সায়ন্তনী ভট্টাচার্য'এর গল্প : মথুরমোহনের সর্বনাশ


-'আমার খুবই আনন্দ হচ্ছে! খুবই’! 

-‘কেন কেন? আনন্দ হচ্ছে কেন’? 

-‘কেন যে আনন্দ হচ্ছে তা একেবারেই বুঝতে পারছি না’। 

-‘আচ্ছা আনন্দ বলতে তুই কী বুঝিস’? 

-‘আনন্দ এমন একটা কিছু, যার আমি প্রায় কিছুই বুঝি না। অন্তত একটু আগে পর্যন্ত তাই ধারণা ছিল। কিন্তু এখন আনন্দ পাওয়ার পর বোঝা গেল যে এখন আমার যা হচ্ছে সেটাই আনন্দ’। 

-‘বহুত ভুল বকিস। এতবছর বেঁচে আছিস। সাঁইত্রিশ বছর পাঁচ মাস আট দিন, এতবছরে কোনোদিন তুই আনন্দ পাসনি, আনন্দ উপভোগ করিসনি, সেটা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়’। 

-‘আমিতো একবারও বলিনি আমি আনন্দ পাইনি। আমি শুধু ব লেছি আমি আনন্দকে বুঝিনি। সে হালকা হাওয়া হয়ে আমার চুল উড়িয়ে ফিরে গেছে, প্রজাপতি হয়ে রঙিন ডানা দেখিয়েছে, মাঝে মাঝে খুঁড়িয়ে হেঁটেছে, মাঝে মাঝে দৌড়েছে। কিন্তু আমাকে ঠিকঠাক বুঝতে দেয়নি সে কেমন, সে কে! রহস্যটা ভাঙেনি। তবে আজ আমার কাছে তার রহস্য খানিক ভেঙেছে। কিন্তু সবটা নয়। এখনো আনন্দর কোনো মানে আমি করে উঠতে পারিনি’। 

-‘উফ খুব জটিল। সব গুলিয়ে যাচ্ছে’। 

-‘আমারও। কিন্তু একইসঙ্গে আমার খুব আনন্দ হচ্ছে’। 

-‘আমি তোর আনন্দকে বোঝার চেষ্টা করতে চাই’। 

-‘স্বচ্ছন্দে। তুই না করলে আর করবে কে’? 

-‘আচ্ছা তাহলে ঝটপট আমার কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দে। এখনো তুই এই পৃথিবীর বাসিন্দা না একেবারে ভেবলে গেছিস যাচাই করি’! 

-‘বল বল’। 

-‘নাম’? 

-‘মথুরমোহন তলাপাত্র’। 

-‘কাজ’? 

-‘ভাবা’। 

-‘ভাবা? শুধু ভাবা? আর কিছু না? ভাবলে কি পেট চলে’? 

-‘পেট চলানোর জন্য কাজ করতাম একটা। প্রুফ রিডিং-এর কাজ। কলেজস্ট্রিটের পাবলিশারের কাছে। কিন্তু সেই কাজটা গেছে’। 

-‘কবে গেল’? 

-‘আজ দুপুরে’। 

-‘আজ দুপুরে কাজ গেছে, তাও তোর আনন্দ হচ্ছে’? 

-‘খুবই আনন্দ হচ্ছে’। 

-‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তুই কি ভাবছিস কাজ যাওয়াটা তোর কাছে আশির্বাদ? তুই আবার সবকিছু নতুন করে শুরু করবি’? 

-‘উঁহু, এসব কিছু ভাবছি না’। 

-‘তাহলে আনন্দ হচ্ছে কেন? এই বাজারে কাজ গেলে কারোর আনন্দ হয়’? 

-‘কাজ গেছে বলে আনন্দ হচ্ছে বলিনি তো। বলেছি আনন্দ হচ্ছে’। 

-‘তা কাজটা গেল কেন’? 

-‘ঠিকমতো প্রুফ দেখতাম না। প্রচুর ভুল থেকে যেত ছাপার পর। মালিকের দোষ নেই। এত খারাপ প্রুফ রিডারকে কেউ কাজে রাখবে না’। 

-‘তা তুই-ই বা ভালো করে প্রুফ দেখতি না কেন’? 

-‘প্রুফ দেখতে বসলেই আমার ভাবনায় পেতো। অন্যমনস্ক হয়ে যেতাম। সারাক্ষণ নিজের সঙ্গে নিজের কথা। মাথারমধ্যে আরো হাজারখানেক মথুরমোহন তলাপাত্র বসে আছে। তাদের কেউ প্রশ্ন করছে, কেউ উত্তর দিচ্ছে, কেউ তলোয়ার চালাচ্ছে, কেউ গঙ্গায় ঝাঁপ দিচ্ছে। সারাক্ষণ কিচিরমিচির কিচিরমিচির। ফলে মাথা প্রুফ দেখায় মন দিতো না’। 

-‘মাথা মন দিতো না’? 

-‘একেবারে দিতো না। মাথা বড় বদ’। 

-‘তো কাজ যাওয়ার পর কী করলি’? 

-‘বড় বড় সাইজের বেগুনী ভাজে, কলেজস্ট্রিটের চপের দোকান, একবার খেলে হা বেগুনী হা বেগুনী বলে হেঁদিয়ে মরতে হবে। তো সেই বেগুনী খেলাম খান চারেক, মুড়ি দিয়ে। তারপর ট্রামলাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি চলে এলাম’। 

-‘এটাকে তুই বাড়ি বলিস? একটা ঝুরঝুরে, বিপজ্জনক নোটিশ টানানো পাঁচতলা বাড়ির চিলেকোঠার ঘর, ফুটিফাটা মেঝে, মাঝখানে খাটিয়া, একপাশে পায়া ভাঙা টেবিল, ঢকঢকে চেয়ার, মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত খরখরি তোলা জানলা, ঘরে রাজ্যের ধুলো, ঝুলকালি, খাটের তলায় স্টোভ ঢোকানো, মাঝে মাঝে সেটায় চা করে খাস, এছাড়া আর রান্নার ব্যবস্থা নেই, আলনার কোণায় এখনো তিনটে বাচ্চা ইঁদুর মরে শুকিয়ে আছে, আলমারি নেই, ট্রাঙ্ক আছে, ট্রাঙ্কে তোর মায়ের বিয়ের ছেঁড়া বেনারসি, বাবার ধুতি পাঞ্জাবি, কয়েকটা ফটো অ্যালবাম, চারটে কাঁসার থালা আর পাঁচটা বাটি আর তোর কলেজের বইপত্র। একে তুই বাড়ি বলিস’? 

-‘আশ্চর্য, এখানে আমি থাকি। বাড়ি নয়তো কী বলব আর? পশ্চিমদিকের জানলা খুললে হাওড়া ব্রিজ আর গঙ্গা দেখা যায়, তারপর ছানার পট্টি, শাড়ির দোকান, আলুকাবলি-কাটা ফল-ফুচকা-ঘুঘনির হকার, চাবিওয়ালা, ট্রাফিক পুলিশ, ট্রাম-বাস-লোকজন, মুটে-মজুর-অফিসবাবু, তারপর পূর্ণিমাতে ব্রিজের ওপর চাঁদ, তারপর কবিতা-গল্প-উপন্যাসের এই যে আমার বই, যেগুলো ইঁদুরের থেকে বাঁচাতে আমাকে কত কষ্ট করতে হয়, টেবিলের ওপর মা-বাবার ছবি, তারপর একতলার বারোয়ারি বাথরুম, শ্যাওলা-উঠোন, পোস্তার দিকের দাঁড়িয়ে থাকা লরি, আমার ঘরের এই ভাঙা আয়না, ইস্ত্রি না করা আমার শার্ট, রঙ-ওঠা জিন্স, ইচ্ছে করে না বলে না কামানো দাড়ি, পাইস হোটেলের রাঁধুনি ময়নার মা, জীবন... এসব কিছু নিয়েই তো আমার থাকা। আর আমার থাকা মানেই আমার বাড়ি। এই চিলেকোঠার ছেঁড়া ঘরটা আমার বাড়ি’। 

-‘আচ্ছা বুঝলাম। তো তুই এই বাড়িতে আনন্দ নিয়ে ফিরলি’? 

-‘হুঁ। তখন শুধু একটা ভালোলাগার ঢেঁকুর উঠছে। তখনো আমি বুঝিনি আনন্দ ঢুকে পড়ছে। তাকে আটকানো যাবে না’। 

-‘আনন্দ আটকাবিই বা কেন? এরকম কেউ করে নাকি’? 

-‘মাম্পি তো তাই বলতো! বলতো আমি নাকি আনন্দ আটকে রাখি, জোর করে বিষাদ ঢোকাই, তাতে আমার ভাবতে সুবিধা হয়। আর না ভাবলে আমি থাকতে পারি না। না ভাবলে আমি মরেই যাব’। 

-‘মাম্পি কোথায়? কাজ যাওয়ার পর বেগুনী না খেয়ে তো মাম্পির সঙ্গে দেখা করলেই পারতি’। 

-‘মাম্পির তো কাল বিয়ে হয়ে গেলো। শ্বশুরবাড়ি বাগনান। এতক্ষণে বাগনান পৌঁছে গেছে’? 

-‘বিয়ে হয়ে গেল? মানেটা কী’? 

-“আরে আমিও জানতাম না। কাল হঠাৎ সন্ধেবেলা ফোন করে বললো, ‘দ্যাখো তোমার সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখতে পারছি না। তোমার তো কোনো ভবিষ্যত নেই। তাই আমি কাল বিয়ে করছি। অবশ্য আগে থেকেই সব আয়োজন চলছিল। তোমাকে জানাতে আমি একটু দেরি করলাম। এটা আমার প্রতিশোধ। শ্বশুরবাড়ি বাগনান। তুমি কাল নেমন্তন্ন খেতে এসো’। বুঝলি কিনা”! 

-‘তোর সঙ্গে এই মেয়েটার সাত-আট বছরের সম্পর্ক আর তুই এত নির্বিকার মুখে এসব বলতে পারছিস? তুই কি জানিস, কেউ তোকে ভালোবাসলো আর তারপর কোনো কারণে ছেড়ে চলে গেল, যেদিন থেকে সে ছেড়ে গেলো সেদিন থেকে যতদিন তুই বেঁচে থাকবি, প্রতিটা দিন এক লক্ষ বছরের সমান? তারপরও নিশ্চয়ই তুই নেমন্তন্ন খেতে গেছিলি’? 

-‘এত করে বলল, না গিয়ে পারি? বিরিয়ানি খেয়েছি কদ্দিন পর। দারুণ বানিয়েছিল’। 

-‘উফ, তুই আমাকে পাগল করে দিবি। এসবের পরেও তোর আনন্দ হচ্ছে’? 

-‘আচ্ছা আনন্দ হলে আমি কী করব বলতো? দ্যাখ দ্যাখ, কলকাতা ঘুমিয়ে পড়েছে। হাওড়াব্রিজের মাথায় থালার মতো চাঁদ উঠেছে। মনে হচ্ছে চারদিকে কত অক্সিজেন’। 

-‘পলিউশন। অক্সিজেন নেই’। 

-‘তুই ভুল জানিস। অক্সিজেন। আমি জানি’। 

-‘কাজ নেই, কাল কী খাবি জানা নেই, প্রেমিকা নেই, আত্মীয় নেই, বিশ্রী একটা বাড়ির, খারাপ একটা ঘরে থাকিস, তাও আনন্দ? মানেটা কি’? 

-‘মানে জানি না। তুই যা, পান্তা আর কাঁচালংকা নিয়ে আয়। দ্যাখ টেবিলের ওপর ঢাকা দেওয়া আছে’। 

-‘আমি কী করে যাব? আমিতো তোর ছায়া। তুই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছিস আর আমি আয়না-মানুষ হয়ে তোকে দেখছি’। 

-‘ঠিক, তাও ঠিক। ঠিকাছে, আমিই পান্তা ভাত নিয়ে আসছি। তারপর খাব। তারপর তোকে ভ্যানিশ করে দেব। তুই আনন্দর পেছনে লজিক খুঁজছিস। আচ্ছা গাধা’। 

আয়নার মথুরমোহন এসব শুনে একটু হাসলো। ততক্ষণে মথুরমোহন পান্তা নিয়ে এসেছে। সঙ্গে একখানা পেঁয়াজ আর পাঁচটা কাঁচালংকা, লেবু, নুন। 

-‘এতগুলো লংকা তুই খাবি’? 

-‘খাবো না মানে? অবশ্যই খাবো’। 

-‘বেলডাঙার লংকা, খুব ঝাল’। 

-‘হিহিহি, তাতে কী’! 

মথুরমোহন লেবু চটকে পান্তা মাখে, পেঁয়াজ আর কাঁচালংকায় কামড় দিয়ে হুশহাশ পান্তা খায়। উফ তার খুব ক্ষিদে পেয়েছে। লংকার ঝালে মথুরমোহনের চোখ থেকে জল গড়ায়, বুক জ্বলে, নাক টানে থেকে থেকে। মুখের হাসি আরো চওড়া হতে থাকে। 

-‘এত ঝালেও তুই হাসছিস মথুরমোহন, এত জ্ল, এত জ্বালাতেও তুই হাসছিস’? 

-‘আমার যে খুব আনন্দ হচ্ছে। খুব আনন্দ’। 

মথুরমোহনের আয়নার ভেতর থেকে অন্য মথুরমোহন ভ্যানিশ হয়ে যায় আর পান্তা খেতে খেতে মথুরমোহন টের পায় তার আনন্দরা ভাঙা শহরের ভাঙা ঘরে চাঁদের আলো হয়ে লাফঝাঁফ করছে। মথুরমোহনের খুউউব আনন্দ হয়। আনন্দ সে ধরে রাখতে পারে না। 



সায়ন্তনী ভট্টাচার্য 
গল্পকার। 
পশ্চিমবঙ্গ


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ