গল্পের কাছে কী চাই : মৌসুমী কাদের





আমরা মানুষ যত বেশী পৃথিবীর নিকটাত্বীয় হচ্ছি ততই যেন বিশ্ব আমাদের খেয়ে ফেলছে। গল্পের কাছে কি চাই? এর উত্তরটা একটা সরলরেখায় আর দেয়া যাচ্ছে না। আগে যেমন বলা হতো, সূক্ষ্ম চরিত্রগঠন, ভাষা, কাঠামো, শব্দ, ইত্যাদির সংমিশ্রণে একটা ঠাস বুনোটের গল্পই শুধু চাই। কিন্তু এখন কথাটা একটু বদলে গেছে। এখন বলতে হচ্ছে গল্প শুধুই কাহিনী বলা নয়, শুধুই আখ্যান রচনা নয়, শুধুই চরিত্র সৃষ্টি নয়। গল্প একটি বিশিষ্ট সাহিত্যরূপ। আবার এটাও অস্বীকার করা যাচ্ছে না যে বিশ্বায়ন, বিশ্বসাহিত্য, প্রকৃতি, সব কিছুই যেন এই সাহিত্যরূপটিকে বদলে দিচ্ছে। গল্পের কাছে আমাদের মাত্রাহীন আশা বেড়ে গেছে। সরলের ভেতর আশ্চর্য একটু গরল ঢুকে না পড়লে গল্পের বৈচিত্রতা নিয়ে আমরা প্রশ্ন তুলছি। 

শৈশবে আমার এক বন্ধু একবার একটা পাঁচশ টাকার নোট বাবার মানিব্যাগ থেকে মেরে দিয়েছিল। তারপর সেটি হজম করতে না পেরে কুচি কুচি করে গাছের তলায় পুতে রেখেছিল। বন্ধুর বাবা গাছের গুড়িতে লাঙল দি্তে গিয়ে সেই টাকার কুচি আবিষ্কার করেছিলেন। যতই তিনি মাটি খুঁড়ছিলেন ততই টাকার কুচি বাড়ছিল। একটা পাঁচশ টাকার নোট থেকে কত হাজার টাকার কুচি যে বেরিয়েছিল! গল্পের অবস্থাটা হয়েছে এখন অনেকটাই সেরকমই। পাঁচশ টাকার নোটটিকে যাদু করতে না জানলে লক্ষ টাকার দাম পাওয়া যাবে না। এবং সেই দাম হতে হবে বাজার দরে, রূপে রসে, গুণে। 

সমাজ, যুদ্ধ, রাজনীতি, ধর্ম, ইতিহাস, দেশভাগ, ভাষা, শহর-গ্রাম, ষড়ঋতু, উচ্ছেদিত-নির্বাসিত-অভিবাসী মানুষ, ভূমি থেকে প্রান্তিক মানুষ, স্মৃতি-বিস্মৃতি, জাতবৈষম্য...কত কিছুইতো গল্পের বিষয় হতে পারে। আবার একটি ছোট্ট মেয়ের কোমল অনুভূতি নিয়েও গল্প হয়। বিষয় যাই হোক না কেন, গল্পের কাছে আমি একটি সরল গতি চাই। কতটুকু বিশদে লিখতে হবে সেই কৌশলটিও চাই। চরিত্রগুলোর নিখুঁত বিশ্লেষণ চাই, টান টান উত্তেজনা চাই। গল্পগুলো তখনই গল্প হবে যখন সেটি পাঠকের মনের গভীরে আবদ্ধ হবে। সেলাই মেশিনে জামার হাতা লাগিয়ে ফেললেই সেটি জামা হয় না। অন্যান্য অংশগুলো জুড়ে দিয়ে পাইপিন ঠিক না করা পর্যন্ত, বা বোতামগুলো না লাগানো পর্যন্ত স্টাইলটা ঠিক বোঝা যায় না। তারপরও পোশাকটি পরে আরামবোধ হচ্ছে কিনা সেই প্রশ্নটিও থেকে যায়। গল্পের কাছে আমার চাওয়াটাও সেইরকম। 

অনেক বিখ্যাত লেখক আছেন যাদের মুখে আজকাল শুনছি, তারা গল্পের শেষে কোন পরিণতি রেখে যেতে চান না। অর্থাৎ গল্প হবে ওপেন এন্ডেড। পাঠকের মাথা ঘামিয়ে পরিণতি খুঁজে বের করে নিতে হবে। গল্পকার হিসেবে আমি যেমন কষ্ট করে গল্প লিখছি পাঠকেরও উচিত হবে সম পরিমান কষ্ট করে গল্পটি বুঝে নেয়া। গল্পের দায় কেবল লেখকের একার নয় পাঠকেরও। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, পাঠকের কোনই দায়ই নেই। পাঠক কেবলমাত্র গল্পটি ভাল লাগলেই পড়বে, নতুবা নয়। পাঠককে গল্পটি ভাল লাগানোর দায়িত্ব গল্পকারের। কিন্তু সেটা কতটুকু বা কীভাবে তিনি করবেন সেটিও অবশ্যই একটি শিক্ষণ প্রক্রিয়া। কাজেই পাঠক এবং গল্পকারের লড়াইটি বরাবরই জটিল ছিল এবং এখনও আছে। এবং এটাই বাস্তব। 

আমরা যারা প্রবাসে সাহিত্য চর্চা করি তাঁদের অবস্থানগত বিষয়টি ছাড়া সাহিত্যের মূলগত কোন পার্থক্য নেই। কিন্তু গুণগত একটা যোগ আছে। স্মৃতিতে, অবচেতনে প্রতিনিয়ত আমরা স্বদেশকে বহন করি। গল্পে যদি দেশ ছেড়ে আসার বা এই বিচ্যুতি-অনুপস্থিতির বিষয়টিই কেবলমাত্র না এসে অভিবাসী জীবনের বৈচিত্র‍্যগুলোও তুলে ধরা হয় তাহলে বোধহয় আরো বেশী নতুনত্ব তৈরী হয়। যেমন ধরুন আমেরিকার আপেল বাগানে ঘুরতে গিয়ে আমি যখন দেশের পেয়ারা বাগানের স্বাদ পাই তখন শুধুইমাত্র স্মৃতিকাতর না হয়ে পড়ে ভিনদেশী হিসেবে আপেলবাগানে আমার যে নতুন অভিজ্ঞতা সেটি উপভোগ্য করে লিখতে পারি। গল্পেরতো কোন দেশ নেই। গল্পতো গল্পই। 

আবার যারা আশেপাশের চেনা জগৎ থেকে কাহিনী নিয়ে গল্প লেখেন তাদের চ্যালেঞ্জ হলো, এই পরিচিত চরিত্রগুলোকে একদম অচেনা করে তুলে ধরা। আমি অনেক বন্ধুর গল্পে দেখি চরিত্রগুলোতে তাদের পরিবারের লোকজন ঢুকে গেছে। আমি চিনতে পারছি। নামটা শুধু আলাদা বা জেন্ডারটা বদলে গেছে। আবার কথা সাহিত্যিক দীপেন ভট্টাচার্যকে দেখি মুক্তিযুদ্ধকে মাথায় রেখেই এমন কিছু কল্পকাহিনী তৈরী করছেন যেখানে নতুন একটি জগৎ তৈরী হচ্ছে। নতুন সময়, নতুন কাহিনী, ভিন্ন উপস্থাপন এবং এ কারণেই গল্পকার হিসেবে তিনিও ভিন্ন। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

4 মন্তব্যসমূহ

  1. এ কথাটি আমারও মনে হয় আপা, পাঠকের কোনো দায় নেই। চমৎকার লিখেছেন। ভাবনার খোরাক দেয় এমন লেখা।

    উত্তরমুছুন
  2. ধন্যবাদ সাদিয়া। আমার সবসময়ই মনে হয়, পাঠক কি দস্তখত দিয়ে বলেছে যে সে এই লেখাটি পড়তে চায়? তাকে পড়বার মতন যোগানতো লেখককে দিতে হবে! অনেক অনেক ধন্যবাদ মন্তব্য করার জন্য।

    উত্তরমুছুন
  3. ভালো লিখেছেন,, পাঠকের আবার দায় কিসের,,,

    উত্তরমুছুন
  4. খুব ভালো লাগলো আপা।

    উত্তরমুছুন