে চায়। তাই পাঠক হিসেবে আমি গল্পে একাধিক প্লটের সমাবেশ একেবারেই চাই না। পরিসরটি যেহেতু ছোট তাই ফর্ম নিয়ে অযথা কালোয়াতিও কাম্য নয়। ছোট জায়গায় অতিরিক্ত হাত পা নাড়তে গেলে সংঘর্ষের সম্ভবনা প্রবল। গল্প একটি বিষয় থেকে শুরু হয়ে একটি বিষয়েই শেষ হবে। সে যে কোনো বিষয়েই হতে পারে। হতে পারে নিরন্ন হাড়-হাভাতে পরিবারের লড়াইয়ের গল্প আবার অভিজাত পরিবারের মানুষের যন্ত্রণার গল্প। হতে পারে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক গল্প, আবার হতে পারে একটা প্রেমের গল্প। হতে পারে ফুল লতাপাতার গল্প। হতে পারে পশুপাখির গল্প। কেউ তো আমাদের জীবনের বাইরে না।
বোদল্যার বলেছেন, প্রতীকের অরণ্যের মধ্যে দিয়ে নিত্য চলেছে মানুষ। আমিও চাই কবির মতো গল্প লেখকও বস্তুময় জীবন থেকে সামগ্রী সংগ্রহ করে প্রতীকী তাৎপর্যে প্রসারিত হয়ে ব্যাপ্তি লাভ করুন। অর্থাৎ পুরো গল্পটাই হোক প্রতীকী। আর এই প্রতীকের আড়ালে লুকিয়ে থাকবে লেখকের জীবনবোধ। তবে সেটা যে খুব গুরুগম্ভীর ভাবে বলতে হবে সেটা নয়। খুব সহজ সরল গল্পের মধ্যে দিয়েও খুঁজে পাওয়া যেতে পারে এক অপূর্ব পাঠ অভিজ্ঞতা। মোট কথা বিষয়কে বহন করবে ভাষা, আবার ভাষাও হবে বিষয়ের অনুসারী। যা নেশা তৈরি করবে মাথার মধ্যে। পাঠককে একটা ঘোরের মধ্যে এনে ফেলবে প্রথম লাইন থেকেই। ব্যাস আর কিছু চাওয়ার নেই আমার গল্পের কাছে, কারণ আমি শুধু গল্পটা পড়তে চাই। আমি তাত্বিক নই। পন্ডিতও নই। গল্প যখন পড়ি তখন আমি শুধুই পাঠক।
0 মন্তব্যসমূহ